বংশ রক্ষা(২য়,পর্ব)
বংশ রক্ষা(২য়,পর্ব)
নিতাইয়ের ছোট মেয়ে বিশাখার জামাই সুধাময় ব্যবসার কাজে মাঝে মধ্যেই, শ্বশুরের গ্রাম বকুল ডাঙ্গা আসত,তার মটোর সাইকেলে।কাজ মিটলে বাড়ি ফিরে যেতো,শ্বশুর বাড়ি আসত না।ঋনার বকুল ডাঙ্গা বাপের বাড়ি আবার শ্বশুর বাড়ি। বাবা ভীষণ অসুস্থ তাই ঋণা বাবাকে দেখতে এসেছিল। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি ফেরার পথে বকুল ডাঙ্গা গ্রামের ছোট গঞ্জ ,পিচ রোড বরারর বাসও চলাচল করে। হঠাৎই সেদিন শেষ বিকালে এই গঞ্জের পথে ঋনার সাথে মোটর সাইকেল আরোহী সুধাময়ের দেখা। ঋনা তখন পরিনত বুদ্ধির,আর রীতিমত সুন্দরী ।
ছোট ননদ বিশাখার স্বামী সুধাময় ঋণাকে পথে দেখে একগাল হেসে মটোর সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ছিল বলে "আরে বৌদি! "
ঋণা বলে "গ্রামে তো আসেন শুনেছি, একবার শ্বশুর বাড়ি তো যান না।"
"আর বলবেন না কাজের ব্যস্ততা থাকে, গেলেই তো বক বক করতে দেরী হবে।"
ঋণা মিষ্টি লাজুক হেসে বলে "আমার সাথে বক বক করতে ভালো লাগবে কেন,মূর্খ গরীব ঘরের মেয়ে।"
"সে কি বৌদি!কি যে বলেন,আপনার এমন মিষ্টি মুখ মিষ্টি হাসি,সত্যি আপনার কথা ভাবলে ভীষণ কষ্ট হয়, ভানু দা আপনার বরের যোগ্য! "
ঋণা মুখ সহসা বিষন্ন দেখায়, সে মুখ নামায়, দুঃখে হতাশায় দুচোখ জল যেন উপচে পড়ছে,দুঃখে গলা ধরে গেছিল। তাড়াতাড়ি অবেগ দুঃখ সড়িয়ে দু হাত দিয়ে চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে।একটু গলা ঝেড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঋণা হাসে, কেমন করুন অসহায় সেই হাসি!তার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে " সব তো ভাগ্য কি আর করব!" তখনও তার দুচোখ জলে ভরে ছিল,দুই ঠোঁট টিপে আপ্রাণ কান্না আটকানোর চেষ্টা করছিল।
সুধাময় ,ঋণার মুখের মধ্যে মনের দুঃখ যন্ত্রণা হতাশার অভিব্যক্তি বুঝতে পারছিল ছিল, বলল"বৌদি নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নিতে হয়, হেরে যাবেন কেন!"
"তার জন্যেও কোন সহৃদয় মানুষের সাহায্য দরকার হয়, সবার ভাগ্যে সেটা জোটে না। আপনারা বনেদী ধনী শিক্ষিত মানুষ, নিজের ঘর সংসার পরিবার সন্তানদের নিয়ে ব্যাস্ত, এমনই তো এ সমাজ!পথে মানুষ খুন হলে বা মেয়ে ধর্ষন হলে কেউ যেখানে এগিয়ে আসে না।সেই সমাজে সংসারের আপনজনেরা যখন কোন পরিবারের দুর্বল সদস্যের প্রতি শোষন নির্যাতন বঞ্চনা প্রতারনা করে, দাবিয়ে রাখে,অন্যদের নজর না পরাই স্বাভাবিক! দোষ নেই এটাই তো সভ্য সমাজ।"
সুধাময় লজ্জায় মুখ নামায়,ব্যাথিত মনে বলে,"আপনি আমাকেই বলছেন মনে হয়।"
ঋণা বলে "না না তা কেন! যদি মনে দুঃখ পান,ক্ষমা চাইছি।"
"এ কী বৌদি! ক্ষমা তো আমরা চাইব। বিশ্বাস করুন, শুধুমাত্র আপনার মুখের দিকে তাকালে ভীষণ কষ্ট পাই, তাই শ্বশুর বাড়ি যাই না।"
ঋনা ম্লান মুখে কেমন অসহায় হাসি, বলে "এই এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলটাই ভদ্র সমাজের আজ একটা বড় অভ্যাস, বিতর্কে যেতে চায় না।"
"আমি অমন নয় বৌদি, আপনার পড়াশোনা শিক্ষা, বংশ পরিচয়,বা অন্য কিছু আমার জানার বিচার্য নয়।আমার আপনার সাথে এত নিবিড়ভাবে কোন দিন কথা বলার সুযোগ হয় নি।আপনি কিন্তু ভীষণ মেধাবী,আপনার কোন কথা আমি কাটছি না। ,কথাগুলো ভীষণ সত্যি আর বাস্তব।"
ঋনা এবার সংকোচে একটু হেসে বলে "আপনার আবার অনেক দেরী করে দিচ্ছি, আপনি কাজের মানুষ। "
সুধাময় অনুনয় সুরে বলে "প্লিজ একটু দাঁড়ান,বলে পাশেই এক মিষ্টির দোকান থেকে তিন চার ধরনের দামি মিষ্টি কিনে আনে,মোটর সাইকেলের ক্যারিয়ারে ভরে হেসে বলে,"চলুন আজ আপনাকে নিয়েই শ্বশুর বাড়ি যাব, আপনার সাথে অনেক গল্প করব,মন খুলে। কিন্তু ধনী বনেদী ঘরের বৌ আপনি,বাপের ঘর হেঁটে যান কেন ! একটা মটোর সাইকেল কিনতে বলুন।"
"কে চালাবে! শ্বশুর বুড়ো, আর স্বামী তো শিশুর অধম।"
"সত্যি তাই ভাবি আপনার মত সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ের এমন বর !"
"কৈ আর ভাবেন। সুন্দরী বৌ নিয়েই সব ব্যস্ত, আমার কথা ভাবার সময় কৈ। টাকা টাকা করেই মরুন,আমার বাপ যেমন।এই তো দেখে এলাম শয্যাশায়ী আর কদিন বাঁচবে কে জানে! টাকা কে খাবে!"
"আসুন বৌদি, আপনাকে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে দি।"
ঋণা তার মটোর সাইকেলের পিছনে চেপে সাবধানে বসে বলল,"আস্তে চালাবেন কিন্তু, কোনদিন তো মটোর সাইকেলে চাপি নেই,অথচ ধনীর বাড়ির বৌ!না ছাই!"
সুধাময় বলে "আমাকে জাপটে ধরুন লজ্জা করবেন না। নতুন চাপছেন তো, পড়ে গেলে আবার বিপদ।"
ঋণা এমন পিছন থেকে সুধাকরকে চেপে ধরেছিল সুধাকর একটু অন্যরকম আবেগ অনুভব করছিল। পথে আর কী তাদের মধ্যে বেদনাঘন না রঙ্গরসের গল্প হয়েছিল কে জানে!
ইচ্ছাকৃত গল্প করতে করতে সাঝ শেষে রাতের আধাঁর নেমে এসেছিল। সেদিন রাতে সুধাকর শ্বশুর বাড়িতেই থাকল,বলল "চোখের জোর কমেছে ,চশমা আনতে আজ ভুলে গেছি, রাতে রিস্ক নিয়ে মটোর সাইকেল চালাব না। "
অন্তরে যাই হোক শাশুড়ি দেঁতো হেসে সম্মতি দেয়, থাকার পরামর্শ দেয়।
শ্বশুরের ল্যান্ড ফোন থেকে,বেশী রাত হবার কারনে শ্বশুর বাড়ি থেকে গেলাম সুধাময় স্ত্রীকে জানাল।
এইভাবে হঠাৎই বৌমার সাথে পথে দেখা ,পরে তার জামাইয়ের মটোর সাইকেলের পিছনে চেপে বৌমার সুধাময়কে জড়াজড়ি করে আসা একদম নারায়ণীর পছন্দ নয়।আবার জামাই বাপধন রাতে থাকবে! বিশাখার সঙ্গে এলেও সে থাকে না। ব্যবসা রাইস মিল নানা কাজের বাহানায় কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার দুর তাদের গ্রাম, রাত দশটা হলেও মটোর সাইকেলে বাড়ি ফিরে যায়।
কিন্ত কী বলবে! একদিকে ধনী জামাতা অন্য দিকে দুই বংশধরের মা একমাত্র বৌমা।
রাতে সুধাময়ের জন্য আলাদা ঘরে বিছানা করা হয়েছিল । জামাই বাবাজীবনের সাথে ঋনার আলাপ আজ যেন অনেক গভীর।আগে ঋনা এতটা গুরুত্ব দিতো না ।বরং তাদের সাথে একটা দুরত্ব রাখত ঋনা। হয়ত হীনমনত্যার কারনে ।আজ রাতের খাবার ঋণা নিজে খেতে দিল।জানাল আমি অনেক যত্ন নিজের হাতে রান্না করেছি,সব খেয়ে নিতে হবে আবদার বায়না করছিল ।যেন খুব কাছের মানুষ,আদরের আপন জন।নারায়ণী থ হয়ে নীরবে সব দেখছিল।
নারায়ণী রাতে স্বামী নিতাই কে চর হিসাবে ঋণার ঘরে পাঠালো তখন রাত একটা। তার অনুমান ঠিক, নিতাই জানাল,ঋণার ঘরের কপাট বাইরে থেকে ঠেসানো। ঘরে ভানু একা ঘুমোচ্ছে, ঋণা ঘরে নেই, ছোট নাতিও নেই।
নারায়ণী বুঝতে পারছিল ঋনা এখন সুধাময়ের ঘরে কিন্তু করবে কী! ধনী জামাই ভীষণ মেজাজ, আর ঋণা তো এসব ব্যাপারে কিছু বললে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সংসারের দাবা খেলায় চালাক বুদ্ধিমতী ঋণার কাছে সে যে কিস্তি মাৎ এর দোর গোড়ায় , বেশ বুঝছিল। কিন্তু না আছে তার কাছে হাতে কোন অবশিষ্ট ঘুঁটি।পাকা খেলোয়াড়দের মত,মানসিক শারীরিক অসুস্থ স্বামীকে স্নেহের বশে ঋণা কাছে টেনেছিল,শ্বশুর তো ভৃত্য,উপপতি!আধমরা বুড়ো, কচি মেয়েটাকে সুযোগ বুঝে ভোগ করছে।আবার ছোট জামাইকে মন মোহিনী রূপে একদিনেই বগলদাবা করেছে। ছোট মেয়েকে হারামীর বাচ্চাটা যে কেমন ভালোবাসে নারায়নীর চিন্তা হয়! মনে চরম দ্বন্দ্ব, একত্রিশ বছরের ছোট কন্যা বিশাখার মেদবহুল মস্ত মোটা চেহারা,আর হাই থাইরয়েড রোগী। সে কী জামাই কে ঠিক মত সঙ্গ দেয় না!
রাতে ঘুমের ওষুধ খায়,নিজের সখ মত প্রথম রাতে সুধাময়কে জড়িয়ে শুয়ে থাকে শোবার ঠিক পরে।কিন্তু সুধাময়ের আবেদনে সাড়া দেয় না। শরীর স্বাস্থ্য ও মন নানা বাহানা করে। সুধাময় মনে মনে এতে চরম বিরক্ত হয়।সভ্য সমাজ, সংসার ,সন্তান নানা কারনে নিজের শারীরিক ক্ষুধা চাহিদার সাথে আপস করে সে ক্লান্ত। ভাবে কেন মানুষ মদ খায়!কেন পতিতালয়ে যায় ! আগের দিনে ধনী জমিদারেরা কেন বাগান বাড়িতে রক্ষিতা রাখত! আজ তাই বহুগামিতা আইন সিদ্ধ।
নিজের মনের ক্ষুধা ,শারীরিক চাহিদা মেটানোর অধিকার সবার আছে। যদি জীবনের সুখের দুখের পার্টনার আত্মাকেন্দ্রিক স্বার্থপর হয়,সঙ্গীর ব্যাপারে চরম উদাসীন হয়। সেই সঙ্গী বা সঙ্গীনী চারিত্রিক দোষে দুষ্ট হলে তাকে দায়ী করা যায় না। জীবন তো একটাই, আর সবাই তো সিদ্ধ মহাপুরুষ নয়!সেদিন আচমকাই সুযোগ পেয়ে,সুধাময় তাই ঋণার মত অভুক্ত কামনার কাঙ্গাল যুবতী রূপসী লাস্যময়ীকে নিজের শেষ শক্তিতে দিয়ে তৃপ্ত করতে চেয়েছিল। এ বিষয়ে সে পাকা খেলুড়ে, যার জন্য একটা সময় স্ত্রী বিশাখার বিয়ের পর একরাত বিচ্ছিন্ন থাকলে ওর অভাবে অস্থির হত।
নারায়ণীর আজ চিন্তা,ঋনার মেদহীন,মেয়েলী সুগড়নের আকর্ষন,মিষ্টি মায়াবী চোখের চাহনি আর রূপের ঝলকে জামাই কী তবে বশীভুত!এতো কন্যা বিশাখার সিঁদ কেটে সর্বস্ব লুটের সামিল! চৌত্রিশ বছরের চাবুকের মত শরীরে সুধাময় আজ ঋণাকে জীবনে প্রথম বার প্রকৃত তৃপ্ত করেছিল।ঋনার মনে নতুন করে আনন্দ জোয়ার বইছিল।সকালে ঋনার চরম পরিতৃপ্ত মুখ।জামাইকে জোড়া হাঁসের ডিম সিদ্ধ,ছানা, আর জোড়া কাঠালী কলা দিয়ে টিফিন দিল। চালাক সুধাময়,সকাল সকাল বিদায় নিল।গদ গদ শাশুড়ি শ্বশুরকে প্রনাম আর সম্মানে বড় ঋণাকে হাত জোর করে নমস্কার করল।মানিক রতন কে,মিষ্টি খেতে টাকা দিল।ভানু তখন হাস্কিং মিলে।
নারায়ণী ভাবছিল আপদ গেল। কিন্ত প্রথম প্রথম মাসে এক দুবার , এখন প্রতি সপ্তাহেই অন্তত একদিন বেহায়ার মত ঋণার রূপ যৌবনে পাগল হয়ে সুধাময় শ্বশুর বাড়ি রাত কাটাতে লাগে।নারায়ণীর সহ্যের সীমা লঙ্ঘন হলে,একদিন বৌমা ঋণাকে সে বলে।"ছোট ননদের সম্পদে হাত কেন!"
ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্য সুরে ঋণা বলে, "আপনার সম্পদ তো আমি ছেড়ে দিয়েছি। আর বিশাখার সাধ্য থাকলে নিজের সম্পদ আটকে রাখুক, আমাকে বলছেন কেন!আপনার লজ্জা করে না! মেয়ে তো তবু বারো বছর সতেজ টাটকা মাল ভোগ করেছে,এঁটো সেকেন্ড হ্যান্ড মালটা একটু ভোগ করি তাতেই এত রাগ এত ক্ষোভ! আমার কী রূপ যৌবন ক্ষমতা আপনার বা আপনার মেয়েদের চেয়েও কিছু কম!"
"কিন্তু তাই বলে মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের ঘর ভাঙ্গবে!"
" নিজে মেয়ে হয়ে আমাকে তো ঘরই দিলেন না!তবে কী বাইরে গিয়ে চড়েফুটে খাবো! ঘরের তবু তো মান সম্মান পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে বাজায় রাখছি।আপনি কি চান!নিজের সম্পদ বাইরে গিয়ে বিলিয়ে দেবো! সামন্ত বংশের মান সম্মান তাতে ডুববে না তো!"
নারায়ণী থ,মুখের উপর যা না তাই! নারায়ণী হতাশায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল।কিন্তু ছোট জামাই আর বৌমার প্রেম লীলা চুপচাপ মেনে নিতে পারছিল না।নারায়ণী চরম দুশ্চিন্তায় ভাবত, বিশাখাকে ছেড়ে ছোট জামাই সুধাময় আবার ঋনাকে বিয়ে করবে না তো!
বেপরোয়া সুধাময় দিন দিন যেন দৃষ্টিকটু ভাবে ঋনার মোহে পাগল হয়ে ওঠে । সংযত ঋণা দুই সন্তানের মা, তাই যথেষ্ট সংযমী দ্বায়িত্বশীল নচেৎ, বিশাখাকে ছেড়ে ঋণাকেই সুধাময় ঘরে তুলতে চাইছিল।ঋনার দুই সন্তানের দ্বায়িত্ব নিতেও রাজী ছিল।
নারায়ণী দুশ্চিন্তা দিন দিন বাড়ছিল ভয়ে আশঙ্কায় বিভ্রান্ত ।ঋণা কাছে একদিন নারায়ণী ভিক্ষা চাওয়ার মত বলে, "তোমার দুই সোনার চাঁদ ছেলেদের ছেড়ে সুধাময়ের মোহে যেন এ বাড়ী থেকে পালিয়ে যেও না।এত বড় সর্বনাশ এবাড়ীর করো না।"
ঋণা বলে "আপনি আমাকে ভরসা করুন,আমার দুই ছেলে, আপনার দুই বংশধরের চেয়ে আমার জীবনে বড় সম্পদ কেউ নয়। এই বাড়ি আমার স্বর্গ, এবাড়ী ছেড়ে পালাব কোথায়! আমার শরীর এই বাড়ি যেদিন ছাড়বে ,সরাসরি শ্মশানের চিতায় উঠবে। মানিক রতনের নামে আমি দিব্যি করছি।" ঋনা বুদ্ধিমতী সে জানত এ বাড়ীতে সে রাজরানী।ধনী সুধাময়ে রক্ষিতা হওয়ার তার কী দায় পড়েছে!
নারায়ণী মনে একটু ভরসা পায় ,ঋনার প্রতি যাই ধারনা হোক , মানিক রতন তার দু নয়ন মনি,তাদের জন্য সে সব ত্যাগ করতে রাজি তাই বলে,"বৌমা তুমি এমন কাজ করো না,যাতে ছেলেদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়।"
ঋনা বলে "আমি সব জানি মা ,সমাজ টা খুব কাছ থেকে দেখেছি, সারা জীবন লড়ে যাচ্ছি,বিয়ের পর একা অভিমন্যুর মত যুদ্ধ করে জয় পেয়েছি। আপনার নাতিদের ভবিষ্যতের জন্য সুধাময়ের মত বুদ্ধিমান শক্তপোক্ত এক পুরুষ মানুষের সাহায্য পেলে ভালো। শ্বশুর মশাই অশক্ত, আপনার ছেলের কথা জানেন ওর কী দশা। সুধাময আমার ছেলেদের ভীষণ ভালোবাসে, সেটা আমার জন্যে।ওকে হাতে রাখলে মানিক রতনের সুবিধা।আমি মূর্খ, বাইরের জগতের কিছুই বুঝি না।আর সুধাময়ের আজ আমি ধ্যান জ্ঞান, ওকে একটু সহ্য করুন।আমার স্বার্থের চেয়েও আপনার নাতিদের ভবিষ্যত তাতে অনেক সুরক্ষা পাবে। আর সুধাময় তো বাইরের পুরুষ নয় !এবাড়ীর জামাই, ভীষণ বড় মনের মানুষ।"
এরপর নারায়ণী কেন কে জানে, সুধাময় ও ঋনার অবাদ মেলামেশায় আর আপত্তি করত না।বরং সুধাময়ের প্রতি একটু প্রসন্ন হয়েছিল।
বিশাখা একদিন চরম ক্ষোভে বাপের বাড়ি এল। চাঁদপানা মুখ করে সুধাময়,যতই বিশাখাকে বোঝায় ব্যবসার কারনেই শ্বশুর বাড়িতে থাকা।"বকুল ডাঙ্গার ধানের বড় বাজার এখন আমি প্রায় কেপচার করেছি।এ গ্রামে শ্বশুর বাড়ি তাই সপ্তাহে একদিন ওখানে থাকতেই হয়।"
সুধাময়ে হাবভাব, নতুন করে শরীর চর্চা,সুগন্ধি মাখা আর তার প্রতি রাতে আকর্ষণ দিন কেমন যেন আগ্রহ হারাচ্ছিল। বারো আর দশ বছরের দুই ছেলে মেয়েদের নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও, রাতে একটু স্বামীকে সোহাগ করে জড়িয়ে শুয়ে বিশাখার মনটা তৃপ্ত হত।এখন সুধাময় কেমন নিজেকে সড়িয়ে নিতে চায়।এতে ওর ঘুমের নাকি ব্যাঘাত হয়!
বিশাখার ধারনা ছিল, মা নারায়ণী আজও বাড়ির সর্ব ময় কর্ত্রী,তাই এদিন একাই সে বাপের বাড়ির এসেছিল ।মা নারায়ণীকে অভিযোগ করে বলে, "ঘন ঘন কেন তোমার জামাই শ্বশুর বাড়ি আসে?আগে তো আসত না! কেন খোঁজ খবর নাও!" এরপর নারায়ণীর ঘরে এসে সরাসরি ঋনার বিরুদ্ধে একগাদা নালিশ করে !
ন্যাকা সেজে নারায়ণী বলে " কেন বলত ঋণা প্রতি তোর এত রাগ!"
"ওর হাবভাব ভালো নয়, সব তো বুঝি, নষ্ট হাঘরের বেটিটা যে কোথা থেকে পেট করে এসে দুটো বাচ্চা দিল,এগুলো দাদার বাচ্চা নাকি! যাইহোক সেটা তোমাদের সংসারের ব্যাপার, আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু আমার বরের দিকে হাত বাড়ালে চরম কেলেঙ্কারি হবে, আমি সহ্য করব না।যতসব নোংরা ছোট ঘরের মেয়ে।"
একটু দুরে ঋণা রান্নার ঘরে কাজে ব্যস্ত ছিল।
নারায়ণী বলে" চুপ কর ঋণা শুনতে পেলে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ছাড়বে।"
"তার মানে,এখন সংসার ঐ সব!"
অসহায় নারায়ণী বলে,"আমি নখ দাঁত হীন বুড়ো বাঘ, বাড়ির সবাই এখন ওর ভৃত্য।নিজের বরকে সামলা।"
"তার মানে দায় এড়িয়ে যাচ্ছ! জামাইকে বাড়ি থেকে দুর করে দিতে পারো না! আর এই মূর্খ ছোট ঘরের বেশ্যাটাকে এত তোমাদের ভয় কীসের! ওকে তাড়িয়ে দাও, বা তোমার জামাই কে এবাড়ী আসা বন্ধ করো। না হলে আমি আত্মহত্যা করব।এ ভাবে ঐ অজাতের মেয়ের কাছে হেরে বাঁচব না।"
নারায়ণী চরম উৎকন্ঠায়, অশান্তির আশঙ্কার করছিল।নিকটে রান্নার ঘরে কর্মরত ঋনার কানে অনেক কথাই যাচ্ছিল, কারণ বিশাখার গলা ক্রমশ চিৎকারের রূপ নিচ্ছিল।
নারায়ণী আতংকে দেখছিল ঋণাকে,তার মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর বিষধর কোন সাপ যেন ক্ষোভে ক্রোধে ক্রমশই তার ফণা ফুলাচ্ছে ,ছোবল দেবার পূর্ব মুহূর্তের মত।আসলে ঋণার ভীতি তাকে গ্রাস করেছিল। মানসিক বিকার গ্রস্থ হয়ে পড়েছিল।মনে হত ঋণা যেকোন সময় তাকে আক্রমণ করবে। ভানুর বিয়েটা ছিল নারায়ণীর পরিকল্পনার ফল, যেটা ঋণা মানতে পারত না ।তার জীবনের সাথে সেটা ছিল চরম প্রতারণা ক্ষমা হীন অপরাধ ভাবত।
যদিও দুই সন্তানের স্নেহময়ী মা ঋণা ছিল আপোষ পন্থি, হিংস্র তার স্বভাব নয়। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ রসীকতা করত, দরকারে স্পষ্ট অন্যায় মুখের উপর সে বলে দিত।শাশুড়ির এক সময়ের তার প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ করা ,ভালো খাবার খাওয়ানো,গহনা দেওয়া, সব তার মনে ছিল,সে তাই অকৃতজ্ঞ ছিল না।
সংসারে নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে তার মেধার জুড়ি মেলা ভার। তিলে তিলে গড়ে তোলা নারায়ণীর সংসারের সাম্রাজ্য ঋণা দখল করে নিচ্ছিল । কিন্তু পরিস্থিতির চাপে নারায়ণী হার স্বীকার করতে করতে মানসিক অবস্বাদে দিশেহারা।সংসারে ক্রমশ এমন তার গুরুত্ব হীনতা সে মেনে নিতে পারছিল না।অন্য দিকে শারীরিক না ব্যাধিতে দুর্বল,মানসিক অস্থিরতা জীবন অতিষ্ঠ, স্বামী নিতাইও কেমন দুরে সড়ে যাচ্ছে তার মনে হচ্ছিল।
নারায়ণী ভয়ে বিচলিত বলে"বৌমা তুমি তোমার ঘরের যাও। আমি রান্না ঘর সামলাচ্ছি।"
ঋণা কটমট করে তাকিয়ে বলে ,"না না, আপনি বয়স্ক মানুষ বিশ্রাম নিন।ছোট ননদের জন্যে স্পেশাল আজ কিছু মুখরোচক রান্নাটা আমিই করব, কী গো ছোটদি! তোমরা অনেক দিন পর একটু সুখের দুখের গল্প করছ বুঝি! তা করো, শুনতে তো ভালোই লাগছে।" বলে একটু হাসল । ননদরা তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, মনে মনে সে ভালোমত জানত।
কথার ধরন হাবভাব স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল কেমন যেন ছোট ননদের সাথে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ।ঋনার কানে আসছিল তার বিরুদ্ধে বিশাখা, মাকে নালিশ খুব করছে, কটু অশ্লীল কথা বলছে,এটাই তার জবাব।যেন ইঙ্গিত,চেঁচিয়ে হিংসায় তুই মর,তোর বরকেও ছিনিয়ে নিয়েছি। দেখ কেমন লাগে! আর তোর মা বুঝুক মেয়ের জ্বালা অশান্তি!
ঋণার স্বভাব নারায়ণীর জানা ঝড়ের পূর্ব লক্ষ্যন। বিশাখা কিছু উত্তর করলে তার কী জবাব ঋণা দেবে! ভয়ে অস্থির,মেয়ে বৌমার আবার ঝগড়া না বেঁধে যায়! থমথমে একটা গুমোট পরিবেশ।নারায়ণী বিশাখাকে বলে "যা রান্না ঘরে বৌদিকে একটু সাহায্য কর গে, একা ওর হয়ত কষ্ট হচ্ছে।আর এসব নিয়ে ভাবিস না,আমি তো এখনও বেঁচে আছি। আমি মরলে তুই যা ইচ্ছা করিস, এসব অশান্তি সন্দেহ আর ভালো লাগে না।"
বিশাখা গুম হয়ে বসে ছিল,কোন উত্তর দিল না।মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে দোতলায় ক্রোধে মুখ ভারী করে উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর না খেয়েই তেজ করে নিজের ব্যাগ নিয়ে,"আমি বাড়ি চললাম"বলে বাড়ি থেকেই সে বেড়িয়ে যায়।
নারায়ণী, ঋণা তাকে বার বার,দুপুরের খাবার খেয়ে বিকালে যাবার অনুরোধ করে, কিন্ত বিশাখা কারও কথার কোন উত্তর দিল না।সেসময়,বাড়িতে নিতাই ছিল না।নারায়ণীর তীব্র আশঙ্কা হচ্ছিল বিশাখা কোন অঘটন ঘটাবে না তো!
সেই রাতে নারায়ণী মারা যায়, বাড়ির লোক বলে হার্ট ফেল, হাই প্রেসার ছিল। আর সত্যিটা সে অতিরিক্ত ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে। সে বুঝেছিল তার দিন এ বাড়ীতে শেষ। তার উপস্থিতি এ বাড়িতে সমাধান নয়, সমস্যাই তৈরি করবে। বীতশ্রদ্ধ জীবনে বেঁচে থাকার আর ইচ্ছা হচ্ছিল না।এই ভাবেই বংশ রক্ষার মিশন পালনে তার যে এখন করুন পরিনিতি হবে,সে স্বপ্নে ভাবে নি।
