বৃষ্টির আহ্বান
বৃষ্টির আহ্বান
ছোটবেলায় মার মুখে শুনেছিলাম আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, এই বৎসর আষাঢ় মাসে খুব বেশি বৃষ্টির দেখা না পাওয়া গেলেও শ্রাবণ মাসে অনবরত বৃষ্টি চলছেই। আজ সারাদিন শুধুই বৃষ্টি - কখনো খুব মুষলধারায় আবার কখনও ঝিমঝিম করে, কিন্তু বৃষ্টির বিরাম নেই।
প্রকৃতির সৃষ্ট যত রকমের আশ্চর্য আছে তার মধ্যে আমার কাছে বৃষ্টি খুবই অন্যতম। এখনোও জানালার ফাঁক দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বৃষ্টির ধারা অবিরাম ঝড়ে পড়া দেখতে দেখতে অন্য এক কাল্পনিক রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করি। সে রাজ্যে শুধুই বৃষ্টির অনবরত ঝড়ে পড়া আর অনন্ত গতিশীলতা।
আমাদের বাড়ির তিন দিকে সবুজ মাঠ এবং একদিকে রাজপথ ও লোকালয়। এইরকম ভৌগলিক অবস্থান হওয়ায় মা-র চিরকালই একটা অভিযোগ ছিল, কিন্তু আমার বেশ ভালই লাগে, কারণ জানালা দিয়ে দূরে তাকালেই অসীম আকাশ, সবুজ ধানের ক্ষেত, বৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য, রাতে পাশের জঙ্গলের থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক, বড়ো বড়ো গাছে ক্লান্ত পাখিদের ঘরে ফেরা এবং সর্বোপরি গভীর রাতের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা -এই সব দেখা যায়। এসবের মধ্যে ছোটবেলায় বৃষ্টির সৌন্দর্য আমি খুবই উপভোগ করতাম। এখন দীর্ঘদিন কোলাহলপূর্ণ, ব্যাস্ততায় ভরা শহরে অবস্থান কালে সেই ছোটবেলার বৃষ্টিমুখর সেই রূপ খুব মনে পড়ছে।
২০১০-১১ সাল পর্যন্ত গ্রামে তখন ইলেকট্রিক এখনকার মতো এত সময় ধরে সেবা করত না, তখন বৃষ্টি হলেই বিদ্যুৎ চলে যেত এবং আবার ফিরে আসত ২-৩ দিন পরে। স্বাভাবিক ভাবেই বর্ষার মরসুমে ইলেক্ট্রিক বিহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হতো। হ্যারিকেন অথবা লন্ঠণের আলোয় দিন কাটাতে হতো। সন্ধ্যা হলেই জানালা দিয়ে বাইরের দিকে বৃষ্টির অবিরাম গতিতে ঝড়ে পড়া দেখতাম, সঙ্গে মা ভাঙ্গা চালের তৈরি মুড়ি সঙ্গে তেল, পেঁয়াজ কুচি ও বাদাম ভাজা দিতেন, ঐ প্রিয় খাবারটি খেতে খেতে বাইরের বৃষ্টিকে উপভোগ করতাম। দেখতাম পাশের পুকুর থেকে একদল হাঁস খাবারের সন্ধানে ছোট ছোট সবুজ ধানক্ষেত এর মধ্যে হন্যে হয়ে কি সব খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখতাম গাছগুলো বৃষ্টির জলে নিজেকে চির পবিত্র করে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করছে না। দেখতাম ব্যাঙের ক্রমাগত চিৎকার, প্রশ্ন জাগতো ওদের ঐ চিৎকার আনন্দের নাকি বিভিষিকার। দেখতাম দূরে ঐ বড়ো গাছের উপর ভিজে গায়ে পাখিগুলো অপেক্ষা করছে বৃষ্টি থামার তাছাড়া ওদের কোন উপায় নেই কারণ ওদের নিরাপদ স্থান ঐ গাছের উপর, নিছক ডাল পালা দিয়ে তৈরি ছোট বাসা। তখন কৌতুহল জাগতো আচ্ছা আমরা আমাদের সামান্যতম সমস্যা হলেই মা- বাবাকে অভিযোগ করি অথবা ভগবানকে দোষারোপ করি কিন্তু ঐ পাখিগুলো তাদের অভিযোগ কাকে জানায় ! এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি তবে আমার মনে হয় ওরা আমাদের মতো অপরিনত মনুষ্য জাতির তুলনায় হয়তোবা একটু বেশিই পরিণত, হয়তো ওরা জানে আমার নিজের শক্তিতে যখন এই বৃষ্টিকে থামাতে পারবো না, তাহলে সর্বশক্তিমান ইশ্বরের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে সবকিছু সহ্য করাই করণীয়, যেমনটি অবতার পুরুষেরা সচরাচর বলে থাকেন।
যাইহোক মা-র হাতে তৈরি ঐ স্পেশাল মুড়ি খেতে খেতে অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্ন জাগতো মনে, মাকে জিজ্ঞেস করতাম -মা এত জল কোথা থেকে আসে, মা গ্রাম্য সরল যুক্ততে উত্তর দিতেন -" ঐ আকাশের উপরে দেবতাদের ঘর আছে, শুনেছি ওখানে খুব বড়ো জলের সমুদ্র আছে সেটাই মাঝে মাঝে ফুটো হয়ে যায়!", পরে বড়ো হয়ে বিজ্ঞানের বইয়ে পড়েছিলাম সূর্যের প্রখর তাপে ভূপৃষ্ঠের জল বাষ্পে পরিণত হয়ে মেঘ হয়ে আকাশে জমতে থাকে, পরবর্তীকালে মেঘের ঘর্ষণের ফলে বৃষ্টির সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমার কল্পনার রাজ্যে মায়ের ঐ যুক্তিটাই প্রযোজ্য হয় এখনোও। আমার কল্পনার রাজ্যে বিজ্ঞানের যুক্তির কোন প্রবেশাধিকার নেই কারণ বিজ্ঞান হয়তো বেগ দিয়েছে কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আজকের বিজ্ঞানের ব্যস্ত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখলে ভয় হয়, কত সন্তর্পনে আমাদের কাছ থেকে আমাদের সূক্ষ্ম বিচারের অবসরটুকুও কেড়ে নিচ্ছে - একদিন হয়তো এমন দিন আসবে যেদিন বৃষ্টি ব্যাকুল হয়ে তার অপরূপ রূপ দেখানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করবে কিন্তু আমাদের অবচেতন মনে সেটা উপভোগ করার সূক্ষ্ম বাসনাটাই হয়তো আর থাকবে না।
" আজকে আর বৃষ্টি থামবে না আর কারেন্টও আসবে না আয় খেয়ে নে" - মায়ের এই আহ্বানে আমার অবচেতন মনের ঘোর কাটতো। খাবার বলতে সেরকম কিছু না আমার প্রিয় দুধ-ভাত অথবা দুধ দিয়ে মুড়ি মাখা। মনে পড়ে হ্যারিকেনের সলতের পোড়া গন্ধ আর বাইরের বৃষ্টির সুন্দর ছন্দে আওয়াজ শুনতে শুনতে কখন যে খাবার শেষ হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। অনেক রাতে বাবা কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন দেখতাম তার সমস্ত শরীরটা পুরো ভিজে গিয়েছে - দৃশ্যটা খারাপ লাগত, পরে বুঝলাম দায়িত্ব জিনিসটা আসলেই খুব কঠোর ও করুণা বিহীন।
মনে পড়ে একবার মা এবং আমরা দুই ভাই আমাদের একটা ঘরে চুপচাপ বসে আছি, বাইরে প্রবল বৃষ্টি, দূরে লম্ফের আলোটা মিটমিট করে জ্বলছে হয়তো ঐ লম্ফের আলোটা তেলের অভাবে কিছুক্ষণ পর নিভে যাবে। হঠাৎ আমার কি মনে হলো জানি না পাশে পড়ে থাকা একটি বড়ো জামা এবং বাবার বড়ো প্যান্ট পরিধান করে নিজের মনেই কোন সঙ্কোচ না করেই অভিনয় শুরু করে দিয়েছিলাম, দর্শকদের আসনে ভাই ও মা ছিলেন। মা এখনও বলে তোর ঐ দিন ওই মাতালের অভিনয় টা মনে আছে? আমি জীবনে অনেক অভিনয় দেখেছি কিন্তু তোর ঐ অভিনয়টা সেরা। পৃথিবীর সব মায়ের কাছেই তার সন্তানের সামান্য জিনিসটাও সর্বোত্তম মনে হয়, যদিও আমি কি অভিনয় করেছিলাম পুরোটা মনে নেই তবে এতদিন পরেও মায়ের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার মানে ঐদিন খুব ভালোই অভিনয় করেছিলাম।।
তাছাড়াও বৃষ্টির সাথে আমার এত সখ্যতার একটি বড় কারণ এই যে খুব জোরে বৃষ্টি হলে আমাকে স্কুল ও কোচিং সেন্টার যেতে হতো না। প্রবল বৃষ্টি হলে মা বারণ করতেন স্কুল যেতে, এই অঘোষিত ছুটি উপভোগ করার জন্য আগের দিন রাতে ঈশ্বরের কাছে কাতর ভাবে প্রার্থনা করতাম। ঈশ্বর কখনো কখনো ঐ অঘোষিত ছুটি মঞ্জুর করতেন কখনো করতেন না। এই অঘোষিত ছুটি আমার কাছে নবজীবন লাভ করার মতোই আনন্দের। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর সবকিছু সমস্যা থেকে অথবা সমস্ত কিছুর থেকে এই অঘোষিত ছুটি কবে পাব!! ছোটবেলায় তো বৃষ্টির দয়ায় সেটা সম্ভব হতো কিন্তু এখন এই অনলাইনের যুগেও কি বৃষ্টি আমাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারবে?? উওরটা জানি, কিন্তু তবুও প্রশ্নটা বৃষ্টির কাছেই থাক।।
এখন বাইরের বৃষ্টিটা আমার জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে, জানিনা হয়তো ঐ উত্তরটা দেবার ব্যার্থ প্রয়াস করছে।।
