Dola Bhattacharyya

Tragedy Crime

3  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Crime

দংশন

দংশন

9 mins
205



সকাল টা আজ একটু অন্যরকম ভাবে শুরু হল সালুর। আগের দিন রাতে নেশাটা একটু বেশি মাত্রায় হয়ে গিয়েছিল। খোঁয়াড়িটা এখনও পুরোটা কাটে নি। চোখ খুলতেই ইচ্ছে করছে না এখনও। তবু উঠতেই হল। কন্ডাক্টর সঞ্জু যা বাক্যবাণ ছাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে, ওর মরা বাপটা এখনই চিতা থেকে উঠে চলে আসবে। ইচ্ছে করছে এক লাথিতে সঞ্জু শালার মুখটা ভেঙে দেয়। হারামিটা এখন খুব বুলি কপচাচ্ছে। 

আগের দিন রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি সালু। গ্যারেজের এক কোণে খাটিয়া পেতে শুয়েছিল। সঞ্জুর কথাগুলো যে ওর কানে মধুবর্ষণ করেনি, সেটা ওর তিরিক্ষি মেজাজ দেখেই বোঝা গেল। "সক্কাল সক্কাল এত চেল্লাচিল্লি কিসের বে"? খাটিয়ায় বসে আরামকাঠি ভাঙতে ভাঙতে জড়ানো গলায় একরাশ বিরক্তি উগড়ে দিল সালু। গরম চায়ের ভাঁড় হাতে এদিকেই আসছিল সঞ্জু। সালুর কথা শুনে আবার ফোঁস করে উঠল, "কি রে শালা! চেল্লাচিল্লি মনে হচ্ছে আমার কথাগুলো না! এবার তো মাইক বাজাবো কানের কাছে। মাল টেনে কাল সারারাত বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলি। তার ওপর বমি করে ভাসিয়েছিস গ্যারেজের ভেতর টা ।সকাল বেলায় উঠে বিল্লু সেসব পরিস্কার করেছে। আর এখন এসেছিস রোয়াব নিতে!" কথা কটা বলে গরম চায়ের ভাঁড়ে সশব্দে চুমুক দিল সঞ্জু। আবারও তীব্র বিরক্তি গোপন করতে পারল না সালু। ও ভেবেছিল, চা টা বোধহয় সঞ্জু ওর জন্যই এনেছে। তাই বলেই ফেলল," শালা চা খাচ্ছে, না কোনো মেয়েছেলের গালে চুমু খাচ্ছে "। কথাটার একটা যুতসই উত্তর দিতে যাচ্ছিল সঞ্জু। কিন্তু তার আগেই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সালু, গামছাটা কাঁধে ফেলেই দৌড় লাগাল গ্যারেজের পেছন দিকটায় । রাগে গজগজ করতে লাগল সঞ্জু, "শালা এক নম্বরের হারামী। হয়েছিস তো পাবলিক বাসের ড্রাইভার। হাবভাব দেখে মনে হয় যেন নিজের বাপের গাড়ি চালাচ্ছে। আজ যদি ঠিক সময়ে গাড়ি না বেরোয়, তাহলে তোর একদিন কি আমারই একদিন।" 

ব্যারাকপুর - কাঁচড়াপাড়া রুটের বাস চালায় সালু। সঞ্জু ওই বাসেরই কন্ডাক্টর। দুজনের মধ্যে একেবারে আদা আর কাঁচকলার সম্পর্ক। খিস্তি খেউর তো লেগেই আছে। বৈজুও ওদেরই সহকর্মী ।তবে নিপাট ভালোমানুষ । ওসব খিস্তি খেউর ওর ধাতে সয় না। সালু আর সঞ্জু সকালে যখন একে অপরকে তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ করছিল, তখন দেখা গেল, গ্যারেজের এক কোণে বসে নিবিষ্ট চিত্তে হাতের তেলোয় খৈনি ডলছে বৈজু । ওকে দেখে এগিয়ে আসে বিল্লু, "এ বৈজু চাচা, সক্কাল সক্কাল কেমন লেগে গেছে দেখছো"? 

"ও আর নতুন কি রে বাপ! রোজই তো লাগছে ওরকম"। একটু রসিকতা করার লোভ ছাড়তে পারে না বিল্লু, বলে, তুমি কার দলে বলোতো দেখি! "

খৈনিটা আয়েস করে নির্দিষ্ট জায়গায় চালান করে বৈজু বলে," আমি রামজীকা দলে। যে ভালো আদমী, আমি তার দলে"। 

"কে ভালো আদমী বৈজু চাচা"! 

"ও বাত স্রিফ রামজী জানেন"। আশা ভঙ্গ হল বিল্লুর। শান্তশিষ্ট বৈজুকে কাঠি দিতে চেয়ে লাভ হলো না বিশেষ। তাই সখেদে বলে উঠল, " সঞ্জুদা তোমাকে রামজী কা বাচ্চা বলে ঠিকই করে দেখছি"। 


ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে কেবিনের দরজাটা সশব্দে বন্ধ করল সালু। মাথার মধ্যে দপদপ করছে এখনও। দশমণ বোঝা যেন চাপান রয়েছে মাথায়। সেই নিয়েই গাড়িতে স্টার্ট দিল সালু। নির্দিষ্ট সময়ের থেকে একটু দেরিতেই গাড়ি বেরিয়েছে আজ। দিনের শুরুটা যেভাবে হলো, তাতে দিনের শেষে আজ কপালে কি আছে কে জানে। আসলে গতকাল মনে বড় দাগা পেয়েছিল সালু ।তাই মালটা একটু বেশিই টেনে ফেলেছিল। ঝুমরিটা যে এভাবে পট করে খুন হয়ে যাবে, কে জানতো! আসলে এইসব মেয়েছেলেরা নানা চক্করে জড়িয়ে যায় মাঝেমধ্যে। খুন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তা বলে এইভাবে! শালীর সবকিছু লুটে নিয়ে ছেঁড়াখোঁড়া শরীরটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছে। 

ঝুমরি ছিল সালুর প্রথম প্রেম। তাকে ভোলা কি অত সহজ! কত মধুর সন্ধ্যা কেটেছে ওর ঝুমরির সান্নিধ্যে। ঝুমরির নরম উষ্ণ শরীরটার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে কতদিন স্বপ্ন দেখেছে সালু, ঝুমরি ওর বৌ হবে। কিন্তু তা হল না। সালুর বিধবা মা একদম সহ্য করতে পারত না ঝুমরি কে। সালুকে বলে দিয়েছিল স্পষ্ট করে, "ওরকম বারো ভাতারি মেয়েছেলেকে আমি ঘরে আনতে দেব না কিছুতেই।" ঝুমরিকে বুঝিয়েছিল সালু, "বুড়ি আর ক'দিন। তারপর আমি তোকেই বিয়ে করব ঠিক। বাপ মা মরা মেয়ে ঝুমরি। একরকম অরক্ষিতই বলা যায়। কার ইচ্ছায় যে এপথে নেমেছিল ও, সেকথা আর জানতে পারেনি সালু। হাজারবার জিজ্ঞেস করেও ঝুমরির মুখ ফাঁক করাতে পারেনি। তবে আন্দাজ করেছিল ব্যাপারটা। ঝুমরিকে বারোভাতারি প্রমাণ করার দায় কার সবচাইতে বেশি, সেটা বোঝা কঠিন কোনো কাজ নয়। 

ভদ্রলোকের মেয়ে বলে ময়নাকে ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল মা। মায়ের ইচ্ছায় ময়নাকে বিয়ে করেছিল সালু। আর সে ভদ্রলোকের বেটি কি করল! দেড় বছরের ছোট্ট মেয়েকে ফেলে রেখে নিজের পুরনো নাগরের হাত ধরে কেটে পড়ল। রাগে সেদিন মাথায় আগুন জ্বলেছিল সালুর ।ইচ্ছে হয়েছিল, বাচ্চাটাকে তুলে আছাড় মারে। কিন্তু তা পারেনি। তবে বাচ্চাটাকে আর ছুঁয়েও দেখেনি কোনোদিন। ঝুমরি সত্যিই সালুকে ভীষণ ভালোবাসত । আজ ভীষণ ভাবে মনে হচ্ছে, ময়নার বদলে যদি ঝুমরিকে বিয়ে করতে পারত সালু, তাহলে মেয়েটাকে এভাবে মরতে হত না। এইরকম একটা ভুল বিয়ে দেওয়ার কারণে, নিজের মাকে আজও ক্ষমা করতে পারেনি সালু। এই ঘটনার পর আর পারবেও না কোনোদিন। 


শ্যামনগর কালীবাড়ির কাছে এসে সাংঘাতিক একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। এক সাইকেল আরোহীকে প্রায় চাপাই দিয়ে বসেছিল সালু। একেবারে শেষ মুহূর্তে খুব জোরে ব্রেক কষেছে। কপালজোরে লোকটা আজ বেঁচে গেল। পাদানি থেকে ছিটকে পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিল সঞ্জু। তারপর শুরু হল ওর বাক্যবাণ, "শালা, রাতের খোয়াব এখনও দেখছিস নাকি! আজ গুমটিতে চল তুই। তোকে যদি জবাই না করেছি তো আমার নাম নেই"। পেছনের দরজা থেকে বৈজুর স্বগতোক্তি শোনা গেল, "আরে শিয়া রাম, শিয়া রাম। সক্কাল সক্কাল এসব কি হচ্ছে সালু ভাইয়া!" আপন মনে বিড়বিড় করে উঠল সালু, "ওই এলেন রামজীকা পুত"। 

সঞ্জুটার আজকাল বড় বাড় বেড়েছে। সালুকে ও আর মানুষ বলেই গণ্য করে না। নিজের সম্পর্কে খুব অহংকার ওর। হবে না ই বা কেন! ও তো আর সালুর মতো মাগী বাড়ি যায় না। মদ খেয়ে মাতলামিও করে না। বউ, ছেলে নিয়ে ভরা সংসার ওর। বেশ কয়েকবার ওর ঘরে গেছে সালু। সঞ্জুর বউটাও বেশ সরেস। কি সুন্দর টসটসে চেহারা! দেখলেই সালুর বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। ইচ্ছে করে ওর নরম তুলতুলে ঠোঁটদুটো একটু ছুঁয়ে দেখতে, হরিণীর মতো দীঘল চোখদুটোতে আলতো করে চুমু খেতে। আরও অনেককিছু করতে ইচ্ছে করে সালুর, সঞ্জুর বৌটাকে নিয়ে। সঞ্জু কি করে যেন ওর এইসব গোপন ইচ্ছের কথা জেনে গেল একদিন। চোখ গরম করে শাসিয়েও দিল সালুকে, "খবরদার! ওদিকে যদি চোখ তুলে চাইবি তো , আ্যসিড ঢেলে দেব চোখদুটোতে। মনে মনে ভাবে সালু, কি বোকা সঞ্জুটা ।ও না হয় বন্ধুর বৌকে মনে মনে একটু আদরই করতে চেয়েছে। সত্যিই তো আর করেনি। আর সত্যিই যদি করে একটু আদর, তাতেই বা ক্ষতি কি! আরে বাবা, নারী হল প্রকৃতি। সে কি কারোর একার! 


বাসে এখন বেশ ভিড়। কাঁকিনাড়ার জনবহুল অঞ্চল দিয়ে ছুটে চলেছে বাস। স্পিডোমিটারের কাঁটা সত্তরের ঘরে এসে থিরথির করে কাঁপছে। পেছন থেকে সঞ্জু চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলছে, "এই সালু, স্পিড কমা। মনে হচ্ছে, পাবলিকের ক্যালানি আজ তোর কপালে নাচছে।" ভ্রুক্ষেপ নেই সালুর। কাঁকিনাড়া ছাড়িয়ে বাস এখন ভাটপাড়া অঞ্চল দিয়ে ছুটে চলেছে। স্কুলের টাইম। পরপর বেশ কয়েকটি স্কুল রয়েছে এই রাস্তার ওপর। বাচ্চারা যাওয়া আসা করছে। ঝড়ের গতিতে বাসটাকে এগিয়ে আসতে দেখে। সকলে সভয়ে রাস্তা ছেড়ে নেমে দাঁড়াচ্ছে। একজনই শুধু সরতে পারল না। পিঠে তার স্কুলব্যাগ। মায়ের হাতটা ধরে যাচ্ছিল স্কুলে। স্কার্টের ক্লিপটা খুলে গিয়েছিল বোধহয় । সেটা ঠিক করার জন্য মায়ের হাতটা ছেড়ে একটু পিছিয়ে পড়েছিল সে। আর তখনই, কালান্তক যমের মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে সেই যান্ত্রিক দৈত্য। রাস্তার সাথে মিশে গেল নরম ছোট্ট শরীরটা। শেষ মুহূর্তে মেয়েটার চোখে চোখ পড়েছিল সালুর। সে দৃষ্টিতে কি ছিল, জানে না সালু। সেই দৃষ্টি পড়ার মতো সময় এই মুহুর্তে সালুর হাতে নেই। এখন একমাত্র চিন্তা ওর, পালাতে হবে এখান থেকে, যেভাবেই হোক। একটা ভাঙাচোরা সংসার ওরও রয়েছে। সেটাকে বাঁচানোর জন্যেই পালাতে হবে ওকে অনেক দূরে কোথাও। 


কিভাবে পাবলিকের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সেদিন কাঁকিনাড়া স্টেশনে এসে পড়েছিল, সালু তা নিজেও জানে না। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে সোজা শিয়ালদহ স্টেশন। শিয়ালদায় পৌঁছে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আর এক প্ল্যাটফর্মে নিরুদ্দিষ্টের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল সালু। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, পালাতে হবে, অনেক দূরে কোথাও। তখনই নজরে পড়েছিল, তিস্তাতোর্সা এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো কিছু না ভেবেই একটা জেনারেল কম্পার্টমেন্টের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়েছিল। পরদিন সোজা শিলিগুড়ি। ভাগ্য টা সেদিন প্রসন্নই ছিল সালুর। সঙ্গে ছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স। আর ছিল হেভি ভেহিকেলস চালানোর অভিজ্ঞতা। লরি চালানোর কাজটা পেতে অসুবিধা হয় নি। লরিতে মাল বোঝাই করে শিলচর, গৌহাটি এসব জায়গায় চলে যায়। সেখানে মাল খালাস করে আবার শিলিগুড়ি ফিরে আসে। হাড়ভাঙা খাটুনির পর অবসর সময়ে নিজের ঠেকে ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে সালু। কিন্তু এ কী! সেই চোখ দুটো! গভীর অন্ধকার থেকে পদ্মকলির মতো ফুটে ওঠে আলোময় দুটো চোখ। নির্নীমেষে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কি যেন প্রশ্ন করতে চায় ওকে। বুঝতে পারে না সালু তার নীরব ভাষা। ধড়ফড় করে উঠে বসে ছিন্ন মলিন শয্যার ওপর ।দিনে দিনে মদ খাওয়ার মাত্রা আরো বাড়িয়ে চলে। 


ছমাস বাদে রাত প্রায় দশটা নাগাদ মদে প্রায় চুর হয়ে নিজের বাড়ি ঢুকল সালু। এতদিন বাদে ছেলেকে দেখে খুশি হতে পারল না সালুর মা পার্বতী। দরজাটা খুলে নাকে আঁচল চাপা দিয়ে সরে দাঁড়াল। মাতাল অবস্থাতেও মায়ের ঘৃণাভরা দৃষ্টি টা চোখ এড়াল না সালুর। জড়িত স্বরে বলে উঠল, "কি হল! এতদিন বাদে আমাকে দেখে খুশি না হয়ে ঘেন্না পাচ্ছো! কেন? বেজন্মা নাকি আমি"? পার্বতী নিরুত্তর। দুচোখের দৃষ্টিতে শুধু ঘৃণা উপছে পড়ছে। 

পার্বতী এখন খুব ভালোভাবেই জানে, ছেলে একটা খুন করে পালিয়েছিল। ওর খোঁজে পুলিশও এসেছিল বাড়িতে। সালুর মতো অসৎ চরিত্র, খুনির জন্য পার্বতীর মনে আর একটুও জায়গা নেই। 

সালুর সাত বছরের মেয়ে বিন্দিয়া এতক্ষণ বাবা আর ঠাকুমাকে জরিপ করে যাচ্ছিল। হঠাৎ ওর মনে হল, বাবা এতদিন পর বাড়ি এল, একটু অন্তত ভালো করে কথা বলা উচিৎ। ঠাকমা যেরকম রেগে আছে বাবার ওপর! অথচ ঠাকমাই তো শিখিয়েছে, অনেকদিন পর কেউ বাড়িতে এলে, তাকে 'কেমন আছো' জিজ্ঞেস করতে হয়। ঠাকমা চুপ করে আছে দেখে নিজেই এগিয়ে এল বিন্দিয়া, বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করবে, 'কেমন আছো'! বাবা নিশ্চয়ই খুশি হয়ে একটু আদর করে দেবে। আদরের বদলে বাবার জুতো পরা পায়ের লাথি সপাটে লাগল বিন্দিয়ার পেটে। ছিটকে পড়ে গেল বিন্দিয়া। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বার হল না ওর। রাগে হিসহিস করে উঠল পার্বতী। চকিতে ফিরে তাকাল সালু বিন্দিয়ার দিকে। একী! এ কী দেখছে ও! সেই চোখ! সেই দৃষ্টি! সেই একই জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছে চোখ দুটো তে। এবার বুঝতে পারল সালু, বিন্দিয়া বলতে চাইছে, কেন মারলে আমাকে! কি এমন অন্যায় করেছি আমি "! এই একই প্রশ্ন ছিল সেই মেয়েটার চোখেও, যা সালু বুঝতেই পারেনি। পাশে বসে বিড়বিড় করে চলেছে পার্বতী," এইটুকু বাচ্চাকে এভাবে মারতে হয়! " সালু নীরব ।পার্বতী তখনও বলে চলেছে," খুন করে পালালি তুই। মার খেয়ে মরল নিরীহ সঞ্জু। বৈজুটা এখনও জেলে। বড় অন্যায় করেছিস সালু। ঈশ্বর তোকে কোনোদিন ক্ষমা করবেন না।" প্রতিবাদ করতে পারত সালু। ঝলসে উঠে বলতেই পারত, "না মা। সঞ্জুর মৃত্যু, বৈজুর জেল —এগুলোর পেছনে একটাই কারণ, সে হল ঝুমরির মৃত্যু। আর ঝুমরির মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী তুমি মা! তুমি! কিন্তু কিছুই বলতে পারল না সালু। সঞ্জুর মৃত্যুর খবরটা যেন ওকে পাথর করে দিয়েছে। 


কাল সারারাত ধরে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে সালু। পার্বতীর আনা সমস্ত অভিযোগই মেনে নিয়েছে ও। ঠিক করেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় গিয়ে সারেন্ডার করবে। বৈজু তাহলে ছাড়া পেয়ে যাবে। বিনা দোষে জেল খাটছে বেচারা। সঞ্জুর বৌ, বাচ্চার কথা ভেবে খারাপ লাগছে খুব। ওদের এই দূর্দশার জন্যে সালুই দায়ী। কিন্তু ওদের জন্যে কিছু করার সাধ্য নেই ওর। তবে বিন্দিয়ার জন্যে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করতে হবে। এ কাজ করতে মন থেকে প্রথমে সায় মেলেনি। মায়ের জন্য খারাপ লাগছিল। মা যে বড় ভালোবাসে মেয়েটাকে। তারপর মনে হয়েছে, ও যেটা করতে চাইছে, তাতে সবার ভালোই হবে। ওর জেল তো আটকানো যাবে না। তার ওপর মায়েরও বয়স হয়েছে। কখন কি হয় কে বলতে পারে। মেয়েটা একেবারে অরক্ষিত হয়ে যাবে। তখন আর একটা ঝুমরি —, নাঃ! তার চেয়ে এই ভালো। 

অবশেষে মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় নামল সালু, ওকে একটা নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দেবার ইচ্ছা নিয়ে। জন্ম ইস্তক মেয়েটা না পেয়েছে মায়ের কোল, না পেয়েছে বাবার আদর। এ দুটোর অভাব কি ওর পূরণ হবে কোনোদিন? একজন সন্তান হারা মা কি তার খালি হয়ে যাওয়া কোলটায় একটু জায়গা দিতে পারবে না এই হতভাগ্য মেয়েটাকে?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy