Sangita Duary

Abstract Romance Classics

4.2  

Sangita Duary

Abstract Romance Classics

একটা সরি

একটা সরি

5 mins
452


ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখটা কুঁচকে নিলেন বিদ্যুৎ। ইশ! ঠান্ডা হয়ে গেল যে!

এই হাড়কাঁপানো শীতে এরকম ঠান্ডা চায়ের থেকে বরং উচ্ছের রস খাওয়া ভালো, সুগার'টা অন্তত কন্ট্রোলে থাকে!

গলার মাফলারটা আরো এঁটে একবার উঁকি দিলেন রান্নাঘরে। স্বপ্না ইতিমধ্যেই তিনবার চা করে দিয়েছেন। এবারে আবার গরম করে দিতে বললে ওই গরম খুন্তির ছ্যাঁকা পিঠে পড়লেও পড়তে পারে।

কোনরকমে ঠান্ডা চা'টা গলায় ঢেলে কাপটা সশব্দে প্লেটে নামিয়ে রাখলেন।

খবরের কাগজটা খুলতে না খুলতেই বান্টির জুতোর আওয়াজ। সোফায় বসে ডাক দিল," মা কফি দিও!"

মাথা নিচু করে চুলের মুঠি খামচে বসে রয়েছে বান্টি।

কাল রাতেও ঝগড়া করছিল। পাশের ঘর থেকে দিব্যি গলার আওয়াজ পেয়েছিলেন বিদ্যুৎ।

অথচ কয়েকদিন আগে পর্যন্তও সারাদিন ফোন কানে হাহা হেসে চলত।

কিছুতেই বুঝতে পারেননা বিদ্যুৎ, আজকালকার ছেলে মেয়েদের এত কিসের কথা থাকে আর এতই বা কিসের ঝগড়া থাকে!

কিন্তু পরীর গলা শুনে তো তেমন কিছু মনে হলো না!

যেমন রোজ সকালে সাতটায় ফোন করে বিদ্যুৎকে গুড মর্নিং জানায় তেমনিই জানিয়েছে!

আসলে সব দোষ বান্টির। পরী যথেষ্ট ভালো মেয়ে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। ওর মতো মেয়ে যেচে এই বাঁদরটার সাথে কক্ষনো ঝগড়া করতে পারে না।

নিজের ছেলেকে হাড়ে হাড়ে চেনেন বিদ্যুৎ। জেদি, একগুঁয়ে, ছোটবেলা থেকে যেটা চাই তো সেটাই চাই।

একবার বিদ্যুৎএর পার্কার পেনটা নেবে বলে টানা একঘন্টা কেঁদেছিল। তখন কতই বা বয়স বান্টির, দশ!


স্বপ্না টেবিলে ব্রেকফাস্ট রেখে গেছেন।

বান্টি সেসব ছুঁলো না। কফিটা খেয়ে উঠে যাচ্ছিল। স্বপ্না রে রে করে দৌড়ে এলেন, "কী শুরু করেছিস তুই? কাল রাতেও খেলি না...!"

মায়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে গটগট বেরিয়ে গেল বান্টি।


**********************


ফোনটা পেয়ে একমুহূর্ত দেরি করেনি পরমা।

বিদ্যুৎ ঘোষ বান্টির বাবা হতে পারেন কিন্তু তার কাছেও বাবার কম কিছু নন।

সেই ছোটবেলায় যখন দাদুর হাত ধরে বান্টিদের বাড়ি যেত আর বিদ্যুৎ আঙ্কেল এত্তো এতো চকোলেট দিয়ে বলতেন, "বড় হলে কিন্তু সব উসুল করে নেব তোকে আমার বাড়িতে লক্ষ্মী করে নিয়ে এসে!" তখন সেই বয়সে পরমা অতশত না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল বান্টি একটা আস্ত হনুমান হলেও আঙ্কেল আন্টি তাকে খুব ভালোবাসেন।

আজ এক্ষুণি যখন আন্টি ফোন করে বললেন, সেই আঙ্কেলেরই হঠাৎ শরীর খারাপ হয়েছে তখন পরমা কি চুপ করে বসে থাকতে পারে?


বান্টিদের ড্রইংরুমে পা দিয়েই পরমা অবাক। আন্টি কড়াইশুঁটি ছাড়াচ্ছেন আর আঙ্কেল দিব্যি কাগজ পড়ছেন।

দুচোখে বিস্ময় মেখে পরমা এগিয়ে গেল ওঁদের দিকে, "আঙ্কেল তোমার...!"

বিদ্যুৎ কাগজ বন্ধ করেন, "কী আমার? কী? আমার কিস্যুটি হয়নি। তবে হ্যাঁ, এটুকু বুঝতে পারছি, তোর আর ওই বাঁদরটার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। আর তোরা যদি এমন শুকনো শুকনো মুখ আর ফোলা ফোলা চোখ করে ঘুরে বেড়াস, তাহলে আমার নির্ঘাত কিছু একটা হতেই পারে যখন তখন।"

বিদ্যুৎ পরমার মাথায় হাত রাখে, "কী হয়েছে পরী? আমায় বল। কী নিয়ে রোজ রাতে এত ঝগড়া করিস তোরা?"

পরমা বলে, "ঝগড়া আমি করিনা আঙ্কেল, করে তোমার ছেলে। ওকে ভালোবাসি বলে কি ও আমার মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? গেল সপ্তাহে কলেজে আমার সেমিস্টার ছিল। পরীক্ষার পরেও ফোন অন করা হয়নি। জানো, সোজা আমাদের বাড়ি চলে গিয়েছিল! গিয়ে সে কী চেঁচামেচি!

তারপর পরশু, রাঙ্গাদির দেওর এসেছিলো বাড়িতে। আমার সাথে বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয়ে গিয়েছিল, দুজনে একসাথে ফিরছিলাম। সেটা নিয়েই ইস্যু! বলো তোমরা, ও ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে পারবো না?"

*********************


অন্ধকারে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিলো বান্টি।

পরীর এখনো এত জেদ! হ্যাঁ, বান্টিই ওই কে যেন রাঙ্গাদির দেওরকে পরীর সাথে দেখে রিয়াক্ট করেছে। বেশ করেছে। সে ছাড়া অন্য কেউ পরীর পাশে বসবে কেন? পরীই বা তখন তার ফোনটা ধরলো না কেন?

বান্টির ভালোবাসার কোনো প্রায়োরিটি নেই তার কাছে?

এইযে দুটো দিন দেখা নেই, ভালোভাবে কথা বলা নেই, কই সে নিজে যেচে তো একবারও ফোন করছে না! সরি বলছে না!

চোখ ফেটে কান্না আসছে বান্টির। ছোটবেলার দিনগুলোই ভালো ছিলো। ভালোবাসা কী, জানা ছিল না। অধিকার কী, বুঝতে পারা যেত না!

যবে থেকে জানলো, সে সত্যি সত্যিই পরমাকে ভালোবেসে ফেলেছে, একটা তীব্র অধিকারবোধ বান্টিকে গ্রাস করে ফেলেছে। পরমা কেন বোঝেনা, যে বান্টি কখনোই তার পরীকে কারোর সাথে শেয়ার করতে পারবে না?

চোখদুটো বড্ড জ্বালা করছে। বান্টি ফোনটা তুলে নেয়। পরমার নম্বর ডায়াল করে। আর নয়, এবার সে নিজে থেকে সরি চেয়ে নেবে। আর ঝগড়া ভাল্লাগছে না। কতদিন পরীর হাসি শোনেনি, আহ্লাদী মুখটা দেখেনি, ভালোবাসেনি!

পরীর ফোন বন্ধ বলছে।

একবার, দুইবার, তিনবার, প্রতিবারই বন্ধ বলছে।

বান্টি পরমার মার নম্বরে ফোন করে, দেবিকা বলেন, "পরী তো কিছুক্ষন আগেই বেরোলো। বললো ফিরতে দেরি হবে!"

ওর্থলেস!

বান্টি পরমার বাবাকে ফোনে ধরে, তিনিও তো অফিসে।

খুব অসহায় লাগছে এবার। কোথায় গেছে পরী?

ফোনটা বন্ধই বা করে রেখেছে কেন?

আবার সেই পাগল পাগল ভাবটা ফিরে আসছে মনের মধ্যে। মাথার ভিতর সব যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। পরী ঠিক আছে তো?

আজকাল রাস্তাঘাটের যা অবস্থা!পরীকে একা কোথাও ছাড়তে বড্ড ভয় করে বান্টির।

কিন্তু পরী এখন কোথায়? 

কী অবস্থায় আছে সে? ফোনটাই বা বন্ধ কেন?

কী করবে এখন?

কী করবে বান্টি?

ঘর থেকে বেরোতে যাবে হঠাৎ, পিঠে একটা স্পর্শ।

ঘরের আলো জ্বললো। পরমা!

বান্টি জড়িয়ে ধরে পরমাকে, "ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিস কেন? জানিস না, তোকে নিয়ে আমি কতটা ওরিড?"

পরমা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, ''ওরিড যখন, তখন ঝগড়া করা কেন? আর না খেয়ে থাকাটাই বা কেন? ঘ্যাম সরিয়ে একটা সরি বলে দিলেই তো মিটে যায়।"

বিদ্যুৎ স্বপ্না ঘরে এসে ঢুকেছেন।

বিদ্যুৎ ছেলের কাঁধে হাত রাখেন, "দেখ, সম্পর্ক ঠিক জলের মতো, যেই পাত্রে রাখবি তেমনি আকার নেবে। আবার বন্ধ বোতলে চাপ দে, ছিপি খুলে বেরিয়ে পড়বে।

পরী যদি অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বলে, মেশে, কী ক্ষতি? তুই না আজকের ছেলে? ভালোবাসার প্রতি এতটুকু বিশ্বাস নেই? নে সরি বল।"

বান্টি চোখ নিচু করে, "হ্যাঁ আমি ওভার রিয়াক্ট করেছি, মানছি। করেছি কারণ আই লাভ হার। ও যদি নিজেই একটা সরি বলে নিত সেদিন তাহলে তো আর... আর আজকেই বা ও ফোন বন্ধ করে রেখেছিল কেন? ওর জন্য আমার চিন্তা হয়না নাকি?"

পরমা তেড়ে আসে, "ওয়েট ওয়েট, আমি কেন সরি বলবো? আঙ্কেল, আন্টি, তোমরাই বলো, আমার দোষ ছিল?"

এবার স্বপ্না মৃদু হাসেন, "দেখ, দোষ যেই করুক, কষ্ট যখন দুজনেই পাবি, তখন একজন কেউ এগিয়ে এসে সরি বললেই তো মিটে যায়। তোরা দুজন কি আলাদা?

এই যে আমাদের, চব্বিশ বছর হতে চললো, কী ভাবিস, ঝগড়া হয়নি? রাগ হয়নি? 

হয়েছে। আবার মিটেও গেছে। যেই দোষী হোক না কেন আমরা সেই অভিমানকে, সেই রাগটাকে কখনো বাসি হতে দিইনি।

মনে রাখিস, ভালোবাসায় যখনই ইগো চলে আসে তখনই ভালোবাসার মৃত্যু হয়।

এবার দুজন দুজনকে সরি বলো দেখি। আর আজ থেকে নো ঝগড়া!"

বেরিয়ে যাওয়ার আগে স্বপ্না বিদ্যুৎকে টানেন, "চলো চলো, কচুরি গুলো বেলে দেবে চলো তো!"

যাওয়ার আগে বিদ্যুৎ বলেন, "দেখ দেখ, কেমন খাটাচ্ছে দেখেছিস? তবুও আমি রাগ করিনা। কেন বল তো? কারণ আমি জানি, আমি ভালোবাসি বলেই না এই শীতে প্রতি সপ্তাহে আমার গিন্নি কড়াইশুঁটির কচুরি বানায় আমার জন্য!"


বাবামা বেরিয়ে যেতেই বান্টি দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। 

এক ঝটকায় পরমাকে বুকে টেনে নেয়। কানে কানে বলে, "দেখলি তো, এখনো বাবা মার কত প্রেম! আর তুই খালি আমায় ভুল বুঝিস, রাগ দেখাস!"

পরমা বান্টির কান টেনে ধরে, " দেখাবই তো। আগে সরি বল!"

বান্টি পরমার ঘাড়ে নাক ঘষে দিয়ে বলে... আই লাভ ইউ!!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract