শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Crime Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Crime Others

বেওয়ারিশ

বেওয়ারিশ

3 mins
182



চারিদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট্ট উঠোন, তার ঠিক একপাশে একটা ছোট্ট মাটির ঘর খড়ের ছাউনি দেওয়া, আর তার সাথে একফালি বারান্দা। উঠোনের দুইধারে ফুলগাছ লাগানো। সকাল থেকেই সেই উঠোন, ঘর আর বারান্দা ঝাঁট দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করতে ব‍্যস্ত ফুলটুসি। বারবার ভালো করে দেখে নিচ্ছে কোথাও যেন একটুও অপরিষ্কার না.... থাকে। ঘরে ঢুকে চৌকির ওপর পাতা বিছানাটা টান টান করে রেখে দরজা এবং জানলায় পুরনো কাপড় দিয়ে তৈরী পর্দাটা এক ধারে সুন্দর করে রেখে দেয়। তারপর মেয়ের হাত ধরে গঙ্গার ঘাটের দিকে পা বাড়ায়।

চান সেরে ভিজে কাপড়ে গায়ে গামছা জড়িয়ে যখন বাড়ি ফেরে, তখন ফুলটুসির বর নিতাই বারান্দায় বসে বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিচ্ছে। ফুলটুসি তাড়াতাড়ি করে মেয়ের গা... মুছিয়ে ভিজে জামা ছাড়িয়ে দেয়, নিজেও গায়ে একটা শুকনো কাপড় জড়িয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরের কুলুঙ্গিতে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা ঠাকুরের পায়ে ফুল বেলপাতা দিয়ে পূজো করে, ভক্তিভরে প্রনাম করে। তারপর ধূনো জ্বালিয়ে ঘরের এক কোনে রেখে দেয়। আর ঘর থেকে একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে আসতে থাকে।

বারান্দায় একটা চটের বস্তা বিছিয়ে মেয়ে মণিকে বসিয়ে দেয় স্লেট পেনসিল দিয়ে। মনি পেনসিল দিয়ে অ আ লিখতে থাকে, আর জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে ''অ.... এ অজগর আসছে তেরে, আ....... এ আমটি খাব পেড়ে।" বারান্দার এক কোনে মাটির উনুনে আগুন ধরায় ফুলটুসি। চা করে স্বামীর হাতে তুলে দেয়। আর জ্বলন্ত উনুনে ভাতের হাড়ি বসিয়ে দেয় তার সাথে আলু, পটল, কচুও দিয়ে দেয়।

নিতাই চা... খেয়ে গামছা কোমড়ে বেঁধে গায়ে ভালো করে তেল মেখে গঙ্গায় ডুব দিতে যায়। এসেই ভাত খেয়ে বেড়বে শহরের উদ্দেশ্য। শহরে রাজমিস্ত্রির যোগারির কাজ পেয়েছে। অনেকগুলো টাকাও আসবে ঘরে কিন্তু এখন মাস দুয়েক ঘরে ফিরতে পারবেনা। তবে এইভাবেই চলে নিতাই এর জীবন, আজ এক শহর তো.... কাল অন‍্য শহর। ভাত ফুটে গিয়ে খুব সুন্দর গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে । ফুলটুসি একমনে উনুনে ফুঁ.... দিচ্ছে যাতে নিভে যাওয়া আগুনটা আবার জ্বলে ওঠে।

---------মণি বলে ওঠে মা.... খিদে পেয়েছে...,

--------ফুলটুসি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে এইতো মা..... হয়ে এসেছে,আর একটুখানি হলেই দিয়ে দেব।

------------মায়ের কথায় মণি মথা নেড়ে বোঝায় আচ্ছা।তারপর আবার পড়তে শুরু করে.... "ই.... এ ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে, ঈ..... এ ঈগল পাখি পাছে ধরে"।

----------নিতাই গামছা করে কিছু ছোট মাছ নিয়ে এসে ফুলটুসির হাতে দিয়ে বলে, ঝোল করে ফেল বৌ, ভালো করে ঘরের খাবার খেয়ে বেড়োব আজ, আবার কবে আসব তার তো ঠিক নেই! আমি মাসে মাসে ঠিক টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার ব‍্যাবস্থা করব, তুই মেয়েকে নিয়ে সাবধানে থাকবি।

----------ফুলটুসি জলভরা চোখে বলে ওঠে, তুমি সাবধানে থাকবে নতুন জায়গায়, ভালো করে খাওয়া দাওয়া করবে, আমরা সাবধানেই থাকব। আর ছুটি পেলেই চলে আসবে।

----------নিতাই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তোর জন‍্য কি আনব রে.... শহর থেকে?

---------মণি বলে লাল কাঁচের চুড়ি...।

মেয়ের কথায় ফুলটুসি আর নিতাই একসাথে হেসে ওঠে।

ফুলটুসি মাছ কটা বেছে ধুয়ে সেদ্ধ আলু, কচু, পটল দিয়ে ছোট মাছের ঝোল করে ফেলে। মাছের ঝোলের গন্ধে মণির খিদে যেন.... আরও বেড়ে যায়।

বারান্দায় চট বিছিয়ে স্বামী আর মেয়েকে ভাত বেড়ে দেয় পরম যত্নে, আর নিজে পিড়িতে বসে পাখার হাওয়া দিতে থাকে। তৃপ্তি করে ভাত খেয়ে নিতাই ব‍্যাগ নিয়ে মেয়েকে আদর করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে, আর ফুলটুসি মেয়েকে কোলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুগ্গা.... দুগ্গা..... বলে ওঠে, নিজের চোখের জলটা লুকিয়ে।

************************************

সময়ের স্রোতে দুমাসের জায়গায় দু... বছর পার হয়ে যায়, তবুও নিতাই বাড়ি ফেরেনা! ফুলটুসি একদিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শহরে গিয়ে ছিল খোঁজ নিতে, কিন্তু নিতাই এর কোনো খোঁজ পায়নি ফুলটুসি, থানায় জানিয়েও কোন লাভ হয়নি! ফুলটুসির উনুনে এখন ভাতের হাড়ি একবেলা চড়ে তবুও খুব কষ্টে। মেয়েটা স্কুলে যায় ,তাই পেটভরে একবেলা খাবারটা পায়। ফুলটুসি রেল লাইনের ধারে হোটেলে বাসন ধোয়ার কাজ নিয়েছে। 

হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় থানা থেকে কজন এসে খবর দেয়, পুরনো বাড়ি ভাঙ্গতে গিয়ে চাপা পড়ে মাড়া গেছিল নাকি একজন শ্রমিক। কেউ চিনতে পারিনি তাই বেওয়ারিশ লাশ ভেবে দাহ করে দিয়েছে সরকার থেকে। ঐ লোকটা হয়তো নিতাই হবে! ফুলটুসির সেদিন সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল, মানুষটার ফেরার যেটুকু আশা নিয়ে ফুলটুসি বেঁচে ছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গেছিল সেইদিন। তবুও মনকে শক্ত রেখেছিল এইভেবে যদি নিতাই বেঁচে থাকে তাহলে ঠিক ফিরবে সেই আশায়। নিতাই এর মত কতজনের জীবন এইভাবে এগিয়ে চলে আবার হঠাৎ করেই মাঝপথে থেমে যায়। কেউ কোনো খোঁজ রাখেনা এদের, বেওয়ারিশ হয়ে থেকে যায় সমাজের কাছে।






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy