STORYMIRROR

KRISHNA JANA

Classics Inspirational Others

4  

KRISHNA JANA

Classics Inspirational Others

রূপ- অরূপ

রূপ- অরূপ

4 mins
291

দুই পাগল, না ঠিক পাগল না তবে কিছুটা সুস্থ, একজন রূপ আর একজন অরূপ। রূপ অরূপের থেকে বয়সে কিছুটা রড়ো‌, তাতে কি পাগলদের ওসবে কিছু আসে যায়না। দুজনেই মাতৃশক্তির‌ দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত। রূপ তার বাড়িতে শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে‌ কর্তী মনে করে সমস্ত কাজ কর্ম করে, আর অরূপ মাতৃশক্তির‌ সীমাহীন ভালোবাসাকে‌ অনুভব করে মাকে যখন তখন কষ্ট দেয়। অরূপ মাতৃশক্তির কাছে একটা বিশেষ আশীর্বাদ চেয়েছিল যে‌ ' তার চারপাশে যেন‌ সর্বদা সৎ ও সরল মানুষগুলো ঘিরে থাকে, বিষাক্ত মানুষজন যেন একটু দূরে থাকে।' রূপ এর বাড়ি হুগলী জেলায় কিন্তু অরূপ একপ্রকার গৃহহীন, গৃহের থেকে অনন্তের মোহ তার কাছে প্রবল। রূপ খুব কথা বলতে ভালোবাসে ভক্তির‌ কথা, মা'র কথা, তার কথা যেন ফুরায় না অপরদিকে অরূপ তার কথা একপ্রকার যেন শেষ, কার‌ সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেনা, ও যে‌ গ্রামে থাকে তার অনেক লোককেই সে চেনেনা, কে কাকু হয় বা কে ভগিনী হয় সে জানেনা।

যাইহোক রূপের সঙ্গে অরূপের দেখা হয় গতবছর সরস্বতী‌ পূজায় হুগলীর স্বজন‌ নামক একটি মন্দিরে, সেখানের এক পুরোহিত ওদের আলাপ করিয়ে দেয়। তারপর কিছুদিন পর দুই পাগল মিলে ঐ পুরোহিতের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয় এভাবেই তাদের মধ্যে সখ্যতা বাড়ে‌ , চলতে থাকে অন্তরের নিবিড় ভাব আদানপ্রদান। এরমধ্যেই অরূপের‌ মধ্যে রূপের বাড়িতে যাওয়ার প্রবল আকর্ষণ পেয়ে বসে তার কারণ অরূপ যেগুলো ভালোবাসে মন্দির, নদী, বিগ্রহ, আশ্রম, ভালোবাসা সেগুলো সে রূপের বাড়িতেই পেয়ে যাবে একসাথে। অবশেষে সে বেড়িয়ে পরে রূপের সন্ধানে, এক গরমের দুপুরে সে পৌঁছে যায় রূপের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখে রূপের বাবা মা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিতে থাকে তাকে এবং এটাও বলে যে, রূপ যেমন‌ আমার ছেলে তেমনি অরূপ‌ও আমার ছেলে তোমার যা লাগবে আমাকে বলবে নিঃসঙ্কোচে। আহা ! কত সুন্দর ভালোবাসার স্পর্শ যেন অরূপের মনের অন্দরে গিয়ে আঘাত করে কিন্তু অরূপ বিরহকে প্রচন্ড ভয় করে কারন বিরহের কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনা কোনভাবেই, তাই সে চেষ্টা করে সমস্ত বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কিন্তু ভালোবাসা তাকে পরাস্ত করে বারংবার।

দুপুরের আহার শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল দুজনে বিকালে বিস্তর প্ল্যনিং‌ আশ্রম, গঙ্গা, পথ সব অপেক্ষা করছে তাদের আগমনের।

অবশেষে বিকাল সাড়ে চারটায় তারা বেড়িয়ে পড়ল, প্রথমে রূপ নিয়ে গেল গঙ্গার দিকে, সেখানে প্রচন্ড ভিড় থাকার দরুন তারা একটি পুরানো রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গেল যেটা নাকি প্রায় পাঁচশত বছরের বেশি পুরনো। ছোট বাচ্চাদের যেরকম চকলেট পেলে আনন্দিত হয় সেরকমই অরূপের পুরাতন মন্দির দেখলে হয়। তারপর সেখানে দীর্ঘ কাল প্রতীক্ষারত বিগ্রহ তাদের দর্শন দেন। তারপর তারা কোন এক ঐতিহাসিক মাতৃপ্রতিমার‌ দিকে এগিয়ে যায়। রূপ ঐ‌ বিগ্রহের সমস্ত রোমাঞ্চকর গল্পগুলো বলতে থাকে, কয়েক লক্ষ ভক্ত ঐ‌ পূজোর সময় নাকি একত্রিত হন, উপহার স্বরূপ মাকে একটা বড় গাড়ি দেন কোন এক ভক্ত ইত্যাদি‌ নানান গল্প। অরূপ সাধারণত ভীড়‌ এড়িয়েই‌ চলে সে মা'র সাথে‌ একান্তে অনেক না শেষ হ‌ওয়া কথা বলতে চায় অনন্তকাল ধরে!

তারপর ওরা কিছুক্ষণ গঙ্গার ধারে বসে গল্প করতে থাকে।

ঠিক সন্ধ্যার কিছু আগে তারা পৌঁছে যায় একটি শান্তিপূর্ণ আশ্রমে‌, সেখানে রূপ খুব উচ্চমার্গের দুটি গান গাইলেন সম্ভবত মাতৃসঙ্গীত, অরূপের নিজস্ব কোন জাগতিক গুন‌ নেই সে প্রায় মূর্খ। গান করে রূপের ভেতর ভক্তির বিদ্যুত‌ খেলে গেল সারাশরীরে শুধুমাত্র অরূপ‌ই সেটা অনুভব করল। তারপর অবশেষে আশ্রমের মোহকে‌ জয় করে তারা চলতে শুরু করল, পথে অনেক জায়গায় বাড়ির‌ সঙ্গে যুক্ত ছোট ছোট মন্দিরে পূজা পাঠ চলছে, অরূপ সেই সব লোভ ছাড়তে না পেরে বসে পড়ে মন্দিরের সিঁড়িতেই‌, গৃহস্বামীদের মুখে অবজ্ঞার হাসি ফুটতে থাকে তাদের রকম দেখে।

রূপের এক খুব 'ভক্ত' দিদিমা (যদিও সে তাকে বান্ধবী মনে করে) সেখানে নিয়ে যায় অরূপকে, দুজনকে দেখে ঐ বান্ধবী আনন্দে যেন পূর্ণ হতে লাগলো সে পূর্ণতার কোন পরিমাপ করা যায়না। সেই বান্ধবী অচেনা অরূপের হাত ধরে তার সমস্ত বাড়ি ঘোরাতে থাকে সাথে অরূপের কাশীধাম‌ যাবার‌ অলৌকিক কাহিনী শুনতে থাকে। কিছুতেই উনি তাদের কাছছাড়া করতে চায়না অবশেষে রূপের কন্ঠে সুমধুর গান শুনে তবে তাদের বিদায় দিলেন। কি অপূর্ব ভালোবাসা! যে কেউ পূর্ণ হয়ে যায় সেই গভীরতায়।

রাত্রিভোজনের পর অনেক রাত পর্যন্ত তারা গল্প করে, সেসব‌ অযৌক্তিক গল্পের কাছে রাত্রির গভীরতা যেন ফিকে হয়ে আসে।

অবশেষে এল সেই মুহূর্ত যখন‌, অরূপকে বিদায় নিতে‌ হবে । মন তো তাদের অখন্ড আবেগে ভরপুর হয়ে আছে কেউ কাউকে ছাড়তে চায়না, কিন্তু সত্য বড়‌ই নিষ্ঠুর, ভালোবাসার মধ্যে বিরহের বীজ ছিটানো থাকে তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের নেই‌। পাগল রূপ, 'অরূপকে‌' স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসে কিন্তু স্টেশন‌ পর্যন্ত‌ এসে অরূপ বায়না শুরু করে তাকে যেমন‌ এগিয়ে দিতে এসেছে, সে যেন‌ পুনরায় তাকে গৃহের দিকে এগিয়ে দেয় কিছুটা পথ!!

আশ্চর্যের কিছু নেই পাগল ভালোবাসা, অবশেষে অরূপ কিছুটা পথ তাকে এগিয়ে দিয়ে আসে, এবং অরূপের রূপকে আলিঙ্গন করার খুব ইচ্ছে হয়। দুজনে প্রেমের আলিঙ্গন করে দুজনেই দুদিকে চলে গেল।

এটা নিছকই একটি রূপক কাহিনী যার‌ বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই‌। আমাদের সকলকেই রূপ -অরূপের আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হবে অনন্তকাল ধরে। পরমপিতা‌ আমাদের সহায় হন, শক্তি দিন!!!!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics