দেবী
দেবী


চার-পাঁচটা ছোটো ছোটো কৌটো, একটা চটের ব্যাগ। ব্যাগটা প্রায় খালি -- একটা হাত ভাঙা পুতুল, একটা উলের টুপি, দুটো সোয়েটার। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো ভাস্কর মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও মুখ উঠিয়ে তাকালো ওর দিকে। এক গাল হাসি। হাসলে ওর মায়ের মতন খানিকটা লাগে। গালে খুব গভীর টোল পড়ে ওর মায়ের মতন। ওর মায়েরই মতন আদুরে আদুরে গন্ধ গায়ে। কি জানি কেন হঠাৎ খুব শুন্য মনে হলো সব কিছু। কোনো....কোনো ভুল করছিনা তো কোথাও?
ভাস্কর ওর হাতটা সরিয়ে নিলো, মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চার দিকে পাহাড় ঘেরা বসন্ত নেমেছে, ফুল-ফলে-ঝর্ণায় পৃথিবী নব-যৌবন সম্পন্না। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে, সন্ধ্যা রক্ত-রাগে দূর পাহাড়ের জঙ্গলের ঘর ফেরা পাখিরা কি যেন একটা বিষন্ন গান গুনগুন উড়ছে…বাসটা সামনের বাঁকের মুখে বিরাট জোড়ে মোড় নিলো, মেয়েটা ভাস্করের গা ঘেঁষে এসে পড়লো।
সরিয়ে দিলো ওকে ভাস্কর এক ঠেলা দিয়ে।
না, না....মায়া ভালো না। আর মায়া বাড়ানো ভালো হবে না।
১.
একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীটা এরকম ছিল না।
প্রাচুর্য ছিল, সময় ছিল, গান ছিল, কথা ছিল, কথা বলার অনেক প্রসঙ্গ থাকত। ভাস্কর একসময় অনেক লেখালেখি করেছে, অনেক বই পড়েছে, ফেভারিট লেখকের চটকদার উদ্ধৃতি -- কলেজ ক্যান্টিনে মহিলা মহলে আবিষ্ট হয়ে লেকচার-বাজিতে, পার্কস্ট্রীটের রুফটপ ক্যাফেতে, কলেজ ফেস্টে আঁতেল আলোচনায় -- ভাস্কর সবসমই ছিল কেন্দ্রবিন্দু। আলোচনার টপিক যাই হোক না কেন, ভাস্করের কিছু না কিছু বলার থাকতোই। রোমিলা থাপারের প্রাক-আর্য্যিক ঐতিহাসিকতা, মায় Schrödinger-এর বেড়ালের হেঁয়ালি, কখনো রবীন্দ্রনাথের double-meaning, অথবা ফ্রয়েডের হাড়-হিম করা মানব মনের নক্কারজনক কালিত্ত্ব, কিংবা রিচার্ড ডকিন্সের নাস্তিকতা। ভাস্করের কিছু না কিছু বলার থাকতোই।
সত্তরের সৌমিত্রের ভারিক্কি চশমায়, কলেজের নতুন ট্রেন্ড-সেটার -- গিক-লুকে ভাস্করের admirer-এর অভাব কখনোই ছিল না।
আর হ্যাঁ। নারীত্ব। নারীত্ব নিয়ে আগ্রহ চিরকালই ছিল ভাস্করের।
সম্ভবতঃ মায়ের খুব কম বয়সে চলে যাওয়াটা এক হার না মানা স্বাক্ষর ছেড়ে গেছিলো ওর মনে। ঘুরে ফিরে ঈশ্বর-নারীত্ব আর সৃষ্টি-তত্ব যেন বেড় হয়ে আছে ওর মনন জুড়ে।
সেই যে। সেবার।
অক্সফোর্ডের বইয়ের দোকানে, ওর লেখা প্রথম বই. "স্ত্রী, পুরানাত্মা ও অর্গাজম"-এর বুক লঞ্চ।
লেখক যেন বারবার বলার চেষ্টা করেছেন -- সৃষ্টি চক্র চালাবার জন্য, একা নারীত্বই যথেষ্ট ছিল। প্রকৃতি নর ওর নারী কেন আনল? ঈশ্বর কি অর্গ্যাসমিক?
এত কম বয়সে এরকম সেনসেশনাল একটা টপিক নিয়ে লেখা। ভিড় উপচে পড়েছে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে, বিকন আর কফির গন্ধ, আলোচনা চলছে womanhood নিয়ে। অনেকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছে।
"অনন্যা। দুর্গার আরেক নাম। মেসোপটেমিয়ার দেবী ইনান্না। সিল মোহরে পাওয়া গেছে সেই একই নারীর সিংহের পিঠে দাঁড়ানো, ক্রোধান্মত্তা অবয়ব। বা সেই নিষিদ্ধ ত্রিবর্ণা -- কালো, লাল আর সাদা কাপড়ে মোড়া, ভুলে যাওয়া সেই তিন নারী -- যাঁরা কিনা সেই মানব সত্ত্বার তিন প্রাচীন প্রতীক: তম, রজঃ আর স্বতঃ। রামায়ণের রামের সীতাকে বনবাসে পাঠানো আর দ্রৌপদীর পঞ্চ-স্বামী। ব্যাসদেবের ফেমিনিজম যেন বাল্মীকির পৌরুষের যথেচ্ছতার যোগ্য জবাব।“
পিছনের সারিতে কলেজের মহিলা মহলের ফিসফিসানি আর হাসির রোল একটানা চলছে। জুহি এসেছে একটা গোলাপির রঙের জ্যাকেট আর নীল রঙের জিন্সে। ভাস্কর কখনো কখনো তাকে দেখছে,কখনো চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।
জুহি। ওর কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের বিকম অনার্সের সোফোমোর।
জুহি ফার্নান্দেস। বাবার বিশাল বড় একটা ফুলের দোকান আছে সেক্সপিয়ার সরণিতে। একদিন ওর মা এসেছিলো কলেজে, প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলতে। দূর থেকে ভাস্কর স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে, ওর দিকে তাকিয়ে মাকে জুহি ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে, আর ওর মা মিটমিটিয়ে হাসছে।
কিছু পরে সভা শেষ হলো, শুভেচ্ছা বার্তা আদান প্রদান, কিছু বই বিক্রি হলো, কিছু সই স্বাক্ষর চলল কিছুক্ষণ। প্রফেসর খান্না, প্রফেসর ব্যানার্জি এসেছিলেন -- ওনারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেও প্রফেসর প্রীতম আনসারী শেষ অবধিই ছিলেন। ইংলিশ পড়ান -- ভাস্কর ওনার খুব প্রিয় ছাত্র। ভাস্কর তাঁর হাতে বই ধরাতে বললেন - "সবই তো বুঝলাম, ইংলিশেই তো লিখতে পারতি?"
"পরেরটায় নিশ্চয়ই চেষ্টা করব – wish me luck", প্রীতম ভাস্করের কাঁধ চাপড়ে চলে গেলেন।
রাত বাড়ছে। শীতের কলকাতা, পার্ক-স্ট্রিটের ফুটপাতে বেহালা বাজাচ্ছিল এক অন্ধ বৃদ্ধ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলো জুহি। অন্য মনস্ক হয়ে। বৃদ্ধের বেহালায় "Drink to me only with thine eyes" কেমন যেন বেসুরো ব্যাথা নিয়ে থমথম করছে শীতের বাতাস।
ভাস্কর এসে পাশে দাঁড়ালো।
চমকে উঠলো জুহি। যেন ওরই কথা আনমনে ভাবছিলো।
ওর হাতে ভাস্করের লেখা বইটা। ভাস্কর হাসলো -- "কৈ সই করালে না তো?"
ও ভাস্করের দিকে বইটা এগিয়ে দিলো।
ভাস্কর সই করতে করতে বললো -- "তুমি বাংলা পড়তে জানো?"
বইটা নিয়ে হাঁটা দিলো জুহি -- "আমি বাঙালি।"
ভুল প্রশ্ন। ভাস্কর হাসলো -- "তোমায় কখনো বাংলা বলতে শুনিনি।"
"মনে তো পড়ছে না আমাদের কখনো কথা হয়েছে বলে।"
বাবাহ...কি মেজাজ মাইরি। হাঁটার গতিবেগ বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে জুহি। আচ্ছা ও কি কথা বলতে চায় না? আচ্ছা মেয়েরা এতো অদ্ভুত কেন? অনেকবারই তো মনে হয়েছে ও কথা বলতে চাইছে। আর আজ এতো ভালো সুযোগ কথা বলার -- এখন তো কেউই সাথে নেই।
"You want me to walk you home?"
"I can manage….আমার বাড়ি সামনেই -- but thanks for asking, though....।", খুব তাড়াতাড়িই একবার ভাস্করের দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাসলো -- "আচ্ছা, চলি তাহলে....ok, bye!"
ভাস্কর যখন bye বলল, তখন ও অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
ভাস্কর পকেটে হাত গুঁজে কিছুক্ষণ ভাবলো। ওর জীবনটা খুব অদ্ভুত, তাই না? মা জন্মের পরই মারা গেলো, বাপ-টা থেকেও নেই। মামার বাড়িতে এঁটো-কাঁটা কুড়িয়ে বাড়িয়ে খেয়েই বড় হয়েছে। বন্ধু, বান্ধব, কলেজ, টোস্ট-মাস্টার, ফাস্ট, ক্যান্টিন -- যাই থাকুক না কেন....সবই যেন কেমন উপরি উপরি। ওকে কিন্তু কারোরই দরকার নেই। ওই যেন জবরদস্তি সবার সাথে মিশতে চায়।
ম্যাগসে আকন্ঠ ভদকা গিলে বাড়ি ফিরলো যখন তখন প্রায় একটা বাজে। কেউই জেগে নেই। খাটে উল্টে পরে ঘুম আসতে মোটেই বেশি সময় লাগেনি।
সেদিন রাতে ভারী অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছিলো ও।
ছোটবেলার এক দূর্গা পুজো। আজ দশমী। ঢাকের আওয়াজে কান ফেটে যাচ্ছে। অনেক লোক, ধুনুচি নৃত্য হচ্ছে। অনেক মহিলা সুবেশে সিঁদুর আদান প্রদান চলছে।
ও আসতে আসতে একটু এগুলো -- দূর্গা ঠাকুরের মূর্তি নামানো হচ্ছে, বিসর্জনে বেরোবে সবাই একটু পরে।
পিঠের ওপর হঠাৎ একটা হাত পড়লো। চমকে উঠলো ও। ফিরে তাকিয়ে দেখে -- মা। সিঁদুর লেপ্টে আছে কপালে, চোখে জল। মা কাঁদছে।
আর আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছে। দূর্গা ঠাকুরের দিকে।
হ্যাঁ দূর্গা ঠাকুর ও কাঁদছে।
তবে দুর্গার মুখ যেন খুব চেনা। ও আরো দু পা এগিয়ে গেলো। হ্যাঁ। এই দুর্গাকে আমি চিনি, তাই না?
জুহি।
কপালে রক্ত। জুহি কাঁদছে।
এক ঠেলা মেরে ফেলে দিলো দুর্গাকে জলে।
পিছনে দাঁড়ানো অনেক লোক। পাশবিক উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো।
২.
পরে জুহি নিজে এসে কথা বলেছিলো। লাইব্রেরিতে। সেদিন সে রাতের ওরকম ব্যবহার করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। বেশ ভয় লেগে গেছিলো নাকি ওর। অত রাতে, একা ওরকম ভাবে কারোর সাথে বাড়ি ফিরতে দেখলে আর যাই হোক ওর বাবা ব্যাপারটা সহজভাবে নিতেন না।
"বইটা কেমন লাগলো?"
জুহি হেসেছিলো -- "ভালো, তবে মনে হয় কিছু কিছু জায়গায় একটু বাড়াবাড়িই করেছো। পুরুষদের নিয়ে এতো বাজে কথা নাই বলতে পারতে। সব পুরুষ সমান নয় -- অন্তত আমার বাবা তো নয়ই।"
জুহি চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলো ভাস্কর। আমি গেলে তোমার বাবা রাগ করতো, আর এখানে তুমি আমার সাথে অবাধে কথা বলছ, এটাকে কি হিপক্রিসি বলে না?
জুহি লাইব্রেরিতে প্রায় আসতো। হয়তো ভাস্কর লাইব্রেরিতে এতো যেত বলেই হয়তো। লাইব্রেরিতেই ওদের প্রথম হাত ধরা, লাইব্রেরিতেই প্রথম চুমু। লাইব্রেরিতেই প্রথম বার বলা -- "I love you..."
পাশ করার পর একটা চাকরি পেয়েছিলো ভাস্কর। একটা advertising agency-তে। এমনিতে লিখতে পড়তে সে বেশ ভালোই পারতো। কথা বলার ক্ষমতাও বেশ ভালোই ছিল। বেশ চান্সেই চাকরিটা হয়ে গেসলো।
সে মাসেই জুহির বাড়িতে কথা বলা।
সে মাসেই জুহির বাবার হার্ট এটাক। জুহি আর ভাস্করের বিয়েটা ঠিক মানতে পারেননি উনি। ওর পরিবারের ধার্মিক ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে মেয়ে অন্য কোনো ধর্মের মানুষকে বিয়ে করবে, ভদ্রলোক এটা মানতে পারেননি। এটা পাপাচার।
Blasphemic...
ভাস্কর বুঝে পায়নি সেদিন, কি করে মানুষের বানানো কিছু নিয়ম কানুন দুটো মানুষের ভালোবাসাকে পাপাচার বলে আখ্যা দেয়।
জুহির মা ধর্মান্ধ ছিলেন না। ভাস্করের কথা আগের থেকেই জানতেন।
কিন্তু জুহির বাবা যে চলে যাবেন সেটা ভাবতেই পারেননি।
বেশ কিছু ঘুমের ওষুধ মুখে ঠুসে সেই যে দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়লেন, আর ওঠেননি।
জুহি আর ভাস্করের বিয়েটা একান্তই একাকিত্বে হলো। কেউই আসেনি সেদিন। জুহির এক বন্ধু গৌতম আর প্রফেসর প্রীতম আনসারী ছাড়া।
৩.
প্রথম প্রথম সবই ভালো ছিল।
ভাস্করের কসবার ফ্ল্যাটে দুজনের বচসা, ভালো, মন্দ, আড্ডা, ইয়ার্কি -- এ যেন এমনটাই চেয়েছিলো ভাস্কর। কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই কারোর। যখন খুশি, যা খুশি করো। অনেক রাত অবধি ভাস্করের গান গাওয়া, জুহির হঠাৎ খেয়াল হলো -- নাচতে শুরু করলো। ভালোই নাচতো ও। নাচ শিখেছিল বলেই নি। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জুহির দিকে চেয়ে থাকতো ভাস্কর। বিশ্বাসই হয় না -- তাই না? কলেজের প্রেম, তাও আবার বিয়ে অবধি গড়ানো -- এতো খুবই কম শোনা যায়। জুহি একটা চাকরিও পেলো। ওয়েবেল মোড়ে অফিস, বাস জার্নি করে অফিস যেতে যেতে বেশ হাঁফিয়েই উঠছিল বেচারি। অনেকবারই বলেছে ভাস্করকে সে কথা। শেষমেশ ঠিক হলো, কসবা থেকে উঠে সল্টলেকেই যাবে, করুণাময়ীর কাছে একটা ওয়ান BHK-- ভাড়াটাও তেমন নয়।
ঠিক এক বছরের মাথায় ভাস্করের প্রমোশন। ম্যানেজার থেকে এরিয়া ম্যানেজার। ওর বস মিস্টার মিত্তাল খুবই খুশি ওর কাজে। এখন তো ঘন ঘন দিল্লি-বম্বে করতে হয় ওকে। উইকেন্ডেও খুব একটা সময় হয় না।
প্রায় দেড় বছরের মাথায় অফিসে বসে লাঞ্চ টাইমে একটা ফোন।
জুহির ফোন।
ও ফোনটা কাটতেই যাচ্ছিলো -- ধরা যায় না সব সময় কল। এখন একটা লম্বা স্ক্রাম কল চলছে। মিস্টার মিত্তাল ইশারা করলেন -- "take the call"।
"হ্যালো?", গলা নিচু করে কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এলো ভাস্কর।
"একটা বড় গন্ডগোল হয়েছে।", জুহির গলাটা ফ্যাকাসে।
"কি?"
"মানে বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম। আজ পাক্কা খবর পেয়েছি।"
"কি হয়েছে?", ভাস্করের বেশ ভয়ই লাগলো। ওদের পাড়াটা অফিস পাড়ার কাছে হলেও, বেশ ঝামেলা হচ্ছিলো কিছুদিন ধরেই। জুহির কোনো গন্ডগোল কি? ও তো আজ বাড়ির থেকেই কাজ করছে।
জুহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ফোনটা নিয়ে।
"কি হয়েছে বলবি তো?"
"হুম....."
"আরে ধ্যাৎ -- বল না?"
আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ও বললো -- "একবার Whastappটা এখনই চেক কর....Urgent...."
তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে Whatsappটা খুলে দেখা গেলো - একটা অস্পষ্ট ছবি।
ছবিটা ডাউনলোড হতে বেশ সময় লাগছে।
দূর শালা -- এখানে নেটওয়ার্কটা এতো ঝোলের....
ফটোটা লোড হতে পাক্কা ২ মিনিট নিলো।
আরে....এটা কি?
এটা তো একটা প্রেগন্যান্সি কীট....জুহির হাতে ধরা কীটটার মাঝামাঝি দুটো গোলাপি রঙের লাইন।
***
বেশ অবাক লাগছিলো ভাস্করের। বাবা? আমি বাবা হতে চলেছি? প্রথমে হাসি পেলো, তারপর পিঠের ওপর দিয়ে কি যেন একটা হাটছে টের পেলো। না না....সিরিয়াস হতে হবে জুহিকে নিয়ে। পাগলিটা যে কি করে! ওর রক্ত খুব কম ছিল। মোটে ৭.৫ -- অনেক ওষুধ-বিশুধ খাইয়েও কোনো লাভ হলো না। এদিকে দিন ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। ভাস্কর তো এখন রাতে মোটামুটি জেগেই থাকে। যদি কিছু হয়। যদি ব্যাথা শুরু হয়। অফিস যেতে পারে না -- মিত্তাল সাহেব তো বলেই দিয়েছেন বাড়ির থেকে কাজ করার জন্য।
ও হাসে।
আজ জীবনে এক অদ্ভুত সম্পূর্ণতা। আজ তার চারপাশে অনেক সত্যিই আছে যারা ওর কথা ভাবে। যাকে ভালোবাসতাম তাকেই বিয়ে করেছি। ভালো চাকরি। প্রাচুর্য্য। জুহির কোল আলো করে আসতে চলেছে ওর সন্তান। একটা মানুষের চাইবার যা পরাকাষ্ঠা থাকতে পারে - সবই তো এসেছে তার জীবনে, তাই না?
না, ঠিক তা নয়।
নিয়তি যে একরম একটা ভয়ানক টুইস্ট রেখে দিয়েছিলো -- ভাস্কর কল্পনাতেও আনেনি।
৪.
হ্যাঁ।
জুহির যা রক্ত ছিল, তাতে অনেক ড্রিপ দিয়েও ওকে বাঁচানো যায়নি।
বারোটা সাত গতে, শনিবার রাতে মেয়েটা জন্মানোর ঠিক আধা ঘন্টার ভিতর জুহির পালস ভয়ানক ভাবে পড়তে থাকে। নিয়ে যাওয়া হয় হাইপার কেয়ারে।
জুহির হাত ঠান্ডা। এগিয়ে দিলো ভাস্করের দিকে। কাছে ডাকছে।
ভাস্কর এগিয়ে এলো। পা ঝিমঝিম করছে -- "no...Don’t do this to me....", ভাস্করের ঝিম ধরা গলায় ফিসফিসানি।
কি যেন....কি যেন বলছিলো জুহি।
"কাছে এসো....আমার কাছে এসো...."
মন্ত্রমুগ্ধের মতন এগিয়ে এলো ভাস্কর।
"এটা....এটা মিত্তালজি'র মেয়ে", জুহি তোয়ালেতে জড়ানো সদ্যজাত মেয়ের মাথায় হাত বোলালো -- "তোমার....তোমার জন্যই আমায় এটা করতে হয়েছে...মিত্তালজি তোমায় অনেক আগেই কাজ থেকে বের করে দিচ্ছিলো...আমার...শুধু আমার কথায়ই তোমায় রেখেছে..."
মেদিনী যেন দ্বিখন্ডিত হচ্ছিলো। ঘৃণা..ঘৃণায় ইচ্ছে করছিলো হাসপাতালের টেরেসের থেকে লাফ মারতে।
"আমার চাকরিটাও ওনারই জন্য পাওয়া..আজ আমাদের যা কিছু, সবই ওনার জন্য..."
ভাস্করের গা গোলাচ্ছিলো...
কি বলছে জুহি এসব?
"শেষ একটা...শেষ একটা অনুরোধ...", জুহির চোখে জল -- "এই মেয়েটাকে নিজের বলেই ভেবো...প্লিজ।"
এক ধাক্কায় দুতিন-জন নার্স আর ডাক্তার এসে ওকে সরিয়ে দিলো -- "সরুন সরুন...নার্স ! ...defibrillators, প্লিজ..."
অনেক লোকের পিছনে মিশে গেলো ভাস্কর।
জুহি...
জুহির চোখটা কিন্তু ওরই দিকে স্থির হয়ে রইলো -- শেষ মুহূর্তের মহালগ্ন অবধি।
***
সেই রাতে সেই স্বপ্নটা আবার এলো।
অনেক লোকের ভিড়ে দূর্গা ঠাকুর কাঁদছে...না, না....দূর্গা না....ওটা তো জুহি।
বিসর্জনের দুর্গা। ধাক্কা মেরে জলে ফেললো দুর্গাকে।
৫.
সে অনেক বছর আগের কথা। আজ জুহির মেয়ের বয়স পাঁচ বছর। কথা জট না বলে, হাঁসে বেশি। অদ্ভুত চেনা চেনা হাঁসি।
সবদিন সমান যায় না।
ওর নাম -- না, না....নামটা ভাস্কর রাখেনি। নামটা মিত্তালই রেখেছিলো।
অনন্যা।
খুব রাগ হয় নিজের ওপর। খুব রাগ হয় জুহির ওপর। খুব রাগ হয় মিত্তালের ওপর। সেদিনই বের করে দিছিলো আমায় চাকরি থেকে? শুধু জুহির কথায়ই রেখেছে? ঘেন্না, খুব ঘেন্না লাগে। এই চাকরিতে -- এই মাইনের টাকায় ওদের দুজনের নিষিদ্ধ ঔরস লেগে আছে।
ছিঃ !
আর শেষে ভাস্কর ঠিকই করে নিলো।
ভালো করে গুছিয়ে resignation লেটার টাইপ করে, মিত্তালের ঘরে রেখে দিয়ে, অকথ্য গালাগাল দিয়ে ছেড়ে বেরিয়ে এলো: মিত্তাল ইনফোরম্যাটিক্স।
বালের ইনফরমেটিক্স। এরকম চাকরির একশ-আটবার।
মিত্তাল সেদিন অন্তত আঠারো বার ফোন করেছিল ওকে। বোঝাবার জন্য। ও ফোন ধরেনি।
***
না, না....হিসেবে একটু গড়বড় হয়ে গেলো যে।
রোগটা যে কি প্রথমে বোঝা যায় নি। প্রথমে একটু একটু করে, তারপর মারণাত্মক বেগে গোটা পৃথিবীকেই খেয়ে নিতে শুরু করলো। হাজার হাজার মানুষ, অ কারণে মরতে লাগলো। যে মানুষটি আজ থেকে দু সপ্তাহ আগেই অবধি আচ্ছা খাসা বেঁচে ছিল -- হঠাৎ আজ সে নেই। বন্ধ হচ্ছে বাজার, বন্ধ মানুষের ,রাস্তায় বেরোনো। বন্ধ হচ্ছে অফিস, বন্ধ হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়। বন্ধ হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাস, ধরিত্রী জোড়া মানুষের মৃত্যু মিছিলে।
করোনা'র কামড়ে সারা পৃথিবী লক-ডাউনে ভুগছে। কাজ আসা বন্ধ হচ্ছে, অফিসে নতুন লোক নেওয়া বন্ধ হচ্ছে, শুধু চলছে বে-লাগাম কর্মী ছাঁটাই।
নাহঃ...চাকরি খুঁজে আর পাওয়া গেলো না ভাস্করের।
জুহির মতনই কোথায় যেন সব হারিয়ে গেছে।
কিন্তু কি করা যায়? আজ যে টাকার খুব দরকার। নেশা। হেরে যাবার দুঃখ ভোলার জন্য, জুহিকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ, অর্থহীনতার দুঃখ,বেকারত্বের দুঃখ, দুর্দম frustration ...এই যে....এই যে -- এটা যে আমার সন্তান নয় -- সেটার চেয়ে বড় দুঃখ কিছু আছে?
এতো কিছু ভুলতে হবে। এতো কিছুকে হারাতে হবে কব্জির জোড়ে -- আর এর থেকে পালাবার একটাই রাস্তা।
ভাস্কর তাকালো শেষ পরে থাকা কালো বোতলের লাল তরলের তলানীর দিকে।
মেয়েটা হাঁসতে হাঁসতে এগিয়ে আসছে ছোট ছোট পায়ে -- "বাবা...."
"চুপ শালী -- বলেছি না আমি তোর কেউ হই না -- ", বোতলটা উঠিয়ে প্রচন্ড জোরে ওটা ওর মাথায় ভাঙতে উদ্যত হলো ভাস্কর --
ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠলো ভাস্করের।
"শুন", গলাটা আবার শুনে হাড় হিম হয়ে গেলো ভাস্করের -- "তু রেডি হ্যায় না?"
গলাটা কেঁপে উঠলো উত্তর দিতে -- "হ্যাঁ...."
"গালা কিঁউ কাঁপ রেহি হ্যায় বে তুম্হারী?", লোকটা থুথু ফেললো বিশ্রী আওয়াজ করে -- "কাল লাস্ট মিনিট-মে মেরেকো কোয়ি ড্রামে বাজি নেহি চাহিয়ে। সমঝা না?"
ফোনটা রেখে দিলো ভাস্কর।
হ্যাঁ, হ্যাঁ...এতো ভয়ের কি আছে? আমার...আমার টাকার দরকার। আর তার জন্য যা খুশিই করতে পারি।
***
লক ডাউন।
হ্যাঁ খানিকটা লক ডাউন উঠেছে। তাতেই অনেকে অনেক জায়গায় যাতায়াত করার সুযোগ পেয়েছে।
গাড়িটা ওদেরই। বড় জিপ। পিছনে লেখা আছে মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি। গাড়িটা চালাচ্ছে নেপালি মাঝ বয়েসী লোক, বাঁ গাল ক্ষত বিক্ষত। সামনের সিটে একজন বসল। আর পিছনের সিটে আরেকজন।
হ্যাঁ -- পাক্কা ১৪ ঘন্টা লাগলো NJP পৌঁছাতে। সেখান থেকে গাড়ি বদল করে আবার পাহাড়ে ওঠা।
"বাচ্ছি-কো সোয়েটার পাহেনা দে", চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলল পিছনের লোকটা -- "বীমার পড়েগি নেহি তো...."
নিকুচি করেছে...মরুক, বাঁচুক আমার কি? মেয়েটাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো ভাস্কর।
গাড়ি পাহাড়ে উঠছে। হালকা হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় দিচ্ছে। জুহি খুব পাহাড় ভালোবাসতো। জানলার কাঁচ নামিয়ে থুথু ফেললো ভাস্কর। নামটা ভাবলেই আজকাল গা গোলায়।
হ্যাঁ...লেপচা-জগৎ পৌঁছাতে লাগলো পাক্কা তিন ঘন্টা। পাক খেতে খেতে উঠতে উঠতে, মেয়েটা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাস্কর জানেই না। ভালো হয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পড়লে, চুপ চাপ ওকে ওদের হাতে দিয়ে কেটে পড়তে হবে। জেগে গেলেই কান্না কাটি শুরু করবে।
একটা কালো জিপ। এক ভয়ানক গিরি-কন্দের পাশে, নিচে -- অনেক নিচে খলখল করে বয়ে চলেছে রঞ্জিত নদ।
একটা লম্বা মাফলার দেওয়া লোক। কালো রঙের জ্যাকেট।
"বাচ্ছি কো লা -- ", হুকুমের সুরে বলল।
"আগে আমার টাকা", ভাস্কর ও জেদ ধরলো।
ভারী ব্রিফকেসটা এগিয়ে দিলো আরেকটা নেপালি লোক -- "গিন লে -- পুরি সাড়ে তিন হ্যায়.."
না। গোনার সময় নেই। এরা মিথ্যে বলছে না ভাস্কর জানে। মিথ্যা বললে আর যাই হোক গুনতে বলতো না।
ভাস্কর ব্রিফকেসটা হাতে নিতেই -- জেগে উঠলো মেয়েটা লম্বা লোকটার কোলে। লোকটা হাঁটা দিলো জীপটার দিকে। মেয়েটা তাকিয়ে আছে ভাস্করের দিকে।
একটা অদ্ভুত হাঁসি ঠোঁটে।
এর পরে এক ঝলকে ভাস্কর পরিষ্কার দেখতে পেলো সব কিছু।
দূর্গা। দুর্গার প্রতিমূর্তি।
কে যেন ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলছে -- "কি রে...চিনতে পারলি না আমায়? এতদিন ধরে তোর সাথে রইলাম -- চিনতে পারলি না আমায়?"
কোথায় যেন বাজে পড়লো। এক গগন ভেদানো অট্টহাসি -- "কি করে চিনবি -- সারা জীবন নিজেকেই চিনতে পারলি না তো আমায় কি করে চিনবি?"