প্রেমের তৃষ্ণা
প্রেমের তৃষ্ণা
"ফিরে এসো এ বসন্তে,
ছুঁয়ে যেও হৃদয় জানালা |
মনে লাগে ফাগুনের আগুন,
মন খোঁজে সুখের নিরালা" ||
আকাশ সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলেজের আঙিনায় পদার্পন করেছে | প্রতিদিন কলেজ যেতে হয় ট্রেনে করে | চুপচাপ শান্ত স্বভাবের | কম কথা বলে | বর্তমানের ইন্টারনেট যুগে প্রায় সকলেই সোশ্যাল সাইটে বুঁদ থাকে | আকাশ'ও ব্যাতিক্রমী নয় | মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে ব্লু জিন্স, কাঁধে কলেজ ব্যাগ | সোশ্যাল মিডিয়ায় কত শত বন্ধু আমাদের ফ্রেন্ড লিষ্টে জায়গা পায় | আকাশের ও প্রচুর বন্ধু আছে, তার সোশ্যাল সাইট ফ্রেন্ড লিষ্টে | প্রায়ই অনেকের সাথে চ্যাটিং হয় |
সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে করতে একটা ছবিতে তার চোখ আটকায় | ছবিটার দিকে অনেক্ষন দেখতে থাকে আকাশ | কোনো এক বন্ধুকে অন্য কেউ ট্যাগ করেছে |
"শিহরিত প্রাণ ও মন,
বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে,
পশ্চিম আকাশের কোণে
রোদ মেঘের লুকোচুরি খেলার
মতো আকাশের মনে সেই 'ছবি'
বার বার লুকোচুরি খেলতে থাকে" |
বার কয়েক ছবিটা দেখার পর আকাশ সেই প্রোফাইলের সব কটা ছবি দেখতে থাকে, এক প্রকার নিশ্চিত ফেক প্রোফাইল নয় |
"মনের কোণে হাজারো প্রশ্নের মাঝে,
ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে
সারি সারি ঝাউ গাছগুলো যেন
ট্রেনের চেয়েও দ্রুত গতি নেওয়ার চেষ্টা করছে" |
তেমনি আকাশের মনটা'ও যেন দ্রুত বসন্তের
পড়ন্ত বিকেলে নিজেকে আর আবদ্ধ রাখতে চায় না |
দ্রুত গতির ট্রেনের ন্যায় একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ছুটে গেল সেই অজানা প্রোফাইলের দিকে |
মন ছুঁয়ে যায় হাজার অনুভূতির টুকরো টুকরো প্রেমেররক্ত কণাকে | হৃদয় মেলে ধরে রঙিন ডানার
বাহার,উড়ে যেতে চায় প্রেমের জগতে,হোক না সে পথ সহস্র যোজন দূর |
ক'দিন পর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট।
গহীন মনে ক্ষনিকের মধ্যে খেলে যায়
এক অদ্ভুত অনুভূতি,সে অনুভূতি হয়তো
অনেকটা-সমুদ্রের কিনারে ভোরবেলায়
দাঁড়িয়ে সূর্য্যের উদয় দেখে রোমাঞ্চিত
হওয়ার সমতুল্য |
তৃষার সোশ্যাল সাইট ওয়ালে কি লিখে প্রথম আলাপ সম্বোধন করবে ভেবে পায় না | গুগল ঘেঁটে সুন্দর একটা বন্ধুসুলভ কমেন্ট কপি করে পেস্ট করে তৃষার ফেসবুক ওয়ালে |
ধীরে ধীরে পরিচয় পর্ব কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হয় | দুজনের মনে এক গভীর বন্ধুত্বের ছাপ স্পষ্ট |
যে কথা যায় না বলা,
সে কথা হৃদয়ে রয়।
যে কথা মনের ভাষা,
সে কথা অপেক্ষা সয় ||
অপরিচিতের আঙিনা টপকে সোশ্যাল সাইট থেকে নম্বর আদান প্রদান ঘটে |
বসন্তের এক নির্জন দুপুরে,আকাশে বাতাসে যখন নয় প্রখর তাপ,নয় হিম শীতল ঠান্ডার দুপুরে শান্ত ঝিলের ধারে একা একা বসে আকাশ বেহিসেবি মনে মোবাইলে খুট খুট করছে, অমনি বেজে ওঠে ফোন |
আননোন নম্বর থেকে ফোন এসেছে দেখে, কালো ফ্রেমের চশমাটা কপালে তুলে আকাশ ফোনটা রিসিভ করে |
◆আকাশ বলছেন ?
●হ্যাঁ বলছি,আপনি ?
◆বুদ্ধু |
●(মনে মনে) আমাকে বুদ্ধু কেবল তৃষাই বলে | তৃষা ??
◆ঠিক চিনেছো | তোমাকে কথা দিয়ে ছিলাম আমি তোমার সাথে কথা বলবো ফোনে,আজ কথা রাখলাম | চ্যাট এ আমাদের কত কথা হয়, টেক্সট লিখতে লিখতে আমার হাত ব্যথা হয়ে যেত, আমি পারছি না বলতাম আর তুমি সেই টেক্সট করে যেতে,আমি শুধু seen... করতাম |
মনে মনে ভালোবেসে ফেলা মানুষের সুমধুর কণ্ঠ আকাশকে যেন প্রেমের জগতে ক্ষনিকের জন্য নিয়ে যায়, শুধু একটা কথা কানে কানে বলবার জন্য |
◆আকাশ ! শুনছো আমার কথা ? চুপ কেন ?
●(হুঁশ ফেরে আকাশের) হ্যাঁ শুনছি তৃষা।
আমিতো হারিয়ে গেছিলাম কোথায় যেন |
◆বুদ্ধু | জানি তো হারিয়ে যাবে | আমি জানি তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো |
●তৃষা,বলো আর এক বার | আমি কিছুই বুঝলাম না |
প্রেমিক মনে তৃষার মতো মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া প্রাকৃতিক ঘটনা | হিয়ার মাঝে ভেসে ওঠে রোমান্সের চলচ্চিত্র, শুধু পুরস্কার পাওয়ার অপেক্ষা |
◆শোনো আমি আগামী পরশু কলকাতায় আসছি বান্ধবীদের সাথে, বইমেলায় যাবো বলে | আমার নম্বর সেভ করে রেখো, আমি পৌঁছে তোমায় ফোন করবো | দেখা হবে দুজনের |
●তাই?এত আমার সৌভাগ্য ! ঠিক আছে রাখি এখন |
◆টাটা.....
হিল্লোলিত প্রানের স্পন্দনে, আকাশে বাতাসে বসন্তের প্রেমের গন্ধ যেমন মাতাল করে তোলে, ঠিক তেমনি আকাশের মনের ভেতরে ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে প্রথমবার তেমনি হিল্লোল বয়ে চলে
|
সেদিন বেশ সাজগোজ করে এসেছে তৃষা | পরনে শাড়ি, ঠোঁটে লিপস্টিক আর এলো চুলের বাহারি বেশে অপেক্ষমান 'বুদ্ধু'আকাশের জন্য বই মেলার 2 নম্বর গেটের সামনে | ফোনে অবশ্য প্রতিক্ষালয়ের স্থান সম্পর্কে দুজন অবগত হয়েছে | কিছুক্ষনের মধ্যে আকাশ ও উপস্থিত |
বান্ধবী কে দেখে আকাশের চোখ আর বাঁধ মানে না, তার অপরূপ লাবণ্য মাখা সুশ্রী মুখ ও শান্ত হাসি আকাশকে বোবা,কালা ও অন্ধ প্রেমিক করে দেয় ক্ষনিকের জন্য |
◆এই ছেলেটা,এমন হা করে দেখবার কি আছে ? আগে আমাকে দেখনি ?
●দেখেছি কিন্তু সে তো ছবিতে,সত্যি তুমি
◆দূর ছাই! এরা সব আমার বান্ধবী | চলো চলো বইমেলায় যাই, আবার বাড়ি ফিরতে হবে |
●চলো |
বয়সটা যখন প্রেম করার উপযুক্ত,তা সে করবেই বা না কেন ? বই পোকা তৃষা বাংলা ভাষার প্রতি প্রচুর টান কিন্তু করবে কি কলেজ পাঠ্য বই সব ইংরেজিতে তাই বাধ্য হয়ে নানা গল্পের বই বাংলায় পড়ে | তার প্রচুর সংগ্রহ আছে বাংলা গল্পের বইয়ের |
বন্ধুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে অনেক বই কিনে ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা,কিন্তু কেউ আর কাউকে প্রেম নিবেদন করতে পারলো না |
মিতভাষী আকাশ একবারও নিজের মন থেকে ছটফটে তৃষার সামনে কখনই প্রেম নিবেদন করতে পারে নি |
গাঢ় বন্ধুত্বের হৃদয় জোড়া, প্রেম সাগরে প্রেমিক মনকে ভাসিয়ে এই বন্ধুত্বের ডিঙা ভেসে চলে বছরের পর বছর | কখনো তা নির্জন তটে নোঙ্গর করে, আবার কখনো ফিল্মের জগতের সিনেমা হলে প্রবেশ করে,নয়তো বা কখনো সখনো পাহাড়ের কোলে শান্ত সকালের তৃপ্তি পাওয়ার বাসনায় ছুটে গেছে |
কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে, আকাশ যখন ধরা দিয়েছে মাঠের ওই প্রান্তের গাছের ডালে,সেই আনন্দে পাখিগুলো কলতানে মুখর,আনমনা আকাশ সারাদিন অপেক্ষমান তার প্রিয় বান্ধবীর ফোনের অপেক্ষায়, না করে ফোন না ধরে ফোন,না দেয় এস এম এস এর রিপ্লাই | হতাশ ও অভিমানী মন ফিরে যায় নিজের ঘরে |
রাত আট'টা বাজে,বেজে ওঠে আকাশের ফোন | দ্রুততার সাথে ফোনটা ধরে বলে হেলো !
◆বুদ্ধু। চিনতে পারছো না ? একটা সু'খবর আছে। অনেক ব্যস্ত ছিলাম,তাই তোমার ফোন ধরতে পারিনি |
●(মনে মনে)জানি তো সুখবর টা কি | বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কোথাও।আমি আর বলতেই পারলাম না |
◆কিছু বললে মনে হয় ?
●তুমি কিছু শুনতে পেয়েছো ?
◆হুম,শুনলাম তো | আমার বিয়ে হয়ে যাবে | বর আসবে, তোমার চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে চলে যাবে আমায়, আর তুমি হাবলার মতো বিষন্ন মনে হা হুতাশ করতে করতে একটা ব্যর্থ প্রেমের গান শুনতে শুনতে বাকি দিন কাটিয়ে দেবে তাই তো ?
● আঁই ! এত আমার মনের কথা |
◆ আমার বিয়ে সামনের মাসে |
● যাও না,বিয়ে করে নাও না,আমাকে বলার কি আছে। আমি কিছু বলছি তোমায়, তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। আমার শুধু অপরাধ আমি তোমায় ভালোবাসি বলতে পারিনা,কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি তৃষা | I LOVE YOU........ I LOVE YOU TRISHA...........
আকাশের পুরো পরিবার হা করে তাকিয়ে আকাশের মুখের দিকে। জোয়ার যখন উর্ধমুখী, তখন সমস্ত গ্লানি ও বাধা ঠেলে তার প্রকৃত রূপের পরিচয় দেয়।তেমনি শান্ত ও চাপা স্বভাবের আকাশ তার প্রিয়ার এ হেন কথনে নিজেকে সামলাতে না পেরে মনের কথা বলে দেয়।
◆আকাশ ! বলো আর একবার | তোমার মুখ থেকে আর একবার শুনতে চাই সেই কথা | এত বছর তুমি আমায় বলতে পারনি। বলো,বলো প্রাণ খুলে | I ALSO LOVE YOU AKASH. আমার বাড়িতে মামা মামী সবাই আজ এসেছিলেন | আমার বিয়ের বিষয়ে কথা হচ্ছিল | আমার মতামত জানতে চেয়েছিল সবাই। আমি বলেছি আমি একজনকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করবো | তারা হয়তো তোমাদের বাড়িতে আসবে ক'দিনের মধ্যে |
আকাশের বাবা আকাশের মা কে বলছেন-'কই গো তোমার ছেলের কাউকে পছন্দ হয়েছে, আর সময় নষ্ট করা যাবে না | আমি আর্মির লোক আমার ছেলের যাকে পছন্দ তার সাথেই বিয়ে দেব | আমি আর কিছু দেখতে চাই না,আমি এক কথায় মানুষ | ওই মেয়েটাকে খুঁজে বার করো আকাশের সাথে কথা বলে | সামনের মাসেই বিয়ে হবে। এদিকে তৃষাও তার পরিবারের সকলকে বলে রেখেছে সে আকাশকে ভালোবাসে | বিয়ে করলে আকাশকেই বিয়ে করবে |
দুই পরিবারের সাক্ষাত এক শুভক্ষন দেখে হলো, কোনো এক বসন্তকালীন সন্ধ্যায় | বাকিটা বিয়ের সানাই বাজছে শুনতে পাচ্ছেন সবাই |
আর আমি , শুধু আশীর্বাদ করতে পারি এভাবেই-----
শত শত বছর জুড়ে যাক দুটি প্রাণে,
এই বসন্তের সন্ধিক্ষণে দুহাত ধরে |
লাগুক মনে প্রেমের রঙ,
কোকিলের কণ্ঠে ফুটুক ভাষা,
তৃষা আকাশের সুখের জীবনে,
নজর কাঠি দিলাম বেঁধে |
|