দিন বদলায়দোলা ভট্টাচার্য্য
দিন বদলায়দোলা ভট্টাচার্য্য
সেদিন মাম্পির বিয়েতে গিয়ে এমন একটা ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়লাম, সেটা ভাবলে রীতিমত বিস্মিত হচ্ছি। মাঝে মাঝে হাসিও পাচ্ছে, আবার রাগও হচ্ছে। বলি, এরা ভেবেছে কি!
মাম্পি আমার বড় ননদের মেয়ে। ননদ বলেছিল, বিয়ের দুদিন আগেই ও বাড়িতে যেতে। সেটা আর সম্ভব হয়নি। বিয়ের দিনই সকালে পৌঁছেছিলাম।
সারাদিন হৈ চৈ হট্টগোল।তার মধ্যে হাজারটা কাজে ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমাকে। টুসু টা কোথায় গেল দেখতেই পাচ্ছি না। টুসু আমার একমাত্র মেয়ে। বাইশ বছরের তরুণী। দেখতে খুবই সুন্দর। একটু ননীর পুতুল ধরণের চেহারা। এম.এ পড়ছে। নাচ, গান দুটোতেই পারদর্শী। অনেক যত্নে মানুষ করেছি ওকে। দেখতে পাচ্ছি না । সবাইকে জিজ্ঞেস করছি। ননদিনী বললেন, মেয়েকে অত চোখে হারালে চলবে! শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হবে তো এক সময়ে। তখন কি করবি! দুচোখে ছায়া ঘনিয়ে আসছিল আমার। অনেকক্ষণ দেখিনি মেয়েটাকে। এতবড় বাড়িটার কোনখানে রয়েছে, কে জানে! একটু হেসে ননদিনী বললেন, "মেয়ে বড় হয়েছে। এখনও তোর আঁচল ধরে থাকবে নাকী! থাকুক না ও নিজের মতো। অত চিন্তা করিস না"।
দুপুরে খাওয়ার সময় দেখতে পেলাম মহারাণীকে। সমবয়সী বেশ কয়েকটিকে জুটিয়ে নিয়ে খাওয়ার জায়গায় এসে ঢুকলেন। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই একজন ছিনেজোঁক টাইপের মহিলা আমার পেছন পেছন ঘুরছিলেন। কেন, তা জানি না। পরে শুনলাম, উনি আমার ননদাইএর মামাতো ভাইয়ের বৌ। নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ে দেবেন। তাই পাত্রী খুঁজছেন। আবার যে সে পাত্রী নয়। রীতিমত সুন্দরী পাত্রী। এই বিয়ে বাড়িতে এসেও খোঁজ চলছে তাঁর। একটা বিয়ে বাড়িতে কত রকমের লোকই তো থাকে। পাত্তা দিইনি। এখন দেখি তিনি আমার মেয়ের পাশে খেতে বসে পড়লেন। ভদ্রমহিলা টুসুর সাথে কথা বলছেন দেখলাম। টুসু খেতে খেতে টুকটাক উত্তর দিচ্ছে। মেয়েটাকে আবার কি বলছে রে বাবা। উল্টাপাল্টা কিছু বললে, টুসুটা আবার যা ঠোঁটকাটা, কি বলে বসবে, কে জানে! কাজের বাড়িতে তখন আবার কি কান্ড বাঁধবে ! তাড়াতাড়ি গিয়ে ওদের কাছে দাঁড়ালাম। যা ভেবেছি ঠিক তাই। টুসুর কাছ থেকেই টুসুর হাঁড়ির খবর নিচ্ছেন উনি। টুসু বিব্রত। আমাকে দেখে চুপ করে গেলেন । টুসুর মুখে বিরক্তির আভাস। এর আগে কি কি বলেছেন কে জানে।
বিয়ের লগ্ন সেই রাত দশটায় । খুব সুন্দর করে মাম্পিকে আজ সাজিয়েছে টুসু। এখন নিজে সাজতে গেছে। সেই মহিলা দেখি এখন আর আমার সঙ্গই ছাড়ছেন না। আমার পাশেই বসে রয়েছেন । একটু পরেই টুসু এসে দাঁড়াল, "মা", ইতস্ততঃ করছে ,"এদিকে এসো না একটু" ।উঠতে যাচ্ছি, উনি বাধা দিলেন, "সব সময় মাকে চাই, তাই না! শ্বশুরবাড়ি গেলে কি করবি। আয় এখানে, দেখি কেমন সেজেছিস"। ভদ্রতা রক্ষার্থে এগিয়ে এল টুসু। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ বিরক্ত।
"ওমা! কি সুন্দর দেখাচ্ছে! ও দিদি ।তোমার মেয়ে খুব সুন্দর গো। আমি তো ঠিক এমনি মেয়েই চাইছি ছেলের বৌ করব বলে। দাওনা দিদি তোমার মেয়েকে "।
এই আশঙ্কাই করছিলাম। বললাম," কি বলছেন দিদি! ওতো অনেক ছোট। তারওপর ওর পড়াশোনা শেষ হয়নি।"
"বিয়ে টা হয়ে গেলে আর তো দরকার নেই পড়ার "।
" না দিদি, এত তাড়াতাড়ি আমি ওর বিয়ে দেব না। টুসুর ইচ্ছা, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে । ওর ইচ্ছা কে সম্মান করি আমি।"
"আরে, অত ভাবছেন কেন? আমার ছেলে ওর কোনো অভাব রাখবে না। আর খুব ছোট তো নয় ও। আইনত বিয়ের বয়স হয়েই গেছে । সত্যি বলতে কি, আমি শুনেছি, আপনি খুব অসুস্থ। বাই এনি চান্স আপনার যদি কিছু হয়ে যায়, তখন তো মেয়েটা একলা হয়ে যাবে ।যতদূর শুনেছি, ওর বাবা দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। সম্ভবতঃ মারাই গিয়েছে। যদিও আপনি সিঁদুর পরেন এখনও। এইরকম ঘরের মেয়ে। তাও আমি অফারটা দিচ্ছি, ছেলের মা আমি। আপনার তো সৌভাগ্য দিদি। আসলে আমার তো মেয়ে নেই। ঠিক এইরকম সুন্দর একটা মেয়ে মা মা করে আমার পায়ে পায়ে ঘুরবে, আমি যা বলব, সব কথা শুনবে, এ আমার বহুদিনের ইচ্ছা।" রাগে টুসুর মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। আশঙ্কা আমার সত্যি হল। রাগে ফেটে পড়ল টুসু । "ও আন্টি, তোমার বাড়িতে কুকুর আছে "?
কিছু না বুঝেই মহিলা বললেন," না রে মা। ওসব কিছু নেই। তবে তুই যদি চাস.. "
টুসুকে ইশারায় থামতে বলছি। কিন্তু না, মেয়েটার যেন খুন চেপেছে মাথায়। ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি।
"না আন্টি, আমি চাই না। তবে তোমার একটা কুকুর দরকার, যে তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে, ছেলের বৌ নয় । আর সারা দিনরাতের জন্য একটা মেড রাখ। সে তোমার সব কথা শুনবে। পয়সা অবশ্য প্রচুর নেবে। তাতে কি। তোমার ছেলে তো আছেই।"
"এ বাবা! এভাবে বলছিস কেন আমাকে? তোর মায়ের শিক্ষা এরকম "!
" আমার মায়ের নাম নিও না আন্টি। আমার মা আমার কাছে দেবী। আর তুমি! তখন থেকে আমাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছো, কি পড়ছিস? কোথায় বাড়ি? আর পড়ার দরকার কি? ঘরের কাজকর্ম করিস কিছু? কি কি রান্না জানিস? এসব কি? তোমাদের মতো শাশুড়িরাই এখনও ছেলের বিয়ে দিয়ে দাসী আনে ঘরে। যুগের কি পরিবর্তন হবে না!"
ভদ্রমহিলা ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন" নিজের ঘরের কাজ সকলকেই করতে হয় কিছু। আমিও তো করেছি। আমার বিয়ের পর আমার শাশুড়ি সব কাজের লোক ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঘরদোর পরিস্কার, কাপড় কাচা, রান্না করা, সব আমি একা হাতে করেছি। খুব কষ্ট হয়েছে, তবু করেছি। কেউ তো আমার হয়ে কিছু বলেনি। আমি ও মুখ বন্ধ করেই ছিলাম "।
" তাবলে তুমিও তাই করবে! যে মেয়েটা পড়াশোনা করছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, তার সব ইচ্ছাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ঘরের বৌ করে আনা, তারপর! সংসারের সমস্ত জোয়াল তার কাঁধে তুলে দেওয়া। যুগের পর যুগ ধরে এই চলে আসছে। বন্ধ হবে না এসব! কি শাশুড়ি মা! ভেবে দেখুন। যুগ কিন্তু পাল্টেছে। অনেক ঘরেই এখন মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হয় । আমি যা সহ্য করেছি, আমার ছেলের বৌকেও তাই সহ্য করতে হবে, এই কনসেপ্ট টা এবার বদলাতে হবে।" আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।মেয়েটা বড্ড খেপে গেছে। এবার থামানো দরকার । নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। আমাদের ঘিরে একটা অস্বস্তিজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তাই আমরাও আর থাকলাম না বেশিক্ষণ।
দশ বছর পর। আমার টুসু এখন কলেজে পড়ায় ,বিবাহিত। ছমাস হল মা হয়েছে মেয়েটা । এতদিন ছুটিতেই ছিল। এতটুকু বাচ্চাকে রেখে চাকরিতে জয়েন করতে হবে আবার। চিন্তায় পড়েছে বেশ । শাশুড়ি মধুপ্রিয়া বলেছেন, "চিন্তা কোরো না বৌমা। নিশ্চিন্তে জয়েন করো তুমি। আমি আছি কি করতে! বাবুসোনা কে বলবো একটা আয়া রেখে দিতে। পা দুটো ঠিক থাকলে তারও দরকার ছিল না। আমার নাতনীকে আমিই সামলাতাম। যাইহোক, একটা আয়া থাকলে সুবিধা হবে।"
একটা মানুষের এতটা বদলও হয়! ওঃ! আপনাদের তো বলাই হয় নি! মধুপ্রিয়া হচ্ছে বিয়ে বাড়ির সেই ভদ্রমহিলা। আমার জামাই তমালের কাছে শুনেছিলাম, সেই রাতে বাড়ি ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন উনি। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, টুসুর থেকেও ভালো মেয়েকে উনি ঘরে আনবেন। ধীরে ধীরে নিজের স্বভাব পাল্টেছেন মধুপ্রিয়া। অবসরে বইপত্রের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তমাল নিজেও । কিন্তু ওকে তো আমরা চিনতাম না কেউ।
অনেক পরে তমাল যোগাযোগ করে টুসুর সাথে। বেশ কিছুদিন মেলামেশার পর বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওর পরিচয় পেয়ে সরে আসতে চেয়েছিল টুসু। তমাল বলেছিল, "যে মানুষটার মধ্যে এতবড় পরিবর্তন আনলে তুমি, একবার তার কাছে চলো। দেখোই না, তাকে ভরসা করা যায় কি না। আমার বাবাও কিন্তু খুব ভালো মানুষ। এসো আমাদের ঘরে। বেরিয়ে আসার পথ তো খোলাই রইলো।
আমিও খুব খুশি। আমার মেয়ের গর্বে গরবিনী মা আমি। মাত্র একজনের পরিবর্তন করতে পেরেছে ও। এভাবেই হবে। পাল্টাবে সমাজ। শ্বশুরবাড়িতে আর কোনো মেয়ে নির্যাতনের শিকার হবে না।