অভীষ্টে একাংক্ষী
অভীষ্টে একাংক্ষী
পুরুষের পুরুষালী ক্ষমতার কাছে একটা নারী কখনো কখনো সামান্য হয়ে যায়, কিন্তু কোন নারীর মধ্যে যদি সেই পুরুষালী ক্ষমতার আবির্ভাব হয় তখন একটা পুরুষ তাকে কখনোই দমাতে পারে না। আজ এমনই একটা নারীর কথা বলব যার অস্তিত্ব পৃথিবীর মধ্যে আজ আর বেঁচে নেই, হয়তো কখনো ছিল না! কিন্তু তার উপস্থিতি, তার অনুভূতি সব সময় নজর বন্দী করে সেই সমস্ত পুরুষদের যাদের মধ্যে লোভ, লালসা, কামনা, বাসনার ভরপুর আধিপত্য। এমন একটি নারী যার মধ্যে ভালোবাসা চিরকালীন বিদ্যমান। সে ভালোবাসতে খুব ভালোবাসে, এক থেকে একাধিক...
প্রতিহিংসা আর ভালোবাসা, এই দুই অনুভূতি দুটোকে যদি পারস্পরিকভাবে সমান্তরালে রাখা হয় কখনো হয়তো নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে না, কিন্তু এই দুটি অনুভূতির প্রভাব কিভাবে আমাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয় সেটা কখনো কখনো আমরা বুঝতে পারি না। কখনো হয় অজান্তে, কখনো বা বুঝেও কিছু করার থাকে না।
পাহাড়ে ঘেরা বণানির চারপাশে সবুজের কলতান ইক্ষান কে বার বার টেনে নিয়ে যায় সুদূর কল্পনার মহাকাশে। সেখানে সাধারণ মানুষের বিচরণ করার প্রবেশাধিকার নেই। প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল ইক্ষান এই নাম না জানা পাহাড়ী এলাকায় এসেছে। সঙ্গে আছে তার সহধর্মিণী একাংক্ষী। ওদের প্রেম করে বিয়ে নয়। রীতিমত কুষ্টি মিলিয়ে দুই পরিবারের অনেক আলাপ আলোচনার পর ওদের বিবাহের মতো একটা ঘটনা ঘরে অবকাশ পেয়েছে। ইক্ষান ও একাংক্ষী দুজনেই ভূ-তত্ত্ববিদ। যথেষ্ট বয়স হয়েছে এবং সংসার ছাড়াও তাদের প্রফেশনালি কোনো ছুটি কাটানোর অবকাশ মেলেনি। বিবাহের প্রায় দেড় বছর পর ওরা অনেক কষ্ট ছুটি নিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বেরিয়ে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। ধরা বাঁধা পরিচিত স্থানে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে কোনো উদ্দীপনা নেই বলেই দুজনে বিশ্বাস করে। গত একসপ্তাহ হলো অনেক ঘোরাঘুরির পর ওরা এই পাহাড়ে একটু স্থির হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইক্ষান একটু কল্পনা প্রবন কিন্তু একাংক্ষী ভীষণ বাস্তববাদী। দুজনের এই টুকুই মতের অমিল। তাছাড়া দুজনের মধ্যে এই কয়েকমাসের মধ্যেই একটা বন্ধুত্ব পূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে এখনও পর্যন্ত তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মতো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কারণ একাংক্ষী ভালোবাসতে খুব ভালোবাসে কিন্তু তার আগে যাকে ভালোবাসছে তার সাথে প্রকৃত সম্পর্কটাই যদি তৈরি না হয় তখন ওই সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ভালোবাসি ভালোবাসি বলাটা সে পছন্দ করে না। ইক্ষানও সহমত হয়েছিল সেই ফুলশয্যার রাতে। সেই থেকেই একটু একটু করে তাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। ক্রমেই সেই বন্ধুত্ব নিজের সরু সরু ডাল পালা বিস্তার করেছে সম্পর্কের গভীরে। নিজেদের পেশার জন্য একে অপরকে সময় দিতে পারেনা বিশেষ। কিন্তু পরস্পরের খেয়াল রাখে সাধ্য মতো। এই নির্জন পাহাড়ের কোলে যেন পরিবেশের সাথেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে একাংক্ষী। ঝিম ধরা জঙ্গলের আলো আঁধারিতে এক একটা দিন কিভাবে যেন কেটে যাচ্ছে, আর যত দিন কাটছে ইক্ষান ততই লক্ষ্য করেছে তার স্ত্রী একাংক্ষী ঝিমিয়ে পড়েছে। রাতের দিকে একাংক্ষী ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে। ইক্ষান তখন গভীর ঘুমের মধ্যে হয়তো কোনো কল্পনার প্রাসাদ গড়ছে বা কোনো নাম না গাছের ডালে বসে পাখিদের সুরে সুর মিলিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আজও সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা একটা পাতলা চাদরের আস্তরণে মুখ লুকিয়েছে। একাংক্ষী গুটি গুটি পায়ে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। যেন সে জানে তার গন্তব্য। মিশকালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দূরে একটা ফিসফিসানি। একটা আহ্বান। কত গুলো পুরুষের মিলিত আহ্বান...
সকালে যখন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জঙ্গলের উপরে। পাখিদের কিচিরমিচির আর অদূরে একটা মিষ্টি বাঁশির সুর মাতাল করে তুলেছে প্রকৃতিকে ঠিক তখনই ঘুমের চাদর সরিয়ে ইক্ষান জেগে উঠলো। পাশের খালি জায়গাটার দিকে নজর যেতেই একটু বুকটা ধড়াস করে উঠলো, পরক্ষনেই দেখলো ওরা একাংক্ষীর লাল স্কার্ফটা। একাংক্ষীর নাম ধরে কয়েকবার ডাকলো ইক্ষান। সাড়া না পেয়ে তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। কিছুটা দূরে একটা গাছের আড়ালে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। ইক্ষান সেদিকে গিয়ে দেখলো একটা জটাধারী বয়স্ক মানুষ ধ্যানে মগ্ন। আর কোনো সাড়া না করে যেই দুপা এগিয়েছে অজ্ঞাত ব্যক্তির থেকে আহ্বান শুনলো ইক্ষান। একটু অস্বস্থি সত্বেও সে ঘুরে বললো, "আমাকে কিছু বলছেন?" চোখ না খুলেই ওই ব্যক্তি বললেন, "তোর স্ত্রীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবি না। সে এখানে তার আদিম ভালোবাসার খোঁজ পেয়ে গেছে। তোর সাথে তো এখনও তার কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়নি। তুই ওকে আর পাবি না" বলেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি হেসে আগের অবস্থাতেই ধ্যানস্থ হয়ে রইলো।
ইক্ষান এই সব মানুষদের বিশ্বাস না করলেও এক্কেবারে অবজ্ঞা করতে পারে না। তার বাবা মা বাবার এই সব সাধু সন্ন্যাসী দের খুব শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু...
"তুমি এখানে? আমি তোমাকে তাঁবু তে দেখতে পেলাম না বলে এদিকে এলাম। চলো আজ তোমার সাথে একজনের আলাপ করিয়ে দিই।" বলেই একাংক্ষী ইক্ষানের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। ইক্ষানের চোখ গেল ওই অজ্ঞাত ব্যক্তির দিকে, উনি আবার মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের মুখে। এদিকে ওদের তাঁবুর সামনে একজন লম্বা চওড়া পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইক্ষান তার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত করলো। তার মুখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠতেই একাংক্ষী বললো, "ওর নাম দিশান। এখানেও থাকে। ওর একটা ছোটো ঘর আছে। আমরা এখানে যতদিন আছি ওর বাড়িতে থাকলে কেমন হয়?"
ইক্ষান একটু অবাক হয়ে বললো, "তুমি ওনাকে চিনলে কী করে? তাছাড়া আমরা তো আর কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে যাবো। এখন আবার বাড়ির কী দরকার একাংক্ষী। শোনো ওনাকে চলে যেতে বলো। আমরা এখানেই ঠিক আছি।"
একাংক্ষী কথা গুলো শুনতে শুনতে কেমন রাগে ফুঁসতে শুরু করলো। চোখের রং ধীরে ধীরে যেন বদলে যাচ্ছিল। মাথা ভর্তি চুলের ভারী খোঁপা টা ঢিলে হয়ে পিঠ ছাপিয়ে এলোমেলো হয়ে শুরু করলো। কিছুই মাথায় ঢুকছিল না ইক্ষানের। সঙ্গে সঙ্গে একাংক্ষীর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইক্ষান বললো, "কী হয়েছে তোমার?" হচ্ছিল। অপরিচিত পুরুষটি হাত জড়ো করে মিনতি করছে, সে ভয় পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের রূপ নিয়ে কিছু অপার্থিব ঘটনা ঘটছে অলক্ষ্যেই। সেদিন পুরো সময় একাংক্ষী আর কোনো কথা বলেনি। বিকেলের দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা নদীর ধারে গিয়ে বসেছিল ওরা। একাংক্ষী তো জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে ছিল। কিন্তু তার মন পড়েছিল অন্য কোথাও। এই অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ী এলাকা, জঙ্গল, নদী, জনবসতি; যা দেখে একাংক্ষী নিজেই এখানে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন সেই সব কিছুই দারুণ বিরক্ত করে তোলে একাংক্ষীকে। ইক্ষান বুঝতে পারে না, এই সব কিছুর অন্তরালে কোন পটভূমির রচনা রচিত হচ্ছে।
সেদিন রাতে আর ইক্ষানের ঘুম আসে না। জঙ্গলের পাশেই একটা ছোট্ট বসতি এলাকা আছে। ওরা রোজ সন্ধ্যে বেলাতেই সেখান থেকে খাবার কিনে চলে আসে। আজ একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে দুজনেই। দূরের নদীর বয়ে চলার কলকল ধ্বনিত হচ্ছে। ওদের তাঁবুর পিছন দিকে সাধুটি নিঃশব্দে ধ্যানে মগ্ন। তাঁর বলা কথা গুলো বার বার মনে পড়তে লাগলো ইক্ষানের। সত্যিই তো এত গুলো মাস তারা এক সাথে একঘরে থাকে। অথচ একটা মুহূর্তের জন্যই কোনো সান্নিধ্য পায়নি সে একাংক্ষীর। এত দিনেও কী ইক্ষান, একাংক্ষীর স্বামী হয়ে উঠতে পারেনি। কেন এই দূরত্ব কেনোই না দূরে দূরে থাকে একাংক্ষী!
ইক্ষান দেখলো একাংক্ষী উল্টো দিকে পাস ফিরে শুয়ে আছে। মাঝে কোনো ব্যবধান নেই। বাড়িতে হলে মাঝে একটা পাশবালিশ থাকতোই। ইক্ষান একটু কাছে সরে এলো একাংক্ষীর। ধীরে ধীরে নিজের জড়তা কাটিয়ে গায়ে হাত দিয়েই উঠে বসলো একাংক্ষী। ভীষণ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, "কেন গায়ে হাত দিচ্ছিস? একদম গায়ে হাত দিবি না। একদম না।" এমন কিছু কল্পনাও করেনি ইক্ষান। একাংক্ষীর কণ্ঠে কেমন একটা অস্বাভাবিকতা। গায়ে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের চামড়া যেন জ্বলে উঠেছিল। কেমন ঘ্যাসঘ্যাসে কণ্ঠে একাংক্ষী আবার বললো, "প্রতিশোধ নেবোই, নেবোই... দূরে থাক, দূরে। একদম দূরে থাক" বলতে বলতে তাঁবুর বাইরে বেড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ইক্ষান হতভম্ব ভাব কাটিয়ে যখন বাইরে এলো তখন তার স্ত্রীর কোনো চিন্হ নেই। অনেকবার নাম ধরে ডেকেও যখন কোনো সাড়া পেল না তখন যেন ভেঙে পড়লো প্রথমে। তারপরেই যেন একটা পুরুষালী কণ্ঠে ডাক শুনলো। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে সামনের জ্বলন্ত ধুনি দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেল ইক্ষান। সাধু বাবার সামনে যেতেই অবাক কান্ড। ইক্ষান দেখলো একাংক্ষী সাধুর সামনে গুম হয়ে বসে আছে। হাত দুটো পিছনে তবে কোনো বাঁধন নজরে পড়লো না। মাঝে মাঝেই একাংক্ষী জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটে নিচ্ছে। ইক্ষান কোনো কথা বলার আগেই সাধু বললেন, "প্রায় দুশো বছর আগে এখানে একাংক্ষী নামে এক পুরোহিত কন্যা ছিল। সে ভালোবাসত রাজপুত্র সৈরণকে। কিন্তু এই খবর প্রচলিত হতেই মহারাজ নিজের একমাত্র ছেলেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। সৈরণও কিছু বোঝার আগেই তাকে তার ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে সরিরে দেওয়া হয়েছিল। ব্রাহ্মণ কন্যাকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করতে প্রতি রাতে একজন করে পুরুষকে পাঠানো হতো, রাজার আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা কারোর ছিল না। ব্রাহ্মণ কন্যাকে সেই পুরুষেরা প্রথমে রাজপুত্রের সম্পর্কে মিথ্যাচার করে পড়ে বলতো রাজকুমার তাকে পাঠিয়েছে একাংক্ষীর লজ্জা হরণ করতে। আবার কেউ কেউ ছলনার আশ্রয় নিয়ে ব্রাহ্মণ-কন্যাকে জানাতো তাদের স্পর্ধা নেই একাংক্ষীকে স্পর্শ করার, কিন্তু রাজকুমার যেন কোনো মতেই সেসব জানতে না পারে। একাংক্ষী খুব সুন্দরী আর তার মনটাও ছিল পবিত্র। গত এক মাস রাজকুমার তার সাথে দেখা করতে আসেননি। তার পিতাও কোনো অজ্ঞাত কারণে বাড়িতে ফেরেননি। আসলেই রাজবাড়িতে ব্রাহ্মণকে এক প্রকার বন্দী করা হয় ষড়যন্ত্র করে। কয়েকটি পুরুষ কিছুদিন পর পর একাংক্ষীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস করে, কিন্তু একটি পুরুষও তার শরীর তো দুর মনও পায়নি।
এভাবেই দীর্ঘ কয়েকমাস কেটে যায়। নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেই একাংক্ষীর দিন কাটে। একসময় এই পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য না রাখতে পেরে মনের দুঃখে একাংক্ষী গ্রামের মন্দিরে গিয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছিল। সেই সময় গ্রামের কয়েকজন যুবক মন্দিরের পাস দিয়ে যেতে যেতে একাংক্ষীকে উদ্দেশ্যে বলাবলি করে, "এই রূপ যৌবনের ভাগ তো আমরাও পেতে পারি, আমাদের মনেও তো তোমার মত সুন্দরীকে কামনা করার ইচ্ছে হয়। শুধু রাজসভার পুরুষ রাই কেন!" একাংক্ষীর কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। তার মনের নরম কাদার মতো মনটা এই সকল পুরুষের লালসার আগুনে পুড়ে কবে যে কঠিন পাথর হয়েছে তা সে সেই ক্ষণেই উপলব্ধি করলো। ব্রাহ্মণ কন্যা একাংক্ষী, মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে ভগবানকে সাক্ষী রেখে উচ্চস্বরে সকল গ্রাম বাসীর উদ্দেশ্যে বললো, "আমি যদি সত্যবতী হই, আমার শরীর ও মনে যদি একটি পুরুষের বাস হয় এবং আমি যদি পূর্ন ভক্তিতে ঈশ্বরের আরাধনা করে থাকি তবে আমি এই নোংরা ছলনার প্রতিশোধ নেবোই। আমি আবার ফিরে আসবো, আমার ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার জন্য আর আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে।" তার কথা শেষ হতে না হতেই নিজের পরনের শাড়িটা আঁচল মন্দিরের চাতালে রাখা পঞ্চপ্রদীপের আগুনে ধরিয়ে দেয়। ততক্ষনে গ্রামের মন্দিরের সামনে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। রাজসভায় সেই খবর পৌঁছতেই সকল বাধা অতিক্রম করে ব্রাহ্মণ ছুটে আসেন। কিন্তু কারোর পক্ষেই সম্ভব হয়নি একাংক্ষীকে বাঁচানো। তার সপ্তাহ খানের পরেই রাজকুমার শোকগ্রস্ত হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। গ্রামের মধ্যে নানা গুঞ্জন উঠলেও সর্বসমক্ষে কেউ একাংক্ষীর চরিত্র সম্পর্কে আলোচনার সাহস দেখাতে পারে না। একাংক্ষীর মৃত্যুর পর মাস খানের নির্বিঘ্নেই কেটে যায়। কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কিছু দিন পর থেকে রাজার অধীনে কর্মরত প্রায় পনেরোজন পুরুষের এক এক করে কয়েক জনের অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয় আবার কেউ কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। স্বয়ং রাজা ও মানসিক ভাবে ভারসাম্য হারান। তার একমাত্র পুত্র তো আগেই মারা গিয়েছিলেন, রাজার শারীরিক অবস্থার অবনতির ফলে রাজকার্য ব্যাহত হতে শুরু করে। এই সময় রাজবাড়ির গুরুদেব কে সংবাদ পাঠানো হয়। তিনি এসে সমস্তটা শুনে নানাবিধ ক্রিয়াকর্মের আয়োজন করেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই সারা রাজ্যে এই যজ্ঞের আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। গুরুদেব তার চারজন শিষ্য কে আহ্বান করেন। গ্রামের মন্দিরের সামনে বড়ো শামিয়ানা টাঙানো হয়। তাঁরা পাঁচজন মিলে সেই স্থানে যজ্ঞের আয়োজন করেন। আশপাশের সমস্ত মানুষ জনের মধ্যে অবিশ্বাস ও তাচ্ছিল্যের ভাব। বেলা বারো টা থেকে যজ্ঞ শুরু হলো। একটানা ঘৃতাহুতি ও নানাবিধ উপকরণ যজ্ঞের আগুনে আহুতি দেওয়া হচ্ছে। এই যজ্ঞ যদি সফল হয় তবে পুরো গ্রাম একাংক্ষীর আক্রোশ থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু সেই যজ্ঞ সম্পন্ন হলো না। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই নানা বাধা আসতে শুরু করে। মন্দিরের দরজার পাল্লা অশান্ত হওয়ার কোপে পড়ে দুমদাম আওয়াজ করতে থাকে। মন্দিরে একটা ঘণ্টা অথচ শখানেক ঘণ্টাধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হওয়া ক্রমেই ঝড়ের আকার নিলে মাথার উপরের বড়ো শামিয়ানা কোথায় উড়ে গেল তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। রাজা ও তাঁর সভার অনেকেই একপাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু চাক্ষুষ করছিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে সকলেরই বুকের মধ্যে প্রবল আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। এদিকে ঝড়ের তান্ডব ও অন্ধকারের মধ্যে যজ্ঞ চলছিল আগের মতোই। কিন্তু বেশি ক্ষন তা স্থায়ী হলো না। পরপর তিনবার আকাশ চিরে বাজ পড়লো। বিদ্যুৎ এর চমকে চোখ ঝলসে গেল, দূরের দুটো গেছে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। যে মানুষ গুলো অবিশ্বাস চোখে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারাই যেন নিজেদের প্রাণ হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। আবার একটা বাজ পড়ার শব্দ ও সঙ্গে সঙ্গে একটা অবয়বের অট্টহাসি শোনা গেল। হাড় হিম করা সেই হাসি শুনে অনেকেই মূর্ছা গেল। গুরুদেব ও তার শিষ্য, সকলেই নতমস্তকে প্রার্থনা করলেন অবয়বের সামনে, "শান্ত হও মা, তুমি শান্ত হও। গ্রামের নির্দোষ মানুষ গুলোকে রক্ষা করো। তোমার ক্রোধ নিয়ন্ত্রন করো মা।" কিন্তু অবয়বের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুন আরও প্রকট হয়ে শুরু করেছে তখন। আশপাশের অনেক গাছে ও খড়ের গাদায় সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সেইসময় ব্রাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে যজ্ঞের সামনে এসে কন্যার উদ্দেশ্যে মিনতি করে, "মা রে, তুই তো আমার লক্ষ্মী মা। তোকে এই রণচন্ডী রূপে মানায় না মা, এই গ্রামের মানুষ গুলোকে তুই রক্ষা কর মা। তোর বাবা হয়ে আমি তোর কাছে ভিক্ষা চাইছি গ্রামের মানুষগুলোর প্রাণ।" পিতার চোখের জল কোন সন্তান সহ্য করতে পারে।
ব্রাহ্মণ কন্যা একাংক্ষীর অবয়বের মধ্যে ধীরে ধীরে মনুষ্য রূপ প্রকট হলো। কিন্তু সেই রূপ সহ্য করার ক্ষমতা কারোর ছিল না। আগুনে পুড়ে যাওয়া শরীরটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করলো। শরীরের বিভিন্ন অংশ গলে গোলে পড়তে শুরু করলো যজ্ঞের আগুনে। মুখের আদল তখনও কোনো পরিবর্তন হয়নি। সকলেই দেখলো, একাংক্ষীর দুচোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে তার গাল বেয়ে নেমে আসছে।" তারপর কিছুক্ষণ থেকে সাধু বললেন, "সেদিন তার প্রতিশোধ স্পৃহা কিছুটা দমন হলেও ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আজ তোর স্ত্রী একাংক্ষী তার গত জন্মের সঙ্গী সৈরণ কে পেয়ে তার একমাত্র ভালোবাসার মানুষটির কাছে যেতে চাইছে। কিন্তু কি জানিস, এই জন্মেও সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাবে না। কারণ মন্ত্র পড়ে মালাবদল করে সাতপাকে বাঁধা পড়েছে সে তোর সাথে। আবার সে তোর সাথেও সুখী নয়, তোর মধ্যে সে তার পূর্ণতা পায়নি। আর সব থেকে বড়ো কথা এই স্থানই হলো সৈরণ ও একাংক্ষীর জন্মস্থান। এই মাটিতেই গড়ে উঠেছিল ওদের সম্পর্ক। এখন সেই ব্রাহ্মণ কন্যা একাংক্ষীর আত্মা ভর করেছে তোর স্ত্রী একাংক্ষীর উপর। রাজকুমার সৈরণের অতৃপ্ত আত্মা একাংক্ষীকে বার বার টেনে নিয়ে যায়। এমত অবস্থায় তোর স্ত্রীর জীবন সংকটে সাথে তোরও। আমাকে একটু ভাবতে হবে কিভাবে তোদের রক্ষা করা সম্ভব।
একাংক্ষী তখনও বুঁদ হয়ে বসে আছে সেই স্থানে। আকাশে ভোরের আলোর ছোঁয়া লেগেছে। ইক্ষান চিন্তিত মুখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন পর যেন একাংক্ষী স্তম্বিধ ফিরে পেল। আড়মোড়া ভেঙে সাধু কে দেখে একটু ছিটকে সরে গেল। প্রায় চিৎকার করে উঠে পড়ল সেখান থেকে। ইক্ষান চমকে উঠেছিল একাংক্ষীর আচম্বিত চিৎকারে। সাধু খুব শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, "ভয় নেই মা, আমি তো তোর পিতার মতো। ভয় নেই" ওনার বলার মধ্যে হয় তো কোনো জাদু ছিল। একাংক্ষী খুব শান্ত হয়ে ইক্ষানের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। ইক্ষান তার স্ত্রীকে শান্ত করে বললো, "আমরা তো একটু ঘুরতে এসেছিলাম ভোর বেলা। তুমিই তো এলে এখানে। এখন ভয় পাচ্ছো কেন? আচ্ছা চলো, এবার আমরা ফিরে যাই। যাওয়ার আগে সাধুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই তিনি ইক্ষানের হাতে দুটো শুকনো বেলপাতা আর শুকনো লাল জবার একটা পাপড়ি দিলেন। হাতের মুঠো না খুলেই একাংক্ষীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলো ইক্ষান।
কার জীবনে কখন কি হয়ে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সময় বয়ে যায়। পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দিন গুলো অগোছালো হয়ে যায়। প্রতিশোধ স্পৃহার থেকেও ভালোবাসার ক্ষমতা অধিক তা আবারও প্রমাণ করে। প্রতিশোধের আগুন নিভে যাওয়ার পরেও মনের মধ্যে জাগরিত প্রেম বিদ্যমান থেকে যায়।
ইক্ষান চুপিসারে সাধুর সাথে সমস্ত ক্রিয়াকর্মের উপকরণ একত্র করতে থাকে। ইক্ষান একাংক্ষীর গলায় শুকনো বেলপাতা আর জবা ফুলের একটা পাপড়ি লাল হলুদ সুতোয় বেঁধে পরিয়ে দিয়েছে। যার ফলে একাংক্ষী প্রায় সারা দিন ঘুমিয়ে থাকে, এর মধ্যে সৈরণ এর নাম করেছে কয়েকবার। সাধু সামনের ত্রয়োদশী তে পুজোয় বসতে চান। তার মধ্যেই হঠাৎ একদিন ঘটে গেল একটা দুর্ঘটনা। ইক্ষান যখন এদিক সেদিক ঘুরে সাধুর বলা এক একটা জিনিস জোগাড় করতে ব্যস্ত। একাংক্ষীর দীর্ঘ ঘুম ভেঙে চার দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে উঠে যেতে গিয়েই লক্ষ্য পরে গলায় ঝোলানো বেলপাতা আর জবা ফুলের মাদুলিটার দিকে। খুব বিরক্ত হয়ে মাদুলিটা ছুঁড়ে ফেলে তাঁবু থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো। ইক্ষান জানতেও পারেনি একাংক্ষী কখন বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যার মুখে ইক্ষান তাঁবুতে ফিরে একাংক্ষীকে না পেয়ে সাধুর কাছে ছুটে যায়। কিন্তু অনেক খোঁজা খুঁজির পরও কোথায় কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। মধ্যরাতে ইক্ষান যখন একটা গাছের নীচে ক্লান্ত হয়ে বসে ছিল সেই সময় একটা পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ী এলাকার ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও ইক্ষানের খুব গরম হতে থাকে। যেন শরীর পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়। ইক্ষান নিজের শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে চোটফটিতে ওঠে। চারপাশে কালো কালো কিছু ছায়া শরীর চোখে পরে ওর। কেউ কেউ ওকে হাত বাড়িতে ধরতে চায়, তো কেউ দূরে দূরে ঘুরে বেড়ায়।
প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আসা শরীরের সমস্ত অনুভূতি নিঃশেষ হয়ে যাবার কয়েক মুহূর্ত আগে ঘাসের মধ্যে একটা সুতোয় জড়ানো কিছু মুঠোর মধ্যে উঠে আসে। তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সব আগের মতো স্বাভাবিক। আবার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে। হালকা হালকা শিরশির করছে শরীর। হাতের মুঠোয় সাধু বাবার দেওয়া মাদুলিটা শক্ত করে ধরে রইলো। হিমেল হাওয়ার আদরের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে গাছের পাতায়, পাহাড়ের কোলে। ছোটো ছোটো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে ঘাসের উপর। দূরে গাছের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের লালচে আভা। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। সারারাত একাংক্ষীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সাধু বাবার কাছে পৌঁছতে হবে। জঙ্গলের অনেকটা নীচের ঢালে বসে ছিল ইক্ষান। সেখান থেকে দূরে উপরে ওঠার সময় চোখে পড়লো একটা শাড়ির ছেঁড়া অংশ, কিছুটা পুড়ে গেছে বলেই মনে হলো। সেগুলো নিয়ে যখন সাধুর আস্তানায় এলো তখনও সাধু ধ্যানমগ্ন। ইক্ষান ডেকে উঠলো, "বাবা, বাবা চোখ খোলো। গতকাল রাতে..." সাধুবাবা চোখ খুলেই হাত তুলে থামিয়ে দিল ইক্ষানকে। সামনের দিকে হাত প্রসারিত করে যেন কিছু চাইলেন। ইক্ষানও সম্মোহিতের মতো তার হাতে থাকা পোড়া কাপড়ের টুকরো ও সুতোয় বাঁধা মাদুলিটা দিয়ে দিল। এরপর সাধু নির্দেশ দিলেন, " যা নিজের তাঁবুতে ফিরে যা, ঠিক সন্ধ্যার আগেই এখানে চলে আসিস। চিন্তা নেই, তোর স্ত্রীকে তোর কাছে ফিরিয়ে দেবোই।
সন্ধ্যার ঠিক আগেই ইক্ষান শুদ্ধ বস্ত্রে সাধুর কাছে এসে বসলো। ততক্ষনে পুজোর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ন। বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে গোল করে সিঁদুর দিয়ে গণ্ডি কাটা। তার ভিতরেই তিনটে আসন পাতা, মাঝে একটা ধুনী সাজানো। নানা সামগ্রীর মধ্যে দুটো ছবি দেখে ইক্ষান চমকে উঠলো। একটা ছেলের ও একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটাকে এক্কেবারে তার স্ত্রী একাংক্ষীর মতো দেখতে। ছেলেটি একটি রাজকুমারের মতো বেশ। ইক্ষানকে দেখে সাধু আদেশ করলেন, "ওই বস্ত্র পরিত্যাগ কর" কিছুদূরে একটা মাচার উপর একটা শ্বেত শুভ্র বসনের দিকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, "ওই বস্ত্র পরিধান করে গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ কর।"
সাধুর নির্দেশ মতো ইক্ষান নিজের বস্ত্র ত্যাগ করে শ্বেত শুভ্র বসন পরিধান করে গণ্ডির মধ্যে একটা আসলে বসলো। সাধু বারবার করে ওকে সাবধান করে দিল "যাই হয়ে যাক এই গণ্ডির বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করবি না। একাংক্ষীর আত্মা এসে তোকে মারতে চাইবে, কারণ তোকে মারলেই ওর অভীষ্ট পূরণ হবে। আজই সেই দিন যেদিন একাংক্ষী গ্রামের নাট মন্দিরে আত্মহত্যা করেছিল।
ইক্ষান লক্ষ্য করলো চারিদিকের পরিবেশ ভীষণ থমথমে, সন্ধ্যার পর থেকে গাছের পাতাও নড়ছে না। ঠান্ডাটা ভীষণ রকম কমে গেছে, একটা গুমোট ভাব। একটা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে না, জোনাকি গুলো যেন কোনো এক জাদু বলে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেমন একটা স্যাঁতস্যাতে হাওয়া বইছে। বাতাসে হালকা দুর্গন্ধ। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ বুঁদ হয়ে আছে। গতকাল থেকে একাংক্ষীর কোনো খবর পায়নি ইক্ষান । সাধু পূজার উপাচার শুরু করলেন। দেহ বন্ধন করে ধুনী জ্বালিয়ে মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন। ঘণ্টা দুয়েক নানা রকম নিয়ম মেনে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিয়ে চললেন সাধু বাবা। কিন্তু ওই পোড়া কাপড় আর ছবি গুলো আহুতি দিতেই বাতাস আরো ভারী হয়ে উঠলো। দুর্গন্ধের প্রভাব বাড়লো। একটা হিশহিশে শব্দ কানে আসছিলো। সেই গতরাতের মতোই সব ঘটনাটা আবার পুনর্বার ঘটতে থাকলো। সাধু নিজের মন্ত্র পাঠ শেষ করলেন। একাংক্ষীর নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। তিনবারের মাথায় প্রবল ঝড় উঠলো জঙ্গলের মধ্যে। এ এক অদ্ভুদ পরিস্থিতি, একটা মৃত মানুষের সাথে যুদ্ধ করে নিজের স্ত্রীকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে হবে। হঠাৎ একটা কর্কশ কন্ঠের চিৎকার শুনে ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। ইক্ষান কখনো ভূত বিশ্বাস করতো না। কিন্তু তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একাংক্ষীকে সে চিনতে পারছে না। ঘাড় কাত করে বিকৃত মুখে ঘোঁস ঘোঁস করে আওয়াজ করছে আর রাগে ফুঁসছে। চুল গুলো একদিনেই জট পাকিয়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে পোড়া ঘা। ট্রাউজার ও গেঞ্জির বদলে শাড়ি পরে আছে একাংক্ষী। শাড়ির কয়েকটা জায়গা ছেঁড়া। হাতে একটা রঙিন বস্ত্র। অনবরত একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ বের হচ্ছে একাংক্ষীর মুখ দিয়ে।
সাধু একাংক্ষীকে বসতে আদেশ করলেন, প্রথমে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দ্বিতীয় বার সাধুর আদেশ অমান্য করতে পারলো না। পাশে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইক্ষান। কাকে দেখছে সেটাই বিশ্বাস করতে পারছে না। একাংক্ষী বিকৃত স্বরে বলে উঠলো, "আমাকে কেন ডাকলি? আমি তো কারোর কোনো ক্ষতি করিনি! আমি তো মুক্তি চাই!" সাধু বললো, "আজ তোকে মুক্তি দেবো। এত গুলো বছর এই দিনটার জন্যই আছি অপেক্ষা করেছি। মা রে, আর কোনো মানুষের ক্ষতি করিস না মা। ওই মেয়েটার শরীর থেকে তুই চলে যা। তোর কাছে এই টুকুই আমি চায়।"
তখনও ঝড়ের তান্ডব কমেনি, ঘনঘন বজ্রপাত শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝেই আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ। জঙ্গলের মধ্যে বড়ো বড়ো গাছ গুলো ক্রমাগত একে অপরের উপর মাথা ঠুকছে। কিছু দূরেই ইক্ষান দেখল একটা পুরুষের ছায়া শরীর বাতাসে ভর দিয়ে দুলছে। একাংক্ষী একটা গণ্ডির মধ্যে ছটফট শুরু করলো। কিন্তু ওই গণ্ডি কখনো কাটা হলো সে জানে না। সাধু আবার মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন। এর পরেই একাংক্ষীর মুখে হাসি ফুটলো। খিলখিল করে হাসতে হাসতে হাত তালি দিতে শুরু করলো। পুরুষ অবয়ব ধীরে ধীরে স্বাভাবিক শরীর ধারণ করে সামনে এসে বসলো। সাধু ইক্ষানকে আদেশ করলো সিঁদুর কৌটো এগিয়ে দিতে পুরুষের দিকে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি ইক্ষান, বড়ো সিঁদুরের গণ্ডিটা তিনটে ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, তার একটি সাধু ও সে। অন্য দুটোর একটায় একাংক্ষী অন্য টায় সেই পুরুষ ছায়া শরীর। সাধুর কার্যকলাপ দেখতে দেখতে ইক্ষান অবাক হয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছে তার সামনে একটা বিয়ে হচ্ছে, আর সে সাক্ষী হয়ে উপস্থিত। সিঁদুর কৌটো ইক্ষানের হাত থেকে উঠে শূণ্যে ভেসে রইলো। কিছুটা সিঁদুর উড়ে এসে পড়লো একাংক্ষীর সিঁথি তে। সেই মুহূর্তেই একাংক্ষী হাসছে, কাঁদছে, খুব আনন্দ পেয়েছে মনে হচ্ছিল। ওর হাতের রঙিন কাপড়টা দিয়ে নিজের মুখ ঢাকলো।
সাধু মন্ত্র থামিয়ে বললেন, "এবার তুই বিদায় নে মা। তোর ভালবাসা স্বার্থক হয়েছে। তুই ভালো থাকিস মা।" একাংক্ষীও কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, "আমি চলি বাবা, তুমিও ভালো থেকো।" বলেই পুরুষ অবয়বের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। কিছু দূর যেতেই একাংক্ষীর শরীরটা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল, আর দুটো ছায়া শরীর অসংখ্য তারার মতো ঝিকমিক করতে করতে আকাশের দিকে উবে গেল।
পরের দিন অনেকটা বেলায় ইক্ষান ও একাংক্ষী সাধু বাবার কাছে গিয়ে দেখলো তিনি খুব অসুস্থ। একটু জলের জন্য ছটফট করছেন। ইক্ষান সামনে রাখা মাটির কলসি থেকে জল ঢেলে খাইয়ে দিল সাধু কে। তারপর একাংক্ষী নিজের কোলে তার মাথাটা রেখে বললেন, "তোমার কি হয়েছে বাবা?"
সাধু অনেক কষ্টে চোখ খুলে বললেন, "আজ আমার কাজ শেষ মা। এবার বিদায়। তুই স্বামী, সংসার নিয়ে সুখী হ। ভালো থাকিস মা।"
ইক্ষান বললো, "আচ্ছা, সাধু বাবা একটা প্রশ্ন জানতে ইচ্ছে করছে, বলবো?"
-- "তার দরকার নেই বাবা, তোর প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি। আমি কে সেটাই জানতে চাস তো? আমি হলাম সেই পুরোহিত, যার কন্যাকে নিয়ে এত ঘটনা ঘটলো। আমার একাংক্ষী মা একটা শরীর খুঁজছিল। তোর স্ত্রী কে পেয়ে ওর ইচ্ছে পূরণ হলো। ওকে ওর পছন্দের পাত্রের সাথে বিবাহ দিয়ে ওকে মুক্তি দিলাম। এবার আমারও মুক্তি। তোরা ভালো থাক।"
কথা শেষ করতে না করতেই সাধুর শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একাংক্ষীর কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন তিনি।

