Jeet Guha Thakurta

Classics Thriller

5.0  

Jeet Guha Thakurta

Classics Thriller

বিকেল ৩টে

বিকেল ৩টে

6 mins
867


লাইটারটা ধরাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সোহম।


রাস্তার ওপারে একটা বয়স্কমতো লোক একটা চওড়া ঠেলাগাড়িতে করে ইয়া উঁচু বস্তা বস্তা মাল টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। একটু বেশীই লোড করেছিলো হয়তো বা গাড্ডায় পা পড়ে গিয়ে হাত ফস্কে গেছে। সোহম দেখলো পুরো ঠেলাটা পিছন দিকে ভারী হয়ে উল্টে গেলো, গিয়ে কাত হয়ে পড়লো। লোকটা শেষমুহূর্ত অবধি ঠেকাতে চেষ্টা করেও পারলো না। ওই অতো উঁচু উঁচু করে সাজানো বস্তা সব দুমদাম করে রাস্তার উপর পড়লো। ঠেলাটাও কাত হয়ে পড়লো একদিকে। একটা চাকা উঁচুতে, বাকিটা থুবড়ে রয়েছে সাইডে। দেখলে মনে হবে ঠিক যেন কোনো নেড়িকুত্তা এক পা তুলে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ইয়ে করছে।


একটা মুহূর্ত। পরক্ষণেই আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এলো। 'এতো মাল কেউ তোলে ?' 'আরে এদের কান্ডজ্ঞান নেই, দেখুন না পিছনদিকে বেশি লোড করেছে, সামনে হালকা।' 'কিছু ভেঙেছে ? চাকাটা তো গেছে মনে হচ্ছে।' 'আপনার লাগেনি তো কাকা ? আপনার গায়ের উপর পড়লে আপনি তো এখানেই শেষ হয়ে যেতেন, এভাবে ওভারলোড করেন কেন ?'


পরামর্শ ও সাহায্যের কোনো অভাব হয় না কলকাতার রাস্তায়। মুটেআলা তার লাল পাগড়িটা খুলে নতুন করে বাঁধতে বাঁধতে চুপ করে এসব শুনছে অপরাধী-অপরাধী মুখে। সোহম জানে একটু পরে এদেরই সাহায্যে গাড়িটা সোজা করে আবার মালের বস্তা নিয়ে ঠেলা টেনে ছুটবে লোকটা। সে দু'চার মিনিট দেখে সিগারেটটা ধরিয়ে হোস্টেলের দিকে রওনা দিলো। আজ বিকেল ৩টের সময় রেজাল্ট। টেনশান কমাতে সিগারেটই সহায়।


হাঁটতে হাঁটতে সোহম ভাবছিলো, রোবট আর চন্দ্রযানের যুগে মানুষ এখনও কেন হাতে টেনে ঠেলাগাড়িতে মাল নিয়ে যাবে, এই প্রশ্নটা কেউ করে না। ওভারলোড তো পরের কথা। আসল প্রশ্ন তো এটাই যে বস্তা বস্তা মাল এভাবে নিয়ে যাওয়ার কথাই নয়। অবশ্য এই প্রশ্ন কাকেই বা করা যায়। মুটেআলার হয়তো আর কোনো যোগ্যতাই নেই, যা করে সে দু'পয়সা উপার্জন করতে পারে। ঠেলাগাড়ি বন্ধ হলে তার পেটের ভাতই সবার আগে বন্ধ হবে। সে নিজেই এই বিপজ্জনক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো সমর্থক। কিন্তু তার অন্য কোনো যোগ্যতা নেই কেন ? সেটাও একটা মস্ত বড়ো প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নটাও যে কাকে করা যায় কে জানে! পৃথিবী একদিকে কত আগে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই অগ্রগতির খবর যেন সবার কাছে পৌঁছায়নি। অন্তত আমাদের মতো বিপুল লোকসংখ্যার দেশে ভীষণ একটা বিভাজন রয়ে গেছে। মুটেআলা কি লেখাপড়া করেছে কোনোদিন ? নাকি সে সুযোগ সে পায়নি ?


হোস্টেলে ঢোকার মুখে একটা পোস্টারে চোখ পড়লো। কোনো একটা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। চাকরির পরীক্ষার ট্রেনিং দেওয়া হয়। সাথে প্লেসমেন্ট গ্যারান্টি। সোহম ভাবলো এক মুহূর্ত, লেখাপড়া করলে কি আর মুটেগিরি করতে হতো না ? সে ভরসা আছে ?


