আরশি
আরশি
১
অনেক দিন থেকেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে পিয়া। নয় নয় করেও, তিন চার মাস তো হবেই। প্রথম প্রথম নিজের মনের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিলেও, সম্প্রতি যা শুরু হয়েছে, তাতে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত না হয়ে পারছে না। অনিরুদ্ধের অফিস থেকে আসামের লাকওা-তে বদলি হওয়ার পর, পিয়া’রা এই ভাড়া বাড়িতে এসে উঠেছে প্রায় মাস আষ্টেক হবে। প্রচুর রোদ্দুর-হাওয়ায় ভরপুর বিশালবহুল এই ফ্ল্যাটটা একনজরে পছন্দ হওয়ার মতন। শান্ত নিরিবিলি আর গাছগাছালিতে ঘেরা পাড়াটাও যেন একটুকরো নন্দনকানন।
সমস্যা হচ্ছে পিয়াদের এপার্টমেন্টের প্রায় সমস্ত ফ্ল্যাট খালি। একমাত্র এক-তলায় এক বয়স্ক দম্পতি থাকেন। বাকিরা সবাই কাজের খাতিরে অন্যত্র চলে গেছে। তাই এতদিন এখানে এসে থেকেও, সেভাবে কারুর সাথেই আর বন্ধুত্ব করে ওঠা হয়নি পিয়ার। তাছাড়া বাড়িতে সংসারের ঢের কাজ নিয়ে ব্যস্ততা লেগেই থাকে। টুকটাক বাজারহাট, দোকানপাট ছাড়া বেরোনো হয়না। এখানে লোকজন পার্কে অথবা নিজেদের বাড়িতে আড্ডা জমায় না। শান্তশিষ্ট এরকম এলাকাতেও যেন সবার সর্বক্ষন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ততা। এখানে গোধূলির শেষে, ক্ষনিকের সন্ধ্যার পরেই ঝুপ করে নেমে আসে রাত। চারদিকটা ঘিরে ধরে নিকষ কালো চাদরে। অনিরুদ্ধের আবার মাঝেমধ্যেই রাতে ডিউটি পড়ে, সন্ধ্যে ৭টা থেকে সকল ৭টা। অগত্যা, দরকার ছাড়া আর বিশেষ বেরোনো হয়ে ওঠে না পিয়ার। সারাদিন ভূতের মতন ঘরে থেকে থেকে, আজকাল নিজেকেই কেমন যেন ভূত বলে মনে হয় ওর।
হয়ত এই একাকিত্বের প্রতিক্রিয়াতেই ওর মস্তিষ্ক ওর সাথে মস্করা শুরু করলো, ভাবে পিয়া। হঠাৎ হঠাৎ, কাদের কথোপকথন শোনা যায় ফাঁকা ফ্ল্যাটের ভেতরে। এতটাই জোরে যে মনে হয় পাশের ঘর থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। কিন্তু গিয়ে দেখে কই, কেউ তো কোথাও নেই! বাইরের রাস্তাগুলোও খাঁ-খাঁ করে অপরাহ্নের একলা আকাশতলে। খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসে শীতল পশ্চিমি হাওয়া, নিয়ে আসে আসন্ন সূর্যাস্তের রং আর শেষ বিকেলের গন্ধ। হ্যাঁ, গন্ধই বটে! কি একটা অব্যক্ত ঘ্রাণ যেন মাঝেমধ্যেই ওর নাসিকেন্দ্রিয় ছেয়ে ফেলে। সেটা ফুলের, ভ্রমরের না মেঘের জলরাশির, বোঝা ভারি দুষ্কর। প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে এইসব জায়গায়, বৃষ্টির ঘনঘটায় আর চারদিকের সবুজে। একে অপরের সাথে জড়িয়ে, কত আনন্দের রং নিয়ে ধরা দেয় পিয়ার দৃষ্টিতে। এসবের মধ্যে যে বেঠিক কিছু থাকতে পারে, সেটা তো কল্পনারও বাইরে। তাই অলীক ভাবনার কুয়াশা এক ঝটকায় তাড়িয়ে দেয় পিয়া মন থেকে।
কিন্তু আবার মাসখানেক আগে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটলো। খুব লোডশেডিং হয় এখানে। কিছুক্ষন পরে কারেন্ট চলে আসে, কিন্তু যখন যায়, এক্কেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। সেদিন রান্নাঘরে পিয়া সবে পালং-শাকের চচ্চড়িটা বসিয়ে আটা মাখতে নিয়েছে, ওমনি ফুস্ করে আলোটা গেল নিভে। কোনোরকমে এক-হাত আটা সামলে মোবাইলটা হাতড়াতে থাকে। ডাইনিং টেবিলেই রাখা আছে, কিন্তু এই অন্ধকার হাতড়ে এতো বড়ো রান্নাঘর পেরিয়ে পৌঁছাতে গিয়েই তো এখানে সেখানে ধাক্কা লাগার জোগাড়। উফ, ডাইনিং টেবিল-টা এতো দূরে লাগছে কেন? ওই তো, মোবাইল থেকে নোটিফিকেশন আসায় একটা ছোট্ট নীল আলো জ্বলছে-নিভছে। ঐটুকু পৌঁছতেও যেন এই দেওয়াল, সেই দেওয়াল হাতড়াতে হচ্ছে, এক্কেবারে ঘন অন্ধকার!
অবশেষে ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বালল পিয়া। আলো জ্বলে উঠতেই, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এটা তো সেই পশ্চিম মুখী ঘরটা। এখানে ওরা থাকেনা, ঘরটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এই ঘরে কোনো আসবাবপত্র রাখার প্রয়োজন হয়নি কখনো। ঘরের চার দেওয়াল, জানলা, দরজা, মেঝে ছাড়া ঘরটা সম্পূর্ন ফাঁকা। তাহলে এখানে এলো কি করে ফোনটা? কোন আসবাবের ওপর থেকেই বা তুলল? ওই তো, পশ্চিমের জানলা দিয়ে এক আধলা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। এবার একটা স্পষ্ট গলার আওয়াজ ভেসে এলো
‘খেতে দিয়ে দাও পিয়া, অনেক রাত হলো যে’
ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল পিয়া’র শিরদাঁড়া দিয়ে। এ যে অনিরুদ্ধের গলা! কিন্তু সে তো বাড়িতে ফেরেনি এখনো। গোটা ফ্ল্যাটে তো ও নিজে ছাড়া আর কেউ উপস্থিত নেই। তাহলে? কে ডাকলো ওকে নাম ধরে? এই ঘরে আর এক মুহুর্তও থাকা ঠিক হবে না। ভারী পায়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল পিয়া আওয়াজটা অনুসরণ করে। ওদের বেডরুমের দিক থেকে এলো কি? ওই তো, কোণাকুণি ভাবে এই পশ্চিম দিকের ঘর থেকেই দেখা যাচ্ছে, উল্টোদিকে ওদের পুবমুখী ঘরের বারান্দার দরজা খোলা। কখন হাওয়ায় খুলে গেছে দরজাটা – অবাক হলো পিয়া। না কি কেউ খুলে দিয়েছে? আয়নায় যেন কিছুর একটা আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। মোমবাতির? অনিরুদ্ধ কি সত্যিই এলো তবে ঘরে? অন্য চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকেছে? ওই কি এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়েছে? কিন্তু তাই বা হবে কি করে? দরজা খোলার আওয়াজ তো পায়নি পিয়া। তখনই আয়নায় একজনের প্রতিফলন দেখতে পেলো। কে ওটা? অসাড় হয়ে আসছে পিয়া’র হাত-পা।
‘অনি?’ ক্ষীণ কণ্ঠে পিয়া ডাকতেই, ওই প্রতিফলিত চেহারাটা মুখ তুলে তাকাতে গেল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কারেন্ট চলে এলো আর ধাঁধিয়ে গেল পিয়া’র চোখদুটো।
অবিশ্বাস্যভাবে পিয়া দেখলো, ও ডাইনিং-রুমে দাঁড়িয়ে আছে, তবে কোনো ঘরে কেউ নেই। পুবের বারান্দা থেকে আচমকা ঝড়ো হাওয়া বয়ে আসাতে, দড়াম করে ওদের ঘরের দরজাটা গেল বন্ধ হয়ে আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ঘরের কলিংবেলটা বেজে উঠলো। অস্ফুটে, একটা ভয়ের আর্তস্বর বেরিয়ে এলো পিয়া’র গলা থেকে।
দরজা খুলতেই অনিরুদ্ধের চিন্তিত মুখটা দেখা গেল।
'কি হলো পিয়া? সব ঠিক আছে? এইমাত্র একটা জোরে আওয়াজ পেলাম মনে হলো ঘরের ভেতর থেকে?'
'পুবের ঘরের দরজাটা আবার হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল' কোনোমতে বললো পিয়া। ওর গলা তখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ততক্ষনে জুতো খুলে ঘরে ঢুকে অনিরুদ্ধ বলতে শুরু করেছে
'এর একটা ব্যবস্থা করতে হচ্ছে... হওয়ায় ধাক্কা খেয়ে খেয়ে দরজাটা এবার ভাঙবে'
'স্টপার তো পাল্টানো হয়েছে এই কয়েক মাসে তিনবার, থাকে কই? অন্য কিছু ভাবতে হবে' মিলিয়ে যায় পিয়ার কথাগুলো।
'হুম' আনমনে সায় দেয় অনিরুদ্ধ।
রাত্রে ঘরে শুতে যাওয়ার আগে, পিয়া লক্ষ্য করলো আয়নার উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা কালো শিসের দাগ। তেলের লণ্ঠন অথবা মোমবাতির থেকে তাপ লেগে দেওয়ালে ছাপ পরলে যেমন হয়, ঠিক তেমনটা। কে এসেছিল ওদের ঘরে?
২
সেই রাত্রের পর থেকে মাসখানেক কেটে গেছে নির্বিঘ্নে। পিয়ার এখন সেদিনের কথা মনে পড়লে নিজের ওপরেই সন্দেহ জন্মায়। হয়তো ভুল দেখেছিল সেদিন। কিন্তু গত সপ্তাহে আবার আরেক কান্ড ঘটল। দোকান থেকে কতগুলো মাসকাবারির জিনিস না আনলেই নয়। তখন প্রায় বার বেলা। অনিরুদ্ধ অফিসে থাকলে, বেরোনোর আগে বেডরুমের দরজা বরাবরই বন্ধ করে বেরোনো অভ্যেস পিয়ার, সে যত অল্পসময়ের জন্যই হোক না কেন। সেই দরজা টানতে গিয়েই আঁতকে ওঠে ও। ওটা কি লাগানো দরজার ফ্রেমে? কব্জা, স্টপার এসব তো কোনকালেই ভেঙে গেছে। কিন্তু ফ্রেমের গায়ে একটা মোটা খয়েরি রঙের পেরেক পোঁতা। আর তার থেকে ঝুলছে একটা ধাতব চাকতি। দরজাটা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই, আটকাচ্ছে চাকতিতে বারবার। পেরেকটাও টেনে খোলা যাচ্ছে না। এ জিনিস তো ও লাগায়নি! তবে কি অনিরুদ্ধ লাগালো? না, তাও কি করে হয়? এটা লাগাতে গেলে যে পরিমাণ আওয়াজ হতো, ও ঠিকই টের পেতো। তাছাড়া অনিরুদ্ধ ওকে না বলে এরকম কাজ করার মানুষই নয়।
তবুও, একবার জিজ্ঞাসা করতে তো হবেই! তাই, সন্ধ্যেবেলায় অনিরুদ্ধ ফিরতেই, দরজার চাকতিটা দেখিয়ে ওকে চেপে ধরলো পিয়া
'এই যে মশাই, এটা তোমার কাজ?' চোখ পাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল পিয়া।
'না তো!' অবাক অনিরুদ্ধ।
'তাহলে কে লাগালো শুনি?' ফের বলল পিয়া।
'নির্ঘাত তুমিই লাগিয়েছ, তারপর ভুলে গেছ। হাওয়ায় দরজাটা যা ধাক্কা খায়, সেটার থেকে বাঁচাতেই কি এই বুদ্ধি বের করলে?' উল্টে জিগ্যেস করে অনিরুদ্ধ।
'দেখো, আমি লাগাইনি' নাছোড় পিয়া, 'এটা তাহলে কি ভূতে লাগিয়েছে বলছ?'
'ওরেবাবারে, একেবারে ভূতে চলে গেলে? তবে বলতে হবে, সে তো ভারি হিতৈষী ভূত! আমাদের আশেপাশে থেকে আমাদের জন্য কত ভাবে! যা আমরা পারলাম না, সেই কাজটা সে করে দেখিয়ে দিলো, কি বল?'
'ইয়ার্কি মেরো না তো!' বিরক্ত হয় পিয়া, 'আজ সকালেও এটা ছিল না আমি জানি। বেলায় বেরোনোর আগে ঘর বন্ধ করতে গিয়ে দেখি এটা ঝুলছে'
'কি যে বলো! গত এক সপ্তাহ ধরে ঝুলছে ওটা আর তোমার চোখে আজ পড়ল? আমি তো ভেবেছিলাম তুমিই লাগিয়েছ তাই এই নিয়ে আর কিছু ভাবিনি বা বলিনি তোমাকে' ভ্রু সঙ্কুচিত হয়ে এবার অনিরুদ্ধের।
'কি?' ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে পিয়া। ওর মাথাটা কি বিগড়েছে? না কি অনিরুদ্ধ ওর সাথে মস্ত বড়ো মজা করছে?
কিন্তু পরমুহূর্তেই অনিরুদ্ধ পিয়ার সামনে চিন্তিত মুখে ঝুঁকে পরে বলল
'তোমার শরীর ঠিক আছে তো পিয়া? মনে হচ্ছে বড্ডো কাজের চাপ যাচ্ছে। চল তো একটা দিন কোথাও থেকে একটু বেড়িয়ে আসি'
কি আর কাজের চাপ, ভাবে পিয়া। নিরলস মস্তিষ্কের আলো-আঁধারী যে এসব ঘটাচ্ছে না, অথবা ওর একাকীত্ব বোধ ওর অবচেতন মনে প্রভাব ফেলছে না, তার কি কোনো প্রমাণ আছে? আজকাল নিজেকে আর কেন ভরসা করতে পারছে না ও? তাও, এত বড় ভুল হবে? বিস্মিত হয় পিয়া। কিন্তু আর কিছু বলে না মুখ ফুটে।
৩
সপ্তাহান্তে ওরা একটা দিন কাছেপিঠেই ঘুরে বেড়িয়ে, সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির ফেরার পথে রওনা হয়।
পাড়ার মোড়ে ঢুকেই পিয়া বলে ওঠে
'যাহ্, সবজি বাজার তো কিছুই নেই, ডিম নেবো ভেবেছিলাম, একদম ভুলে গেছি'
'আচ্ছা তুমি এগোও, আমি পাড়ার দোকান থেকে ডিম নিয়ে আসছি' অনিরুদ্ধের কথায় পিয়া আশ্বস্ত হয়ে, পৌঁছে যায় ওদের ফ্ল্যাটে। দুপুরে মনে হয় খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে এদিকটায়। জায়গায়-জায়গায় জল-কাদা জমে আছে খানা-খন্দে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কখন যে ভুল করে ছাদে উঠে গেছে, খেয়াল করেনি পিয়া। যাচ্চলে, এই তো তিনতলা পেরোলো! চারতলায় ওদের ফ্ল্যাটের ঘর, তার ওপরে তো ছাদ। কখন যে চারতলা পেরিয়ে গেছিল, খেয়াল করেনি। আসলে আজ বহুদিন পর, প্রকৃতির হাওয়া-বাতাসে মনটা ভরপুর হয়ে ছিল। আজকের বেড়ানোর ভাবনাতেই মশগুল হয়ে হয়তো বেখেয়ালে উঠে গেছে ওপরে। নীচের তলায় নেমে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরের চাবি ঘোরাতে, দেখে চাবি ঘুরছে না, দরজাও খুলছে না! ক্যাঁচক্যাঁচ করে অনেক্ষন ধরে চেষ্টা করার পর, হাঁফ ধরে যায় পিয়ার।
'এই ফ্ল্যাটে নতুন এসেছেন দিদিমনি?' আচমকা একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চমকে পেছনে ঘুরে তাকায় পিয়া।
'আরে রঘু, তুমি এখানে?' সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় পিয়া ছেলেটার দিকে। রঘু আগে পিয়াদের রোজকার খবরের কাগজ দিত, কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে, গত ছয় মাস ধরে ও আর আসছে না। ওর জায়গায় এখন অন্য একটা ছেলে আসছে।
'হ্যাঁ একটু কাজে এসেছিলাম, কিন্তু আপনি এখানে...' রঘুর পাল্টা প্রশ্নে অবাক হয় পিয়া।
'আমরা তো এখানে সেই কবে থেকেই আছি! তোমার কথার মানেটা কি?!' সামান্য বিরক্তি পিয়ার কণ্ঠস্বরে।
'কিন্তু… আপনারা তো এই ফ্ল্যাটে থাকতেন না! পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন তো, ওই একদম কোণের দিকে, পুকুর ঘেঁষা ফ্ল্যাটটায়? কবে ঘর বদলালেন জানতে পারলাম না তো!'
একটু থতমত খেয়ে যায় পিয়া। সত্যি তো! এটা কোন ফ্ল্যাটে আসলো ও? তাই কি দরজা খুলতে পারছে না? অবিকল একইরকম তো দেখতে ফ্ল্যাটে ওঠার সিঁড়ি আর প্রতিটা দরজা। কিন্তু ও তো শেষের এপার্টমেন্টেই ঢুকলো। তবুও আর একটাও কথা না বাড়িয়ে, হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো পিয়া। বাইরে এসে চারিপাশটা আর ওদের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে লক্ষ্য করে বুঝল, এটাই ওদের ফ্ল্যাট। আচ্ছা উটকো লোকের পাল্লায় পড়েছিল তো! নিজের মনকে কড়া ধমক দিল পিয়া। লোকটা নির্ঘাত মস্করা করছিল আর ও কি না নিজের ফ্ল্যাটের সামনে থেকে চলে এলো!
একতলার বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোক ওকে এমন উৎক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখে, জিজ্ঞাসা করলেন
'কি হলো মামনি? খুব চিন্তায় পড়েছ মনে হচ্ছে?'
'না মানে... মেসোমশাই...' কি বলবে ভেবে পেল না পিয়া। পাগলামি করছে না কি ওর সাথে কোনো মস্ত ষড়যন্ত্র হচ্ছে? কাকে কি বলবে ও? কে বিশ্বাস করবে ওর কথা? অনিরুদ্ধ এখনও এলো না।
সাত-পাঁচ ভাবছে, হঠাৎ বয়স্ক লোকটা সামনে ঝুঁকে, বারান্দার গরাদ দুটো হাতে ধরে, তার ফাঁকে মুখটা রেখে হিসহিসিয়ে বললেন
'আমি জানি মামনি। এ বড়ো কষ্টের। কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউ বুঝবে না' ঘোলাটে চোখদুটো যেন অস্বাভাবিক রকম জ্বলজ্বল করছে তাঁর।
ফের বললেন 'আমরা যেখানে আছি, সেই অবস্থানে এমন কিছু অনভিপ্রেত শক্তি আছে, যে কারণে আমরা তাদের দেখতে পেয়ে যাই। তাদের সাথে আমাদের অযাচিত সহাবস্থান ঘটে যায়। কিন্তু সে যে সবার সাথে হয়না, সবাই অনুভব করতে পারেনা'
'কারা মেসোমশাই? কি বলছেন? কাদের সাথে সহাবস্থান?' এবার আরও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে পিয়া।
ওকে সামনে ডেকে, কানে ফিসফিসিয়ে কি যেন একটা বলেন বৃদ্ধ লোকটা। ছিটকে পিছিয়ে যায় পিয়া।
এমন সময় পেছন থেকে বয়স্ক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসেন
'কি গো, কার সাথে বন্ধুত্ব করছো?'
পিয়াকে সামনে দেখে, অমায়িক হেঁসে ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসতে সাহায্য করলেন। তারপর পিয়াকে বললেন
'বয়স্ক মানুষটা কি বলেছে কে জানে, তবে তুমি যেন কিছু মনে করো না মামনি। উনি বহুবছর ধরে অ্যালজাইমার্সে রোগাক্রান্ত। কিছু মনেই থাকে না বেশিরভাগ সময়। এমনকি আমি কে, সেটাই ভুলে যায় মাঝেমধ্যে!'
ততক্ষনে পিয়া একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়েছে।
'ভেতরে আসবে মামনি?' সদয় হয়ে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।
'না মাসিমা, আজ নয়। তবে একদিন এসে ঠিক আলাপ করে যাবো' মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় পিয়া।
'বেশ, তাই ভালো। আমরা বুড়ো বুড়ি তো বাড়িতেই থাকি। যখন মন চায় চলে এসো, খুব ভালো লাগবে'
চলে যেতে গিয়েও আরেকবার ঘুরে দাঁড়ায় পিয়া
'আচ্ছা মাসিমা, আপনারা এখানে কত বছর আছেন?'
'তা ত্রিশ বছরের বেশি হবে মা'
রাত্রে সেদিন আর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না পিয়ার। এতদিন তো জানতো যে একতলার প্রবীন ভদ্রলোক বৈজ্ঞানিক মানুষ, এখনো যথেষ্ট কাজপাগলা আর কর্মদক্ষ। ও তো এটাও শুনেছিল যে তাঁরা দিল্লি থেকে এখানে এসে উঠেছেন মাত্র বছর দশেক আগে, তাহলে ভদ্রমহিলা কেন বললেন যে তাঁরা ত্রিশ বছর ব্যাপী দীর্ঘ সময় ধরে এখানে আছেন? তাছাড়া, ভদ্রলোক যে সাংঘাতিক দাবিটা করলেন, তার কোনো মাথামুন্ডু বোঝা যাচ্ছে না। বৈজ্ঞানিক হয়ে এতো বড়ো অলীক কথা বললেন কিভাবে?
নিজের চারপাশটা আরও ভালো করে খেয়াল করতে শুরু করলো পিয়া। কথাগুলো শোনার পর থেকে, অবচেতনে অথবা হয়তো সত্যিই, নানারকম আওয়াজ পেতে থাকলো ও প্রতিনিয়ত। আগে যেগুলো মনের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিত, সেই আয়াজগুলোই ক্রমে আরো প্রকট হতে লাগলো ওর কর্ণেন্দ্রিয়ে…
'পিয়া... ও পিয়ারে, আয় মা, বেলা বেরিয়ে যায় যে' অবিকল ওর মায়ের ডাক, কিন্তু তিনি যে এখন নিঃসন্দেহে কলকাতায়…
'মামনি, আমার জামাটা খুঁজে পাচ্ছিনা' একটা ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠস্বর, কিন্তু এমন কেউ তো ওর জীবনে ওর নিজের হয়ে কোনদিন আসেনি…
'পিয়া, আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে এই দেখো কি এনেছি তোমার জন্য' অনিরুদ্ধের গলা না? কিন্তু সে তো এখন অফিসে…
'পিয়া রানী, দাদু কে আবার সেই কৎবেলের আচারটা বানিয়ে খাইয়ো তো একবেলা' কোন ছোটবেলায় শেষবার দাদুর এই ভরাট ডাক শুনেছিল, মনে পড়ে না পিয়ার…
এরকম টুকরো কথোপকথন স্পষ্ট ভেসে আসে পিয়ার কানে, যখন তখন, একাকী ফ্ল্যাটে। অথচ নিস্তব্ধ সেই ঘরগুলোয় ও ছাড়া যে আর কেউই নেই! তবুও, এই মায়াপরিপূর্ণ ডাকগুলোর জন্য ও আজকাল উদগ্রীব হয়ে থাকে, বড়ো আসক্তি এসে যায় এদের প্রতি, না চাইতেও। ফাঁকা হাওয়ায় হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চায় এই মনের মানুষগুলোকে…
পিয়ার মন আজকাল ওকে জানান দেয়, ওরা সবাই আছে আশেপাশেই, অত্যন্ত ব্যস্ত তাদের প্রতিনিয়ত জীবন আর তাদের সাথে তাদের আহুত পিয়াকে নিয়েও। কিন্তু সেই পিয়া যে ও নয়, ঠিক যেমন ওর পরিচিত একতলার বৈজ্ঞানিক ভদ্রলোক সেদিনের সাক্ষাৎ হওয়া অ্যালজাইমার্সে আক্রান্ত ভদ্রলোক ছিলেন না, ঠিক যেমন সেদিনের রঘু ওদের খবরের কাগজওয়ালা রঘু ছিল না, ঠিক যেমন ও পেরেক আর চাকতিটা ওদের দরজায় লাগায়নি...
৪
'এ কি, আয়নায় এমন ফাটল ধরল কিভাবে? দরজার চাকতিটাও এমন বিশ্রীভাবে ভেঙেচুরে গেল কেন?' অনিরুদ্ধের অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়া আর মুখ ফুটে বলতে পারল না অপরাহ্নে ঘটে যাওয়া কাণ্ড। ওকে কি ওর অনি বিশ্বাস করবে আদৌ? একতলার সেই ভদ্রলোক তো সতর্ক করে দিয়েছিলেন আগেই, তাই এবারেও মৌনতা অবলম্বন করল পিয়া।
সেই নিরালা দুপুরে সবে একটু চোখটা লেগে এসেছে, ঝড়ো হাওয়ার আগমনে মনে হলো এক্ষুনি জানলা-দরজা না দিলেই নয়। আর সেটা করতে গিয়েই, আয়নাতে চোখে পড়লো সেই দৃশ্যটা...
পিয়া নিজে বিছানায় বসে আছে, সামনে একটা বছর সাতেকের মেয়েকে পড়াচ্ছে একমনে
ঝড়ের আগমনে মেয়েটা জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বলল
'মামনি, আবার ঝড়! ওরা আবার আসবে না তো?'
'না পিহু সোনা, এই আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। কেউ আসবে না, কেউ ক্ষতি করবে না আমার রাজকন্যার, আমি তো আছি'
কিন্তু পিয়া তো নিঃসন্তান! যে এসেছিল, সে তো না এসেই চলে গিয়েছিল… তবে ওই পিহু মেয়েটা কে?
আয়নার পিয়া ফের সামনে বসা একটা লোককে বলল
'কাল সত্যনারায়ণ পুজো করিয়ে নেব অনি, তুমি আর পিছিয়ো না ব্যাপারটা'
হতবাক পিয়া আয়নায় দেখল, একটা আরামকেদারায় ওর অনি গা এলিয়ে খবরের কাগজ দেখছে আর বলছে
'ওগো পিয়া, ওরাও তো সমান্তরাল দুনিয়ার আমরাই। ভুলবশত দুই মাত্রার সংঘর্ষণে আমরা ওদের দেখে ফেলি মাঝেমধ্যে। থাকুক না ওরা ওদের মতন! ওরাও তো তুমি-আমিই!'
'তুমি থামো! একতলার মেসোমশাইয়ের কোনো মাথার ঠিক আছে? কি বলতে কি বুঝিয়েছেন আর তুমিও তাই নিয়ে বসে আছো? জানোই তো উনি কবে থেকে স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন! শোনো, এসব অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আমি একদম বসবাস করতে পারবো না, এই বলে রাখলাম'
'পিয়া মা, অ পিয়া মা, জানালাটা ভেজিয়ে দে মা, জলের ছাঁট আসে যে ঘরে'
অন্য ঘর থেকে নিজের মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে, পিয়া আয়নায় আরও ভেতরে উঁকি দেয়। ওই তো... পশ্চিমের ঘরটা তো বেশ বিছানা, আলনা, আলমারিতে সুসজ্জিত! কিন্তু আয়নার বাইরে, নিজের পেছনে ওর দুনিয়ার ওই আসল ঘরটা যে খাঁ খাঁ করছে!
আয়নায় আরেকটু ঝুঁকে দেখতে গিয়ে, হঠাৎ পিয়া চোখাচোখি হয় আয়নার ওপ্রান্তে বাস করা নিজের অবয়বের সাথে। চিৎকার করে ওঠে আয়নার ওপার... মূহুর্তের মধ্যে সজোরে একটা ফুলদানি ছুড়ে দেয় সে কাঁচে।
পিয়ার সামনের চেনা তবু অচেনা আরশিটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে না, চওড়া একটা ফাটল দেখা দেয় মাত্র। দড়াম করে ঘরের দরজাটা বন্ধ হতে গিয়েও আটকে যায় সেই চাকতিতে। প্রবল ধাক্কায় ভেঙে পরে চাকতি।
নিজেরই কান্নার সুর নিজের না, অন্যের গলায় শুনতে পায় পিয়া
'ও কে অনি? কি চায় ও? অতিপ্রাকৃতিক শক্তিদের সাথে থাকা কি আমাদের রক্তমাংসের মানুষদের পোষায়? নিয়ে চলো আমাকে এখান থেকে তুমি। ফিরে যাই চল কালকেই আমরা কোলকাতায়'
'আচ্ছা আচ্ছা দেখছি আমি, এবার একটু শান্ত হও তো' আশ্বস্ত করার সুর ভেসে আসে ফাঁকা ঘর থেকে।
দৃষ্টির সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সমান্তরাল বিশ্বের ছায়া সঙ্গীরা।
'কি গো? কখন থেকে ডাকছি, কি ভাবছো এতো?' অনিরুদ্ধের পিয়াকে ধরে ঈষৎ ঝাঁকানোয়, সম্বিৎ ফেরে ওর।
'বলো' কোনোমতে বলে পিয়া।
'তোমার চোখ-মুখ এতো ফ্যাকাশে লাগছে কেন? শুনলে কি বললাম? কালই আমাদের কোলকাতায় ফেরত চলে যেতে হবে, ওপরমহল থেকে এমার্জেন্সি অর্ডার এসেছে, ওখানে সিনিয়র অফিসার প্রবালবাবুর কাছে রিপোর্ট করতে হবে'
'সত্যি?' একরাশ মেঘের জমায়েত সরে গিয়ে এক চিলতে রোদ্দুর উঁকি মারে পিয়ার মনে।
'হ্যাঁ গো সত্যি! চলো ব্যাগপত্র গোছাই'
'কোলকাতায় ফিরে আর কোনো আয়না লাগাবো না বাড়িতে' আনমনে বলে পিয়া।
'আয়না আর আলাদা লাগাতে হবে না, আমাদের বেডরুমে আমাদের বহুকাঙ্খিত যা সুন্দর একটা দেওয়াল জোড়া আয়না লাগানোর ব্যবস্থা করেছি না! উফ্, চমকে যাবে তুমি দেখলে' অনিরুদ্ধর হাসতে থাকা আনন্দোজ্জ্বল মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে পিয়া।
সমাপ্ত।।
