বজবজ লোকাল
বজবজ লোকাল
আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বজবজ থেকে টালিগঞ্জ কিন্তু কখনো কখনো বালিগঞ্জ শিয়ালদহ চলে তাই। এই রাতের বজবজ লোকাল খুব ভালো ঘুম পক্ষে। যদিও লোকাল ট্রেন খুবই আরামদায়ক ঘুমের পক্ষে সিট পেলে।লোকাল ট্রেন উঠে মাঝে মাঝে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়ে থাকি ট্রেনে উঠে। লুঙ্গি পার হতে না হতে ঝিমোনো শুরু। কিন্তু কপাল নিতান্ত খারাপ আজ পাশে এক সুন্দরী তরুণী বসেছে। না না আমিই তার পাশে বসেছি এমন নয় সেই বসেছে। আমি আগে থেকেই জানলার ধারে ছিলাম। হাওয়া আসার সম্ভাবনা যাচাই করে সে সাধারণত আসন বাছে ছিলো। এক্ষণেও তাই হয়েছিল। কিন্তু আড় চোখে দেখেলাম তরুণীকে একটু হাসলাম । প্রাথমিক চাউনিই বুঝিয়ে দিল সে খুব খুশী হয়নি আমার তাকানোতে । সে কোনো সুন্দর তরুণকে সহযাত্রী হিসেবে চেয়েছিল। এদিকে আমার চিরুনি, লিপস্টিক, আয়না কিছুই নেই যে তার মনে প্রলেপ দেব। কি আর করি কথা না বাড়িয়ে চোখ বুজলাম। ব্যাস শালার ঝিম অমনি এসে বাসা গাড়ল চোখে। তারপর আর কিছু খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙ্গল মেয়েটির ঠান্ডা চীৎকারে। -
"এ কী গায়ে পড়ছেন কেন? "
আমি তড়িঘড়ি ঝিমের পিন্ডি চটকে উঠে বসলাম। তারপর কোথায় আছি খেয়াল করার চেষ্টা করলাম। তারপর সব বুঝিয়ে টুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে বললাম, -"ঘুমিয়ে পড়েছি ম্যাডাম sorry, নির্ভেজাল ঘুম আর তার সাথে ট্রেনের দুলুনি, ইসসা কইর্যা করি নাই। "-
সে চিৎকারে করে বললো " ইচ্ছা করে করিনি,যত্ত বজ্জাত লোক ট্রেনে ওঠে। "
আমি মজা করে বললাম "-ইয়ে মামণি আমি নার্কো টেস্ট দিতি রাজি আছি, ব্রেন ম্যাপিং হলেও অসুবিধা নাই, পলিগ্রাফের জন্য আবেদন করা যেতে পারে, কিন্তু আমি ইসসা কইর্যা করি নাই।" সামনের একটা লোক চোখ মটকে হাসল। শালা বুঝতে পেরেছে আমি কেস খেয়েছি। কি আর করি জানলার কাছের সিটের মায়া ছাড়লাম।ইন্সাল্ট পকেটে পুরে জায়গা মানে ভালো সিট ত্যাগ করলাম। ভীড় বেশি নেই বাঁচোয়া , হাওয়াহীন জায়গায় এসে বসলাম । মনে মনে ছোলা মটর চিবিয়ে চলেছি মেয়েটার নামে, রাগে শরীরটা গজগজ করছে। মহিলা কামরায় তো উঠতে পারেন এরা।
আবার এও মনে হল পথেঘাটে বেচারি মেয়েদের হয়তো পুরুষরা এমনি ভাবে ছুঁয়ে থাকে ভিড়ের অজুহাতে তাই এমন খিট খিট ঐ তরুণী। মেয়েরা ভীড় বাসে ট্রেনে এমনি অপরিচিত ছোঁয়া ফেস করে তাই হয়তো , এতো গরম হয়ে গেছে মেয়েটা। যাইহোক ট্রেন খালি হতে হতে মাঝের হাটে। কামরায় জনা পাঁচেক। আমি আবার হাওয়া বাছাই করে বসে পড়লাম মেয়েটার বিপরীতে ট্রেনে । ইতোমধ্যে তিন হিরো ট্রেনে উঠেছে । মেয়েটির অবিশ্যি সে নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ট্রেন গতি নিল। কামরায় এখন মেয়েটি, তিনটি ছেলে আর আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি ঝিমের প্রস্তুতি নিলাম। চোখ খানিক বুজেছে কি বোজেনি আবার মেয়েটির চীৎকার। বললো" -কি হচ্ছে সরে বসুন।" শালা এরা কিছুতেই ঝিমুতে দেবে না দেখছি। একটা স্টেশনে বাকি তবুও একটু ঝিমুতে দেবে না। তাকিয়ে দেখি ছেলে তিনটে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসেছে। কিন্তু বসাটা ঠিক সুবিধের নয়। মরুক গে, আমার কি, অনিচ্ছাকৃত ঘুমের অপরাধী বানিয়েছিস বেটি আমাকে, আর যাই? ছেলে গুলো আবার বাড়াবাড়ি আরম্ভ শুরু করল। এইবার একবারে হিন্দি গান সহযোগে। তবে শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেভাবে এবার গায়ে হাত উঠতে লাগল, আর যেভাবে বিশ্রী হাসি মেয়েটির চীৎকার কে ছাপিয়ে ভেসে আসতে লাগল, বুঝলাম কেস জন্ডিস। কিন্তু এ সব বদ ছোড়াদের হাতে তো নানা অস্ত্রটস্ত্র থাকে প্রতিবাদ করা কি ঠিক হবে? কিন্তু মেয়েটা যেভাবে উঠে আসতে চাইছে আর
অবশ্যম্ভাবী তা বুঝতে পারছি আবার আমি ভেতো ও ভীতু বাঙ্গালি হিসেবে তেমন মজবুত সাহসও পাচ্ছিনা। হঠাৎ এক বদবুদ্ধি চিড়িক দিয়ে গেল। ফোনটা বার করলাম। তারপর কানে দিয়ে শুরু করলাম, - "হ্যাঁরে ডিউটিতে আছিস? এই তো ট্রেনে-- তোর সঙ্গে কনেস্টবল ক'জন?-হ্যাঁ সমস্যা-- আমি চেষ্টা করছি খারাপ কিছু যাতে না হয় তবে শ্লীলতাহানি জোর কদমে চলছে- তিনজন -আর মিনিট তিনেকে ঢুকবে টালিগঞ্জ --- প্লাটফর্ম এর মাঝামাঝি--পাঁচের তিন এ আছি। আড় চোখে দেখলাম ছেলে তিনটে এগিয়ে এসে পিছিয়ে গেল। এর মধ্যে দু'জন দরজায়। আমি উৎসাহ নিয়ে গিয়ার বাড়ালাম --দরকারে গুলি চালাবি পায়ে, পালাতে দেওয়া যাবেনা--ফোনে ছবি তুলে রাখব? -- ঠিক আছে। "
মেয়েটি দেখি হাত জোর করছে।
আমি একটু বুক ফুলিয়ে বললাম "কি হল?" মেয়েটি বললো -"আমাকে এ রাস্তায় রোজ ফিরতে হয়।"
আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম -"ভালোই তো। আমি ও আসি। চিন্তা নেই একবারে গ্রেফতার করিয়ে দিচ্ছি।"
মেয়েটি বললো -"তাহলে ওরা আমাকে ছাড়বে না।"
আমি অভয় দিয়ে বললাম "আরে না না - আগের জেলের ঘানি টানুক বছর পাঁচেক..".
যেই না কথাটা বলেছি। অমনি ঝুপ ঝুপ করে তিন ছোকরা দরজা থেকে ঝাপ।ট্রেনের গতি অবশ্য কমে এসছিল। ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকবে ঢুকবে করছিল। মেয়েটি দেখি চোখে হাত দিয়ে ফোঁপাচ্ছে। ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তিন ছোকরা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে প্লাটফর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ট্রেন থামল। কিছু লোক উঠল। সব বোধহয় শিয়াল দাহ যাবে। আমি ভয়ে নামলাম না টালিগঞ্জে। ভাবলাম শিয়ালদহ ফিরে এসে সিটে বসতে গিয়ে । মনে লাড্ডু ফুটলো যদি বন্ধু তো করতে পারি। আবার দেখি মেয়েটি আমার সিটের পাশে এসে বসেছে। এইরে আবার যদি ঘুমিয়ে পড়ি?
মেয়েটি মনের ভাব বুঝে হাসল। -"প্লাটফর্মে আপনার বন্ধু কেউ এল না তো? "
আমি বললাম -"দূর ও তো ঢপ দিয়েছি তোমাকে বাঁচাতে।"
মেয়েটি বললো -" ধন্যবাদ ।ইস আমি আপনাকে তখন কি খারাপ ভাবছিলাম, ছি ছি। সরি, সরি।"
হু হু বাবা ঠ্যালায় পড়ে এখন ক্ষমা। কিন্তু একটু ইমপ্রেস করতে ।ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম "ওরে এতো কিছুর দরকার নেই। এরকম উপকার আমি করেই থাকি, লোকে বুঝল না। আমি খাঁটি ভদ্রলোক তাইতো এখনো সিঙ্গেল আছি।"
কথা শুনে হাসলো মেয়েটি। ট্রেন চলতে শুরু করতেই আবার ঝিম এল। মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
মেয়েটা হাসল বলল "ভয় নেই , ঘুমোন। আমি কিছু মনে করব না।"
শিয়াল দাহতে নেমে back করবো ঠিক করলাম। কারণ দেখে নেবো মেয়েটা কোথায় থাকে। পরে সুযোগ মতো বন্ধুত্ব করে নেবো। ঘরে গিয়ে তো লেখা নিয়ে বসি ঘুমাই না রাতে। ঘুম এসে গেলো।তারপর অনেকক্ষণ কিছু খেয়াল নেই। ট্রেনের দুলুনি বেশ ঘুমটা এসেছে ভালো ই। শিয়ালদহ এসে ঘুম ভাঙ্গল বলে তাকিয়ে দেখি কামরা ফাঁকা। কেউ নেই। সব্বাই নেমে গেছে।মেয়েটিও কি অকৃতজ্ঞ। যাবার সময় একটু বলে গেলি না। যাহোক ট্রেন ছাড়ল। ওপরে তাকিয়ে দেখি ব্যাগটা নেই।শখ করে কেনা লেদারের ব্যাগ। ছাত করে উঠল বুকটা। টাকা অল্প ছিল।বই ছিল নতুন গোটা চারেক। বৌদির দেওয়া দুটো শাড়ি মায়ের জন্য। কামরার এদিক ওদিক ঘুরে দেখলাম। সব ভোঁ ভা। মনের দুঃখে সিটে এসে বসলাম। আচমকা দেখি বুক পকেটে চিরকুট একটা।খুলতেই হিরোগিরি ফুস হয়ে গেল।
ওই মেয়েটি লিখেছে,
স্যার
ব্যাগটা নিলাম।যা পয়সা আসে তাই লাভ।তার ওপর আমার পার্টনারদের যা ঝাড় তুমি দিলে। একটার পা গেছে মনে হয়। ওরা সব আমারি লোক। তোমাকে সিন করে ডেকে এনে ব্যস্ত রাখতাম আরেকজন সেই ফাঁকে ব্যাগ নিয়ে চম্পট দিত।এভাবেই এ লাইনে অনেকদিন হল। তোমার উপস্থিত বুদ্ধি সব কেচিয়ে দিয়েছিল প্রায়। কিন্তু স্লগ ওভারে তুমি ঘুমিয়ে পড়ায় ছক্কাটা মারলাম। ভালো কথা ফোনটাও নিয়েছি। আর সিম এবং এসডি কার্ড তোমার পকেটে। ভালো থেকো।,,,,
