অপয়া
অপয়া


আজ মিতার ছেলের মামাবাড়ীর ভাত। বিশাল আয়োজন হয়েছে। মামাবাড়ী ভাত নামেই,মামা কোথায়? ভাত খাওয়াবেন দাদু। দত্তবাড়ীটা আজ ভীষণভাবে সাজগোজ করেছে,অথচ ৪বছর আগে এই বাড়ীটাকে শোক গ্রাস করে ফেলেছিল পুরোপুরিভাবে। দত্তবাড়ীর একমাত্র ছেলে অয়নের সঙ্গে মিতার বিয়ে হয়,৪বছরের ভালবাসাবাসির পরিণতি। বিদেশে হানিমুন সেরে নতুন বউকে বাবা-মায়ের জিম্মায় রেখে অয়ন অফিস জয়েন করতে চলে যায় মুম্বাই। এতদিন মেসে থাকত,এবার বাড়ীর ব্যবস্থা করে মিতাকে নিয়ে যাবে অয়ন,সাথে বাবা-মা, ছেলে বউয়ের নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে মাসখানেক থেকে তাঁরা কলকাতা ফিরে আসবেন।
নতুন বিয়ের পর দু'জনই অস্থির দু'জনকে কাছে পাবার জন্য। পেরিয়ে গেল দু'টো মাস। অয়ন সবার টিকিট কেটে বাড়ী আসছে। বাড়ীতে সাজো সাজো রব। ছেলের সংসার সাজাবার জন্য বাবা-মায়ের সে কি উৎসাহ,কি কি নিয়ে যাবেন তাই নিয়ে দু'জনেই খুব উত্তেজিত। মিতার বেশ লাগে। ক'দিন ধরে বুড়োবুড়ীর মজা দেখছে সে,যেন ওদের দু'জনকে নিয়ে পুতুলখেলার আনন্দ উপভোগ করছেন তাঁরা। ক্রমে অয়নের আসার দিন উপস্থিত। কাল অয়ন বাড়ী আসবে, মিতা ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফুটছে,মন ব্যাকুল ওকে দেখার জন্য,একটু ছোঁবার জন্য,একটু উষ্ণতার জন্য । সকলের অপেক্ষার শেষ করে অবশেষে এল অয়ন,তবে জীবিত নয় মৃত।
অয়নের প্লেনক্র্যাশ হয়েছিল,একজন যাত্রীও জীবিত ছিল না। বাবা-মা শোকে পাগল, মিতা পাথর। ওই শোকের বাড়িতে মিতা টিঁকতে পারছিল না। যন্ত্রের মত সমস্ত নিয়ম-কানুন পালন করে গিয়ে উঠল বাপের বাড়ী,যদিও বাবা নেই,দাদা-বৌদি আর মা। মিতার এমন অবস্থা হওয়ায় এবাড়ীতেও কম তোলপাড় হয়নি তবে তা শোকে নয় আশঙ্কায়। সারাজীবন মিতা দাদার গলগ্রহ হয়ে থাকবে সেই চিন্তায়। দাদা বিরক্ত, বৌদি আসার সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিল আর মা তাকে অভ্যর্থনা জানালেন 'অপয়া' বলে। মিতা শুনল,কলের পুতুলের মত ঢুকল ভিতরে,শুরু হল তার অবহেলিত জীবন। কেউ ভাল করে কথা কয় না,মিতার বাঁচতে ইচ্ছে হয় না। কিছুদিন বাদে অয়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুমন তার স্ত্রীকে নিয়ে মিতার সাথে দেখা করতে আসে। তাদের সামনেই মিতার মা আবার তাকে 'অপয়া' বলেন। বস্তুত,এই নতুন নামটা রোজই বেশ কয়েকবার শুনতে হয় তাকে। বাড়ীর পরিবেশ দেখে সুমন বেশ বুঝতে পারে,মিতা সেখানে মোটেই ভাল নেই। হাসিখুশি উচ্ছ্বল মিতার এমন অবস্থা দেখে ওদের খুব খারাপ লাগে।
বর্তমানে সুমন ও তার স্ত্রী অয়নের বাবা-মায়ের খেয়াল রাখে,প্রায়ই সেখানে যায়, যদিও তাতে শূন্যস্থান পূরণ হয় না। এরপর সুমন একদিন গিয়ে অয়নের বাবা-মাকে মিতার অবস্থার কথা বলে। অয়নের মা পুত্রশোক ভুলে মিতাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বলেন। সুমনের কাছে শুনে মিতাকে তাঁর মা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন অয়নদের বাড়ী। এসে যথারীতি তিনি বলেন তাঁর 'অপয়া' মেয়ের জন্যই তাঁদের ছেলের মৃত্যু হয়েছে। মিতার শাশুড়ী হৈহৈ করে আপত্তি তুলেছেন,"ছি ছি দিদি,আমার ছেলে যেটুকু পরমায়ু নিয়ে এসেছিল তা তার পূর্ণ হয়েছে তাই তাকে যেতে হয়েছে,এতে মিতের দোষটা কোথায়?"এরপর তিনি মিতাকে আর ফিরতে দেননি মায়ের সঙ্গে। মিতা ভাবে কোনটা তার আসল মা-তার গর্ভধারিণী মা,না তার শাশুড়ী মা। শাশুড়ীও তাকে আঁকড়ে ছেলের শোক ভোলেন। শাশুড়ীমাই দিনে দিনে তার নিজের মা হয়ে উঠলেন। এবাড়ীতে মিতার যেন পুনর্জন্ম হল।
এরপর তাঁরা উপযুক্ত পাত্র দেখে মিতার আবার বিয়ে দেন খুব ধুমধাম করে,যেন মেয়ের বিয়ে তাঁদের। মেয়েরা যেমন বিয়ের পর স্বামীর ঘর থেকে বাপের বাড়ী আসে,মিতা আসে তার প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ীতে,স্বামীর সঙ্গে তার ছুটিছাটাতে। এটাই যে এখন তার বাপেরবাড়ী,আর আজ মিতার ছেলের এবাড়ীতেই মামাভাত খাওয়া।