দীর্ঘশ্বাস
দীর্ঘশ্বাস


দীর্ঘ চারবছর ভালোবাসাবাসির পর বিয়ে করল সীমা ও তপন বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে কিছু বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে। তারপর কালীবাড়িতে হল সিঁদুরদান ও মালাবদল। হানিমুনও হল দার্জিলিং এ। সীমা তখন ২১,বি.এ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে কেবল,রেজাল্টও বেরোয়নি। দুজনে দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারছিল না আর,তাই তড়িঘড়ি বিয়ে। তপনের ব্যাঙ্কে পাকা চাকরি ছিল তাই অসুবিধে ছিল না। শুরু হল সুখের সংসার। রেজাল্ট বের হলে তপনের উদ্যোগে চাকরির পরীক্ষায় বসতে বসতে এক বেসরকারি সংস্থায় চাকরিও একটা পেয়ে গেল সীমা। দুজনেই খুব খুশি,অফিসের পর একই ট্রেনে বাড়ি ফিরত দুজনে প্রথমদিকে। ফেরার সময় দোকান বাজার, কেনাকাটা একসঙ্গে করে বাড়ি গিয়ে দুজনে হাতে হাতে সব কাজ করে ফেলত মিলেমিশে। এভাবে বছরখানেক কাটার পর কোথায় যেন সুর কাটল। সীমা প্রায়ই অফিসের কাজের দোহাই দিয়ে দেরি করে ফিরতে লাগল। তপন মেনে নিল,সীমা প্রথমে চাকরি করতে চায়নি,তপনই জোর করেছিল,বলেছিল, "দুজনের রোজগারে আমরা আরও ভাল থাকতে পারব, ভাড়াবাড়ি ছেড়ে একটা ফ্ল্যাট কিনব,সুন্দর করে বাড়ি সাজাবো,আমাদের সংসার-গাড়ি ডবল ইঞ্জিনে তরতরিয়ে চলবে"বলে হেসেছিল খুব সেদিন। অলক্ষ্যে বসে বিধাতাও বোধহয় হেসেছিলেন সেদিন খুব। আর তাই সীমার বাড়ি ফেরার সময়ের আর সীমা-পরিসীমা থাকল না। তপনের ভাল লাগে না,রোজই বাড়ি ফিরে সীমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে যায় দেখে রান্নাটা সে একাই করে ফেলে। সীমা ফিরে কোনোরকমে খেয়েদেয়েই ঘুম,দুটো কথা বলতেও যেন তার ইচ্ছে করে না।
কিছুদিন পর তপন আবিষ্কার করল তার গায়ে সাদা দাগ। প্রথম দাগ দেখা দিলে তপন শিউরে ওঠে,খুব মনখারাপ হয় ওর। কি করবে ভেবেই পায় না। সীমাকে যে বলবে তা তার সময়ই নেই তপনের দুটো কথা শোনার। তবু সীমার সঙ্গে একটু পরামর্শ করার অভিপ্রায়ে খুব মনখারাপ করে ওকে দেখাতেই "ইসসসস" করে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ও। সীমার ওইরকম অভিব্যক্তিতে তপন জোর ধাক্কা খেল। ওর ঘৃণাভরা চোখ তপনকে কষ্ট দিত প্রথমদিকে,পরে দেখল সীমা ওর দিকে মোটে তাকায়ই না। কিছুদিন পর,কানাঘুষোয় শোনে,অফিসের কোনো পুরুষ কলিগের সঙ্গে সীমার ঘনিষ্ঠতার কথা,যার সঙ্গে সে রোজই ট্রেনে ফেরে রাত করে। চেনা মানুষদের অনেকেরই যেটা চোখে পড়েছে। এব্যাপারে জানতে চায় তপন,"যা শুনছি তা সত্যি?" সীমা তপনের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বলে,"কি শুনেছ তুমি তাই তো আমি জানি না, তার উত্তর দেবো কেমন করে? আর সারাদিনের পর আমার আর ভাল লাগছে না এসব।" সে রাতে এসব নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রচন্ড বাকবিতণ্ডা হয়,সবদিক থেকে হতাশায় ভেঙে পড়ে তপন। নিত্যই প্রায় অশান্তি লেগে থাকে। এভাবে চলতে চলতে সীমা একদিন তপনের কাছে বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব রাখে। তপন বোঝে তার জন্য সীমার মনে কোনও অনুভূতিই নেই,মন তার অন্য কোথাও নোঙর ফেলেছে। তবে বৃথা কেন আর সম্পর্কের বোঝা টেনে বেড়ানো। তপন রাজি হয়ে যায়। বিবাহবিচ্ছেদটা হয়েই যায়। তপন বলে,"মুক্তি দিলাম তোমায়"।
সীমা রঞ্জনকে বিয়ে করে নতুন সংসার পাতে আবার। নতুন করে হানিমুন,সুখের সাগরে ভাসতে থাকে সীমা। রঞ্জনের প্রথমবার বিয়ে,বাড়ি থেকে সীমাকে মেনে নেয় না,তাই ভাড়াবাড়ি। দুজনেই চাকরি করে,আর্থিক স্বাচ্ছল্য যথেষ্ট,যখন খুশি,যেখানে খুশি ঘুরছে,বেড়াচ্ছে। নতুন একটা ফ্ল্যাট নেবার চেষ্টাতেও রয়েছে ওরা। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সীমার জীবনে তপনের দীর্ঘশ্বাসের ছায়া পড়ে। ওর ডানদিকের গালে কানের ঠিক নিচে একটা টিউমার দেখা দিল যেটা অল্পদিনের মধ্যেই বেশ বড় আকার ধারণ করে এবং সীমাকে দেখতে কুৎসিতদর্শন হয়ে যায়। পাড়ায় নামই হয়ে গেল ওর 'গালফোলা'। রঞ্জনেরও এখন ওর মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছা হয় না,এমনই কুৎসিত দর্শন হয়ে গেছে সীমা,তবু কর্তব্যের খাতিরে ভেলোরে নিয়ে যায় ওকে দেখাতে। সেখানে বলে অপারেশন করলে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা আছে,তাই সীমাকে মেনে নিতে হয় তার এই কুৎসিত রূপ আর ভাবে,এ তপনের দীর্ঘশ্বাসের ফল। এতদিনে সীমার মনে হয় এভাবে তপনকে ছেড়ে এসে ও ঠিক কাজ করেনি,যখন ওর তপনের পাশে থাকাই উচিত ছিল। আজ তাই রঞ্জনও একই বাড়িতে থেকেও ওকে এড়িয়ে চলে,পারতপক্ষে সামনে আসে না। সীমা ভাবে সবই তার কর্মফল।