arijit bhattacharya

Classics Crime Thriller

3  

arijit bhattacharya

Classics Crime Thriller

আঁধার রাতের বিভীষিকা

আঁধার রাতের বিভীষিকা

4 mins
693



         লক্ষ্মীপূজার পর থেকে এখন অবধি গাঁয়ে তিন তিনটে অপঘাতে মৃত্যু হয়ে গেলো । রাখু সক্কাল সক্কাল রেল লাইনের ধারে প্রাতঃকৃত্য সেরে হাল্কা মনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফিরছিল বড় মাঠের ওপর দিয়ে ফিরছিল হঠাৎ চোখ পড়ল 

নিমাই হালদার চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে পাকুড় গাছের তলায় । চোখ দুটো খোলা । রাখু ভেবে পেলো না নিজের বাড়ী ছেড়ে নিমাই বাবু পাকুড় গাছে তলায় চোখ খুলে কেন ঘুমচ্ছেন ? রাখু এগিয়ে গিয়ে বার কয়েক ডাকল - ও বাবু ওঠেন ? এই খানে শুয়ে কেন ? কোনও সাড়া না পাওয়াতে গাড়ুর থেকে দু ছিটা জল চোখে মুখে ছিটা দিলো তাতেও বিস্ফারিত চোখের পাতা কাঁপল না দেখে রাখু গায়ে হাত দিয়ে দেখে বরফের মত ঠাণ্ডা গা । চিৎকার করতে করতে গ্রামে এসে খবর দিলো । নিমাই হালদার 

লোক ভালো ছিল না । সুদের কারবার করতো একবার যে টাকা নিয়েছে তার টাকা আর জম্মে শোধ হত না তার ওপর ভদ্রোঘরের মেয়ে বৌ দের ওপর নজর । শত্তুরের শেষ ছিল না , একদিন বেঘোরে প্রাণটা যাবে সবাই জানত । কিন্তু আশ্চর্য হল 

যখন থানার দারোগা এসে বলল - কি ভাবে খুন হল সেটাই বোঝা যাচ্ছে না । গায়ে কোথাও আঘাতের চিহ্নমাত্র নেই । শুধু দেখে মনে হয় কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলেন । কোন সূত্র না পেয়ে ফাইল বন্ধ করা হল । গাঁয়ের কেউ কেউ বেশ খুশী হল ।

       মিলির অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে দিতে পারেনি সারা গাঁয়ে ওর মত ঝগড়ুটে আর নেই । মা বাবা মারা যাওয়ার পর থাকে ভাই ভাজের সংসারে কিন্তু মুখনাড়া দিয়ে ভাজের চোখে সর্ষেফুল দেখিয়ে রেখেছে । সেদিনও তুমুল ঝগড়া করেই 

বেরিয়েছিল স্নানে তালপুকুরের দিকে । এ দিকটা একটু নির্জন গাছগাছালির আড়াল থাকায় গাঁয়ের মেয়ে বৌরা স্নানে আসে । মিলি গেলো তো গেলোই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো শেষে ওর ভাজ বুক থাবড়ে কাঁদতে কাঁদতে গাঁয়ের এঘর ওঘর 

খোঁজা শুরু করলো । মিলির খোঁজ মিলল দুদিন বাদে তালপুকুরের পাশে পরে আছে । অথচ ওসব দিক তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছিল । নিমাই হালদার আর মিলির মৃত্যুতে অদ্ভুত মিল দুজনের শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই । কিন্তু মিলির মত

দজ্জাল মেয়ে কি দেখে ভয় পেয়েছিলো বোঝা গেলো না তার ও চোখদুটো বিস্ফারিত । দারোগার কপালে ভাঁজ পড়ল । গাঁয়ের মধ্যে একটা অস্বাস্তির ভাব । 

        বেচুর একমাত্র কাজ হল ধার করা আর চোলাই খাওয়া , এর তার ফাই ফরমাস খেটে যা পায় তাও ওই নেশায় যায় , বৌটা বড় কষ্ট করে মুড়ি ভেজে , ঘুটে বেচে তিন ছেলেপুলে নিয়ে সংসার টানে । ঘরটা পরবে পরবে করেও যেন বৌটার কষ্টের কথা ভেবে পরে নি । বেচু ছেলেমেয়েদের অসুখের গল্প শুনিয়ে হাতে পায়ে ধরে এমন কান্নাকাটি করে ধার চায় যে ওকে কিছু না দিয়ে ফেরানো যায় না । সেদিনও গঞ্জের অসীম মোদকের থেকে পাঁচ থাকা ধার চেয়ে অনেক কান্নাকাটি করে একটা আধুলি 

যোগার করেছিলো । তাই দিয়ে নেশা করে ঘরে ফিরছিল হঠাৎ ওর বৌ আঁ আঁ করে চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে । বেচু ছুটতে ছুটতে এসে ঘরের দাওয়ায় পড়ল আর সেখানেই শেষ । বেচুর বৌ এর চিৎকার আর কান্নায় লোক জড় হল , দারোগা এলো , বেচুর বৌ বেচুকে ছাড়া আর কিছু দেখে নি । গাঁয়ে আতঙ্ক আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল । সবাই সবাইকে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে । এমনকি এই মৃত্যুগুলো নিয়েও খোলাখুলি আলোচনা করতেও ভয় পাচ্ছে ।

      রূপারা গাঁয়ের মধ্যে বেশ অবস্থাপন্ন একবিঘে জমির ওপর আটচালা ঘর গোয়ালঘর আছে । এ ছাড়া চাষের জমিজমা । রুপার বাবা সখ করে জমির সামনেটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে লোহার ফটক বসিয়েছে । ঘর থেকে ফটক বেশ কিছুটা যেতে হয় 

ডানদিকে পরে গোয়ালঘর , বড় বড় আম জাম কাঁঠাল আরও না না রকমের গাছে সন্ধ্যের দিকটা কেমন ঝুপসি হয়ে থাকে । সেদিন ভূতচতুর্দশী চৌদ্দটা প্রদীপ পাঁচিলের ওপর বিকেলেই রেখে এসেছিল রূপা । সন্ধ্যের মুখে প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে দেখে 

এলোমেলো হাওয়া ছেড়েছে । বার বার প্রদীপ নিভে যাচ্ছে । এই করে সন্ধ্যে গড়িয়েছে কতটা খেয়াল করে নি । মায়ের ডাকে হুস ফিরতেই পেছন ফিরে চোখ পড়ল গোয়ালের পাশে গাছটার দিকে ।হাওয়ায় হিমেল পরশ। হেমন্তের সময় ।হাল্কা হাল্কা কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক ।গোয়ালের কাছে গাছটা আশশেওড়া। আর সেখানেই বসে আছে এক অদ্ভূত আতঙ্ক। এক ঝলক না দেখলে মানুষ না পশু কিছুই বোঝা যাবে না। যেন রূপকথার কোনো অজানা বিভীষিকা নেমে এসেছে বাস্তবে।টকটকে লাল দুই চোখ আঁধারে জ্বলজ্বল করছে,মুখের চোয়াল লম্বাটে ও তা থেকে বেরিয়ে এসেছে শ্বদন্ত, সারা শরীর ধূসর বা ছাই ছাই লোমে ঢাকা। যেন এই সেই ইউরোপের কুখ্যাত মিথ নেকড়েমানব।রূপাকে দেখেই ওটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে পালিয়ে গেল। আতঙ্কে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে গেল রূপা। 


রূপার ভাগ্য ভালো ছিল যে, অন্যদের মতো তার আতঙ্কে হার্টফেল হয়ে মৃত্যু ঘটে নি। বাড়ির লোক যখন খুঁজে পায় তখন সে অজ্ঞান হয়ে লোহার ফটকের কাছে পড়ে ছিল। সেবা শুশ্রুষার পর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফেরে রূপার। কিন্তু,কে না জানত গ্রামে হয়েছে এক নতুন প্রাণীর আবির্ভাব।


"জান তো মা,যখন যখন পৃথিবীতে পাপের পরিমাণ খুব বেড়ে যায়,তখন ঈশ্বর নিজের হাতে পাপীদের ধ্বংস করেন। কখনো তিনি আসেন রামরূপে,কখনো আসেন কৃষ্ণরূপে,কখনো আসেন বরাহ বা নৃসিংহরূপে। আর এভাবেই তিনি পাপীদের দমন করে নিজের ভক্তদের উদ্ধার করেন।"এই বলে থামলেন গাঁয়ের শিবমন্দিরের পুরোহিত।


নির্নিমেষ নয়নে পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে ছিল রূপা। সুস্থ হবার পর এই প্রথম রূপা পূজা দিতে এসেছে পঞ্চাননতলার শিবমন্দিরে এক সোনালী সকালে। পূজার পর মন্দিরের চাতালে কথা হচ্ছে পূজারীর সঙ্গে। জ্ঞান আর ভক্তির সম্মিলনে এক অপরূপ ব্যক্তি,সদাহাস্য মুখমণ্ডলে প্রশান্তি সদাই বিরাজমান,প্রশস্ত কপালের নিচে স্নিগ্ধ টানা টানা দুই চোখ। অবাক হয়ে চেয়ে রইল রূপা। এই চোখ সে আগেও দেখেছে,কিন্তু তার মধ্যে স্নিগ্ধতা আর প্রশান্তির বদলে ছিল হিংস্রতা। এই চোখ সে দেখেছে সেই আশশ্যাওড়ার গাছে,সেই কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাতে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics