পৌষ সংক্রান্তি
পৌষ সংক্রান্তি
ছোটবেলায় পৌষ সংক্রান্তি মানে বুঝতাম মায়ের হাতের তৈরী সুন্দর পিঠা-খাবার খাওয়া এবং বিকালে গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ দামোদর নদীর ঐ পাড়ে বিশাল মেলা, অনেক মানুষের ভিড়, মেলার প্রাঙ্গনে হুগলী জেলার তাঁতীপাড়ার মানুষের আলুর তরকারি দিয়ে মুড়ি খাওয়া ইত্যাদি। হয়তোবা কয়েক হাজার মানুষ ঐ মেলায় আসত কিন্তু মা বলতেন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে নাহলে ঐ ভীষণ ভীড়ে হাড়িয়ে যাবি বাড়ি ফেরা হবে না, তখন ভাবতাম মা যদি আমার হাতটা একটু আলগা করে দেয় আমি এক দৌড়ে ঐ খেলনার দোকান গুলোতে গিয়ে দেখতাম, যদি হাতে টাকা থাকত ঐ ঝুড়ি ভর্তি জিলিপি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিতাম, যদি একটু মুক্ত হতে পারতাম তাহলে ঐ নাগরদোলায় চড়ে আকাশটাকে ছুঁয়ে দেখতাম। কিন্তু খুব আশ্চর্য লাগে আজ আমি মায়ের বন্ধন থেকে কিছুটা মুক্ত কিন্তু সেই ছোটবেলার বদ্ধ অবস্থার বেপরোয়া ইচ্ছে গুলো এখন আর একটুও নাড়া দেয়না, সেই ইচ্ছেগুলো কত ছোট লাগে! তাহলে কি সেদিনের সেই ইচ্ছে গুলো মিথ্যা ছিল? না না তাই কি করে হয় সেদিনও তো সেই ছোট্ট আমির মধ্যে আজকের আমিই ছিলাম!!! এর একটাই কারণ হতে পারে সেটা হল উত্তরণ। ছোটবেলার সেই বেপরোয়া ইচ্ছেগুলো এখন আর ভীড় করে দাঁড়িয়ে নেই, মনের উত্তরণ হয়ে গিয়েছে আর ঐ গতিশীল উত্তরণই জীবন।
ঈশ্বরের প্রেরিত দূতেরা বারবার আসেন এই উত্তরনটা আমাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁর দূতেরা আসেন আমাদের উত্তরণের স্বর্ণপথটি দেখিয়ে দেবার জন্য কিন্তু তার পরিবর্তে তাঁর কোন চাহিদা নেই বা পূজিত হবার উদগ্র বাসনা নেই বরং তিনি চান আমারা যেন পূজিত হই তাঁর নিজের দর্পণ হয়ে অনন্ত কাল ধরে। শুধুমাত্র তিনি চান যেন আমরা তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকি ঐ মায়ের মতোই যাতে করে এই বিশাল প্রবৃত্তির ভীষণ ভীড়ে হাড়িয়ে না যাই, অবান্তর ইচ্ছেগুলোকে পোষণ করতে গিয়ে কষ্ট না পাই। আমাদের কষ্টটা আমাদের যত না কষ্ট দেয় তার থেকে বেশি কষ্ট দেয় আমাদের সৃষ্টিকর্তা পরমপিতাকে, ঠিক যেমন আমাদের শরীর খারাপ হলে মায়ের কিছুতেই যেন স্বস্তি হয়না। এই উত্তরণটা যতদিন না আমাদের প্রাণে জেগে ওঠে ততদিন ঈশ্বরের স্বস্তি নেই তিনি অনন্তকাল ধরে আমাদের পথ চেয়ে বসে থাকবেন।
যাই হোক সময়ের সাথে সাথে পরে জানতে পারলাম যে পৌষ সংক্রান্তি মানে শুধু দামোদরের পাড়েই মেলা হয়না, গঙ্গাসাগরের সঙ্গম স্থলে বিশাল মেলা হয় যেখানে সারা দেশ থেকেই বহু মানুষজন, সাধু সন্যাসী আসেন, সে এক বিশাল জনজোয়ার লক্ষ লক্ষ পুন্যার্থীর ভীড়। গতবছর একবার সৌভাগ্য হয়েছিল একাই সেই দূর্গম পথ ও লক্ষ ভীড়ের মধ্যে পথ চিনে পৌঁছানোর। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় যখন ঐ ভীড়ের মধ্যে মাকে খুঁজে পেলাম ( মা কিছুদিন আগেই পৌঁছেছিল) তখন মার মুখে বেশ স্বস্তির হাসি ছিল, জানিনা ঐ হাসিটা কি হাজারো ভীড়ের মাঝে আমাকে চিনে নেবার আনন্দ নাকি আমাকে পথ দেখানোর কর্তব্য থেকে ছুটি পাওয়ার আনন্দ!!
কিছু প্রশ্নের উত্তর না পাওয়াটাও বেশ ভালো লাগে।
এ বৎসর কলিকাতার রাজপথেই কাটল, আর ভিড় ভালো লাগেনা। ভয়ানক শীতের ভোরে গঙ্গার পার বরাবর হেঁটে চললাম বেশ অনেকটা, তখনও গঙ্গার ঘাটে উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়নি, অনেকেই তৈরি হচ্ছে এই পুন্য দিনে গঙ্গার বুকে নিজের সারাবছরের সঞ্চিত পাপ ভাসিয়ে দেবার জন্য। জান্তেই হোক অজান্তেই হোক আমাদের সকলের চাহিদা কিন্তু সেই চির পবিত্র হওয়া, হাজার হোক আমরা তো সেই চির পবিত্র, চির মুক্ত, চির সত্যময়ের সন্তান। কিছুটা এগিয়ে আসতেই দেখি এই ভয়ানক শীতে পথের দুধারে লাইন দিয়ে নারায়নের দরিদ্র অবতারের দল বসে আছে নারায়নের ধনী অবতারের থেকে কিছু অনুগ্রহ ও কিছু ভিক্ষা পাবার আশায়। সম্ভবত ওরা খুব দূরের গ্রাম থেকে এসেছে, ওদের দেখে খুব কষ্ট হলেও বেশ উপভোগ করছিলাম কারন ওদের দেখলাম ওদের চাহিদা গুলো খুবই নিয়ন্ত্রিত, খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট এবং ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি প্রসন্নতা লুকিয়ে আছে। আমার খুব ইচ্ছে থাকলেও কিছুই করতে পারলাম না ওদের জন্য কারন সামান্য জিনিস ওদের দিয়ে আমার সন্তুষ্টি হয়না।
শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে ওদের জন্য প্রার্থনা করলাম ওদের ঐশ্বর্য দিও সাথে ঐ ঐশ্বর্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিও, ওদের সুস্থ রেখ, এদের ঐ প্রসন্নতা যেন চিরকাল থাকে।।
আজ মকর সংক্রান্তির পুন্য লগ্নে তোমায় প্রনতি । আমি জানিনা কিসে আমার মঙ্গল আমার ভিতর তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। তোমার চরণধূলার পুন্য সলিলে নিত্য যেন অবগাহন করে পুন্য হতে পারি অনন্তকাল ধরে।