Sukdeb Chattopadhyay

Abstract

5.0  

Sukdeb Chattopadhyay

Abstract

আমার প্রথম স্কুল

আমার প্রথম স্কুল

4 mins
570


মহম্মদগঞ্জ। পালামৌ জেলার একটা ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নামেই স্টেশনের নাম। রেল লাইনের একদিকে গ্রাম আর অন্য দিকে জঙ্গল আর পাহাড়। স্টেশনের পাশেই রেল কমর্চারিদের কোয়ার্টার। তার পিছনদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল গ্রামের ঘরবাড়ি। অধিকাংশই মাটির। গ্রামের শেষে বয়ে চলেছে কোয়েল নদী। দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসা দুটি ঝর্ণা গ্রামের দুপাশ দিয়ে বয়ে কোয়েলে গিয়ে মিশেছে। রেল লাইন পার হয়ে কাছের পাহাড়টার গা বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠলে ঝর্ণা আর নদী দিয়ে ঘেরা গ্রামের পুরোটাই দেখা যেত। সে এক অপরূপ দৃশ্য। বিশেষত কোয়েলের ওপারে রোটাস পাহাড়ের কোলে যখন সূর্য ঢলে পড়ে তখন গোধূলির আলোয় যে মোহময় পরিমণ্ডল তৈরি হয় তা যেন কোন চিত্রকরের সৃষ্টির এক জীবন্ত রূপ।


বাবা প্রায় বছর পাঁচেক মহম্মদগঞ্জের স্টেশন মাস্টার ছিলেন। সেই সুবাদে শৈশবে চার পাঁচ বছর খুব নিবিড়ভাবে উপভোগ করেছিলাম প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ লাবণ্যকে। 

 

গ্রামের একমাত্র স্কুলের নাম ছিল ‘মহম্মদগঞ্জ মিডল স্কুল’। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ান হত। এরপর এগোতে হলে অন্যত্র যেতে হবে। আমার জীবনের প্রথম স্কুল। বাবার সাথে প্রধান শিক্ষক রাম সেবক সিং এর ঘরে গেলাম। ওনার নির্দেশে আমাকে সরাসরি ক্লাস ফোরে ভর্তি করে নেওয়া হল। প্রথম দিন ক্লাশ টিচার কামেশ্বর সিং হিন্দিতে দু একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখনও হিন্দিতে খুব একটা সড়গড় হইনি। আমার মত করে উত্তর দিলাম। এরপর তিনি ইংরাজিতে জিজ্ঞেস করলেন- What is your name? আমি নাম বললাম। ক্লাসের সমস্ত ছাত্র ছাত্রী এমনকি মাস্টার মশাই নিজেও হতবম্ব। ক্লাস ফোরের ছেলে একটা সম্পূর্ণ বাক্য ইংরাজিতে কি করে বলল! বাবা র নামটাও ইংরাজিতে বলায় বিস্ময় আরো বাড়ল। আমার ইংরাজিতে অগাধ জ্ঞানের কথা সারা স্কুলে ছড়িয়ে গেল। একে বড়বাবুর(ওখানে স্টেশন মাস্টারকে বড়বাবু বলা হত) ছেলে তায় আবার ইংরাজি জানা বলে অন্য ছাত্রদের থেকে আমাকে একটু পৃথক ভাবে দেখা হত। এর কিছুদিন আগের কথা। আমি তখন তালতলায় আমার মামার বাড়িতে। দাদু একদিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে, তাঁর সাহেব বন্ধু, ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল আমাকে পরবর্তীকালে ঐ স্কুলে ভর্তি করা। দাদু, নাতি সম্পর্কে প্রশংসা সূচক অনেক ভাল ভাল কথা ভদ্রলোককে বললেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অগাধ বিস্ময়ে সাহেবের সাথে দাদুর কথোপকথন শুনছিলাম। একমাত্র ‘ইন্টালিজেন্ট’ ছাড়া আর কোন কথার মানেই বোধগম্য হয়নি। এরপর ভদ্রলোক পরম স্নেহে বন্ধুর নাতিকে কাছে টেনে নিলেন। মাথায় গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে কিছু জিজ্ঞেস করলেন। কামেশ্বর সিং এর সহজ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যে শিশুটি অজ গ্রামের এক প্রাইমারি স্কুলের সকলকে হতবাক করেছে, সে সাহেবের কথা কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিল। দাদুই সে যাত্রায় নাতিকে ঐ সংকট থেকে উদ্ধার করলেন।

আমাদের স্কুলটি ছিল কো-এডুকেশন স্কুল। এলাকার একমাত্র স্কুল হওয়ার ফলে অবস্থাপন্ন ও গরিব উভয় ঘরের ছাত্র ছাত্রীরাই এখানে পড়তে আসত। দুঃস্থ ঘরের ছেলে মেয়েই বেশি ছিল। দারিদ্রের তাড়নায় অনেকেই মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দিত। একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই এদের পারিবারিক অবস্থার ছবিটা পাওয়া যাবে। একদিন ক্লাশের ফাঁকে হুড়োহুড়ি করতে করতে আমি আমার সহপাঠী রামেশ্বর রামের জামা ধরে টান মারি। অনিচ্ছায় হলেও ঐ টানে রামেশ্বরের জামা খানিকটা ছিঁড়ে যায়। ছেলেটা শান্ত প্রকৃতির ছিল বলে কোন প্রতিবাদ করেনি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে জামার ছেঁড়া অংশটা বারবার দেখছিল। একজন শিক্ষক ঘটনাটা লক্ষ্য করেন। তিনি আমাকে ডেকে বলেন যে রামেশ্বরদের মত গরিবের ঘরে ঐ একটা বা দুটো জামাই সম্বল। আমি ঘটনার জন্য খুবই অনুতপ্ত হয়ে রামেশ্বরের কাছে বারে বারে দুখ প্রকাশ করি।

ওয়ান আর টু, এই দুটো ক্লাস নিতেন লালা গুরুজি। তিনি একই সঙ্গে স্কুল সংলগ্ন একটা পোস্ট অফিসের দায়িত্বেও ছিলেন। বয়সেও ছিলেন বৃদ্ধ। এতটা ধকল ঐ বয়সে তাঁর পক্ষে সামলানো বেশ কঠিন ছিল। ছাত্রদের জোরে জোরে পড়তে বলে তিনি অকাতরে ঘুমোতেন। ঘুমোতে ঘুমোতে যাতে পড়ে না যান তার জন্য এক পা চেয়ারে তুলে আর এক পা টেবিলে ঠেকা দিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতেন। পঞ্চম শ্রেণীতে একাধারে শ্রেণী শিক্ষক ও আমার গৃহ শিক্ষক ছিলেন রাম নরেশ সিং। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করতেন। শেখানো আর শেখার মধ্যে যা কিছু ব্যবধান থাকত তা তিনি মুছে ফেলতেন পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পত্রগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে আগাম সমাধান করিয়ে দিয়ে। পরীক্ষার উত্তরপত্র মুল্যায়নের ক্ষেত্রেও কোন রকম কার্পণ্য থাকত না। ফলে যে কয় বছর ওখানে পড়েছি প্রথম স্থানটা আমার বাঁধা ছিল।

স্কুলের শিক্ষাদানের পদ্ধতির মধ্যে মারের একটা বড় ভূমিকা ছিল। শিক্ষকদের মারের এত বৈচিত্র আর ছাত্রদের মার সহ্য করার এত ক্ষমতা আমি আর কোথাও দেখিনি। স্কুলের মাঝখানে খাপরার চাল দিয়ে ঢাকা খানিকটা জায়গা ছিল। গোবর আর মাটি দিয়ে লেপা মেঝেতে চেটাই পেতে বসতে হত। ওখানেই স্কুলের সব  সভা বা অনুষ্ঠান হত। নাম ছিল ‘গান্ধী মঞ্চ’। ওইখানেই একবার পরীক্ষায় প্রথম হওয়া এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য পুরস্কার পেয়েছিলাম। একটা পেন্সিল আর একটা শিশু পাঠ্য হিন্দি বই ‘বমবম কাকা’। যত সামান্যই হোক না কেন, ওটাই জীবনের প্রথম পুরস্কার, তাই আজও আমার কাছে তা দুর্মূল্য। মাত্র তিন বছর পড়েছিলাম ওই স্কুলে, তবু স্মৃতির সরণিতে একটু ঘোরাফেরা করলেই এখনও খুঁজে পাই আমার শিক্ষা জগতের প্রবেশদ্বার ‘মহম্মদগঞ্জ মিডল স্কুল'কে। ঐ স্কুলই ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রামে একমাত্র আলোর দিশারী। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract