নমস্কার। আমার নাম সায়ন রায়। বেনারসের মূল বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও চাকরি পেলাম সুদুর হরিয়াণা রাজ্যের ফারিদাবাদ শহরে। ভাল চাকরি, তার উপর আবার সেই সময় দেশে চাকরির বাজারও মন্দা। তাই আর দুরত্ব কে তোয়াক্কা না করে 'দুগ্গা দুগ্গা' বলে বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থানের উদ্দেশ্যে।
আমি যখনকার কথা বলছি, তখন ফারিদাবাদ শহরটা তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। না ছিল অত শহুরে জাঁকজমক, না ছিল এত ট্র্যাফিক-জ্যামের হাঙ্গামা। তখনকার ফারিদাবাদ ছিল ছোট, কিন্তু সুব্যবস্থিত আর ছবির মতো সাজানো গোছানো। এইখানে প্রথমবার এসে আমার শহরটা কে একটা গতানুগতিক 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ' বলেই মনে হয়েছিল। শুধুমাত্র 'বাটা চক' ছিল এই শহরের মুখ্য বাজার, বেশ কিছু দোকানপাট ইত্যাদি ছিল। এছাড়া এইখানে তেমন বিশেষ কোনও আকর্ষণ আমি খুঁজে পাইনি। বেশিরভাগ মানুষই বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত। এইখানকার লোকেরা যথেষ্ট গম্ভীর প্রকৃতির....অচেনা লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে নারাজ। কাজ থেকে ফিরে ঘরে এসে নিজের ক্লান্ত শরীরটা কোনওমতে বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। অবশ্য এহেন আচরণে তাঁদের কোনও দোষ নেই। কেই বা টানা আট ঘণ্টা ধরে ফ্যাক্টরি-শিফ্টে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসে আপনার সাথে খেজুরে আলাপ সারবে, বলুন?
এইখানে এসেই ভাগ্যক্রমে একটা ভাল বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেলাম। বাড়িওয়ালা অন্য এক বাড়িতে ভাড়া থাকেন, তাই ভাড়াটে-বাড়িওয়ালার সেই চিরাচরিত সংগ্রাম বাঁধারও কোনও ঝঞ্ঝাট নেই। ভাড়াও খুব বেশী কিছু নয়। সবই পছন্দসই, তবে বাড়িটার প্ল্যানটা একটু অদ্ভুত ধরনের। একটাই ঘর, কিন্তু বেশ বড়সড় আর উন্মুক্ত। খুব ভালো হাওয়া-বাতাস খেলে। চারদিকে চারটে বড়-বড় জানালা আছে। দুটো দরজা আছে; একটা উত্তর দিকের সদর দরজা, আর একটা তার উল্টো পিঠে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে। এই দক্ষিণের দরজাটা খুললে সামনে একটা ছোট সমতল উঠোন মতো পড়ে। এই উঠোনটা পার করলেই সামনে রান্নাঘর। ধার্য করা হল যে আমরা তিনজন মিলে বাড়িটা ভাড়া নেব। আমি, সান্যাল বাবু আর অমিয়।
আমি আর অমিয় সমবয়সী, কিন্তু সান্যাল বাবু আমাদের থেকে অনেকটাই বড়। তাই আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক ঠাট্টা ও খুনসুটি করে থাকলেও, তাঁকে বড় একটা ঘাঁটাতাম না।রান্নাবান্নার কাজটা বলতে গেলে অমিয় একা হাতেই সামলে নিত। ছেলেটা ঘরোয়া কাজে অত্যন্ত পটু হওয়ায় আমাদের কোনও চিন্তাই ছিল না। দিনের বেলায় কাজ, রাতে এসে গল্পগুজব আর ছুটির দিনে এদিক-ওদিক বেড়াতে যাওয়া....বেশ ভালই কাটছিল আমার কর্মজীবন।
কিন্তু আমার এই নিশ্চিন্ত, সুখের জীবনে একদিন ছন্দপতন ঘটল। খবর পেলাম যে সান্যাল বাবুর বিয়ের তিথি নির্ধারিত হয়েছে এই মাসেরই শেষের দিকে। কোলকাতায় তাঁর বাড়িতেই অনুষ্ঠানটা হবে। হারামজাদা অমিয় ব্যাটা নাচতে-নাচতে কোলকাতা পালাল তার সোহাগের 'সান্যাল দা'র বিবাহে যোগ দেবে বলে। কিন্তু আমার এমনই দুর্ভাগ্য, যে অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও কম্পানি থেকে আমায় কোনও ছুটিই দিল না। ফলে আমার দুই রুমমেট পাড়ি দিল কোলকাতায়, আর আমি একরাশ বিরক্তি ও একাকীত্ব নিয়ে পড়ে রইলাম এখানেই।
সময় কাটতে দেরী লাগে না। স্যানাল বাবু আর অমিয় চলে যাওয়ার পর পাঁচ দিন গড়িয়ে গেছে। এতদিনে আমি একটু-একটু করে অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে উঠেছি। হাত পুড়িয়ে রান্না করতে আর নিজের বানানো সেই যৎপরানাস্তি অখাদ্য খাবার খেতে নেহাত মন্দ লাগছে না। আর যাই হোক্, এদের দুজনের না থাকায় নিদেনপক্ষে আমি নিজের জন্য কিছু স্বতন্ত্র সময় তো পেয়েছি। এই নিজস্ব স্বাধীনতাটা কে এই ক'দিনেই আমি অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছি। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর ঘরে এসে সোফায় বসে নিরিবিলিতে এক কাপ কফি খাওয়া বা কোনও পছন্দের বই পড়ার আনন্দই আলাদা। এই সময়টা সম্পূর্ণ ভাবে আমার নিজের, আমার আপন।
এইভাবেই একদিন বাড়ি ফিরে বেশ জমিয়ে এক পেয়ালা কফি আর বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক' নিয়ে বসেছিলাম। কাপে চুমুক দিতেই বাইরে গুরু-গুরু ডাক শুনতে পেলাম। যাঃ বাবা! জানালার কাছে এসে দেখি, কোত্থেকে দলা-দলা গাঢ় নীলবর্ণ মেঘপুঞ্জ এসে গোটা আকাশটা কে আচ্ছাদিত করে তুলেছে। এখন ডিসেম্বর মাস; এইখানে প্রতি বছরের মতোই ঠাণ্ডাটা এইবারও ভীষণ জাঁকিয়ে পড়েছে। এই সময় হরিয়াণায় বড় একটা বৃষ্টি-বাদলা হয় না। কিন্তু আজকের ছবি দেখছি একদমই ভিন্ন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি নামল। আর ঠিক তার সাথেই হয়ে গেল লোডশেডিং। চমৎকার....এ যে দেখছি গোদের উপর বিষফোঁড়া! বর্ষার রুদ্র-রূপ দেখে বুঝলাম যে আজ রাতে আর কারেন্ট আসারও কিছুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তাই আর বেশী সাত-পাঁচ না ভেবে, নৈশভোজ সেরে শোবার উপক্রম করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমের সমুদ্রে তলিয়ে গেলাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। একটা 'খুট্' করে শব্দ হতেই আমার চটকা ভেঙে গেল। ঘড়িতে সময় দেখি, রাত দেড়টা। বিছানায় উঠে বসলাম। বাইরে বৃষ্টির তোড় আরও বেড়েছে। ইতিউতি দেখতে-দেখতেই হঠাৎ আমার চোখ গিয়ে পড়ল সামনের জানালার দিকে। দেখি একটা কালো মতো ছায়ামূর্তি জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চকিতে চাইতেই সে এক নিমেষে সরে গেল। ভয়ে আমার শরীর কাঠ হয়ে গেল। হায় ভগবান! শেষে কি ফাঁকা বাড়িতে চোর-টোর ঢুকল নাকি? আমি এখানে সম্পূর্ণ একা ও নিরস্ত্র, আমায় খুন করে রেখে গেলেও কেউ টের পাবে না। মাথায় নানা দুশ্চিন্তা খেলে বেড়াতে লাগল। বলাই বাহুল্য, ঘুমের বারোটা অনেক আগেই বেজে গেছে। নাঃ, আর ঘুমানো যাবে না। উঠে একটা মোমবাতি জ্বালালাম। খুব তেষ্টা পেয়েছে....এক গ্লাস জল নিয়ে সবেমাত্র মুখে তুলেছি; আচমকা একটা বিকট শব্দে আমার হাত থেকে স্টীলের গ্লাসটা সশব্দে খসে পড়ল।
দুম্....দুম্....দাম্....দাম্....দমাস্....দমাস্....
শব্দটা আসছিল উঠোনের দিকের সেই দক্ষিণমুখী দরজার দিক থেকে। ঠিক যেন কেউ আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে খিল-কপাট ভেঙে ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে। আমি প্রস্তরপ্রতিমা হয়ে বসে থাকলাম। না....এটা বাতাসের ধাক্কা হতেই পারে না। কেউ যেন পাঁচটা আঙ্গুলের মুষ্টি পাকিয়ে দরজায় প্রবলতম করাঘাত করছে। এইটা আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যে এটা চোর-ছ্যাঁচোরের কাজ নয়। যতই হোক্, চোর তো আর চুরি করতে এসে মাঝরাতে দরজা কিলিয়ে পাড়া জাগাবে না! এইটা অন্য কিছু....আরও বেশী ভয়ানক, আরও বেশী হিংস্র। এইভাবে বসে থাকলে হবে না। এমনকরে পিটিয়ে চললে এই কাঠের দরজা আর বেশীক্ষণ টিকবে না। এর আগেই আমাকে কিছু একটা করতে হবে....এখান থেকে এই মুহূর্তে পালাতে হবে আমায়। মোমবাতির স্বল্প আলোয় কোনওমতে হাতড়ে-হাতড়ে আলমারির ভিতর থেকে সান্যাল বাবুর একটা পুরনো ছাতা বের করলাম। বেরোবার শুধু একটাই উপায়:- উত্তরের দিকের সদর দরজাটা। গলার পৈতেটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ইষ্টনাম জপ করতে লাগলাম। দক্ষিণের দরজায় এখনও সেই অশুভ, অমঙ্গলকারী সত্তাটি অনবরত আঘাত করে চলছে। আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে সটান সদর দরজা পার হয়ে এসে পড়লাম বড় রাস্তায়। পেছন থেকে কানে তখনও ভেসে আসছে সেই রক্ত জল করা দুম্-দুম্ শব্দ।
একেই এই উত্তাল বারিধারা বর্ষণ, তার উপর ডিসেম্বর মাসের হিমেল হাওয়া....একে কি আর সান্যাল বাবুর মান্ধাতা আমলের ছাতা রুখতে পারে? কিন্তু ঘরের ভীতরে ঘাপটি মেরে বসে থেকে, বাইরের সেই রহস্যময় বিভীষিকার সাথে সাহচর্য করার চাইতে এই কষ্ট অনেক বেশী সুখকর! অবশ্য এখন আমার প্রধান সমস্যা হল
এই যে; আজ পুরো রাতটা আমি কাটাই কোথায়? অনতিদুরেই হরিয়াণা রাজ্য সড়ক পরিবহনের বাস ডিপো আছে। ব্যস্ত জায়গা, সারারাত ধরে ওখানে লোকের আনাগোনা লেগেই থাকে। সিদ্ধান্ত নিলাম, রাতটা কোনওমতে ওইখানে কাটাব, সকাল হলে যা হয় একটা কিছু দেখা যাবে। যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। সেই উন্মাদ বৃষ্টির সঙ্গে মোকাবিলা করতে করতে এগিয়ে চললাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
ভোরের আলো ফুটতেই চোখ কচলে উঠে পড়লাম। যতই ঘুমানোর চেষ্টা করি না কেন, কিন্তু একটা সরকারি বাস ডিপোর ভাঙাচোরা 'ওয়েটিং রুম'এর ভিতরে পাতা বেঞ্চে শুয়ে কি আর বাড়িতে শোবার আনন্দটা পাওয়া যায়? হাতমুখ ধুয়ে এসে বাইরে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে সুর্যোদয় দেখতে দেখতে মনের হারানো বল কিছুটা হলেও ফিরে পেলাম। কিঞ্চিৎ হাল্কা জলযোগ করে, আবার পা বাড়ালাম বাড়ির পথে।
পাড়ায় ঢুকতেই আমার প্রতিবেশিনী, শ্রীমতী শর্ম্মার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। হাতে এক পেয়ালা চা বা কফি নিয়ে, তিনিও তার বাড়ির সামনের একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন বোধহয়। আমার দিকে নজর পড়তেই হাঁক পাড়লেন-
"আরে....সায়ন বাবু যে! তা এত সক্কাল-সক্কাল এইদিক পানে কি মনে করে আসা হয়েছে শুনি? প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন বুঝি? "
"ওই আর কি," কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম, "লাইট এসেছে কি?"
"আর বলবেন না, বৃষ্টির দুর্যোগ খানিক আগে থেমে গেলেও কারেন্ট এখনও আসেনি। শুনলাম নাকি চৌমাথার মোড়ে বসানো ট্রান্সফর্মারটা পুড়ে গেছে। মেরামতের কাজ চলছে বটে, কিন্তু লাইট আসতে সময় লাগবে। রাতে ভাল করে ঘুমই হল না।"
কাল রাতের কথা উঠতেই একটা মতলব আমার মাথায় এল। শ্রীমতী শর্ম্মা তো এইখানে থাকছেন প্রায় বছর দশেক হল। ওনাকে কালকের ঘটনার সম্বন্ধে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? হয়তো কোনও কাজের কথা বেরিয়ে পড়লেও পড়তে পারে। বাজিয়ে দেখতে আর ক্ষতি কি?
"আচ্ছা মিসেস শর্ম্মা, এই পাড়ায় কি চোরের উপদ্রব আছে নাকি?"
আমার এই আকস্মিক ও অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না শর্ম্মা গিন্নি। আমতা আমতা করে বললেন-
"এতদিন এই পাড়ায় আছি, কখনও একটা চামচে চুরি হওয়ার খবরও আজ অবধি পাইনি। কেন বলুন তো? আপনার কি কোনও জিনিস হারিয়ে গেছে?"
"না। তবে কাল রাত্রে প্রায় দেড়টা-দুটো নাগাদ কেউ আমার বাড়ির দরজা পেটাচ্ছিল।"
"কোন্ দরজা?"
"উঠোনের দিকের দরজাটা।"
দেখলাম আমার এই কথা শোনা মাত্রই শর্ম্মা গিন্নির ফর্সা মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে।
"আরে ও কিছু না," উনি কথা ঘোরানোর ছলে বললেন, "হাওয়া-টাওয়ার শব্দ পেয়েছেন বোধহয়।"
এবার আমার ভীষণ রাগ হল। খানিকটা চীৎকার করেই বললাম-
"আপনি কি আমায় এতটাই অবুঝ ভাবেন যে আমি বাতাসের ধাক্কা আর দরজায় কিল মারার শব্দের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাব না? আপনি নিশ্চয়ই কিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।"
বেগতিক বুঝতে পেরে শ্রীমতী শর্ম্মা কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বলে উঠলেন-
"কিছু মনে না করলে কি আপনি একটু ভিতরে আসতে পারবেন? এইসব কথা এইখানে বলাটা ঠিক নয়....বুঝতেই তো পারছেন, কথা পাঁচ কান হতে সময় লাগে না।"
বুঝলাম, কড়া করে ধমক দেওয়ার ওষুধটা ভালই ধরেছে। তাই আর কোনও বাক্যব্যয় না করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম।
আমাকে বসতে বলে শ্রীমতী শর্ম্মা আমার জন্যে চা আনতে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে আমার হাতে কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন-
"আমি আপনাকে যা বলতে চলেছি, আপনার হয়তো তাঁর পুরোটাই অবিশ্বাস্য বা পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হবে। কিন্তু এই ঘটনাটা একদমই সত্যি। আর একটা কথা, আপনি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলবেন না যে এই ঘটনার কথা আমি আপনাকে জানিয়েছি। কারণ আপনার বাড়িওয়ালা বারম্বার আমাদের অনুরোধ করেছেন যে আমরা যেন এই রহস্য কাউকে ফাঁস না করি। এতে ভাড়াটে পেতে যেমন অসুবিধা হবে, বাড়ির দুর্নামও হবে তেমনই। কিন্তু আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মতো, তাই আপনার প্রাণরক্ষা করাও আমার দায়িত্ব বটে।"
"কিচ্ছু চিন্তা করবেন না মিসেস শর্ম্মা, আপনি শুধু আমায় সত্যি ঘটনাটি বলুন।"
"শুনুন তবে," গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, "আজ থেকে প্রায় বছর চারেক আগেকার কথা। তখন আপনার বাড়িওয়ালা সপরিবারে এই বাড়িতেই থাকতেন। বেশ সুখের সংসার ছিল তাঁদের। কিন্তু পরে কার যে কুনজর লেগেছিল ওই পরিবারে....একদিন আপনার বাড়িওয়ালা এবং তাঁর স্ত্রীর মধ্যে কোনও এক ব্যাপার নিয়ে তুমুল অশান্তি বাঁধে। তখনকার মতো ঝগড়াঝাঁটি মিটে গেলেও, কর্তা হয়তো গিন্নি কে রাগের মাথায় এমন কোনও কথা বলেছিলেন যার ক্ষোভ গিন্নির মনে থেকে যায়। সেই রাতেই ওই দক্ষিণের উঠোনে আত্মহত্যা করে সে....গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ে মরেছিল বেচারি। সেই রাতটাও ছিল কালকের মতোই ঝড়-জলের রাত। এই ঘটনার পর কর্তা হয়তো যথাযথ ভাবে তাঁর স্ত্রীর শ্রাদ্ধশান্তি করাতে পারেননি। তাই অভাগিনী বউটার আত্মাটা মুক্তি পেল না। শত হোক্, অপঘাতে মৃত্যু তো। সেই জন্য এই ঘটনার পরেও ওঁকে মাঝেমধ্যেই দেখা যেত, বিশেষ করে বর্ষার রাতে....আলো না থাকলে।"
একটানা বলার পর শ্রীমতী শর্ম্মা আমার দিকে চাইলেন। আমার আতঙ্কিত মুখ দেখে একটু স্মিত হেসে বললেন-
"ও কারোর কোনও ক্ষতি করেনা সায়ন বাবু। কিন্তু একটা গৃহস্থ বাড়ির উপর একটা অতৃপ্ত প্রেতাত্মার ছায়া জড়িয়ে থাকাটা মোটেই মঙ্গলজনক নয় বলে আমি মনে করি। তাই আপনি আমার পরামর্শ মেনে নিন, ওই অভিশপ্ত বাসা আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্যাগ করুন। আর পারলে আপনার দুই বন্ধুদেরও তাই করতে বলুন।"
"তা আর বলতে!" একটা ফাঁপা হাসি হেসে বললাম, "আচ্ছা মিসেস শর্ম্মা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এইবার আমি উঠি।"
নিজের বাড়িতে ফিরে এসে খাটের উপর ধপ্ করে বসে পড়লাম। পাংশু মুখে উঠোনের দরজাটার দিকে তাকালাম। না, দরজা অক্ষতই আছে। তবে এতক্ষণে আমার কাছে এইটা বোধগম্য হল যে কাল রাতে জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছায়াময়ী নারীমূর্তিটি আসলে কে ছিল। এবং আমার এটা বুঝতেও বাকি রইল না যে কেন আমার সহৃদয় বাড়িওয়ালা তাঁর নিজস্ব বাড়ি থাকা সত্ত্বেও, পরের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে বসে থেকে মাসে- মাসে ভাড়া গুনছেন।
যাক্ গে, আমি আর বেশী সাহস দেখালাম না। কিছুদিনের মধ্যেই অন্য একটা বাড়ি দেখে, আমার লটবহর নিয়ে ওখান থেকে চুপচাপ সটকে পড়লাম।
**** সমাপ্ত ****