হোস্টেলে সিগারেট কিনে রাখে না সোহম। এর একটা সুবিধা আছে। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে দু'মিনিট হেঁটে গেলে তবে সিগারেটের দোকান। রুমে রেডিমেড সিগারেট মজুত না থাকার ফলে তবু একটু কম খাওয়া হয় আরকি। তবে আজ একটা গোটা প্যাকেট কিনেই আনলো সে। অনেক কাজ বাকি আছে। দুপুরের মধ্যে শেষ করতে হবে।


**************************************************


এগারোটার দিকে মেসেজ এলো একটা - 'কিরে কী করছিস ? বেরোবি আজকে ?'


সোহম কম্পিউটারের স্ক্রিনে আটকে ছিলো। এই কম্পিউটারটা তিনজন মিলে কেনা। তার দুজন রুমমেটের একজন গ্রামের বাড়িতে গেছে, মেদিনীপুর। আরেকজন ঘুরতে গেছে। আপাতত গোটা ঘরে সে একা। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে সোহম উত্তর করলো - "আজ হোস্টেলেই থাকবো। তিনটের সময় রেজাল্ট ভাই। টেনশানে আছি।"


"আজ রেজাল্ট ? কীসের রেজাল্ট রে ? তোর সাপ্লির ?"


"না। আসল রেজাল্ট। ঠিক তিনটের সময় অনলাইনে বেরোবে।"


"সে তো ডিসেম্বরে বেরোনোর কথা। ডেট এগিয়ে এনেছে নাকি ? এরকম বলিস না মাইরি, হার্টফেল করবো।"


"টেনশান নিস না। তোর রেজাল্ট নয়।"


অফলাইন হয়ে গেলো সোহম। একটা রিপোর্টে বলছে ৭০ শতাংশ কোনো সরকারি-বেসরকারি চাকরি পায়নি, তারা স্বনির্ভর। আরেকটা রিপোর্টে বলছে ৭৬ শতাংশ। এই গরমিলটা দেখতে হবে।


**************************************************


ঘড়িতে তখন ২টো বেজে ৫০ মিনিট। ঋতব্রতর মোবাইলে একটা মেসেজ এলো ইউনিভার্সিটি থেকে - আজ বিকেল ৩টের সময় রেজাল্ট ঘোষণা করা হবে, রেজাল্ট দেখতে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে লগইন করতে হবে।


ঋত সম্পূর্ণ অবাক। আজ তো রেজাল্ট বেরোবার কোনো কথাই ছিল না। হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি কেন বেরোচ্ছে ? তাও আগে থেকে কোনো নোটিশ নেই। একদিন আগে তো অন্তত নোটিশ দেবার কথা। ভীষণ ধোঁয়াশে ব্যাপার। সকালে সোহম এরকম কিছু একটা বলছিলো না ? কিন্তু সোহম কী করে জানলো এটা আগেভাগে ? অনলাইনও নেই ছেলেটা। সোহমকে কল করলো ঋত। তার লাইন ব্যস্ত। লাগছে না কল। পার্থকে কল করলো সে। পার্থও পেয়েছে এই মেসেজ। স্বরূপা পেয়েছে। সায়ন্তি পেয়েছে মেসেজ। দেখা গেলো সব্বার কাছে এসেছে এটা। গোটা ইউনিভার্সিটির সব ইয়ারের সব কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের কাছে একই মেসেজ এসেছে। বিকেল ৩টে। কী অদ্ভুত ব্যাপার।


টেনশানে আগেভাগেই রেজাল্টের ওয়েবপেজটা খুলে বারবার রিফ্রেশ করতে থাকলো ঋত। আর তিন মিনিট... আর দু মিনিট... ভগবান জানে কী রেজাল্ট আসবে। পাশ করবে কিনা। অনার্সটা থাকবে কিনা। এবছর নাকি সবার রেজাল্ট খারাপ আসছে। এমনিতেই গতবছর একটা ব্যাক পেয়ে বসে আছে সে। এবছর কী হবে কে জানে। ঠিক ৩টের সময় ওয়েবসাইটে লগইন করার অপশানটা আসতেই নিজের রোল নাম্বার দিয়ে ঢুকতে গেলো ঋত। প্রথমবার টাইমআউট হয়ে গেলো। দ্বিতীয়বার ঢুকতে পারলো সে। ঢুকে রেজাল্টটা পরিষ্কার দেখতে পেলো। আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। কাউকে ফোন করতেও ভুলে গেলো। এতটাই বিস্মিত সে। এরকম রেজাল্ট কোনোদিন দেখবে সেটা ঋতব্রত কল্পনাও করেনি।


সবার উপরে লেখা, পরীক্ষার্থীর নাম - বঙ্গীয় মহাবিদ্যালয় তথা বাংলা ইউনিভার্সিটি (কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)।


শিক্ষাবর্ষ - ১৯৪৭ থেকে বর্তমান সাল।


এরপর মার্কশীটের মতো করে কিছু নাম্বার ও সেই নাম্বারের পাশে নোট লেখা আছে।


প্রথম পত্র - শিক্ষা পদ্ধতি। পূর্ণমান ১০০। প্রাপ্ত নম্বর ১৮।


কলেজে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা দেখা গেছে ভীষণই অসম্পূর্ণ। টিচারদের হাজিরা নিলে দেখা যাবে অর্ধেক দিনই তারা ক্লাসে আসেন না। সিলেবাস শেষ হয় না। যা পড়ানো হয় তাও কারুর বোধগম্য হয় না। যেটুকু শেখা হয়, সেটা তো হয় প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে। সেখানে সব টিচারই নিয়মিত হাজিরা দেন। আর সেখানেও পড়ানো মানে দিস্তা দিস্তা নোট, যা মুখস্থ করে উগরে দিতে পারলেই বাজিমাত। সব মিলিয়ে ১৮ এর বেশি দেওয়া গেলো না এই পদ্ধতিকে।


দ্বিতীয় পত্র - সততা ও নিয়মানুবর্তিতা। পূর্ণমান ১০০। প্রাপ্ত নম্বর ১৫। ভালো কলেজে ভর্তি হবার জন্য ২০ হাজার টাকার ঘুষ দিয়ে শুরু হয় একজন শিক্ষার্থীর জীবন। পরীক্ষার সময় হল-কালেকশান আর টুকলি দিয়ে হয় পরিসমাপ্তি। এই অরাজকতাকে কোনো নম্বরই দেওয়া যায় না, তবু ১৫ বরাদ্দ করা হলো।


তৃতীয় পত্র - শিক্ষার উপযোগিতা। পূর্ণমান ১০০। প্রাপ্ত নম্বর ১৭।


যারা এই ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে বেরোয়, তারা অতঃপর কী করে ? অধিকাংশই অন্য কোনো জায়গায় ভর্তি হয় চাকরির প্রস্তুতি নিতে। মানে এখানে যে শিক্ষা তাদের দেওয়া হলো, তা কোন কাজে লাগে ? কোনো কাজে লাগে না। কোনো যোগ্যতা তৈরী হয় না। আবার নতুন করে যোগ্যতা তৈরী করতে নতুন কোনো ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে হয়। বেসরকারি ক্ষেত্রে এরকম রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে যে চাকরির অভাব নেই, অভাব যোগ্য লোকের। প্রতি বছর এতো যে ছাত্রছাত্রী শিক্ষা সম্পূর্ণ করে বেরোচ্ছে, তারা কোনোকিছুরই যোগ্যতা অর্জন করছে না। শুধু তাদের একটি যোগ্যতা আছে। তারা শিক্ষকতা করতে পারে, অর্থাৎ তারা আরো একদল অযোগ্য ছাত্রছাত্রী তৈরী করতে পারে। আর কিছু না। অতএব ১৭ এর বেশি এক নম্বরও দেওয়া গেলো না।


তারপর নিচে লেখা - সর্বসাকুল্যে বঙ্গীয় মহাবিদ্যালয়ের মোট মান তাহলে দাঁড়ালো ৩০০ তে মাত্র ৫০। সর্বনিম্ন পাশ মার্কস ১২০। বঙ্গীয় মহাবিদ্যালয় বা বাংলা ইউনিভার্সিটি প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও তাই অকৃতকার্য হলো। অর্থাৎ ফেল। সম্পূর্ণ ফেল। এখন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে শিক্ষা থেকে বহিস্কার করা উচিত। জনহিতার্থে এই প্রতিষ্ঠান এতদ্বারা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য শিক্ষা দপ্তরের কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে।


বার বার রেজাল্টটা দেখতে দেখতে বেশ মজা পেলো ঋত। হোয়াট্সঅ্যাপে পরপর মেসেজ ঢুকছে। সারা দেশের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ এই রেজাল্ট দেখছে আজ এই মুহূর্তে। একেই কি বলে জাস্টিস ? ভীষণ একটা বুক কুঁকড়ে ওঠা ভালোলাগা ও কান্না মিলেমিশে গলার কাছে উঠে এলো ঋতর। চোখ থেকে চশমাটা খুলে গা এলিয়ে দিলো সে বিছানায়। এই আনন্দের স্বাদ অন্য। চোখে মুখে পাশ করার খুশি। আজ তারা সবাই হয়তো পাশ করে গেলো।


**************************************************


সেদিনই সন্ধ্যে ৮টার খবরে জানা গেলো, ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট হ্যাক করার জন্য কলকাতার একটি নামীদামি কলেজের হোস্টেল থেকে দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। নাম সোহম ব্যানার্জি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics