অনন্য মাতৃত্ব
অনন্য মাতৃত্ব


স্কুল থেকে ফিরে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল রমা। ছোট ভাইয়ের বউ একবার জিজ্ঞেস করলো ও কিছু খাবে কিনা। রমা ঘাড় নেড়ে না বলল।আসলে মধ্য চল্লিশের রমার এখন আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করে না। যে যা জিজ্ঞেস করে সেই টুকুর উত্তর দেয়।নিজে যেচে কাউকে কোনো কথা বলেও না। আর নিজেও জানতে চায় না কারুর থেকে কিছু। আজ ওর মনটা একদম ভালো লাগছে না। স্কুল থেকে ফেরার পথে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল স্কুল লাইফের দুই বান্ধবী তাপসী আর শ্রাবণী র সঙ্গে। দুজনেই বিয়ে থা করে ঘোরতর সংসারী। এই বয়সে যেরকম হয় আর কি। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ওদের। রাস্তায় রমা ওদের দেখতে পায়নি। ওরাই দেখতে পেয়েছে রমাকে। তারপর ইচ্ছা প্রকাশ করলো এক কাপ করে কফি ও খাবে আর একটু গল্প ও করবে সবাই। এতদিন পর দেখা হলো সবার। সত্যি কথা বলতে, রমা র খুব একটা ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু ওরা এমন জোরাজুরি করলো যে ,আর না করতে পারলো না ও। অগত্যা সবাই গিয়ে একটা কফি শপে বসলো। তাপসী বরাবরই একটু চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। অনেকটাই রমা র মতো। কিন্তু শ্রাবণী একটু বেশি কথা আগেও বলতো আর এখনো ওর সেই স্বভাবটাই আছে। না জেনে বুঝেই রমাকে বলে ফেললো,"আর বল্, তোর কি খবর। দিব্যি ঝাড়া হাত পা তো তোর। বর নেই, বাচ্ছার ঝামেলা নেই, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি নেই। তুই তো ভালোই থাকবি। সংসার ধর্ম করতে হলে বুঝতে পারতিস কতো ধানে কতো চাল।" আচ্ছা রমা তো একবার ও ওকে ওর সংসারের ব্যাপারে কোনো কথা জানতে চায়নি। তাহলে শ্রাবণীর কি দরকার ওর জীবনের এই অসম্পূর্ণ স্থানটাতে আঘাত করার।
রমা যখন স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিল ,তার আগে থেকেই ওর বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখতে শুরু করেছিলো ওর বাবা মা। তারপর চাকরি হলো। হঠাৎই একদিন স্কুল ক্যাম্পাসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।সবাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার ভালো বুঝলো না ব্যাপারটা। একজন ভালো গাইনোকলজিস্ট এর সঙ্গে কনসাল্ট করতে বললো। আর তারপর অনেক রকমের টেস্ট, আর শেষ পর্যন্ত একজন নারীর মাতৃত্ব পরিপূর্ণ হবার সমস্ত অঙ্গ ই কেটে বাদ দিতে হলো ওর শরীর থেকে।এক অসম্পূর্ণ নারী হয়ে আজ ও বেঁচে আছে। অসুবিধা ওর ছিলো শুরু থেকেই। কিন্তু সেটা যে এতো ভয়ানক রূপ নিয়েছিল, তা ও বুঝতে পারেনি। ইউট্রাসে টিউমার টা ম্যালিগনান্ট ছিল। আর তাই পুরো ইউট্রাস টাই বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ডাক্তাররা।আর কোনো উপায় ছিল না। ফলস্বরূপ রমা আজ অসম্পূর্ণ এক নারী। যাকে কথায় কথায় সমাজের কাছে কথা শুনতে হয়। না জেনেই অনেকে মন্তব্য করে বসে। এই যেমন আজ শ্রাবণী করলো। ও বিয়ে করেনি, ওর বাচ্চা নেই, এই অপূর্ণতা তো ওর সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। আজকাল আর অত কষ্ট হয়না এইসব শুনে। আসলে অভ্যেস হয়ে গেছে। তাও কখনো কখনো তো খারাপ লাগেই । এই যেমন আজই তো ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো শ্রাবণী র এই ধরণের মন্তব্যে।
বাবা, মা আর দুই ছোট ভাই এই নিয়েই রমা ছিল। তারপর তো বাবা মারা গেলেন। দুই ভাইকে লেখাপড়া শেখানো, তারপর তাদের চাকরি, বিয়ে সবই রমার হাত ধরেই হলো। ভাইয়ের বউ রাও যতটুকু করে যথেষ্ট ওর জন্য। আজকাল এতটুকু ই কজন পায়। অবিবাহিতা ননদের ঝক্কি আজকাল কোন ভাইয়ের বউরা নিতে চায়। দুবেলা রান্না করে খেতে দিচ্ছে ওকে এটাই তো অনেক।আর কি চাই। মা আর ও একটা ঘরেই থাকে। তবু তো দিনের শেষে মায়ের সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা একটু শেয়ার করতে পারে। আসলে এই পৃথিবীতে মায়ের থেকে আপন বোধহয় আর কেউ হয় না। রমার যেদিন মন খারাপ থাকে , ওর মা ঠিক বুঝতে পারে। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওকে,"দুঃখ করিস না মা। লোকের কথায় কান দিতে নেই।" রমা শুধু ভাবে মা চলে গেলে ওর কি হবে। কে ওকে বোঝাবে এমন করে।
রমা শুয়ে শুয়ে ভাবে পুরানো দিনের কথা। ওর অপারেশনের এক দু বছর পরের কথা। স্কুলের ট্রেনিংয়ের সময় আলাপ হয়েছিল বিমানের সঙ্গে। ওর থেকে এক দু বছরের বড়ো হবে। পরিচয় ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে পৌঁছায়।রমার চোখ ও নতুন করে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওর সেই স্বপ্নসৌধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।যখন বিমানও সব জানতে পেরে একজন অসম্পূর্ণ নারী এই কথাটা বলে অপমান করে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। না কোনো অনুনয় বিনয় করেনি ও। সত্যিই তো ওর মতো মেয়েকে কেউ কেনই বা বিয়ে করে নিজের জীবন ধ্বংস করবে। বিমান তো ঠিকই বলেছে। এটাই তো সত্যি। আজ জীবনের এই জায়গায় পৌঁছে তাই ওর সত্যি ই কারুর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কি হবে অপরকে দোষারোপ করে। ওর নিজের এই অসম্পূর্ণতা ও কেনই বা অন্যের উপর চাপাতে যাবে।
কিন্তু তাও। আসলে রক্তমাংসের মানুষ তো। মনের ভেতরেও তো একটা ইচ্ছা থাকেই।সব মেয়েই সংসার চায়, স্বামী চায়, সন্তান চায়।রমার তো কোনোটাই পূরণ হলো না। ছোটবেলায় মা কখনো কখনো বলতো , যখন মা হবি ,তখন বুঝতে পারবি সন্তান স্নেহ কি হয়। সেটা আর রমার এ জন্মে বোধহয় জানা হলো না। একটা কষ্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে।কাকে প্রকাশ করবে ও এই কষ্ট। কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে ,আত্মীয়রা চাপা গলায় বলাবলি করে ওকে নিয়ে। কেউ কেউ সামনে এসে সহানুভূতি প্রকাশ করে। কিন্তু সত্যিই কি এসব ওর প্রাপ্য ছিল। সবার কাছে সহানুভূতির পাত্রী হয়ে বাঁচা কি কম কষ্টের। সেকারণে ই তো এখন আর কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতেও যায় না ও। সেদিন বড়ো মাসি এসে বলে গেল, ওর নাতির মামা ভাতের অনুষ্ঠানে যাবার জন্য। রমা একপ্রকার না ই বলে দিয়েছিল। কিন্তু মাসি কিছুতেই শুনলো না। রমাকে অনেক করে যেতে বলে গেল।রমার স্কুল থেকে বেশি দূর ও নয় বড়ো মাসির বাড়িটা।নির্দিষ্ট দিনে সবাই মিলে যাওয়াও হলো ওখানে। রমা ওর এক অফিস কলিগের সঙ্গে গল্প করছিল। হঠাৎই একটি ফুটফুটে চার পাঁচ বছরের মেয়ে এসে ওর শাড়ির আঁচলের পিছনে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছিল। রমা ও কোনো কথা না বলে উপভোগ করছিলো ব্যাপারটা। মেয়েটা যখন বারবার ওর আঁচলটা টেনে টেনে ধরছিল।রমার সারা শরীরে এক অপত্য স্নেহের অনুভূতি হচ্ছিল।যে অনুভূতি ঠিক বোঝানো যায় না। হয়তো মাতৃত্বের অনুভূতি এটা, যে অনুভূতি থেকে ও বঞ্চিত ছিলো এতদিন।
মেয়েটিকে বারবার মিষ্টু মিষ্টু করে ডাকছিলো কেউ। সম্ভবত ওর বাবা। ওকে খুঁজতে খুঁজতে রমার একেবারে সামনে যে এসে পড়েছিল, তাকে এত বছর পর হলেও রমার চিনতে কোনো অসুবিধা ই হয়নি।এ তো বিমান।ও আচ্ছা এই বাচ্চাটা তাহলে বিমানেরই সন্তান। আচমকা রমাকে দেখে বিমান ও একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। অপ্রস্তুত এই কারণেই হয়েছিল হয়তো, কারণ রমার সঙ্গে ওর শেষ সাক্ষাতের স্মৃতি টা খুব একটা মধুর ছিল না।আর অপমান টা ওই করেছিলো রমাকে। প্রত্যাখ্যান ও ওই করেছিলো।রমার এতে কোনো দোষ ছিল না। বিমান মিষ্টুকে বারবার রমার শাড়ির আঁচল থেকে বেরিয়ে আসতে বলছিল। কিন্তু মিষ্টু ততই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখছিল রমাকে।আর বারবার একটাই কথা বলছিলো যে সে কিছুতেই খাবার খাবে না।তার মাকে যতক্ষণ না তার কাছে এনে দেওয়া হচ্ছে। শেষে রমা আর চুপ করে না থাকতে পেরে বিমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,এতো করে যখন মেয়েটা ওর মাকে এনে দিতে বলছে, সেটা করলেই তো হয়। তাহলে তো আর এতো ঝামেলা হয়না। বিমান কোনো কথা বললো না।তখন রমার মাসির মেয়ে ইতি এসে বিমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,"দাদা আপনি যান, আমি নিয়ে যাচ্ছি মিষ্টুকে।"
বিমান চলে যেতে ইতি বললো ,"আমার ভাসুর, আর এ হলো আমার ভাসুরের মেয়ে মিষ্টু। ওর জন্মের সময়ই ওর মা মারা গেছে।অনেক কমপ্লিকেশন ছিলো দিদি ভাইয়ের। ডাক্তার অনেক বারণ করেছিলো দিদিকে। কিন্তু ও শোনেনি ।শেষ পর্যন্ত বাচ্চা টা তো এই পৃথিবীর আলো দেখেছে। কিন্তু নিজে চিরবিদায় নিয়েছে এই পৃথিবী থেকে।যখন থেকে মিষ্টুর একটু জ্ঞান হয়েছে, ওর শুধু একটাই কথা ওর মাকে এনে দিতে হবে ওর কাছে।" ইতি জোর করে মিষ্টুকে রমার আঁচল থেকে বের করে আনলো। খুব কাঁদছিল মেয়েটা। রমার ও বুকের ভেতর কেন জানেনা একটা অসম্ভব কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল। মিষ্টু রমার আঁচলের তলা থেকে তো বেরোলো কিন্তু ওর হাতের আঙ্গুলের সঙ্গে নিজের কচি কচি আঙ্গুলগুলো দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখলো। ইতি কিছুতেই ওকে নিয়ে যেতে পারছিল না রমার কাছ থেকে। শেষে রমা ই বললো ইতিকে,"তুই চল, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি"। তারপর মিষ্টুর দিকে তাকিয়ে বললো,"কি মিষ্টু, এই আন্টিটার সঙ্গে যাবে তো?" মিষ্টু একগাল হেসে বলল ,"হ্যাঁ যাবো। আর খাবো ও তোমার সঙ্গে ই"। রমা কেন জানেনা না করতে পারলো না এই অবোধ শিশুটাকে।ও সঙ্গে করে মিষ্টুকে নিয়ে গেল। তারপর নিজের হাতে মিষ্টুকে যখন ও খাইয়ে দিচ্ছিলো,সেই মুহূর্তে ওর মধ্যে যে আশ্চর্য সুখানুভূতি হচ্ছিলো তা ও কাউকে বলে ঠিক বোঝাতে পারবে না।এ এক স্বর্গীয় সুখের অনুভুতি। যা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করলেও মানুষ কিনে আনতে পারবে না।রমা যখন মিষ্টুকে পরম মমতায় খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলো তখন সবার অলক্ষ্যে এক জোড়া চোখ ওদের দুজনকে দূর থেকে লক্ষ্য করছিল। সেটা রমা বা মিষ্টু কেউই দেখতে পায়নি।
রাত্রি বেলা সবাই বাড়ি ফিরে এলো।আর মিষ্টু?সে তো যতক্ষণ রমা ওখানে ছিলো, এক মুহুর্তের জন্যও রমাকে নিজের কাছছাড়া করেনি। ওকে ছেড়ে আসতে রমারও খুব মনখারাপ করছিলো। পরের দিন স্কুলে গিয়েও রমার খুব মনে পড়ছিলো মিষ্টুর ওই ডল পুতুলের মত চেহারাটা। ক্লাস থেকে বেরোতেই একজন স্টাফ ওকে বললো, কেউ দেখা করতে চায় ওর সাথে। অপেক্ষা করছে বাইরে। রমা একটু অবাক ই হয়ে গেল। এখন এই স্কুল আওয়ারে কে আসবে ওর সঙ্গে দেখা করতে। তাও বাইরে বেরিয়ে দেখলো এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন পেছন ফিরে। রমা ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"আপনি কি আমার কাছে এসেছেন? কি দরকার বলুন তো?"
ভদ্রলোক সামনে ঘুরে দাঁড়াতেই রমা অবাক হয়ে বললো "তুমি"?
"হ্যাঁ রমা আমি। আমি বিমান।আজ থেকে বিশ বছর আগে এই জায়গাতে দাঁড়িয়েই আমি তোমাকে তোমার অসম্পূর্ণ মাতৃত্বের জন্য ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। তোমাকে অপমান করেছিলাম এক অসম্পূর্ণ নারী বলে।অথচ বিধাতার কি নির্মম পরিহাস দেখো। সেই অসম্পূর্ণ নারী র কাছে আজ আমাকে আমার একমাত্র মেয়ের জন্য মাতৃত্ব ভিক্ষা করতে হচ্ছে। রমা তুমি ই একমাত্র পারো আমার মেয়ের মায়ের অভাব পূরণ করতে। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। দয়া করে তুমি আমাকে, এই অসহায় বাবা কে ফিরিয়ে দিও না। আমার মেয়ের মায়ের জায়গা আমি তোমাকে দিতে চাই রমা। কাল থেকে ও শুধু তোমাকেই খুঁজছে সব জায়গায়। মিষ্টুকে তুমি তোমার সন্তান স্নেহ থেকে বঞ্চিত করো না "।
রমা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। ওই ছোট্ট শিশু টাকে তো সেও এই একদিনেই অনেক আপন করে ফেলেছে।এই ছোট্ট ,অবুঝ শিশু টাই তো কাল ওর মধ্যে এক অপার মাতৃত্বের অনুভূতি এনে দিয়েছে। যার জন্য আজ এতকাল ধরে ও অপেক্ষা করে ছিলো। এই মাতৃত্বকে সে অস্বীকার করতে পারে না। নাই বা ওর গর্ভে জন্মালো ওই শিশু। গর্ভে জন্ম না দিলে কি মা হওয়া যায় না। ও না হয় এই শিশুর যশোদা মা হয়েই ওকে বড়ো করবে।
পরের দিন রমা বিমানদের বাড়িতে গেল। ওর মাতৃত্বই ওকে ওখানে টেনে নিয়ে গেল। মিষ্টু ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বললো,"আমি জানতাম তুমি আসবে।আর কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না তুমি।" রমাও ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললো , "না রে যাব না, তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না"। এই অনন্য মাতৃত্বের অনুভূতি আমার জীবনেও যে এই প্রথম।