সূর্য্যেন্দু গায়েন

Romance Fantasy Others

4.0  

সূর্য্যেন্দু গায়েন

Romance Fantasy Others

বধুবরণ

বধুবরণ

57 mins
1.6K



সুনীল খুব ভালো ছেলে। চাকরিসূত্রে বিদেশে থাকে। বয়স প্রায় 28। প্রেম করেনা। ছোটভাই আগেই প্রেম করে বিয়ে করে নিয়েছে । পরিবারের অ'মতে ছোট ভাই বিয়ে করে। সেও এক বিরাট ঘটনা, অন্য কোনোদিন আলোচনা করা যাবে। ছোটভাই বিয়ে করে নিয়েছে, বড়ভাই এখনও বিয়ে করেনি, গ্রামেগঞ্জে এ নিয়ে এখনও নানান অবান্তর প্রশ্ন ওঠে। বড় ছেলেকে নিয়ে সুনীলের বাবা ও মায়ের দুশ্চিন্তা দিনে দিনে বেড়ে চলে। এবার বিয়ে দিতে হবে বড়ছেলের। বাবা-মা তাই সুনীলকে জিজ্ঞেস করেন, তারও কোনো প্রেমঘটিত সম্পর্ক যদি থেকে থাকে, তা যেন জানায় এবং বিয়ে সেখানেই হবে, কথাবার্তা এগোতে হবে। এই পালিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসা মোটেই ভালো নয়। সুনীলের সাফ কথা, তার প্রেমঘটিত কোনো সম্পর্ক নেই, দেখে শুনেই বিয়েটা হোক। সুনীলের মতামতে বাড়ি থেকে সম্বন্ধ দেখাশোনা চলছে। অনেক জায়গা থেকে পাত্রীর খবর আসে, দু'পক্ষের মতের অমিলের কারণে কয়েক জায়গায় কথাবার্তা বিশেষ এগোয়নি। বছর দুয়েকের মধ্যে এক ঘটকমশাই বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। আশেপাশের গ্রামের কোনো এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। মেয়ের পাঁচ বোন, ভাই নেই। মেয়ের ভালো পড়াশোনা আছে, সুশ্রী দেখতে, বাকি কথাবার্তা দুপক্ষের দেখাশোনার পর এগোবে।

          সুনীলের বাবা-মা, মেয়ের বাড়ি গিয়ে মেয়ে দেখে আসেন।পছন্দও হয়। ছেলে বিদেশে থাকে তাকেও আসতে হবে এবং দেখাশোনাপর্ব শেষ হলে বিবাহের প্রস্তাব যাবে।

         বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরে একটা শুভদিন দেখে দেখাশোনার প্রথমপর্ব সাঙ্গ হয়। সুনীলেরও মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মেয়ে ও মেয়ের বাড়ির সকলের ছেলে পছন্দ হয়েছে।

          সুনীলের বাড়ি থেকে মেয়ে পছন্দ-অপছন্দের মতামত জানতে চায়, সুনীলের "মেয়ে পছন্দ হয়েছে, স্বভাবে ভালো কি খারাপ সেটা আমার জানা নেই, সেটা মানুষের সাথে ওইটুকু কথাতে বোঝা সম্ভব নয়, আর তোমাদেরও একটা পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকতেই পারে। বাবা মায়ের অমত যদি থাকে তাহলে সেখানে বিয়ে না হওয়া বাঞ্ছনীয় কারণ আমিও যেমন তারসাথে সংসার করবো, তোমরাও দিনের বেশিরভাগ সময় সেই মেয়ের সাথে কাটাবে, তাই কোথাও যেন মনোমালিন্য না থাকে এই বিয়ে নিয়ে, সেটাই আমি চাই।" অতি উত্তম প্রস্তাব।

           বিয়ে দুমাস পর হবে, তাই বাকি আরও কিছু যদি জানা-অজানা থাকে তাহলে সেই বিষয়গুলো কথোপকথনের মাধ্যমে পরিষ্কার হবে। দুটো পরিবার এই দুমাসে আরও বেশি কাছাকাছি আসার মাধ্যমে প্রত্যেকের চাল-চলন সম্পর্কে অবগত হবে।

         সুনীল তার মোবাইল নম্বর দিয়ে আসে, হবু শশুরমশাইয়ের কাছে। কোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে লাগলে ফোন করবার জন্য। কয়েক দিন পর, সুনীলের ফোনে ফোন আসে অপরিচিত নাম্বার থেকে।

সুনীল: হ্যালো।

[ওপারে কোনো উত্তর নেই। সুনীল কলটা কেটে দেয়। আবার কল আসে ফোনে।]

সুনীল: কেউ কথা বলছে না, ভুতুড়ে নম্বর নয়তো? হ্যালো, কে বলছেন।

         ওপার থেকে মেয়েলি হাসি শুনতে পায় সুনীল। অনেকে মিলে হয়তো ঠাট্টা করছে। ওপার থেকে উত্তর এলো ধরুন ধরুন ফোনটা, আপনার সাথে একজন কথা বলবে। এই রিয়া বলনা কথা, ফোন করতে বলে পালিয়ে যাচ্ছিস।

রিয়া: আমি কথা বলবো না, আমার ভয় করছে।

(এ তার কাছে ও এর কাছে ফোন এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কেউ আর কথা বলেনা। মনোযোগসহকারে সুনীল শুনবার চেষ্টা করছে, এরা কারা হতে পারে। তবে রিয়া নামটা শুনে আন্দাজ করতে পারে হবু বউ ফোন করেছে, হয়তো লজ্জায় কথা বলতে চাইছে না। স্বাভাবিক।)

সুনীল: আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাদের একজন কথা বলুন। আমি এপারে শুনতে পাচ্ছি।

রিয়া: হ্যালো।

সুনীল: হ্যালো, কে বলছেন ?

রিয়া: চিনতে পারছেন না ?

সুনীল: না। নাম'টা বলুন।

রিয়া: আন্দাজ করুন।

সুনীল: আন্দাজ তো আমি করেছি। তাও আপনার নাম আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

রিয়া: হ্যাঁ। যা আন্দাজ করেছেন সেই আমি।

সুনীল: হা হা হা। কেমন আছো ?

রিয়া: ভালো আছি। আপনি?

সুনীল: আমি ভালো আছি। আর হ্যাঁ আপনি বলার প্রয়োজন নেই, তুমি বলতে পারো।

রিয়া: আচ্ছা। ঠিক আছে।

সুনীল: আমার নম্বর পেলে কোথাথেকে।

রিয়া: কেন? সেদিন যে এসেছিলে, বাবাকে বলছিলে তুমি, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার মনেছিল । আমিও সেভ করে রেখেছি ।

সুনীল: আচ্ছা! ব্রেন ভালোতো? দশটা নম্বর একবার বলায় মুখস্থ করে নিয়েছো। বুঝলাম। নম্বর মুখস্থ মানে আমার নামও মুখস্থ আর আমার নাম মুখস্থ মানে আমি পছন্দ হয়েছি তোমার নজরে।

রিয়া: খানিকক্ষণ চুপ।

সুনীল: চুপ কেন?

রিয়া: না। কিছু না, বলো।

সুনীল: আমি একটা কথা বলবো?

রিয়া: বলো।

সুনীল: আমার পছন্দ হয়েছে তোমাকে। আশাকরি বিয়েটা মনে হয় তোমার সাথেই হবে।

রিয়া: আমারও তাই মনে হয়, বাবা সামনের শুক্রবার তোমার বাড়ি যাবেন বলেছেন।

সুনীল: তাই? ঠিক আছে।

রিয়া: একটা কথা জিগ্যেস করবো?

সুনীল: নির্দ্বিধায় জিগ্যেস করতে পারো।

রিয়া: শুনলাম তোমার ভাই নাকি আগে বিয়ে করেছে। তা তুমি বিয়ে করনি কেন?

সুনীল: ভালো প্রশ্ন করেছো। নিশ্চই জানবে। ভাই প্রেম করতো। মেয়ের বাড়ির মত ছিলনা ওদের প্রেমের বিষয়ে। মেয়েটার বিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে দেওয়ার কথাবার্তা চলছিল। কোনো একদিন মেয়েটা প্রায় রাত দশটা নাগাদ আমাদের বাড়ি চলে আসে লুকিয়ে, মাসির বাড়ি যাচ্ছে বলে। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি অনেকদূর। এত রাতে একটা মেয়েকে আমরা ঘর থেকে বের করে দিতে পারিনি। ওর বাবা মা'কে খবর দিতে বারণ করে। আর যদি আমরা খবর'দি তাহলে সে ঘরে ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করবে। আমরা সকলে ভয় পেয়ে প্রতিবেশী সকলকে জানাই। সবাই বলে মেয়েটা আজ রাতে আমাদের বাড়ি থাক, যা হওয়ার আগামীকাল হবে। লোক লজ্জায় সেদিন আমাদের সকলের মাথা হেঁট হয়ে যায়। একটা অ'বিবাহিত মেয়ে সারা রাত ঘরের বাইরে থাকবে, তাও এই রকম এক পরিস্থিতিতে, আমাদের সমাজ এখনও এতটাই উদার হয়নি যে, সেই মেয়েকে ভালো বলবে।

      তাই পরেরদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েটার বাড়িতে জানিয়ে ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। মেয়ের বাড়ির লোকের এই সম্পর্কে অ'মত ছিলই, তাও মেয়ে যেহেতু এই কাজ করে ফেলেছে সেহেতু ওনারাও আর বিশেষ আপত্তি তোলেনি, মেয়ের পছন্দের কথা ভেবে হয়তো বিয়েটা আটকায়নি, ওদের বিয়ে হয়ে যায়। এই হলো আমার আগে ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কারণ, তাই আমি পরে বিয়ে করেছি। মনে যদি অন্য কোনোপ্রকার সন্দেহ থাকে, তাহলে তোমার বাবা আসবেন আমাদের বাড়ি, বলো একটু আমাদের সম্পর্কে কোনো লুকানো কথা যদি থাকে, আশপাশের প্রতিবেশীর থেকে জেনে যেতে। তাঁরা অন্ততঃ মিথ্যা বলবেননা। আশাকরি বোঝাতে পেরেছি?

রিয়া: ঠিক আছে। আজ রাখি অন্য কোনোদিন কথা বলবো, আমি তোমাকে ফোন করেছি কাউকে বলোনা। আমার বাড়ির লোকও জানেনা, তোমাকে ফোন করেছি। এটা আমার নাম্বার সেভ করে রেখো। বায়..

সুনীল: টাটা। ভালো থেকো।

          বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তা অনেকটাই এগিয়ে যায়।

দিনক্ষণও ঠিক হয়ে যায়। তবে মেয়ের বাড়ি প্রস্তুত নয় বলে, বিয়েটা পিছিয়ে যায় দু'মাস। রিয়া এবং সুনীল, ফোনে যে কথা বলে, তা এখন দুই পরিবার জানে। সেদিন সুনীল ফোনে রিয়ার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে।

          বিয়ের আগে দুমাস সময় পাওয়া মানে, হবু বউ'য়ের সাথে প্রেম করা যায়। তাই এখন দুজনের ফোন ব্যস্ত থাকে প্রেমালাপে।

সুনীল: আচ্ছা রিয়া, তুমিতো একবার আমাদের বাড়ি এসে ঘুরে যেতে পারো। আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে কথাবলে দেখতে পারো। তাদের সাথে তোমার মতের মিল-অমিল হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত বা আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তোমার পছন্দ হলো কি হলোনা তাও জানা যেত।

রিয়া: না, এটা ঠিক না। আমাদের সে রকম কোনো নিয়ম নেই। মেয়েরা বিয়ের আগে হবু বরের বাড়ি যায়না। বাড়ির অন্য সদস্যরা যায়, তাঁরা যেটা দেখে আসেন সেটাই ঠিক।

সুনীল: ভালো। তবে আমার কিছু তোমাকে বলবার।

রিয়া: বলো।

সুনীল: আমার বাবা মা বৃদ্ধ, তাঁরা আর কদিন হয়তো বাঁচবেন। মূর্খ মানুষ ওনারা। পরিবারে সকলে একসাথে থাকলে কোনো না কোনোদিন হয়তো টুকটাক ঝামেলা অশান্তি লাগতে পারে। আমি বাড়ির বড় ছেলে, তুমিও বাড়ির বড়বউ হিসেবে আসবে। তোমার থেকে আমি আশা করবো আমার বাবা ও মাকে মানিয়ে চলা। আর তোমার যদি কোথাও মনোমালিন্য হয়, পরিবারের কারুর সাথে তাহলে আমাকে নিশ্চই জানাবে। ঝগড়ায় জড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করোনা। এইটুকু আমার পাওনা আশাকরি তোমার থেকে।

রিয়া: হুম। বুঝলাম। আমি চেষ্টা করবো।

সুনীল: ধন্যবাদ।

রিয়া: ঠিক আছে, আজ রাখি। আমাদের আবার কিছু কেনাকাটা করতে মা দিদির সাথে বেরোতে হবে।

সুনীল: ঠিক আছে। টাটা।

রিয়া: হুম। বায়।

          সুনীলের প্রস্তাব খারাপ ছিলনা। রিয়া তার পরিবারের সাথে এসে একবার সুনীলের বাড়ি ঘুরে যেতে পারতো। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের পর এসে জীবনের বাকি অধ্যায় কাটায়। তাই তারও ভালো মন্দ দেখবার অধিকার থাকে।

          এর মধ্যে আবার রিয়ার বাড়ি থেকে এক নতুন বিষয় নিয়ে পরিবারের অনেকের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে।......

         এখানে একটা কথা বলে রাখি, প্রাকবিবাহ সময়গুলো বেশ মধুময় হয়। আমরাও সকলে সেটাই আশাকরি।

            সকাল-সকাল ঘটকমশাই, রিয়ার বাবা অর্থাৎ অজয়বাবুর বাড়ি এসেছেন। আবার কি হলো ভেবে সবাই শুনবার আগ্রহে অস্থির।

অজয়বাবু: ঘটকমশাই আসুন-আসুন, বসুন। সকাল-সকাল আপনার আগমন কোনো বিশেষ বার্তা ছাড়া হয়না? রিয়ার'মা দু'কাপ চা নিয়ে এসো।

ঘটকমশাই: এসেছি কিছু কথা বলবার জন্য। চা খেতে খেতেই বলা যাবে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। আপনার আর কোনো চিন্তা রইলোনা। এবার বুড়োবুড়ি চার মেয়ের বাড়িতে মাঝেমধ্যে পালা করে ঘুরে আসবেন ।

অজয়বাবু: হা হা হা । তা ঠিক বলেছ ভায়া। এই নাও চা খাও। আর বলো....

ঘটকমশাই: হাঁ যেটা বলবার জন্য এসেছি সেটা হলো-'ছেলের বাড়ি থেকে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। তাঁরা চান বিয়ের আগে ছেলে ও মেয়ের ব্লাডটেস্ট করিয়ে নিলে ভালো হয়। আজকাল সরকার থেকেও এবিষয়ে প্রচার করছে। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে এখনকার দিনে এই সব করতে হয়।

অজয়বাবু: (লাফিয়ে উঠে) না ! এ সম্ভব নয়। কেন, আমি আমার আর তিন মেয়ের বিয়ে দিনি? তারা সংসার করছেনা ? তারা কি বিয়ের পর মারা গেছে? হবেনা ভাই এসব হবেনা। ওরা কি বোঝাতে চাইছে , আমার রক্তের দোষ আছে? না আমার পূর্বপুরুষের রক্তের দোষ আছে? আমার মেয়ের রক্তের পরীক্ষা আমি করাবোনা। তাতে বিয়ে হলে হবে আর না হলে হবেনা। আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম ভায়া।

             ( বিয়ের কথা প্রায় পাকা, এই সময় সমস্যা হলে বিয়েটাতো ভেঙে যাবে। সকলের মুখ গম্ভীর।)

অজয়বাবু: বসো, আমি সন্তুকে ডাকি। ও আমার ভাইয়ের ছেলে। ও এসব বিষয়ে বোঝে, ও কি বলে, আমি শুনি আগে।

           সন্তুবাবুকে ডাক পড়লো। উনি সদ্য ওকালতি পাস করেছেন। জেলা'দায়রা আদালতে কি সব লেখালেখির কাজ প্র্যাকটিস করে। ভালোভালো লোকের সাথে ওর ওঠাবসা আছে। ও যেটা বলবে আমরা সেটা বুঝে বলবো। সন্তুবাবুও সকাল-সকাল হাজির। কি হলো আবার, এত সকাল-সকাল ডাক পড়লো?

সন্তুবাবু: কি হয়েছে, ঘটকমশাই? আপনি সকাল-সকাল।

অজয়বাবু: শোন সন্তু, উনি ছেলের বাড়িথেকে খবর নিয়ে এসেছেন, আমাদের মেয়ের রক্ত টেস্ট করে দেখতে চান। আমি বাবু এসব হতে দেবনা। তুই কি বলিস? আমাদের কি রক্ত খারাপ? না তোদের রক্ত খারাপ? প্রয়োজন হলে মেয়ের বিয়ে দেবনা।

সন্তুবাবু: আহঃ কাকা তুমি বোঝার চেষ্টা করো। ওনারা ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন। আজকাল এই ধরণের পরীক্ষা করানো উচিত। বিয়ের আগে ব্লাড সংক্রান্ত পরীক্ষার নিরীক্ষায় অনেক কিছু বোঝা যায় । এটাও বোঝা যায় কে কি অসুখে আক্রান্ত। সেই রোগ আদৌ সারবে, কি সারবেনা, তাও বোঝা যায়। আর শরীর থাকলে অসুখ হয় এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্রত্যেকের সচেতন হওয়া উচিত। তা ছাড়া ছেলের বাড়ি থেকে ছেলেরও ব্লাড টেস্ট করাতে আপত্তি নেই। আমরাও ছেলের ব্লাড রিপোর্ট ভালো ডাক্তারকে দেখিয়ে নেব। এখন সবে পাকা কথা হয়েছে নাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেওয়া যাবে। বিয়ে এখানেই হতে হবে তাতো লেখা নেই কোথাও। আর কাকা, যদি ধরো ছেলের রক্ত পরীক্ষায় এমন কিছু রিপোর্ট এলো যার লক্ষণ ভালোনা তাহলেও কি তুমি তোমার মেয়ের বিয়ে সেই ছেলের সাথে দেবে? ভাবো, আমি কি বোঝাতে চাইলাম। এখনকার যুগে থ্যালাসেমিয়া টেস্ট মাস্ট করাতে হয়, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিপদ থেকে যায়।

অজয়বাবু: তা বলে রক্ত পরীক্ষা? আমার বাপের জন্মে এসব হয়নি। ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তাহলে হোক রক্ত পরীক্ষা। আমাদের রক্তে কোনো দোষ নেই। ঘটকমশাই, কবে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট চাই ওনাদের থেকে জেনে আমায় আপনি জানাবেন। প্রয়োজনে একটা ল্যাব থেকেই আমার মেয়ের ও ছেলের রক্তপরীক্ষা হোক।

ঘটকমশাই: ঠিক আছে অজয়'দা, আমি আজ বিকেলেই জানাবো ওনাদের মতামত। আজ আসি তাহলে?

অজয়বাবু: হুম। আসুন।

          দুই বাড়ির মতামতে ,রিয়া ও সুনীলের রক্তের টেস্ট হয়েছে, রিপোর্ট হাতে আসবে আগামীকাল। সকলে উৎকণ্ঠায় আছে। রিপোর্ট যেন ঠিকঠাক আসে দুজনের।

           সহাস্যে রিয়ার বান্ধবীরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে ঘর থেকে নিচে নেমে, ঘটকমশাইকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানি করে বলতে থাকে, আজ আবার কি হলো, ঘটকমশাই সকাল-সকাল বাড়িতে উপস্থিত।

            পাশের ঘর থেকে কাকিমা ডাক দিলেন-" এই রিয়া আয়'তো, তোর সাথে কথা আছে"।

রিয়া বলল-"হ্যাঁ কাকিমা আসছি, চল চল তোরাও চল, কাকিমা আবার কেন ডাকদিল, নিশ্চয়ই বিয়ের বিষয়ে কিছু কথা বলবে। বলো কাকিমা কি বলবে?"

            আয় আয় ঘরে আয় বলছি। এই রিয়া শোননা, ছেলের বাড়ির লোকে কি পাজী'রে, বলে কিনা আমাদের মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করাবে, কেন, আমাদের রক্তদোষ আছে? তোর হবুবর তোকে ফোন করে? যদি ফোন করে, তাহলে বলে দিস তুই রক্ত পরীক্ষা করাবিনা। তাতে বিয়ে হলে হবে, নাহলে হবেনা, দেশে কি ছেলের অভাব আছে।

           আমতা আমতা করে রিয়া বললো-" না কাকিমা, মানে এসব বিষয়ে আমিতো ঠিক জানিনা, বাড়িতে বাবা-মা আছে, সন্তুদা এসেছে, ওরা যেটা ভালো মনে করবে সেটাই হবে।

          রিয়ার কাকিমা বলল-" ও... আমরা কি তোর ভালো চাই না? আমরা কি তোর পর? তোর ক্ষতি করবো? ঠিক আছে, যেটা ভালো বুঝিস সেটাই করিস।

          রিয়া ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক আছে কাকিমা, দেখছি, আমাকে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, আমি কিছু একটা বলবো। ও কাকিমা, আমরা শপিং-এ যাবো বেনারসি শাড়িটা কিনবো, কত দামের মধ্যে কিনলে ভালো হবে আমাকে একটু বলবে?

            কাকিমা মুখ ভেংচে বলল, মরণদশা, বিয়ে এখনো ঠিক হলোনা, বেনারসি কিনতে ছুটছে দোকানে।

           রিয়া আবার আমতা-আমতা করে বলল,আচ্ছা কাকিমা ঠিক আছে, আজ আমি আসি তাহলে?

রিয়ার কাকিমা বললো --' আয়'।

রিয়া: এই চল চল চল সবাই, ড্রেসচেঞ্জ করতে হবে, সীমা, তুই তো আমার সাথে যাবি শপিং করতে? তুই না গেলে কিন্তু আমি যাব না, কারণ, তুই কাপড়চোপড় বেশ পছন্দ করতে পারিস।

সীমা: আচ্ছা ঠিক আছে, যাব'খন, তাহলে তুই ড্রেসচেঞ্জ কর, আমি বাড়ি যাই ড্রেসচেঞ্জ করি, তুই বেরোনোর পথে আমাকে ডাক দিবি, আমি ঘরে তৈরি হয়ে থাকবো। ওকে।

          ওকে ডিয়ার। তাড়াতাড়ি তৈরি হও। ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রিয়া মাকে ডাক দিলো মা......... তাড়াতাড়ি তৈরি হও শপিংয়ে যাবে না? আমি ওপরের ঘর থেকে তৈরি হয়ে আসছি।

          রিয়ার মা বললেন, আমিতো তৈরি আছি, তুই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আয়।

          বাড়ির বড়রা নীচের ঘরে বসে কথা বলছেন, রিয়ার মা ও রিয়া বিয়ের কেনাকাটা করতে বেরিয়ে গেলেন।

           বেরোতে বেরোতে রিয়ার মা বলে গেলেন-"ওগো শুনছো, আমি আর মেয়ে একটু কেনাকাটি করতে বেরোচ্ছি, তুমি একটু কার্ড ছাপানোর বিষয়ে কথা বলে নিও সবার সাথে, আজ সবাই আছে।"

           রিয়ার বাবা বললেন "থামোতো, এখন মেয়ের ব্লাডটেস্ট নিয়ে কথাবার্তা চলছে, আগে এটা সমাধান হোক, তারপর কার্ড ছাপানো নিয়ে কথা বলা হবে।"

           রিয়ার মা বললেন, তোমরা যা ইচ্ছে তাই করো, আমরা এখন আসছি।

            শপিংয়ে যেতে যেতে রিয়ার ফোন বেজে উঠল, রিয়ার মা বললেন -"ফোনটা ধর, কে ফোন করেছে।"

             লাজুক মুখে রিয়া তার মাকে বলল, ও কেউ না কাস্টমার কেয়ার ফোন করেছে।

ও আচ্ছা। তোর বান্ধবী সীমা কোথায়? ও আমাদের সাথে যাবে বলছিল?

          হ্যাঁ মা, আমিতো ওকে বলেছি তৈরি হয়ে ওদের বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়াতে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো।

আবার রিয়ার ফোনটা বেজে উঠলো।

            রিয়ার মা বললেন, ফোনটা ধর, কে ফোন করেছে কথা বল।

            রিয়া ফোনটা দেখে বুঝল সুনিল ফোন করেছে, তাই ফোনটা ধরে একটুখানি রাস্তার বাঁদিকে চেপে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, এখন ফোনটা রাখ, মা আছে, আমরা শপিংয়ে যাচ্ছি, শপিং সেরে তোমার সাথে কথা বলবো, কিছু দরকারী কথা আছে।

         সুনিল ইয়ার্কির ছলে বলল ' মা থাকলো তো কি হয়েছে? আর কদিন পরে আমারও শাশুড়িমা হবেন ,কথা বলতে লজ্জা কিসের?

         রিয়া বলল, তুমি চুপ করবে? ফোনটা এখন রাখছি। পরে কথা বলব।

          ফোনটা রাখার সাথে সাথে রিয়ার মা জিজ্ঞেস করলেন, কে ফোন করেছিল রে?

রিয়া বলল, ও কেউনা।

রিয়ার মা বললেন, ওহ! বুঝেছি, সুনীল ফোন করেছিল?

          না..মানে.. হ্যাঁ।

জিজ্ঞেস করিস তো আবার নতুন কি সমস্যা হল। ঘটকমশাই সকালবেলা এসে ব্লাডটেস্ট নিয়ে কথা বলছিল, এই বিষয়টা।

আচ্ছা মা ঠিক আছে, তবে এখন নয়, পরে ফোন করে জানবো।

এইতো সীমা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আয় আয় তাড়াতাড়ি আয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।

-- চল।।

শপিং শেষে দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে, খাওয়া-দাওয়ার পর, রিয়া সুনীলকে ফোন করল।

-- এখন ফিরলে?

-- না, আমরা অনেক আগে ফিরে এসেছি, এইমাত্র খাওয়া-দাওয়া সারলাম, তারপর তোমার সাথে কথা বলছি।তোমাদের লাঞ্চ হয়ে গেছে ?

-- হুম আমাদেরও লাঞ্চ হয়েগেছে।

-- শুনলাম তোমাদের বাড়ি থেকে ব্লাডটেস্ট করানো নিয়ে ঘটককাকুকে কিছু বলেছো, তাই উনি আজ সকাল সকাল আমাদের বাড়ি এসেছেন। বিষয়টা কি একটু বলবে?

-- ওহ হাঁ। কিছুইনা। বিষয়টা আমরাও তোমাদের ফোন করে জানাতে পারতাম কিন্তু জানাইনি। যেহেতু এই বিবাহ সম্পর্কিত রসায়নে অনুঘটক বিদ্যমান, তাই ওনাকে বাদ দিয়ে আমরা নিজে থেকে কিছু করতে চাইনি। জানতে যখন চাইছো তাহলে বিষয়টা বলি, "আজকালকার দিনে বিয়ের আগে ডাক্তাররা বলেন ব্লাডটেস্ট করাতে। এতে কি হয়, কোনো অসুখ যদি থেকে থাকে, তাহলে তার সমাধান সময়ে করা সম্ভব। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুরক্ষিত থাকে। তাতে তোমাদের কী, কোনো আপত্তি আছে?"

-- আমি অতশত বুঝিনা। আমার কোনো আপত্তি নেই।

তবে বাবা হয়তো বিষয়টা বুঝতে পারেননি, তাই, এই বিষয়ে তর্কাতর্কি চলছে ঘটককাকুর সাথে।

-- আমার মনে হয় এখানে আপত্তির কিছু থাকার কথা নয়। উনি বুঝলে বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। যাক বাদ দাও। বিয়ের কেনাকাটা শেষ?

-- না। শেষ কোথায়? আমার কেনাকাটা প্রায় শেষ। তাছাড়া বাড়ির অন্যদের এখনো কেনাকাটা বাকি। দিদি, জামাইবাবু ওদেরও বাকি আছে। ওরা কয়েকদিনের মধ্যে এসে পড়লে একসাথে আর একদিন বেরিয়ে কেনাকাটা হবে। তোমাদের কতদূর এগোলো?

-- আমাদেরও কেনাকাটা তেমন হয়নি। দেখি দু একদিনের মধ্যে আশাকরি সব হয়ে যাবে।

রিয়ার বাবা মেয়েকে ডাক দিলেন , রিয়া একবার নীচে আয় তো ।

--ঠিক আছে রাখছি এখন, বাবা ডাকছেন। পরে কথা হবে। টাটা। হ্যাঁ বাবা আসছি।( বলতে বলতে রিয়া নীচে নেমে আসে। বলো বাবা কেন ডাকলে?)

-- শোন, ছেলের বাড়ি থেকে বলে পাঠিয়েছে তোর ব্লাডটেষ্টের রিপোর্ট দেখবে। কাল সকালে তোর ব্লাডটেস্টটা মাকে নিয়ে গিয়ে করিয়ে আসিস। রিপোর্ট কবে দেবে জেনে আসবি। আমি রিপোর্টটা নিয়ে আসবো। আমাকে রসিদ'টা এনে দিবি। আর তোর কোনো আপত্তি নেই তো এবিষয়ে?

-- না বাবা আপত্তির কিসের? আমারও যেমন ব্লাডটেস্ট হবে, ওদের বাড়ির ছেলের রিপোর্টও হবে। ওরাও যেমন আমার রিপোর্ট দেখবে, আমরাও তেমন ওদের রিপোর্ট দেখবো। তাতে কারুর কোনো সন্দেহ থাকবেনা। ঠিক আছে বাবা কাল আমরা সকাল বেলা চলে যাবো।

-- ঠিক আছে, রিপোর্ট আসুক, তারপর বিয়ের কার্ড ছাপানোর হবে। তোর কতজন বন্ধুবান্ধবী আছে তার একটা হিসেব দিস, সেই হিসেব করে কার্ড ছাপানো হবে।

-- আচ্ছা বাবা, বলে দেব'খন। আসি এখন?

-- হুম আয়। আর তোর মা'কে বলিসতো মেজমামাকে একবার ফোন করে আসতে আমাদের বাড়িতে। কিছু দরকারি কথা আছে।

রিয়া: আচ্ছা বাবা,আমি সন্ধ্যায় ফোন করে মামাকে আসতে বলে দেব।

             বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। পরেরদিন সকালসকাল রিয়া ব্লাডটেস্ট করিয়ে আসে।

             সন্ধ্যাবেলা রিয়ার বাবা রিপোর্ট নিয়ে আসেন। রিপোর্ট ভালো আসে। সুনীলের বাড়িতে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঘটকমশাইয়ের হাতদিয়ে।

             সুনীলের ব্লাড রিপোর্টও রিয়ার বাবার হাতে তুলে দিলেন ঘটকমশাই।

             ছেলে ও মেয়ে দুজনের রিপোর্ট ভালো আশায় উভয় পরিবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

            এমনি সময় রিয়ার মেজোমামা শুকদেববাবু হাজির।

শুকদেব: জামাইবাবু কোথায়, দরজা খুলুন। আমি শুকদেব। আপনার প্রিয় মেজোশালাবাবু। ভাগ্নির বিয়ের কয়েকদিন আগে হাজির হয়েছি। কদিন জমিয়ে দিদির হাতে তৈরি মাছের মুড়োর খাওয়া যাবে। বউয়ের হাতে তৈরি ডালভাত আর আলুচোখা খেয়েখেয়ে পেটে চড়া পড়েগেছে।

অজয়বাবু: উফঃ শুকদেব, সেই আমাদের বিয়ের পরথেকে তোমাকে শুধু খাইখাই দেখছি। তোমার বউ, মানে অনিতা, তোমার দিদিকে, মানে আমার বউকে ফোন করে বলে, তুমি নাকি যা মায়না পাও শুধু বড়বড় মাছ আর পাঁঠারমাংস খেয়ে টাকাগুলো উড়িয়ে দাও।

শুকদেব: এই সেরেছে, ফোনকরে সব বলে দিয়েছে? না মানে ওই আর কি একটু আধটু খাই। খেয়েইতো বাঁচতে হবে, না কী বলো জামাই বাবু?

অজয়বাবু: তা ঠিক বলেছো। কিন্তু তা'বলে পুরো মায়নার টাকা? আর পরের মেয়ের নামে দোষ দিচ্ছ, কিছু খাওয়ায়না রান্না করে! অসাধারণ প্রতিভা তোমার।

শুকদেববাবু: এইতো এইতো দিদি। আজ কী রান্না করেছিস দিদি? মটনের গন্ধ নাকে আসছে। আমার আবার মটনের গন্ধ নাকে লাগলেই, পেটে ক্ষিদে পায়। তাছাড়া কত রাস্তা পার করে এলাম, শরীরের সব ক্যালোরি শেষ হয়ে গেছে। আমার জন্য একটু ভা....ত তাড়াতাড়ি বেড়ে দিবি দিদি? দিদি তোর পায়েপড়ি।

অজয়বাবু: যাও যাও, ওর খাওয়ার বন্দোবস্ত আগে করো। তারপর জরুরি কথায় বসবো।

শুকদেববাবু: ধন্যবাদ জানাই জামাই মহারাজ। চলচল দিদি, তাড়াতাড়ি খেতে দে। এই রিয়া তোর সাথে পরে কথা বলবো। তোর জন্য তোর মামী সুন্দর একটা ড্রেস পাঠিয়েছে। পরে দেখিস। পছন্দ হলে মামী'কে ফোন করে জানিয়ে দিস। চিন্তা করিসনা, আমি এসে পড়েছি, তোর বিয়ের অতিথিসেবা ও রান্না খাওয়ার সব দায়িত্ব আমি নেব। রসগোল্লাটা একটু বেশি করে অর্ডার করতে হবে বল, রিয়া?

      (হাসতে হাসতে রিয়া বলে,আচ্ছা মামা তাই হবে।)

           খাওয়া শেষকরে মামা শুকদেববাবু, রিয়ার বাবার ঘরে প্রবেশ করলেন।

শুকদেববাবু: জামাইবাবু, আজ ভাতটা মনে হয় অনেকটাই খেলাম। (একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলে বললেন)

           রিয়ারবাবা, শালাবাবুর ভুঁড়িটা চশমার তলদিয়ে বেশ করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, তা বুঝতেই পারছি। আর একটু খেতে পারতে। যাক এখন কাজের কথায় আসা যাক। তোমাকে কয়েকটা দায়িত্ব নিতে হবে।

অজয়বাবু: তুমি বিয়ের আগের দিন রাতে মাছ আনতে যেও। চিকেন আর মটন আমার ভাইপো সন্তু ও ওর বন্ধুরা আনতে যাবে। তুমি মাছ এনে রান্নাঠাকুরমশাইয়ের হাতে সকাল আটটার মধ্যে দিয়ে দিও। তারপর তোমাকে আর বিশেষ কিছু করতে হবেনা। তুমি অতিথি সেবায় থাকবে। অতিথিদের খাওয়ার ব্যাবস্থাটা তোমাকেই করতে হবে। সেখানে বাকি সময়টা উপস্থিত থেকো। অতিথি আপ্যায়নের ত্রুটি যেন নাহয়।

শুকদেববাবু: যথা আজ্ঞা জামাইবাবু, আমি আপনার আদেশ অক্ষরেঅক্ষরে পালন করিব। বিয়ের ডেট'টা কি ফিক্সড হয়ে গেছে?

অজয়বাবু: না, এখনো কিছু ঠিক হয়নি, সামনের সপ্তাহে একটা শুভ দিনক্ষণ দেখে, দুইপক্ষ বসে, ফাইনাল কথাটা করা যাবে। আর ঘটকমশাইয়ের হাত দিয়ে রিয়ার ব্লাডটেস্টের রিপোর্ট পাঠানো হলো ছেলের বাড়ি, ছেলের ব্লাডটেস্ট রিপোর্টটাও ওরা পাঠিয়েছে, আমরা ডাক্তার দেখিয়েছি, রিপোর্ট ভালো আছে, এখন শুধু দিনক্ষণ ঠিক করা বাকি আছে।

শুকদেববাবু: আর দেনাপাওনা বিষয়টা জামাইবাবু, তা নিয়ে কিছু ভাবলেন?

অজয়বাবু : না ওটা নিয়ে ভাবিনা ঐদিন ভাবা যাবে।তাছাড়া আজকাল সভ্য ভদ্রলোকেরা দেনাপাওনা নিয়ে কথা বলেনা, শুধুমাত্র বলে আপনাদের মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠিয়ে দেবেন, আমাদের চাওয়া কিছুই নেই। তাই সবই দিতে হয়। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছো তো?

শুকদেববাবু: একদম জামাইবাবু, অনেক ছুটি জমেছিল, সেগুলো এখন নিয়ে নেব।

রাতে সুনীল রিয়াকে ফোন করে।

রিয়া: হেলো।

সুনীল: হুম বলো ডিনার শেষ?

রিয়া: হুম। আমার শেষ, তোমার? আর তোমাদের শান্তি তো? আমার ব্লাডরিপোর্ট দেখে? ঠিক আছেতো?

সুনীল: শান্তি অশান্তির কিছু নেই, এটা একটা মেন্টাল সেটিসফিকেশন। আমিও যেমন সিটিসফায়েড তুমিও তাই। আর বলো।

রিয়া: আর তেমন কিছু না। বাবা বলছিল, ঘটককাকু হয়তো এরমধ্যে কোন একদিন তোমার বাড়ি গিয়ে, পাকা কথায় কবে বসা যায়,সে বিষয়ে বলবে।

সুনীল: ও ঠিক আছে, ভালো কথাতো, শুভস্যশীঘ্রম, তাই নয়?

রিয়া: হ্যা, তাই হলে তাই। আচ্ছা চলো রাখছি, আজ আমরা ভীষণ টায়ার্ড, কাল সকালে ফোনকরো, কথা হবে কেমন?

সুনীল: ওকে ডিয়ার, যাহা বলিবে তা হইবে। শুভরাত্রি।

রিয়া: হ্যাঁ, তোমাকেও শুভ রাত্রি জানাই।

আরে ঘটকমশাই আসুন-আসুন, এই অ'বেলায় এসে পৌঁছানোর কারণকি আবার?

           না কোন খারাপ কারণ নয়, শুভ কারণেই আমি এসেছি, আমাকে একটু বসতে দিন, আর একগ্লাস জলদিন। আজ দু'তিনটে সম্বন্ধে দেখার ছিল, সেগুলো শেষ করেই সোজা আপনার বাড়িতে আসছি। একটা সম্বন্ধের পাকাকথা আজই হল, বাকিদুটো সম্বন্ধ হয়তো আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ফাইনাল হয়ে যাবে, এইতো হল আমার কাজ। দুহাত এক করাই হচ্ছে আমার জীবনের মূলমন্ত্র।।

-- তা ঠিক বলেছো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। কই'গো, ঘটকমশাইকে এক গ্লাস জলদাও, একটু ঠান্ডাজল নিয়ে আসো। সুনীল, টেবিল ফ্যানটা সামনে নিয়ে আয়তো।সুনীল: এই নিয়ে আসছি বাবা।

সুনীলের মা: হ্যাঁ, ঠাণ্ডাজল আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি। ওনাকে বসতে বলো।

সুনীলের বাবা: বস।

ঘটকমশাই: হ্যাঁ। আমি আসলাম আজ আপনার বাড়িতে এক জরুরি কথা বলতে, ছেলেরবাড়ি থেকে বলেছে পাকা কথায় কবে বসা যায়, তার একটা দিনক্ষণ ঠিক করতে, উনারা তো পঞ্জিকা দেখে সামনের সপ্তাহের বুধবার ঠিক করেছেন, আপনারাকি এই দিনটা পাল্টাবেন? যদি অন্য কোনদিন ঠিক করেন, তাহলে আমাকে বলুন, আমি কাল সকালবেলা ওনার বাড়িতে বলে আসবো।

            না না, আমাদের পাল্টানোর কিছু নেই, যদি ওই'দিনটা শুভদিন থাকে, তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই, আপনি হ্যাঁ বলেদিন। আমরা যাব সকাল দশটার সময়, হয়তো দুপুরের খাবারটা ওখানেই সারতে হবে এভাবে আপনি বলে রাখবেন। আমরা ওই আটজন যাবো। দুপুরের খাবারে বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা করতে বারণ করবেন।

           তা ঠিক বলেছেন, আমি বলে দেবো। তবে কিছু কথা জানতে পারি? আপনাদের দেনাপাওনা বিষয়ে কিছুকথা বলবেন? মানে ওই চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আপনাদের কি কিছু দাবি থাকবে?

সুনীলের বাবা: নানা, আমাদের ওসব কিছু দাবি থাকবেনা, তবে তুমিতো জানোই, আমরা কিছু না'চাইলেও আজকাল মেয়েরবাড়ি থেকে , মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠায়। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কোনো দাবি নেই।

ঘটকমশাই: ওহ। এটুকুই শোনার ছিল আমার। খুব ভালো কথা বলেছেন, আমিতো ঘটকের কাজকরি, আজকালকার যেসব সম্বন্ধেগুলো দেখছি সেখানে কেউ দাবি-দাওয়া পেশ করেনা, মেয়ের বাড়ি থেকে যা কিছু দেয় তাই সব মেনে নিচ্ছে, এটাই হওয়া উচিত। আচ্ছা, তাহলে আমি ওনাদের ডেট'টা ফাইনাল জানিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালেই আমি জানিয়ে আসবো। আজ আসি তাহলে, আর কোন কথা যদি আসে আমি নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়ে দেবো।

           পরেরদিন সকালবেলা ঘটকমশাই অজয়বাবুর বাড়ি গিয়ে পাকা কথার তারিখ বলে এলেন। দুই বাড়িতে খুশির জোয়ার বইতে লাগলো।

            ইতিমধ্যে সেই শুভদিন এসে পড়েছে। সুনীলের বাড়িথেকে অনেকেই এসেছেন, সুনীলের বাবা, মামা, কাকা, জেঠু ও দাদু এসেছেন।

            রিয়া সেদিন বেশ সেজেগুজে সকলের সামনে উপস্থিত হয়েছে, আজ নাতবৌ পছন্দ করবেন সুনীলের দাদু, রিয়ার মুখটা তুলে, দাদু চশমাতল দিয়ে একটু ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এতো মেয়ে নয়,সাক্ষাৎ লক্ষী। আমারতো পছন্দ হয়েছে। বাকি তোরা বল আমাদের ঘরের বউমা কেমন দেখতে? সকলেই একবাক্যে বললেন, আমাদেরও পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া আমাদের ছেলের পছন্দ, শেষ পর্যন্ত। এবার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা যাক।

          তখন দুপুর, সকলে বসে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হল। শ্রাবণ মাসের 2 তারিখ। দেনা-পাওনার প্রসঙ্গটা রিয়ার মামা নিজেই তুললেন।

           সুনীলের দাদু বললেন, আমাদের চাওয়া-পাওয়া তেমন কিছু নেই, মেয়ে পছন্দ হয়েছে এটুকুই যথেষ্ট, বাকি আপনারা মেয়েকে কিভাবে সাজিয়ে পাঠাবেন, সেটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

            সুনীলের বাড়ির সকলের একই কথা। নতুন করে বলার কিছুনেই, দাদুর কথায় সবাই সায়দিল।

             রিয়ার'মা নিজেই বললেন, আপনাদের যখন দেনাপাওনা নিয়ে কিছু বলার নেই, তবে আমি এটুকু বলে রাখি সবার সামনে, আমরা আমাদের মেয়ের জন্য যেটা দেবো, সেটাতো দেবই। তবে সুনীলের জন্য আমরা একটা সোনার হার দেবো, একটা আংটি দেব, আর একটা বাইক দেওয়া হবে। এর বেশি আমরা দিতে পারবনা। ক্ষমা করবেন আমাদের।

             সুনীলের বাবা বললেন, এগুলো কিন্তু আমাদের কোনো দাবি নয় বা ভবিষ্যতে যেন দেনাপাওনা প্রসঙ্গ না ওঠে। আপনারা যা কিছু দিচ্ছেন সেটা নিজের খুশিতে দিচ্ছেন এবং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আপনারা অনেক কিছুই দিচ্ছেন।

             রিয়ার জ্যাঠামশাই একটা সাদাকাগজ নিয়ে এসে সর্বসমক্ষে বিয়ের দিনক্ষণ এর সমস্ত বিষয়টা লিখিত আকারে উপস্থিত সকলের কাছ থেকে একটা করে সই করিয়ে রাখলেন। তারপর ঠিক হলো আগামী 24 তারিখ রেজিস্ট্রিম্যারেজ হবে।

        উভয় পরিবারের রেজিস্ট্রিম্যারেজ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই।

        দুপুরে রিয়ার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া হল। বেশ ভালো ভালো পদ ছিল। যেহেতু সম্বন্ধের ফাইনাল কথা, তাই বয়স্ক ও ছোটদের সাথে অনেকেই আলতা খেলায় মেতে উঠলেন।

আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপর সুনীল আর রিয়ার দাম্পত্যজীবনে প্রবেশ করবে। আমরা সকলেই সেই দাম্পত্য জীবন সুখের হোক এই কামনা করব

রিয়া ও সুনীলের বৈবাহিক বিষয়ে সামাজিক দিনক্ষণ প্রস্তুত। বিয়ের আর বেশিদিন বাকি নেই।

             দুই বাড়িতে প্রস্তুতি তুঙ্গে। সুনীলের পুরো পরিবার সেদিন শপিংয়ে গেছে। সুনীলের ভাইঝি'টা খুব ছোট। বছর পাঁচেকের হবে। ওর যত আবদার জেঠুর কাছে,অর্থাৎ সুনীলের কাছে। সারাক্ষণ জেঠু ছাড়া চলেনা। নিজের বাবা মায়ের কাছে খুব কম থাকে। আসলে সেটা নয়,বাচ্চারা যার থেকে বেশি স্নেহ ভালোবাসা বা আদর পায় তার ভক্ত বেশি হয়। সুনীলের ভাইঝির নাম রিমি। বেশ মিষ্টি মেয়ে। চনমনে,ছটপট করে সারাক্ষন। ওকে কেউ যদি বকে দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে জেঠুর কাছে নালিশ। আর জেঠু অর্থাৎ সুনীল যদি মাথায় হাত বুলিয়ে একবার বলে দেয়, আচ্ছা বকে দেব তাকে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কান্না থেমে যায়।

               সুনীলের বাবা পরিবারের প্রত্যেকের জন্য কাপড়চোপড় কিনেছেন। দুই বৌমার জন্য সুন্দর দেখে দুটো বেনারসী শাড়ি কিনেছেন। পছন্দ অবশ্য সুনীলের ভাই বউয়ের।

             সেদিন সুনীল আর রিয়াকে সারাদিনে ফোন করবার সুযোগ পায়নি, এত ব্যস্ততার জন্য।

            সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে সুনীল রিয়াকে ফোন করে। প্রথমবার সুনীলের ফোন ধরলোনা রিয়া। পরের বার রিয়া ফোনটা তুললো।

         সঙ্গে সঙ্গে সুনীলকে বললো- 'কি ব্যাপার, তোমার আজ সারাদিনে আমার কথা এখন মনে পড়লো? কই একবারও ফোন করনি তো'।

সুনীল: ওহ স্যরি ডিয়ার,আজ একদম সময় পাইনি সারাদিন, খুব ব্যস্ত ছিলাম।এই আমাদের সব শপিং-এ বেরিয়ে ছিলাম, আমি,মা, বাবা, ভাই,ভাইবউ ও আমাদের পুচকি রিমি। সেও ছিল সাথে। ওতো সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরবে। ওর যত আবদার আমার কাছে, তাই সবার জামা কাপড়, আরো অন্যান্য কিছু কিনতে গিয়ে আমাদের এই কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফেরা হলো। সেকারণেই তোমার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বলো তোমাদের খবর কি?

রিয়া: ভালো। খুব ব্যস্ত থাকা ভালো, তোমারতো দেখছি আমার জন্য এক বিন্দু সময়ও নেই।

সুনীল: আরে তেমনটা নয়, আজ সত্যি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম,তাই তোমাকে ফোন করা সম্ভব হয়নি। বল এখন ফ্রি আছি। আসলে কি জানো তো, আমাদের আবার নিয়ম আছে, বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে বাবা, মা, কাকা, জেঠা, দিদি, জামাইবাবু,ওদের ছেলে মেয়ে সবার নতুন জামা কাপড় কিনতে হয়। তাই কার কি পছন্দ হবে না হবে, সেটা অনেকটা দেখে কিনতে হয়েছে। আজ খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

রিয়া: আচ্ছা ঠিক আছে, ক্লান্ত যখন হয়ে পড়েছো, আজ রেখে দাও, কাল কথা হবে।

সুনীল: না না, তেমনটা কিছু নাই, বল কি বলবে?

রিয়া: ভাইঝি আবদার করলে তার কথা শোনো, বিয়ের পরে আমি আবদার করলে আমার কথা শুনবে তো?

সুনীল: এ বাবা! এমনটা বলতে আছে? তোমার কথা শুনবো না?

রিয়া: কি জানি, আমার তো কি মনে হয়?

সুনীল: একচুয়ালি সেটা নয়, কি বলতো, আমি বাচ্চাদের একটু বেশি ভালোবাসি। তাই বাচ্চারাও আমাকে ভালোবাসে। বাড়িতে ওই হচ্ছে একমাত্র ছোট বাচ্চা, তাই একটু বেশি আদর পায়, আমি একটু বাচ্চাদের বেশি আদর করি। আমি বাচ্চাদের মারিনা, বকিনা, ওদের যা বায়না থাকে সব শুনি, তাই বাচ্চারা আমার ভক্ত হয়ে যায়। একটা বাচ্চার আবদারে, তোমার হিংসে করা ঠিক হয়নি।

রিয়া: সবই ঠিক আছে, মানলাম, আমাদেরও বাচ্চা যখন হবে, তাকে তুমি ভালবাসবে তো? না সব ভালোবাসা তোমার ভাইঝিকে দিয়ে দিয়েছো? ঠিক আছে, আমার কথায় রাগ করোনা, খারাপ কিছু বলে থাকলে সরি।

সুনীল: ও না ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। আজ কত তারিখ বলতো?

রিয়া: আজ কুড়ি তারিখ।

সুনীল: তাহলে আমাদের বিয়ের কদিন বাকি?

রিয়া: কদিন আর বাকি, এদিকে দশদিন আর ওদিকে একদিন মোট 11 দিন।

সুনীল: ঠিক বলেছ। যত দিন ঘনিয়ে আসছে, কেমন বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে তাই না?

রিয়া: হাহাহা, একদম ঠিক বলেছ,আমার মনের কথা।

সুনীল: হাহাহা।

রিয়া: শোনো না, তোমাদের কার্ড ছাপাতে দিয়ে দিয়েছো?

সুনীল: না, কাল যাব সকালবেলা, অনেক বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন আছে, অনেকে কার্ড ছাপাতে হবে।

রিয়া: আমাদেরও তাই।

সুনীল: তোমার বান্ধবীদের নেমন্তন্ন করবে। আর বৌভাতে আমাদের বাড়িতে সকলকে আসতে বলবে, প্রয়োজনে ওদের জন্য স্পেশাল গাড়ি পাঠিয়ে দেব।

রিয়া: না না, আলাদা গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই, আমাদের বাড়ি থেকে যারা যাবে, একটা বাস বুক হয়েছে, সেই বাসে সবার হয়ে যাবে, তাতেই ওরা চলে আসবে।

সুনীল: আচ্ছা ঠিক আছে, দেখে নিও তুমি ওদিকটা, যদি কোনো অসুবিধা হয় আমাকে জানাবে।

রিয়া: আরে জানো, আমার ছোট কাকার শরীরটা ভালো নেই। আমাদের ফাইনাল কথার দিন, এসে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়িতে গেছে, গিয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ডাক্তার দেখেছে জানিনা কি হবে।

সুনীল: এমা তাই! খুব ভালো মানুষ তো! বেশ রসিক কথাবার্তা বলছিলেন। যাবে একবার, দেখা করে আসবে।

রিয়া: আজ সকালে গিয়েছিলাম,দেখা করে এসেছি।

সুনীল: গুড গার্ল।

রিয়া: আচ্ছা আজ রাখি কাল কথা হবে। আমার আবার মায়ের সাথে রান্নায় একটু হাত লাগাতে হবে। চলো টাটা।

সুনীল: হুম। টাটা। রাতে কথা হবে।

মনে মনে সুনীল রিয়ার এরকম কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়লো। ভাবলো এই ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যত বেশি মাথা ঘামানো যায় ততবেশি সমস্যা। বেশি চিন্তা না করাই ভালো।

         পরেরদিন সুনীল পাশেই এক ছাপাখানায় গিয়ে নিজের পছন্দের কয়েকটা বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড নিয়ে আসে। বাড়ির সকলের পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে। দুপুরে বাড়ির সকলে মিলে বসে বেস্ট কার্ডটা পছন্দ করে।

       সন্ধ্যায় কার্ড ছাপাতে যায় সুনীল। ফেরার পথে সুনীল রিয়াকে ফোন করে কার্ড ছাপানোর বিষয়টা বলে দেয়।

      সুনীলের ভাই আবার এক অভিনব পন্থায় দাদার বিয়ের কার্ড ছাপানো তোড়জোড় শুরু করেছে। আজকালকার যুগে ভিডিও বার্তায় অনেক সময় নেমন্তন্ন কার্ড পাঠানো যায়, যেটা আমরা হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও বলে থাকি। দাদার বিয়ে বলে কথা! বেশ ধুমধাম করে বিয়েটা হবে এবং সকলেই উপভোগ করবে, মনে রাখার মত বিয়ে হোক । কার্ড ছাপানো হল, সাথে ভিডিও মারফৎ নিমন্ত্রিতদের মোবাইলে নেমন্তন্ন কার্ড পাঠানোর বন্দোবস্ত হলো।

       রিয়ার বাড়ি থেকেও বিয়ের কার্ড ছাপানো শেষ। বাকি শুধু কার্ড বিতরণ করা। কদিনের মধ্যে দুই বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে নেমন্তন্ন কার্ড পাঠানো শুরু হয়ে গেছে।

      রিয়া ও সুনীল নিত্য দিনের মতো ফোনালাপ করে। আগামী বুধবার অর্থাৎ বিয়ের শুভদিন বাকি মাত্র তিন দিন।

সেদিন সন্ধ্যায় রিয়া সুনীলকে ফোন করে ।

রিয়া: জানো। কাকুর শরীরটা ভীষণ খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি। কি জানি কি হবে। আমার বাড়ির সবাই হাসপাতালে গেছে। কাকুর সাথে দেখা করতে।

      কদিন আগে কাকু আমাকে বললো, তোর বিয়েতে জমিয়ে খাবো। আজ কাকুর শরীরটা এত খারাপ হয়ে যাবে, এমনটা আমাদের জানা ছিল না। বাড়ির সকলের মন'মেজাজ খারাপ। আমারও ভালো লাগছেনা।

সুনীল: আমারও কথাটা শুনে ভালো লাগছেনা। আমি কাল সকালে একবার ওনার সাথে দেখা করতে যাবো হসপিটালে। হসপিটালে তোমাদের বাড়ির লোক থাকবে তো কেউ না কেউ ।

রিয়া: হা। থাকবে তো নিশ্চই। একবার যেও। কাল আমাদের বাড়ির লোক কে থাকবে আমি জানিয়ে দেবো।

পরের দিন সুনীল সকাল সকাল এক বন্ধুর সাথে বাইকে করে হসপিটালে পৌঁছে যায়। রিয়ার জেঠুর ছেলে হসপিটালে ছিল। ওর সাথে দেখা করে, রিয়ার কাকুর সাথে কথা বলে সুনীল।

অশ্রুসজল নয়নে রিয়ার কাকু, কত কি বলে গেলেন। " বাবা, আমার ভাইঝিকে ভালো রেখো। তোমাদের বিয়েতে হয়তো আমি উপস্থিত থাকতে পারবো না। তবুও আমার আশীর্বাদ রইল তোমাদের দুজনের জন্য। তোমাদের বিয়ে ভালোভাবেই হোক। ঈশ্বরের কাছে তোমাদের সুখের সংসার কামনা করি।"

সুনীল: কাঁদতে নেই কাকু। সুস্থ হয়ে উঠবেন তাড়াতাড়ি। চিন্তা করবেন না। ডাক্তার আছে তো। ওষুধ চলছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

সিস্টার: বেশি কথা বলবেন না। আপনার কথা বলা বারণ আছে। ডাক্তার দেখলে বকা দেবে।

সুনীল: আচ্ছা কাকু আজ আসি আমি। নিচে অন্যরা অপেক্ষা করছে। তারা আপনার সাথে দেখা করবে।

       আচ্ছা, এসো বাবা। এই কদিন সাবধানে থেকো। আমার ছুটি হলেই তোমাদের বাড়ি যাবো।

সুনীল: আচ্ছা। নিশ্চই আসবেন। আজ আসি কাকু।

        (বলেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সুনীল বিদায় নিল। বাইরে বেরিয়ে সুনীল রিয়ার সাথে ফোনে কথা বলে। উপস্থিত রিয়ার বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ফেরে।)

আগামীকাল সুনীল ও রিয়ার বিয়ে।

      বিয়ের আগেরদিন রাতে রিয়া ও সুনীল হাতে মেহেন্দি লাগিয়েছে। বেশ সুন্দর ডিজাইন।

       উভয়ে উভয়ের হাতের ছবি তুলে হোয়াটসআপ করে। তখন প্রায় রাত দুটো।

হঠাৎ রিয়া ফোন করে সুনীলকে।

সুনীল: হাঁ বলো রিয়া। এত রাতে ফোন করলে? সব ঠিক আছে তো?

(ওপার থেকে রিয়া হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে।)

সুনীল: অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে। বলো কি হয়েছে। শান্ত হও।

রিয়া : (নিজেকে সামলে নিয়ে।) কি কেমন ইয়ার্কি করলাম বলো। তুমি ভয় পেয়ে গেছো নিশ্চই।

সুনীল: উফঃ। আমার বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করে উঠলো। বলো । আমার হাতের মেহেন্দি দেখেছো? কেমন ফুটেছে? বেশ সুন্দর ডিজাইন না?

রিয়া: খুব সুন্দর ডিজাইন। কে এঁকে দিয়েছে? আর আমার হাতের মেহেন্দির ডিজাইন দেখেছ? কেমন বললে না তো? তাই ফোন করলাম।

সুনীল: ওহ । এগুলো বাড়ির বোনেরা এসেছে। ওরাই সব এঁকে দিয়েছে। আর উত্তর দিতে পারিনি। কারণ তখনও মেহেন্দি শুকিয়ে ছিলনা। তাই। তোমার হাতে আঁকা ডিজাইন হেভি হয়েছে। কে এঁকেছে?

রিয়া: কে আবার। আমার বান্ধবীরা এঁকেছে। আমার তো কি ঘুম পাচ্ছে। ওদের জ্বালাতনে একটু ঘুমোতেও পারছি না।

সুনীল: আমারও ঘুম পাচ্ছে। অনেক কাজ করতে হবে তাই মনে হয় আজ সারা রাত জাগতে হবে। চলো রাখি। দেখি ওদিকে বন্ধুরা কি করছে দেখে আসি।

সকালে ফোন করবো কেমন?

রিয়া: ওকে। বায়...........

দুই পরিবারে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আসতে শুরু করেছেন। সবাই কিছু সময় পর বিয়ের আনন্দে মেতে উঠবে। সকাল গড়ালেই গায়ে হলুদ পর্ব ।

        প্রায় সকাল সাত'টা বাজে। সুনীলের বাড়িতে বিয়ের সানাই বেজে ওঠে। ঘুমঘুম চোখে সুনীল বিছানা ছেড়ে মোবাইল দেখে মুচকি হাসে। রিয়া এর মধ্যেই দুবার ফোন করে ফেলেছে। সুনীল মুখচোখ ধুয়ে এসে রিয়াকে ফোন করে।

সুনীল: বলো , ফোন করে ছিলে? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

রিয়া: বাবা তোমাকে ফোন করেছিল। আর্জেন্ট দরকার, বলছিলেন। তারপর কিছু বুঝতে পারছিনা। বাবা কেমন অস্থির হয়ে এদিকওদিক ছোটাছুটি করছিলেন, সবাই কোথায় গেল, বুঝতেই পারছি না। কি জানি কি হলো। ওহ হ্যা, মামা বললেন তুমি যেন ওনাকে এক্ষুনি ফোন কর। তোমাদের বাড়ির কাউকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা।

সুনীল: আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি কথা বলছি। গান চালিয়েছে ডেকোরেটরের লোকটা। তাই শুনতে পাইনি। আচ্ছা, এখন রাখো। পরে কথা বলছি।

সুনীল মাইক বাজানো বন্ধ করতে বলে কিছুক্ষনের জন্য।

সুনীল: (রিয়ার মামাকে ফোন করে।) হেলো! হা মামা বলুন। ফোন করতে বলেছিলেন?

     রিয়ার মামা বললেন-'হা,হা । খুব আর্জেন্ট আছে। তোমার বাবাকে একটু ফোনটা দাও, কিছু কথা বলবার আছে।

সুনীল: আচ্ছা, একটু ধরুন বাবাকে দিচ্ছি লাইনটা। বাবা, বাবা..... (বলতে বলতে সুনীল ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো।)

      সুনীলের মা বললেন,তোর বাবা তো এখন ঘরে নেই, বাজারের দিকে গেছে। কিছু বলবি?

সুনীল: না, রিয়ার মামা একটু কথা বলবেন, ফোনে আছেন। আর্জেন্ট কথা আছে।

      কি হলো আবার? ওই তো, তোর ছোটকাকু দাঁড়িয়ে বাইরে, কথা বলতে বল। আমি একটু ব্যস্ত আছি।

সুনীল: হাঁ মামা,আমার ছোটকাকুর সাথে কথা বললে হবে?

রিয়ার মামা: হুম,তাই দাও।

সুনীল: কাকু.... ও কাকু। এদিকে আসো।

-- হা বল। (সুনীলের কাকু এগিয়ে এলেন,ঘরের ভিতর)

সুনীল: লাইনে রিয়ার মামা আছেন। কিছু বলতে চাইছেন, আর্জেন্ট। বাবার সাথে কথা বলতো উনি। কিন্তু বাবাতো এখন ঘরে নেই। বাজারে গেছে। তাই তোমার সাথে কথা বলবেন উনি। একটু কথা বলোনা।

-- হা, দে ফোনটা। বলে সুনীলের কাকা কথা বলতে বলতে ফোন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

       ক্ষনিকের মধ্যে ফিরে এসে সুনীলের হাতে ফোন দিয়ে আর কারুর সাথে কথা না বলে, ঘরের বাইরে দাঁড়ানো বাইক নিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেলেন।

(সাময়িক সুনীলও ঘাবড়ে গেল। যাহ বাবা! কি হলো? কাকু কিছু না বলে ফোনটা হাতে ধরিয়ে কোথায় চলে গেলো? দেখি রিয়াকে একবার ফোন করি। বলতে বলতে রিয়াকে ফোন করে সুনীল।)

        সুনীলের কাকু, সোজা বাজারে গিয়ে সুনীলের বাবার সাথে দেখা করে বলে -"দাদা একটু এদিকে এসো। দরকারি কথা আছে।"

সুনীলের বাবা বললেন-'বল, কি কথা'।

       রিয়া আর ফোন ধরে না সুনীলের। কি যে হচ্ছে সকাল সকাল, । বুঝতেই পারছি না কিছু। সুনীল বিড়বিড় করতে করতে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো।

       সুনীলের কাকা নলিনীবাবু, সুনীলের বাবাকে বললেন-" মেয়ের মামা ফোন করে ছিলো, মেয়ের কাকা কদিন ধরে হসপিটালে ভর্তি। অবস্থা বিশেষ ভালো নেই। ওনার বাড়ির সকলে হসপিটালে গেছে। ঘরে শুধু বাড়ির মেয়েরা আছে। তাই ওনারা সময় নষ্ট না করে, বিয়েটা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেরে ফেলতে চাইছেন। যদি কিছু অঘটন ঘটে যায় তাই। তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিল রিয়ার মামা। তোমাকে ফোনে পায়নি। তুমি কি বলো দাদা?

       সুনীলের বাবা পরেশ বাবু বললেন-"তা বুঝতে পারছি। কিন্তু এই বরযাত্রীদের যে যাওয়ার কথাছিল তাদের কি হবে? তাছাড়া অনেক আত্মীয়স্বজন এখনও এসে পৌঁছায়নি। তারা তো মনোক্ষুন্ন হবে। কি করা যায় এখন? আমারতো মাথায় কিছু আসছে না। ঠিক আছে ঘরে চল, তারপর কি করা যায় দেখছি।

        বাড়ির অন্যান্য সকলের সাথে পরামর্শ করে, সুনীলের বাবা পরেশবাবু, তৎক্ষণাৎ সবার সাথে আলোচনা সারলেন।

        রান্নাঠাকুরকে বলে দুপুরের আয়োজনে একটু বাড়িয়ে রাখতে বলেন সুনীলের বাবা।

      রিয়ার বাড়িতে কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। রিয়াকে বিয়ের সাজে সাজাতে ব্যস্ত রিয়ার বান্ধবীরা। রিয়া কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। যে বিয়ে রাতে হাওয়ার কথা সেটা এই দুপুরেই হবে কেন, বুঝতেই পারছি না।

(মনের দুঃখে বিয়ের সাজেরত রিয়া ও সুনীল।)

       কিছুক্ষণের মধ্যেই সুনীলের বাড়ি থেকে বর ও বরযাত্রী বেরিয়ে গেছে শুভবিবাহ সম্পন্নের উদ্যেশ্যে।

         রিয়ার বাড়িতে উপস্থিত বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্যরা ব্যস্ত কনেকে সাজাতে।

ছাদনাতলা সেজে উঠছে। বিয়ের সানাই বেজে উঠেছে রিয়ার বাড়িতে। এ সানাইয়ের সুর বিষাদেভরা। ক্রন্দনরত বাড়ির সকল মহিলা। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে রিয়ার বাবা ঘরের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। মেয়েকে কনের সাজে দেখে আরও জোরে কেঁদে ফেললেন। মেয়ের কাছে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসে নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন।

রিয়া নিজেকে সামলাতে না পেরে বাবাকে এমন কাঁদতে দেখে নিজেও কেঁদে ফেললো। রিয়ার বান্ধবীরা রিয়াকে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে।

        রিয়ার এক দাদা এসে, রিয়াকে ছাড়া বাড়ির সকলকে এক ঘরে ডেকে নিয়ে গেল।...

উৎকণ্ঠার মধ্যে বাড়ির সকল সদস্য একটা ঘরে প্রবেশ করলেন। সম্পর্কে রিয়ার দাদা হন, তিনি, রিয়ার মাকে জিজ্ঞেস করলেন-'আমাদের মেয়েকে সাজানো হয়ে গেছে? যদি না হয়ে থাকে তাড়াতাড়ি সাজিয়ে নিও। কারণ কাকু আর বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ হলো মারা গেছেন'।

      এক দিকে বিয়ের সানাই বাজছে,অন্যদিকে বরের গাড়ি অর্থাৎ সুনীল সহ বরযাত্রীর গাড়ি , রিয়া'দের বাড়ির গেটে উপস্থিত।

বাড়ির মেয়ে ও বাচ্ছা'রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, রিয়ার কাকুর মৃত্যুসংবাদে।

         বাড়িতে কেউ মারা গেলে, সেই বাড়িতে অ'শৌচ হয়, তাই বিয়ের আসরে রিয়ার বাবা-মা বা রক্ত সম্পর্কিত অন্য কেউ উপস্থিত থাকতে পারেননা।

         এমতাবস্থায় ঠিক হলো, রিয়ার মামার বাড়ি থেকে যারা এসেছেন, তারাই কন্যাসম্প্রদান থেকে আরম্ভ করে, যাবতীয় বিয়ের কাজ করবেন।

         অশ্রুসজল নয়নে রিয়ার বাবা বললেন-' এই খবরটা মেয়েকে অর্থাৎ রিয়াকে এখন আপাতত কেউ দিওনা। কারণ ভাই রিয়াকে খুব ভালোবাসত। ভাই এজগতে নেই শুনলে রিয়া খুব মানসিক আঘাত পাবে। যা ঘটার ঘটে গেছে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন শুভ কাজটা সম্পন্ন হোক।

সবাইকে এক ঘরে একসাথে চলে যেতে দেখে, রিয়ার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। রিয়া কোন বাধা না মেনে সবার কাছে চলে আসে। বাবার মুখ থেকে যা হওয়ার হয়ে গেছে কথাটা শুনে, কেমন বিচলিত হয়ে ওঠে রিয়া।

        জিজ্ঞেস করে বাবাকে-' কি হয়েছে বাবা! যা হওয়ার কি হয়ে গেছে? আমাকে বলোনা। মা! কাকিমা! তোমরা কাঁদছো কেন?

চোখ মুছতে মুছতে রিয়ার মা রিয়াকে বললেন-'তুই এখন ও ঘরে যা মা। আমাদের ছুঁবিনা মা, তোর বিয়ে না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। এখন তোর শুভ সময় চলছে। কিচ্ছু হয়নি মা। যা, তুই তোর বান্ধবীদের সাথে সাজগোজ যদি কিছু বাকি থাকে তাড়াতাড়ি করেনে। বর এসে গেছে। এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

অঝোরধারায় রিয়ার মা কাকিমা'রা ঘরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। রিয়াও মা কাকিমার কান্না দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনা। পুরো পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।

রিয়ার মামা ও আশেপাশের প্রতিবেশীদের সহায়তায় বর ও বরযাত্রীদের যথাসম্ভব আপ্যায়ন করতে কেউ ত্রুটি রাখেনি।

সুনীলের বাবাকে, রিয়ার মামা, দুঃসংবাদ শুনিয়েছেন। উভয় পরিবার শোকে মুহ্যমান। সুনীলও সাময়িক বুঝতে পেরেছে। যদিও সুনীল ও রিয়াকে কাকার মৃত্যু সংবাদ শোনানো হয়নি।

        ইতিমধ্যে ঠাকুরমশাই ছাদনা তলায় উপস্থিত হয়েছেন। বিবাহের যাবতীয় উপকরণ রিয়ার বান্ধবীরা ও রিয়ার মামার বাড়ির সকলে পরিবেশন করছেন।

         ঠাকুরমশাই সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে বর-কনেকে আশীর্বাদের জন্য উপস্থিত হতে বললেন।

         খুব দ্রুততার সাথে সমস্ত কাজ হচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে রিয়া বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে।

          সাজগোজে রিয়াকে বেশ লাগছে। উঁকিঝুঁকি মেরে রিয়াকে সুনীল বারবার দেখার চেষ্টা করছে। সুনীলের বন্ধুরা, সুনীলের সাথে সমানে ইয়ার্কি করে চলেছে। 'ভাই অত দেখিসনা। তোর বউ এক্ষুনি তোর সামনে আসবে। একটু সবুর কর'।

লজ্জায় সুনীল বলে-'নানা কই আমিতো দেখছিনা কিছু'।

          সুনীলের বন্ধুরা বলে, আচ্ছা! আমরা কি কিছু বুঝিনা।

ঠাকুরমশাই, কনে ও কনের বাবাকে ছাদনা তলায় উপস্থিত হতে বলেন।

          সবাই যে যার মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক।

রিয়ার মামা ছুটে এসে ঠাকুর মশাইয়ের কানেকানে রিয়ার কাকার মৃত্যুর দুঃসংবাদের খবর শোনালেন ফিসফিস করে।

তাই ঠিক হলো, রিয়ার মামী, কন্যাসম্প্রদান করবেন।

          অশ্রুসজল নয়নে রিয়া ও রিয়ার মামী ধীরে এগিয়ে এলেন ছাদনা তলায়।

           দূর থেকে মেয়েকে, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দেখে, বাবা মায়ের কান্না থামেনা।

           একদিকে ঘরের লক্ষী বিয়ের পিঁড়িতে বসবে, অন্যদিকে ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ। যেন ঈশ্বরের সর্বসুখ হরণের খেলা।

            ঠাকুরমশাই দ্রুত মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যদিয়ে বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন করবার চেষ্টা করছেন।

            এমন সময় রিয়া কেঁদে ওঠে বিয়ের পিঁড়িতে বসেই।

কাঁদতে কাঁদতে বলে 'আমার ছোটকাকুর জন্য মনখারাপ করছে। কাকু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে আমাদের ঘরে অবশ্যই যেতে বলো মা। কাকিমা কোথায়? মা! কাকিমা এত কাঁদছে কেন ওখানে? কাকুর কি কিছু হলো.......

রিয়া: মা! কাকিমা এত কাঁদছে কেন । বলো আমাকে মা। চলো কাকিমার কাছে যাই। জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে।

রিয়ার মা: না মা না। এমনটা করেনা। কাকিমা এমনি কাঁদছে। তোকে খুব ভালোবাসতো তো তাই। আমাদের কাছে বেশি আসিসনা। তোর মামীকে যা বলার বলবি। মামী তো কন্যা সম্প্রদান করেছে। ওরাই তোর বিয়ের সবটা দেখছে।

রিয়া: মা তোমরা কিছু লুকাচ্ছ আমায়। সত্যি করে বলোতো কি হয়েছে?

রিয়ার মা: তুই থামবি এবার। যা। বিয়ে শেষ পর্যায়ে এসেছে।

রিয়ার মামা এসে পুরুতমশাইয়ের কানে কানে কিছু একটা বলে যেতেই পুরুত মশাই ক্ষনিকের মধ্যেই বিবাহ সম্পর্কিত সমস্ত বিধি সম্পাদন করলেন।

বর কনেকে নিয়ে ঘরে যাওয়া হলো। তখন প্রায় বেলা হয়ে এসেছে। একদিকে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া চলছে অন্যদিকে বর ও কনেকে শেষ মুহূর্তের বাকি মেকাপটুকু করে দিতে ব্যস্ত রিয়ার বান্ধবীরা।

সুনীলের বন্ধু, সৌনকের আবার রিয়ার এক বান্ধবীকে পছন্দ হয়েছে। তার কি কাকুতিমিনতি সুনীলের কাছে। ভাই তোর বউকে বলে আমার সেটিংটা করে দিস প্লিজ।

হাসতে হাসতে সুনীল সৌনককে বলে তা বলবোখন। কিন্তু একটা কাজ করে দিতে হবে তোকে।

কি কাজ বল ভাই। এক্ষুনি করে দিচ্ছি।

সুনীল: আরে এক্ষুনি নয়। আমার ঘরটা গিয়ে তোকে দায়িত্ব নিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে। বাকিটা আমি দেখছি রিয়াকে বলে। তবে এখন নয়। ফেরত জামাই আসি, তারপর বলবো।

        আচ্ছা। তাই করিস। দেখিস যেন কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়েটা করার সৌভাগ্য হয়। তোরা তো সবাই বিয়ে করে নিলি। আমায় নিয়ে কেউ ভাবেনা।

সুনীল: হা হা হা । আচ্ছা আমি ভাববো। ওকে। চাপ নিসনা।

-- তাই ভাবিস।

রিয়া ও সুনীলকে তৈরি করে সকলে মিলে গাড়ির উদ্যেশ্যে এগিয়ে চলে। বাড়ির প্রতিটা মেম্বার কান্নায় ভেঙে পড়ে। মেয়েটা এত বছর ঘরে ছিল আজ শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে।

বিদায়ের সুর বেজে ওঠে । বিষণ্ণতা যেন গ্রাস করে আসে সারা পাড়া জুড়ে। দূরে রিয়ার মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সমানে কেঁদে চলেছেন। রিয়ার বাবাও মেয়েকে বিদায় জানাতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ওমনি রিয়ার মা হাতটা টেনে ধরলেন।

গাড়ি ছাড়বে ছাড়বে করছে। রিয়ার বান্ধবীরাও প্রিয় বান্ধবীর বিদায় লগ্নে যেতেই দিতে চাইছে না।

         এমন সময় স্বর্গসাথী গাড়িটা সজোরে হর্ন বাজিয়ে চলেছে। ইশারায় রিয়ার মামা বর-কনের গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে যেতে বললেন।

          সেদিন রিয়া ও সুনীলের গাড়িটা আর থামেনি।গাড়ি ধীর গতিতে এগিয়ে চলে ।

          ক্রন্দনরত পরিবারের কান্না যেন আর থামেনা। বিয়ের গাড়িটা এগিয়ে যেতেই সেই জায়গায় স্বর্গসাথী গাড়িটা এসে দাঁড়ালো।

গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রিয়া তাকিয়ে দেখে বাপের বাড়ির গেটের সামনে শববাহী একটা গাড়ি দাঁড়ালো। সামনে সুনীলদের সাথে আসা ডিজে সমানে বেজে চলেছে।

ততক্ষনে রিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ কাকু বেঁচে নেই।

         দুঃখভরা হৃদয়ে রিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে সুনীলের কাঁধে মাথা রেখে। বারবার সুনীলকে বলতে থাকে গাড়িটা ঘুরিয়ে একবার যেন ঘরে নিয়ে যায়।

          রিয়ার কান্না দেখে সুনীলও ঠিক থাকতে পারেনি। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে সুনীলের।

          ক্ষণিক গাড়ি যাওয়ার পর, সুনীল ড্রাইভারকে গাড়িটা দাঁড় করাতে বলে। ড্রাইভার গাড়িটা বাঁদিক করে রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে।

সুনীলের বাড়ির সকলের সাথে কথা বলে গাড়িটা ঘুরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করে সুনীল। বয়স্ক অনেকেই বিষয়টা মেনে নিতে চায়নি। শুভক্ষণে ফিরে যেতে নেই।

সুনীল: না বাবা তা হতে পারেনা। মৃত্যুও তো শুভ। কোথাও লেখা নেই মৃত্যু অশুভ। প্লিজ বাবা তুমি ওদের সকলের কথায় সায় দিওনা। একবার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দাও। আমরা দেখে চলে আসবো।

        সুনীলের বাবা ছেলের কথা ফেলতে পারলেননা। কোনো আপত্তি করলেননা।

          গাড়ি ঘুরিয়ে এগিয়ে যায় রিয়ার বাপের বাড়ির উদ্যেশ্যে।

উপস্থিত সকলে অবাক। গাড়ি থেকে নেমে রিয়া কাকুর মুখটা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

          ক্ষণিক দাঁড়িয়ে কাকুর পায়ের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে দুজন প্রনাম করে,বাড়ির উদ্যেশে রওনা দিলো।

            একপক্ষের কান্না ও অন্য পক্ষের সেই দুঃখের সময়ে সহানুভূতি যেন মিলেমিশে একাকার। সুনীল রিয়ার আবদার বা অনুরোধ যাই বলিনা কেন, তা সুনীল ফেলে দেয়নি। এক সাথে পথ চলার অঙ্গীকার নিয়েই তো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে কিছু সময় আগে। তা সুনীল ভোলে কি করে। স্ত্রীর কথা যথাযোগ্য সম্মানের সাথে রক্ষা করেছে।

          গাড়ি ছুটে চলেছে, সুখ দুঃখের সফর সন্ধানে। গাড়ির জানালার খোলা, হওয়া হুহু করে ঢুকছে গাড়ির ভিতর। কখন যে রিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে সুনীলের কাঁধে তা জানেনা।

          মাঝেমাঝে গাড়ি রাস্তায় থমকে দাঁড়ায়। গ্রামের দিকে এখনও বিয়ের গাড়ি লোকে ঘিরে ধরে, বিশেষ করে গ্রামের মহিলারা নতুন বউকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করে।

          ঘুমন্ত চোখে মাঝেমাঝে রিয়া গাড়ির জানালার বাইরে তাকায় আর ক্রমশ গাড়ি এগিয়ে চলে রিয়ার শ্বশুর বাড়ির উদ্যেশ্যে।

          আর হয়তো মিনিট পনেরো পরে সুনীলের বাড়ি পৌঁছবে বিয়ের গাড়ি। তাই সুনীল রিয়াকে জেগে থাকতে বলে।

গ্রামের বুড়ো শিবমন্দিরে ও শীতলা মায়ের মন্দিরে প্রনাম সেরে সুনীল ও রিয়া আবার গাড়িতে উঠে পাশেই নিজের বাড়ির পথে রওনা দিলো।

          বরণডালা হাতে বাড়ির মেয়ে বউরা তৈরি নতুন বউকে বরণ করতে।

গাড়ি এসে থামলো সুনীলের বাড়ির সামনে। মুখে মুখে উলু ধ্বনিত হতে থাকে। মঙ্গলময় উপাচারে নব দম্পত্তির গৃহপ্রবেশ হলো।

         হঠাৎ অশীতিপর বৃদ্ধা, সুনীলের আম্মা, নাত বউয়ের চৌকাঠ পেরোনোর মুখেই, বলে উঠলেন দাঁড়াও। তোমার গৃহপ্রবেশ এভাবে সম্ভব নয়।

         উপস্থিত অবাক সকলে, আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

আবার কি সমস্যা তৈরি হলো?

           রিয়া চমকে ওঠে। দু'পা পিছিয়ে থমকে দাঁড়ায়।

ভাঙা কোমরটা তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সুনীলের বৃদ্ধা আম্মা। সকলে ভয় পেয়ে যায়, আম্মা কি বলে দেখি। রিয়া কি কোনো দোষ করলো? নিশ্চুপ সকলে। ধীর পায়ে রিয়ার আম্মা এগিয়ে আসছেন রিয়ার দিকে।

           চশমার তলদিয়ে মুখ উঁচিয়ে রিয়ার মুখটা দেখে, গম্ভীর ভাবে সুনীলের দিকে তাকালেন।

            এই বুড়ির আবার কি হলো ভেবে সুনীলও ভয় পেয়ে যায়। তারপর এক গাল হাসি দিয়ে ঠাম্মি বললেন -"এতো সাক্ষাৎ লক্ষী ঘরে এনেছিস সুনীল। সাবধানে রাখিস, আমি আবার এই বয়সে ওর প্রেমে না পড়ে যাই"।

           ঠাম্মার কথা শুনে, উপস্থিত সকলে হোহো করে হেসে ফেলে। সুনীল বলে-' ঠাম্মা তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেছিলাম। এবার পথ ছাড়ো আমরা ভেতরে যাই'।

আবার ঠাম্মি গম্ভীর হয়ে সুনীলকে বললেন- 'এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ফুলশয্যার রাত আসতে অনেক বাকি। এখন থেকেই শুধু ঘরঘর করছে। পাজি ছেলেটা'।

          লজ্জায় সুনীল ও রিয়া মাথা নিচু করে হাসতে থাকে।

সুনীল বলে-'আচ্ছা, বলো ঠাম্মা তোমার আর কি আবদার আছে। সব পূরণ হবে'।

হা। নাতির বিয়ে বলে কথা। নতুন বউকে একটা পরীক্ষা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। সুনীলের ঠাম্মা বললেন।

(পরীক্ষা! কি পরীক্ষা আবার?)

         আছে আছে দিতেই হবে পরীক্ষা, না হলে বুঝবো বৌমা আমাদের খুব দুর্বল।

এদিকে সুনীলের বোনেরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নতুন বউকে ঘরে ঢোকানোর আগে ওদের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে তারপর ঢুকতে দেবে।

          বহুক্ষণ দর কষাকষির পর, সুনীলের পকেট থেকে পাঁচহাজার খসিয়ে, যেই ভিতরে ঢুকবে, ওমনি ঠাম্মি পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

         সুনীল এবার ঠাম্মার পাল্লায় পড়েছে। ঠাম্মার আবদার মেটাতে হবে।

সুনীল বললো এবার বলো ঠাম্মা তোমার কি সেবা করতে পারি।

ঠাম্মি বললেন -"বৌমা গায়ে গতরে কেমন, আমি একটু যাচাই করতে চাই। মানে বৌমা আমাকে কোলে করে এখান থেকে তুলে সোজা ঘরে নিয়ে যাবে। আর নাপারলে বুঝবো মেয়েটা খুবই দুর্বল"।

এত বেশ আবদার! সুনীল বললো-' না ঠাম্মি এমন আবদার মানা সম্ভব নয়। তুমি অন্য কিছু বলো'।

        এবার ঠাম্মি সুনীলের গালটিপে বললেন 'তোকে তো বলছি না। আমার আর বৌমার কথা হচ্ছে।'

         এবার রিয়া হকচকিয়ে যায়। সুনীলের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কি করবে ভেবে পায়না।

         সুনীলও কিছু বলতে পারছেনা।

সুনীলের বাবা বলে উঠলেন-'মা ছাড়ো। বৌমা তোমাকে তুলে যদি না নিয়ে যেতে পারে তাহলে ফেলে দেবে, সাথে তোমার কোমর ভাঙবে আর মেয়েটার কোমরে হয়তো খটকা লাগতে পারে'।

         এবার ঠাম্মি নিজের ছেলেকে থামিয়ে বললেন, আহঃ তুই থামবি? নিজের বৌমা বলে দেখছি বেশ দরদ তোর। সবার আগে ও আমার নাতবউ। তাই আমার আবদার বেশি।

        রিয়া বুঝতে পারছে এবুড়ি সহজে হার মানার নয়। তাই শাড়িটা কোমরে জড়িয়ে ঠাম্মাকে সোজা কোলে তুলে ঘরের ভিতর চেয়ারে নিয়ে বসালো।

          সুনীলের বাড়ির বড় ছোটো সকলে হাততালি দিতে লাগলো।

ঠাম্মিকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের শাড়িটা ঠিক করে নেয় রিয়া।

এবার ঠাম্মিকে সুনীল ও রিয়া প্রনাম করে। ঘরে গিয়ে বসলো।

নব দম্পত্তিকে দুহাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন ঠাম্মি।

          নতুন ঘরে এসে রিয়াকে একবারও মনে হয়নি এরা সবাই অপরিচিত। মনে হয় যেন অনেক বছরের পরিচয় সকলের সাথে। পরিবারের প্রত্যেক মেম্বার বেশ মিশুক মনে হলো রিয়ার।

বৌভাতের দিন নিমন্ত্রিত অতিথিরা জনেজনে আসছেন, নানান উপঢৌকনের সাথে, অনেকেই সেলফি তোলার চেষ্টা করছে।

দুপুরে রিয়ার বাপেরবাড়ি থেকে বান্ধবীরা ও রিয়ার মামা বাড়ির অনেকে এসেছেন বৌভাতের তত্ত্ব হাতে।

       অশৌচের কারণে বাপেরবাড়ি থেকে কেউ আসেনি।

রিয়ার বান্ধবী, সুমনা এসেছে, যাকে সুনীলের বন্ধু সৌনকের পছন্দ হয়েছিল।

         আনন্দে আত্মহারা সৌনক, বন্ধু সুনীলকে বলে-'ভাই, আমার পছন্দের সেই মেয়েটা এসেছে, যার কথা তোকে বিয়ের সময় বলেছিলাম। সেটটিংটা করিয়ে দিস। পারলে তোর বউ কিছু করতে পারে।

সুনীল: আমার ঘরটা এখনও সাজিয়ে উঠতে পারিসনি, আগে আমার কাজ, তারপর তোর কাজ। দাঁড়া, রিয়াকে তোর বিষয়টা বলি, কি বলে দেখি।

           সুনীল রিয়ার কানে কানে বললো, সৌনকের প্রেমের কথা।

রিয়া প্রত্যুত্তরে সুনীলকে বললো-"সৌনককে একবার আসতে বলো এখানে। এভাবে ভালোবাসা বা প্রেম নিবেদন হয় না"।

বাসরঘর সাজাতে ব্যস্ত, সৌনক'কে সুনীল আস্তে করে বললো-'আপনাকে যথাস্থানে স্মরণ করা হয়েছে, আপনি উপস্থিত হউন। কি বলে শোন, হয়তো তোর পছন্দের জনের সাথে পরিচয় করাবে।

      নাচতে নাচতে সৌনক, পাশের ঘরের সভাস্থলে হাজির।

ঘরে রিয়া,ও রিয়ার বান্ধবীরা আড্ডায় মশগুল। সৌনক প্রবেশ করলো, গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললো-' আমায় মনে হয় এই সভাস্থলে স্মরণ করা হয়েছে'?

ইতস্ততঃ রিয়া সৌনককে ডেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়-' সম্পর্কে আমার দেওর বাহাদুর। নাম'টা খুব মিষ্টি, সৌনক। উনি পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। বর্তমানে উনি এক গুরুদায়িত্ব পালন করছেন, সেটা হলো বন্ধুর বাসরঘর নিজের মতো সাজানো। আর বিশেষ কিছু আমার জানা নেই এনার সম্পর্কে।😊

সৌনক: আহঃ! থামলে কেন বৌদিমনি। আমি তো তৈরি আছি।

রিয়া: আমি আর কিছু বলতে পারবো না,(লাজুক মুখে) আমার বলতে বাকিটা লজ্জা লাগে। কারণ আমিতো আর ঘটক নই।

সৌনক: যাঃ, তীরে এসে তরী ডোবালে? দেখি, আমি আর সুনীল কতটুকু কি করতে পারি। আচ্ছা ম্যাডাম আপনার নামটা জানতে পারি?

রিয়ার বান্ধবী বললো -'আমার নাম সুমনা'।

সৌনক: আহঃ রে। সুমনা নামটা কি মিষ্টি। কি মিষ্টি। নামটা বিশ্লেষণ করলে ঠিক এই রকম, সু'মনের অধিকারীকে সুমনা বলে। খুব মিষ্টি নাম।

সুমনা: এই রিয়া,তোর দেওর কে সামলা। বলেদে আমি এনগেজ।

রিয়া: সৌনক, তোমার কপাল খারাপ। বান্ধনীর মুখনিঃসৃত বাণী শুনিলেন? এবার কেটে পড়ো বাপু।

সৌনক: বুঝলাম বুঝলাম। কেউ ট্রাম করেছে, আমি না হয় ওভার ট্রাম করবো। ক্ষতি কি।

সুমনা: হাসি মুখে। আচ্ছা! নমস্কার। আপনি আসুন। বান্ধবীর বাসর ঘরটা সাজান মনদিয়ে ওভার ট্রামটা না হয় পরে করবেন।

সৌনক: আস্বস্ত হলাম এই ভেবে যে, ওভার ট্রাম করবার সুযোগ পেলাম। অপেক্ষায় থাকলাম সেই দিনের জন্য,যেদিন ওভার ট্রাম করবার সুযোগ আসবে। বিদায় সবাই,শুভ বিদায়। আবার দেখা হবে কোনো এক এমনি সভায়।

হাসাহাসি হুল্লোড়ে সবাই মেতে।

        সুমনা ও অন্য বান্ধবীরা রাত্রে বৌভাতে বসেছে। সুনীল ও তাঁর বাবা সমস্ত রকম তদারকিতে কার্পণ্য রাখছেন না। সুনীলের কিছু স্পেশাল বন্ধু যেমন সৌনক, শিশির, রনি, অজয়, তাপস এরা গেষ্টদের পরিবেশনে নিয়োজিত। শেষ পাতে সৌনক, মিষ্টি পরিবেশন করছে। সুমনার পাতে চারটে বেশি রসগোল্লা দিয়ে সৌনক বললো-' একটু আসতে আসতে খান, অনেকক্ষণ খান, সারা রাত খান। কোনো আপত্তি নেই, আমি বারবার এসে রসগোল্লা দিয়ে যাবো। কেমন'😊

সুমনা:😊 আচ্ছা। আপনি দিন আমি জমাই রসগোল্লা আর শেষে আপনি একটা একটা করে খাবেন, আমি আপনাকে সযত্নে পরিবেশন করবো কেমন।

    ঢোক গিলে সৌনক, রসগোল্লার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বলে, ক্ষমা করো আমায়। স্বপ্নে রসগোল্লার পাহাড় দেখছি। আমি আসি এখন?

সুমনা: হা আসুন।😊

বৌভাত শেষে, সকলের ঘরে ফেরার পালা। সুমনা রিয়ার সাথে দেখা করে, বলে ভালো থাকিস। সুখে থাকিস। বাপের বাড়ি এলে আমায় ফোন করিস, আমি দেখা করবো তোর সাথে। যোগাযোগ রাখিস। বান্ধবীদের আবার ভুলে যাসনা, বরকে পেয়ে😊।

রিয়া বলে-' তাই কখনও হয়?

     পাশের বাড়ির সুনীলের সম্পর্কে এক কাকিমা, নতুন বউকে দেখতে এসে নতুন বৌমাকে দেখে কি প্রশংসা করলেন, 'বউয়ের মুখটা তো খুব মিষ্টি। বেশ সুশ্রী দেখতে, তা বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে কে ছাড়তে এসেছে? তোর শালা?'

রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সুনীল আমতা আমতা করে বলে-'না ,মানে শ্বশুর বাড়িতে এক সমস্যা হয়েছে তাই শ্বশুর বাড়ির কেউ আসেনি। আমার কাকাশ্বশুর বিয়ের দিন মারা গেছেন, নিয়ম অনুযায়ী ওনার বাড়িতে অশৌচ চলছে, তাই রিয়ার মামার ছেলে এসেছে দিদিকে ছাড়তে।

       মুখে শাড়ির আঁচলচাপা দিয়ে পাড়ার কাকিমা এমন একটা কথা বললো যা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক। সুনীল শুনে একবার রিয়ার মুখের দিকে তাকায়, একবার ওই কাকিমার দিকে তাকায়।

এ মা বিয়ের দিনেই কাকুর মৃত্যু! ঘোর অমঙ্গল। আমার মনে হয় তোর বউয়ের গ্রহদোষেই এমন কান্ড ঘটলো। সাবধানে থাকিস সুনীল, কি জানি কি হয় আবার।

সুনীলের মায়ের কানে কথা'টা যেতেই, উনি একপ্রকার কড়া সুরে বললেন 'ছোটো তোকে তো এই বিষয়ে আমাদের কেউ চিন্তা করতে বলেনি। তাই বলবো এমন মন্তব্য থেকে ভবিষ্যতে বিরত থাকিস।'

কাকিমার সম্মানে লেগেছে-' নেমন্তন্ন করে আমাকে অপমান! দু কথা বলা'ও যাবে না! নেমন্তন্নের কি দরকার ছিল? আমি আর তোদের বাড়ি আসবোনা। এই চললাম।

       অতিথি এসে অনাহারে ফিরে যাবে? রিয়া উঠে এসে কাকিমাকে অনুরোধ করে, দয়াকরে আপনি এভাবে যাবেন না। আপনি খেয়ে যান। আপনি খারাপ কিছু বলেননি। আপনি যা বলেছেন, সমাজের কথা, আমি জানি এটা আপনার মুখের কথা নয়। চলুন, আমি আপনাকে খাবার পরিবেশন করবো।

সুনীলকে সাথে নিয়ে, রিয়া খাওয়ার টেবিলে কাকিমাকে স্বযত্নে খাইয়ে প্রনাম করে আশীর্বাদ নেয়।

         কাকিমা আশীর্বাদ করতে করতে বললেন, বেঁচে থাকো, ভালো থেকো। সুনীল তোর বউ ভারী সুন্দররে।

        রিয়া বলে-'আপনার আশীর্বাদ থাকতে আমার ক্ষতি হয় কেমনে'? আবার আসবেন কাকিমা।

(আমার কথায় রাগ করোনা বৌমা)

না না। আমি রাগ করবো কেন? রাগ করলে কি আমি আসতে বলতাম?

সুনীলের মা, পুরো ঘটনা চাক্ষুস করবার পর অবাক হলেন। যে মানুষটাকে গ্রহদোষে দোষী হতে হলো, আর যে দোষারোপ করলো তাকেই সযত্নে খাওয়ানো!

        বৌমাকে সুনীলের মা বললেন-'বৌমা, তুমি কাকিমার কথায় রাগ করোনা, ও একটু এমন আগাগোড়া'।

         আমি ওনার কথায় রাগ করিনি। এমন ধারণা নিয়ে উনি একা নন, এই সমাজে অনেক অনেক মানুষ চলেন। আপনার উত্তেজনা মুহুর্ত দেখে আমি তৎক্ষণাৎ বুঝেছিলাম, আপনি বা আমার পরিবার অন্তত তেমন মানসিকতার নয়। তাই ওনার কথায় রাগ না করে আস্বস্ত হয়েছিলাম যে আমার সাথে আমার পুরো পরিবার আছে, সুতরাং অন্যের কথায় কান দেওয়া বা রাগ করা উচিত নয় মা।😊

       শৌণক এসে কথার মাঝখানে বলে, এইযে বৌদিমনি আপনি আর সুনীল বাবু দুইজন, একবার ঘরটা কেমন সাজানো হয়েছে দেখে নিন, তবে হ্যাঁ দেখার আগে আমাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে।

সুনিল বলে-' ভাই, আমি কত পারিশ্রমিক দেব? পারিশ্রমিক দিয়ে দিয়ে তো আমার পকেট ফাঁকা হয়ে যাবে এবার। তুই বরং একটা কাজ কর, আমার বিয়েতে তুই আমার ঘর সাজিয়ে দিয়েছিস,তোর বিয়েতে আমি তোর ঘর সাজিয়ে দেবো ব্যাস! আশাকরি হিসেব হয়ে যাবে।

       মাথা চুলকাতে চুলকাতে সৌনক বলে,উত্তম প্রস্তাব, মন্দ নয়, আচ্ছা তাই হবে এবার ঘরটা দেখেনে।

        কি করেছিস? এত গোলাপ কোথা থেকে আনলি? আচ্ছা ঠিক আছে, এই গোলাপের দামটা আমি তোকে দিয়ে দেব। শান্তি। 😊

গোলাপের দাম তোকে দিতে হবেনা। আমরা বন্ধুরা মিলে কিনেছি। আমাদের গিফ্ট এটাই।😊

         বাড়ির ছোট বউ এসে আচমকা বলে, দিদি আজকে তুমি যা গিফট পেয়েছো, সেখান থেকে আমাকেও কিছু দিও, কারণ আমরাতো আর তোমার মত দেখেশুনে বিয়ে করিনি, তাই আমরা কোন গিফ্ট পাইনি।

        আমাকে দিদি বলছো কেন? কারণ, আমি তোমার থেকে ছোট। হ্যাঁ দেব না কেন? নিশ্চয়ই দেব, তোমার যেগুলো পছন্দ সেগুলো তুমি নেবে আমার কেন আপত্তি থাকবে।

বাহারে! দিদি বলবো নাতো কি বলবো, বয়সে তুমি ছোট হতে পারো কিন্তু সম্পর্কে তুমি এখন বড়? সুতরাং,দিদি বলতে আমার অসুবিধা নেই।

না, তুমি আমাকে দিদি বলবেনা, তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে, ঠিক আছে।

আচ্ছা,তাই ডাকবো।

পরের দিন দুপুরে সবাই মিলে, সমস্ত গিফ্ট জড়ো করে খুলে খুলে দেখা হচ্ছে। রিয়া ছোটোবউকে তার পছন্দের কয়েকটা শাড়ি দেয়।

বিবাহ পরবর্তী বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের হ্যানিমুন বলতে স্বল্প দূরত্বের নিরিবিলি জায়গা বেস্ট।

তাই সুনীল ও রিয়া ঠিক করে 'উটি' সুন্দর জায়গা, হানিমুন পিরিওড ওখানেই হবে।

পরিবারের সকলের পছন্দের জায়গা উটি, তারাও উৎসাহিত করলো। যথা সময়ে টিকিট কাটা হয়েছে। রিয়া ও সুনীলের মধুচন্দ্রিমা চলছে।

কয়েকদিন পর ঘুরে এসে সুনীল ও রিয়া প্রথম শ্বশুরবাড়ি যায়।

সেখানে রিয়া এসেছে শুনে তার বান্ধবীরাও একদিন সন্ধ্যায় আসে। খোশগল্প হতে হতে সৌনকের প্রেম প্রস্তাব উপস্থাপন করে।

সুমনা আজ অনেকটা খোলা মনে কথা বলবার সুযোগ পায়। সুমনা বলে, দেখো সুনীল'দা শৌণক ছেলেটা নো ডাউট ভালো কিন্তু বিবাহ সম্পর্কিত বিষয়ে আমার একার মতামত চলেনা, আমার বাবা-মা আছে কাকা জাঠা আছে, তাদের মতামত নিতে হবে কিন্তু তোমার হয়তো জানা নেই আমার পরিবারে আমার বাবা অসুস্থ, তাদের নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তায় থাকি। সে ক্ষেত্রে আমাকে নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত বিয়ে করা সম্ভব হবেনা। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে কোন একটা সম্পর্কে জড়ানো উচিত, নচেৎ না এগোনো ঠিক আছে।

সুনীল বলে, তা ঠিক বলেছ, তবে আমি বাড়ি গিয়ে শৌণকের সাথে কথা বলি তার চিন্তা ভাবনাটা ঠিক কেমন সেটা জেনে আমি এই সম্পর্ক বিষয়ে তোমাকে জানাবো।

       দু-তিনদিন শ্বশুরবাড়িতে কাটানোর পর সুনীলের বাড়ি থেকে ফোন আসে, সুনীলের মা অসুস্থ, ওদের তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে, তাই আর কালবিলম্ব না করে রিয়া ও সুনীল ঘরে ফিরে যায়।

        ঘরে ফিরে দেখে সুনীলের মা সুস্থ আছেন কিন্তু সবাই কেমন মুখ ভার করে আছে। রিয়া সবার সাথে হাসিখুশিতে কথা বলার চেষ্টা করে, জানবার চেষ্টা করছে কেন ওদের এইভাবে ডেকে আনা হলো। শাশুড়িমা উত্তরটা তেমনভাবে না দিয়ে, শুধু বললেন ঘরে আজ সন্ধ্যায় সবাই উপস্থিত থাকবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আমাদের বলার আছে।

সন্ধ্যায় দুই বৌমা, বাড়ির কেউ রাতে রুটি খায়,কেউ আবার ভাত খায়,তাই বানাতে ব্যস্ত। ছোট বউ আগে বেশ হাসি খুশিতে থাকতো, আজ কেমন গম্ভীর ভাব।

        ছোটছেলে আড্ডায় বাড়ির বাইরে, বড়ছেলে ভাইঝির সাথে টিভি দেখছে। রিয়ার শশুরমশাই ও শাশুড়ি ঘরে বসে টিভি দেখছেন।

         ছোটোছেলে আড্ডা থেকে ফিরতেই শাশুড়ি ও শশুরমশাই দুজনে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

         শশুর মশাই সবার উদ্যেশ্যে বললেন, শোন তোরা, সবাই ঘরে আছিস।

বড়ছেলে টিভি মিউট করে, বাবার কথা শুনছে। সাথে অন্যরাও শুনছে।

সুনীলের বাবা,পরেশ বাবু বললেন-"আগামী সপ্তাহে আমরা দুজন, অর্থাৎ আমি ও তোমাদের মা সাতদিনের জন্য পুরী যাচ্ছি। পাড়া থেকে গাড়ি ছাড়ছে। অনেকেই যাচ্ছে। আমি দুটো টিকিট নিয়ে এসেছি। ছোট বৌমা শুনছো?

--খুব ধীরগলায় ছোটোবৌমা উত্তর দিলো 'হুম, শুনছি বাবা।'

--আচ্ছা। এবার থেকে দিনে রান্নার যাবতীয় কাজ তুমি করবে, অর্থাৎ ছোটোবৌমা। তখন বড়বৌমা ঘরের বাকি কাজগুলো করবে। রাতের রান্নার কাজটা বড়বৌমা করবে। ওর রান্না সম্পর্কে ধারণা না থাকতেই পারে। তাই আপাতত তোমাদের মা দুজনকেই রান্না বিষয়ে সাহায্য করবে। বড়বৌমাকে একটু বেশি সাহায্য করবে। বড়বৌমা আমাদের ঘরে নতুন মেম্বার, এখনো বাড়ির কোন আসবাব কোথায় আছে জেনে উঠতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তাই ছোটোবৌমা ও তোমাদের মা ওকে বেশি সাহায্য করবে। যদি কারুর কোনো আপত্তি থাকে তবে সে এখানেই আপত্তি তুলতে পারে। অন্য সময়ে কেউ যেন এই বিষয়ে মতান্তর তৈরি না করে, সেই সুবিধার্থে সবার সামনে কথা গুলো বললাম।

     পরেশবাবুর মুখের উপর কথা বলবার সাহস তেমন কেউ দেখালো না।

একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে, পরেশবাবু আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে গেলেন।

বড়বৌমা বাপের বাড়ি থেকে মায়ের হাতে তৈরি নারকেল নাড়ু এনেছে। ছোটোবউর থেকে শুনেছিল শশুরমশাই নারকেল নাড়ু পছন্দ করে, তাই রিয়া এবার বাপেরবাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে গল্প করেছিল।

শ্বশুরের পছন্দের নারকেল নাড়ু এক কৌটো বানিয়ে রিয়ার মা পাঠিয়েছেন।

সেই নারকেল নাড়ু, রিয়া শাশুড়িমায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলে 'মা পাঠিয়েছে, সবার জন্য'।

       পরেশবাবু উৎসাহের সহিত জিজ্ঞেস করলেন-'কি দেখি'?

শাশুড়িমা কৌটো খুলে দেখতেই নারকেল নাড়ু। বেশ হাসি মুখে শাশুড়ি বললেন-'বাহঃ। সুন্দর জিনিস। এই নাও তোমার পছন্দের নারকেল নাড়ু।

-- তাই? দাও দাও দাও। আমায় দুটো বেশি দিও।

-- উফঃ। বাচ্চাদের মতো করছে। সবাই পাবে।

-- পরেশবাবু বললেন-'বৌমা আমার তরফ থেকে তোমার মা কে ধন্যবাদ বলে দিও।

-- বড়বৌমা হাসতে হাসতে বলে, ধন্যবাদ বলার দরকার নেই বাবা। আসলে আমিও নারকেল নাড়ু খেতে ভালোবাসি।

-- পরেশ বাবু বললেন-'তাই? শোনো, রিয়াকে তাহলে দুটো বেশি নারকেল নাড়ু দিও।

রিয়ার শাশুড়ি সবাইকে নারকেল নাড়ু বন্টন করলেন। সব শেষে রিয়াকে দুটো বেশি দিলেন। আর নিজের ভাগ থেকে দুটো নাড়ু দিলেন পরেশবাবুকে।

         ছোটোবৌমা রাতে খাওয়ার পর নিজের মায়ের সাথে প্রতিদিন ফোনে অন্ততঃ একবার কথা বলে।

          আজ রাতে খাওয়ার পর ছোটো বউ মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে, প্রসঙ্গ, শশুরমশাইয়ের বাড়ির নিত্য কাজ বন্টনের কথা উঠলো। আমি সকাল দুপুরের রান্নার দিকটা দেখবো। বাকিটা ও দেখবে।

-- ও মানে?

-- ওই। বড় বউ। রিয়া।

-- তা তুই দিনের কাজটা নিলি কেন? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে তোকে।

-- ওহ ঠিক আছে।

-- না। ঠিক নেই। কাল সকালেই বলে দিবি, আমি রাতের রান্না করবো।

-- ছোটোবউ চিন্তায় পড়ে যায়। শ্বশুরের কথা ফেলা যাবেনা। আবার মায়ের কথাও গ্রহণযোগ্য। ভাবতে ভাবতে ছোটোবউ ফোন রাখছি বলে ঘুমোতে চলে যায়।

        চিন্তার দ্বন্দ্বে মায়ের কথাই উপযুক্ত বলে মনে হলো ছোটোবৌয়ের। তাই কাল বিলম্ব না করে, ঘুমন্ত বরকে অর্থাৎ সুনীলের ভাই, স্বরূপকে ঘুম থেকে তুলে ছোটোবউ বর্ণালী বলে-'শোনো, বাবা যে বললো আমি দিনের রান্নাটা দেখবো, তা আমি মানলাম না। আমি রাতে রান্নাগুলো করবো। কাল সকালে তুমি বলে দিও।

-- যখন বাবা বলছিলো তখন বললেনা কেন? দেখছি কি করা যায়। সকাল হোক।

-তুমি বলবে কি বলবেনা, আমি জানিনা, আমি কিন্তু কাল দিনে রান্নাঘরে যাচ্ছিনা।

-আচ্ছা। এখন ঘুমাও।

সকালে ঘুম থেকে উঠে পরেশবাবু প্রতিদিনের ন্যায় চা পান করেন। ছোটো বৌমাই চা করে দিত। আজ আর চা পেলেননা। ছোটোবউ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।

    কিছু না বলে,পরেশবাবু গায়ে একটা কুর্তা গলিয়ে পকেটে দশ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

      পাড়ার চায়ের দোকানে সচরাচর আড্ডায় যাননা পরেশবাবু। আজ গেলেন। বসলেন। চাও খেলেন।

    সমবয়সী সুধীরদা বললেন-'পরেশ, তুই তো কোনোদিন দোকানে চা খেতে আসিসনা। আজ সকাল সকাল আমাদের মাঝে হটাৎ? ভালো হয়েছে, এবার রোজ আসিস।

    পরেশবাবু বললেন, তা ঠিক। তবে ডাক্তার বলেছে আজকাল একটু হাঁটাচলা করতে। তাই বেরোনো। নিশ্চই আসবো তোদের মাঝে। যেদিন বেরবো।

    ঘরে গিয়ে দেখেন ছোটোছেলে স্বরূপ ঘুম থেকে উঠে

দাঁত মাজছে। বড়বৌমা সবার জন্য চা বানাচ্ছে।

           পরেশবাবু ঘরে ঢুকে গিন্নিকে বললেন, কি ব্যাপার চা বানাচ্ছে বড়বৌমা? কাল যে কথা হলো ছোটো দিনের দিকটা সামলাবে?

কথাটা স্বরূপের কানে যেতেই, স্বরূপ বললো একচুয়ালি কি বাবা, বর্ণালী রাতের দিকটা রান্নায় আসতে চায়। আমাকে রাতেই বলতে বলেছিল আমি আর অতরাতে কিছু বলিনি। সকালে মাকে বলতে মা'ই বৌদিকে বলে রান্না ঘরে যেতে।

      পরেশবাবু বললেন, তা ঠিক আছে। ছোটোবৌমা কথাটা রাতেই বলতে পারতো। যদি ছোটোবৌমা আজ চা বানিয়েই দিত ক্ষতি কি ছিল? এই প্রথমবার আমাকে ঘরের বাইরে গিয়ে সকালে চা খেতে হলো। যাক ও সব কথায় যাচ্ছি না। বড় বৌমা, তুমি তাহলে একটু সকালের দিকটা দেখো।

-আচ্ছা। ঠিক আছে বাবা। আমি করে নেবো। কোনো অসুবিধা নেই।

সবার জন্য চা বানিয়ে রিয়া আগে দেওর স্বরূপকে দিলো, তারপর এককাপ শাশুড়িকে, আর এককাপ শ্বশুরকে। বর্ণালীর চা'টা টেবিলে রেখে ডাক দিল, বর্ণালী তোমার চা টেবিলে রাখা। ঠান্ডা হয়ে যাবে। নিজের ও সুনীলের চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘুম থেকে সুনীলকে তুলে চা দিয়ে, নিজেও খেলো।

সুনীলের বাবা আর এককাপ চা খেয়ে বাজারে গেলেন মাছ আনতে। মাছ এনে বড় বৌমাকে বললেন, বৌমা তেলঝাল রান্না করতে পারো?

(পারি বাবা, না হলে মা তো দেখিয়ে দেবে।)

ঠিক বলেছো। ওগো শুনছো..... বড়বৌমাকে একটু দেখিয়ে দিও যদি ওর রান্নায় কোথাও অসুবিধা হয়। আচ্ছা বৌমা তুমি পাঙ্গাশ মাছ খাও ?

       আমি সব মাছ খাই বাবা।

বাহঃ বাহঃ। পুরো আমার মতো। আমি ভাবলাম তুমি হয়তো খাবারে বাছবিচার করো। একদম খাবারে বাছবিচার করোনা। বাঙালি আমরা, আমাদের একটা বড় গুন আছে, যা খাবো চেটেপুটে খাবো।

       বর্ণালী ইশারায় ডাক দেয় স্বরূপকে। স্বরূপ উঠে নিজের ঘরে যেতেই বলে-'তোমার বাবা ওকে কত আদর করে বলছে, আর আমার বেলায় বিয়ের একমাসতো কথাই বলেনি'। জঘন্য পরিবার একটা তোমাদের।

       স্বরূপ বলে, তোমার সাথে কথা বলেনি অন্য কারণে। আমাদের বিয়েটা ওদের অ'মতে হয়ে ছিল তাই। এখনতো সব ঠিক হয়ে গেছে। আর আমাদের পরিবারের জঘন্য বিষয়গুলো কি দেখলে ? বৌদি নতুন মানুষ, একটু যদি এমনভাবে কথা বলা হয় তবে ক্ষতি কোথায়? তাছাড়া জঘন্য পরিবারের ছেলেকেই তো তুমি জেনেশুনে বিয়ে করেছো, তাও আবার পালিয়ে। বাদ দাও ওসব কথা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হবে আবার।

--তোমাকে বলে লাভ নেই। তুমিতো ওদের দলের।

-- আমি কারুর দলের নয়। সঠিক কথাটা বললাম।

           বর্ণালী মাকে ফোন করে। স্বরূপ জামাকাপড় পরে একটু বেরিয়ে যায় বাইরে।

--কিরে বর্ণালী, আজ সকাল সকাল ফোন করলি?

--হাঁ মা, এখন আমাদের কাজ ভাগ হয়েগেছে। তাই ফোন করলাম।

--তোর সকালের কাজগুলো যে?

--না । তুমি কাল রাতে বললেনা। তাই স্বরূপকে দিয়ে বলিয়ে পাল্টে নিয়েছি।

--দেখ, কারুর নজরে খারাপ হবিনা।

--আমি কেনো খারাপ হবো। যা বলার স্বরূপ বলছে, খারাপ হলে ও খারাপ হবে ওদের নজরে। জানো মা, আমার শ্বশুর সে কি হাসি খুশি কথা বলছে রিয়ার সাথে, সারাক্ষন বড়বৌমা আর বড়বৌমা। আমি যেন বানের জলে ভেসে এসেছি।

-- এ মা তাই? শোন আজ বিকেলেই আমাদের ঘরে স্বরূপকে নিয়ে আয়। আমি সব বুঝিয়ে বলছি তোকে কি করতে হবে।

--আমি যাবো কিভাবে? রাতে যে আমায় আবার রান্নার দিকটা দেখতে হবে।

--তাতে কি হয়েছে? স্বরূপকে বল আমার মায়ের শরীরটা ভীষণ খারাপ, দেখতে যাবো। কেউ আটকাবেনা তোকে।

-আচ্ছা মা এখন রাখি। দেখছি কি করা যায়।

          বাড়ির অন্য কাজগুলো বর্ণালী করতে করতে স্বরূপ ঘরে ফিরে আসে।

--এই শোনো, তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার ছিল।

--বল কি হল আবার?

--না। মানে। মাকে ফোন করেছিলাম এক্ষুনি, মায়ের শরীরটা ভীষণ খারাপ। আমার মনটা কেমন করছে, প্লিজ আজ বিকেলে একটু নিয়ে চলোনা বাপের বাড়ী।

--কেনো,কি হলো আবার?

--কি জানি, বলছে গা-হাত-পা তরতর করছে।

--আচ্ছা। তাহলে তো বিকেলে যেতেই হবে। মাকে বলে দিও এক্ষুনি।

--আমি বলতে পারবোনা। যা বলার তুমি বলে দিও।

--কেনো? আজ পর্যন্ত তুমিই তো এগুলো বলতে। এখন আবার সামান্য সামান্য কথায় আমাকে টানছ কেনো?

--বললে বলো। না বললে আমি যাবইনা বাপের বাড়ি।

--আচ্ছা,ঠিক আছে, আমি বলে দেবো।

        স্বরূপ মাকে বলে, মা, আজ একটু বর্ণালীর বাপেরবাড়ি যেতে হবে, বিকেলে। ওর মায়ের ভীষণ শরীর খারাপ। তাই।

--কেনো? কি হলো? ঠিক আছে যাবিনা কেন। দুপুরে ভাত খেয়েই বেরিয়ে যাবি।

      মা তোমরা চলে যাও আমি জেম্মার কাছে থাকবো, বর্ণালীর মেয়ে বর্ণালীকে বলে।

--ঠিক আছে, তোকে যেতে হবে না। সন্ধ্যায় পড়ে নিবি যেম্মার থেকে। আমরা কাল বিকেলেই ফিরে আসবো।

--তা বৌমা তোমার মায়ের কি হয়েছে?

-কি হয়েছে আমি এখনো জানিনা মা। শুধু বলছিল গা-হাত-পা তরতর করছে।

--মনে হয় প্রেসার লো হয়েছে। যাইহোক তোমরা আজই চলে যেও।

বর্ণালীর মা (মিতা দেবী) : বর্ণালী চলে এসেছিস? এই দেখনা, আজ সারাদিন আমার শরীরটা কেমন করছিল, তোর বাবা ডাক্তার দেখিয়ে আমাকে নিয়ে এই কিছুক্ষণ আগে ফিরলাম | ওষুধ দিয়েছে, এখনো খাইনি রাতে খাওয়ার পর খাব | বৌমা, স্বরূপকে একটু জল দাও | বর্ণালী তোর মেয়েকে আনিসনি কেন | ও তোকে ছাড়া আবার থাকতে পারেনা | ঘরে রেখে দিয়ে এলি কেন?

বর্ণালী: -ও আসবেনা মা | ওর জেম্মার কাছে থাকবে | এখন কাঁদবেনা, বড় হয়েছে ঠিক থেকে যাবে | আর আমরাতো কাল বিকালে ফিরে যাচ্ছি | ছাড়োছাড়ো মা আমাদের জন্য চা করতে হবেনা | আমরা বাস থেকে নেমে চা খেয়ে এসেছি |

মিতা দেবী: -এ'মা! চা খাবিনা? ঠিক আছে তোরা ফ্রেশ হয়েনে |

         স্বরূপের শালাবাবু, সন্ধ্যাবেলায় জামাইবাবুকে নিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডায় বেরিয়ে গেল |

          বর্ণালীর মা ঘরে বসে গল্প করছে মেয়ের সাথে, রান্না ঘরে নিজের বৌমা রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত | শাশুড়ি ও ননদের কথাবার্তা শুনছে বর্ণালীর বৌদি নিশা |

মিতা দেবী: কি বলছিলিস বর্ণালী? তোর বাড়িতে রান্নাবান্না নিয়ে কি এক অশান্তি হচ্ছে, আমাকে খুলে বলতে বিষয়টা |

বর্ণালী: -তেমন কিছুনা মা,ওই শশুরমশাই আমাদের দুই জা এর কাজ ভাগ করে দিয়েছেন | আমার জন্য সকালে আর বড়োর জন্য রাতে |

মিতা দেবী: -না না,খবরদার সকালে কাজ করিসনা | সকালে কিন্তু অনেক রান্নাবান্না করতে হয় | আবার তোর শ্বশুর বাজারে গেলে এই মাছ-ওই মাছ-সেই মাছ, এই সবজি-সেই সবজি এনে তোর ঘাড়ে ফেলে দিয়ে বলবে -'বৌমা এটা রান্না করো ওটা রান্না করো | তোর তো রান্না করতে করতেই বিকেল হয়ে যাবে |

বর্ণালী: -তা ঠিক বলেছ, কিন্তু এতদিন অব্দি আমিতো সবার রান্না করতাম |

মিতা দেবী: -যখন করতিস তখন করতিস | এখন আর একটা বউ এসেছে ঘরে, সেও করুকনা |

বর্ণালী : -ও নতুন তো, এখনো ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি সংসারের কাজকর্ম, তাই শশুরমশাই ওকে বিকেলে বা রাতের রান্নাটা করতে বলেছেন, আমার শাশুড়িতো আছেন হেল্প করবে দুজনকে |

মিতা দেবী: -আমি যে কথাগুলো বলছি সে কথাগুলো মাথায় রাখ, তুই রাতে রান্না করবি, তোর বড়'জা'কে দিনে রান্না করতে দে |

বর্ণালী: -জানো মা ! বড়বৌমাকে আমার শশুর খুব ভালোবাসে, আমার শ্বশুরের সাথে বড় বউয়ের খুব মিল, আমার শ্বশুর যেমন খাদ্যরসিক জা'ও ঠিক তেমনি খাদ্যরসিক |

মিতা দেবী: -দেখ! এবার মনে হয় তোকে আর কেউ তোদের সংসারে পাত্তাই দিবেনা |

বর্ণালী: -না মা তেমনটা কিছু নয় |

মিতাদেবী: -আমার কথা শুনছিসনা, যেদিন তোর ঘাড়ে সংসারের সব কাজকর্ম চাপিয়ে দেবে এই বড়বৌমা, তোদের শশুরের সাথে শলাপরামর্শ করে, সেদিন কিন্তু আমার বাড়িতে ছুটে এসে আমার থেকে বুদ্ধি চাইবিনা | এখন বাজারহাট কে করে? তোর শ্বশুর করে বুঝি ?

বর্ণালী: -হ্যাঁ মা শ্বশুরমশাই করে কারণ ওনার ছেলেদের বাজারহাট করা পোষায়না | আমার ভাসুর তো বাজার সম্বন্ধে কিছুই বোঝেনা, কানা বেগুন, পচা আলু, দোকানদার যা দিয়ে দেয় তাই নিয়ে চলে আসে | আর তোমার জামাই তো বাজারে যায়ই না, তবে আমার শ্বশুর বাজারে গেলে ভালোভালো শাকসবজি নিয়ে আসে, ভালো ভালো মাছ নিয়ে আসে |

মিতা দেবী: তোদের আয়ের টাকা তোরা কিভাবে খরচা করিস ?

বর্ণালী: -আমাদের নিয়ম আছে মা,যে যাই আয় করুক, শ্বশুরের হাতে টাকা দিতে হয় | সেখান থেকে শ্বশুরমশাই বাজার হাট করার যেটা করে আর আমাদের যদি কারো হাতখরচের প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা উনাকে চাইলে উনি দিয়ে দেয় | ওটা নিয়ে কোন সমস্যা হয়না | তাছাড়া আমার ভাসুরতো যত আয় করে সবটাই শ্বশুরের হাতে তুলে দেয়, তোমার জামাইতো যা আয় করে তা পুরোটা দেয়না উল্টে শশুরের থেকে টাকা নেয় | তোমার জামাইকে কেউ কিছু বলেনা, ও ছোটছেলে তো  |

মিতা দেবী: -শোন কান খুলে, একটা কথা বলি, তোর শ্বশুরের এবার বয়স হচ্ছে, তোরা শশুরকে এত দায়িত্ব দিসনা, এবার থেকে তুই একমাস বাজারহাট করবি তো একমাস তোর ভাসুর বাজারহাট করবে | কি জানি কত টাকা খরচ হয় বাজারে, তোরা তো বুঝতে পারিসনা |

বর্ণালী: - ওরকম আমরা তো কোনদিন ভাবিনা।

মিতা দেবী: -ভাবিসনা, এবার ভাবতে হবে | তোর একটা মেয়ে আছে, মেয়ে বড় হচ্ছে, তার বিয়ে দিতে হবে, বিয়েতে একটা খরচ থাকে সেই খরচে টাকা পয়সা পাবি তখন? এইভাবে যদি সব শ্বশুরের হাতে টাকা দিয়ে দিস, একদিন শ্বশুর বলবে আর টাকা পয়সা আমার কাছে নেই সব খাওয়া-দাওয়ার পেছনে, সংসারের পেছনে খরচ হয়ে গেছে, তখন তোর মেয়েটাকে বিয়ে না দিয়ে কি ঘরে রাখবি?

বর্ণালী: -আরে ওসব কিছু হবে না মা | আমার শ্বশুর বলেছে আমার মেয়ের বিয়েতে সমস্ত খরচ উনি করবেন | আমাদের এক পয়সাও খরচ করতে হবেনা, ওটা নিয়ে চিন্তা করতে আমাদের বারণ করেছেন উনি নিজেই |

মিতাদেবী: - আজ বলছে, কাল যখন সমস্যা হবে তখন কোথায় যাবি ? তোরা আমি যে কথাটা বলছি সেটা বোঝার চেষ্টা কর |

[পাশের ঘর থেকে বর্ণালীর বৌদি কথার মাঝখানে বলল, মা, দিদিকে এইসব কথা বলছো কেন ? ওদের সংসারটা এইসব কথা বলাবলি হলে ভেঙে যাবে | ]

মিতাদেবী: বর্ণালীর মা বৌমার উদ্দেশ্যে বললেন, তুমি চুপ করো, তুমি একা আমাদের বাড়ির বউমা তোমার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? হচ্ছেনা | যার বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে তার বাড়িতে কি করতে হবে না করতে হবে সেটা আমি ভালো করে জানি, তাই তুমি চুপ করে থাকো আমাদের মা মেয়ের কথার মাঝখানে নাক গলাবেনা |

বর্ণালীর বৌদি: -হ্যাঁ সেটা ঠিক বলেছেন মা, তবে এতক্ষণ অব্দি আমি যা শুনতে পাচ্ছি আপনাদের কথা তাতে বর্ণালী'দির শ্বশুরবাড়িতে তো কোনো অসুবিধা নেই, তবে আমার মনে হয় এই সব কথাগুলো যদি বর্ণালী দি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বলা শুরু করে, তাহলে ওদের সংসারে অশান্তি অনিবার্য |

বর্ণালী: বৌদি তোমার রান্না কতদূর ? আমার খুব খিদে পেয়েছে, তোমার হাতে রান্নাটা কিন্তু আমার খেতে ভীষণ ভালো লাগে |

মিতাদেবী:-শোন বর্ণালী বলি একটা কথা | বাড়ি গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে বলবি, দিনের বেলা তুই রান্না করতে পারবিনা | এতদিন তুই একা সবার জন্য রান্না করে দিয়েছিস | পরিষ্কার বলবি, ঘরে আরেকটা বউ যখন এসেছে সেও এবার কিছু কাজ সামলাক | দিনের বেলা রান্নাটা ওকে দায়িত্ব দিতে বলবি আর রাতেরটা তুই নিবি |

[শালা বাবুর সাথে স্বরূপ আড্ডা থেকে ফিরে এসে ঘরে ঢোকার মুখে শাশুড়িমা ও বর্ণালীর বকবক শুনতে পায় | তবুও কোন প্রকার না ভেবে শুধু এটুকুই ভাবে এটা হয়তো মা-মেয়ের কথা হচ্ছে | ]

[ জামাইবাবুকে ঘরে ঢুকতে দেখে শাশুড়িমা অসুস্থতার ভান করে কেমন যেন ঝিমিয়ে গেলেন | ]

ফিসফিসিয়ে বর্ণালী, মাকে বললো, চুপ করো এখন | তোমার জামাই এসেছে, শুনলে আমাদের আবার গৃহযুদ্ধ বাধবে |

মিতাদেবী: জামাইকে চোখের সামনে দেখে, বললেন বৌমা.... বর্ণালীর শ্বশুরমশাই নারকেল নাড়ু খেতে পছন্দ করে ,খানকতক বানিয়ে দিও, কাল নিয়ে যাবে। দুটো নারকেলও দিও গাছ থেকে পড়েছিল ।

        মায়ের কথাগুলো কানে বাজলেও বর্ণালী রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে কথাগুলো ভাবতে থাকে | পরেরদিন

         বাপের বাড়ি থেকে ফিরতে, বর্ণালীর সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় | রাতের খাবার আয়োজনে ব্যস্ত রিয়া । সহযোগিতায় শাশুড়ি মা |

         মায়ের গলা শুনে, মেয়ে ছুটে মাকে জড়িয়ে ধরে | মা, আমার জন্য মামা বাড়ি থেকে কি এনেছো?

বর্ণালী: ভালো জিনিস এনেছি | দিচ্ছি সবাইকে |

         বর্ণালী কাপড় চেঞ্জ করে, ফ্রেশ হয়ে, লাড্ডুর কৌটো শাশুড়িমায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো -" এই নাও মা, বাবার জন্য পাঠিয়েছে মা |

- জানি | নিশ্চই নারকেল নাড়ু! দাও দাও | তোমার শ্বশুর তো মুখিয়ে থাকে নারকেল নাড়ুর আশায় | এ মা! কত নারকেল নাড়ু পাঠিয়েছে দেখো বর্ণালীর মা | সত্যি আমাদের ছেলেদের শ্বশুর বাড়ির সবাই খুব ভালো মানুষ |

          বর্ণালী হাসি মুখে বেরিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করে, রিয়াকে বলে -'দাও, আমি রান্নাকরি | কি রান্না হবে আজ?

           বর্ণালীর শাশুড়ি, রান্না ঘরে এসে বললেন-' বর্ণালী, তোমার কাজে হাত বাড়িয়ে হালকা করে দিলো রিয়া | রিয়া নিজেই বলেছে রান্নার যাবতীয় কাজ ও একা করবে। আমি দু'বেলা ওর সাহায্যে থাকবো | তুমি শুধু ঘরের টুকটাক কাজগুলো করে নিও | রিয়া রান্না করতে ভালোবাসে, তাই দু'বেলা রান্নায় ওর আপত্তি নেই |

বর্ণালী: এ মা! তাই? ( রিয়াকে জড়িয়ে ধরে) তুমি তো খুব ভালো মেয়ে | তবে একটা শর্তে, যেদিন আমার রান্না করবার মন চাইবে, সেদিন কিন্তু আমার জন্য রান্না ঘর ছাড়তে হবে |

          রান্না ঘরে, দুই বৌমা ও শাশুড়ির হাসি যেন আর থামেনা |

বেশ গর্বের সাথে বর্ণালী ও রিয়ার শাশুড়ি বললেন-"বধূ যদি বরণ করবার থাকে, আমার দুই বৌমার মতো মেয়ে বরণ করা উচিত | এরা আমার বাড়ির লক্ষী | লক্ষী বললেও কম হবে"। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তোমরা এভাবেই মিলেমিশে সংসার করো। সারা জীবন সুখে থাকো | আমার সুখের সংসারে যেনো কারুর অশুভ নজর না লাগে |

         নারকেল নাড়ু খেতে খেতে সুনীলের বাবা বললেন-"বৌমা, তোমার মা'তো খুব সুন্দর নারকেলনাড়ু বানায়। একবার ফোনে কথা বলিয়ে দিও তো" |

         বর্ণালীর শাশুড়ি বললেন-'জানি, দিদিকে ফোনে পেলেই তো ফাজলামো শুরু করবে' | তোমারও এই বুড়ো বয়সে ফাজলামিটা দেখি বেড়েই চলেছে |

           না না ফাজলামো করবো না, আমরা বরং ক'দিন বর্ণালীর বাপের বাড়ি যাবো | তুমি একটু নারকেলনাড়ু বানানোর রেসিপি শিখে আসবে |

        তা মন্দ কথা নয় | নিশ্চই শিখে রাখা ভালো |



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance