দুর্ঘটনা
দুর্ঘটনা
‘রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তার মন্দির!'
জামাই এর ঘোষণা শুনে আমার মা একটু নড়ে চড়ে বসলেন। আমার বিষন্ন মুখে ছোট একটু হাসির রেখা দেখে কর্তা বললেন, কি, পছন্দ হল না?’
বিয়ের পরে প্রথম বার পুজো- কালীপুজো কোনোটাই কলকাতায় কাটানো গেল না। সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে পুজোর আগেই রাঁচি ফিরতে হল। সঙ্গে ছোট বোন এসেছিল, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মা এসেছেন। মা আসাতে একটু ভালো লাগছিল, কিন্তু মাকেও তো ফিরে যেতে হবে- কালীপুজোর পরেই মার স্কুল খুলে যাবে।
তখনও সত্যজিত রায়ের সদ্য প্রকাশিত ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ আমার হাতে আসেনি। ফেলুদাও এত লাইম লাইটে আসেননি। ছিন্নমস্তার মন্দির সম্মন্ধে কোন আইডিয়াই ছিল না। পিকনিকের গন্ধে সকলের মধ্যেই আলোড়ন দেখা গেল, কলকাতার কালীপুজো মিস করার দুঃখটা একটু হলেও কম হলো। আমাদের বন্ধু সঞ্জয়দা আর মধুপাকেও আমন্ত্রণ জানানো হল, সঙ্গী হওয়ার জন্যে।
রাঁচি থেকে প্রায় শ’ খানেক কিলোমিটার দূরে রাজরাপ্পায় ছিন্নমস্তার মন্দির একটি শক্তিপীঠ। মা সেখানে ‘প্রচন্ড চণ্ডী’ নামে প্রসিদ্ধ। প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারলাম, রাজরাপ্পার সিনিক বিউটি অসাধারণ। এইবার আমার মধ্যে ‘যোশের’ সঞ্চার হল। মা থাকাতে রান্নাঘর নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই, কাজেই প্রবল উৎসাহে জল্পনা- কল্পনা চলতে থাকল। একটাই দুশ্চিন্তা, কালীপুজোতে নাকি প্রচুর বলি পড়ে সেখানে। পুজোর এই প্রথা আমার একদমই পছন্দ নয়, কিন্তু বলি বন্ধ করার সামর্থ্যও তো আমার নেই... যাকগে, দূরে থাকলেই হবে।
রাঁচিতে শীত পড়তে শুরু হয়েছিল, পৌঁছে দেখলাম রাজরাপ্পাতে বেশ ভালোই ঠাণ্ডা।
অসাধারণ প্রাকৃতিক সুষমায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মা পুজো দিতে গেলেন, আমাকে মন্দিরের ত্রিসীমানায়ও দেখতে পেল না কেউ। ভৈরবী (ভেরা) নদীর সৌন্দর্য আমাদের হতবাক করে দিল। রাঁচি মালভূমি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার দরুন, চলার পথে পথে ছোট ছোট র্যাপিডস ও জলপ্রপাত সৃষ্টি করে ঘুঙুর বাজিয়ে নিজের মনে নেচে চলেছে সুন্দরী ভৈরবী, বেশ কিছুদূরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দামোদর নদের বুকে, সৃষ্টি করেছে ‘রাজরাপ্পা জলপ্রপাত।
পথে গরম গরম সমোসা ও জেলেবী দিয়ে জলখাবার সারা হয়েছে, কাজেই তৎক্ষণাৎ উদরের চিন্তা ছিল না, মা'র পুজো হয়ে গেলে আমরা ভেরা নদীর হাঁটুজলে ঘুরে বেড়িয়ে, নদী পারাপার করে প্রকৃতিকে প্রাণভরে উপভোগ করলাম। অনন্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যকে চোখে আর ক্যামেরাতে বন্দী করে আমরা ‘ডেরা ডাললাম’ ভেরানদীর তৈরি করা ভয়ঙ্কর সুন্দর একটি নদী- প্রপাতের পাশে। যতদূরে চোখ যায় সবুজের সমারোহ মনকে মাতাল করে তুলল। কতরকম যে পাখি, আগে কখনও দেখিইনি, নামও জানি না।
চারিদিকে নানা আকৃতির পাথরখন্ড, আমাদের কতরকম পরিচিত বস্তুর কথা মনে করালো। প্রস্তরখন্ডের ওপর দিয়ে বয়ে চলার সময়ে, নদী সৃষ্টি করে চলেছে ছোট ছোট ঘূর্ণি- অপূর্ব সে দৃশ্য।
পেটে ছুঁচো ডন মারছিল। সঙ্গে আনা মা'র রান্না করা কষা মাংস, রুটি আর গোকুল পিঠের কথা ভাবতেই ক্ষিদে আরও বেড়ে গেল।
আমার ঠাকুর্দা আমার মা'কে দ্রৌপদী বলে ডাকতেন, তাঁর অসাধারণ রান্নার জন্যে। আর তর সইছিল না, খাবারের পাত্র টানাটানি করে আমরা উদরপূর্তি করলাম। মা খেয়ে উঠে নিজের থালা নিয়ে নদীর ধারে গেলেন, ধোওয়ার জন্যে। সেখানে জল পায়ের পাতা ডোবা। কিন্তু তার পরেই নদীর জল আছড়ে পড়ছে পাথরের গায়ে, সৃষ্টি করেছে এক প্রপাতের।
হাত ধুতে গিয়ে, আমার চোখের সামনেই আমার মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন, হারিয়ে গেলেন সেই প্রবল প্রপাতের মধ্যে... যা আমাদের এতই সুন্দর লেগেছিল যে আমরা ওইখানেই বিশ্রামের ব্যাবস্থা করেছিলাম।
প্রথমে তো বুঝেই উঠতে পারলাম না কি হল, কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা। আমার প্রচন্ড চিৎকারে আমার কর্তা ও সঞ্জয়দা ছুটে এলেন। তাঁরা নদীর ধারে প্রস্তরখন্ডের ওপরে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন, আমার তিনমাসের মেয়ে তার বাবার কোলে। কি হয়েছে জানতে পেরে, মেয়েকে প্রায় ছুঁড়ে আমার কোলে ফেলে দিয়ে তিনি দৌড়োলেন।
উথাল পাথাল জলস্রোতের পরেই নদী আবার ধরেছে তার শান্ত রূপ, খানিকদূর বয়ে চলে ভেরা নদী জলপ্রপাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার দয়িত- দামোদরের কোলে। আমার বারো বছর বয়েসের বোন তো ভীষণ ভাবে কাঁদতে শুরু করল, একে তো ছোট তায় আবার সে খুব মা-ভক্ত। সবথেকে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল, যখন সিলেটের ডাকাবুকো ছেলে- সঞ্জয়দা পাথরখন্ডের ওপর থেকে ঝাঁপ দিলেন সেই প্রবল স্রোতের মধ্যে, আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। তাঁর স্ত্রী মধুপার অবস্থা তো অবর্ণনীয়। আমি তো মায়ের বেঁচে ফিরে আসার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সাঁতার তো তিনি জানেনই না, কিন্তু ওই জলস্রোতের ভেতর থেকে কোনও সাঁতারুর পক্ষেও বেঁচে ফেরা অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। কুচিন্তায় ঘিরে ছিল মন- জলের তলায় পাথরের ফাঁকে মা আটকে যেতে পারেন, পাথরে মাথা ঠুকে গেলে আহত হতে পারেন... আমরা দুই বন্ধু দুজনে দুজনকে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার কর্তা চলে গিয়েছিলেন সেইদিকে, প্রবল জলস্রোতের পরে নদী যেদিকে আবার শান্ত ধারায় বয়ে চলেছে, তাঁর ধারণা ছিল, মা জলের স্রোতে ভেসে, ওদিকেই উঠবেন।
ভগবান সহায় ছিলেন, মায়ের আয়ু ছিল... একটু পরেই দেখি দুই ছেলের হাত ধরে তিনি জল থেকে উঠে আসছেন। চোখে জল ও মুখে হাসি নিয়ে আমরা তাঁর অভ্যর্থনা করলাম হাসিমুখে।আমাদের বরেরা তো আমাদের শাল জড়িয়ে, তাদের ভেজা প্যান্ট ও সোয়েটার পাথরের গায়ে মেলে দিলেন। মায়ের ভেজা শাড়ী আর সোয়েটার বদলে পরতে দেবার মত আমাদের কাছে কিছুই ছিল না, ভেজা কাপড়েই বসে তিনি আমাদের তাঁর অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনালেন...
‘থালাটা ধোওয়ার পরে যখন হাত ধুচ্ছি আমি, ঠিক মনে হল কেউ যেন আমার হাত ধরে টেনে নিল। তার পরেই আমি ঐ প্রবল স্রোতের মধ্যে পড়ে একদম নীচে চলে গেলাম। সাঁতার তো জানি না, কিন্তু হাত পা মারতে লাগলাম।
ভগবানকে বললাম, হে প্রভু আমার এই অবস্থায় ছেলেদুটি তো আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেই। আমার যা হওয়ার হোক, ওদের তুমি দেখ ঠাকুর। সঞ্জয়দা বললেন, ‘মাসীমাকে চেষ্টা করতে দেখেই আমিও বল পেলাম, তাঁকে বাঁচাবার জন্যে ঝাঁপ দিলাম’।
প্রবল জলের তোড় তাড়াতাড়িই তাঁকে অক্ষত ও অনাহত অবস্থায় ওপরে তুলে আনল।
আরও একবার আমার মায়ের অপরিসীম মানসিক শক্তি ও সহ্যক্ষমতার পরিচয় পেলাম আমরা।
মায়েদের ভগবান বোধহয় এইভাবেই গড়ে তোলেন, কোনও পরিস্থিতিতেই তাঁরা নিজেদের কথা চিন্তা করেন না।
মার খুব কষ্ট হচ্ছিল, ঠান্ডাতে। আমাদের কারুরই আর পিকনিকের মুড ছিল না। সব গুছিয়ে নিলাম। মা ভৈরবীর মাভৈ মন্ত্র আমাদের শক্তি যোগাল, শেখাল তাঁর ওপরে ভরসা রাখতে... তাঁর হাতেই ক্ষয়, তাঁর হাতেই রয় সারা রাস্তা আমরা মায়ের দাঁতের খটাখট বাদ্যি শুনতে শুনতে হোম সুইট হোমে ফিরে চললাম।