বন্ধুত্ব
বন্ধুত্ব
পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে, কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় মানুষ ছাড়া কোনো জীবই তা বিশ্লেষণ বা উপোভোগ করতে পারে না। আজ তেমনই দুই মানুষ , যদিও জানি না তথাকথিত সভ্য সমাজ তাদের মানুষ বলে মেনে নেবে কিনা তাদের গল্প বলব । হাওড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ডিহিভূরশুট এ কৃষ্ণ নামে একজন থাকত , সে পড়াশোনা করার জন্য কলিকাতা শহরের একটি রামকৃষ্ণ আশ্রমে থাকত। ছেলেটি খুবই দরিদ্র ও অদ্ভুত রকমের ছিল ।তার ছিল না বেশি বন্ধু বান্ধব খুব বেশি হলে তার পাঁচ জন বন্ধু ছিল । অবশ্য সে এমনই একঘেয়ে রকমের ছিল ও স্পষ্ট বক্তা ছিল যে কেউই তাকে পছন্দ করত না। তার ছিল না কোন নেশা করার ঝোঁক অথবা কোন পার্টি তে বন্ধু বান্ধব মিলে আনন্দ করার ঝোঁক এবং ছেলেটি আমিষ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলে।
সুতরাং দেখতে গেলে ছেলেটি সম্পূর্ণ অদ্ভুত রকমের।
সে বই পড়তে খুব ভালো বাসত , আর সেটা যদি আধ্যাত্মিক হয় তো কথাই নেই ।সে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দিতে ভালোবাসত গাছ , নদী,পাহাড় এমনকি ইতর জীবজন্তুকে পর্যন্ত সে খুব ভালো বাসত এবং তাদের সঙ্গে কথা বলত। দেশের সৈনিক দের কাছে যেমন দেশই শেষ কথা দেশের জন্য প্রান পর্যন্ত দিতে পিছপা হয়না তেমনই কৃষ্ণের কাছে শাস্ত্র ,পুরান, বেদ এ সবকিছুই জীবনের তুলনায় খুবই বড়।
বর্তমানে পৃথিবীতে শাস্ত্র এর অবমাননা দেখে তার খুব কষ্ট হয়, বুকের ভিতর টা দুঃখে ভরে ওঠে। তার কতকগুলো আধ্যাতিক বিষয়ের উপর WHATSAPP. গ্রুপ ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধিত । যেটাতে স্বামী বিবেকানন্দ এর ত্যাগ ও আদর্শের কথা আলোচনা করা হয়। ঐ গ্রুপ এর মাধ্যমে তার পরিচয় হয় সুদূর উড়িষ্যার একটি ছেলের সঙ্গে, ছেলেটি কৃষ্ণের থেকে বছর দুয়েক এর ছোট তার নাম ছিল অশ্বীনী। ছেলেটির বাবা গত হয়েছেন,মা ও দুই বোন মিলে ছোট একটি পরিবার, বাবা না থাকার কারণে তার পরিবারকে অনেক পারিপার্শ্বিক অত্যাচার এর মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত। সুতরাং অশ্বীনীর সব কিছু থাকলেও নিজে বড় একা কৃষ্ণেরই মতো। সে চায় বড় হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে এবং তার জন্য সে আই এ এস হতে চায়। তারও কিছু বদঅভ্যাস আছে কৃষ্ণেরই মতো যেমন তার বন্ধু সংখ্যা কম, আমিষ খায় না, প্রকৃতি প্রেমী । সুতরাং একজন পাগলকে একজন পাগলই চিনতে পারে, কৃষ্ণ শাস্ত্রের জন্য পাগল আর অশ্বীনী আই এ এস হয়ে দেশ সেবার জন্য পাগল। হয়ে গেল তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব যদিও কৃষ্ণ ওডিয়া ভাষা বোঝে না আর অশ্বীনী বাংলা বোঝে না , কোনরকমে কাটা কাটা হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলে ওরা। দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসত এবং কথা বলে আনন্দ পেত।
এবার আসি ওদের দুজনের বন্ধুত্ব হবার ইতিহাসে।
আগেই বলেছি যে কৃষ্ণের Whatsapp গ্রুপ ছিল এবং তাতে স্বামীজির আদর্শ অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য বা celebacy নিয়ে আলোচনা হতো। আর অশ্বীনীর কৌতুহল ছিল স্বামীজির স্মরনশক্তি সম্বন্ধে । যেহেতু স্বামীজি ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে অটুট স্মরনশক্তি লাভ করেন তাই অশ্বীনীও ব্রহ্মচর্য পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষ্ণকে whatsapp এ দেখে তার মনে হয় সে ব্রহ্মচর্য পালন করে। তার পর থেকেই তাদের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। ব্রহ্মচর্য সম্বন্ধে দুজনের আলোচনা জমে ওঠে। অশ্বীনী বারবার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করে যেত নিজেকে একশো শতাংশ তৈরি করতে। অশ্বীনীর বেলুড় মঠ খুব আকর্ষণীয় লাগত আর কৃষ্ণের ওড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দির, যদিও তারা দুজন দুজনকে সামনাসামনি কখনো দেখেনি।
কৃষ্ণের সঙ্গে অশ্বীনীর প্রায় নব্বই শতাংশ মিলে যেত, তাদের পছন্দ প্রায় একইরকম ,দুজন দুজনের মনের কথা বলে ওরা হালকা হতো।
ওদের দুজনকে স্কুল বা কলেজে কেউ বিরক্ত করত না, এমনকি পিকনিকেও নিয়ে যেত না এই ভেবে যে ওরা অন্য গ্রহের জীব। এই একই কারনে তাদের কোন গার্লফ্রেন্ডও ছিল না।
ইশ্বর কৃষ্ণের তুলনায় অশ্বীনীকে অনেক রকমের গুন দিয়েছেন যেমন জিমন্যাস্টিক এ জাতীয় স্তরে চ্যাম্পিয়ন, বিভিন্ন ইন্টারন্যাশ্যানাল বই এর রাইটার , সুন্দর গানের গলা ইত্যাদি।
বয়সে ছোট হবার কারণে অশ্বীনী বরাবরই একটু কথা বলতে সংকোচ বোধ করত কিন্তু কৃষ্ণ বয়সকে একটি সংখ্যা বিবেচনা করে তাকে ভালোবাসতো।
কৃষ্ণের অনেক অবান্তর ইচ্ছের মধ্যে অন্যতম হলো লন্ডনে টেমস নদীর তীরে একটু হাঁটাচলা করতে এবং আমেরিকা তে কিছুদিন থাকতে ,অশ্বীনী কথা দিয়েছে যে ও যদি UPSC তে নির্বাচিত হয় তবে ও কৃষ্ণ কে বিদেশ ভ্রমন এ নিয়ে যাবে।
এইভাবেই সম্পূর্ণ অচেনা অজানা দুই বন্ধু শুধুমাত্র ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ।
অশ্বীনীর একটি নরম হৃদয় আছে কিন্তু এটার জন্য ওকে অনেকেই ঠকিয়ে নেয় , ও সবই বোঝে কিন্তু ঐ সব কিছু সহ্য করে নেয়।
দুজন দুজনকে খুবই ভালোবাসে কোন চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই।
হয়তো এইভাবেই ইশ্বর জগতে যারা একা তাদের মতোই সমচরিত্রের বন্ধু তৈরি করে রেখেছেন যাতে তারা জীবনটা উপভোগ করার সুযোগ পায়।
সমাজে হয়তো এরকম অসংখ্য কৃষ্ণ ও অসংখ্য অশ্বীনী দেখতে পাবেন যারা হৃদয় থেকে সম্পূর্ন একা সব থেকেও কিছু নেই। এই একাকিত্ব ও সামাজিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই নিজেদের শেষ করে দিতে চায় স্তব্ধ করে দিতে চায় জীবনের স্পন্দন, তাদের খোঁজ করা উচিত এরকম বন্ধু যারা তাদের জন্য বাঁচার নতুন আশা হলেও হতে পারে।