বিধু চ্যাটুর্জ্জের চশমা
বিধু চ্যাটুর্জ্জের চশমা
চ্যাটুর্জ্জে পাড়ার পূর্নেন্দু চ্যাটার্জ্জীর মেয়ের সাথে, মুখুর্জ্জে পাড়ার নির্মল মুখার্জ্জীর ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে । দুই পাড়ায় একটা ব্যাপার নিয়ে প্রায় ঝামেলা লেগে থাকে। আর সেই ব্যাপার টা হলো পান্ডিত্য। মানে কোন পাড়ার পুরোহিত বেশি ভালো, এবং তার সাথে কোন পাড়ার পুরোহিতের সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ, পূজা পদ্ধতি একেবারে নিখুঁত। প্রত্যেক বার যখনই পাড়ায় কোন বড় পূজো হয়, তখনই দুই পাড়ার লোক চুল চেরা বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য সাংস্কৃতিক টোলের বড় বড় পন্ডিত দের নিয়ে আসেন। এবং শেষ পর্যন্ত বিচারকের নির্নয়ে সেরার সেরা পুরোহিতের হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মান সূচক। প্রত্যেক বছর ধরে সেই সম্মান সূচক অর্জন করে আসছেন চ্যাটুর্জ্জে পাড়ার বিধু চ্যাটুর্জ্জে (বয়স ষাটের কাছাকাছি, ছিপছিপে চেহাড়া, গায়ের রঙ দুধসাদা, পড়নে সবসময় ধূতি আর ফতুয়া, মাথা ভর্তি পাকাচুল আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা)। বিধু চ্যাটুর্জ্জের সম্বন্ধে পত্রিকাতেও অনেক সময় লেখা বেড়োয়। চ্যাটুর্জ্জে পাড়ার গর্ব এই বিধু চ্যাটুর্জ্জে।
পূর্নেন্দু বাবু মেয়ের বিয়ের জন্য বিধু চ্যাটুর্জ্জেকে বলার আগেই, তিনি নিজে থেকেই বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। তবে রাজি হওয়ার পিছনে অন্যতম প্রধান কারন হলো, ছেলের বাড়ির কুলপুরোহিত হলেন আশিষ মুখুর্জ্জে (লম্বা দোহারা চেহারা, গায়ের রঙ চাপা, বয়স বাহান্নর কাছাকাছি, মাথায় চুল নেই শুধু আছে টিকি, ধূতির পাশাপাশি অন্য পোশাকও পড়েন, আর সবসময় চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কথা বলেন) এবং তিনিই বিয়ে দেবেন। আর বিধু চ্যাটুর্জ্জের বরাবরের প্রতিদ্বন্দি এই আশিষ মুখুর্জ্জে। যদিও তিনি তাকে বছর বছর হারিয়ে সম্মান সূচক আদায় করে নেন, তবুও হারানোর আরও একটা সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাননা, তাই একপ্রকার নিজেই তিনি পূর্নেন্দু চ্যাটার্জ্জীর মেয়ের বিয়ে নিজে থেকেই দিতে চেয়েছেন।
ওদিকে ছেলের বাড়িতেও একই রকম অবস্থা, আশিষ মুখুর্জ্জে নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন নির্মল বাবুর ছেলের বিয়ের, এমনকি তিনি পারিশ্রমিক পর্যন্ত নেবেন না... বলেছেন। কারন তিনিও মনে মনে ঠিক করেছেন বিধু চ্যাটুর্জ্জেকে যোগ্য জবাব দেবেন নিজের মধ্যেকার এতদিনের জমে থাকা রাগের নিস্পত্তি করবেন। এখন পুরোহিত নিয়ে ছেলে আর মেয়ের বাড়ির মধ্যে একটা চাপা টেনশন কাজ করছে। কারন বিয়ের মন্ডপে শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য অশান্তি না লেগে যায়, এবং বিয়েটা না মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়।
*************************
অবশেষে এসে গেল বিয়ের পূর্ন লগ্ন। নির্মল বাবু বরকর্তা হয়ে ছেলে নিয়ে হাজির হলেন পূর্নেন্দু বাবুর বাড়ি। শুরু হল বিয়ের অনুষ্ঠান। কন্যাদান পর্যন্ত সমস্ত কিছু নিয়ম বিধি নিখুঁত ভাবে বিধু চ্যাটুর্জ্জে করে গেলেন, যাতে আশিষ মুখুর্জ্জে কোন রকম সুযোগ না পান খুঁত ধরার। এবার কুসুমডিঙ্গার পালা এবং তার সাথে ছেলের বাড়ির পুরোহিতের কাজ শুরু। হিসেব মত আশিষ মুখুর্জ্জে নেমে পড়লেন মাঠে। শুরু হল বিয়ে।
----------কিছুটা সময় পার হতেই বিধু চ্যাটুর্জ্জে জোড় গলায় বলে উঠলেন ভুল হচ্ছে নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে ছেলের বাঁ দিকে বসবে,ব্যাস শুরু হয়ে গেল ঝামেলা, যেটার কথা ভেবে সবাই এতদিন ধরে টেনশনে ছিলেন।
বিয়ে গেল থেমে শুরু হল পুরহিতের লড়াই। বিধু চ্যাটুর্জ্জে একদিকে পুঁথি বার করছেন, তো অন্যদিকে আশিষ মুখুর্জ্জে পুঁথি বার করছেন, আর সবাই ওনাদের থামানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছুনা!!দুজনের ঝোলা থেকে একের পর এক পুঁথি বেড়িয়েই চলেছে, ওনারা একপ্রকার লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছেন। অনেকক্ষন পুঁথি নিয়ে লড়াইয়ের পর আশিষ মুখর্জ্জে যখন বুঝতে পাড়লেন তিনি আবার বিধু চ্যাটুর্জ্জের কাছে হারতে বসেছেন তখন তিনি অন্য পথে মোড় নিলেন, এবং বলে উঠলেন
-----------তিনি চশমাটায় ভালো দেখতে পাচ্ছেন না..!!! তাই পড়তে ভুল হয়ে গেছে কিছু!
বিধু চ্যাটুর্জ্জে নিজের চোখ থেকে চশমা খুলে আশিষ মুখুর্জ্জের হাতে দিলেন। আশিষ মুখুর্জ্জে বিধু চ্যাটার্জ্জীর চশমাটা চোখে পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন লেখা গুলো এবং আবার শুরু হল বিয়ে। কিন্তু বেশিক্ষন স্থায়ি হলো না,আবার বিধু চ্যাটুর্জ্জে, আশিষ মুখুর্জ্জের ভুল ধরলেন, এবং তারপর লাগল চশমা নিয়ে দুই পুরোহিতের কাড়াকাড়ি, আশিষ মুখুর্জ্জে হার স্বীকার করবেন না বলে সমস্ত দোষ চশমার ওপর চাপিয়ে দিলেন। একবার বিধু চ্যাটুর্জ্জে চশমাটা পড়ে পুঁথির পৃষ্ঠা উল্টাছেন, তো আর একবার আশিষ মুখুর্জ্জে নিজের চশমাটা ছেড়ে বিধু চ্যাটুর্জ্জের চশমাটা পড়ছেন। এইভাবে ভুল ধরতে, আর তার সংশোধন করতে , আর চশমা নিয়ে টানাটানি করতে করতে এক পর্যায়ে আশিষ মুখুর্জ্জে হার স্বীকার করে লড়াইয়ের ময়দান ছাড়লেন।
বিধু চ্যাটুর্জ্জে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে বিয়ে শুরু করলেন। আর আশিষ মুখুর্জ্জে যাতে কোন খুঁত ধরতে না... পারেন তার জন্য সমস্ত নিয়মকানুন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করিয়ে চললেন ছেলে আর মেয়েকে দিয়ে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে শুরু হয়ে ছিল, এবং শেষ হলো তখন সূর্য নতুন করে উঠতে শুরু করেছে, রাতের অন্ধকার কাটিয়ে।