Dola Bhattacharyya

Tragedy Crime

3  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Crime

অভিনেত্রী

অভিনেত্রী

7 mins
159



বাবা শিবেন পালের হাত ধরে আজই প্রথম স্টুডিও পাড়ায় পা রাখল কমলা। এই মুহুর্তে ও চিত্র পরিচালক প্রকাশ শর্মার চেম্বারে একটা সোফার ওপর চুপ করে বসে আছে। কাঁচের জানলার বাইরে সন্ধ্যার ঘন নীল আকাশ। একটা দুটো করে তারা ফুটে উঠছে সেখানে ।সেদিকেই তাকিয়ে বসেছিল কমলা। পর্দার ওপাশে বাবার সঙ্গে শর্মা বাবুর নিচু গলায় কিছু কথা হচ্ছে। কি কথা হচ্ছে তা না জানলেও, কথাগুলো যে ওকে নিয়েই, সেটা ও ভালো করেই জানে। কিছুক্ষণ পর পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন প্রকাশ শর্মা, পিছনে শিবেন। "কথাবার্তা তাহলে হয়ে গেল। এবার তুমি এসো শিবেন। তোমার মেয়ে যদি আমার কথা শুনে চলে, তাহলে ওকে আমি রাণী করে দেবো।" বিনয়ের অবতার শিবেন আকর্ণ হেসে বলে, "ঠিক আছে স্যার। তাই হবে। আপনার কথা মতোই চলবে ও।" 

মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় প্রকাশ শর্মার সেক্রেটারি শিবেন পাল । 


কমলার সামনের সোফায় ওর মুখোমুখি এসে বসলেন মি.শর্মা। হাতে সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে রঙিন পানীয়। দুটি চোখ দিয়ে সামনে বসে থাকা চোদ্দ বছরের মেয়েটাকে একটু মেপে নিচ্ছিলেন, এইমাত্র যার আসন্ন যৌবন কে উনি দশ লাখ টাকার বিনিময়ে কিনেছেন। হাঃ হাঃ। কিনেছেন ঠিক না, লিজ নিয়েছেন বলা যেতে পারে। পরনে একটা সস্তা দামের ছিটের ফ্রক, হাতকাটা । সোফার কোণে একটু জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে মেয়েটা। মৃদু হেসে এবার ওর পাশে এসে বসলেন শর্মা, "কি গো! ভয় করছে নাকি!" 

ঘাড় নাড়ে কমলা, না, করছে না। 

"তাহলে! শীত করছে! এসি টা কমিয়ে দেব?" 

এবারেও ঘাড় নাড়ে কমলা, তবে হ্যাঁ সুচক। 

"ঠিক আছে, টেম্পারেচার টা একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলো তো, কি খাবে তুমি? এটা নিশ্চয়ই চলে না তোমার!" নিজের হাতে ধরা গ্লাসটা ছোট্ট মেয়েটার মুখের সামনে ধরলেন শর্মা। আরো গুটিয়ে গেল মেয়েটা। নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন শর্মা। "আরে! এত ভয় পাচ্ছো কেন?আমি কি তোমায় খেয়ে ফেলব নাকি আ্যঁ! দাঁড়াও, তোমার জন্যে আমি একটু হট চকোলেট আনতে বলি। তারপর আমাদের প্রয়োজনীয় কথাগুলো সেরে নেব।" এবার একটু নড়েচড়ে বসে কমলা ।


সিনেমা জগতের নতুন মুখ সৃজনী। প্রথম ছবিই সুপার হিট। পরিচালক প্রকাশ শর্মা ভীষণ খুশি ।মুঠো মুঠো টাকা ঢেলেছেন এই ছবির পেছনে। সমস্তটাই পুষিয়ে দিয়েছে সৃজনী ওরফে কমলা পাল, শিবেন পালের বড় মেয়ে। শর্মার সেক্রেটারি শিবেন এখন বড় ব্যস্ত। নায়িকার বাবা সে । নায়িকার পোষাক, সাজগোজ সবকিছুর দায়িত্ব এই শিবেনের হাতে। সবদিক সামলাতে রীতিমত হিমশিম অবস্থা তার। তবে বড় মেয়ের দৌলতে মুঠো মুঠো টাকা আসছে ঘরে। এতে সে বড়ই খুশি। এরপর আছে ছোট মেয়ে রূপা । একেও শর্মার হাতে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। তবে রূপা এখন খুবই ছোট। সবে চার বছর বয়স। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। 

কমলার মা লক্ষ্মীকেও প্রকাশ শর্মার হাতে তুলে দিয়েছিল শিবেন। লক্ষ্মী ছিল অসামান্যা রূপসী। নাচটাও জানত খুব ভালো। কিন্তু মেয়েটা ছিল বড় বোকা। নিজের আখের গোছাতে পারল না। আত্মহত্যা করে বসল। তারপর থেকে মেয়ে দুটোকে একাই মানুষ করেছে শিবেন। কাঁচা টাকার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে ওদের। মায়ের মতোই রূপ গুণ পেয়েছে মেয়ে দুটো। 

ছোট থেকেই অনেক অনেক টাকার স্বপ্ন দেখত কমলা। কিন্তু টাকা রোজগারের পথটা যে এমন ক্লেদাক্ত, পিচ্ছিল, ভাবতে পারেনি। দুটো বছর স্বপ্নের পাখায় ভর দিয়ে খুব উড়েছিল মেয়েটা। একটার পর একটা বই সুপারহিট। নতুন ফ্ল্যাট, দামী গাড়ি। অধরা স্বপ্নেরা সব ধরা দিচ্ছে হাতের মুঠোয়। খুব খুশি কমলা ।

 

রাতের পার্টি বেশ জমে উঠেছে। আজ সৃজনীর জন্মদিন ।ষোলো বছর পূর্ণ হলো আজ। কত লোক এসেছে ওকে শুভেচ্ছা জানাতে। কত উপহার, ফুলের তোড়া। 

আজ অরণ্য এসেছে। সৃজনী আর অরণ্য এখনকার সুপারহিট জুটি। সিনেমা জগতের বাইরেও অরণ্যর সাথে সৃজনীর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। নায়ক হিসেবে অরণ্যও এখন খুবই জনপ্রিয়। গাঢ় নীল রঙের লং ড্রেসটায় রাণীর মতোই দেখাচ্ছে সৃজনীকে। অরণ্যের মুগ্ধ দৃষ্টি বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে। 

এক অনাবিল স্বপ্নের জগতে ভেসে চলেছে সৃজনী। 


এক নির্মম আঘাতে হঠাৎ করেই স্বপ্নটা ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। রাত প্রায় একটা। অতিথিরা চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে। যান নি প্রকাশ শর্মা। আজ নেশাটা একটু বেশিই করেছেন। সৃজনী বলে, "আঙ্কেল, অনেক রাত হল। তুমি ফিরবে তো! এই অবস্থায় তো ড্রাইভ করতে পারবে না। আমার ড্রাইভার কে বলে দিচ্ছি, তোমাকে ড্রপ করে দেবে"। 

"আজ রাতটা ভাবছি তোমার ঘরেই কাটাবো সুন্দরী।" জড়ানো গলায় বলেন প্রকাশ। 

"ঠিক আছে। তাহলে চলো, গেস্ট রুমটা খুলে দিই তোমায়"। 

"উঁহু ।গেস্টরুম নয় গো সুন্দরী । আমি তোমার ঘরে, তোমার সঙ্গেই কাটাবো "। 

" কি বলছো আঙ্কেল।"

" এ্যাই ।আঙ্কেল আঙ্কেল কোরো না তো। প্রকাশ বলবে, প্রকাশ। এই লাইনে কেউ কারো আঙ্কেল নয়, বাবা নয়, দাদা নয়, কেউ না। কাজ করবে আর ফাঁকে ফাঁকে একটু মস্তি । মস্তি নাহলে জীবনটা যে পানসে হয়ে যাবে সুন্দরী। ছেনালপনা রাখো। এসো আমার কাছে ", সৃজনীর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে চেষ্টা করেন প্রকাশ। ছিটকে সরে যায় সৃজনী।" তুমি ড্রাঙ্ক গেছো আঙ্কেল"। 

" আঃ। প্রকাশ বলতে বলছি না! " সৃজনীর দিকে আবার এগিয়ে আসেন প্রকাশ। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সৃজনী। পথ আটকে দাঁড়ায় শিবেন।

"কোথায় যাচ্ছিস!"

" বাবা! আঙ্কেল আমাকে…"। কথা শেষ করতে পারে না সৃজনী। কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। কঠিন স্বরে মেয়েকে নির্দেশ দেয় শিবেন," যাও ।ঘরে যাও"। 

"বাবা"! 

"চোওপ! মায়ের অবস্থা কি করেছিলাম মনে আছে তো?" মনে আছে বৈকি। মাকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল বাবা। সে রাতে ওদের ঘর থেকে বার করে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বোনকে কোলে নিয়ে বাইরে বসেছিল ও। মায়ের কান্না হঠাৎ করে থেমে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল সমস্ত চেঁচামেচি। কৌতুহলী হয়ে চোখ রেখেছিল দরজার ফুটোয়। আর তখনই দেখে ফেলেছিল সেই ভয়ংকর দৃশ্য। তখন ওর এগারো বছর বয়স। আর বোনের এক বছর। বাবা সবাইকে বুঝিয়েছিল, মা নাকি আত্মহত্যা করেছে। ভেবেছিল সব বলে দেবে পুলিশ কে। কিন্তু ওইটুকু বয়সেই বুঝে ফেলেছিল, প্রকাশ আঙ্কেলের হাত রয়েছে বাবার মাথায়। বাবার কোনো ক্ষতি হবে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সৃজনী। শিবেন অধৈর্য্য ।বলে, "শর্মা কে সন্তুষ্ট করতে পারলে আখেরে লাভ আছে। কথাটা মনে রাখিস।" 


লাভের পর লাভ করেই চলেছে শিবেন। একটার পর একটা ছবির কনট্রাক্টে সাইন করে চলেছে সৃজনী। শর্মা ছাড়াও অন্য পরিচালকের সাথে কাজ করারও অফার আসছে। এটুকু ছাড় ওকে দিয়েছেন প্রকাশ। শুরু হয়েছে অতিরিক্ত মদ্যপান। শ্যুটিং এর সময় ছাড়া বাকি সময়টা মদে ডুবে থাকে সৃজনী। প্রকাশ শর্মা ভীষণ বিরক্ত। মদে চুর হয়ে থাকা সৃজনীর শরীরটাকে সম্ভোগ করা যায়, কিন্তু পরিতৃপ্তি আসে না। তবু ফেলা যায় না মেয়েটাকে। নিজের কাজটা খুব ভালো ভাবেই বোঝে ও। একজন দক্ষ অভিনেত্রী সৃজনী। 

দেখতে দেখতে কেটে গেল পনেরো বছর। সিনেমার জগতে রূপার প্রথম প্রবেশ ঘটল। কিন্তু সৃজনীর কি হলো! আস্তে আস্তে মেয়েটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে! সেদিন শ্যুটিং স্পটে হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেল। পরিচিত ডাক্তার কে কল দিলেন প্রকাশ। সৃজনীর আ্যসিসট্যান্ট সোমা জানাল, "কিছুদিন ধরেই দেখছি, দিদির খাওয়া অনেক কমে গেছে, প্রায়ই জ্বর আসে, মাঝেমধ্যেই পেটে ব্যথা করে। 

ডাক্তার কিছু টেস্ট লিখে দিলেন। আর বললেন, ড্রিংক করা চলবে না। 


 নানা রকম পরীক্ষা করে লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ল সৃজনীর। রোগটা তখন অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে। প্রকাশ শর্মার মাথায় হাত। 'আলোর দেশের মেয়ে' সিনেমার শ্যুটিং চলছে। শেষ হতে এখনও দেরি আছে। মূল নায়িকাই যদি না থাকে, তাহলে কি করে চলবে। অপারেশনের পর রেডিয়েশন চলবে, কেমোথেরাপি চলবে। সে এক লম্বা গল্প। তাহলে কি হবে? অন্য কারোকে নেওয়া হবে! প্রকাশ শর্মার চেম্বারে বসেই কথা হচ্ছিল। শিবেন, অরণ্য এছাড়াও আরও কয়েকজন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলেন প্রকাশ। ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল সৃজনী, "প্রকাশ! তুমি আমার জায়গায় অন্য কারোকে নিতে পারো না। এটা আমার জীবনের শেষ কাজ। এটা শেষ করেই আমি অপারেশন টেবিলে উঠব। প্লিজ, তোমরা কেউ বাধা দিও না আমাকে। সকলেই চুপ ।শুধু অরণ্যের বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে। মেয়েটা ইচ্ছাকৃত শেষ করে দিল নিজেকে। আজও সৃজনী কে ভালোবাসে অরণ্য। কিন্তু ভালোবেসে নিজের করে নিতে পারে নি ওকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকাশ শর্মার বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকতে পারে না কেউ। 

আবার শ্যুটিং শুরু হল। দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের শেষ কাজটা শেষ করল সৃজনী। শেষ হল শ্যুটিং। 


বিকেল চারটে নাগাদ অপারেশন টেবিলে তোলা হল সৃজনীকে। হাসপাতালের লবিতে অপেক্ষারত অরণ্য আর সৃজনীর সেক্রেটারি সোমা। বাইরের আকাশে মেঘের আনাগোনা। মেঘ জমেছে অরণ্যের মনেও। জ্বলে উঠল অপারেশন থিয়েটারের আলো। ওরা প্রার্থনা করছে ঈশ্বরের কাছে, ওদের প্রিয় মানুষটাকে আবার ওদের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য। 

কড় কড় শব্দে বাজ পড়ল হঠাৎ। চমকে উঠল অরণ্য। বাইরে ঝড়ের সঙ্গে চলেছে অঝোর বর্ষণ। ছটফট করছে সোমা, "একি! আটটা বেজে গেল। এখনও অপারেশন চলছে!" কোনো উত্তর দেয় না অরণ্য। সোমা বুঝতে পারে অরণ্যের মনের কথা। বলে ওঠে, "আচ্ছা, দিদি তো আপনার গান খুব ভালোবাসত। ওই যে ওই গান টা, 'আজি ঝড়ের রাতে', গাইবেন একবার। সুরটা যদি পৌঁছোয় দিদির কানে, তাহলে হয়তো…" কথা শেষ করতে পারে না সোমা, চুপ করে যায়। কাঁচের জানলার বাইরে ঝলসে ওঠে নীল বিদ্যুতের শিখা। গেয়ে ওঠে অরণ্য :—

"আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

পরানসখা বন্ধু হে আমার॥

আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, 

 নাই যে ঘুম নয়নে মম--

দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥

বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,

তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।

সুদূর কোন্‌ নদীর পারে,

গহন কোন্‌ বনের ধারে

গভীর কোন্‌ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার॥"

সেই মুহূর্তে এক অচেনা বনপথ ধরে অচেনা এক নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে সৃজনী পারের মাঝির অপেক্ষায়। আসছে মাঝি। শোনা যাচ্ছে তার দাঁড় টানার শব্দ। কিন্তু গভীর অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না তাকে। অরণ্য কিন্তু জানে না। হঠাৎ চমকে ওঠা বিদ্যুতের শিখায় সৃজনী দেখতে পেল তার মাঝিকে। ঘাটের কিনারে এসে পড়েছে সে। অনেকটা যেন অরণ্যের মতো দেখতে তাকে। নৌকায় ওঠার জন্য পা বাড়ালো সৃজনী। আর ঠিক সেই সময়ে আলো ঝলমলে এক হলঘরে হাজার লোকের হাততালির মধ্যে নতুন চুক্তি তে সাইন করল রূপা। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy