Manasi Ganguli

Tragedy

4.9  

Manasi Ganguli

Tragedy

ধর্মঘট

ধর্মঘট

3 mins
574


দিন দিন সুবলের হাঁ-টা ছোট হয়ে যাচ্ছে, ভাল করে চিবিয়ে খেতে পারছে না। ছোট হতে হতে ক্রমে খাবারটুকু মুখে ঢোকাবার রাস্তাটুকু পাওয়া যায় না, কথা বলতেও অসুবিধা। প্রত্যন্ত গ্রামে এক ছোট মুদিখানার দোকান সুবলের। কাজ করতে অসুবিধা কিছু হচ্ছেনা, খদ্দেরদের মালপত্র ওজন করে দেওয়া, টাকাপয়সা হিসাব করে বুঝে নেওয়া, অসুবিধাটা শুধু ওই খাওয়ার। একটা করে পান খায় মাঝে মাঝে, সেটা ওর নেশার মত, আজকাল তাও খেতে না পেরে শরীরটা আনচান করে আর ভাল করে খেতে না পারার ফলে শরীরটাও দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। চেহারাটাও বেশ ভেঙেছে। এমনিতে চেহারাপত্তর বেশ ভালই সুবলের কিন্তু এখন সে চেহারায় একটা রুগ্ন, ক্লিষ্ট ছাপ পড়েছে। চেনাপরিচিতরা সবাই বলছে কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার দেখাতে, কিন্তু সে তো অনেকটা দূর, সেখানে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরাও সম্ভব নয় দিনে দিনে আর কেউ নেইও সেখানে যার বাড়ি একটা রাত থাকা যায়। এছাড়া সঙ্গে কাউকে নিতেও হবে, দুজনের যাতায়াত, বাইরে খাইখরচ, থাকা সব মিলিয়ে খরচাও অনেকটা হয়ে যাবে। দোকানটা এমনিতে ভালই চলে তবে এই বাড়তিটুকু করার মত নয়। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে দিন পার হয়, সুবলের শরীরটাও দুর্বল হতে থাকে।

    অবশেষে চেনা-পরিচিত সকলের জোরাজুরিতে এলাকার শিক্ষিত ছেলে রতনের সঙ্গে কলকাতার পথে পা রাখে সুবল। মনে আশা কলকাতায় গেলে তার রোগ মুক্তি হবে। কলকাতায় বড় বড় ডাক্তারেরা আছেন তারা নাকি ভগবান! রতন শিক্ষিত, সে বোঝে সুবলের মুখে ক্যান্সার হয়েছে। অতিরিক্ত সুপুরি খাওয়া থেকে এ ধরনের ক্যান্সার হয় যাতে মুখের হাঁ ক্রমশ ছোট হতে থাকে। তাই সে অঙ্কলজিস্টের কাছে নিয়ে যায় সুবলকে, কিন্তু ডাক্তার দেখানো হল না, সেখানে আগে নাম লিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। নাম লেখানোর জন্য বসে থাকতে হয় ওদের বিকাল পর্যন্ত। তারপর আর গ্রামে ফেরার কোনো উপায় থাকেনা। একটা সস্তাদরের হোটেলে রাতটা কাটাতে হয় একগাদা টাকা খরচ করে, কাজের কাজ কিছুই হল না। এদিকে এই একদিনের ধকলেই সুবল বেশ কাহিল হয়ে ফিরল গ্রামে।

    দুমাস পর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তিল তিল করে সুমনের শরীরটা ধ্বংস হচ্ছে, দেখে তার বাড়ির লোক, দেখে পাড়াপড়শি। বেশিক্ষণ দোকানে বসেও থাকতে পারে না সে আর,তার বউ বাচ্চা সামলে এসে বসে দোকানে মাঝেমাঝে। এতে আয়পত্তরও কমে যাচ্ছে, এদিকে কর্মচারী রেখে দোকান চালাবার সামর্থ্যও তার নেই। গ্রামের এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের ভরসাতেই রইল তাই। মনে হাজার চিন্তা, দুমাস পর আবার কলকাতা ডাক্তার দেখাতে যাওয়া মানে একগাদা টাকা খরচ। রাতে ঘুম আসে না চিন্তায়। এদিকে মুখের হাঁ-টাও আরো যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। গলা ভাত, সুজি এসবই তখন তার আহারপথ্য।

     বউটা ভাল,"বলে টাকার চিন্তা কোরোনা, আমার কানের দুল জোড়া না হয় বেচে দেবো"। সুবল আঁতকে ওঠে, খেতে পরতে দিতে পারলেও বউকে গয়না দেবার সামর্থ্য তার হয়নি কোনোদিন, এ তার বিয়েতে পাওয়া যৌতুক, এ গয়না সে বেচবে কেমন করে? এসব ভাবে আর বলে,"কলকাতা গিয়ে কাজ নেই, হোমিওপ্যাথিই ভাল"। বউ কোনো কথা না শুনে কলকাতা যাবার জন্য কানের দুল জোড়া বেচে টাকা তুলে দিল সুবলের হাতে, ডাক্তারের ফিস, যাতায়াতের খরচ, খাইখরচের জন্য।

    নির্দিষ্ট দিনে দুর্বল শরীর টেনে নিয়ে সুবল চলল রতনের সঙ্গে কলকাতায়। কিন্তু চিত্রগুপ্তের খাতায় সুবলের আয়ু বোধহয় শেষ। তাই যেদিন তার ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, সেদিন থেকেই কলকাতার সব ডাক্তাররা জুনিয়ার ডাক্তারকে পেসেন্টপার্টির মারার প্রতিবাদে ধর্মঘটে বসেছেন। রোগী দেখা বন্ধ। রতন অনেক ছোটাছুটি করেও সুবলকে ডাক্তার দেখাতে পারল না। ধর্মঘট কবে উঠবে জানতে পারেনি আর অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকবেই বা কোথায়! তাই সুবলকে গ্রামে ফিরতে হলো আবার বিনা চিকিৎসায়। দেহও তার কাহিল, এভাবে কলকাতা যাতায়াতের ধকলে সে বিছানা নিল। খাদ্য নেই, ওষুধ নেই, সুবল তাই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু পথযাত্রী। পরিস্থিতির শিকার সুবল, সঙ্গের সাথী অভাব, তার আর বাঁচা হল না।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy