Manasi Ganguli

Tragedy

4.0  

Manasi Ganguli

Tragedy

বিপর্যয়

বিপর্যয়

5 mins
305



    আমি একজন মনোবিদ। কর্মসূত্রে নিত্য কত মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়,তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করার সময় যা পড়েছি,তার থেকে অনেক বেশি জানতে পারছি কাজে নেমে। কত বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় রোজ আর মানুষের মন সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় আমার ঝুলি ভরে ওঠে। মানুষের মন হল ভাবনার কারখানা,সেই কারখানায় কত রকমারি ভাবনা যে তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত তা আমি টের পাচ্ছি। কথায় আছে,'ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা',তাই দেখছি,মানুষ সত্যিই এমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। অনেকের স্বপ্ন আবার আকাশচুম্বী। স্বপ্ন দেখা ভালো,তবে জেগে জেগে আর তবেই তো মানুষ তা পূরণ করবার যথোচিত চেষ্টা করবে, তার জন্য শ্রম দেবে। কিন্তু এই পেশায় এসে দেখছি এমন কিছু মানুষ আছে যারা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে,তবে তা অলীক স্বপ্ন, আকাশকুসুম। আর তাদের এমন স্বপ্নই মানুষের কাছে যখন অস্বাভাবিক লাগে,তখনই তাদের নিয়ে তাদের প্রিয়জনেরা আমাদের মত মনোবিদদের কাছে নিয়ে আসে।


     আমার কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি এবার। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলেকে নিয়ে তার বাবা-মা এলেন আমার কাছে। ছেলেটি ক্লাস ফাইভে পড়ে। ক্লাস থ্রি অবধি সে স্কুলে খুব ভালো রেজাল্ট করত,প্রাইজ পেত কিন্তু ক্লাস ফোর থেকে হঠাৎ কোনোরকমে পাশ মার্কস পেয়ে পাশ করতে লাগল,ক্লাসে ক্লাস ওয়ার্ক কমপ্লিট করত না কোনোদিন। তার মা তাকে নিয়ে নাজেহাল,কিছুতেই তাকে পড়ায় মন বসাতে পারতেন না। তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা সিটিংয়ে বসার পর জানতে পারলাম সে ভালো করে পড়া করা ও ভালো নম্বর পাওয়া সত্বেও ক্লাসটিচার অন্য একটি ছেলেকে সর্বদা ফেভার করতেন ও তাকে ভালবাসতেন। তাই সে আর ভালোভাবে পড়াশোনা করতে চায় না। তাকে বোঝানোর পর আবার সে ভালো করে পড়াশোনা করতে শুরু করে। বাবা-মা খুব খুশি। ওনারা তাড়াতাড়ি আমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাই ছেলেকে নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি।


     আরেকটি ১৭/১৮ বছরের ছেলেকে নিয়ে তার মা এলেন আমার কাছে অনেক আশা নিয়ে। তাকে বলা হয়নি তার জন্য আমার কাছে আসা। বলা হয়েছিল মায়ের ডিপ্রেশনের কথা। ইনফ্যাক্ট ওই ছেলের জন্য মা ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবার,কিন্তু ছেলের চাহিদা আকাশছোঁয়া। রাতদিন টাকা টাকা,এটা দাও,ওটা দাও,দামি মোবাইল দাও,ট্যাব দাও অথচ পড়াশোনায় কোনোরকমে পাশ মার্কস। বাবা-মা তাকে নিয়ে নাজেহাল,তার চাহিদা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়,আর ছেলে তা বুঝবে না। মা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, "পড়াশোনা না করলে এসব জোটাবি কোথা থেকে,টাকা রোজগার করবি কি করে? বাবা তো আর চিরকাল জোগান দেওয়ার জন্য থাকবে না"। সেই ছেলের উত্তর,"আমাকে তোমরা পৃথিবীতে এনেছ,আমার চাহিদা যোগান দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের। আর রোজগার করতে হলে পড়াশোনা করতে হবে এমন কথা কোথায় লেখা আছে? গুন্ডামি,বদমাইশি,পার্টি-পলিটিক্স করেও অনেক টাকা রোজগার করা যায়। তাতে নামডাকও হয়,সবাই একডাকে চেনে। আর অমন রোজগার করতে পারলে যা চাইব তাই পাব। সর্বদা তোমাদের মত নেই নেই,কোথায় পাব,কোথায় পাব করতে হবে না,আর টাকা থাকলেই লোকে সেলাম ঠুকবে"। এসব শুনে মা ভয় পেয়ে নিয়ে আসেন আমার কাছে। সে ছেলে আমার কাছে এসে বলে,"রোজগার করলে হাতের মুঠোয় কত বাড়ি,কত গাড়ি,কত নারী",অর্থাৎ ভোগের চূড়ান্ত। সে ছেলে বড় হয়েছে,তাকে বোঝাতে অনেক সময় লেগেছিল কিন্তু তাকেও আমি সুস্থ,স্বাভাবিক জীবন দিতে পেরেছিলাম। বাবা-মা পরে এসে জানিয়েছিলেন ছেলের আমূল পরিবর্তনের কথা। সে ছেলে পরে এসে আমায় যখন বলে, "ভাগ্যি মা আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলেন,তাই আমি একটা সুন্দর জীবন পেলাম",তখন যে কি আনন্দ হয়, নিজেকে সফল মনে হয়,ধন্য মনে হয় জীবন।


     এমন কতই মানুষ আসে আমার কাছে কতরকমের সমস্যা নিয়ে। তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দেওয়াটা তখন আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। যত দিন যাচ্ছে আমার এই পেশাটাকে আমি আরো ভীষণভাবে ভালবেসে ফেলছি,খুব এঞ্জয় করি এই মানুষকে সুস্থ -স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। আমি আমার প্রাণপাত করি আমার কাছে যারা আসে তাদের জন্য। এক মধ্যবয়সী মহিলা এসেছিলেন একবার আমার কাছে। তিনি যখন সংসার সন্তান নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন তখন তাঁর স্বামী বাড়ির কাজের মহিলাদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে তাদের টাকাপয়সা এমনকি সোনাদানাও দিতে থাকেন। সে ভদ্রমহিলা কখনও তাঁর স্বামীকে অবিশ্বাস করতেন না কিন্তু মাঝে মাঝেই বিসদৃশ কিছু তাঁর চোখে পড়তে লাগল। তিনি খুবই ভদ্র,এরপরও ওসব কথা নিয়ে স্বামীকে কিছু বলতে তাঁর মুখে বাধত। কিন্তু বারবার দেখতে দেখতে একদিন তাঁর স্বামীকে বলায় সেদিন বাড়িতে প্রচুর অশান্তি হয় এবং ভদ্রলোক তাঁর গায়ে হাতও তোলেন সেদিন আর এটা চলতেই থাকল। সব কাজের লোক ভদ্রলোকের এমন আচরণ মেনে নিতে পারত না,তাই কখনও নিজেরা কাজ ছেড়ে চলে যেত,আবার কখনও ভদ্রমহিলা ছাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় শেষে,ভদ্রমহিলা কাজের জন্য কোনও লোক আর পান না। কাছেই কাজের লোকেদের পাড়ায় তার স্বামীকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়,কেউ কাজ করতে এলে তাকে অন্যেরা বাধা দিতে থাকে। কাজের লোক পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু ভদ্রলোক এটা এতই এঞ্জয় করতেন তাঁকে আমার কাছে আনা ভদ্রমহিলার পক্ষে অসাধ্য ছিল। তাই তাঁকে নিয়ে আসার জন্য ভদ্রমহিলাকে অনেক নাটক করতে হয়। নিজে অসুস্থতার ভান করে আমারই পরামর্শে মনোরোগীর মতো আচরণ করে অবস্থা এমন সৃষ্টি করেন যে ভদ্রলোক তাকে আমার কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসতে বাধ্য হন। ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে আমার কাছে নিয়ে এলে স্ত্রীর কাউন্সেলিং এর বদলে ভদ্রলোককে আমি কাউন্সেলিং করেছি দিনের পর দিন। এভাবে তার মধ্যে পরিবর্তন আমি আনতে পেরেছিলাম। ভদ্রমহিলা খুব খুশি হয়েছিলেন সুস্থ সুন্দর জীবন পেয়ে।


      এভাবে সবাইকে সুস্থ জীবন দিতে দিতে নিজের পেশায় আমি মগ্ন হয়ে ছিলাম। আর সেই সুযোগে আমার জীবনে এল ঘোরতর বিপর্যয়। সেই যে বলে না,"ঘরামির ঘর ছাঁদা",আমার হল সেই দশা। আমার পেশাটাকে আমি মনে করি এক মহান পেশা। এই মহান পেশায় আমি খুব সুখী ছিলাম,খুশি হতাম। কিন্তু এই মহান পেশা যে আমার জীবনে এমন বিপর্যয় এনে দেবে,দুঃস্বপ্নেও আমি কখনও ভাবিনি তা। আমি নিজের কাজে মগ্ন থাকার ফলে সংসারে সেইভাবে সময় দিতে পারতাম না,কাজের লোকের ওপরই ছিল ভরসা। হয়তো আমার তরফে সেটা ছিল অবহেলা,আর তাই আমার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে কবে যে ঘুণ ধরে গিয়েছিল টেরটিও পাইনি। দুজনেই ব্যস্ত থাকায় প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া দুটো গল্প করাও যে কবে উঠে গিয়েছিল মনে করতে পারি না। আমার স্বামী একজন চাইল্ড স্পেশালিষ্ট। এক সহপাঠিনীর সঙ্গে তাঁর একসময় গভীর প্রেম ছিল। প্রেমিকার ব্রাহ্মণ পিতা নীচুজাতের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। বিরহে কাতর হয়ে আমার স্বামী প্রথমে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। আমাদের বিয়ে হয় তার তিনবছর পর। ভালোই ছিলাম আমরা প্রথম প্রথম। পরে কিভাবে আবার সেই পুরাতন প্রেমিকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। সেই প্রেমিকার স্বামী মারা গেলে সে বিদেশ থেকে ফিরে আসে। এখন তার সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক নিবিড়। মানসিকভাবে আমি খুবই বিপর্যস্ত। আমার এখন একটাই ব্রত, আমার স্বামীকে আমার জীবনে আবার আগের মতো করে ফিরিয়ে আনা। যেমন করে অন্যান্য মানুষের সম্পর্ক ভালো করবার চেষ্টা করি নিজের ক্ষেত্রেও আমি তেমনই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তথাপি আমার পেশার প্রতি আমি নিষ্ঠাবান,দায়বদ্ধ। এখন অপেক্ষা আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy