Debdutta Banerjee

Tragedy

3  

Debdutta Banerjee

Tragedy

অন্য এক মা এর গল্প

অন্য এক মা এর গল্প

5 mins
2.1K



মাতৃ-দিবস উপলক্ষে সেদিন জিয়াদের বাড়ি দারুণ খাওয়া দাওয়া আড্ডা আর মজা হয়েছিল। আকাশ নতুন জামাই হিসাবে একটু বেশিই খাতির যত্ন পেয়েছিল। জিয়ারা তিন ভাই বোন মিলে মায়ের জন্য দারুণ সারপ্রাইজ পার্টি দিয়েছিল। বড় বৌদি তন্নি, যে কিনা শাশুড়িকে পছন্দই করে না, আলাদা থাকে বড়দার সাথে, সেও কাল পোজ দিয়ে শাশুড়ি মা এর গলা জড়িয়ে ফটো তুলে স্ট্যাটাস আপ ডেট দিয়েছিল।মা শোভা দেবীকে অঞ্জলির একটা মুক্তার সেট উপহারও দিয়েছিল জয় আর তার বৌ তন্নি। 

জিয়ার দিদি হিয়া যে কিনা কলকাতায় থেকেও সেভাবে মা এর একটা খোঁজও নেয় না সেও কাল কি করবে বুঝে পাচ্ছিল না। একটা বাংলাদেশের ঢাকাই এনেছিল মা এর জন্য।আর বড় জামাই মিলন কে তো ছেলেই মনে হচ্ছিল। মা কে নিয়ে যা করছিল .......।


আকাশ সবে মাত্র পাঁচ মাসের পুরানো জামাই।তাছাড়া ও একটু চুপচাপ, তাই আলগা হয়েই ছিল। জিয়া একটা ব‍্যাঙ্গালোর সিল্ক নিয়ে গেছিল মায়ের জন্য। জিয়ার টানাটানিতে কয়েকটা ফটো তুলতে হয়েছিল সবার সঙ্গে। প্রায় রাত দুটোয় সবাই বেরিয়েছিল ওখান থেকে। আকাশ একবার জিয়াকে রাতটা ওখানেই থাকার কথা বলেছিল কিন্তু জিয়া বলেছিল এই গরমে এসি ছাড়া ঘুম হবে না ঐ পুরানো বাড়িতে। পাঁচ মাসেই ওর অভ্যাস বদলে গেছিল যে। বড় মেয়ে হিয়া থাকে বেহালা, ছেলে নিউটাউন আর জিয়ারা সল্টলেক। জিয়ার বিয়ের পর থেকে শ্যামবাজারের বাড়িতে ওদের  মা শোভা দেবী একাই থাকেন। উনি সবাইকেই থাকতে বলেছিলেন।


বাড়ি ফিরে আকাশ জিয়াকে বলেছিল মা কে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে যে ওরা পৌঁছে গেছে।কিন্তু জিয়া তো তখন ফেসবুকে ব্যস্ত আপডেট দিতে । আকাশও শুয়ে পড়েছিল ।


সকালে ফোনটা করেছিল মায়ের কাজের লোক বন্দনা-মাসি। সাতটা নাগাদ কাজে এসে বার বার বেল দিয়েও যখন মা দরজা খোলেনি ।ও বাধ্য হয়ে ফোন করেছিল জিয়াকে। আটটার সময় জিয়ারা পৌঁছে গেছিল। অনেক কষ্টে দরজা ভেঙ্গে ওরা মা বিভা দেবীর অচৈতন্য দেহটা পায় বাথরুমের কাছে। তক্ষুনি বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ওঁঁকে ভর্তি করে আকাশ। খবর পেয়ে হিয়া আর ওদের বড়দা জয় চলে এসেছিল। স্ট্রোক, একটা সাইড প‍্যারালাইসিস, জ্ঞান ফিরেছিল পরদিন বিকেলে। কিন্তু মেমোরি লস.... বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে গেছিলেন উনি। বারবার নিজের স্বামীকে খুঁজছিলেন। আকাশ আর জয়ের বৌ তন্নি কে চিনতে পারছিলেন না। ডাক্তার বলেছিলেন সময় লাগবে। বেশি চাপ দিলে আবার একটা অঘটন ঘটতে পারে‌।


বাইরে এসে জয় একটু বিরক্ত হয়েই জিয়াকে বলেছিল এতো বড় হসপিটালে মা কে আনার কি দরকার ছিল !! বাড়ির সামনেই যেখানে আর জি কর ছিল।

হিয়াও ওকে সমর্থন করেছিল। জিয়া বলেছিল মা এর তো মেডিক্লেম ছিল। কিন্তু জয় বলতে চাইছিল মেডিক্লেম তো পুরো খরচা দেয় না। আর এসব হাসপাতাল বিল করে প্রচুর। ছুটিও দিতে চায় না। আকাশ একটু অবাক হয়ে ভাবছিল এই ছেলে মেয়েরাই কাল দামি রেস্তোরার খাবার আনিয়ে মায়ের নামে পার্টি করেছিল!! থাকতে না পেরে জয় কে জিজ্ঞেস করেছিল তাদের অফিস মায়ের খরচা দেবে না? ও সেটাই ভেবেছিল , কারণ জয় যথেষ্ট ভাল চাকরি করে। 

জয় আর তন্নি একটু মুখ চাওয়া চাওয়ি করে যা বলেছিল যে জয়ের অফিস তিনলক্ষ টাকার কভারেজ দেয় বছরে। সেটা জয় নিজের বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি বৌ বাচ্চা সবার জন্য নিতে পারে। দু মাস আগেই জয়ের শ্বশুরের বাই পাস করাতেই আড়াই লাখ বেরিয়ে গেছিল। একই বছর যে মা ও অসুস্থ হবে ওরা ভাবেনি একবারও!


হিয়ারা নতুন একটা থ্রি বেডরুমের ফ্ল্যাট নিয়েছে, গাড়িও বদলেছে তিনমাস আগেই তাই ওদেরও হাত খালি। বড় জামাই তো খবর পেয়েও আসেনি দেখতে। ফোনেই সব শুনে নিয়েছিল।

আকাশের খুব খারাপ লাগছিল এই সব আলোচনা। ওর মা মারা গেছিল ও যখন তিন বছর,আয়ার কাছেই মানুষ হয়েছিল। বিয়ের পর শাশুড়ির আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল। হঠাৎ করে কি যে হলো?শ্বশুর মশাই নেই দশ বছর। হিয়ার বিয়ের আগেই মারা গেছিলেন। শাশুড়ি একা হাতে এক ছেলে দু মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কারো বোঝা হতে চাননি কখনো । অথচ এখন ছুটির পর ওনার দায়িত্ব কে নেবে তাই নিয়েও জোর আলোচনা চলছিল। প‍্যারালাইসিস ঠিক হতে সময় লাগবে, ততদিন ওনাকে কে দেখবে এই ছিল আলোচ্য বিষয়!


পায়ে পায়ে আকাশ সরে আসে ওখান থেকে,ঐ আলোচনা ভাল লাগছিল না। হাসপাতালের ভিতরেই একটা মন্দির করেছে কর্তৃপক্ষ, আকাশের মনে হয় ভগবানের নামেও ব‍্যবসা! কয়েকজন সেই মন্দিরে বসে ছিল। একজন মহিলা খুব কাঁদছিল, দুজন সান্ত্বনা দিচ্ছিল ওনাকে। ওদের কথা যেটুকু কানে আসছিল বোঝা যাচ্ছিল মহিলার ছেলে আইসিইউতে লড়ছে জীবন মৃত্যুর সাথে, ওরা ঘর বাড়ি সব বিক্রি করে দিয়েছে ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে। শেষ সম্বল নিজের মঙ্গল সূত্রটাও খুলে দিতে চাইছে স্বামীকে, যদি ছেলেটা বাঁচে।


মনটা ভার হয়ে গেছিল কেমন। নিজের মাকে আকাশের মনেই পড়ে না। তাকে বড় করেছিল মনি। মনি ছিল তাদের ড্রাইভারের বউ। বাবা নিজের ব‍্যবসার কাজে এতোটাই ব্যস্ত থাকত ছোট্ট আকাশের জন্য সময় থাকত না। ঠাম্মা আর মনি মিলেই তাকে দেখে রাখতো। বেশ কিছুটা বড় হয়ে আকাশ বুঝেছিল মনি তার মা নয়। যখন আকাশ স্কুল শেষে বাইরে পড়তে চলে গেছিল মনিও কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। আসলে ড্রাইভার কাকু আগেই মারা গেছিল। ওদের ছেলেকে আকাশের বাবাই এক বন্ধুর প্রমোটারীর ব‍্যবসায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ততদিনে ঠাম্মাও চলে গেছিল সব মায়া কাটিয়ে। তাই আকাশ পড়তে চলে যাওয়ার পর মনি নিজেই ছেলের কাছে চলে গেছিল। আকাশ প্রথম এক দু বার এসে খোঁজ নিয়েছিল, তারপর আর যোগাযোগ নেই। বিয়ের সময় মনি আসেনি।আকাশ বৌ নিয়ে আর গিয়ে উঠতে পারেনি, আসলে জিয়া যেতেও চায়নি ওর আয়ার বাড়ি।


আকাশের মনে পড়ছিল ছোটবেলায় সে অসুস্থ হলে মনি রাতের পর রাত জেগে ওর সেবা করতো। মনি ভাত মেখে খাইয়ে না দিলে আকাশের খাওয়া হতো না। বিকেলে পার্কে নিয়ে যতো মনি। স্কুলের জন্য রেডি করা, নতুন নতুন টিফিন বানিয়ে দেওয়া সবেতেই মনি। একবার ওর টাইফয়েড হয়েছিল, মনি কতো জায়গায় মানত করে পূজা দিয়েছিল ওর নামে। যখন আকাশ রাত জেগে পড়তো মনিও মেঝেতে বসে রাত জাগত ওর সাথে। ও না ঘুমলে শুতে যেতো না। অথচ ধীরে ধীরে সেই মনিকে ও কি করে ভুলে গেছিল !! মনি একদিনের জন্য অসুস্থ হয়নি কখনো, নিজের ছেলেকেও এতো যত্ন করতো না সে যেভাবে আকাশের জন্য করতো। অথচ আকাশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেই মনিকেই ভুলে গেছিল!! আকাশের মনে হয় জিয়া হিয়া আর জয়ের সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই।


অবশেষে সবার সব অস্বস্তি কাটিয়ে তিনদিনের দিন বিকেলে শাশুড়ি মা চলে গেলেন। জয় নিশ্চিন্ত হয়েছিল যে এই অবস্থায় মাকে নিয়ে গিয়ে তাকে রাখতে হবে না। তিনদিনে বিলও খুব বেশি হয়নি। মেডিক্লেম কোম্পানির বাইরেরটুকু সামলে নেওয়া যাবে। সব কাজ শেষ করতে করতে ভোর হয়ে গেছিল। অনেক আলোচনা করে তিন ভাই বোন আজ একসাথে শ্যাম বাজারের বাড়ি চলে গেলো। এখন এই কয়েকদিন ওরা ওখানেই নাকি থাকবে। আকাশ একবার জিয়াকে মনে করাতে গেছিল এসির কথা। উত্তরে জিয়া জানিয়েছিল মা এর গহনাগুলো যতক্ষণ ভাগ না হচ্ছে সে কোথাও যাবে না। আর বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা সবের ব্যবস্থা করেই ওরা বাড়ি ফিরবে।


আকাশ আর থাকতে পারেনি।কেমন যেন নিজেকে বেমানান মনে হচ্ছিল ওদের মাঝে।শাশুড়ি মা বিহীন ঐ বাড়িতে যাওয়ার আর কোনো ইচ্ছাই ছিল না ওর।


গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, তারপর জিপিএসে লোকেশনটা সেট করে গাড়িটা চালিয়ে দিয়েছিল বারাসতের দিকে। আর দেরি করা বোধহয় ঠিক হবে না। মনিকে নিয়ে আসতেই হবে। এতদিনের ভুলের জন্য মনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে আকাশকে। সে যে আকাশের মা। মায়েরা সর্বদা সন্তানকে ক্ষমা করে।


সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy