সূর্যেন্দু গায়েন

Inspirational Others

3.7  

সূর্যেন্দু গায়েন

Inspirational Others

কাঙাল রাজা

কাঙাল রাজা

6 mins
292



"ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" মহারাজ!

এ আমায় কেমন কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব দিয়েছেন? দিনে দিনে আমার প্রাণ সংশয় হয়। মনে হয় আমার প্রাণ স্পন্দন বেশি দিন নাই। মৃত্যু শিয়রে। যদি বেঁচে থাকি, তবে তা আমার পূর্ব পুরুষের সৌভাগ্য,আমার নয়। আমায় এ কর্ম যজ্ঞ থেকে বিরতি প্রদানে বাধ্য করুন মহারাজ। আমি জীবন ভিক্ষা চাইছি। আমার কর্ম জীবন হইতে অব্যাহতি চাই। দিনে দিনে আমার শত্রু বেড়ে চলে।

ভ্রু কুঞ্চিত,বিচলিত মহারাজ সাগ্রহে খাজাঞ্চি কে জিজ্ঞেস করলেন--"এ কি বলছেন খাজাঞ্চি বাবু!আপনি রাজ দরবারের কোষাগার বহু বছর দায়িত্ব সহকারে সামলেছেন। তাছাড়া আপনার প্রাণ সংশয়! এমন সংশয় আগে কখনো শুনিনি আপনারথেকে। আমি বিচলিত।আমি অস্থির। আমি আগ্রহী। বিস্তারে বলুন। সমস্যা সমাধানে ব্রতী। আমি মহারাজা। আমি রাজাধিরাজ। আপনার প্রাণ সংশয়,আমার প্রাণ সংশয় সমান"।

খাজাঞ্চি বাবু, কাতর স্বরে বললেন-"আপনি মহারাজা ছিলেন,রাজাধিরাজ ছিলেন,কিন্তু আপনি আজ রাজাও নন, মহারাজও নন এমনকি রাজাধিরাজ উপাধিটাও আপনার মুকুটেই শুধু আছে। প্রজার নজরে আপনি...

বলুন । বলুন খাজাঞ্চি বাবু। প্রজার নজরে আমার স্থান।

মহারাজ.. এ আমার শেষ ডাক আপনাকে "মহারাজ"।


বলুন--খাজাঞ্চি বাবু--

আপনি মহারাজ নন। আপনি কাঙাল রাজা। আপনি কাঙাল রাজা। আপনি কাঙাল রাজা..।

না..এ আমি কি শুনছি খাজাঞ্চি বাবু..

আমি কাঙাল রাজা!আমি কাঙাল রাজা। এ পরিণতি কিভাবে হলো।

একি!একি! চারিদিকে কোলাহল? এরা কারা চিৎকার করে? কাকে চায় এরা?এ কোলাহল কার বিরুদ্ধে? নাহ। নাহ। না.....

এ জনসমুদ্র রাজদরবারে দিকে ক্রমশ এগিয়ে। দাও, দাও,দাও সিপাহী। এগিয়ে দাও আমার বর্ম,ঢাল ও শান দেওয়া তরবারি। আত্ম রক্ষার্থে। আমি অস্থির। আমি অস্থির। আমি কাঙাল রাজা......। তৈরি হও সৈন্য সামন্ত। তৈরি হও। সম্মুখে শত্রু।

না......। না! না। না কাঙাল রাজা। নাহ! আপনি প্রজা পালক। আপনি প্রজা হিতৈষী। আপনি প্রজার দুঃখে দুঃখী হবেন। আপনি সুখ খুঁজে পাবেন প্রজার সুখে। আপনি এক্ষুনি বিরত হন,প্রজা সংহারে। এ দুঃসময় শুধু আপনার একা নয়। এ দুঃসময় সারা রাজ্য বাসীর। ধৈর্য্য আপনাকে ধরতে হবে মহারাজ। মৃতপ্রায় প্রজার বুকে খঞ্জনী চালানোর চেয়ে, নিজের ভুল ও নিজের মন্ত্রী সান্ত্রীর ভুলের মাশুল আগে গুনতে হবে আপনাকে। আপনার প্রজাগণ কেন আজ আপনার প্রতি এত বিরূপ,তার কারণ অনুসন্ধান করুন মহারাজ। আমি আপনার ধর্ম পত্নী। করজোড়ে আমার বিনীত আকুতি, আপনি নিরস্ত্র হন।

বিচিলিত মম হৃদয়,


ভয় হয় কাঙাল চিত্তে,

আমি রাক্ষস নই,

আমি নিয়োজিত প্রজা হিতে।।

খাজাঞ্চি বাবু। আপনার বিচলিতের কারণ আমায় বলুন। আমি জানতে চাই আপনি বিচলিত কেন?

মহারাজ! এ কক্ষ কারণ দর্শানোর উপযুক্ত নয়। একান্তে। নির্ভয়ে। আপনাকে সব বলবো। চলুন মহারাজ অন্তঃপুরে।

খাজাঞ্চি বাবু,আপনার ইচ্ছা শিরোধার্য। আসুন। আসুন অন্তঃপুরে। সেনাপতি, রাজদ্বার অবরুদ্ধ করো। আমি আজ বড় বিচলিত।

যথা আজ্ঞা কাঙাল রাজ। আমি শীঘ্র সুবন্দোবস্ত করছি। সিপাহী প্রস্তুত হও।

(জীবনে মহান যদি হতে চান,তাহলে লোভ,ক্রোধ,মোহ,মায়া,কাম বর্জন করুন। আপনার হিতে, সবার হিতে।)


ভাঙ ভাঙ ভাঙ তালা। রুদ্ধ দুয়ার অবারিত হোক। কাঙাল রাজার শাস্তি হোক। আমরা অর্ধাহারে। আমরা বুভুক্ষু। আমরা অত্যাচারিত। আমরা শোষিত। আমরা নিপীড়িত। আমরা কাঙাল রাজার দরবারে বিধানের অপেক্ষায়।

একি শুনি খাজাঞ্চি বাবু। আমার রাজ্যে প্রজা এত অসহায়! বাইরে অসহায় চিৎকার। চলুন খাজাঞ্চি বাবু,খুলুন কোষাগারের রুদ্ধ দ্বার। বিদূষক! ডাকো মন্ত্রী মন্ডলীর জরুরী সভা। রাজ দরবারে উপস্থিত হোক সমস্ত রাজ কর্মচারী। আজ ঠিক বেলা ঠিক দ্বিপ্রহরে।

আসুন আসুন আসুন কাঙাল রাজ। প্রবেশ করুন অর্থের ভাণ্ডারে।

একি! ভান্ডার শুন্য! দেখি দেখি,খোলো খোলো মোহরের বাক্স। খাজাঞ্চি বাবু! মোহর কোথায়?একি! স্বর্ণ ভান্ডার ফাঁকা! একি!রৌপ্যের বাক্স খালি! অর্থে সিন্দুকে তালা নেই কেন? বলুন খাজাঞ্চি বাবু। কে ঠগ তিনি, যে আমার রাজকোষ লুঠ করেছে?

সমস্ত ভান্ডার শুন্য! কোথায় গেল এত অর্থ? আমার হিসেব চাই খাজাঞ্চি বাবু। সিপাহী...খাজাঞ্চি বাবুকে বন্দী করো। অতিশীঘ্র হিসেব দাখিল করুন খাজাঞ্চি বাবু। হিসেব বিনা আপনি কারাগারে বন্দি থাকবেন। আমার রাজ কোষ শুন্য!

কাঙাল রাজ,আমি বন্দি হই, তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার পক্ষে, বক্তব্য পেশ করবার সুযোগ দিন। আমি সত্যের সন্ধানে ব্রতী। আপনি আমার কর্মস্থলের প্রধান। নিশ্চয়ই আপনি হিসেব চাইতে পারেন। আমাকে আজ দ্বিপ্রহরে সভাস্থলে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দিন। তবে এটুকু বলি কাঙাল রাজ-"ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় যেন না হয়"।


অনুমতি প্রদান করলাম। আপনি অবশ্যই সমস্ত হিসেব নিয়ে আসবেন। সাথে আপনার প্রয়োজনীয় মূল্যবান দলিল দস্তাবেজ। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়! চিন্তা মগ্ন কাঙাল রাজা।

যথা আজ্ঞা,কাঙাল রাজা মহাশয়।

ঠিক দুপুর দ্বিপ্রহরে,সভাস্থলে উপস্থিত হলেন,সমস্ত মন্ত্রী-সান্ত্রী, ছোট,বড় সকল সভাসদ। গ্রামের মোড়ল পর্যন্ত উপস্থিত হলেন।

নীরব সভাস্থলে। ক্ষনিকের মধ্যে উপস্থিত হলেন কাঙাল রাজা। কাঙাল মহারাজের পৌরোহিত্যে, সভার কাজ শুরু হলো। খাজাঞ্চি বাবুও উপস্থিত । সভাস্থলে তাঁর হাত কড়ি খুলে দেওয়া হয়।

বক্তব্য পেশ করবেন কাঙাল রাজা,মাথা থেকে স্বর্ণ খচিত মুকুট খুলে সিপাহীর হাতে দিলেন। সভা স্থল নিশ্চুপ।


বক্তব্য রাখছেন কাঙাল মহারাজ-"উপস্থিত সভাস্থলে সকল গুণীজন ও সুধীজনদের উদ্যেশ্যে বলি,আমরা সমবেত হয়েছি,জরুরি ভিত্তিতে। তা হয়তো সকল সভাসদের নিকট পরিষ্কার। বাইরে উন্মত্ত,বুভুক্ষু মারমূখী জনতার ঢল। এ বিষয়ে আগে থেকেই আপনারা অবহিত। খাজাঞ্চি বাবু, কয়েকদিন ধরে রাজ্যের কিছু কিছু বাড়ি ঘুরে এসেছেন। প্রজা কেন সুখে নেই তার বিস্তারিত বিবরণ আনার আদেশ ছিল আমার। এ বিষয়ে হয়তো আগে থেকে আপনারা উপস্থিত সভাসদগণ অবহিত ছিলেন না। আমি খাজাঞ্চি বাবুর মুখ থেকে শুনেছি,প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার কথা। প্রজাদের সহ্যের সীমা মাত্রাতিরিক্ত ছাড়িয়েছে। তাই রাজ্যের সমস্ত প্রজা তলে তলে সঙ্গবদ্ধ হয়ে,আমার বিরুদ্ধাচরণ করছেন। বাইরের মুখরিত ধ্বনি-"কাঙাল রাজা দূর হঠ"। এ হেন পরিস্থিতিতে আপনারদের সকলের মতামত অবশ্যই চাই। একে একে সকলে আপনাদের বক্তব্য লিখিত আকারে পেশ করুন। হাতে বেশি সময় নেই। আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাই।

নীরব,নিশ্চুপ সভাস্থল। সকলের মুখ গম্ভীর। কাঙাল রাজা অনুমতি ক্রমে ক্ষণিক প্রস্থান করলেন।


উপস্থিত সভাসদ ও মহা মন্ত্রীগণ একে অপরের মুখ চাওয়া চাই ছাড়া,আর কিছুই লিখতে পারলেন না।

এমন সময় কাঙাল রাজা সভাস্থলে পুনশ্চঃ উপস্থিত হলেন এবং প্রত্যেকের লিখিত পত্র একত্রিত নিয়ে চমকে উঠলেন।

এ কি! একি! আপনারা কিছুই মন্তব্য করেন নি! দেশে প্রজা আক্রমণাত্মক। প্রজা অভুক্ত। প্রজাদের স্বাধিকার হনন হওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ আসছে,আজ আপনার নিশ্চুপ! খাজাঞ্চি সাহেব... আপনার বক্তব্য পেশ করার কথা ছিল পেলাম না আমি।

এই নিন কাঙাল রাজা। আমার বক্তব্য আপনি বিবেচনার সহিত দেখবেন এবং আমাকে কারাগার জীবন হতে মুক্ত করুন।

গম্ভীর মুখে কাঙাল রাজা,খাজাঞ্চি বাবুর উপস্থাপিত সমস্ত বিষয় অক্ষরে অক্ষরে পড়তে লাগলেন,মাঝে মধ্যে বিচলিত হয়ে পড়ছেন আবার ভ্রু কুঞ্চিত করে কপাল চাপড়াচ্ছেন।

সুনির্দিষ্ট তথ্যের সাথে সমস্ত রিপোর্ট একত্রে কাঙাল রাজের সামনে পরিবেশন করেছেন খাজাঞ্চি বাবু।

পায়চারি করতে করতে সভা স্থলের চারিদিক ঘুরতে ঘুরতে কাঙাল রাজা প্রতি সভাসদের মুখ দর্শন করতে করতে আবার নিজের সিংহাসনে বসলেন।

তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন না......না.....না......


এ কেমন রিপোর্ট পেশ করলেন খাজাঞ্চি বাবু। আমার প্রতিটা সভাসদের নামে আপনার তথ্য ভিত্তিক অভিযোগ,এনারা প্রজা হিতের নামে রাজ কোষ লুঠ করেছেন। আমার রাজ্যের প্রজাদের সাহায্যের নাম করে সমস্ত রাজ সম্পদ নিজের নামে করেছেন আপনারা? এ কি করেছেন আপনারা?এ কি করেছেন আপনারা?এ কি... করেছেন আপনারা? রাজ সম্পদ লুঠ করে আপনারা হতদরিদ্র প্রজাদের বঞ্চিত করেছেন। আজ আমি কাঙাল রাজা। প্রজার নজরে আমি কাঙাল রাজা। আজ ঠগ কি বাছবো? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে যে। সেনাপতি.....

যথা আজ্ঞা মহারাজ। সৈন্যগণ! একে একে সকলকে বন্দি বানিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করো। রাজার আদেশ,শিরোধার্য।

এক সাথে সভাস্থলে রব ওঠে-"না.. মহারাজ,আমরা চোর নই। আমাদের মুক্তি দিন। আমরা নিরপরাধ।


রাজ দরবারের মূল ফটকের সম্মুখে, উপস্থিত প্রজাগণ মুখরিত ধ্বনি তুলছেন চোর... চোর... চোর। কাঙাল রাজা তুমি চোর। দূর হঠ কাঙাল রাজা।

বিচলিত কাঙাল রাজা,খাজাঞ্চি বাবুকে নিজের পাশে বসিয়ে অভয় দিলেন, তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না।


মুকুটহীন কাঙাল রাজা, প্রজার উদ্যেশে দরবারের মূল ফটকে উপস্থিত হলেন। প্রজার উদ্যেশ্যে বললেন-"শান্ত হন, শান্ত হন, শান্ত হন। আমি উপস্থিত মুকুটহীন কাঙাল রাজা,আপনাদের সম্মুখে করজোড়ে। আমার অপরাধ ছিল,আমার রাজ্যের মহামন্ত্রী এবং অন্যান্য সকল সভা'সদের অন্ধের মতো বিশ্বাস করবার ফল ভোগ করছি। তবে এটুকু বিশ্বাস করুন,আপনাদের কাঙাল রাজা,আপনাদের সেবায় সদা নিয়োজিত। আপনাদের সুখ দুঃখে আমাকে অবশ্যই পাশে পাবেন। সবার সামনে সেনাপতি কে আদেশ করছি, রাজ্যের যত জন রাজ কোষ লুঠে জড়িত,যত জন প্রজাদের ঠকিয়েছে,তাদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হোক। তাতে যদি ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয় হোক,ক্ষতি নেই। লুঠের সম্পদে যাঁরা অট্টালিকা তৈরি করেছে তাঁদের অট্টালিকায় গৃহহীন দের আশ্রয় দেওয়া হবে। যাঁরা দরিদ্র চাষির জমি খাজনার দায়ে লুঠ করেছে,তাদের জমি আবার দরিদ্র চাষিরা ফেরত পাবেন। আর যাঁরা খুন ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয়েছে,তাদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে,যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন জঘন্য অপরাধ করবার আগে সহস্রবার ভাবে।খাজাঞ্চি বাবুকে আপনাদের সমস্ত অভাব অভিযোগ জানান। ধীরে ধীরে আমি সবার সমস্যা সমাধান করার অঙ্গীকার করলাম।

উপস্থিত প্রজাগণ কাঙাল রাজার মুখ থেকে এমন কথা শুনে বিস্মিত হলেন। সকলে মিলে উচ্চারিত করলেন--"জয় মহারাজের জয়।জয় মহারাজের জয়।

জয় মহারাজের জয়।


কাঙাল রাজা বললেন-"আজ থেকে আমাকে দয়া করে মহারাজ বলবেন না। আমি কাঙাল রাজা হিসেবে থাকতে চাই।

উপস্থিত সকলে অবাক হলেন। সারা রাজ্য জুড়ে কাঙাল রাজা নামে পরিচিতি পেলেন।

কাঙাল রাজার যেমন কথা, তেমন কাজ। একে একে সব লুঠের সম্পদ উদ্ধার করে রাজ্যবাসীর হাতে ফেরালেন। যারা খুন ধর্ষণ করেছিলেন,তাঁদের সূলে চড়ালেন।

রাজ্যে খুশির হওয়া। প্রজাদের মুখে তৃপ্তির হাসি। শান্তির বাণী দিকে দিকে প্রচারিত। বারে বারে জয়ধ্বনি ওঠে কাঙাল রাজার নামে।

বহু মন্ত্রী, সভাসদ প্রজা ঠকানোর দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।

কাঙাল রাজা এখন নিয়ম করে প্রজা গৃহে প্রায়শ উপস্থিত হন। সবার অভিযোগ নিজের মুখে শোনেন এবং নিজে সুরাহা করেন,যাতে আবার না "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়"।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational