চক্রাবর্তন - অন্তিম পর্ব
চক্রাবর্তন - অন্তিম পর্ব


প্রেম বহ্নিমান
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নিশু ডোম নিজের কুঁড়ের মধ্যে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনছিলো। হঠাৎ তার মনে হলো কারা যেন হাসছে শ্মশানের মধ্যে! মনে হলো যেন অনেক মানুষের সমবেত হাসি! কিন্তু এই বৃষ্টির দিনে বন্দিপুরের শ্মশানে মানুষের হাসি! নিশু ডোম আনন্দে বাইরে বেরিয়ে আসে। মনে হয় যেন তার পরিবার অনেকদিন পর উৎসবে মেতে উঠেছে, নিশুও তাতে যোগ দিতে চায়। তখনই কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ে, সামনে প্রাগৈতিহাসিক বৃদ্ধের মতো ঝুরি বেরোনো বিশাল বট গাছটা দুফাঁক হয়ে কাত হয়ে যায়।
শ্মশানের বুকে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ। বৃষ্টির জলের তোড়ে ধুয়ে যাচ্ছে একটি মৃতদেহের বুক চিরে বেরিয়ে আসা সব রক্ত। আর মৃত দেহ দুটির ঠিক ওপরেই বাতাসের মধ্যে ভেসে থাকা দুটি সদ্য দেহ থেকে মুক্তি প্রাপ্ত আত্মার মধ্যে চলছে দারুণ লড়াই। একটু আগেই তারা পরস্পরকে খুন করেছে অগোচরে আর এখন লড়াই চলছে বদলা নেওয়ার। তারা কিন্তু একলা নয়, তাদের ঘিরে রয়েছে শ্মশানের আরো সব আত্মারা। তারা ভেসে ভেসে চারিদিক থেকে মজা দেখছে; বহুদিন পর তাদের কাছে এমন বিনোদনের বস্তু উপস্থিত হয়েছে। এদের মধ্যে আছে নিশু ডোমের পরিবারও। আর আছে সেই ছয়টি মেয়ের আত্মাও যারা এতদিন বন্দি ছিল গুরুদেবের হাতে, বাপনের মতো পশুকে ভালোবাসার মূল্য যারা চুকিয়েছিলো নিজেদের দেহ ও আত্মা উভয়ের বিনিময়েই, আজ তারাও মুক্ত।
কিন্তু এদের সকলের থেকে দূরে, সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে আস্তে আস্তে ভেসে চলছে আরো দুটি আত্মা - একটি নারীর, একটি পুরুষের। নারী আত্মাটি বলে উঠলো, “তুমি কেন নিজেকে শেষ করে দিলে এভাবে?”
পুরুষ আত্মাটি জবাব দিলো, “তুমি ছাড়া আমার তো বাঁচার আর কোনো কারণ ছিল না। মা বাবা তো অনেক আগেই এই পারে চলে এসেছিলেন। তোমার বিয়ের পর আমিও তাই চলে এলাম।”
“বুঝলাম। এবার তোমার থেকে আমাকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা।”
“কিন্তু তোমাকে তো অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।”
“আর কোনো কষ্ট নেই আমার, ওই দুটো শয়তানকে শাস্তি দিয়েছি এই আমার প্রাপ্তি। তাছাড়া আমার আত্মা ওই লোকটা পেত কি করে! আমার আত্মা তো সেই কবেই তোমার কাছে অর্পণ করেছিলাম।”
পুরুষ আত্মাটি বোধহয় মৃদু হাসলো। শরীর নেই তো, তাই ঠিক বোঝা গেল না।
এরপর তারা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে এই বন্দিপুর শ্মশানের পরিমন্ডল ছেড়ে পাড়ি দিলো কোনো এক দূর অজানার উদ্যেশ্যে...
শেষ।