(প্রথম পর্ব)
- "বাড়িটা কিন্তু চমৎকার! বলো শম্পা?"
- "মন্দ নয়। তবে আমার একটাই আপত্তি, আজকালকার দিনে এত বিশাল অট্টালিকার মতো বাড়ি কে কেনে গো? এতটা বড় জায়গা....বাগান....ফোয়ারা....উফ্! কে মেন্টেইন করবে এত্তসব? আমার তো ভাবলেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে।"
- "হাহা!" হাসিটা আর চেপে রাখতে পারলাম না, "আরে সে নাহয় ঝি-চাকর লাগিয়ে সব কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে'খন। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো, আজকের যুগে এইটা কয়েক কোটি টাকার প্রপার্টি। আর আমরা পেয়ে গেলাম মাত্র কুড়ি লক্ষ টাকায়....ভাবতে পারছ?"
- "সেখানেই তো আমার খটকা, মিস্টার সরকার এমন জলের দরে এই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটা কেন বিক্রি করলেন বলো তো?"
- "ভদ্রলোক বিপত্নীক। তাঁর একমাত্র মেয়ে-জামাই বিয়ের পরে পাকাপাকি ভাবে এখানকার বাস উঠিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পর উনি আর কদ্দিন যক্ষের ধনের মতো বাড়িখানা আগলাতেন? ভাগ্যিস আমার প্রোমোটার বন্ধুটার মারফৎ এই বাড়ির সন্ধান পেলাম!"
- "কে জানে বাবা!" সন্দিহান চোখে বাড়িটা জরিপ করতে-করতে শম্পা বলল, "সব ভাল হলেই ভাল।"
দেখেই বোঝা যায় যে বাড়িটা স্বাধীনতার বহু বছর আগেই বানানো হয়েছিল। শোনা যায়, ব্রিটিশ আমলে বাড়িটা ছিল গভার্নমেন্ট প্রপার্টি। তখনকার দিনে বাড়িটা "ইন্সপেকশান বাংলো" হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্বাধীনতার পর অনেক হাত ঘুরে আজ এই বাড়িটা আমার, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ম্যানেজার প্রতীক ঘোষের মালিকানাধীন। গতানুগতিক ব্রিটিশ স্থাপত্য, বাইরে বড় বাগান। আর সেই বাগানের ঠিক মাঝখানে শ্বেত পাথরের একটা ফোয়ারা....যদিও ফোয়ারার পরীর ডান হাতটা বহুকাল আগেই বেপাত্তা হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাগানটাও বেশ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। সত্যি, সরকার বুড়ো এই বাড়ি নিয়ে মোটেই কুলিয়ে উঠতে পারছিল না!
অবশ্য বাইরের তুলনায় বাড়ির ভিতরটা কিন্তু অনেকটাই পদের। বৈঠকখানার বড় ফায়ারপ্লেসটা আজও বহন করে চলেছে ইংরেজ আমলের সাহেবিয়ানা। তবে অন্যান্য আসবাবপত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে বেডরুমের বড় গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা। কালচে-মেরুন ওয়ালনাট্ কাঠ দিয়ে তৈরি। উচ্চতায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। পেন্ডুলাম আর ঘড়ির কাঁটাগুলো সম্ভবতঃ রূপোর উপর সোনার জল করা। জিনিসটা সত্যিই খাসা বটে! কোনও অজ্ঞাত কারণে সরকার বাবু বাড়ি ছাড়ার আগে জিনিসটা নিজের সাথে নিয়ে যাননি। শম্পা চিরকালের খুঁতখুঁতে, তবে গোটা বাড়ির মধ্যে শুধু এই একটিমাত্র জিনিসই ওর কিছুটা মনে ধরেছে। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব আছে ঘড়িটার মধ্যে। ওইটা যেন শুধু কাঠ-ধাতু ইত্যাদি দিয়ে গড়া কোনও জড় বস্তু নয়, জিনিসটার নিজস্ব একটা প্রাণ আছে। কাঠের শুষ্ক আবরণের তলায় কোথাও একখানা জীবন্ত হৃদয় ধুকপুক করছে। ঘড়িটা এত বছর ধরে এক নির্লিপ্ত দার্শনিকের মতো মানুষের সব কাণ্ডকারখানা নীরবে লক্ষ্য করে চলেছে। শুধু যেন কিছুক্ষণ পরপর মানুষের অফুরন্ত মূর্খামিগুলো প্রত্যক্ষ করতে-করতে একটা হতাশায় ভরা ধাতব দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ঘড়ির বুক ঠেলে:- ঢং ঢং ঢং!!
দেখতে-দেখতে নতুন বাড়িতে একটা মাস দিব্যি কেটে গেল। প্রাথমিক দোলাচলটা কাটিয়ে শম্পাও এখন অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। বাড়ির ভিতরটা সাজিয়ে তুলেছে নিজের মতো করে। আর বাইরেটা সামলে নিয়েছি আমি। এককাঁড়ি টাকা খরচ করে লোক-লস্কর লাগিয়ে বাইরের বাগানটার হাল কিছুটা হলেও ফেরানো গেছে। পরে সময় করে বাড়িটা একবার রং করিয়ে নিলেই হবে।
প্রতিদিন নিজস্ব গাড়ি করেই ব্যাঙ্কে যেতাম, তবে এইমুহূর্তে আমার ড্রাইভার সাধন দা তার কন্যার বিয়ে উপলক্ষ্যে দিন দশেকের ছুটি নিয়ে গ্রামে গেছে। এই ক'দিনের জন্য সকাল আটটার বাসটাই আমার একমাত্র ভরসা, সুতরাং সাতটার মধ্যে উঠে পড়া অনিবার্য। অবশ্য এ নিয়ে এতদিন তেমন সমস্যা হয়নি....বেশ একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছিল সকাল-সকাল ওঠার। তার উপর শয়নকক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্যিকালের সেই বিশ্বস্ত ঘড়ি। সাত বার নিজের গুরুগম্ভীর ধাতব ঝঙ্কার শুনিয়ে সুনিপুণ ভাবে আমার তন্দ্রা কাটিয়ে দেয় প্রতিদিন। অন্তত বিগত কয়েকদিন ধরে তো এমনটাই হয়ে আসছে।
কিন্তু ছন্দপতন ঘটল একদিন বুধবারে। ঘুম জড়ানো চোখ মেলে দেখি, বিছানায় সকালের চড়া রোদ এসে পড়েছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চকিতে ঘড়ির দিকে তাকালাম....তিনটে বেজে সাত মিনিট। এতদিন ধরে দেখে আসা দোদুল্যমান পেন্ডুলামটা আজ অদ্ভুত রকমের স্থির। হাতড়ে-হাতড়ে মোবাইল বের করে টাইম দেখলাম, সকাল সাড়ে আটটা। মাথাটা বেজায় গরম হয়ে গেল।
- "সবিতা দি, সবিতা দি!"
হন্তদন্ত হয়ে সবিতা দি ছুটে এল।
- "কী হয়েছে দাদাবাবু?"
- "কাল বিকেলে ঘড়িতে দম দেওয়া হয়নি কেন? জানো তোমার এই বোকামির জন্য আজ আমি এখনও পর্যন্ত কাজে বেরোতে পারলাম না?"
- "সেকি দাদাবাবু! আমার তো ভালই মনে আছে....ঘড়িতে আমি কাল চাবি দিয়ে রেখেছিলাম।"
- "তাই নাকি?" আমি ঘড়ির দিকে ইশারা করলাম, "তাহলে ওইটা কী?"
