বিদায়ের বাঁশি....
বিদায়ের বাঁশি....
নৈনিতাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটি শহর। প্রকৃতি যেন নিজের অপার সৌন্দর্য দিয়ে নৈনিতাল কে সাজিয়ে দিয়েছে। এই শহরের বুকে আরোগ্য নিকেতন নামে একটি ছোট আশ্রম আছে। প্রায় এক থেকে দেড়শো জন এখানে একসাথে থাকে। এখানে বয়স্ক থেকে বাচ্ছা সবাই একই সাথে থাকে। সবার জীবনেই কিছু না কিছু ভয়ংকর অতীত আছে তবুও ওরা আনন্দ আর হই হুল্লোড় করে জীবনের প্রত্যেকটা দিন কাটিয়ে দেয়।
এখানে সবাই যেন একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু আজ আরোগ্য নিকেতনে খুশির হাওয়াটা কেমন বিষাদে পরিনত হয়েছে। সবার চোখের কোন আজ ভেজা, কারন আজ আরোগ্য নিকেতন থেকে বিদায় নিচ্ছে তাদের সবথেকে কাছের দুটি মানুষ । একজন নন্দিনী সেন। যে এই আরোগ্য নিকেতন কে এতদিন ধরে আগলে রেখেছে সমস্ত রকমের বিপদ থেকে। এবং সবার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রেখেছে। আসলে এই আরোগ্য নিকেতনের সমস্ত মানুষ নন্দিনীর কাছের মানুষ। এই আরোগ্য নিকেতন নন্দিনীর পরিবার। সেই তিরিশ বছর বয়সে স্বামীর হাতে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত হতে হতে কখন যে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল ভিতর থেকে নন্দিনী তা নিজেও বুঝতে পাড়েনি। কিন্তু নন্দিনী কল্পনাও করতে পারেনি তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য নিজের একমাত্র কন্যা সন্তান কেও হারিয়ে ফেলতে হবে চোখের সামনে । সত্যি এই সমাজে কিছু কিছু মানুষ বড় নিষ্ঠুর হয়। এবং একসময় এরা মানুষ থাকেনা পশুতে পরিনত হয়।
নন্দিনী যখন একেবারে নিঃস্ব এবং একা হয়ে গিয়েছিল এই গোটা দুনিয়ার মধ্যে থেকেও তখন এই আরোগ্য নিকেতন ওকে বাঁচার সাহস দিয়েছিল। নতুন করে সবকিছু শুরু করতে সাহায্য করেছিল। আরোগ্য নিকেতনের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দের মধ্যে নিজের সন্তান হারানোর কষ্টকে কিছুটা হলেও লাঘব করতে পেরেছিল নন্দিনী। এবং বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের মধ্যে নন্দিনী বাবা,মার ভালোবাসার ছোঁয়া খুঁজে পেয়েছিল।
এইভাবে বিগত তিরিশ বছর নন্দিনী আরোগ্য নিকেতনের সাথে জড়িয়ে। কখন যে নিজের অজান্তেই সকলের ভালোবাসার নন্দু দিদি হয়ে উঠেছে বুঝতে পাড়িনি। বাইরে থেকে দেখে ভীষণ রকম কড়া মনে হলেও ভিতরের মনটা বড্ড নরম নন্দিনীর। আসলে সবকিছুই ঠিক রাখতে গেলে অনেক সময় নিজের ওপর একটা কঠিন মুখোশ পরতে হয় এতে কারোর ক্ষতি হয়না বরং ভালোই হয়। সমস্ত কাজের দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেও এই আরোগ্য নিকেতনেই থাকবে নন্দিনী। কারন নন্দিনীর যাওয়ার আর যে কোন জায়গা নেই। তবে নন্দিনী সমস্ত কিছুর দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের বাকি দিন কটা কাটাতে চায় সম্পূর্ণ নিজের জন্য এবং নিজের মনের মত করে।
আর একজন হল এই গোটা আরোগ্য নিকেতনের প্রান ভ্রমরা। তার নাম তুতুল। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে নন্দিনী তুতুল কে নিয়ে এসেছিল বেশ্যাপল্লী থেকে। আমাদের সংসারে মেয়ে হলে যেমন সবার চোখে জল আসে বংশ রক্ষা হবেনা বলে। কিন্তু বেশ্যাপল্লীতে ঠিক তার উল্টো মেয়ে হলে সবার খুব আনন্দ। কারন মেয়ে যে মায়ের ব্যাবসাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তুতুলের মা চায়নি নিজের এই অপমানের জীবনের সাথে মেয়েকে জড়াতে তাই আরোগ্য নিকেতনের নন্দিনী দিদির হাতে তুলে দিয়ে ছিল তার ছোট্ট সন্তানকে। ছোট্ট তুতুল চঞ্চল, প্রানবন্ত একটা ফুটফুটে মেয়ে। তার দুষ্টমি দেখে সবাই যেন প্রান খুলে হাসতে পারে। এই আরোগ্য নিকেতনের সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। আসলে হাতে করে বড় করে তুলেছে সেই একদিনের ছোট্ট মেয়েটাকে পাঁচ বছর ধরে। মোটামুটি সবাই এখানে একটু বড় বয়সেই এসেছে তুতুল একমাত্র এত ছোট্ট। কিন্তু আজ থেকে তুতুলের নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে কারন একজন নিঃসন্তান দম্পতি তুতুলকে অ্যাডপ্ট করেছে। এই পৃথিবীতে তুতুল আর অনাথ থাকবেনা ওরও একটা পরিচয় হবে।
আরোগ্য নিকেতনের সামনের প্রার্থনা মঞ্চটাকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের জন্য। একে একে সবাই নিজেদের হাতের তৈরী কিছুনা কিছু উপহার তুলে দিচ্ছে নন্দিনী আর তুতুলের হাতে। সবার চোখের কোন আজ ভেজা। তবুও কোথাও যেন একটা আনন্দ আছে। যারা আরোগ্য নিকেতন থেকে চিরদিনের মত বিদায় নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তাদের উদ্দেশ্যেও সবাই কিছুনা কিছু বলছে এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে। আজ নন্দিনী নিজের হাতে তুতুল কে তার নতুন বাবা, মার হাতে তুলে দিল। এবং প্রান ভরে আর্শীবাদ করল যাতে ওর নতুন জীবন যেন খুব খুব সুন্দর হয় আর সেখানে যেন কোন ঝড় না ওঠে। আসলে "ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়"। সমাজের ভয়ংকর রূপটাকে নিজের জীবনের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছে নন্দিনী তাই সবেতেই খারাপ চিন্তাটাই যেন মনের মধ্যে আগে বাসা বাঁধে। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ থেকে সবাই একসাথে গেয়ে ওঠল একটি গান, যেটা এই জীবনের চলার পথে ওদের সকলের কাছে মন্ত্র.........
"আছে দুঃখ......,আছে মৃত্যু.....,
বিরহ.... দহন লাগে.....।
তবুও শান্তি....., তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে...... ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা........
হাসে সূর্য চন্দ্র তারা.....,
বসন্ত নিকুঞ্জে... আসে বিচিত্র রাগে...॥
তরঙ্গ.... মিলায়ে যায় তরঙ্গ..... উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে... কুসুম ফুটে...।
নাহি ক্ষয়...., নাহি শেষ....,
নাহি....নাহি.....দৈন্যলেশ--
সেই... পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে.... ॥
