স্বা ধী ন তা
স্বা ধী ন তা
তখনও পতাকা উত্তোলন এর প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়নি, চলছে পতাকার খুঁটে ফুল বাঁধার কাজ, চারিদিকে দেশাত্মবোধক গান চলছে, সবাই নিজেকে স্বাধীন প্রমাণ করার চেষ্টায় নিয়োজিত। গতকালই ঠিক করেছিলাম নিজেকে 'স্বাধীন' প্রমাণ করার চেষ্টা করা দরকার(যদিও সর্বদা স্বাধীন থাকারই চেষ্টা করি) । হঠাৎ ফোনের ওপার থেকে আমার এক প্রিয় বন্ধু সৌভিক প্রস্তাব দিল জযরামবাটি ও কামারপুকুর গেলে কেমন হয়! সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলাম। আগে অনেকবার চেষ্টা করেও ঐ স্থানে যাওয়া হয়নি, হয়তো সারদা দেবী জয়রায়বাটিতে এতদিন অন্য সন্তানদের নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন হয়তো আমার জ্বালাতন সহ্য করার জন্য এতদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
খুব সকালে বেরিয়ে পড়লাম ৭:২৫ এর গোঘাট লোকালে উঠে পড়লাম দুজনে। ট্রেনের মধ্যে ও বাইরে বিভিন্ন মনোরম ঘটনার সাক্ষী হতে হতে চললাম, কত রকমের মনিমুক্ত ছড়ানো চারিদিকে কিন্তু দুঃখের বিষয় চুরি করতে কেউ এগিয়ে আসছে না!
হঠাৎ ট্রেনের মধ্যে একজন(নেশাগ্রস্ত )বিভিন্ন ধরনের গান গাইতে শুরুকরে দিল, কয়েকজন মুগ্ধ হয়ে টাকা দিতে এগিয়ে এলে উনি বললেন " না না টাকা লাগবে না আমি এমনই গাইছি! "-ওদের দুই বন্ধুতে খুব হাসলাম!
তারপর দেখলাম দুটি বাচ্চা ছেলে গলায় গানের যন্ত্র ঝুলিয়ে ভিক্ষা করছে, আজকের জন্য স্বাধীন থাকার চেষ্টায়। খুব কষ্ট হল দৃশ্যটি দেখে! এদের জীবনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কতটা কঠিন! আমি যখন ওদের বয়সে পরীক্ষা দিয়েছিলাম প্রায় ৫০% কমন পেয়েছিলাম।
তারপর অনেক রকমের হকাররা ট্রেনে উঠে নিত্যনতুন ভঙ্গিতে জিনিস বিক্রি করছে কত বিচিত্র রকমের স্লোগান!
কেউ গামছা বিক্রির উদ্দেশ্যে বলছে " হরেকৃষ্ণ হরেহরে আমার গামছা যাবে ঘরে ঘরে" । এইরকম অনেক অনন্য ভঙ্গিতে তারাতারি বিক্রি করে বাড়ি ফিরে একটু স্বাধীন হবার চেষ্টায় নিয়োজিত।
কিছুক্ষণ পরে হিজরারা উঠলেন, আমরা দুজনেই ওদের খুব ভয় পাই কারণ অতীতে অনেক বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে হাতে একটা ১০টাকার নোট লুকিয়ে রাখলাম চেষ্টা করলাম যাতে না দিতে হয়, যাইহোক আমরা জয়ী হলাম টাকা দিতে হলনা। ওরা হিন্দিতে বলল খুব শিক্ষিত ওরা দেবেনা! বুঝলাম না কোন দৃষ্টিতে আমরা শিক্ষিত, আর শিক্ষার সঙ্গে এই ঘটনার কি সম্পর্ক।
ট্রেন বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে তারপর টকিপুর নামক স্টেশনে আসতেই মনে পড়ে গেল ঐ স্টেশনের কাছে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি (সম্পর্কে কাকু হন উনি)। দামোদর নদীর উপর দিয়ে ট্রেন চলছে, দুপাশে ধু ধু করছে সবুজ। নতুন ধানের বীজ বপন করেছেন কৃষকরা, ধানগাছগুলো মাথা দুলিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করার নেশায় মেতে আছে। কতো সুন্দর দৃশ্য অনেকদিন পর দেখলাম।
ঠিক ১০ টা নাগাদ ট্রেনটি গোঘাট স্টেশনে এসে থামলো, তারপর বাস ও অটোতে করে পৌঁছে গেলাম সেই চির প্রতিক্ষিত দেবীর জন্মস্থান জয়রামবাটী । অবিকৃত পল্লী, খড়ের ছাউনী সেই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। প্রসাদের টিকিট কেটে সমস্ত মঠটি দেখতে লাগলাম। অসাধারণ লাগলো।
তারপর গেলাম কামারপুকুর -শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মস্থান, এটি আরও অসাধারণ! ঠাকুরের ব্যবহৃত পুকুর, লাহাদের বাড়ি, বিষ্ণুমন্দির, ঠাকুর যে পাঠশালায় পড়তেন সেটা এছাড়াও আরও অনেক সেই সময়কার অবিকৃত সব জিনিসপত্র ইত্যদি দেখে রোমাঞ্চ অনুভব করলাম।
ঠাকুর ছোটবেলায় যখন পাঠশালায় পড়তেন তখন একটা দারুন ঘটনা ঘটেছিল - পন্ডিতমশাই যখন ছোট গদাধরকে অঙ্কের যোগ-বিয়োগ শেখাচ্ছিলেন তখন উনি পন্ডিতমশাইকে বলেছিলেন যে ঈশ্বরের সঙ্গে কখনই বিয়োগ হতে পারে না শুধুই যোগ সম্ভব এই বলে উনি শিবমন্দিরের পিছনে লুকিয়ে ছিলেন আর ক্লাস করেননি।
অবশেষে ফেরার পালা সমস্ত রোমাঞ্চকর অনুভূতি গুলো নিয়ে হাওড়াগামী ট্রেনে উঠে পড়লাম। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের বিদায়বেলার সাক্ষী হতে হতে ফিরে এলাম।
আজ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দিন- বহিঃশত্রুর হাত থেকে আমরা এই দিনে স্বাধীন হয়েছিলাম কিন্তু আমারা কি অন্তরের প্রবৃত্তি রূপ শত্রুর থেকে স্বাধীন হতে পেরেছি? অর্থ, মান, যশ - এদের থেকে মুক্ত হতে পেরেছি?
সূর্য, চন্দ্র, ধানখেত, পাখি এদের মতো কি আমরা নির্মল হতে পেরেছি? উত্তরটা প্রায় সকলেরই জানা- 'না' ।
আর এই 'না' এর কলঙ্ক ঘোচানোর জন্যই সেই এক পরমপুরুষ বারে বারে জগতে আসেন বিভিন্ন রূপ ধারণ করে কখনো অযোধ্যায় রাম হয়ে কখনও বৃন্দাবনের রাখাল হয়ে কখনও বা নবদ্বীপের নিমাই হয়ে আবার কখনও কামারপুকুরে গদাধর রূপে। আমাদের প্রবৃত্তির নেশা থেকে স্বাধীন করতে এভাবেই সেই পরমপুরুষের আগমন ঘটুক অনন্তকাল ধরে। শুধু মাত্র একটিই প্রার্থনা মনের সমস্ত প্রবৃত্তির উপরে উঠে তোমাকে যেন চিনতে ভুল না করে ফেলি - নিত্য, মুক্ত, শুদ্ধ সেই সত্যকে ।।।
তত্ত্বমসি 🙏