সবিতা দি হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করল-
- "এত বড় ভুল আমার হয় কেমন করে? আমার পরিষ্কার মনে আছে, বিকেলে ঘড়িতে চাবি দিয়েই আমি বাড়ি গেছিলাম। রোজ তাই করি।"
এবার যেন আমার মনেও একটু ধাঁধা লাগল। ঘড়ি তো বন্ধ, কিন্তু সবিতা দি এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বার-বার যখন বলছে যে সে দম দিয়েছে....তখন সেই কথাটাও তো ফেলে দেওয়া যায় না।
- "যাই হোক, তুমি এখন যাও। আমি দেখছি কী করা যায়।"
- "আচ্ছা দাদাবাবু।"
সবিতা দি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি নিজে ঘড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাল করে পরীক্ষা করে বুঝলাম, সবিতা দি একদম সত্যি কথাই বলছিল। ঘড়িতে পুরো দম দেওয়া রয়েছে। এদিকে আমার চেঁচামেচি শুনে শম্পারও ঘুম ভেঙে গেছে।
- "কী হয়েছে গো? সকাল-সকাল এত গোলমাল কীসের?"
- "আর বোলো না! ঘড়িটা বিগড়েছে। এর চক্করে আজ বাসটা মিস্ করলাম। আমারই দোষ, মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলেই ভাল হতো।"
- "ও মা তাই তো! আমারও তো উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল। কী হবে এখন?"
- "কী আর হবে? আজ ট্যাক্সি ধরেই কাজে যাই, বাড়ি ফিরে জিনিসটা মেরামত করানোর ব্যবস্থা করছি।"
****************
কোনও অজানা কারণে সেদিন ব্যাঙ্কে কাজটা একটু বেশিই ছিল। এক মনে কাজ করছি, হঠাৎ দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ আমার মোবাইলে এক অচেনা নম্বর থেকে কল এল।
- "হ্যালো?"
- "হ্যালো, আমি কি মিস্টার প্রতীক ঘোষের সঙ্গে কথা বলছি?"
- "হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?"
- "আমি মেডিলাইফ হস্পিটাল থেকে সিস্টার সুজাতা বলছি। আপনার ওয়াইফের একটা মাইনর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন। উনি বার-বার আপনাকে দেখতে চাইছেন।"
হন্তদন্ত হয়ে হস্পিটালে ঢুকে দেখি, দুজন নার্স শম্পার হাতটা ড্রেসিং করছে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন।
- "এ যাত্রায় খুব বাঁচা বেঁচে গেছে আপনার স্ত্রী, মিস্টার ঘোষ। ভাগ্য ভাল যে বড় কোনও ইঞ্জ্যুরি হয়নি।"
- "কী হয়েছিল ডাক্তার বাবু? কীভাবে হল এসব?"
- "উনি বোধহয় খানিকটা আনমনা হয়ে রাস্তা পারাপার করছিলেন। উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি এসে....ভাগ্যিস গাড়ির চালক সময় মতো ব্রেক কষেছিলেন! গাড়ির ধাক্কা খেয়ে উনি রাস্তায় পড়ে যান। কোনও মেজর ইঞ্জ্যুরি হয়নি, শুধু পড়ে যাওয়ার ফলে ওনার ডান কনুইয়ে আঘাত লেগেছে। আমরা ভাল করে জায়গাটা ওয়াশ করে ড্রেসিং করে দিয়েছি। আপনি এই ওষুধগুলো কিনে সময় মতো খাওয়াবেন। এ ছাড়া চিন্তার কিছু নেই।"
শম্পা কী একটা যেন বলতে গিয়েও বলল না। আমিও ওর যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে বেশি কথা বাড়ালাম না। ওষুধপত্র কিনে ট্যাক্সি ধরে আমরা দুজন সোজা বাড়ি ফিরে এলাম। রাস্তায় এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও আলোচনা হয়নি।
ঘরে ফিরে শম্পার জন্য এক গ্লাস ধূমায়িত দুধ এনে ওর পাশে বসলাম।
- "এই নাও, চটপট এই গরম দুধটা খেয়ে নাও। যা বিশাল ফাঁড়া গেল আজ তোমার উপর দিয়ে! ও ভাল কথা....তুমি হঠাৎ ভর দুপুরে একা-একা বেরোতে গেলে কোন আক্কেলে?"
- "তুমি তো সকাল-সকাল কাজে বেরিয়ে যাও। আর সবিতা দিও সকালের কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরে যায়, আবার আসে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। তার মাঝে এতটা দীর্ঘ সময় এই বিশাল অট্টালিকায় আমাকে একাই কাটাতে হয়। কার ভাল লাগে একা-একা ভূতের মতো এখানে ঘুরে বেড়াতে? আর....তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, দিনের বেলাতেও এখানে একা থাকতে আমার বেশ গা ছমছম করে। তাই আজ ভাবলাম একা-একা বাড়িতে না পড়ে থেকে বাজার থেকে তোমার জন্য একটা টি-শার্ট কিনে আনি।"
- "টি-শার্ট?"
- "হ্যাঁ, আসলে সামনের পাড়াতে জামা-কাপড়ের নতুন একখানা দোকান খুলেছে। ওখানে একটা টি-শার্ট আমার খুব পছন্দ হয়েছিল তোমার জন্য। অনেকদিন ধরেই কেনার কথা ভাবছিলাম। তাই ঠিক করলাম আজকে জিনিসটা নিয়েই আসব। কিন্তু রাস্তা পার করতে গিয়ে কোত্থেকে যে কী হয়ে গেল...."
- "আচ্ছা শম্পা, তুমি কি দেখতে পাওনি যে একটা গাড়ি তোমার দিকে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে?"
শম্পার মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল। খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে কী একটা যেন ভাবল।
- "যদি সত্যিটা বলি তাহলে বিশ্বাস করবে?"
- "বিশ্বাসযোগ্য হলে অবশ্যই করব।"
- "আমি রাস্তা পার করব বলেই ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার ঠিক মাঝ-বরাবর বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না না, আসলে 'দাঁড়িয়ে আছে' বলাটা ভুল হবে। কেমন যেন মাটির থেকে কয়েক ইঞ্চি ঊর্ধ্বে ভাসছে। নরম ধোঁয়ার মতো শরীরটা....আর সেই সূক্ষ্ম দেহ ভেদ করেই রাস্তার গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা একদম নির্বিকার ভাবলেশহীন মুখে ভেসে রয়েছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। ওর দৃষ্টি সরাসরি আমার মুখেই নিবদ্ধ ছিল।"
- "বুঝলাম। তারপর?"
- "তারপর মেয়েটা নিজের শীর্ণ একখানা আঙুল তুলে আমাকে ইশারা করল। ঠিক যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে নিজের কাছে ডাকছে। ওর অঙ্গুলিহেলনে কী যে আকর্ষণ ছিল আমি জানিনা, কিন্তু আমিও সেই ডাকে জগৎসংসার ভুলে রাস্তার মাঝে ছুটে গেলাম। তখনই উল্টোদিক থেকে আসছিল গাড়িটা...."
শম্পা দু'হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে ডুকরে উঠল। পুরো বৃত্তান্ত শোনার পর আমিও একটু থতমত খেয়ে গেছিলাম। শুধু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
- "মেয়েটা কে আর দেখতে পেলে না?"
