সূর্যেন্দু গায়েন

Horror Thriller Others

3  

সূর্যেন্দু গায়েন

Horror Thriller Others

আঁশ পেত্নীর কীর্তি

আঁশ পেত্নীর কীর্তি

7 mins
635


বৃষ্টির সুভারম্ভে কারুর মন খুশিতে ভরে উঠুক বা নাই উঠুক,আমার মন আনন্দাসৃত হয়ে ওঠে | সারাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হবে, বাস্তু-ভিটার মেটে জলের স্রোত, বয়ে যাবে সো..জা পুকুরের এক কোনায়, সেই জলস্রোতের বিপরীতে কই, মাগুর,সিঙ্গি এমনকি শোল মাছ যখন লাফিয়ে ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করে,আমি ওৎ পেতে বসে থাকতাম মাছগুলোকে ধরবার উদ্যেশে | এমন সময়ে মাছ ধরা আমার একপ্রকার নেশা ছিল | দিনের বেলা মাছ, যতটা না ওপরে ওঠার চেষ্টা করে, তার থেকে বেশি রাতে চেষ্টা করে | চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার,হাতে টর্চলাইট, শক্ত পোক্ত একটা লাঠি,ছাতা মাথায় ও কোমরে একটা থলে গুঁজে মাছ ধরার নেশায় বেরিয়ে পড়তাম, অবশ্যই দাদুকে লুকিয়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে | উৎসাহ প্রদানে কেবল আমার কাকু তৈরি থাকতেন |

সেবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল | আমার মন উসখুস করছে কখন যাবো মাছ ধরতে | সেন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি মেঠো রাস্তার দিকে, যদি টর্চের আলো চোখে পড়ে তাহলে বুঝে নেবো নির্ঘাত আমার মতো কোনো এক মাছ শিকারি চুপি চুপি শিকারে বেরিয়ে পড়েছে | এমতাবস্থায় মনটা খুব উতলা হয়ে যেত, ইচ্ছে করতো এক ছুটে পুকুর পাড়ে ঘাপটি মারি | রাত প্রায় আটটা বাজে | দাদু ঘুমোতে যাবেন যাবেন করছেন | যেই বিছানা ধরলেন অমনি আমি পেছনের দরজা দিয়ে দিলাম ছুট | পুকুরের পূব কোনায় পাড়ার মাছ পেত্নী বলে যাকে এক ডাকেই চেনে, রমেন দাদু ঠিক হাজির হয়েছে আমার আগে | আমাকে দেখে রাগে গজগজ করতে লাগলেন, পাছে মাছ শিকারে আমি ভাগ বসাই |

যা ভেবেছিলাম তাই | কই মাগুরের লাফালাফি ওপরে ওঠার জন্য, আর আমি অতি সন্তপর্নে একটা একটাকে মাছ ধরে ব্যাগে রাখছি | অনেক মাছ কুড়িয়ে,বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে এসে কলসির মধ্যে জল ভরে, তাতে জ্যান্ত মাছগুলো ছেড়ে দিলাম, কারণ একদিনে সব মাছ না মেরে জ্যান্ত রাখলে বেশি ক'টা দিন খাওয়া যাবে |

পরের দিন দুপুরে দাদু যখন খেতে বসলেন,পাতে কই মাছের ভাজা ও মাগুর মাছের ঝোল দেখার সাথে সাথে আনন্দিত না হয়ে, মুখ ঝামটা দিয়ে আমায় ডাক পড়লো,কেন আমি রাতে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলাম তার কৈফিয়ত দিতে হবে |

আমি ভয়ে ঘরের ভিতর থেকে বেরোনোর সাহস পেলাম না | আমার ছোট কাকুও দাদুর পাশে বসে খাচ্ছিলেন, দাদুর গম্ভীর বাক্যবান থেকে বাঁচাতে তৎক্ষণাৎ মুখ খুললেন কাকু, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,'ও মাছ ধরতে যায়নি,আমি আজ সকালে বাজার থেকে কিনে এনেছি | খাও বাবা খাও, ভাজা কই মাছটা কি সুস্বাদু | এ যাত্রায় বাঁচা গেল |

দুপুর বেলা ঘুমোনোর সময় দাদু আমাকে ডেকে বললেন আমার কাছে শুয়ে পড়, একটা ঘটনা শোনাবো তোকে, তারপর তুই আর কোনোদিন মাছ ধরতে অন্তত রাতে বেরোবি না |

ভয়ার্ত মুখ-চোখে,দাদুর কাছে শুয়ে,কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম | মনোযোগের সহিত গল্প শোনার চেষ্টা করলাম |

দাদু গল্প বলা শুরু করলেন........

"আমি তখন ছোট ছিলাম | আমি আর তোর ছোট দাদু, আমাদের দুজনেরও খুব নেশা ছিল মাছ ধরবার | ঐ যে আমাদের ছোটো পুকুর আছে,একসময় তাতে প্রচুর জংলা মাছ, রুই,কাতলা থাকতো | আমি আর তোর দাদু জাল ফেলে মাছ ধরবো বলে আগের দিন রাতে কথা বলছিলাম | হঠাৎ বাড়ির সদর দরজায় কেউ খট খট করে চলে গেল | আমরা দুজন বাইরে বেরিয়ে দেখি কেউ নেই, ভাবলাম হয়তো কুকুর বা শেয়াল হবে | ঘরে ঢুকে দুজনে দরজার শিকল তুলে ঠিক করলাম কাল সকালে সূর্য ওঠার আগে পুকুরের মাছ ধরে কাছেই হাটে নিয়ে যাবো বিক্রির জন্য | যার ঘুম আগে ভাঙবে সে ডেকে তুলবে, তারপর এক সাথে মাছ ধরতে যাওয়া হবে | দুজনে ঘুমোতে গেলাম |

শেষ প্রহরের জোৎস্নার আলোয়, বাইরে চারিদিক আলোকিত, মাঝে মধ্যে জোনাকির আনাগোনা জানান দেয় এটা নিশুতি রাত,সবাই সাবধান | ব্যাঙের ডাক আর কাল পেঁচার চিল্লানি'তে বোঝা যায় এখন নিশুতি রাত |

তোর ছোট দাদু ডাক দিল-'দাদা ওঠ ! ওঠ ! মাছ ধরতে যাবিনা? কখন ভোর হয়ে গেছে | তাড়াতাড়ি আয়, আমি পুকুরপাড়ে চললাম তুই জাল নিয়ে চলে আয় |

ঘুম ঘুম চোখে, তাড়াহুড়ো করে উঠে জালটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়লাম | বাইরে বেরিয়ে দেখি, জোৎস্নার আলোয় আলোকিত | টপ টপ করে সজনে ফুল ঝরে পড়ছে সজনে গাছের গোড়ায় |আঁকা বাঁকা সজনে গাছের ডাল গুলোর ছায়া নীচে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, জোৎস্না রাতে সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখলেই মনে শিহরণ জাগাবে |

পাশের বাঁশ বাগানের তলা দিয়ে,শিশির স্নাত শুকনো পাতার ওপর দিয়ে মচ মচ করে হেঁটে চলেছি | হালকা হওয়ায় বাঁশ গাছ গুলো এমনভাবে নড়ে উঠছিল যেন মনে হয় কেউ বাঁশ গাছের ডগায় লাফালাফি করছে |

ভয়ার্ত চোখে মুখে বাঁশ বাগান পার করে পূব দিকের পুকুর পাড়ে পৌঁছলাম | গিয়ে দেখি ভাইয়ের দেখা নেই | ডাক দিলাম তোর ছোট দাদুকে | তাতেও শুনলো না | এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, ঘন কুয়াশার আড়ালে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের নুইয়ে পড়া অর্জুন গাছের গোড়ায় কেউ একজন চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে | মনে শান্তি ফিরে এলো ভাইকে দেখে |

পুকুরে মাছের লাফালাফি অতি মাত্রায় বেড়ে গেছে | আমি ফটাফট জাল'টা ঠিক করে, পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ফেললাম | ততক্ষনে কুয়াশা যেন চারিদিক ঘিরে ধরেছে | কাছাকাছি কিছুই দেখা যাচ্ছেনা | জাল ভর্তি মাছ তুলে ভাইকে ডাক দিলাম মাছগুলো কুড়িয়ে রাখতে | নিমেষে চাদর মুড়ি দিয়ে ভাই ওপার থেকে এপারে হাজির,আর জালের সামনে বসে চট-পট মাছ গুলোকে তুলে থলেতে ভরছে | আমি অবাক হলাম,এত তাড়াতাড়ি মাছগুলো কি ভাবে খুলছে জাল থেকে | মুখটা ঢাকাই আছে | ঘন কুয়াশা ও শীতের জন্যে ভাই হয়তো মুখ ঢেকে চাদর মুড়ি দিয়েছে | জিগ্যেস করলাম তোকে খুব শীত করছে ? ভাই কোনো উত্তর না দিয়ে চটপট জাল থেকে দূরে সরে গেল | ভাবলাম হয়তো কথা বলছে না এই কারণে- যদি মাছ গুলো শব্দে এলো মেলো হয়ে জলের তলায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে না যায় | আমিও আর কথা না বাড়িয়ে জাল পরিষ্কার করে উত্তর-পূর্ব কোণের উদ্যেশে গেলাম এবং জাল ফেললাম | কিছু বড় ঠেকেছে জালে, বুঝেই ভাইকে ডাক দিলাম সাহায্যের জন্য | আমি যেদিকে, নিমেষেই সেদিকের পুকুর পাড়ে ভাই এসে হাজির | আবার অবাক হলাম,এত তাড়াতাড়ি কি ভাবে ওপার থেকে এপারে আসছে ? এক হাঁটু জলে নেমে জাল টেনে উপরে তুলছি দেখি মস্ত বড় কাতলা ঠেকেছে | আস্তে করে জালটা ওপরে তুললাম |

দেখলাম প্রায় দশ হাত দূরে ভাই কেমন লাফালাফি করছে | ভাবলাম হয়তো বড় মাছ পড়েছে তাই আনন্দ পাচ্ছে | বড় কাতলাটাকে আমার একার পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল হচ্ছিল,ছটফট করতে করতে মাছটা জলে পড়ে গেল | অমনি ভাই লাফ দিলো জলে কাতলা মাছটা ধরবে বলে | হাতে ব্যাগটা ছিল সেটাও নেই কেমন যেন জলের উপর অনায়াসে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের মাঝখান দিয়ে ওপারে চলে গেল |

ভয়ে চুপসে যেতে লাগলাম, মনে মনে ভাবলাম এটা আমার ভাই হতে পারেনা | নিশ্চই কোথাও গন্ডগোল হচ্ছে | আমি অতি সাবধানে জালের যে দড়িটা আমার হাতে বাঁধা ছিল সেটা খুললাম | আর এদিক ওদিক না তাকিয়ে দিলাম ছুট বাড়ির উদ্যেশ্যে | আমার পেছন পেছন সেই পেত্নীটাও ছুটছে | হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ির দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিলাম | এত রাতে কে টোকা দিচ্ছে জানতে চাইলো মা | আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম আমি ---- আমি গোপাল | মাছ ধরতে গিয়েছিলাম | তাড়াতাড়ি দরজা খোলো |

মা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে দরজায় খিল তুললেন | হঠাৎ বাইরে কে যেন কর্কশ আওয়াজ করতে করতে দরজায় সামনে থেকে কাঁদতে কাঁদতে মিলিয়ে গেল |

পুকর পাড়ের সমস্ত ঘটনা বাড়ির সকলকে জানালাম | ভাই ও ঘুম থেকে উঠে চলে এলো | ঘটনাটা শুনে সকলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো | আমি ভোর হয়ে গেছে ভেবে যখন উঠে গেছিলাম, ওটা ভোর নয় ওটা নিশুতি রাত ছিল | ভোর হতে তখনও দু ঘন্টা বাকি ছিল | তখনকার দিনে ঘড়ি ছিল না তাই রাত'টা আন্দাজ করতে পারিনি | তাছাড়া জোৎস্নার আলো এতটাই বিকশিত ভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে ছিল যে, ভোরের সমান আলো ফুটে উঠেছিল |

পরের দিন সকালে বাবা ঘুম থেকে উঠে জালটা তুলে নিয়ে এলেন, জালটার তন্ন তন্ন ছেড়া, আর পুকুর পাড়ে কাঁচা মাছের মাথা পড়ে রয়েছে, সাথে মাছের কাঁটাও পড়ে রয়েছে |

বাবা বললেন আমি এ যাত্রায় বেঁচে গেছি | আমার ভাইয়ের গলা নকল করে যে ডাকছিল, সে আঁশ পেত্নী ছিল | ছলনা করে ডেকে নিয়ে গেছিলো আমাকে | যত মাছ ধরছিলাম পেত্নীটা কুড়িয়ে ঘন কুয়াশার আড়ালে খেয়ে ফেলছিল | বড় কাতলার ওপর আঁশ পেত্নীর লোভ ছিল, তাই ওটাকে ধরবে বলে জলের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে, পেট পুরে মাছ খেতে না পেলে হয়তো আমাকেই মেরে ফেলতো | আমি মাছ না ধরে ছুটে পালিয়ে আসার জন্য রাগে জালটা ওই পেত্নী ছিঁড়ে ফেলেছে | পুকুর থেকে পালিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে গেছি |

সেদিন থেকে আমরা দুই ভাই আর মাছ ধরতে অন্ততঃ রাতে যাই না | সকাল হলে,লোকজন রাস্তাঘাটে বেরোলে তবেই যাই, এরপরও যদি তোর মাছ ধরতে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে, যাস | আমি আটকাব না |

দাদুর মুখ থেকে এ হেন হাড় হিম করা ঘটনা শোনার পর আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আর কোনোদিন এভাবে মাছ ধরতে যাবো না |

পরের দিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে আর কাকু বললো-'মাছ ধরতে যাবিনা আজ'? আমি হাত তুলে নমস্কার করে বললাম, 'ক্ষমা করো আমায়, আমার মাছ ধরার নেশা কেটে গেছে দাদুর থেকে গল্প শোনার পর | মাফ করো আমায় |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror