একটি আধপোড়া বিড়ির জন্যে
একটি আধপোড়া বিড়ির জন্যে
লম্বু, শ্রীনিবাস,রাজেশ,মোহন,রামবাবু,শ্যামবাবু,আর রোহিত সকলেই পর পর লাইন দিয়ে নিজেদের থালা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটাই যেন বুফে সিস্টেমের মতো ব্যাপার। তবে এরপর অবশ্য সকলেই সারিবদ্ধ ভাবে এসে ডাইনিং স্পেসের লম্বা টেবিলেই নিজেদের থালাগুলো রেখে এক একটা চেয়ার দখল করে খেতে বসেছিল রোজকার মতো।
গল্প করতে করতে সকলেই খাচ্ছে। আজ সব পদ গুলোই নিরামিষ। কাঁটা বাছার কোনো ব্যাপার নেই।
আসলে ছুটিতে ওরা এবার কেউই বাড়ি যায় নি। এখন নবরাত্রি চলছে। হোস্টেলের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা চলে গেছে বলে এখন হোস্টেলে ভিড় নেই মোটেও।
আরো কিছু স্টুডেন্টদের দেখাদেখি ওরাও থাকবে বলে সুপারের কাছে আবেদন করেছিলো, ছুটিতে হস্টেলে থাকার জন্যে। প্রথমে সুপার রাজি হননি। ফাইনাল এক্সাম এর প্রিপারেশনের কথা বলে কয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো হয়েছে ওনাকে।
আসলে ওদের বন্ধুত্বের একসাথে থাকার এটাই তো
শেষ সুযোগ! এরপর তো কর্মজীবনে প্রবেশ । সংসার ধর্ম পালন, বিয়ে থা, সন্তান । আর তো এমন ভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করা যাবেনা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসার আগে কল্পনাও করতে পারেনি যে বছরগুলো এমন হুড়হুড় করে কেটে যাবে। অজানা অচেনা কতগুলো ছেলে এমন প্রাণের বন্ধু হবে যে তাদের ছেড়ে ছুটিতে বাড়ি যেতেও ইচ্ছে হবে না।
এমনকি লাজুক টাইপের রামবাবু-শ্যামবাবুও ওদের পাল্লায় পড়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে গেছে। হরদম হিন্দিতে কথা বলতে পারে। সহজেই জোকস বুঝতে পারে।
খেতে খেতে লম্বু রোহিতকে লক্ষ করে চিৎকার করে ওঠে,
"আবে মচ্ছর, দেখ্ ইধার, খানে পে কেয়া দেতে হ্যায় ইয়ে লোগ"
শুধু রোহিত নয়, লম্বুর চিৎকার শুনে সকলেই নিজের খাবার ছেড়ে উঠে আসে লম্বুর কাছে। সকলেরই কৌতুহল চরমে। কি এমন জিনিস পড়েছে ওর পাতে যে লম্বুর মতো ছেলে এভাবে চিৎকার করে উঠল!
শ্যামবাবু রামবাবুকে খাস বাংলায় বলে ওঠে,
"আরে এটা তো একটা আধপোড়া বিড়ির টুকরো!"
শ্যামবাবুও রসিকতা করতে ছাড়ে না। বলে ওঠে,
"আর যাই হোক, আমিষ তো নয় ! পুরো ভেজ ।"
এই ভেজ মানে যে নিরামিষ সেটা প্রায় সকলেই জানে তাই প্রথমে একচোট হেসে নেয় বটে! কিন্তু তারপর একযোগে সকলের মাথায় যেন রক্ত উঠে যায়। একি অনাসৃষ্টি কান্ড ! খাবারের মধ্যে এমন নোংরা ব্যাপার কেন! ওড়িয়া ঠাকুরেরা রয়েছে এখন কাজে। একজন বেশ মোটাসোটা আর ফর্সা যে কি না হেড ঠাকুর বা বড়া ঠাকুর। আর রোগা মতন কালো লোকটা তার সাগরেদ ছোটা ঠাকুর। কার কীর্তি কে জানে ! হয়তো দুজনেই রান্নার ফাঁকে বিড়ি ফুঁকছিল !
অর্ধেকের বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যিস ! আর খেতে ইচ্ছে হয়না কারো। খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে সকলেই। রওনা দেয় সুপারিনটেনডেন্টের ঘরের উদ্দেশ্যে। সকলের আগে মচ্ছর । হাতে ওর লম্বুর ঐ থালা যেখানে অড়হঢ় ডালের মধ্যে বিড়ির পোড়া টুকরোটি ভাসছে। থালা গুলোতে বাটির মতো তিনটে গর্ত করা আছে বলেই সহজেই দেখা যাচ্ছে, ডালের ওপরে যেন মনের সুখে সাঁতার কাটছে আধপোড়া বিড়ি। অন্য দুটো গর্তের একটাতে কয়েক টুকরো আলুভাজা লেগে রয়েছে তখনও, আরেকটা গর্তে খানিকটা পাঁচমিশালি সবজি যেন ঘটনাটার সাক্ষী দিতে সঙ্গে চলেছে।
না, খুব বেশি কথা ওদের বলতে হয়নি। সুপার মচ্ছরের হাতের থালাটার দিকে আর ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে লজ্জা আর রাগ চেপে রেখে বলেছিলেন,
"ওকে, আই উইল টেক এ্যাকশন।"
তাদের দুষ্কর্মের ফল ভুগতে হয়েছিলো ছোটা আর বড়া দুই ঠাকুরকেই। কেউ ছাড় পায়নি। রাতে খাবার পরিবেশনের আগেই কাঁচুমাচু মুখে হাত জোর করে মাপ চাইতে এসেছিলো ওদের কাছে। কথা দিয়েছিল রান্নার কাজের সময় আর কখনো বিড়ি খাবে না।
ওরা দয়া না করলে ওনাদের চাকরি চলে যাবে সামান্য ঐ একটা আধপোড়া বিড়ির জন্যে।
ছোটা আর বড়া ঠাকুরের তখনকার অবস্থা মনে পড়লে এই মাঝবয়েসে এসেও ওদের বন্ধুদের কাউকে না কাউকে ভিডিও কল না করলে চলে না। তারপর কিছুক্ষণ চলে এসব কথা নিয়ে হাসাহাসি।
এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের ওদের ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ নিজেদের বন্ধুদের সাথে পর্যন্ত এই গল্পটা করে চলেছে !