- "না গো, আমি গাড়িতে ধাক্কা খাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে স্পষ্ট দেখেছিলাম, মেয়েটা কোত্থাও ছিল না। যেন কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছিল।"
- "কেমন দেখতে ছিল ওই মেয়ে?"
- "রোগা। গায়ের রং অস্বাভাবিক রকমের ফর্সা....কেমন যেন বিবর্ণ। মাথায় পাতলা সোনালী চুল। পরনে একটা নীল গাউন। হাতে সাদা গ্লাভস্। দেখে মনে হল যেন মেয়েটা এই দেশের নয়, বিদেশিনী।"
শম্পার সঙ্গে আমার বৈবাহিক জীবন মাত্র চার মাসের। তবু এইটুকু সময়তেই ওকে যা চিনেছি, তাতে কখনও ওকে মিথ্যেবাদী বা অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ বলে মনে হয়নি। তাছাড়া ঘটনার বিবৃতি দেওয়ার সময় ওর চোখমুখের যা অবস্থা হয়েছিল, তা দেখে ওর উপর সন্দেহ করার কোনও অবকাশই থাকে না।
তখন কি আর জানতাম যে আসল ধাক্কাটা খাওয়া এখনও বাকি ছিল! হঠাৎ আমার চোখ পড়ে সেই ঘড়ির দিকে। যেই জিনিসটা কিছু সময় আগে পর্যন্ত নিথর নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তা এখন দিব্যি আগের মতোই টিকটিক করে চলছে। পেন্ডুলাম দুলছে নিজের তালে। সময় দেখাচ্ছে সন্ধ্যে পৌনে আটটা। পকেট থেকে ফোনটা বের করে টাইম মেলালাম....একদম সঠিক সময় দেখাচ্ছে ঘড়িটা!
- "তুমি কি মিস্ত্রি ডেকে ঘড়িটা সারিয়েছ শম্পা?"
- "ঘড়ি? কই না তো। তুমি বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আমিও বেরিয়ে পড়েছিলাম মার্কেটের উদ্দেশ্যে। আর তার পরেই তো অ্যাক্সিডেন্ট, হাসপাতাল...."
- "বুঝলাম। তাকিয়ে দেখো, ঘড়িটা আবার চলতে শুরু করেছে। তবে আমি একটা কথাই বুঝতে পারছি না। যদি ধরে নেওয়া যায় যে ঘড়িটা কোনওভাবে আপনা থেকেই আবার চলতে শুরু করেছে, তা হলেও তো ঘড়ির কাঁটা কয়েক ঘণ্টা স্লো চলার কথা। একদম সঠিক সময় দেখাচ্ছে কেমন করে বলো তো?"
- "সত্যিই জানিনা বিশ্বাস করো; আমি তো আজ পর্যন্ত জিনিসটায় হাতই দিইনি।"
(দ্বিতীয় পর্ব)
এরপর আরও আট মাস কেটে গেছে। ঘড়িটাও তারপর থেকে আর কোনও সমস্যা দেয়নি। এতদিনে শম্পার মন থেকে ওই ঘটনার আতঙ্কটা অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। আজ আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। বাড়িতে এই উপলক্ষ্যে সন্ধ্যে বেলা একটা ছোটখাটো পার্টি রাখা হয়েছে, তাই বাবা-মা আজ বাড়িতে এসেছে। শম্পার মা নেই, ওর বাবার আজ পার্টিতে থাকার কথা। অনেক কাজ বাকি এখনও। রান্নাবান্নার দিকটা মা আর শম্পা দেখছে। আর বাড়ি সাজানোর দিকটা সামলাচ্ছি বাবা আর আমি। শম্পার বাবা এলে তাঁকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ব কেকটা আনতে। বেলুন দিয়ে সবকটা ঘর সাজানো হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র আলোগুলো লাগাতে পারলেই হল।
- "তোমাদের বাড়ি সাজানো কতদূর? আমাদের রান্না কিন্তু প্রায় শেষ। শুধু পায়েসটা বাকি। আচ্ছা, তোমার ব্যাঙ্ক থেকে কতজন বন্ধু আসবে গো?"
- "পনেরো জন কে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করেছি। সব মিলিয়ে ধরো পঞ্চাশ-ষাটজন মতো হবে।"
- "বেশ বেশ। তোমরা সাজানো-গোছানো কম্প্লিট করে নাও। আমি আসি, মা একা রান্নাঘরে আছেন।"
বাবা আর আমি মিলে সবে টুনি লাইটগুলো লাগাতে আরম্ভ করেছি, ঠিক তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠল। দরজার বাইরে শম্পার বাবা, এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
- "আরে বাবা, আপনি!" আমিও একগাল হেসে ওনাকে বাড়ির ভিতরে অভ্যর্থনা জানালাম, "ভাল হল আপনি বেশ আগেই এসে পড়লেন, চারটেয় এলে আমাদের বেরোতে বড় দেরি হয়ে যেত। কেক কেনা কিন্তু এখনও বাকি। তা আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল বুঝি?"
- "না না, তাড়াতাড়ি কোথায় গো প্রতীক!" শ্বশুর মশাই নিজের হাতঘড়ির ডায়াল আমার চোখের সামনে তুলে ধরলেন, "এখন সোয়া চারটে। আর বোলো না, রাস্তায় যা ট্র্যাফিক!"
- "তবে আমি যে এইমাত্র দেখলাম...."
এক ছুটে বেডরুমে এসে দেখি, যা ভয় পেয়েছিলাম ঠিক তাই। আদ্যিকালের ঘড়িটা আজ আবার দাগা দিয়েছে। কাঁটা তিনটে বেজে সাত মিনিটে স্থির। স্ট্রেঞ্জ! বার-বার একই সময়ে কাঁটা আটকাচ্ছে কেন? অবশ্য তখন আমার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর জো নেই। হাতে প্রচুর কাজ। সাতটা থেকে সব অতিথিরা আসতে শুরু করবে। তাই বেশি সাত-পাঁচ না ভেবে তড়িঘড়ি আবার কাজে লেগে পড়লাম।
****************
যাক....সমস্ত আয়োজন সময় মতো সাঙ্গ হয়েছে। অতিথিরাও সবাই একে-একে হাজির। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব, কেক কাটা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সময়টা কখন যে পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। নৈশভোজ সেরে আমি দো'তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিন-চারজন সহকর্মীর সঙ্গে গুলতানি মারছিলাম। হঠাৎ নিচতলা থেকে শম্পার গলা ভেসে এল।
- "ওগো শুনছ! একটু নিচে এসো না।"
- "কেন, কী হল?"
- "আরে তুমি তো দত্ত বাবুর ছেলের সঙ্গে আলাপই করোনি। দারুণ ব্রাইট স্টুডেন্ট, এই বছরই মাধ্যমিকে ৯৩% পেয়ে পাশ করেছে। এসো তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।"
- "আসছি দাঁড়াও।"
কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আমার পা'দুটো থমকে গেল। শম্পা দাঁড়িয়ে আছে, ওর ঠিক পাশেই এক সপ্রতিভ তরুণ। সম্ভবতঃ ওটাই দত্ত দা'র পুত্র। কিন্তু ওদের ঠিক পিছনে ভাসমান ওই ষদচ্ছ ছায়াশরীরটা কীসের? একটি কৃশকায়া মেয়ে, যার অস্থিময় দেহ কে আবৃত করে রেখেছে একটা নীলচে গাউন। হাতে সাদা গ্লাভস্। মেয়েটির দুটো গাঢ় নীল চোখের দৃষ্টি সরাসরি আমারই দিকে....যেন আমার হৃৎপিণ্ড ভেদ করে শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিতে চাইছে।
ভয়ের চোটে আমার কথা আটকে যাচ্ছে। মনে হয় শম্পাও আমার এহেন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
- "কী হল তোমার? অমন করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?"
- "শ-শ-শম্পা! তোমার....তোমার পিছনে...."
- "আমার পিছনে কী?"
কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হয়ে শম্পা পিছনে ঘুরে তাকাল। ও এখন প্রেতিনীর একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্য! ও কি সেই ছায়ামূর্তি কে দেখতে পাচ্ছে না?
- "কোথায়? কিছুই তো নেই," শম্পা আবার আমার দিকে ফিরে বলল, "কী দেখাতে চাইছ তুমি?"
অশরীরীর ঠোঁটে এবার এক আকর্ণবিস্তৃত চওড়া হাসি দেখা দিয়েছে। নিজের একটা হাত তুলে সেই ছায়াশরীর আমাকে ডাকছে....নিজের কাছে ডাকছে। কোথায় শম্পা? কোথায় বাকি লোকজন? এখানে আর কেউ নেই। শুধু আমি আছি, আর আছে সেই রহস্যময়ী বালিকার ক্ষীণ অপচ্ছায়া। আমাদের মাঝে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে অসীম কালের অকূল নদী। যেতে হবে নদীর ওই তীরে....আমাকে যেতেই হবে ওর কাছে! পার করতে হবে মৃত্যুনদীর সুবিস্তৃত বক্ষ। নদীর ছন্দবদ্ধ ছলাৎ-ছলাৎ ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে গেছে আমার হৃৎস্পন্দন। লুপ্ত হয়েছে আমার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান। আমি আসছি, এক্ষুনি আসছি!
অন্ধের মতো পা বাড়ালাম সিঁড়ির দিকে। যা হওয়ার ছিল তাই হল। সোজা চোদ্দটা সিঁড়ি টপকে মাটিতে আছড়ে পড়লাম ঠাস হয়ে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত....রক্ত....তারপর সব অন্ধকার।
এর পরে যা-যা ঘটেছিল, তার সারসংক্ষেপ হল এই:-
মাথায় গুরুতর চোট পেয়ে আমি টানা একমাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর বেশ কিছুদিন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। হাসপাতাল থেকে ডিস্চার্জ হয়ে বাড়িতে ফেরার পরেও খুব একটা কথা বলতাম না। শরীর যথেষ্ট দুর্বল ছিল। খাট থেকে বেশি নামতে পারতাম না। সারাদিন শুয়ে-শুয়ে আকাশকুসুম চিন্তা করতাম। পরিবারের লোকজন আমাকে অনেক খুঁচিয়েছে....সেদিন আমি কী দেখে ওইভাবে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি থেকে আছড়ে পড়েছিলাম? কিন্তু আমি কোনও সঠিক উত্তর দিইনি। কী জবাব দিতাম? একটা ভূত কে দেখে গড়িয়ে পড়ে গেছি? লোকে বিশ্বাস তো করবেই না, উল্টে আমাকেই বদ্ধ উন্মাদ ভাববে। শুধু একজন মানুষকেই কথাটা বলা যায়, শম্পা। আমার স্ত্রীও তো ঠিক ওই প্রেতিনী'কেই দেখেছিল। নীল গাউন আর সাদা গ্লাভস্ পরা একটি শীর্ণদেহী বিদেশিনী....এই বর্ণনা তো সর্বপ্রথম আমাকে শম্পাই দিয়েছিল। হ্যাঁ, ওকেই সবকিছু খুলে বলব। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।
****************
শম্পার একার পক্ষে আমাকে সামলে রাখা সম্ভব হবে না, এই কথা ভেবে ওই দুর্ঘটনার পর থেকে বাবা-মা এখানেই রয়ে গেছে। আমার শ্বশুর মশাইও মাঝেমধ্যে এসে আমাকে দেখে যান। সবার সম্মিলিত শুশ্রূষা পেয়ে বেশ দ্রুত স্বাস্থ্যলাভ হচ্ছে আমার। কপালের ক্ষতটাও অনেকটা শুকিয়ে এসেছে। কতদিন আর বিছানায় শুয়ে-শুয়ে গল্পের বই পড়া যায়? তাই একদিন সবার অলক্ষ্যে আমি একাই খাট থেকে নেমে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। মাথায় তখনও ওইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু হাজারটা অপ্রয়োজনীয় কথার মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি বার-বার উপেক্ষা করে ফেলছিলাম। এতক্ষণে হঠাৎ সেইটার উপলব্ধি হতেই আমার যেন টনক নড়ল। ইশ! এতদিন ধরে এই সামান্য পয়েন্ট'টা কেন আমার মাথায় খেলেনি?
এই সবকিছুর সঙ্গে আমার শয়নকক্ষের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। আজ পর্যন্ত জিনিসটা শুধু দুই বার থেমেছে। আর দুই বারই তাতে পুরো দম দেওয়া ছিল। দুই বারই কাঁটা তিনটে বেজে সাত মিনিটে থেমেছে....প্রথম বার রাতে আর দ্বিতীয় বার দুপুরে। যখনই ঘড়ি থেমেছে, তখনই পরিবারে কোনও অঘটন ঘটেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দুই বারই দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পূর্বে দেখা গেছে সেই প্রেতিনী কে। আগের বার শম্পা দেখেছিল, এইবার দেখলাম আমি। এবং তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, প্রত্যেক বার ঘড়িটা নিজে থেকেই আবার চলতে শুরু করেছে। এই তো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ঘড়িটা, দিব্যি টিকটিক করছে....একদম সঠিক সময় দেখাচ্ছে। অথচ বিবাহবার্ষিকীর দুপুরে আশ্চর্যজনক ভাবে নিথর হয়ে পড়েছিল জিনিসটা। তার মানে কি এই ঘড়ি কোনওভাবে আমাকে আসন্ন বিপদের সঙ্কেত দেয়? এই পুরনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক কি অলৌকিক ক্ষমতা-সম্পন্ন?
কাছে গিয়ে ঘড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। না, একদম সাধারণ দেখতে জিনিসটা। শুধু এক জায়গায় সোনালী রং দিয়ে খুব ছোট-ছোট হরফে কিছু লেখা চোখে পড়ল। এতদিনে এই প্রথম দৃষ্টিগোচর হল লেখাগুলো। কিন্তু সেগুলো এতই ছোট যে বিশেষ কিছুই পড়া গেল না। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা কই? দেরাজ থেকে একখানা আতস কাঁচ বের করে লেখাটা পাঠ করলাম:-
Monitum Primum
Monitum Iterum
Denique Mors
যাঃ বাবা! এ আবার কোন ভাষা? মোবাইলে টাইপ করলাম ঘড়ির গায়ে খোদাই করা শব্দগুলো। সেখান থেকে জানা গেল, ভাষাটা ল্যাটিন। বাংলায় অনুবাদ করলে যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়:-
প্রথমবার সাবধান
পুনরায় সাবধান
অবশেষে মৃত্যু
বজ্রাঘাতের মতো সবকিছু আমার কাছে এক নিমেষে দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল। হাত থেকে ফোনটা সশব্দে খসে পড়ল মেঝেতে। মনে হচ্ছে যেন পায়ের তলা থেকে কেউ মাটি সরিয়ে নিয়েছে। হা ভগবান....এ আমি কী দেখলাম! তার মানে কি আমি যেটা ভাবছি সেটাই ঠিক? প্রথম দুটো অ্যাক্সিডেন্ট নিছক কাকতালীয় নয়, সেগুলো আসলে ছিল সতর্কীকরণ? তাহলে তো এর পরের বার....মৃত্যু! কার মৃত্যু? কবে মৃত্যু? এতক্ষণে সব টুকরো-টুকরো ঘটনাগুলো নিজে থেকেই এক জায়গায় এসে পুরো সমীকরণটা দুইয়ে-দুইয়ে চার করে দিল। ঈশ্বর! এ আমাদের কোন নিষ্ঠুর খেলার মধ্যে জড়ালে তুমি? কোনও এক অত্যন্ত শক্তিশালী শয়তান আশ্রয় নিয়েছে এই ঘড়ির মধ্যে। তার ইঙ্গিতেই আমাদের জীবনে ঘটছে এইসব অস্বাভাবিক ঘটনা। না, আমি এই পরিবারের কারও প্রাণসংশয় ঘটতে দেব না....কিছুতেই না!
- "তোমার ব্যাপারখানা কী বলো তো দেখি? তখন থেকে কী বিড়বিড় করছ মনে-মনে?"
বুঝতেই পারিনি কখন শম্পা নিঃশব্দে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
- "আরে শম্পা, তুমি?"
- "তোমার জন্য এই চিকেন স্যুপটা করে এনেছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আর তুমি এইভাবে একা-একা খাট থেকে নেমেছ কেন? মনে নেই ডাক্তার বাবু কী বলেছেন? এই ক'দিন তোমার কম্প্লিট বেড-রেস্ট।"
- "একটা....একটা কথা বলব তোমাকে? অবশ্য জানিনা ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবে কী না।"
- "হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না।"
- "আমাদের পরিবারের এখন চরম বিপদ শম্পা, চরম বিপদ আমাদের।"
- "বিপদ? আমাদের আবার কীসের বিপদ?"
শম্পা কে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। আতস কাঁচ দিয়ে ওকেও পড়ালাম লেখাগুলো। পুরো ব্যাপারটা বোঝার পর ও রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল।
- "এখন তাহলে কী করা যায় বলো তো? এই অপয়া ঘড়ি কিন্তু আমি কিছুতেই বাড়িতে রাখব না।"
- "সে ঠিক আছে, তবে জেনে-শুনে কাউকে এই অভিশপ্ত জিনিস দিই বা কীভাবে? যদি আবার তার বাড়িতে ওই ঘড়ির কারণে কোনও অঘটন ঘটে, তার দায় কি আমাদের ঘাড়ে বর্তাবে না?"
- "দাঁড়াও, আমি আজই বাবা কে ফোন করে এখানে ডেকে পাঠাচ্ছি। বাবার অনেক লোকের সঙ্গে জানাশোনা আছে। নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির বৈঠকখানায় এই নিয়ে একটা মিটিং বসল। শম্পার বাবাও সেখানে উপস্থিত। শম্পা আর আমি মিলে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে বিষয়টা বোঝালাম। সবকিছু শোনার পর প্রত্যেকের মাথায় হাত।
- "না না, এমনটা তো চলতে দেওয়া যায়না," শ্বশুর মশাই গম্ভীর মুখে বললেন, "মনে হয় বাড়ির প্রাক্তন মালিক সরকার বাবু জেনেবুঝেই এই অপয়া গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ছেড়ে গেছেন। এখন ঝামেলাটা এসে পড়েছে আমাদের ঘাড়ে।"
- "তা তো বুঝলাম ভাই কুণাল," বাবা ফোড়ন কাটলেন, "কিন্তু এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হচ্ছে যে এই আপদটা কে ঘর থেকে বিদায় করা যায় কী উপায়ে?"
- "আপনি ভাববেন না দাদা। জিনিসটা পাকাপাকি ভাবে এখান থেকে সরিয়ে ফেলার একটা রাস্তা আমার জানা আছে। আমার একজন পরিচিত আছে, পরিমল সেন। কলকাতায় ভদ্রলোকের অ্যান্টিক-শপ রয়েছে, তিন পুরুষের ব্যবসা। চড়া দামে পুরনো দিনের সব বহুমূল্য জিনিসপত্র কেনাবেচা করে। এই গ্র্যান্ডফাদার ক্লক তো নেহাৎ একশো বছরের কম নয়। পরিমল কে বাড়িতে ডেকে কিছু ভুজুংভাজুং দিয়ে জিনিসটা ওর ঘাড়েই গছাতে হবে।"
- "কিন্তু," আমি বলার চেষ্টা করলাম, "এইটা করলে যদি পরিমল বাবুর বা ওনার পরিবারের কারও ক্ষতি হয়ে যায়?"
- "অত কিছু জানিনা তাতান!" মায়ের গলা থেকে ঝরে পড়ল একরাশ বিরক্তি, "এই মুহূর্তে ওই অলক্ষুণে ঘড়িটা বিদায় করতে পারলে বাঁচি! তারপর ওই দোকানদার ঘড়িটা কাকে বিক্রি করছে বা না করছে, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। যাক যে চুলোয় যাবে....আপনি বাঁচলে বাপের নাম!"
- "বেয়ান একদম ঠিকই বলেছেন প্রতীক। তবে খুব সাবধান! লোকটা বেশ ধুরন্ধর। ওর মনে যেন ঘড়িটা নিয়ে একফোঁটাও সন্দেহ না ঢোকে। বলে দিও যে বাড়িতে অত ঢাউস ঘড়ির কোনও প্রয়োজন নেই, তাই বিক্রি করা হচ্ছে। এরচেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার নেই।"
পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিমল বাবু কে জিনিসটা গছাতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। বুঝতে পারলাম, বাড়ির সকলে বেশ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু কেন জানিনা, আমার মনটা অল্প ভারাক্রান্ত ছিল। হাজার হোক, জিনিসটা তো এতদিন পরিবারের এক সদস্যের মতোই এই ঘরে আশ্রয় পেয়েছিল। আজ ঘরের সেই কোণাটা একেবারে নিরেট ফাঁকা পড়ে আছে। তবে যেখানে নিজেদের প্রাণটাই যেতে বসেছে, সেখানে বোধহয় একটা জড় পদার্থের প্রতি এসব ছেঁদো সেন্টিমেন্ট মানায় না!
(তৃতীয় পর্ব)
এই ঘটনার পর আরও মাস তিনেক কেটে গেছে। এখন আমি অনেকটাই সুস্থ, তাই বাবা-মা আবার ফিরে গেছেন বাড়িতে। এমনিতেই এখানে পড়ে থেকে আমার সেবা করতে গিয়ে বাবার ব্যবসার বিস্তর লোকসান হচ্ছিল। আমিও ডিউটি'তে জয়েন করেছি। এইসব গোলমালের চক্করে ব্যাঙ্কে অনেকদিন কামাই হয়ে গেছে। ঘড়ি বিদায় হওয়ার পর থেকে পরিবারে কোনও গণ্ডগোল ঘটেনি। জীবনের চাকা দিব্যি স্বাভাবিক গতিতে গড়গড় করে গড়িয়ে চলেছে। তবু আমার মন থেকে সেই নিরানন্দ ভাবটা যেন কাটছে না। নাহ্....ঘড়ি হাতছাড়া হওয়ার দুঃখ মনের মধ্যে আর নেই। ফাঁকা কোণাটায় শম্পা একটা সুন্দর বুকশেল্ফ বসিয়েছে। তা সত্ত্বেও এত বিষাদ কেন যে আমার মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে আমার জানা নেই। শম্পার সাথেও খুব দরকার ছাড়া বিশেষ কথাবার্তা বলি না। সবকিছুই আজকাল বড্ড সাদাকালো মনে হয়। হৃদয়-বসন্তবনের উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা কোথাও হারিয়ে গেছে। সেই স্থান দখল করেছে শীতকালের সুদীর্ঘ হিমেল নৈরাশ্য।
থাকতে না পেরে নিজে একদিন ফোন করে বসলাম সরকার বাবু কে। ওপার থেকে উনিই ফোনটা রিসিভ করলেন।
- "হ্যালো, কে বলছেন?"
- "গুড মর্নিং মিঃ সরকার! আমি প্রতীক বলছি।"
- "আরে ম্যানেজার সাহেব যে, হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! কেমন আছেন?"
- "ওই চলছে আর কি। আপনি এখন কোথায়?"
- "কোথায় আর থাকব! সমস্ত প্রপার্টি আপনার হাতে তুলে দিয়ে ইন্ডিয়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছি। এখন মেয়ে-জামাইয়ের কাছেই জীবনের শেষ ক'টা দিন শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চাই।"
- "তা বেশ বেশ, ভালই করেছেন। আচ্ছা মিঃ সরকার, আপনাকে একটি জরুরি কথা জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন করেছিলাম।"
- "ও....কী নিয়ে কথা?"
- "শোওয়ার ঘরের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা নিয়ে।"
ফোনের ওপারে দীর্ঘক্ষণের নীরবতা। বুঝলাম সরকার বুড়ো মনে-মনে অজুহাত দেখানোর ফন্দি আঁটছে। সেই সুযোগ ওকে দেওয়া চলবে না। কড়া ভাষায় একটু ভাল করে জেরা করতেই ভিতর থেকে আসল কথাটা বেরিয়ে এল। বহু বছর আগে ওই বাড়িতে ফক্স সাহেব নামক একজন ব্রিটিশ অফিসার থাকতেন। তার মেজো কন্যা ছিল সেই মেয়েটি....লরা ফক্স। ওরই ছায়া আমি আর শম্পা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। খুব কম বয়সে কোনও অজানা রোগে ভুগে বাচ্চাটার জীবনাবসান ঘটে। বেডরুমের ওই ঘড়িটা লরার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তাই মৃত্যুর পরেও ওর আত্মা সেই গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের মায়া ছাড়তে পারেনি। লরার আত্মা চায় না যে ওই ঘড়িটা অন্য কারও মালিকানায় থাকুক। তাই ফক্স সাহেব বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পরেও যখনই কোনও পরিবার এই বাড়ির দখল নিয়েছে, তাদের সকলের সঙ্গে ঘটেছে কিছু না কিছু মারাত্মক বিপর্যয়।
- "আর আপনি সবকিছু জানা সত্ত্বেও আমার কাছে এতগুলো কথা চেপে গেলেন?"
- "কী করব বলুন ম্যানেজার সাহেব?" সরকার বাবু প্রায় ফুঁপিয়ে উঠলেন, "আমার তিন বছরের ফুটফুটে নাতিটা....বলা নেই কওয়া নেই, সেদিন বাগানে খেলতে গিয়ে ওর মাথায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। শেষ হয়ে গেল শিশুটা। তারপর আর আমার কোনও জ্ঞানগম্যি ছিল না বিশ্বাস করুন। যেন-তেন-প্রকারেণ বাড়িটা বিক্রি করে, দেশের মোহ ত্যাগ করে সোজা জামাইয়ের কাছে ঠাঁই নিয়েছি। নাহলে এই শেষ বয়সে এসে কার ইচ্ছে করে নিজের মেয়ে-জামাইয়ের ঘাড়ে গলগ্রহ হয়ে ঝুলে থাকতে?"
আর বেশি কথা বাড়ালাম না। আমিও তো একই দোষে দোষী। আমিও তো সমস্ত তথ্য ধামাচাপা দিয়ে জিনিসটা বিক্রি করে ফেললাম। চালুনি হয়ে সূচের বিচার করা আমার সাজে না।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। অনেক রাত হয়েছে, তবুও কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় শুধুই এপাশ-ওপাশ করে যাচ্ছি, কিন্তু নিদ্রাদেবীর সদয় হওয়ার নামগন্ধ নেই। পাশে শম্পা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। উঠে বসলাম বিছানায়। টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন। পুরনো ঘড়িটা বিক্রি করার পর একটা নতুন দেওয়াল-ঘড়ি লাগানো হয়েছে এই ঘরে। বেশ সুন্দর দেখতে জিনিসটা।
পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর চেষ্টা করা দরকার, আবার কাল সকালে উঠে দুটো নাকে-মুখে গুঁজে ব্যাঙ্কে ছুটতে হবে। সবে চোখ বন্ধ করেছি, হঠাৎ খুব পরিচিত এক শব্দ কানের পর্দায় এসে সজোরে ধাক্কা মারল।
ঢং...!!
এক লাফে নেমে পড়লাম খাট থেকে। এইটা....এইটা সেই ভুতুড়ে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের ঘণ্টার আওয়াজ না? এখনও হচ্ছে শব্দটা। গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ সেই ধাতব 'ঢং ঢং' আওয়াজ, যার প্রতিধ্বনিতে গোটা বাড়িটা গমগম করছে!
গুণে-গুণে বারো বার বাজল ঘড়ির ঘণ্টা। ঠিক তাই! এখন তো বারোটাই বাজে। কিন্তু শব্দটা এল কোত্থেকে? ঘরের মধ্যে থেকে তো নয়। যেন বেশ দূর থেকে সেই ধ্বনি ভেসে আসছিল আমার কানে। এবার আমার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিতে শুরু করেছে। কাণ্ডটা কী হল? প্রায় তিন মাস আগেই তো জিনিসটা বিক্রি করে ফেলেছি। তাহলে?
উফ্! আর ভাবতে পারছি না। নির্ঘাত কাজের চাপ বেশি হয়ে যাচ্ছে বলেই এসব অবাস্তব চিন্তাভাবনা মাথার মধ্যে ভীড় করছে। শম্পা তো ভালই ঘুমাচ্ছে; মনে হয়না ও কোনও আওয়াজ-টাওয়াজ শুনতে পেয়েছে। আরে আওয়াজ থাকলে তবে তো শুনবে! আমারই যত্তসব আজগুবি কল্পনা। না, এবার আমারও ঘুমানোটা খুব দরকার। বিশ্রামের অভাবে অনেক সময় মানুষ রজ্জু কে সর্পভ্রম করে ফেলে।
সকালে শম্পার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল।
- "আরে তাড়াতাড়ি ওঠো! সাধন দা গাড়ি নিয়ে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।"
- "তাই তো!" আমি চোখ কচলে উঠে বসলাম, "ভাগ্যিস তুমি ডাকলে, নাহলে আজ নির্ঘাত লেট হয়ে যেত!"
- "তুমি তো কোনওদিন এতক্ষণ অবধি ঘুমাও না, কাল রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছিলে বুঝি?"
- "হ্যাঁ গো, আসলে কাল রাতে যা ভয়ঙ্কর...."
- "ভয়ঙ্কর? কী ভয়ঙ্কর?"
- "ইয়ে মানে....না তেমন কিছু নয়। রাতে ঘুম আসছিল না, তাই আজ উঠতে দেরি হয়েছে। যাই হোক, এবার আমি উঠি।"
কাল রাতের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার ব্যাপারে স্ত্রীর কাছে কিচ্ছু ফাঁস করলাম না।
সেদিন ব্যাঙ্কে কাজের চাপে মাথা তুলতে পারিনি। ডিউটি থেকে ফিরে শম্পা কে নিয়ে আবার বেরোতে হয়েছিল টুকটাক কিছু কেনাকাটি করার জন্য। শেষমেশ যখন বাড়িতে ফিরলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর ছুঁইছুঁই। কালকের মতো আজ আর অনিদ্রায় ভুগতে হয়নি। ক্লান্ত ছিলাম, তাই রাতের খাবার সেরে দুজনেই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরিশ্রান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম নরম বিছানায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে গেলাম সুপ্তির গভীর সাগরে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মনে নেই। আবার সেই মিষ্টি অথচ ভারী শব্দটা কানে আসতেই চোখদুটো খুলে গেল।
ঢং ঢং...!!
আবার....আবার সেই অভিশপ্ত আওয়াজ! আজও বেশ দূর থেকে আসছে শব্দটা। এক ঝটকায় চাদরটা সরিয়ে উঠে বসলাম। আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত-পা যেন আমার বশে নেই। গলা দিয়ে একটা স্বর পর্যন্ত বেরোচ্ছে না। শেষে বুঝি আমায় বোবায় ধরল! শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সজোরে এক ঠেলা মারলাম শম্পার কাঁধে।
- "কে!" শম্পা ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে, "কী ব্যাপার?"
- "শম্পা....শম্পা!"
- "এইতো আমি। কী হয়েছে তোমার? অমন করছ কেন?"
- "আওয়াজ! ওই যে শোনো সেই গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের আওয়াজ। কোথা থেকে....কোথা থেকে আসছে আওয়াজটা?"
- "ঘড়ির শব্দ?" শম্পা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল, "কোথায়? আমি তো কোনও শব্দ পাচ্ছি না।"
এবার আমার মাথায় সত্যিই রাগ উঠে গেল। শম্পার কাঁধে আরেকটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম-
- "শুনতে না পাওয়ার কী আছে? কানের মাথা খেয়েছ নাকি? এই তো এখনও হচ্ছে শব্দটা। বাড়ির প্রত্যেকটা কোণায় ওই অভিশপ্ত ঘড়ির ঘণ্টা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, এদিকে তুমি নাকি শুনতে পাচ্ছ না!"
- "আমি তোমাকে মিথ্যে কেন বলতে যাব বলো? আমি সত্যিই কিছু শুনতে পাচ্ছি না। তাছাড়া ওই ঘড়ি তো কবেই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন আর ওই শব্দ আসবে কোত্থেকে? তুমি নিজেই ভেবে দেখো।"
দেখে বুঝলাম, শম্পা আমার এই আকস্মিক উগ্রমূর্তি দেখে যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে। আমিও নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত হলাম। সত্যিই তো! শম্পার যুক্তি অকাট্য। ওই আওয়াজ এখন আসবে কীভাবে? কিন্তু আমি যে স্পষ্ট শুনলাম সেই সুমিষ্ট, মন্দ্রিত ধাতব ধ্বনি....যার অনুনাদ এখনও আমার কানে বেজে চলেছে। অর্থাৎ আমি কি একাই সেই ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি? ওই ভুতুড়ে ঘড়ির কালো ছায়া আদৌ আমার জীবন থেকে কোনওদিন দূর হবে?
আজ শনিবার। পরপর দু'রাত ধরে একই কাণ্ড ঘটছে। আর নয়....আজ আমাকে যেমন ভাবেই হোক ওই শব্দের উৎস খুঁজে বার করতেই হবে। কাল ছুটি, অতএব আজ রাতটা জেগে কাটালেও বিশেষ সমস্যা নেই। শম্পা কে এই বিষয়ে কিচ্ছু জানাইনি। প্রতি রাতের মতোই আজও আমি চুপচাপ ওর পাশে শুয়ে আছি। কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলো যতটা সম্ভব সজাগ রেখেছি। ঘুমালে চলবে না; আজ এই ভৌতিক তামাশার একটা বিহিত করতেই হবে। সঙ্গে রেখেছি চার ব্যাটারির টর্চ আর একখানা ছোট লাঠি। জানিনা কী আছে কপালে! তবে রোজ-রোজ এই এক অশান্তি আর সহ্য হচ্ছে না। আজ এর একটা মীমাংসা হয়ে যাক।
ঢুলে আসা চোখগুলো কে সচেতন রাখার জন্য মোবাইলে সিনেমা দেখছিলাম। অনেকক্ষণ ওইভাবে জেগে কাটিয়ে দেওয়ার পরেও যখন ভূতের আসার বিশেষ সম্ভাবনা দেখলাম না, শেষে যখন সব আশা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়তে যাব....ঠিক সেই মুহূর্তে কানের পর্দায় আঘাত হানল সেই অপয়া রব।
টর্চ আর লাঠিটা বাগিয়ে খাট থেকে নেমে পড়লাম। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে বুঝতে পারলাম, শব্দটা আসছে ছাদ থেকে। তিন বার বেজে বন্ধ হয়ে গেছে ঘড়ির ঘণ্টা। সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে পড়লাম ছাদে। এই বাড়ির ছাদটা সম্পূর্ণ নেড়া, প্রাচীরবিহীন। আজ মনে হয় অমাবস্যা। এমন কালিঢালা মসীকৃষ্ণ রজনী সচরাচর দেখা যায়না। চারিদিক বড্ড থমথমে, গাছগুলোর একটি পাতাও যেন নড়ছে না। তবে এমন নিস্তরঙ্গ পরিবেশের মধ্যেও ছাদের একাংশ আলোকিত করে রেখেছে এক অদ্ভুত দীপ্তি। ছাদের পশ্চিম দিক থেকে আসছে আলোটা। তবে সেদিকে ফিরে তাকাতেই আমি পেলাম জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা। শরীরের সমস্ত রক্ত এক নিমেষে জমাট বেঁধে গেল।
অমাবস্যার তমসার মাঝে কৌমুদী-দ্যুতি ছড়িয়ে আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে সেই মান্ধাতার আমলের গ্র্যান্ডফাদার ক্লক....হ্যাঁ, পরিমল বাবু কে বিক্রি করা সেই ভৌতিক ঘড়ি। এক অলৌকিক নীলচে প্রভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে জিনিসটার থেকে। ঘড়ির গাঢ় মেরুন রঙের কাঠামো যেন আরও কয়েকগুণ বেশি রাজসিক দেখাচ্ছে সেই নীলাভ আলোর প্রেক্ষাপটে। কাঁচের স্বচ্ছ কেসিংয়ের পিছনে সোনালী রঙের ভারী পেন্ডুলামটা দুলে চলেছে আপন ছন্দে। কিন্তু একি! খানিকক্ষণ স্বাভাবিক ভাবে দোলার পর একসময় যেন পেন্ডুলামের গতিটা ধীরে-ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ থেমে গেল ঘড়ির কাঁটাগুলো। সময় তখন....তিনটে বেজে সাত মিনিট।
নিচের বারান্দায় আবার দেখতে পাচ্ছি ফক্স সাহেবের মেজো কন্যার এক ক্ষীণ প্রতিচ্ছবি। নীল গাউন পরিহিতা রোগা মেয়েটি আমাকে পুনরায় দু'হাত তুলে ইশারা করতে আরম্ভ করেছে। আবার সেই অপ্রতিরোধ্য আহ্বান, আবার ওর কাছে যাওয়ার সেই দুর্দম্য বাসনা। আগের বার যেতে পারিনি ওর কাছে, তবে আজ আমি যাবই। হাজার চেষ্টা করেও কেউ আটকাতে পারবে না আমাকে।
আসছি....আমি আসছি....!
হাঁটতে-হাঁটতে নেড়া ছাদের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। এখান থেকে লরার ছায়াশরীর আরও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এখনও একনাগাড়ে ডেকে চলেছে আমাকে....প্রেতিনীর ঠোঁটচেরা হাসিটা আরও একটু চওড়া হয়েছে। সেই অপার্থিব ডাক কে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই। মনে হচ্ছে যেন নিজের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। ছাদ থেকে এক লাফ দিয়ে নিজের দেহটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম। শরীরটা তুলোর মতো হালকা লাগছে। ওই তো....ওই তো নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেই অশরীরী!
****************
- "তাতান, এই তাতান! শুনতে পাচ্ছিস? কী হয়েছে তোর? ওঠ, একটিবার অন্তত চোখ মেলে তাকা।"
- "বাবা?"
- "হ্যাঁ রে, আমি এসেছি। তোর মাও এসেছে। এখন শরীরটা কেমন লাগছে রে?"
- "ঠিকই লাগছে," আমি আস্তে-আস্তে উঠে বসলাম, "শুধু মাথায় অল্প যন্ত্রণা হচ্ছে।"
আমি নিজের খাটেই শুয়ে আছি। শম্পার জবানবন্দী শুনে যেটুকু বুঝলাম, আমি নাকি কাল সারারাত বেডরুমেই ছিলাম। সকালে আমি উঠছি না দেখে ও আমাকে ডেকে তোলার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুতেই আমার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। শেষে ঘাবড়ে গিয়ে ও নিজেই বাবা-মা কে ফোন করে ডেকে পাঠায়। তাই তাঁরা আজ পড়িমরি করে এই বাড়িতে ছুটে এসেছে। তারপর তিনজনে মিলে মুখে জল-টল ছিটিয়ে আমার চেতনা ফিরিয়ে এনেছে।
- "এবার সবটা খুলে বল দেখি তাতান," মা আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, "শরীরটা এত খারাপ হল কেন?"
- "কাল রাতে...."
- "কাল রাতে কী? কী ঘটেছিল কাল রাতে!"
- "ও কিছু না মা। আসলে কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম তো, তাই ঘুম ভাঙতে অসুবিধা হয়েছে। অভ্যাস না থাকলে যা হয় আর কি!"
- "ঘুমের ওষুধ?" শম্পা হাঁ করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, "কই আমাকে তো বললে না?"
- "আরে এতে বলার কী আছে? কয়েকদিন ধরে নানা কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছিল, তাই ভাবলাম আজ একটা স্লিপিং পিল খেয়েই দেখি। চমৎকার ঘুম হল!"
- "রাখ তোর ঘুম!" বাবা এক ধমক দিলেন, "ফোনে বৌমার কথা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। আর কোনওদিন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন্ ছাড়া ওসব জিনিস খাবিনা বলে রাখলাম!"
ঘুমের ওষুধ নিয়ে আরও কিছু মনগড়া আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে সাময়িক ভাবে পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়া গেল। ইচ্ছে করেই কাল রাতের সব কথা বেমালুম চেপে গেলাম। কী দরকার সকলের মনে অবান্তর আতঙ্ক ঢোকানোর? কিন্তু পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্ত করতে পারলেও আমি নিজের মন কে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না। কাল যে ঘড়ির শব্দ শুনে ছাদে গেলাম, সেখানে ওই ঘড়ির প্রতিবিম্ব দেখলাম, তারপর প্রেতিনীর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ছাদ থেকে নিচে ঝাঁপ দিলাম....সবটাই তাহলে দুঃস্বপ্ন? কিছুই বাস্তবে ঘটেনি? তার মানে আমি কি কাল সারারাত জেগে থাকার পণ করা সত্ত্বেও শেষমেশ একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
আজ রবিবার, তার উপর বাবা-মাও এখানেই চলে এসেছে। তাই ঠিক করা হল যে শম্পার বাবাকেও আজ বাড়িতে ডাকা হবে। দুপুরের লাঞ্চটা সবাই একসাথেই করব। যথাসময়ে শ্বশুর মশাই এসে হাজির।
- "কী হে জামাই! ফোনে শুনলাম তুমি নাকি রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে?"
- "ওই আর কি! প্রথমবার খেলাম তো, তাই হয়তো...."
- "তা অবশ্য ঠিক, এইসব ওষুধ ডাক্তার কে জিজ্ঞেস না করে খাওয়াটা অন্যায় হয়েছে। যাই হোক, ডাক্তার থেকে মনে পড়ল....তোমাদের আজ একটা খারাপ খবর দেওয়ার ছিল। আজ সকালে আমি হাসপাতালে গেছিলাম।"
- "বলো কী কুণাল?" বাবা চোখ বড়-বড় করে তাকালেন, "তোমার আবার কোন ব্যারাম হল হে?"
- "আরে আমার কিছু হয়নি। আসলে একটা দুঃসংবাদ এনেছি। আমার বন্ধু পরিমল, যাকে তোমরা ঘড়ি বিক্রি করলে....ও কাল রাতে মারা গেছে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।"
- "মারা গেছেন?"
- "হ্যাঁ বেয়ান। আমি তো খবর পাওয়া মাত্রই হাসপাতালে ছুটেছি। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।"
কী একটা মনে হতেই আমি প্রশ্ন করলাম-
- "আচ্ছা, উনি ঠিক ক'টার সময় মারা গেছিলেন?"
- "ডাক্তার তো বডি দেখে বললেন যে পরিমল রাতে ঘুমের মধ্যেই এক্সপায়ার করে গেছে। আনুমানিক সময়....এই ধরো রাত আড়াইটা থেকে তিনটের মাঝামাঝি। মৃতদেহের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, পরিমল মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে কিছু একটা দেখে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে।"
হতাশায় ভরা একখানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। যা ভয় পেয়েছিলাম, শেষে ঠিক ওই জিনিসটাই হল! ডাক্তার যাই বলুক না কেন, আমি তো জানি পরিমল সেনের মৃত্যুর সঠিক সময়....রাত তিনটে বেজে সাত। কাল শেষবারের মতো ঘড়ির কাঁটা থেমেছিল। শেষবারের মতো এসেছিল লরা। এসে হরণ করে নিয়ে গেল এক নির্দোষ মানুষের প্রাণশক্তি। মরণের আগে মেয়েটির ছায়া দেখেই হয়তো ভয় পেয়েছিলেন পরিমল বাবু। ঘড়ির গায়ে খোদাই করা লেখাগুলো আগেই করে রেখেছিল ওনার করুণ পরিণতির ভবিষ্যদ্বাণী........
Monitum Primum
Monitum Iterum
Denique Mors
**** সমাপ্ত ****