ভাষা বিভ্রাট
ভাষা বিভ্রাট
প্রিয় ডায়েরি,
আজকে অতীতের কিছু স্মৃতিচারণা করবো। সম্পূর্ণ বাঙালি একটা পরিবেশ থেকে একটা অবাঙালি পরিবেশে গিয়ে ভাষা নিয়ে কি পরিমাণ নাকানিচোবানি আমাকে খেতে হয়েছিল ,তারই কিছু ঘটনা আমার আজকের ভাবনায়।বিয়ের পর যখন ধানবাদে এলাম, সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশ। কি সুন্দর এখানে সামনেই পাহাড়। প্রাকৃতিক দৃশ্য ও অসাধারণ। সব কিছু ঠিকঠাক লাগলেও ভাষা নিয়ে আমি মহা সমস্যায় পড়েছিলাম সেইসময়। আদ্যোপান্ত বাংলা জানা একটা মেয়ে, কখনও হিন্দি বলিনি। পড়াশোনা,ওঠাবসা, বন্ধুবান্ধব সব বাঙালায় আর ইংরেজি তে। ক্লাস সিক্স থেকে এইট এই দুবছর শুধু সংস্কৃত পড়েছিলাম। দু একজন অবাঙালি বন্ধু যদিও ছিলো, কিন্তু তারাও পরিষ্কার বাঙলাতেই কথা বলতো। বড়ো মাসির বাড়ি ভিলাইতে ছিলো, ওখানে বছরে একবার যাওয়া হতো আমাদের। সেইসময় ওই , নমস্তে, খানা ,আনা,জানা এই জাতীয় কিছু হিন্দি শব্দই আয়ত্ব করতে পেরেছিলাম। আর হিন্দি সিনেমা দেখার দৌলতে হিন্দিটা অল্পস্বল্প বুঝতে পারতাম। কিন্তু কারুর সঙ্গে বাক্যালাপ করিনি কোনোদিন সেভাবে। যাইহোক বিয়ের পর গিয়ে দেখলাম আমার শ্বশুর বাড়ির আশেপাশে প্রচুর বাঙালি এবং অবাঙালি পরিবার থাকে। তাদের সবার সঙ্গেই আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের রীতিমতো ভালো সম্পর্ক। সেই সুবাদে তাদের যাওয়া আসাও ছিল আচার অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাড়ি থেকেও ওদের আচার অনুষ্ঠানে যেত সবাই।
এবার আসি আমার হিন্দি অপারগতা সম্পর্কে। বিকালে হয়তো ছাদে ঘোরাঘুরি করছি, পাশের বাড়ির দুটি মেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,"ঘুম রহে হ্যায় ভাবি?আপকো য়ঁহা মন লগ রাহা হ্যায় না?"আমি তখন শুধু একটা কথাই বুঝতে পারছিলাম, ঘুম। ভাবলাম দুপুরে ঘুম হয়েছে কিনা জানতে চাইছে হয়তো।ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম শুধু। ওরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। একবার আমার কর্তার কিছু বন্ধুবান্ধব তাদের বৌদের নিয়ে এসেছিল। মোটামুটি সে যাত্রা ঠিক হ্যায়, নহী হ্যায়,হ্যা নহী এই জাতীয় টুকটাক হিন্দি বলে ভেবেছিলাম হয়তো উৎরে গেলাম সে যাত্রায় । কিন্তু গন্ডগোলটা বাঁধলো ওরা যাবার সময়। আমি একটু বেশি উৎসাহী হয়ে বলতে গেলাম, " টাইম মিলা তো ফির আনা একদিন"।ওই যেমন আমরা বাঙলায় বলি আর কি,"আবার আসবেন একদিন সময় সুযোগ করে।" কিন্তু কি করে জানবো আর , হিন্দিতে অন্যভাবে আসবার কথা বলতে হয়। আমার কর্তার বন্ধুর বৌ ভাবলো তাকে আমি শুধুমাত্র একদিন ই আসতে বলছি আমাদের বাড়িতে, আর তাও যদি সময় হয় তবেই। সে যাত্রায় কর্তার দৌলতে বেঁচে গিয়েছিলাম। কর্তা ওদের বুঝিয়ে বলেছিল, আমার হিন্দি অপারগতা সম্পর্কে।
কর্তার সঙ্গে কোথাও ঘুরতে গেলে ,বা কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে, যদি একজন বাঙালি কেও পেতাম,ভাবতাম বেঁচে গেছি।নইলে বোকার মতো, কিছুই না বুঝে ,কতো আর হ্যাঁ, না বলবো। সবথেকে বেশি সমস্যা হতো তুমি আর আপনি নিয়ে। আমরা তো জানি ছোটদের তুমি আর বড়োদের আপনি বলতে হয়। কিন্তু ওখানে অপরিচিত কাউকে যে 'আপ' বলতে হয়, সেটাই তো জানতাম না।প্রত্যেক সবজির হিন্দিতে আলাদা নাম, কিছু সবজি ছাড়া। অনেক ফলের ও আলাদা নাম। কাজের মেয়েটিকে বাসন মাজতে দিলে কড়া, খুন্তি, চাটু বোঝাতেই অর্ধেক সময় পার। সব মিলিয়ে বেশ দুরবস্থা ছিলো আমার ভাষা নিয়ে। ধীরে ধীরে অবশ্য শিখেছি নিজের আর কর্তা র মিলিত প্রচেষ্টায় হিন্দি।আর এখন আমার মনে হয় বাঙলার মতো হিন্দিটাও বেশ মিষ্টি ভাষা।