ভাইরাসের কড়চা#৭ | বাংলা বনধ
ভাইরাসের কড়চা#৭ | বাংলা বনধ
৩১শে মার্চ ২০২০
আমি যে একটা বেয়াড়া জাতের ভাইরাস সেই পরিচয়টা তো আপনারা এতদিনে জেনেই গেছেন। সেটা আবার যেমন তেমন গোত্রের নয়। করোনা গোত্রীয় আমার দাদারা আগেই পৃথিবী কাঁপিয়েছে। তাদের লোকে চিনতো অন্য অন্য নামে। আমাকে এরা যে নাম দিয়েছে সেটাও আপনাদের জানা। আগে দেখেনি তাই টেকনিক্যাল (কোভিড -১৯) নামটা না ব্যবহার করে অনেক সময়েই নোভেল করোনা ভাইরাস নামেই আমার পরিচয় দিচ্ছে।
লোকে বলে - অন্ধের কিবা দিন, কিবা রাত। চোখে দৃষ্টি নেই বলে দিন বা রাত দুটোই তাদের কাছে সমান। আমাদেরও সেই দশা। দিন হোক বা রাত, আমাদের চোখে ঘুম নেই। সবসময় আমরা কাজে লেগে থাকি। কি দুর্দশা বলুন তো!
আজ সকালে দেখলাম পাড়ার ওই বখাট ঢ্যাঙা ছোঁড়াটাকে। কলেজের পর্ব শেষ করেছে কিন্তু ফাটা কপালে চাকরি এখনো জোটে নি। দু'চারটে টিউশনি করে নিজের হাতখরচা চালায় আর সারা দিন টো-টো কোম্পানি। চান-খাওয়া-ঘুম, বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক এইটুকুই। বাপ-মা অহরহ গালমন্দ করে - অকালকুষ্মান্ড, ধম্মের ষাঁড় আরো কত কি। লিস্টি বানালে অষ্টোত্তর শতনামের কাছাকাছি পৌঁছবে! সেই ছোকরা আজ বেরোচ্ছে সাতসকালে। মুখে মাস্কের বদলে রুমাল বাঁধা, কাঁধে ক্যামেরা। ক্যাননের এন্ট্রি লেভেল ডিএসএলআর, ইওএস ১৩০০ডি। অনেক কষ্টে টিউশনির টাকা জমিয়ে কেনা। ছবি ব্যাটা মন্দ তোলে না, দু'চারটে এদিক সেদিক ছাপাও হয়, পয়সাও কিছু জোটে। অভ্যেসে খামখেয়ালি আর অসম্ভব কুঁড়ে বলে রোজগেরে ফটোগ্রাফার হয়ে উঠলো না। এ কি দেখছি আজ, সূয্যিমামা কোন দিকে উঠেছে! যে ছোঁড়া সকাল দশটার আগে বিছানার মায়া কাটায় না, সেই ঘুমকাতুরে আজ সাতসকালে, মানে সাড়ে পাঁচটায় উঠে পড়েছে। আজ অন্যরকম ছবির চিন্তা তার মাথায়। তাল করেছে ওর বাড়ির কাছেই কলেজ স্ট্রিট এলাকায় ঘুরে এই বাংলা বনধের ছবি তুলবে। যেই বাংলা বনধ কথাটা উল্লেখ করেছি, আপনাদের জয় বাংলা, মানে আমাদের ভাই কনজানকটিভাইটিস ভাইরাস তেড়ে এল আমার দিকে। বললো আমার জন্য লকডাউনের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ডাকা বাংলা বনধের কোনও তুলনাই হয় না। আমার কারণে ঘোষিত বন্ধে আছে ভয়, মরার ভয়, আর ওদেরটায় দলীয় সমর্থন।
আমার কারণে কতো কিছু যে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে তার খবর পাচ্ছেন তো! অন্য সব ছাড়ুন। খেলার জগৎ, যেটা নিয়ে বিশ্বের সব দেশের মানুষ পাগলের মত মাতামাতি করে তার কথাটাই একবার ভাবুন। ফুটবল নিয়ে লাথালাথি বন্ধ, লন টেনিসে সেরা গ্র্যাণ্ড স্লাম সাধের উইম্বলডন হবে না, ব্যাট-বলের ঠোকাটুকি বন্ধ। রাগবি, বেসবল, বাস্কেটবল এসবের কথা তো ছেড়েই দিলাম! খেলার জগতের সবচেয়ে সেরা অনুষ্ঠান টোকিও অলিম্পিক ২০২০, সেটার নাম একই থাকছে, খালি পিছিয়ে যাচ্ছে এক বছর। সামনের জুলাইতে যখন দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ দেখবেন, আমাকে মনে করবেন। করতেই হবে। আপনাদের দাদার কীর্তি বা দিদির কীর্তি ভুলে যাবে লোকে সহজেই, মনে রাখবে আমার কীর্তি, অনেক অনেকদিন।
