চড়ের ইতিবৃত্ত
চড়ের ইতিবৃত্ত
অতলান্তকে সবাই ডাকাবুকো হিসেবেই চেনে। ভয় তার শরীরে তেমন নেই। বাড়িতে তার আপনার বলতে ছোট দুই বোন আর কাকিমনি আর দাদু দিদা। কাকাই থাকেন কর্মসুত্রে বাইরে বাইরে।রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মী। আগে কাকাই আর কাকিমনির সাথে দুই ভাইবোনে বেশ ঘুরেছে।ওরা দুইজন বছর পাঁচেকের ছোট বড়।তার উঁচু ক্লাস হয়ে যাওয়ার আর ছোট বোনের জন্মের পরে থেকে ওরা এখন রায়গঞ্জবাসী।উত্তর দিনাজপুরের সদর শহর এই রায়গঞ্জ। বেশ পুরোনো জায়গা।৫০০ বছরের পুরোনো বন্দরের দুর্গাপূজা আজও হয় প্রতি শারদীয়ায়।এখানে এসে রায়গঞ্জ করনেশন উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। বেশ নাম আছে এই স্কুলের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে শীর্ষ তালিকায় থাকে। অবশ্য এতে স্কুলের থেকে বাবা মায়ের পরীক্ষাযুদ্ধ সফলতার কারণ। আর বোন ভর্তি হয়েছে কিশলয় কেজি স্কুলে, তৃতীয় শ্রেণীতে।বেশ নামকরা স্কুল। কড়াকড়িও বেশ।
অতলান্ত পড়াশোনায় মন্দ নয়।তবে অত্যন্ত দূরন্ত প্রকৃতির। আগে দুটো বাচ্চাকে সামলাতে বেগ পেতে হতোনা। সাথে থাকতো অতলান্তের কাকাই হিরন্ময় বাবু।একটু হলেও ওই মানুষটাকে ভয় পায় সে। অবশ্য বর্তমানে তারা অতলান্তের কাকিমনি সুদীপা দেবীর বাড়িতেই আছেন।অতলান্তের বাড়ি আছে যেখানে, সেটা শহর থেকে বাইরে।তবে খুব মন্দ জায়গা নয়।কিন্তু স্কুলের থেকে দূরত্ব অনেক।তাই এখানেই থাকবে তারা। আর বাড়িতে বলতে কেবল সুদীপার মা-বাবা দুই দাদার একজন আমেরিকা আর অপরজন দিল্লী নিবাসী।তারা বাড়ি ছাড়ার পরে হাতে গুনে এসেছে। এদের দেখাশোনারও কেউ নেই, অবশ্য আগেও দায়িত্ব সুদীপা আর হিরন্ময়রই ছিল।
এখানে এসে একটা সুবিধা হয়েছে ওদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে ওকে ভাবতে হয়না।
তবে এখানে এসে দাদু দিদার প্রশ্রয়ে অতলান্তকে সামলান বড় কঠিন হয়ে গিয়েছে।
অতলান্তর যখন বছর তিনেক বয়স তখন বিয়ে হয়ে যায় সুদীপা। সুদীপা আর অতলান্ত মা দীয়া ছিল একই গানের স্কুলের ছাত্রী। দীয়াই বিয়ের সম্বন্ধটা করে। সুদীপা ছোট থেকেই বাচ্চাদের ভালোবাসে।অতলান্ত একেবারে কাকিমনির ন্যাওটা হয়ে যায় কিছুদিনেই। বাড়ি এলেই সাথে থাকতো অতলান্ত। তখন থেকেই দাদু-দিদা বলতে এদেরকেই চিনেছে। তাছাড়া তখন দীয়া দ্বিতীয়বার মা হতে চলেছে, তাই অতলান্তের সব দায়িত্ব নিজে থেকে সুদীপা দেবী নিয়ে নেন খুব খুশী মনে। তবে কি তখন জানতো সেটা সারাজীবনের জন্য। দীয়া সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনা বাড়ি, ফিরে না তার সন্তানও। সেই শোক সইতে পারেননি অতলান্তর বাবা মৃন্ময় বাবু।বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যান মাস খানেকের মধ্যে।তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই। কন্যা আসার আনন্দে আশায় বুক বেঁধেছিল। কন্যাকে তো পেলই না, সাথে চলে গেল দীয়া। ওদের প্রেম করে বিয়ে ছিল, অনেক দিনের সম্পর্ক। দীয়া ছিল ওদের পরিবারের দত্তক সন্তান। ও যখন বছর খানেক দুই যমজ ভাই আর এক বোন হওয়ার পর দীয়ার ভালোবাসা, কদর সব চলে যায়। উচ্ছিষ্টর মতো বড় হয় সে।
