SUBHAM MONDAL

Horror Classics Thriller

3.8  

SUBHAM MONDAL

Horror Classics Thriller

বিনি কলিং

বিনি কলিং

13 mins
593


একটা পুরনাে মন্দির। খানিকটা অংশ ভাঙাচোরা। দেখলে মনে হয় যেন, একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং অনেকদিন পড়ে আছে। মন্দিরটার মাঝে একটা ঘরে একটা বিশাল শিবলিঙ্গ, যার উচ্চতা একটা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি এবং চওড়ায় প্রায় থামের মতাে। সেই শিবলিঙ্গ ঘিরে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড জ্যান্ত সাপ। আমি শিবলিঙ্গটার কাছ থেকে সরে এসে এগিয়ে গেলাম ভাঙা জানালাটার দিকে। সেখান দিয়ে দেখি বাইরে সমুদ্র। জানালাটা দিয়ে পা বাড়াতেই নেমে পড়লাম সমুদ্রতীরে। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড, সমুদ্রতীরে বরফ জমে রয়েছে। চারপাশটা ধূসর সাদা। কোনও রং নেই। বরফের উপর থেকে যেন 

ধোঁয়া উঠছে। কয়েকটা লােক ভীষণ ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। আমি এগিয়ে যেতে দেখি, সমুদ্রের পাড় বরাবর বরফের উপর লাইন দিয়ে পড়ে রয়েছে অনেকগুলাে কফিন। এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম,

"দাদা, এগুলাে কী?"

লােকটা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখে বলল," দেখে বুঝতে পারছেন না? কফিন। খুলে দেখুন নিজের কেউ আছে কি না।"

 আমি শ্লথ পায়ে একটা-একটা করে কফিন ক্রস করে একদম শেষ কফিনটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, তার চেয়েও খানিকটা দূরে একটা কফিন বিচ্ছিন্নভাবে একা পড়ে রয়েছে। আমি কেমন একটা টানে কফিনটার

দিকে এগিয়ে গেলাম। কফিনের উপর ঝুঁকে পড়ে লেখাটা পড়লাম, B R ।

কফিনের ডালাটা খুলতেই কেমন যেন বােবা হয়ে গেলাম, গলা দিয়ে শব্দ বেরচ্ছে না। নড়তে পারছি না, কেমন যেন শক্ত হয়ে গিয়েছে। হাত-পা। কফিনের মধ্যে দেখি, আমিই শুয়ে আছি! মুখে-চোখে আঁচড়ের চিহ্ন। নিজের মুখে নিজে হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে দেখছি। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না...মুখ দিয়ে শুধু আঁ, আঁ, আঁ’ করে আওয়াজ। শৌনকের গলা পেলাম," কী আঁ, আঁ করছ? কী গাে, কী হল ? তাড়াতাড়ি ওঠো।"

সটান উঠে বসলাম বিছানার উপর।


-" আবার বাজে স্বপ্ন দেখেছ নিশ্চয়ই? এর জন্যই শােওয়ার আগে তােমাকে ওইসব আধভূতুড়ে বইগুলাে পড়তে বারণ করি।”

- “কী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, আমি মরে গিয়েছি।”

-"তাই!" বলে চকচকে চোখ নিয়ে বৃন্দার কাছে এসে বসল শৌনক, তা হলে তাে বাঁচলাম, ভাগ্যবানের বউ মরে গাে !”

- “তাই বুঝি?” বলে বৃন্দা ওর বড়-বড় নখগুলাে সােজা শৌনকের হাতে বসিয়ে দিল। "ওরে বাবা! ছাড়ো-ছাড়ো, তুমি একশাে বছর বাঁচো,” বলে শৌনক তিড়িংবিড়িং করতে শুরু করল। বৃন্দাও লাফিয়ে ওর ঘাড়ে উঠে খুনসুটি শুরু করল।

শৌনক আর বৃন্দার বিয়ে হয়েছে একমাস হল। বিয়েটা দু'বছর বাদে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শৌনক ঝট করে একটা ভাল চাকরি পেয়ে গেল। তা ছাড়া, গােয়াতে ট্রান্সফারও হয়ে গেল, তাই আর ওয়েট করতে চাইল না ওরা। চটপট বিয়ে সেরে দু’জনে গােয়ার এই বাংলায় সংসার শুরু করেছে। একদম সি বিচের ধারে এই বাংলা ভাড়া নিয়েছে শৌনক। অফিস থেকে এর ভাড়া দেয়। প্রথমে ঠিক করেছিল, ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে। কিন্তু হুট করে এই বাংলােটা এত পছন্দ হয়ে গেল।


বাড়ির ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সামনে কিছুটা অংশ জুড়ে রয়েছে বাগান, সেখানে নানারকম গাছ। বাগানে দোলনা, বসার জায়গা রয়েছে। বাংলা এটা বেশ ভাল। সামনে পােরটিকোটা পুরাে কাঠের। বাড়ির ভিতরে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটাও কাঠের। পুরনাে দিনের সুন্দর সব ভারী-ভারী আসবাবপত্র! শুধু পুরনাে বলে দেওয়ালের রংটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই লাইটটা একটু কম লাগে বাড়িটায়। রাতের দিকটাও একটু অন্ধকার অন্ধকার। তবে সব মিলিয়ে এত বড় কার্নিশড বাংলাে এরকম ঝটপট আর এত সস্তায় পেয়ে যাবে ভাবেনি ওরা। তাই আর সাতপাঁচ না ভেবেই এখানে উঠে পড়েছিল।যাই হােক, শৌনককে তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য সব গুছিয়ে দিল বৃন্দা। শৌনক টিফিনের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলে বৃন্দা বাইরের ঘরের চেয়ারে পেপার আর চা নিয়ে এসে বসল। শৌনক অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে যেন ওর সময়ই কাটতে চায় না। খানিকক্ষণ কাগজ পড়ে, তারপর টিভি। তারপর মাঝে মাঝে একটু বাজারে যায়। সংসারের দরকারি জিনিসপত্র কেনে বা কখনও এমনিই এদিক ওদিক ঘুরে চলে আসে। আজও বৃন্দা পেপারে খানিকক্ষণ চোখ বােলাল। কিন্তু কোনও লেখাটাই তেমন মন দিয়ে পড়া হল না আজ। সারাক্ষণই কাল রাতের স্বপ্নটা মাথায় ঘুরছে।


স্বপ্নের কথা ভাবতে-ভাবতে কাল দুপুরের কথাটা মনে পড়ে গেল বৃন্দার। মনে-মনে ভাবল, "তাই তাে! তারপর তাে আর দেখা হল না ।” কাল দুপুরে বাড়ির অ্যাটিকে উঠেছিল বৃন্দা। ওখানে কাঠের উপর খােদাই করে কাজ করা একটা বাক্স পেয়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই বাক্সের তালাটা খুলতে পারেনি। সেটা তাে এখন দেখলে হয়।বৃন্দা আজ আবার অ্যাটিকে গেল। বাক্সটা একই জায়গায় একইভাবে পড়ে রয়েছে। বাক্সটাকে টেনে-টেনে নামাল, নীচে লিভিংরুমে। বাক্সটার উপর ঝুঁকে পড়ে বাড়ির চাবির বাঞ্চটা নিয়ে, বিভিন্ন চাবি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাক্সটা খােলার। চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই যে খুলছে না বাক্সটা। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শেষে ঠিক করল, বাক্সটাকে বাজারে নিয়ে যাবে। ওখানে একটা লােক বসে থাকে, সবরকম তালা খুলতে পারে সে।


ঝটপট রেডি হয়ে বাক্সটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বৃন্দা। বাজারে ওই চাবিওয়ালার কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু লােকটা অনেক চেষ্টা করেও বাক্সটা খুলতে পারল না। বাক্সটা যেহেতু পুরনো, এর চাবিও পুরনাে আমলের। আজকালকার চাবি দিয়ে এ তালা খুলবে না। আলাদা করে চাবি বানাতে হবে। বৃন্দা অবশ্য এককথায় রাজি হয়ে গেল। লােকটাকে নতুন চাবি বানাতে বলে কিছু টাকা দিয়ে দিল। এদিকে সন্ধেও হয়ে এসেছে। শৌনক মােটামুটি বিকেলের দিকে বাড়ি ফেরে। তাই বৃন্দা আর বেশি দেরি করল না। আনাজপাতি কিছু কিনে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।শৌনকও আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু বাড়িটা আজ যেন একটু বেশিই অন্ধকার লাগছে। শুধু উপরে ওদের বেডরুমে একটা হালকা নীল আলাে জ্বলছে। এটা ওরা রাতে জ্বালিয়ে শােয়, একদম অন্ধকারে শুতে বৃন্দা খুব ভয় পায়। শৌনক পকেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবিটা বের করে দরজার লকটা খুলল। ওরা দুজনেই চাবি রাখে নিজেদের সঙ্গে। যে যখন আসে, চবি খুলে ঢােকে। লিভিংরুমে আলাে জ্বালিয়ে ব্যাগটা সােফায় ছুড়ে দিয়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ঠকাঠক ঠকাঠক শব্দ করে দোতলায় উঠে এল শৌনক। বেডরুমের দরজাটা অর্ধেক বন্ধ। সেখান দিয়ে হালকা নীল আলাে বেরিয়ে আসছে। বেশ একটা মােহময় আবহ তৈরি করেছে। শৌনক এগিয়ে গেল। বেডরুমের দরজায় হালকা চাপ দিতেই বাকি দরজাটা খুলে গেল। বিছানায় বুন্দার হাউসকোট পড়ে রয়েছে।ঘরে ল্যাভেন্ডারের হালকা গন্ধ। 


ও!আজ তো বৃন্দা অন্য মুডে আছে-- ভাবল শৌনক।ভালই লাগল ওর। এত রােম্যান্টিক কখনও দ্যাখেনি তাে বৃন্দাকে। পকেট থেকে মােবাইলটা বের করে বেডসাইডে রাখল। বৃন্দার কথা ভাবতে-ভাবতে শার্টটা প্যান্টের মধ্যে থেকে টেনে বের করল শৌনক।বােতামগুলাে পটাপট খুলে শার্টটা বিছানার উপর ছুড়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সিগারেটটা সবে মুখে দিয়ে ধরাতে যাবে, এমন সময় বৃন্দা পিছন থেকে এসে সিগারেটটা ওর হাত থেকে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। বৃন্দা শৌনকের হাতটা ধরে বিছানায় টেনে নিয়ে গেল। সাদা স্লিভলেস নাইটড্রেসে বৃন্দাকে যেন আরও বেশি মােহময়ী লাগছে। মুখটা অদ্ভুত স্নিগ্ধ লাগছে আজ। অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি ফরসা। বৃন্দার গা যেন আজ তুলাের মতাে নরম। আজ নিশ্চয়ই বিউটি পার্লারে গিয়ে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে এসেছে বৃন্দা। বিউটি পার্লারে গেলেই মুখ থেকে পা অবধি সব ঘষে আসে। এই নিয়ে অনেক মশকরা করে শৌনক। কিন্তু এরকম ঝকঝকে তকতকে বউকে কাছে পেতেও মন্দ লাগে না। বৃন্দাকে আরও একটু কাছে টেনে নিল শৌনক। বৃন্দার ঠোটে হালকা লাজুক হাসি। এমন সময় হঠাৎ মোবাইলটা বাজতে শুরু করল। শৌনকের মাথাটা গরম হয়ে গেল! এত সুন্দর একটা সময় কে রে শালা বিরক্ত করছে।বৃন্দাকে পাশে সরিয়ে পিছন ফিরে মােবাইলটা তুলে দেখল বিনি কলিং। শৌনকের মেরুদণ্ড বরাবর যেন একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল নীচের দিকে। শৌনক মাঝেমাঝে বৃন্দাকে আদর করে বিনি বলে ডাকে। ওর ফোনেও বৃন্দার নম্বর বিনি নামে সেভ করা। তা হলে ওর পিছনে বিছানায় এখন কে? শৌনক পাথরের মতাে স্থির হয়ে গেল। মনে-মনে ভাবছে পিছন ফিরে কি সে দেখবে? ঘাড় যে ঘুরছে না। কেমন যেন শক্ত হয়ে গিয়েছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। ফোনটা ধরল। ওপাশে বৃন্দা, “কী গাে, দরজাটা ভিতর থেকে লক করেছ কেন? আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”


“হ্যা, আসছি," বলে শৌনক একলাফে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বিছানার দিকে ফিরল। কই? কেউ নেই তাে! খাটের চাদরের উপর বৃন্দার হাউসকোটে চাঁদের আলাে এসে পড়েছে। হঠাৎ করে ঘরের নীল আলােটা মােহময়ী থেকে কেমন যেন ভুতুড়ে চেহারা নিচ্ছে। বেডরুমের দরজাটা অল্প খােলা, সেখান দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। শৌনক তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে পড়িমরি করে ছুটে গেল মেন গেটের দিকে। দরজা খুলতেই সামনে বৃন্দা, "দরজাটা ভিতর থেকে লক করেছ। কেন? তোমায় বলেছি না, যখন আসব, চাবি দিয়ে খুলে যাতে ঢােকা যায়, ভিতর থেকে লক করবে না। কখন থেকে ভেকে যাচ্ছি।" শৌনক তখনও দরজা ধরে হা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কোনটা আসল, এটাই বৃন্দা তো! দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বৃন্দাকে এসে জড়িয়ে ধরল। শৌনক। বৃন্দার হার্টবিট যেন শৌনকের বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। উ। ধড়ে প্রাণ এল শৌনকর। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোটাই চেপে গেল ও বৃন্দার, কাছে। একেই বৃন্দা একটু ভয় পায়, তার উপর উলটোপালটা স্বপ্ন দেখে। তারপর আবার এইসব ঘটনা শুনলে একেবারেই আর এখানে থাকতে পারবে না। দুপুরটা তাে অন্তত বৃন্দাকে একা থাকতে হবে।সেদিন রাতে বেডরুমে ঢুকতেই ভয় লাগছিল শৌনকের। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে বারবার বৃন্দার মুখটা দেখার চেষ্টা করছিল। অনেক রাত অবধি একা-একা জেগেছিল শৌনক। সন্ধেবেলায় যে ব্যাপারটা কী হল, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এটা আবার মনের ভুল না তো! কী জানি, এসব ভাবতে-ভাবতে কখন যে শৌনক ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই।


সকালে বৃন্দার ডাকে ঘুম ভাঙল। পরদিন অফিসে বেরতে যাবে, হঠাৎ শৌনকের চোখ পড়ল সােফার নীচে রাখা কাঠের ওই বাক্সটার দিকে। ওটাকে টেনে বের করে বৃন্দাকে ডাকল, “এটা কী ?"


-"কাল অ্যাটিকে উঠেছিলাম। ওখানে এটা পেলাম। কিন্তু খােলা যাচ্ছে না কিছুতেই।"

- “কী দরকার এটা খােলার! এই অনধিকার চর্চাটা আমার একদম পছন্দ নয়। দু’দিন এখানে থাকতে এসেছি। নিজেদের মতাে থাকলেই হয়। কেন এসব জিনিসে হাত দিচ্ছ। এটায় একদম হাত দেবে না আর খােলার চেষ্টা করারও দরকার নেই,” বলে শৌনক রেগেমেগে বাক্সটা নিয়ে অ্যাটিকে গিয়ে রেখে এল। একটু ঝামেলা করেই সেদিন শৌনক অফিসে বেরল। বৃন্দার মনটা ভাল লাগছিল না। প্রত্যেকদিনের মতােই কাগজ আর এক কাপ চা নিয়ে সােফায়এসে বসল। পরপর পাতাগুলাে অলস হাতে উলটে যাচ্ছিল বৃন্দা। হঠাৎ কাগজের ভিতরের পাতার একটা খবরে একটু চমকে গেল। কাগজটা ভাঁজ করে খবরটা চোখের কাছে নিয়ে এসে নড়ে-চড়ে বসল। হেডিং 'রহস্যজনক মৃত্যু।' নীচে বাজারের ওই চাবিওয়ালার ছবি। চাবির গােছাটা যে রিংয়ে থাকে, সেটা চাবিওয়ালার গলায় পেঁচানাে। উফ! দেখা যায় না। তাড়াতাড়ি কাগজটা বন্ধ করে দিল বৃন্দা। দুপুরবেলার দিকটা বৃন্দা একবার বাজারে গিয়েছিল চাবিওয়ালা যেখানে বসত, সেখানে। জায়গাটা ফাঁকা। শুধু ওঁর বসার টুলটা রয়েছে। টুলটায় কেমন যেন নখের আঁচড় রয়েছে বলে মনে হল। ব্যাপারটায় একটু ভয় তাে পেলই সে। আর মনটাও খারাপ হয়ে গেল সেই সঙ্গে। সেদিন মনখারাপ নিয়েই বাড়ি ফিরল বৃন্দা। শৌনকও সেদিন একটু ডিস্টার্বড ছিল। খুব একটা কথা হল না ওদের মধ্যে। রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়ল ওরা। শৌনকেরও কাল ভাল ঘুম হয়নি। তা ছাড়া আজ দুপুরে বৃন্দাও একটু রেস্ট নিতে পারেনি। পরদিন ভালই কাটল। দু'জনের মধ্যে মিলমিশও হয়ে গেল। অনেকদিন পর একটু সি বিচেও ঘুরতে গেল সেদিন। দু-তিনদিন এভাবে ভালই কেটে গেল, অদ্ভুত কিছুই ঘটেনি তেমন। কিন্তু সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ শৌনকের ঘুমটা ভেঙে গেল। কেমন যেন, খসখস একটা শব্দ পেল সে। যেন কেউ কিছু একটা ঘষছে। বেডসুইচটা অন করল, আলাে জ্বলল না। নিশ্চয়ই লােডশেডিং। বেশিরভাগ দিনই রাতের দিকে এখানে কারেন্ট থাকে না। বিছানায় পাশে হাত দিয়ে বৃন্দাকে খোঁজার চেষ্টা করল শৌনক। না, বৃন্দা তাে নেই ওখানে। মােবাইলের টর্টা অন করে প্রথমে বাথরুমটা চেক করল। এবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল শৌনক। শব্দটা কোথা থেকে আসছে? টর্চটা নিয়ে আস্তে-আস্তে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। না, নীচে কেউ নেই। মেন গেটও লক করা। শৌনক আবার টর্চ নিয়ে দোতলায় এল। আওয়াজটা আরও উপর থেকে আসছে, মনে হচ্ছে। অ্যাটিকের দিকে টর্চের আলাে ফেলল শৌনক। অ্যাটিকের কাঠটা কেমন যেন হালকা নড়ছে। আর ওদিক থেকেই আওয়াজটা আসছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এল শৌনকের। মনে-মনে শুধু বলল, বিনি! সিঁড়ি দিয়ে অ্যাটিকে উঠে এল সে। অ্যাটিকে যাওয়ার ডালাটা খােলা। উপরে উঠে আসতেই দেখল, বৃন্দা উবু হয়ে বসে, ওই কাঠের বাক্সটার উপর ঝুঁকে পড়ে নখ দিয়ে খসখস করে বাক্সটা ঘষে যাচ্ছে। বৃন্দার চুল খােলা, কেমন যেন পাগলের মতাে একদৃষ্টে বাক্সটার দিকে তাকিয়ে নখ দিয়ে আঁচড়ে যাচ্ছে। শৌনক চেঁচিয়ে উঠল, "বিনি-ই-ই! বৃন্দা ভয়ে ছিটকে বাক্সটার থেকে দূরে সরে গেল। একটা কোণে গিয়ে জড়ােসড়াে হয়ে বসে পড়ল।


শৌনক আস্তে-আস্তে টর্চটা নিয়ে বাক্সটার কাছে গেল, বাক্সটার উপর নখের আঁচড়।এবার বৃন্দার দিকে টর্চের আলাে ফেলে এগিয়ে গেল। বৃন্দা চিৎকার করে উঠল, আমাকে মেরো না, আমাকে মেরাে না।” শৌনক তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। বৃন্দা অজ্ঞান হয়ে ওর কোলে ঢলে পড়ল। 

সেদিন রাতে শৌনকের ঘুম হয়নি। বৃন্দা অবশ্য তারপর টানা ঘুমিয়েছে। শৌনক একদৃষ্টে সারারাত চেয়ে থেকেছে বৃন্দার দিকে। বৃন্দার গালে-মুখে আঁচড়। খুব অনুশােচনা হচ্ছে। শৌনকের। আজ ওর জন্যই বৃন্দার এই অবস্থা। কেন যে ওকে বিয়ে করতে গেল ? কেনই বা যে এখানে আনতে গেল? উফ।

পরদিন বৃন্দা ঘুম থেকে উঠেই মুখে আঁচড়ের দাগ দেখে ভয় পেয়ে গেল। শৌনককেও দেখাল। শৌনক বুঝতেই পারল যে, ওর কাল রাতের কথা কিছুই মনে নেই। সেদিন ছুটি নিয়ে একবার গির্জায় ফাদারের কাছে বৃন্দাকে নিয়ে যাবে ভেবেছিল শৌনক। বৃন্দাও সারাদিন একা একা থাকতে চাইছিল না। এই বাড়িটা নিয়ে একটা ভীতি বাসা বেঁধে ফেলেছিল ওর মনে। সামান্য সামান্য জিনিসেই যখন-তখন চমকে উঠছিল। কিন্তু অফিস থেকে ছুটি মঞ্জুর হল না। অফিস যেতেই হল শৌনককে। সারাদিন বেশ চিন্তাতেই কাটল। বৃন্দাকে বারবার ফোন করে খোঁজও নিচ্ছিল শৌনক। কালই বৃন্দাকে নিয়ে কলকাতা ফিরবে বলে ঠিক করে ফেলল শৌনক। অফিসেও দু’সপ্তাহ ছুটি ও কলকাতায় ট্রান্সফারের দরখাস্ত জমা দিল। কিন্তু দুপুরে খেয়ে উঠে বৃন্দাকে ফোন করেই শৌনকের চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল। বৃন্দা ফোন ধরছে না। অফিসে বলে বিকেল-বিকেল বেরিয়ে পড়ল। সন্ধের একটু আগে বাড়ি ফিরল শৌনক। বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল। সারাটা বাড়ির মাটি কোপানাে। কিছু একটা দিয়ে বাড়ির চারপাশে বাগানে মাটিটা কোপানো। এমনকী, কিছু ছােট গাছও উপড়ে পড়ে আছে। সারা বাড়িটা লন্ডভন্ড। মাঝে-মাঝে গাছ করার জন্য বাগানের মাটি কোপানাে হয় ঠিকই। কিন্তু এরকম ভাবে নয়! শৌনকে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। শৌনক ব্যাগ ফেলে দৌড়ে গিয়ে ঢুকল বাংলাের মধ্যে। কেউ কোথাও নেই! বৃন্দা গেল কোথায়? পাগলের মতাে দশ-পনেরোেবার বৃন্দাকে ফোন করে গেল শৌনক। নাে রেসপন্স। নেই। কোথাও নেই। বাগানের চারপাশ খুঁজতে লাগল। বৃন্দা, বৃন্দা করে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগল শৌনক। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। ছুটতে-ছুটতে হঠাৎ বাড়ির পিছনে কীসে একটা হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শৌনক। কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল। মাটির উপর একটা কাঠের অংশ দেখা যাচ্ছে। চারপাশটা তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। শৌনক হাত দিয়ে কাঠের অংশটা টানল। আরও খানিকটা অংশ বেরিয়ে এল। কিন্তু খুব ভারী লাগছে জিনিসটা। শৌনক ছুটে গিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে একটা শাবল আর টর্চ নিয়ে এল। টর্চটা পাশে জ্বালিয়ে রেখে উপর থেকে খানিকটা মাটি সরাতেই বেরিয়ে এল ওই কাঠের বাক্সটা আর সেটাকে জড়িয়ে ধরে বিনি। শৌনকের বুকটা টিপটিপ করছে। মনে-মনে শুধুই বলে যাচ্ছে, 'সরি, বিনি সরি, আয়্যাম রিয়ালি সরি।'

