Ajobdeep Bromho

Abstract Horror Thriller

4.4  

Ajobdeep Bromho

Abstract Horror Thriller

আমার একটা রাত

আমার একটা রাত

19 mins
379


একপ্রকার দমকা বাতাসের মতোই আমার নাক দিয়ে নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে হলো কেউ যেন আমার শ্বাসনালীটাকে সকল শক্তি দিয়ে এতক্ষণ চেপে ধরে রেখেছিল। তারপর হয়তো আমার করুন পরিস্থিতি দেখেই আমাকে দয়া করে রেহাই দিয়েছে। আমি জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানতে লাগলাম। মধ্যে মধ্যে বার কয়েক কেশেও উঠলাম। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হতেই আমি আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। কিন্তু প্রথমবারে কিছুই দেখতে পেলামনা। ভীষন ঝাপসা লাগছিলো। প্রানপনে কয়েকবার চোখের পাতা ফেলতেই আমার দৃষ্টি সামান্য পরিষ্কার হলো। দেখলাম আমার চোখের থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে। প্রথমে বুঝতে পারলাম না। পরে একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝলাম সেটা একটা ল্যাম্প পোস্টের আলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম না আমি কোথায়! বহুদূর থেকে লড়ি বা বাস জাতীয় কিছু একটা চলে যাওয়ার আওয়াজ বেশ কয়েকবার কানে ভেসে এলো। চারিদিকে প্রচন্ড বাতাস বইছে। জলের কলতানও শুনতে পেলাম। কোথা থেকে একটা লঞ্চের ভেঁপুও বেজে উঠল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আমি কোথায় আছি! মনে করার চেষ্টাও করলাম কিন্তু উফ্ মাথায় মধ্যে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার সমস্ত শিরাগুলো বোধহয় এক্ষুনি সব ছিঁড়ে যাবে। আমি ওঠার চেষ্টাও করলাম কিন্তু পারলাম না। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। যন্ত্রনা যেন আমার শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে অসাড় করে দিয়েছে। তারা কেউই যেন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমি অসহায়ের মতো পড়ে আছি। এইভাবে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর আমি স্থির করলাম, না আর পড়ে থাকলে চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে উঠতে হবে। শরীরের সমগ্র বল প্রয়োগ করে বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ওঠার চেষ্টা করলাম। যন্ত্রনায় আমার কান্না পেয়ে গেলো। তবুও আমি হার মানলাম না। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। দেখলাম আমি একটা পীচের রাস্তার উপর শুয়েছিলাম এতক্ষণ। আমার ভীষণ অবাক লাগলো। আমি এখানে এলাম কি করে! আমার কোন কিছুই মনে পরছে না। আমি আমার ডানদিকের ল্যাম্প পোস্টটার গা ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। মাথার যন্ত্রণায় আমি ঠিক মতো দাড়াতে পারছিনা। মাথাটা এতো ভার লাগছে যেন মনে হচ্ছে এক্ষুনি আবার পড়ে যাবো। কিন্তু হার মানলে চলবে না। যেভাবেই হোক আমাকে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভাল করে দেখলাম। বুঝতে পারছিলাম না কোন দিকটাতে যাবো। রাস্তা ঘাট ফাঁকা। মানুষ তো দূরস্ত একটা নেড়ি কুকুরও চোখে পড়ছে না। আমার বাঁ দিকে একটা রেল লাইন চোখে পড়লো আর তার ধারেই একটা বিরাট বড় গুদাম। রেল লাইনের এ ধারে কয়েকটা বড় বড় লড়ি ও ৪০৭ গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে। আমার ডান দিকে আগাছার জঙ্গল। তার গা ঘেঁষেই শান্ত ভাবে গঙ্গা নদী বইছে। পারে দুটো নৌকা বাঁধা আছে দেখলাম। আমি ঠিক করলাম সামনের দিকে এগোবো। তখন কত রাত হয়েছে জানিনা। হাত ঘরিটার দিকে তাকাতে দেখলাম সেটা ১০টা বেজে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ঘরির কাঁচটাও ভেঙ্গে চৌচির। আর কিছু না ভেবে আমার সমস্ত যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। কিছুটা এগোতেই বেশ সেকেলে গোছের একটা মন্দির চোখে পড়লো। মন্দিরটার কাছে আসতেই দেখলাম সেটার ফটক বন্ধ। তবে তার সামনে একটা বেশ লম্বা সরু আকারের গাছ দেখতে পেলাম। গাছটার নীচেরদিকে বেশ কিছুটা বাঁধিয়ে একটা বেদীর মতন বানানো। তারই উপরে একটি কালো রঙের পাথর রাখা। পাথরটার চারিদিকে ধূপকাঠির অবশিষ্টাংশ ও ফুল ছড়ানো দেখে বুঝলাম সেটাকে নিত্যদিন পূজা করা হয়। মন্দিরটাকে রেখে আরও কিছুটা পথ এগোতেই একটা ঘাট দেখতে পেলাম। সেখানের একটা পোষ্টের আলোতে দেখলাম ঘাটটা বেশ পুরনো। জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট খসে ভেতরের ইটগুলো দেখা যাচ্ছে। আরও কিছুটা এগোতেই ওই ঘাটেরই সিঁড়িতে কতকগুলো মূর্তিকে বসে থাকতে দেখলাম। তাদের দেখে আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ভাবলাম হয়তো এরা স্থানীয় বাসিন্দা! যদি তাদের থেকে কোনরকম সাহায্য পাওয়া যায়, এই আশা নিয়েই আমি দ্রুতপদে ঘাটটির দিকে এগোতে লাগলাম। "এই যে শুনছেন" বলে ঘাটটির সামনে যেতেই আমার কথা আর পা - দুটোই থমকে গেলো। আমি হতবাকের মতো শূন্য ঘাটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোথায় সেই মূর্তিগুলো! সেখানে কেউই ছিলনা। যেন তারা আমাকে দেখতে পেয়েই শূন্যে লুকিয়ে পড়েছে। আমি বিস্ময়ে ও আতঙ্কে ধীরে ধীরে এক একটা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি নামতেই আমি হতাশ হয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। এই ঘটনার পর আমার ক্লান্তি যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম। "কিরে, অনিন্দ্য না!" হঠাৎ একটা প্রশ্ন শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম অন্বেষা, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। তবে ওইরকম অবস্থায় অন্বেষাকে পেয়ে আমি সত্যি বুকে প্রান ফিরে পেলাম। অন্বেষা হলো আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী। আমরা একই কলেজে পড়তাম। একসাথে ঘোরা ফেরা, কলেজ যাওয়া, পড়তে যাওয়া আরও কত কি! ওর সাথে বন্ধুত্বটা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে, একদিন সমস্ত বন্ধুত্বকে উপেক্ষা করে অন্বেষাকে গোপনে গোপনে ভালবেসে ফেলি। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য এই যে, ওকে কোনদিনও সেকথা বলতে পারিনি। এই ভয়ে যদি বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই ভেঙ্গে যায়! তারপর কলেজের থার্ড ইয়ারের একদম শেষের দিকে অন্বেষা ইন্দ্র নামের একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তার কয়েকদিন পর কলেজও শেষ হয়ে গেলো। অন্যান্য বন্ধুদের মতোই অন্বেষাও সম্পর্কের বাঁধন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করলো। সত্যি বলতে কলেজ পাশ করার পর আমিও ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কর্মসূত্রে আমেরিকা চলে যাই। এমন করে আরও চার বছর কেটে গেলো। আর এই চার বছর পর আজ এই রাতে একটি নাম না জানা জায়গায় নির্ঝুম গঙ্গার ঘাটে ওর সাথে আমার আবার দেখা। অন্বেষাকে প্রথমে দেখে অদ্ভুতই লাগছিলো। কেমন যেন হয়ে গেছে দেখতে। ভীষন রোগা দেখাচ্ছে আগের তুলনায়। কিন্তু যে জিনিসটা আমায় সবথেকে বেশী বিস্মিত করছে তা হলো ওর সাজ পোশাক। অন্বেষা একটা লাল রঙের বেনারসি শাড়ি পরে আছে। মাথায় সোলার চূড়া। এছাড়া গলায় সোনার হার, হাতে সোনার চুড়ি, মাথার মাঝখান বরাবর সোনার টিকলি, নাকে নথ ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছে যেন ও বিয়ে করতে যাচ্ছে। আমি ওর দিকে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখেই হয়তো ও বললো, "কিরে, চিনতে পারিসনি আমায়?" আমি একটু ইতস্তত করেই বললাম," না মানে তোকে এখানে এইভাবে দেখবো তা আমি একেবারেই আশা করিনি।" অন্বেষাও একটু গম্ভীর ভাবে বললো," আমিও।" এই বলে ও আস্তে করে আমারই পাশে সিঁড়ির ধাপটাতে এসে বসে পড়লো। আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই বললাম," কিরে তুই এখানে কি করছিস?"

"তুই যা করছিস, আমিও তাই করছি", কথাটা বেশ মজা করেই বললো অন্বেষা।

" মানে! সত্যি বলতে আমি নিজেও জানিনা যে, আমি এখানে কি করছি, কি করে এলাম! কিচ্ছু জানিনা আমি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। যখন আমার জ্ঞান ফিরলো আমি দেখলাম ওইদিকটাতে রাস্তার উপর শুয়ে আছি" বলে আমি যেদিক থেকে এসেছি সেদিকেই আঙ্গুল তুলে দেখালাম। অন্বেষা মৃদু হেসে বললো, " তুই এখনও সেই হাঁদারামটাই আছিস। আমেরিকাতে গেছিস ঠিকই কিন্তু ওখানকার সাহেবরা তোকে এতটুকুও পাল্টাতে পারেনি।"

- হাঁদারাম! কেন বলতো?

- ও তুই ঠিক পরে জানতে পারবি। আচ্ছা সিগারেট হবেরে তোর কাছে?

"হ্যাঁ থাকার তো কথা। দাঁড়া" বলে আমি আমার প্যান্টের পকেটের ভিতর হাতরাতে লাগলাম। বেশীক্ষন লাগলো না, প্যান্টের পকেট থেকে একটা সাদা ধবধবে সিগারেটের প্যাকেট বেড়িয়ে এলো। প্যাকেটটা কোনো কারণে দুমরে মুচড়ে গিয়েছে বটে কিন্তু দু একটা সিগারেট তখনও অক্ষত রয়ে গেছে। সিগারেটের প্যাকেটটা আমি অন্বেষার দিকে এগিয়ে দিলাম। ও একটা সিগারেট নিলো। তারপর আমিও একটা নিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে আমার আর ওর সিগারেটটাতে অগ্নিসংযোগ করলাম। সিগারেটে প্রথম টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অন্বেষা বললো, " কেমন আছিস অনিন্দ্য?" আমিও ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম," ভাল আছি। তুই কেমন আছিস?"

- এতক্ষণ ভাল ছিলাম না, তবে এই তোকে পেয়ে গেলাম এখন কিন্তু বেশ ভালো আছি।

অন্বেষার গলায় গদগদ সুর।

- তুই কিন্তু এখনও পাল্টাসনি। সেই আগের মতোই ছ্যাবলাস।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্বেষা বললো, " এই বালের জীবনে যখন ছ্যাবলিয়ে আসলাম আর এখন কেন নয়! ব্যাপার কি জানিস তো মানুষের মন সব অবস্থাতেই একইরকম থাকে।" বেশ অবাক হয়েই বললাম," ওরে বাবারে! তুই তো দেখছি দার্শনিকও হয়ে গেছিস।" আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। ও হাসি থামিয়ে বললো," তুইও হবি, দাঁড়া। আগে নিজের স্থান-কাল নিজেকে বুঝতে দে।" সত্যি বলতে আজ অন্বেষাকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত বলেই মনে হচ্ছিল। তবে ওর কোন কথারই তল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওর এই হেঁয়ালিপনা কথাগুলি বড্ড অস্বস্তিতে ফেলছিল আমাকে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য ওকে একটা সহজ-সরল প্রশ্ন করে বসলাম। " একটা কথা বলতো, তুই এতো রাতে এই বিয়ের সাজ নিয়ে এমনভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?" সিগারেটে শেষ একটা লম্বা টান দিয়ে অন্বেষা বললো," কারণ বিয়ের মন্ডপ থেকে পালিয়ে এসেছি তাই।"

- কেন?

ও সিগারেটটাকে যথা সম্ভব দূরে ছুঁড়ে ফেলে বললো," বলছি। তার আগে ওঠতো। এখানে বসে থাকতে বড্ড বিরক্ত লাগছে। বলে ও উঠে পড়লো। " চল হাঁটতে হাঁটতে বলছি।" অন্বেষা সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। আমি বললাম," না রে আমি পারবো না।" ও কিছুটা উঠে গিয়ে পিছন ফিরে বললো," কেন, কি হয়েছে?" বলে ও আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করলো।

- শরীরে ভীষণ ব্যাথা করছেরে। আমি আর চলতে পারছিনা, বিশ্বাস কর।

এই শুনে ও একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো," কই দেখি, কোথায় ব্যাথা করছে!" এই বলে আমার একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারতেই আমি সম্মোহিতের মতো উঠে পড়লাম। মনে হলো যেন আমার সকল ব্যাথা-যন্ত্রনা সবকিছু বাতাসে উবে গেছে। মনে মনে বেশ বিস্মিতও হলাম। কিন্তু পরমুহুর্তেই আমার গা টা শিউরে উঠলো। কারণ যখন অন্বেষা আমার হাতটা ধরেছিল আমি স্পষ্ট অনুভব করেছিলাম ওর হাতটা ভীষণ ঠান্ডা। কিন্তু কেন! আমি ওকে প্রশ্ন করতে যাবো কিন্তু কোথায় ও! দেখলাম ও ঘাটের একদম উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে হাতছানি দিচ্ছে," কিরে আয়।" আমি কোনো কথা না বলে উপরে দিকে উঠতে লাগলাম। ঘাট থেকে উঠে আবার বাঁ দিক বরাবর হাঁটা শুরু করলাম। অন্বেষা একটু আগে আগেই হাঁটছে আর কি যেন একটা গান গুনগুন করছে। কি গান সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম," কিরে শুনছিস!" প্রথমটায় ও কোনো উত্তর দিলোনা। এমনকি ঘুরেও তাকালো না। মনে হলো যেন ও আমাকে শুনতেই পায়নি। আমি আরেকটু জোরে ডাক দিলাম," এই অন্বেষা, কিরে কোথায় যাচ্ছিস তুই?" এবার ও থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরে তাকালো। বললো," কোথাও না। মনে আছে কলেজে পড়ার সময় আমরা মাঝে মাঝেই এখানে চলে আসতাম। কত সিগারেট খেয়েছি বল এই গঙ্গার ধারে!"

আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টার পর বললাম," উফ্! কিচ্ছু মনে পড়ছে না আমার। কোথায় বলতো এটা!"

- বুদ্ধু এটা শোভাবাজার গঙ্গার ঘাট।

- ও হ্যাঁ হ্যাঁ। তাইতো।

আমরা এখন পাশাপাশি হেঁটে চলেছি। দুজনেই চুপচাপ। লক্ষ্য করলাম ওর মুখের ভাব, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু কেমন যেন পাল্টে গেছে। গাম্ভীর্যের দাপটে সেখানে আর কোনো রসিকতা নেই। ও বললো," কিছু বলছিস না যে!"

- না কিছু না। তোর কথাগুলো শুনছি।

- পাগল একটা! আচ্ছা মনে আছে ওই মদ খাওয়ার কথাটা!

আমি হেসে বললাম," মনে আবার থাকবে না। তোর যে সেদিন কি শখ হয়েছিল কে জানে! বায়না ধরলি গঙ্গার ধারে বসে মদ খাবি।"

- তবে মানতেই হবে তুই আমার জন্য সেদিন খুব কষ্ট করেছিলি। ওতো রাত্রে তুই মদ জোগাড় করে আমাকে নিয়ে এখানেই এসেছিলি।

- কিন্তু হায়! তোর কপালে আর সুখ সইল না।

আমি হেসে উঠলাম। আমার হাতে একটা মৃদু চাঁটি মেরে বললো," মোটেও না। ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। কে জানতো যে, ঠিক ওই সময়ই পুলিশ এইখানে রেইড করবে।"

আমি আবার হাসতে শুরু করলাম। " মানতেই হবে তখন তোর মুখটা দেখার মতন হয়েছিল। একটু হলেতো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলি।" অন্বেষা একটু লজ্জা পেয়ে বললো," যা! মোটেও না।" তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো," হ্যাঁ রে, সেই দিনগুলো কি আর কোনদিনও ফিরবে না!"

- ফিরবে তো বটেই। তবে স্মৃতির হাত ধরে। যেমন এখন ফিরছে।

তারপর কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ হাঁটলাম। সেই রাত্রির নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে অন্বেষাই কথা বললো," সেদিন যা জানতে পারিনি আজ তা জানতে পেরেছি।

- কি জানতে পেরেছিস?

- বললাম না তুই একটা হাঁদারাম। তোর দ্বারা কিস্যু হবে না।

- আমি আবার কি করলাম?

- একবার তো মুখ ফুটে বলতে পারতিস আমায়! তাহলে আজকের দিনটা এমন হতো না।

- কি বলতাম?

- তোর সেই না বলা কথাগুলো। যেগুলো তুই আমার জন্য মনে মনে তুলে রেখেছিলি।

অন্বেষার এই কথাগুলো শুনে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ও জানলো কি করে! আমি ওই কথাগুলো তো কাউকেই বলিনি। ও বললো," কি হলো রে! দাঁড়িয়ে গেলি কেন?" এই বলে ও আমার হাত ধরে আবার চলতে শুরু করলো। বললো," নিশ্চয়ই ভাবছিস যে, আমি কি করে জানলাম!" আমি শুধু উপর-নীচ মাথা নাড়লাম। ও বললো," সেটাও পরে জানতে পারবি।" আমি এবারও ওর কথার মানে বুঝতে পারলাম না। শুধু হাঁটতে লাগলাম। গঙ্গার শীতল বাতাস যেন আজ আমাদের এক অন্য জায়গায়, এক অন্য জগতে নিয়ে চলে গিয়েছিল। তবুও একটা অস্বস্তি বারবার আমার মনকে বিচলিত করছিল। অন্বেষার ওই ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। আমি আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম," হ্যাঁ রে, তোর হাতটা এত ঠান্ডা কেন রে?" আমার হাতটা ছেড়ে আবার ও রসিকতা শুরু করলো," জানিসনা যে, মরা মানুষদের হাত ঠান্ডা হয়!" এবার সত্যিই ওর ওই ধরনের রসিকতায় বিরক্ত হলাম। বললাম," জাস্ট স্টপ ইট ইয়ার। সব সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না।" তবে ও কিন্তু কিছুই বললোনা। পরে মনে হলো বোধহয় রাগ করেছে। সত্যি! আমার ওমন করে বলাটা ঠিক হয়নি। আমি একটু নরম সুরেই বললাম," হ্যাঁ রে, রাগ করলি নাকি!" অন্বেষা আমার থেকে একটু দূরেই হাঁটছিল। আমার কথা শুনে পিছন ফিরে বললো," না রে, রাগ করবো কেন?"

- ওই যো, ওমন করে বললাম বলে!

- ধুর পাগল, এর জন্য আবার কেউ রাগ করে নাকি!

কথাটা শুনে আমি একটু মুচকি হাসলাম। তারপর আবার নিঃস্তব্ধ। ও আর আমি পাশাপাশি চুপচাপ হেটে যাচ্ছি। গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া ক্রমাগত মনটাকে হাল্কা করে তুলছে। আমি আমার কনুইতে একটা ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করলাম। অন্বেষা আমার কনুইটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। আমি একবার তাকালাম ওর দিকে। দেখলাম ও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমিও চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। একটা মুচকি হাসি যেন নিজের থেকেই আমার মুখে ফুটে উঠল। মনে হতে লাগল এটা যেন আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতি। গঙ্গার জলের পাড়ে আছড়ে পড়ার শব্দ, হাওয়ার সন্ সন্ আওয়াজ আর তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নিঃস্তব্ধতা বেশ মধুর মনে হলেও একটু একঘেয়েমি লাগছিলো। তাই বললাম," বললিনা তো!" ও বললো," কি?"

- এমনভাবে বিয়ের কনে সেজে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলি?

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্বেষা বললো," জানিস তো ইন্দ্রর সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা!"

- হুম।

- কিন্তু আমার বাড়ির লোক, বিশেষ করে বাবা একদম রাজি ছিলনা।

- কেন? ছেলেটাতো ভালোই ছিল।

- হুম, ভালো ছিল। তবে আমাদের মতো তো আর বড়োলোক ছিলনা। বাবা বললো, ওকে বিয়ে করলে নাকি সমাজে বাবার মুখ থাকবে না। তাই বাবা আমাকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করল। আমার ফোন কেড়ে নিলো। এমনকি আমার বাড়ি থেকে বেড়োনো পর্যন্ত বন্ধ করে দিলো।

অন্বেষা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে ততক্ষণে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। খালি ওর কাঁধে একটা হাত রাখলাম। ও চোখ মুছতে মুছতে বললো," একদিন হঠাৎ শুনলাম কোনো এক নামকরা ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমি সেটা মানতে পারলাম না। ব্যাস্ ঠিক করলাম যে, যেভাবেই হোক এই বিয়ে করবোনা। অনেক চেষ্টা করলাম। মাকে অনেকবার বোঝালাম। কিন্তু মাও বাবার জেদের কাছে হার মেনে নিলো। আমি নিজেকে শক্ত করলাম। ঠিক করলাম পালাবো বাড়ি ছেড়ে।" এইটুকু বলে অন্বেষা থামলো। আমি বললাম," আজকেই তোর বিয়ে ছিল নাকি?" অন্বেষা মুখে কিছু বলল না। খালি উপর নীচ মাথা দোলালো। আমি হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলাম। বললাম," তাই তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে এই রাত বিরাতে এইভাবে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিস!" ও বললো," হুম।"

- তাহলে তুই ইন্দ্রর কাছে গেলিনা কেন?

- ওর কাছে যাবো বলেই তো বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাগ্য! আমি চেয়েও যেতে পারলাম না।

- কেন?

- ওই যে সামনের পাঁচ মাথার মোড়টা, ওখানেই যত কেলেঙ্কারি ঘটলো।

- কেলেঙ্কারি! কিসের কেলেঙ্কারি?

- কি জানিস তো, আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে দিশেহারার মতন ছুটছিলাম। কোনো দিকে ধ্যান ছিলনা আমার। ভেবেছিলাম পাঁচ মাথার মোড় থেকে কোনো একটা ট্যাক্সি নিয়ে ইন্দ্রর বাড়ি রওনা দেবো।

- তারপর?

- পাঁচ মাথার মোড়ে আসতেই অনেকটা দূরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমি দূরের থেকেই তারস্বরে " ট্যাক্সি ট্যাক্সি" বলে চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে থাকি। তখন আমার মনের অবস্থা এমন যে, আশপাশ সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞানই ছিল না। ট্র্যাফিক সিগন্যালের দিকে খেয়াল না করেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকি। হঠাৎ আমার সম্বিত ফেরে একটা আওয়াজে। একটা ট্রাকের আওয়াজ! আমি বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি একটা বিরাট বড় ট্রাক আমারই দিকে ধেয়ে আসছে। ট্রাক ড্রাইভারটি বারংবার হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওইরকম পরিস্থিতিতে কি করবো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকের জোড়ালো আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।

আমি উত্তেজিত হয়ে অন্বেষার হাতটা চেপে ধরে বললাম," তারপর কি হল?" অন্বেষা আস্তে করে আমার চোখের দিকে তাকালো। স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম ও চোখের মণি দুটো কেমন লালচে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সেখানে যেন এক্ষুনি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের সঞ্চার হবে। ও আমার হাতটা ছাড়িয়ে কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়াল। বললো," তারপর আর কি! সব শেষ হয়ে গেল। ট্রাকটা আমাকে পিষে দিয়ে চলে গেল।" অন্বেষার এই রসিকতাটা শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো। " দেখ অন্বেষা অনেক..." বাকি কথাগুলো আমার গলায় আটকে গেল। কারণ আমার সামনে এখন যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর সেই অন্বেষা নয় যাকে আমি চিনি। যার সাথে এই কিছুক্ষণ আগেও স্বচ্ছন্দে হেঁটে এসেছি, কথা বলেছি। তার জায়গায় সেখানে এখন একতাল মাংসপিন্ড। তার সারা শরীর বেয়ে অঝরে রক্ত পড়ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন সেই শরীরটাকে মনের সুখে ভারী কিছু দিয়ে পিষে দিয়েছে। আমার হাত পা অবশ হতে শুরু করলো। হৃৎপিণ্ডটা এক মুহুর্তের জন্য যেন থেমে গেল। সেই অচেনা অন্বেষার শরীরটা তখন আস্তে আস্তে শূন্যে ভাসতে শুরু করেছে। কানে এলো এক তীব্র পৈশাচিক হাসি। নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। আমি দিক বিদিক শূন্য হয়ে উল্টো দিকে দৌড়ানো শুরু করলাম। কোন দিকে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কিচ্ছু জানিনা। দৌড়াতে দৌড়াতে শুনতে পেলাম অন্বেষা বলছে," ওরে পালাচ্ছিস কেন! তুইও তো..." বাকিটা শুনতে পাইনি। প্রানপনে ছুটতে ছুটতে সেই পাঁচ মাথার মোড়টার সামনে এসে পৌঁছালাম। রাস্তা ঘাট একদম ফাঁকা। দূরে কোথাও কতকগুলো কুকুর ডেকে উঠলো। মাঝে মাঝে মেইন রাস্তাটা দিয়ে বড় বড় মাল বোঝাই লড়ি ছুটে যাচ্ছে। আমি ফুটপাতের ধারে রেলিংটা ধরে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যেভাবেই হোক আজ বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। হয়তো বাড়িতে গেলেই জানতে পারবো এখানে কি করে এলাম! এই ভেবে আমি রেলিংটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। ফুটপাতের উপর কয়েকজন ভিখিরি শুয়ে আছে। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে সামলে চলতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই আমি আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম। কারণ শরীরের ভিতরে আবার কষ্ট হচ্ছে। আবার মাথার পেছনে, সাড়া শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। সেই যন্ত্রণায় আমি আবার কাতর হয়ে পড়ছি। রেলিংটা ধরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে কোঁকাতে লাগলাম। " বাবু, আপনি ঠিক আছেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?" একটা ফ্যাসফ্যাসে গলা শুনে চমকে সামনের দিকে তাকালাম। দেখলাম একটা হলুদ রঙের অ্যাম্বাসেডর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারই ভেতর থেকে একটি অদ্ভুত মুখমন্ডল বিশিষ্ট লোক আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রথমবারে লোকটির মুখখানি দেখলে ঈষৎ ভয় হয়। মুখটা ভীষণ ভাবে শুকনো। অনেকদিন না খেয়ে থাকলে যেমন হয় কতকটা তেমন। চোখদুটো কোটরের মধ্যে ঢোকানো। গালদুটো ভেঙ্গে ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে। মাথার চুল ও দাড়ি কাঁচা পাকা, সমানভাবে ছাঁটা। বয়স আন্দাজ করা খুব কঠিন। পঞ্চাশও হতে পারে আবার চল্লিশও। যেন মনে হয় কঙ্কালের উপর কেউ বোধহয় চামড়ার প্রলেপ লাগিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ লোকটির মুখখানি এতটাই শীর্ন যে, তার চামড়ার নীচের খুলিটিকে সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু গাড়িটা এলোইবা কোথা থেকে! আমি তো কোনো গাড়ির আওয়াজ শুনিনি! যাইহোক এইসব ভাবার এখন সময় নেই। এরকম একটা পরিস্থিতিতে একটা রিক্সা পেলেও খুব একটা মন্দ হতো না। কিন্তু এটা তো একটা আস্ত অ্যাম্বাসেডর। সেই মুহূর্তে আমার কাছে সেটা হাতে স্বর্গ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই না। তাই ভগবানকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম," হ্যাঁ দাদা, ভীষণ বিপদে পড়েছি। দয়া করে আপনি যদি আমাকে আমার বাড়ি অবধি পৌঁছিয়ে দেন!" লোকটি একবার জিভ কেটে হেসে হেসে বললো," বাবু, এসব আপনি কি বলছেন! দয়া বলবেন না। এটাতো আমার কর্তব্য। আসুন, উঠে পড়ুন গাড়িতে।" আমি" অনেক ধন্যবাদ" বলে কোনো রকমে কষ্টে-সৃষ্টে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে ভিতরে গিয়ে বসলাম। দরজা সজোরে বন্ধ করে নরম গদিটার উপর একটু হেলান দিয়ে বসতেই অনুভব করলাম গাড়ির ভেতরটা ভীষণ ঠান্ডা। মনে হচ্ছে যেন এ. সি. চলছে। কিন্তু আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম গাড়িটার সামনে কোনো এ. সি.-র ব্যবস্থা নেই আর চারদিকের দরজার কাচগুলো নামানো। বাইরেরও এত ঠান্ডা নেই যে, ঠান্ডা হাওয়া গাড়ির ভেতরে ঢুকবে। মনের ভিতরটাতে ভীষণ খচ্ খচ্ করতে লাগলো। কিন্তু সেই সব ভাবার সময় নেই। গাড়ির ভিতর ঠান্ডা না গরম সেই সব চুলোয় যাক। আমার বাড়ি পৌছানোটা খুব জরুরি এই মুহূর্তে। লোকটি বললো," বাবু কোথায় যাবো?"

- সল্টলেক, এ. বি. ব্লক।

"আচ্ছা" বলে লোকটি গাড়ি চালানো শুরু করলো। শান্ত কলকাতার রাতটাকে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো। একটু আগেই ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ঘটনা আমার মন থেকে কখন যেন মুছে গেলো। রাস্তার ধারের ল্যাম্প পোস্টের আলোগুলো আমার মুখের উপর পড়ে পড়ে সরে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে চোখ ভারি হয়ে এলো। ঘুমাবার আগে বেশ কয়েকবার লড়ির পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার আওয়াজও শুনতে পেলাম। কতক্ষন পর জানিনা আমার ঘুম ভাঙ্গল একটা ভয়ানক স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে আবার অন্বেষার সেই ভয়াবহ বিকৃত রূপটাকে দেখতে পেয়েছি। স্বপ্নের মধ্যেও ও সেই একইরকম ভাবে পৈশাচিক হাসি হাসছিলো। চোখ খুলতেই বুঝলাম আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। হাতের তেলো দিয়ে কোনোরকমে কপালটা মুছে পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মনে মনে একটু স্বস্তি বোধ করলাম। কারণ আমি এখন আমার পাড়ায় ঢুকে পড়েছি। সামনে থেকে লোকটি আবার বললো," বাবু, এ. ডি. ব্লক তো এসে গেছে। আপনি কোথায় নামবেন?" আমি ডান হাতের একদম প্রথম আঙ্গুলটি তুলে বেশ উৎফুল্লতার সাথেই বললাম," ওই যে সামনে, বা দিকে গলিটা ঢুকছে, ওই গলি দিয়ে ঢুকে একদম শেষের বাড়িটা।" আমার দেওয়া নির্দেশ মতো লোকটিও গাড়ি নিয়ে গলিতে ঢুকে এগোতে লাগলো। বাড়ির সামনে আসতেই মনটা ভীষন ভাবে নেচে উঠতে চাইলো। মনে হচ্ছে যেন কতো বছর পর বাড়িতে ফিরলাম। আমি লোকটিকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে যখন ভাড়ার কথা বললাম, লোকটি বেশ অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো," না বাবু, আমি আপনার কাছ থেকে পয়সা নিতে পারবোনা।" আমি অবাক হয়ে বললাম," কেন? পয়সা নেবেন না কেন? আপনি এতটা পথ আমায় নিয়ে এলেন!"

- না বাবু, আমরা সবাই এক। আপনার বিপদে পাশে থাকতে পেরেছি, আপনাকে ঠিক ঠাক করে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পেরেছি- ব্যস এইটুকুই যথেষ্ট আমার কাছে।" লোকটির কথাগুলি বেশ অবাক করে দিলো আমায়। আমি তারপরেও অনেকবার ভাড়ার জন্য জোরাজুরি করেছিলাম কিন্তু সে না নেওয়ায় তাকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। এতক্ষণে খেয়াল করিনি, দেখলাম আমার বাড়ির গেটের সামনে বেশ অনেক লোক জমা হয়েছে। ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ কোলাহলও শোনা যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিছুটা এগোতেই সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে অবনী জ্যেঠুকে দেখতে পেলাম, আমাদের প্রতিবেশী। আমি বেশ কৌতূহলী হয়েই অবনী জ্যেঠুকে প্রশ্ন করলাম," জ্যেঠু কি হয়েছে বলোতো? আমাদের বাড়ির সামনে এতো ভিড় কেন?" অবনী জ্যেঠু আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রশ্নটা আমি বেশ জোরেই করেছিলাম কিন্তু জ্যেঠু কোনোরকম উত্তর দিলোনা। সেই একই রকম ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি আবারও প্রশ্ন করলাম," ও অবনী জ্যেঠু, কি হয়েছে বলবে তো?" এইবারও অবনী জ্যেঠু নির্বিকার। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো দুরস্ত আমার দিকে ফিরেও তাকালোনা পর্যন্ত। মনে হলো তিনি বোধহয় আমাকে শুনতেই পাননি। আমার ভীষণ রাগ হতে লাগল। এবার আমি তাঁর গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেলাম। তবে এবার কিন্তু আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো। আমার সারা শরীর উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। আমার মনে এক অজানা আশঙ্কা ভিড় করে আসলো। কারণ আমি স্পষ্ট দেখলাম যে, আমি অবনী জ্যেঠুকে ছুঁতে গেলাম ঠিকই কিন্তু ছুঁতে পারলাম না। আমার হাত যেন তাঁর শরীর ভেদ করে শূন্যে চালিত হলো। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না এসব কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে! আমি আবারও চেষ্টা করলাম। অনেকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনোবারই অবনী জ্যেঠুকে ছুঁতে পারলাম না। আমার চোখ ঠিকরে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইলো‌। আমি দিশাহীন হয়ে ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঘরের মধ্যে প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তাদের উপস্থিতি আমার গতিকে রোধ করতে পারলোনা। আমি যেন হাওয়ার মতো তাদের সকলকে ভেদ করে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমার বাড়ির বসবার ঘরেটাতে এসে দেখি মা তারস্বরে কাঁদছে। কাকিমাও মায়ের পাশাপাশি বসে মাকে ধরে কাঁদছে। বাবাকে দেখলাম ঘরের একটা কোনায় হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে আর কাকু বাবার কাঁধে একটা হাত রেখে কি যেন বলছে। কাকুর চোখেও জল। মা-কাকিমার কান্নার কারণ আমি বুঝতে পারলাম না। আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছিলো না। আমি ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। " মা কি হয়েছে" বলে মায়ের কাঁধে হাত রাখতে গেলাম কিন্তু অবনী জ্যেঠুর মতোই মাকেও আমি ছুঁতে পারলাম না। মা, কাকিমা, বাবা, কাকু এমনকি ঘরে উপস্থিত কেউই আমাকে লক্ষ্য করলোনা। আমি থম মেরে বসে পড়লাম। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এমন সময় একটা টান অনুভব করলাম। কেউ একজন পিছন থেকে আমার জামাটা ধরে টানছে। আমি সচকিত ভাবে পিছন ফিরতেই দেখি, মুন্নী! মুন্নী আমার ছোট বোন। মুন্নীকে দেখে আমার দুচোখ কান্নায় ভরে উঠলো। হয়তো এই কারণেই যে, এতগুলো লোকের মাঝখানে একমাত্র ওই আমাকে দেখতে পাচ্ছে। দেখলাম ও আমার দিকে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। ওর সেই চাহনীতে যেন একটা অভিমানি বোধ রয়েছে। আমি মুন্নীকে আনন্দে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিন্তু পরমুহুর্তেই ভয়ে গাটা শিউরে উঠলো। আমি পিছিয়ে এলাম সঙ্গে সঙ্গে। এটা কি করে সম্ভব! না এ হতে পারে না। তুই এখানে কি করে আসলি? তুইতো... মুন্নীর যখন দশ বছর বয়স তখন ওর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলো। অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখিয়েছিলো, এমনকি বাইরেও নিয়ে গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ওকে বাঁচানো যায়নি। মুন্নী আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো," দাদা, শেষমেশ তুইও মা-বাবাকে ছেড়ে দিলি! ভেবে দেখলিনা এবার মা-বাবার কি হবে!"

" আমি ছেড়ে দিলাম মানে...!" হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার সবকিছু মনে পড়ে যেতে লাগল। মনে পড়তে লাগলো কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার কথা। বিকেলবেলা আমার এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল... জন্মদিনের নিমন্ত্রণ। বেশিদূর না এই শোভাবাজারে। আমি যথারীতি আমার মোটর সাইকেলটা নিয়ে যাই। বন্ধুর জন্মদিন বলে কথা, তাই প্রয়োজনের থেকে একটু অতিরিক্ত মাদক সেবন করে ফেলেছিলাম। সন্ধ্যা-রাত অবধি পার্টি চলার পর যখন আমি ফিরতে যাচ্ছিলাম তখন বাকি বন্ধুরা অনেকবার বারণ করেছিল এই অবস্থায় বেড়োতে। কিন্তু আমি শুনিনি। " ও কিছু হবে না" বলে একপ্রকার জোর করেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম। গঙ্গার ধারের রাস্তাটা দিয়ে তাড়াতাড়ি হবে বলে মোটর সাইকেলটা চালিয়ে আসছিলাম। নেশাগ্রস্ত হলেও বেশ সজাগ হয়েই গাড়িটা চালাচ্ছিলাম। এতক্ষণ সব ঠিকই ছিল। তবে বিপত্তিটা বাঁধল শোভাবাজার রেল স্টেশনটা ক্রশ করতেই। রেল স্টেশনটা ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ করে একটা কোথা থেকে কালো বিড়াল দৌড়ে আমার মোটর সাইকেলের চাকার সামনে চলে আসে। আমি বিড়ালটাকে দেখে বেশ দক্ষতার সাথেই কোনোরকমে মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেলটা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিই। কিন্তু বুঝলাম যে, আমার এতদিনের সঞ্চিত দক্ষতা সেক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও আমি টাল সামলাতে পারলাম না। সামনেই একটা ল্যাম্প পোস্টে গিয়ে মারলাম সজোরে ধাক্কা। ছিটকে পড়লাম রাস্তার উপরে। মাথায় একটা তীব্র চোট অনুভব করলাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। ঘটনাটা মনে পড়তেই আমার ভীষণ হাসি পেয়ে গেলো। একা একাই হাসতে লাগলাম। কতক্ষন হেসেছিলাম জানিনা, যখন বাইরে এলাম দেখলাম তখনও ওই হলুদ অ্যাম্বাসেডরটা আমার গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাও গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি আর ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি তার সামনে যেতেই লোকটি নড়ে চড়ে বললো," বলুন বাবু, এখন কোথায় যাবেন?" আমি একটু হেসে বললাম," শোভাবাজার গঙ্গার ঘাট।"

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract