সান্তাক্লস
সান্তাক্লস
Jingle bells,jingle bells
Jingle all the way.
মনটা আজ ভীষণ উদাস। একা বসে সান্তাক্লস। আর কটাদিন পর খ্রিস্টমাসডে। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও সান্তা সাজে সাজতে হবে যে। দরকার নতুন দাড়ি, নতুন গোঁফ। সাথে লাল-সাদা সেই বিখ্যাত পোশাক। যে পোশাক আজীবন সন্তার পরিচয় বহন করে।
ছোট ছোট বাচ্চারা হয়তো সারা বছর অপেক্ষায় আছে , তাদের সাধের সান্তাদাদু এবছরও বরফের দেশ থেকে ঝুলি ভর্তি চকোলেট নিয়ে চমক দেবে মাঝরাতে। হয়তো এবছর অন্য ফ্লেভারের লজেন্স আনবে।
সান্তা সাজা জন্মসূত্রে। দাদু সেজেছেন, বাবা সেজেছেন আর রবার্ট খ্রিস্টিয়ানোও প্রতিবছর সাজছেন। সান্তাসাজাকে পেশা নাবলে নেশা বা পরম্পরা বলা চলে।
সান্তার স্ত্রীবিয়োগ অনেক বছর হয়েছে। একমাত্র ছেলে তার দশবছর বয়সে সেবারের প্রবল বন্যায় ভেসে যায়। পুত্র হারানোর জ্বালা প্রতিদিন সান্তাকে তাড়াকরে বেড়ায়। আজও সান্তা যেন ছেলের সেই ছোটবেলার ডাক শুনতে পায় "পাপা ও পাপা" -আমি এখানে। সান্তা মূহুর্তে ছুটে যায় জানালার ধারে, হয়তো ছেলে আসছে। নাহ ছেলের কোনো খবর নেই, কোথায় আছে কেমন আছে জানেননা, সরকারও জানেনা ছেলের খবর। হয়তো ঈশ্বর জানেন তার সন্তানের খবর। শরীর ও বয়সের ভারে আর পরিশ্রম করতে পারেননা। আপনমনে বিষন্নমাখা উদাসহৃদয়ে বাজিয়ে চলেছেন তাঁর বাঁশি। দূর থেকে যে কেউ তার মধুর বাঁশির সুর শুনলে একবার অন্তত থমকে দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে শুনবে।
পারিবারিক সম্পত্তি অনেক ছিল। বিগত কয়েক বছর ধরে নদীভাঙ্গনের ফলে পৈতৃকসম্পত্তি যা ছিল সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চাষযোগ্য যা জমি ছিল তাও নদীর গ্রাসে চলে গেছে। একটা ছোট্ট ঘর বানিয়ে একা থাকে সান্তা।
ডিসেম্বরে বরফের চাদরে যখন নদী জমে যায়। জানালাধারে বেড়ে ওঠা লতার ওপর যখন বরফ জমে যায় আর ওপারের ভেড়ার দল যখন এপারে এসে অবাধ বিচরণ করে একটু ঘাসের খোঁজে, তখন সান্তা বুঝে যায় সামনেই 25th ডিসেম্বর।
হাতে টাকা নেই, তাই সান্তার মন খুব ভার। আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে সান্তা। এবছর কিভাবে ছোটোছোটো বাচ্চাদের জন্য চকোলেট নিয়ে যাবে সে চিন্তায় মগ্ন সান্তাদাদু। সান্তা ঠিক করেছে এবার সে তার সাধের ভেড়াটা বেচে দেবে। তাই দিয়ে যা পয়সা পাবে অনেক চকোলেট কিনবে।
পরদিন সান্তা ভেড়াকে অনেক আদর করে। ভালো করে খাইয়ে কানেকানে বললো চল 'তোকে আর আমি রাখতে পারবোনা রে। আমার অপেক্ষায় অনেক ছোট ছোট শিশু। তাদের দরজায় আমাকে কড়া নাড়তে হবে এবছর। তাই তোকে এক নতুন মালিকের হাতে দিয়ে আসবো। তাকে বলে আসবো সেযেন তোকে আদর যত্নে রাখে। আর আমার হাতে অনেক টাকা হলে তোকে আবার নিয়ে আসবো।'
সেদিন ভেড়া হয়তো বুঝতে পেরেছিল তাকে সান্তা বিক্রি করে দেবে। তাই ভেড়াটা চোখের কোনে জল নিয়ে সান্তার কাঁধে মুখরেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সান্তাও সেদিন অনেক কেঁদেছিল। সে তার একমাত্র সঙ্গীকে আজ থেকে আর পাবেনা ।
ভেড়াকে নিয়ে বিকেলের দিকে চলে যায় অদূরের পশু বাজারে। ভেড়ার গলায় সান্তা প্রতীক হিসেবে নিজের ছেলের ব্যবহৃত বেল্ট বেঁধে দেয়।
ভেড়াটা দেখতে বেশ ভালো বলে একজন খদ্দের শখে ঘরে রাখবে বলে স্থির করেছেন। অনেক টাকা দিয়ে সান্তার থেকে কিনে নিলেন সান্তার শখের ভেড়া। সান্তা বললো-"স্যার, আপনি আমার ভেড়াটার একটু যত্ন নেবেন। ও আমার খুব শখের। খুব শান্ত। আপনাকে জ্বালাবে না। তবে একটা শর্ত আমার কাছে যেদিন অনেক টাকা হবে সেদিন যেন আমি আবার আমার ভেড়া আপনার থেকে নিতে পারি।" ভদ্রলোক বললেন-"ঠিক আমি বুঝতে পারছি এটা আপনার শখের ভেড়া, আপনি এই আমার ঠিকানা রাখুন, যেদিন আপনার টাকা হয়ে যাবে সেদিন আপনি এসে নিয়ে যাবেন।" বলেই উনি অনেক টাকা দিলেন সান্তাকে।
সান্তা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে তাই সেদিন অন
েক দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরল। সাথে বাজার থেকে ঝুলিভর্তি চকোলেট ও খেলনা কিনল। নিজের জন্য দাড়ি গোঁফ ও সুসজ্জিত পোশাক কিনে বাড়ি ফিরল।
সান্তা সাজা যে নেশা। আনন্দ দেওয়া ছোটছোট শিশুদের। পরদিন সান্তা স্নানকরে ঈশ্বরকে স্মরণ করে রেডি হয়ে আছে। রাত 12টার সময় চমক দিতে হবে ছোটছোট শিশুদের তাদের বহুকাঙ্খিত স্বপ্নপূরণ করতে সান্তা বেরলো খুদেদের উদ্দেশ্যে। চারিদিক বরফে ঘেরা, বরফে জমে যাওয়া ছোট্ট নদী পেরিয়ে সান্তা পাহাড়ের কোলে একটা গ্রামে প্রবেশ করলো।
যে ব্যাক্তি ভেড়া কিনে ছিলেন। তিনি বাড়ি গিয়ে ভেড়ার গলায় পুরোনো যে বেল্টটা পরানো আছে সেটা পাল্টে নতুন বেল্ট পরাতে গিয়ে দেখেন বেল্টের গায়ে অস্পস্ট কিছু লেখা আছে। তিনি দেখলেন একটা নাম লেখা, ফিরতে থাকে সেই ব্যাক্তির অতীত জীবনের দিনগুলির কথা। সেই বেল্টটা যে তাঁরই। সেই লেখাটা তাঁরই। স্কুল পরে যাওয়ার বেল্ট। ম্যাডাম বকেছিলেন বেল্টে স্কেচপেন দিয়ে লেখার জন্য। অর্থাৎ যিনি ভেড়া বিক্রি করেছেন , তিনি তাঁর পরিচিত কেউ একজন হবেন। ছোট ভেড়াটা যে ব্যক্তি কিনেছিলেন তিনি অন্য কেউ নন। তিনি সান্তার একমাত্র ছেলে। জলস্রোতে ভেসে যাওয়ার পর এক মাঝির দ্বারা উদ্ধার হয়েছিল নদীচরে। সেই থেকে সে তার অতীতস্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল। মাঝি তাকে লালনপালন করছিল। পড়াশুনা করিয়ে ছিল। আজ সান্তার ছেলে বিখ্যাত ব্যবসায়ী মানুষ। বাবার মতো তারও ভেড়ার শখ। নিজের ঠিকানা মনে পড়তে থাকে সান্তার ছেলের । পালন করা জেলে আর এখন বেঁচে নেই। সেই রাতেই নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা দিলেন আপন দেশে। সাথে বাবার শখের ভেড়াটাও নিয়ে গেলেন।
চারিদিক আলোময় জগৎ। প্রচুর লোক বেরিয়েছে খ্রিস্টমাস পালন করতে। মনে একরাশ আশা ও আনন্দ ভরে, সান্তার ছেলে এগিয়ে চলেছে আপন বরফের দেশে, নদীপাড়ের ঘরে। ভোর হয়ে এসেছে। সান্তার ছেলে পাহাড় ডিঙিয়ে, বরফে ঢাকা নদী পেরিয়ে নিজের ঘর খোঁজার চেষ্টা করছে। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদের আলো বরফের উপর পড়ে হীরের শোভাবর্ধন করছে। কোথাও বাড়িঘর নেই। দূরদূর শুধু বরফে ঢাকা। চোখে পড়লো সরু একটা রাস্তা। সান্তার ছেলে এগিয়ে গেল সেই পথ ধরে। কিছুদূর যাওয়ার পর বরফে ঢাকা ছোট্ট একটা ঘর নজরে এল। সেখানে গিয়ে তেমন কিছু পুরোনো স্মৃতি নাপেয়ে ব্যর্থ মনে সান্তার ছেলে ফিরে আসতে চাইছিল। কিন্তু ভেড়াটা তার নিজের ঘর চিনতে পেরে, কিছুতেই আসতে চাইছেনা। শুধু সেই বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সান্তার ছেলে শান্তমনে ভাবলো, ভেড়াটা এই বাড়ির দিকে যেতে চাইছে অর্থাৎ এখানেই তার পরিবার আছে। অনেক ডাকাডাকি করলো কিন্তু কেউ শুনলোনা। সান্তার ছেলে সারারাত সেখানেই বসে রইল। বাবা হয়তো কোন কাজে গেছেন। নিশ্চই সকালে ফিরবে। ওহ। আজ যে 25শে ডিসেম্বর। বাবা সান্তা সেজে কচিশিশুদের মনে আনন্দ দিতে গেছেন।
সেদিন ভোর বেলা বিষন্নমনে ঘরে ফেরার বাঁশি বাজাতে বাজাতে ফিরছে সান্তা, এমন সময় সান্তা তার শখের ভেড়ার ডাক শুনতে পেল। ক্ষনিকের মধ্যে সান্তা পরখ করলো এডাক তো তারই পোষা ভেড়ার। সান্তা ছুটে আসছে। সান্তার ছেলে বলে উঠলো "পাপা ও পাপা"--- আমি এখানে---। সান্তা পাগলের মতো ছুটছে বাড়ির দিকে। ছেলেও ছুটছে তার বাবার কাছে। সাথে শখের ভেড়াও ছোটে তার প্রভুর উদ্যেশ্যে। সেই বিরল মুহুর্ত যেন ঈশ্বরের দান। ঈশ্বর যেন এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন, মিলিত করলেন তিনটি প্রাণকে। সান্তা জড়িয়ে ধরলো তাঁর পুত্রকে নিজের বুকে। দূরে দাঁড়িয়ে ভেড়া পিতাপুত্রের এই মিলনদৃশ্য দেখে আবেগে আপ্লুত এবং বিরল দৃশ্যের সাক্ষী থেকে হয়তো নিজেকে ভাগ্যবান মনে করল। ভেড়া চোখদিয়ে জল ফেলে দিল। সান্তা সাধের ভেড়া ও ছেলেকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। ভোরের মনোরম পরিবেশে ঈশ্বর যেন স্বয়ং জেগে উঠলেন। গির্জায় গির্জায় সজোরে ঘন্টা বেজে উঠলো। গির্জাগুলি মুখরিত হল সেই গানে--
Jingle bells,jingle bells
Jingle all the way।।
মানুষ ঈশ্বরের আহ্বান করছে। সান্তাও নিজের চোখ বন্ধকরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল। সান্তারছেলে বাবাকে ফিরে পেয়ে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ। আজ সান্তার ছেলে বড় ব্যবসায়ী। বাবাকে নিয়ে নিজের ঠিকানায় ফিরল। সাথে শখের ভেড়াটাও গেল।