আমার সৃজনী
আমার সৃজনী


প্রিয় ডায়েরি,
আজকে এই দুঃসময়ের দিনে মন ভীষণ ভারাক্রান্ত। চতুর্দিকে শুধুই খারাপ খবর। ঘরে বসে থাকতে থাকতে সময় যেন পাহাড় প্রমান বিশাল মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় ঘরের কাজকর্মের অবসরে নিজের কিছু পুরানো শখ নিয়ে বসতে খুব ইচ্ছা করলো। লেখালেখির শখ তো আমার শুরু থেকেই। সেটাকে কখনও নিজের থেকে আলাদা করিনি। সে তো আমার মনখারাপের সঙ্গী,মন ভালোর সঙ্গী। কিন্তু লেখালেখি করা ছাড়াও আমার ছোটো থেকে আরও বেশ কিছু শখ ছিলো। সেগুলো আজ হয়তো সময়ের অভাবে করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই নিশ্চিত অবসরে আজ যখন সেগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে, সেটাকে হাতছাড়া করা ঠিক কি? কে জানে আর কখনও পাব কিনা এরকম অবসর। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম আলমারির সামনে। তারপর তার ভেতর থেকে বের করলাম একটা ঝোলা ব্যাগ।ওই অনেকটা ঠাকুরমার ঝুলির মতো আর কি। তফাত শুধু এটাই যে ঠাকুরমার ঝুলিতে ছিলো রাক্ষস,খোক্ষস,পরী, রাজকন্যা এরা সবাই। আর আমার ঝোলাতে রয়েছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত কিছু জিনিস। ভাবতে পারিনি কখনও আবার এই ঝোলাটা নিয়ে বসতে পারব । বিয়ের পর যখন অষ্টমঙ্গলাতে গিয়েছিলাম, তখনই আমার এই প্রিয় ঝোলা টিকেও আমি নিজের সঙ্গে ই নিয়ে চলে এসেছিলাম এই বাড়িতে। আমার সঙ্গে সঙ্গে এটিরও স্থান পরিবর্তন হয়েছিল আর কি? বিয়ের পর নতুন নতুন এক দুবার অবসর সময়ে নিয়ে বসতামও এই আমার প্রিয় ঝোলাটিকে নিয়ে। তারপর তো সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে আমার সেই প্রিয় ঝোলা টির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। এই সুদীর্ঘ অবসর আবার আমাকে তার কাছাকাছি নিয়ে এলো। এ বাবা এতক্ষণ ধরে যে ঝোলার কথা বলছি, তার মধ্যে কি জাদু কি ঝাপ্পি আছে, সেটাই তো বলা হয়নি। যত্ন সহকারে আমি খুললাম আমার সেই ঝোলা ব্যাগটি। এ বাবা এটা কি? একটা ছোট্ট আমার হাতে বানানো সুতির ফ্রক। আবার কি সুন্দর লাল লেস দিয়ে ফ্রিল করা। নতুনের মত আছে ছোট্ট ফ্রকটা। ও আপনাদের তো বলাই হয়নি, আসলে ছোটবেলায় আমার খুব শখ ছিল আমি দর্জিদের মতো জামা সেলাই করবো, কাটিং করবো। পাড়ার এক দর্জি কাকুকে দেখেই আমার সেই ইচ্ছা জাগ্ৰত হয়েছিল। দর্জি কাকু খুব সুন্দর সুন্দর জামা সেলাই করতো। আমি একমনে বসে বসে দেখতাম সেইসব জামা বানানো। ঘরে এসে মাকে বললাম, পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না আমার। আমি জামা সেলাই করা শিখবো। ঘা কতক খেয়েও ছিলাম তখন মায়ের থেকে। কারণ তার দুদিন পরেই আমার অংক পরীক্ষা ছিল। যাইহোক এখনকার সময় হলে হয়তো বলতাম ফ্যাশন ডিজাইনার হবো। তখন তো আর অতশত জানতাম না। তাই বলতাম দর্জি হবো। লুকিয়ে লুকিয়ে এক ঠাকুমার কাছ থেকে জোগাড় করা ছোট্ট এক টুকরো নতুন কাপড়ের টুকরো দিয়ে বানিয়েছিলাম আমার প্রিয় পুতুলের জন্য এই ফ্রক। আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য ফ্রকটা হাতে নিয়ে। ফিরে গিয়েছিলাম সেই ছোটবেলায়। ঘোর কাটল মেয়ের ডাকে। খাবার চাইছে ও , বেচারার খিদে পেয়েছে। খাবার দিয়ে এসে আর কি আছে আমার ঝোলাতে দেখাবো। এবার আমার ঝোলা থেকে বেরিয়েছিল মাটির এবড়োখেবড়ো বানানো কয়েকটা মূর্তি। একটা মাটির পুতুল, একটা মাটির হাঁস, ইঁদুর এইসব। ওগুলো আবার রঙ ও করা আছে দেখছি। ও আপনাদের তো বলা ই হয়নি ,এটাও আমার ছোটবেলার আর একটা শখ ছিল। বাড়ির পাশে ছিল ঠাকুর দালান। মহালয়ার দিন থেকে শুরু হতো সেখানে ঠাকুর তৈরির কাজ। প্রবোধ দাদু প্রথমে একটু মোটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বাঁধত ঠাকুরের কাঠামো। তারপর যত্ন সহকারে সেই কাঠামোকে খড় আর দড়ি দিয়ে বেঁধে, তার উপর মাটির প্রলেপ দেওয়া শুরু করতো। কতভাবে সেই কাঠামোতে মাটির প্রলেপ পুরু করে লাগানো হতো। ধীরে ধীরে সেই কাঠামো প্রবোধ দাদুর হাতের ছোঁয়ায় রূপ পেত নিখুঁত প্রতিমায়। কত যত্ন সহকারে সেই প্রতিমার প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গড়ে তোলা হতো। সবথেকে ভালো লাগতো দেবীর চক্ষুদান। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য।আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।চক্ষুদানের পর দেবী মূর্তির মধ্যে যেন প্রানের সঞ্চার হতো। আর আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতাম সেই শিল্পকলা। জিজ্ঞেস করতাম প্রবোধ দাদুকে ,"কোথায় শিখেছো গো এত সুন্দর ঠাকুর তৈরি করতে?" প্রবোধ দাদু প্রতিমার গায়ে রঙের প্রলেপ দিতে দিতে বলতো,"বাপ-ঠাকুরদার থেকেই শিখেছি গো মা।" একদিন বললাম ,"আমাকে শিখিয়ে দেবে ?" ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো প্রবোধ দাদু। পরদিন সকালে উঠেই হাজির প্রবোধ দাদুর কাছে। খানিকটা মাটি নিয়ে বললাম, "এবার শেখাও আমাকে ঠাকুর তৈরি করতে"। বললো, "আগে তুমি মাটি টাকে মূর্তি তৈরি র উপযুক্ত করো, তবে তো তৈরি করবে ঠাকুর।ওটাকে মসৃন করে মাখো আগে। " বেশ কিছুক্ষণ মাটি টাকে জল দিয়ে দিয়ে মাখতে লাগলাম। তারপর বললাম প্রবোধ দাদুকে ,"এবার শেখাও তো বাপু কেমন করে ঠাকুর তৈরি করে। কখন থেকে তো মাটি টাকে মেখেই চলেছি।"প্রবোধ দাদু শান্ত স্বরে বলতো, "এসব কাজে কি অত তাড়াহুড়ো করলে হয় দিদিমনি।কতো মন দিয়ে করতে হয় ,তবে তো সুন্দর একটা প্রতিমার সৃষ্টি করতে পারবে তুমি।" তখন কি আর অতো বুঝতাম, ভাবতাম ওই তো একটা কাঠামো বেঁধে তার উপর মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া আর জল ,কাদা দিয়ে দিয়ে তাতে হাত বোলানো।এ আর এমন কি কঠিন কাজ। কিন্তু কাজটা যে মোটেই সহজ না তার প্রমাণ আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলাম হাতেনাতে। প্রবোধ দাদু বলেছিল ,"আগে এরকম একটা পুতুল বানিয়ে আমাকে দেখাও তো"। আমি আবার রেগে গিয়ে বললাম, "ওইসব পুতুল টুতুল আমি শিখবো না। আমাকে ঠাকুর তৈরি করতে শেখাও তুমি।" প্রবোধ দাদু মৃদু হেসে বলল,"দিদিমণি আমাকে একটা কথা বলো, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?" আবার আমার রাগ ,"শেখাবে তো ঠাকুর তৈরি করতে বাপু, তার সঙ্গে আমি কোন্ ক্লাশে পড়ি , সেটা জেনে কি করবে? যাইহোক জানতে যখন চেয়েছো বলছি। আমি ক্লাস ফোরে উঠলাম।" হাসতে হাসতে দাদু বললো, "তুমি তো লিখতে পারো তাহলে অনেক কিছুই।" আমি হেসে কুটিকুটি। বললাম,"এত বড়ো মেয়ে হয়ে গেলাম আর লিখতে পারবনা। ইংরেজি, বাংলা সব লিখতে পারি আমি।" এবার দাদু বললো, "এই যে তুমি এত কিছু লিখতে পারো এখন, তার জন্য তো তোমাকে আগে অ,আ,ক,খ ,এ,বি,সি,ডি এইসব শিখতে হয়েছে দিদিমনি।" আমি আবার হেসে বললাম, ওগুলো না শিখলে লিখবো কি করে। এবার দাদু বললো,"ঠাকুর বানানো শিখতে হলেও তো তাই তোমাকে ছোট ছোট পুতুল বানানো আগে শিখতে হবে দিদিমনি। তবে তো তুমি সুন্দর প্রতিমা তৈরি করতে পারবে।" যাইহোক ব্যাপারটা আমি দেরিতে হলেও বুঝেছিলাম সেদিন। তাই আর তর্কে না গিয়ে, শুরু করেছিলাম পুতুল বানানো দিয়ে। কিন্তু সেটা যে কতটা কঠিন একটা কাজ ,তা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। শত চেষ্টাতেও সেদিন প্রবোধ দাদুর মতো নিখুঁত পুতুল আমি বানাতে পারিনি। তারপর সরস্বতীর হাঁস,লক্ষী ঠাকুরের পেঁচা, এমনকি গনেশের ইঁদুর ও বাদ যায়নি আমার হাত থেকে। কোনো না কোনো একটা কিছু তো ভালো হবেই,তারই প্রচেষ্টা আর কি। তারই কিছু নিদর্শন আমার এই বর্তমানের ঝোলা ব্যাগে আজও বিদ্যমান সশরীরে। আমার ঝোলার সবগুলো জিনিসের সঙ্গে ই জড়িয়ে আছে, আমার ছোটবেলার স্মৃতি, যা কখনও ভোলার না। সময়াভাবে আমরা অনেকেই আমাদের পুরানো কিছু জিনিস, যা একসময় হয়তো আমাদের খুব প্রিয় ছিল, সেসব নিয়ে বসতে পারি না। কিন্তু সেইসব দুর্লভ স্মৃতি আমরা মনের মণিকোঠায় সযত্নে তুলে রেখেছি। আজ ব্যস্ততা থেকে দূরে গিয়ে সেই সব সযত্নে লালিত স্মৃতিদের পুনরায় মনের মধ্যে আনবার সুযোগ পেয়েছি হয়তো। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই মন খারাপের দিনে ঘরবন্দী আমরা অনেকেই হয়তো আমাদের পুরানো স্মৃতি আঁকড়ে ধরতে চাইছি। ধন্যবাদান্তে কলম রাখলাম।