ওদের বিয়েও দিয়েছিল মন্দিরে। নমো নমো করে।তবে তা নিয়ে কোনদিন মৃন্ময়বাবু বা তার পরিবার কিছু বলেননি। তাই খুব কমই যেতো দীয়া বাবার বাড়ি, এক জেলায় হওয়া সত্ত্বেও । ওর মৃত্যুর পরে সেটাও ঘুচে গেল।
রায়গঞ্জ এসে সুদীপার মনে হয় খুব ভুল করে ফেলেছে ও। হতে পারে পুরনো শহর । সবাই শিক্ষার অনুরাগী। কিন্তু চিকিৎসা সহ যোগাযোগ থেকে শিক্ষা সবকিছুরই অবস্থা বেহাল। সুদীপার খালি ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে চিন্তা। আর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছেলেটাকে নিয়ে।সবসময়ই স্কুল থেকে নালিশ আসে। একে মেরেছে, তাকে মেরেছে। কখনো বা স্যারেদের অদ্ভুত সব প্রশ্নবানে কুপকাত করেছে।
এবার তো চুড়ান্ত ঘটনা ঘটালো চ্যালেঞ্জ জিততে গিয়ে পা ভেঙ্গে বাড়ি ফিরলো। ছোট বাচ্চাটাকে রেখে কত ছুটাছুটি সুদীপার। নেহাত বেশ কাছেই হাসপাতাল। তাই রক্ষা।
এই খবর শোনার পরে তড়িঘড়ি ছুটি নিয়ে ফিরলো হিরন্ময়। তাও ফিরতে দিন তিনেক লাগলো।এসেই পড়লো পিঠে কয়েকটি অতলান্তর। সুদীপা আর দাদু এসে আটকালো হিরন্ময়কে।হিরন্ময় ঘোষণা করলো সে এই ছেলেকে বাড়ি রাখবে না হোস্টেলে দিয়ে দেবে। অনেক বুঝিয়েও মানাতে পারলো না কেউ হিরন্ময়কে।
এই সিন্ধান্তের পরে বাড়িতে যেন শোকের ছায়া নেমে এলো। মনে মনে বড় বিরক্ত হল হিরন্ময়। তবে চাইলেই তো আর পাঠানো সম্ভব না, বছরের মাঝ পথে। হিরন্ময় সপ্তাহ খানেক থেকে চলে গেল।
অতলান্ত আগে ভয় পেলেও কাকু তাকে হোস্টেলে না পাঠিয়ে চলে যাওয়াতে ও ভাবলো ওকে ভয় দেখিয়েছে বুঝি কাকু।
মাসখানেক পরে সুস্থ হয়ে আগে রূপে ফিরে এলো অতলান্ত।
একদিন কাকিমনিকে লুকিয়ে পড়ার নাম করে পাঁচ বন্ধু মিলে প্ল্যানচেট করার পরিকল্পনা করলো। অবশ্য ডাকাবুকো অতলান্ত একদম ঘোর অবিশ্বাসী। ভুত বলে কিছু নেই এটা প্রমাণ করার জন্য সে রাজি হয়েছে। তারা সেদিন সবাই অতলান্তদের বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় এলো। এদের মধ্যে একজন মাধ্যম। অতলান্ত বললো দেখাতো মাকে। অনেকক্ষণ ধরে তারা হাতে হাত রেখে চোখ বুজে চুপ আছে, একরকম অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। তখন সজোরে অতলান্ত একটা চড়ে চটক ভাঙ্গলো।ওর চরের শব্দের সবাই চোখ খুলে দেখে বিষু চড় কষিয়েছে অতলান্তকে। সবাই বেশ অবাক হলো অতলান্তকে মারার সাহস এদের কারো হবে না।তারমধ্যে বিষু সবথেকে ভিতু।
অতলান্ত খেপে মারতে উঠলো ওকে।
বিষু অদ্ভুত গলার স্বরে বলে উঠলো " চুপটি করে বস, নইলে আরেকটা পড়বে।"
অতলান্তর মতো মানুষ চুপটি করে বসে পড়ল।
" খুব সাহস হয়েছে? আমাকে কে আনতে বললো এখানে তোকে?"
সবাই তো ভয়ে কাঠ।
অতলান্ত তোতলাতে তোতলাতে বললো "তুতুমিমি কেকেকে..?"
"আমি কে মানে? তুই কাকে আনতে চেয়েছিস?"
চুপ থাকে অতলান্ত। বেশ ভয় পেয়েছে।
"আমি তোর মা।"
অতলান্ত অস্ফুটে বললো "মা।"
"হ্যাঁ মা, এনেছিস বেশ করেছিস আর যাচ্ছিনা। আমার শাসন ছাড়া মানুষ হবিনা।"
হঠাৎ দেখলো হাওয়া উঠলো মোমবাতি গুলো নিভে গেলো, বিষু ধপ করে পড়ে গেল।
অতলান্ত বুদ্ধি না পেয়ে নিচে ছুটলো। টেনে দাদুকে নিয়ে এলো।দাদু দেখে তো চড়কগাছ, "কি রে তোরা কি করছিলি?"
অতলান্ত "পড়ছিলাম। "
অতলান্ত সাথে সাথে গালে একটা সজোরে চড় খেলো। চারিদিকে চেয়ে দেখে আশেপাশে কেউ নেই। সে এবার ঢোক গিললো।
"যা অতু দাদু নীচে থেকে জল নিয়ে আয়।"
ভাবলো মিতুলকে বলে। তবে সাহস পেলোনা, নিজেই নিয়ে এলো।জ্ঞান ফিরে পেয়ে বিষু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।যেন ঘুম থেকে উঠলো।
"ঠিক আছিস বিষু দাদু?"
"হ্যাঁ কেন আমার কি হয়েছে। "
দাদু নীচে নেমে গেল। অতলান্ত জোর করে চেপে ধরলো, "তুই ইচ্ছে করে করেছিস তাই না? " এই বলে মারতে যাবে আবার জোরে একটা কান মলা খাওয়ায় বেশ ভরকে গেল অতলান্ত।
এই তোরা আমার কান ধরলি তাই না।সবাই একেই ভয়ে পেয়েছিল।অবাক হয়ে বললো "চলি রে তুই থাক,কাল সোমবার স্কুল খুলবে যাই।"
সবাই চলে গেল।সাহসী অতু আর উপরে একা থাকতে পারলো না, ওদের সাথে নীচে নেমে এলো।
যে ছেলে সারাক্ষণ ধুন্ধুমার করে বেড়াচ্ছে সে আজ বাথরুমে যেতে ভয় পাচ্ছে,তবে প্রকাশ করল না সে।
বাথরুমে এসে টয়লেট করে জল না দিয়ে বাইরে আসতে গিয়ে এবার আবার খেলো কান মলা।আর সাথে শুনতে পেলো "জল কে দেবে।" ভয় পেয়ে কোনমতে জল দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো।
এরপর যখনই যা দোষ করত কপালে জুটেতো অদৃশ্য মার কিংবা কানমলা আর শুনতে পেত ভুলের কারণ। সবসময় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতো ওকে।
আর হ্যাঁ, ওকে আর হোস্টেলে পাঠাতে হয়নি।
তবে সেও আর কখনো বুক ঠুকে বলতে পারেনি আত্মা নেই আর প্রমাণও করতে পারেনি আছে।আসলে মার,কানমলা ,চর সে একাই খেতো নীরবে।কেউ তো জানতেও পারতো না।দেখতেও পেতো না, নীরবে তাই সইতে হতো তাকে।
পরে সে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক,এমনকি কলেজ পাশ করে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত খেয়েছে চড় বা কানমলা । তবে চাকরি পেয়ে এখনো পর্যন্ত খায়নি।
কিন্তু এখনো দোষ করে নিজের গালে হাত দেয়,ভাবে পড়লো চড়।আবার লোকে এটাকে আজকাল মুদ্রাদোষ ভাবছে।
আজ সে নিজে স্কুল শিক্ষক। যখন সে তার মতো কোনো ছাত্রকে দেখে মনে পড়ে যায় তার চড়ের ইতিবৃত্ত।
_______