বৃষ্টি ভেজা মন
বৃষ্টি ভেজা মন


কানে হেড ফোন দিয়ে অলকা চোখ বুজে গান শুনছিলো আর বন্ধ চোখের দুচোখের কোল বেয়ে শ্রাবণের অবিরাম ধারার মত অশ্রুধারা বয়ে চলেছে।ছেলে এসে কান থেকে হেডফোনটা খুলে দিয়ে মায়ের পাশে বসে বলে,'যে গান শুনলে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে সেই গান বারবার কেন শোনো?'তোমাকে কতদিন নিষেধ করেছি তুমি কান্নাকাটি করলে আমার যে খুব কষ্ট হয়।
অলকা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলে,'কাঁদিনি তো।এই দেখ আমি হাসছি।'
জোর করে মুখে হাসি এনে ছেলে অর্কের দিকে তাকায়।অর্ক মায়ের বুকের উপর মাথাটা রেখে বলে,
---আজ দু'বছর হয়ে গেছে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।কিন্তু বিশ্বাস করো মা আমি বাড়িতে থাকলেই প্রতিমুহূর্তেই যেন বাবার অস্তিত্ব টের পাই।এমন অনেকদিন হয়েছে বন্ধুদের সাথে বাইরে আড্ডা দিচ্ছি হঠাৎ যেন মনেহয় বাবা আমায় বলছেন,'মা একা বাড়িতে রয়েছেন বাড়ি যা।'আবার অনেক সময় কোন কাজ করবো মনস্থির করেছি পরক্ষণে মনেহয় বাবা যেন কাজটা করতে নিষেধ করছেন।কেন এরূপ মনেহয় মা?
---আসলে তুই তো খুব বাবাকে ভালোবাসতিস,ছেলেবেলায় বাবার খুব ন্যাওটা ছিলি,আমার একটাও কথা শুনতিস না ঠিকই কিন্তু তোর বাবার সবকথা শুনতিস।তোর মনে তোর বাবার আজও সেই জায়গাটা রয়ে গেছে।তাই চেতন অবচেতনে তুই যাই করিস না কেন তোর মনেহয় তোর বাবাই তোকে বলছে।
--হয়তো তাই হবে।
তিন ছেলের পরে এক মেয়ে।আদর করে মেয়ের নাম রাখা হয় অলকা।তিন দাদা আর মা, বাবার চোখেরমনি।মাধ্যমিকে ও উচ্চমাধ্যমিকে ষ্টার মার্কস নিয়ে পাশ করে অঙ্কে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়।কলেজেই পরিচয় হয় প্রবীরের সাথে।একই সাবজেক্ট।প্রবীরও পড়াশুনায় খুবই ভালো।পড়াশুনার ব্যপারে দু'জন দু'জনকে খুব সাহায্যও করে।যার যতই শরীর খারাপ হোকনা কেনো কলেজ কেউ কামাই করেনা।বাস স্টপেজে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে কলেজে ঢুকতে হয়।একদিন সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি।চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে।মুষলধারে বজ্রপাতের সাথে দমকা হাওয়া।এক পা এগোনো যাচ্ছেনা।সামনে এগোতে গেলে হাওয়ার দাপটে পিছনের দিকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে।বাতাসের সাথে বাতাসের ঘর্ষণে এমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে যেন মনেহয় কোন দুষ্টু ছেলে শীষ দিয়ে চলেছে।রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে।অলকা বাস স্টপেজের শেডের নীচে চেয়ারের হাতলটাকে শক্ত করে ধরে বসে।তার আশা প্রবীর আসবেই।
কিছুক্ষণ পরে কাকভেজা হয়ে প্রবীর এসে উপস্থিত হয়।আস্তে আস্তে বৃষ্টি কিছুটা ধরে আসলে দুজনে কলেজ গেটে এসে দেখে সেদিন কলেজের গেটই খোলেনি।ভিজে চপচোপে হওয়া একটি কাগজ গেটে ঝুলিয়ে দেওয়া 'বৃষ্টির জন্য আজ কলেজ ছুটি'।দু'জনেই ভিজে একসার।এদিকে ওদিকে তাকিয়ে অর্ধেক ঝাঁপ ফেলা একটি চায়ের দোকানে গিয়ে ঢোকে।দোকানদারের আজ তেমন খদ্দের নেই।ওরা দোকানে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিলে তিনি চায়ের জল চাপিয়ে দেন।দু'জনের এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় কি করে তারা বাড়ি ফিরবে।অলকার তো বাসে করে বেশ খানিকটা যেতে হবে আর প্রবীরের মিনিট পনের হাঁটা পথ।
--তুই আমাদের বাড়িতে চল আলো।
---এই ভিজে জামাকাপড়ে?
--আরে সেই জন্যই তো বলছি।বোনের একটা জামা পরে চলে যাবি।চা টা খেয়ে চল আমরা হাঁটতে শুরু করি।
--কি পরিচয় দিবি বাড়িতে আমার?
--কেন বন্ধু।আর বোন তো সব জানে।
--তুই বোনকে আমাদের কথা বলেছিস?
--আরে না বলে উপায় আছে।ফোনে তোর সাথে কথা বলতে শুনে ফেলেছিলো।তারপর এমন চেপে ধরলো,মাকে বলে দেবে বললো তখন বলতেই হোল যে আমি অলকা নামে একটি মেয়েকে ভালোবাসি।
--কিন্তু কই ?তুই তো আমাকে কোনদিন বলিসনি আমায় ভালোবাসিস।
--সেতো তুই ও আমাকে বলিসনি।সবকথা কি আর মুখ ফুটে বলতে হয় রে?কিছু কিছু কথা পরস্পরকে বুঝে নিতে হয়।
কথা বলতে বলতে ওরা প্রবীরদের বাড়ির গেটের কাছে চলে আসলো।প্রবীরের বোন এসে দরজা খুলে দিয়ে অলকাকে দেখে বললো,
--তুমি নিশ্চয়ই অলকা?
প্রবীর ধমক দেয়।'এই অলকা কিরে অলকাদি বল।'
প্রবীরের বোন সুস্মিতা প্রবীরের কানে কানে বলে,'দাদা সময়মত বৌদি বলবো।এখন তো মাকে আমার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে হবে।বন্ধুকে তো আর দিদি বলা যায়না।'
প্রবীর হাত তুলে বোনকে মারতে গেলো।সুস্মিতা হাসতে হাসতে অলকার হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে গেলো।
সেদিন প্রবীরের মা অলকাকে না খাইয়ে ছাড়লেন না।সুস্মিতার একটা গোলাপী রঙ্গের সালোয়ার কামিজ পড়েছিলো অলকা।প্রবীর হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো।একসময় বোন নিজেই সুযোগ করে দেয় ওদের একাকী কথা বলার।সেদিনই প্রবীর অলকার গোলাপী ঠোঁটদুটো প্রথম ছুঁয়েছিলো।সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে কিন্তু সে অনুভূতি ব্যক্ত করার ক্ষমতা ঈশ্বর তাকে দেননি।পরবর্তীতে প্রবীর বহুবার অলকার ঠোঁটদুটিকে নানানভাবে নিজের ঠোঁট ও মুখের সাহায্যে স্পর্শ করেছে কিন্তু সেই প্রথম দিনের শিহরণ আজও যেন চোখ বন্ধ করলে অনুভূতিতে শরীর সারা দেয়।
কলেজ জীবন শেষ করেই প্রবীর কিছুদিনের মধ্যেই সরকারী কলেজে চাকরী পেয়ে যায়।অলকা তখনও বেকার।চাকরীর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এরই মধ্যে তার বাড়ি থেকে তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে।প্রথমে চাকরী না পেয়ে বিয়ে করবে না বলে কিছুদিন চালালেও বাবা,মায়ের তাকে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছার কাছে হার মানতেই হয়।বড় বৌদিকে গিয়ে সব জানায়।বড়দা শুনেই রাজি হয়ে যান।এই বড়দাই একে একে অনান্য ভাইদের ও বাবা,মাকে রাজি করায়।বিয়ের ছ'মাস পরেই সেও একটি সরকারী স্কুলে চাকরী পেয়ে যায়।প্রবীরের বোনের সাথে ছোটদা অনিকেতের বিয়েটা অলকা নিজেই ঠিক করে।দু'বছরের মাথায় অলকার কোল জুরে অর্ণব ওরফে অর্ক আসে।সকালে উঠে সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে অর্কের সারাদিনের খাবারের জোগাড় রেখে স্কুলে বেরিয়ে যাওয়া; অলকার বেরোনোর অনেক আগেই অবশ্য প্রবীর বেরিয়ে পড়ে।প্রবীরের কলেজটা একটু দূরে।অলকার স্কুলটাও দূরে ছিলো কিন্তু অর্ক পেটে থাকতে প্রবীর অনেক ছুটোছুটি করে বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে বদলী করাতে সক্ষম হয়।বাড়ির থেকে বেরিয়েই অটোতে মিনিট দশেক।নিজের বাড়িতে নিজের মা ঠিক যতটা মেয়ের যত্ন সম্পর্কে সচেতন থাকতেন অলকা বৌ হয়ে আসার পর দেখেছে তার শ্বাশুড়ীমা ও ঠিক তেমনই।যেহেতু অর্কের দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব তার শ্বাশুড়ীমায়ের তাই সে রান্নাবান্নার ব্যপারটা নিজেই করে।স্কুলের বেরোনোর মুহূর্তে কতবার যে রান্নাঘরে এসে বলেন,'বৌমা,তোমার দেরি হচ্ছে,বাকিটা আমি করে নেবো,টিফিনটা গুছিয়েছো?সেদিন তো ভুলে গেলে, সারাটাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দিলে।দাও তো টিফিনবক্সটা আমি ব্যাগের উপর রেখে আসি -----।এইরূপ আরও কত কি।অলকা ভাবে সত্যি ভাগ্য করে শ্বাশুড়ী পেয়েছে।এমন শ্বাশুড়ী কপাল না করলে ভাগ্যে জোঠেনা।
সবই ঠিকঠাক চলছিলো।কিন্তু অলকার এই সুখ দেখে বিধাতা পুরুষ মনেহয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন।অর্ক তখন সবে ক্লাস সেভেন।অর্কের ঠাকুমা একদিন বাথরুমে পরে গিয়ে কোমরে মারাত্মকভাবে আঘাত পান।সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতাল ভর্তি করানো হয়।বেশ কিছুদিন হাসপাতালে তাকে ট্রাকশান দিয়ে রাখা হয়।বয়সটা অতিরিক্ত হবার ফলে ডক্টর অপারেশন করতে ঠিক রাজি ছিলেননা।কিন্তু হাসপাতালে থাকাকালীন সময়েই ঘুমের মধ্যেই একটা মাইন অ্যাটাক হয়।কিছু আর করার ছিলোনা।অতিরিক্ত বয়স আর দুর্বল শরীর এই আক্রমন নিতে পারেনি।তিনি তার সুখের সংসার ছেড়ে চিরতরে চলে যান।
শ্বাশুড়ীকে হারিয়ে অলকা ভীষণ ভেঙ্গে পরে।নিজের মা আর শ্বাশুড়ী মায়ের মধ্যে কখনোই কোন পার্থক্য সে করেনি কোনদিন।এই সময়ে তার মা এসে তাদের কাছে দিনপনের থাকেন।তিনিও বেশিদিন থাকতে পারেন না কারন বাড়িতে অসুস্থ্য বয়স্ক স্বামীর দেখভালের প্রয়োজনে তিনি পনেরদিন পরেই তার নিজের বাড়ি ফিরে যান।অলকা তার সংসার,চাকরী,ছেলে আর স্বামী নিয়ে হিমশিম খেতে খেতে এই জীবনযাত্রায় সে অভ্যস্ত হয়ে পরে।রাতে যখন খাটে শরীরটাকে এলিয়ে দেয় তখন মাঝে মাঝে প্রবীরের আদরটাও অসহ্য মনেহয়।শরীরের সাথে মনের যে অমোঘ সম্পর্ক তাকে তো আর অস্বীকার করা যায়না।ছুটির দিনগুলোতেও এক মুহূর্ত বসবার ফুসরৎ অলকা পায়না।সেদিন কাচাকুচি,ঘরদোর পরি ছেলে আগামীবার মাধ্যমিক দেবে।বিয়ের পর সেই একবার তারা দার্জিলিং গেছিলো আর এতগুলো বছরে তাদের আর বেরোনোর উদ্দেশে বাইরে পা রাখা হয়নি।এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে তারা ঠিক করে তিনজনে মিলে গ্যাংটক যাবে।সেইমতো তোড়জোড় শুরু করে।কিছু কেনাকাটা করার জন্য এক রবিবার স্বামী, স্ত্রী দু'জনে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরে।হঠাৎ করে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। অলকা পিছন দিক থেকে প্রবীরকে জোরে ঝাপটে ধরে বলে,'এই মনে আছে আমাদের কলেজ জীবনের বৃষ্টির দিনগুলোর কথা?'বৃষ্টির শব্দে প্রবীর ঠিক ভালোভাবে কথাটা শুনতে পায়না।সে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায়,'কি বললে?'আর ঠিক তখনই তাদের বাইকের চাকাটা স্লিপ করে কাত হয়ে ঘষতাতে ঘষতাতে প্রবীরকে নিয়ে বেশ কিছুটা দূরে চলে যায়।অলকা বাইকটা কাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় পরে যায়।অল্পবিস্তর আঘাত লাগে।কিন্তু প্রবীরের মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে যাওয়ার ফলে -----।স্পট ডেথ।সব স্বপ্নআশা এক নিমেষেই ভেঙ্গে চুরমার।সময়ের হাত ধরে এই শোক আস্তে আস্তে অলকা ও তার ছেলে কাটিয়ে উঠলেও আজও যখন বৃষ্টি নামে তখন অলকার প্রথম প্রেমের ছোঁয়া আর সারা জীবনের মত সেই প্রেমিককে হারানোর বেদনা দুইই মিলেমিশে এক হয়ে চোখের কোন ভিজিয়ে দেয়।