আজ চাঁদের মিষ্টি আলোটা ভালো লাগছে না? নাকি দেখেননি। দেখলে চাঁদের ক্ষতগুলো আরো পরিষ্কার দেখতেন, দূষণ কমে গেছে দিনের মতন রাতেও। তারাগুলোও অনেক পরিষ্কার, ঝকঝকে। মেঘগুলো সরে সরে যাচ্ছে হালকা ঝোড়ো হাওয়ায়। শোঁ শোঁ শব্দ আপনার কানে যাচ্ছে তো শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া এই রাত্তিরে? রোজ রাতে সরকারী বুলেটিনে আমাকে নিয়ে যে তথ্যগুলো ফুটে উঠছে সেটা ভয়ে ভয়ে দেখছেন তো! শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরছে! গরমে আমি জব্দ হই এই প্রচারের কথা চিন্তা করে এই গরমেও এসি না চালিয়ে দুচোখের পাতা এক করার চেষ্টা করছেন! চালিয়ে যান, ইলেকট্রিক বিলের মাত্রা অনেকটাই কম হবে। সারাদিন ধরে চলতে থাকা টিভিকে একটু রেহাই দিচ্ছেন তো। শ্যুটিং হচ্ছে না, তাই সিরিয়ালগুলোও সব বন্ধ, চ্যানেলগুলো পুরোনো সিরিয়ালের পুরোনো এপিসোড গুলোই চালাচ্ছে বাধ্য হয়ে। দেখা জিনিস আবার দেখতে ভালো লাগছে না, তাই না!
আজকের রাতটা শেষ হতে আরো কয়েক ঘন্টা বাকি। রোজ এই সময়ে এপাড়ায় জড়ানো গলায় চেনা চিৎকার শোনা যায় - এ্যাই শ্-শালা, চিনিস আমাকে? আমার নাম সোমনাথ বোস, শ্-শালা আমি কাউক্কে ভয় পাই না। শালা, আমার পেছনে লাগা ... ভলুকে বলে দিবি আমার সঙ্গে যেন পাঙ্গা নিতে না আসে, এক্কেবারে শ্-শেষ করে দেবো। শ্-শালা চেনেনা তো, আমি সোমুউ --সোমনাথ বোস।
লোকেদের মুখে শুনছিলাম এর কহানী! পাড়ার পুরনো দিনের নামকরা বোস পরিবারের সেজ ছেলে। বয়স পঞ্চাশ, অবিবাহিত। দিনের বেলায় চাকরি একটা করে বটে, তেমন কিছু বলার মতো নয়, নিতান্তই ছোটখাটো। রাত নটা থেকে এগারোটা বাংলা খায় -- ওর ভাষায় বিপিনবাবুর কারণসুধা। আর তারপরই ভোর হওয়ার কিছুটা আগে পর্যন্ত হাতে বোতল ঝুলিয়ে রাস্তায় এমুড়ো থেকে সেমুড়ো মাতলামি করে বেড়ায়! শরীরে যখন ক্লান্তি আসে তখন টলতে টলতে এসে নিজেদের বড় বাড়ীটার বাঁধানো রোয়াকে শরীরটাকে এলিয়ে দেয়। গত কুড়ি বছর ধরে এক রুটিন। কোনো অন্যথা নেই! বেশ কয়েকবার পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে নাইট পেট্রলের গাড়িতে বসিয়ে, কিন্তু পাড়ার মাতব্বরেরা বলে কয়ে ছাড়িয়ে এনেছে। স্যার, হার্মফুল না, পিরীতের কেস…
আজ ওর সেই বাংলা-বনধ কিন্তু আমার জন্যেই... লকডাউনে কোথাও জোটেনি। আমার জন্যেই ও আজ এই মিষ্টি চাঁদের আলোয় তারার বুটি দিয়ে সাজানো নীল আকাশের নীচে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বপ্ন দেখছে ওর সেই ফেলে আসা যৌবনের প্রেমিকার - অরুণিমার -- যাকে হারানোর শোক ভুলতেই ওর 'বিপিনবাবুর কারণসুধা'!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়