বৃন্দা শুয়ে আছে বাক্সটা শক্ত করে বুকে ধরে। মুখে আঁচড়ের দাগগুলাে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর তার উপর গুড়াে-গুড়াে মাটি ছড়িয়ে আছে। শৌনক তাড়াতাড়ি বৃন্দাকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরল। বৃন্দার হৃদস্পন্দন টের পেল। এখনও বেঁচে আছে। বৃন্দাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেল। সােফায় শুইয়ে দিয়ে ওর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিল। বৃন্দা আস্তে-আস্তে চোখ মেলল। শৌনককে দেখেই কেঁদে উঠল,"আমাকে ছেড়ে যাবে না তাে তুমি? বলাে।"


 তারপরই হঠাৎ শৌনকের জামার কলারটা ধরে, শৌনকের মুখটা কাছে টেনে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসে উঠল বৃন্দা। শৌনকের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বৃন্দার চোখগুলাে আস্তে-আস্তে কটা রংয়ের হয়ে আসছে। তারপর বৃন্দা এক ধাক্কায় শৌনককে প্রায় কুড়ি হাত দূরে ছিটকে ফেলে দিল।


শৌনক সেখানেই কুঁকড়ে বসে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল, “সরি বিনি, সরি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তােমাকে মারতে চাইনি, বিশ্বাস করাে, আমি সত্যি বলছি, আমি তােমাকে খুন করতে চাইনি। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। আমার বাড়ি থেকে তােমাকেমেনে নিত না। কম বয়স ছিল। তার উপর গােয়ার মতাে জায়গা, তার মাঝে তােমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এত ভয় দেখাচ্ছিলে আমাকে যে, আমি কী করব বুঝতে পারিনি। আমি শিপ থেকে তােমায় ধাক্কা দিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, তুমি এরকম ভাবে চলে যাবে। আমি স্বীকারও করেছি। আমার নােটে। বিশ্বাস করাে, ওই কাঠের বাক্সটায় আছে লেখাগুলাে। তােমাকে দেওয়া গিফ্টগুলােও আছে। আমি স্বীকার করছি তােমাকে খুন করেছি, আমি স্বীকার করছি। প্লিজ তুমি বৃন্দাকে ছেড়ে দাও। আমাকে শাস্তি দাও। তুমি বৃন্দাকে ছেড়ে দাও। ওর তাে কোনও দোষ নেই, বলাে। ওকে কেন কষ্ট দিচ্ছ তুমি? আমি কিন্তু তােমাকেও তখন ভালবেসেছিলাম বিনি, শুধু বাবা-মায়ের ভয়ে... প্লিজ প্লিজ...” হাউহাউ করে কাঁদছে শৌনক।


বৃন্দা শৌনকের পাশে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল, "শৌনক, তুমি খুন করেছিলে ? বিনি কে? তুমি আমাকে বিনি বলে ডাকতে না!"

শৌনক আরও জোরে কেঁদে উঠল। চোখ-নাক মুছে বলল, “পাঁচবছর আগে আমি একটা প্রজেক্টের কাজে গোয়াতে এসে কদিন ছিলাম। তখন বেনি রোজারিও নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমি ওকে বিনি বলে ডাকতাম। গােয়ার এই সমুদ্রসৈকতে বুকে খুব সহজেই বিনির কটা চোখের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। ও ও আমাকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিল। আমার সব ব্যাপারে ওই খেয়াল রাখত। সকালে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে রাতের ডিনার পর্যন্ত। আসলে ওর নিজের বলতে কেউই ছিল না। ওর এক দুরসম্পর্কের আন্টির সঙ্গে থাকত। সে ওকে মােটে সহ্য করতে পারত না। তাই আমার একটু কেয়ারই ওর কাছে সবকিছু হয়ে গেল। একদিন ও আমার কাছে চলে এল। আমরা একসঙ্গে থাকাও শুরু করলাম। গির্জায় গিয়ে একদিন লুকিয়ে বিয়েও করলাম। কিন্তু ও বারবার আমার বাড়িতে যাওয়ার জন্য চাপ দিত। কিন্তু আমি তাে তখনও ঠিক রেডি ছিলাম না। ক্রমশ ওকে বিরক্ত লাগতে শুরু করল। ওর সঙ্গে ঠিক করে কথা বলতাম না, দেরি করে বাড়ি ফিরতাম। ও-ও ভীষণ সন্দেহ করতে আমায়। মাঝে-মাঝেই রেগে গেলে খুব পাগলামি করত। মারত, নখ দিয়ে আঁচড়ে দিত। নিজের চুল নিজেই টানত। আমাদের সম্পর্কটা আঁকড়ে ধরার জন্য যা নয় তাই করত। তারপর একদিন আমার বাড়ির নম্বরে ফোন করবেই। তাই নিয়ে আমাদের খুব ঝামেলা হয়। পরদিন আমি ওকে সমুদ্রে ঘুরতে নিয়ে যাই। ও শিপের ধারে উঠে পােজ দিচ্ছিল ছবি তােলার জন্য। আমার হঠাৎ কী মনে হল, ওকে ধাক্কা মেরে দিলাম। ব্যস..."


বৃন্দার চোখটাও ছলছল করে উঠল একটা অচেনা মেয়ের জন্য। আহা রে! কেউ তাে ছিল ওর। যাকে পেল, সে-ই ওকে শেষ করে দিল। হঠাৎ করে শৌনকের প্রতি ঘৃণা বােধ করল বৃন্দা। সেদিন সারা রাত বৃন্দা আর একটাও কথা বলেনি শৌনকের সঙ্গে। ওরা যে কতক্ষণ ওইভাবেই চুপ করে বসেছিল, জানে না। একটা সময় বৃন্দার চোখ লেগে এসেছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল হয়ে গিয়েছে। সকালটা কী শান্ত। একটা বড় ঝড় যেন থামল। বৃন্দা শৌনককে দেখতে পেল না আশপাশে। দোতলাতে গেল দেখতে। সেখানেও নেই। শুধু বিছানার উপর ওই কাঠের বাক্সটা ডালা খােলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বাক্সটায় শুধু একটা চিঠি।


 "বৃন্দা,আমি কিন্তু তােমাকে খুব ভালবাসি, বিশ্বাস করাে। কিন্তু খুনের মতাে অপরাধ যখন আমি করেছি, তার প্রায়শ্চিত্তও আমাকেই করতে হবে। আমি পুলিশ স্টেশনে যাচ্ছি সারেন্ডার করতে। জানি না, আর দেখা হবে কি না। তুমি ভাল থেকো। বিনির দেওয়া গিফটগুলাে আমি নিয়ে গেলাম।"

-শৌনক


দূরে ভােরের আলােয় সমুদ্রের ঢেউ তখন আছড়ে এসে পড়ছে বৃন্দার চোখে।


এই ঘটনার কিছুদিন পরই বৃন্দা কলকাতায় ফিরে এসেছিল। কিন্তু ফেরার আগে একবার শৌনকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল লকআপে। সেখানে শৌনককে দেখে চমকে উঠেছিল বৃন্দা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ওর। শৌনকের চেহারায় শুধু নয়, ওর লকআপের দেওয়ালেও ছিল নখের আঁচড়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror