Ajobdeep Bromho

Horror Tragedy Thriller

3  

Ajobdeep Bromho

Horror Tragedy Thriller

দড়ি

দড়ি

58 mins
396



(১)


দরজার বাইরে তখন থেকে প্রচন্ড কোলাহল হচ্ছে। প্রায় পাড়াসুদ্ধ লোক এসে জড়ো হয়েছে সেখানে। প্রত্যেকের কন্ঠস্বরেই উদ্বেগ। কেউ কেউ "ওরে কেউ দরজাটা ভাঙ্গ" বলে চেঁচাচ্ছে। আবার কেউ কেউ "কি সর্বনাশ হয়ে গেল" বলে চিৎকার করে উঠছে। পাড়ার পুরুষ মানুষেরা থেকে থেকে বলপূর্বক দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। ভেতরে পামেলা নিশ্চুপ। একবার কান পেতে শুনল তার ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মা বুক ফাটিয়ে কাঁদছে আর বলছে, আমার মেয়েটাকে কেও বাঁচাও গো! ওরে মারে শোন! এরকম করিসনে!


আরেকবার শুনল তার অনূর্ধ্ব দশ বছর বয়সী মেয়েটির কান্না। সেও মা মা বলে ডাকছে তাকে। বিছানার উপর রাখা মোবাইলটা আরও একবার বেজে উঠল। সে কর্ণপাত করল না। তার বোন, তার পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে। আচমকা সে অনুভব করল দরজায় ধাক্কাটা বেশ জোড়ে জোড়েই পড়ছে। সর্বনাশ! আর বেশি দেরি করলে এক্ষুনি ওরা দরজাটা ভেঙে ফেলবে। আর একবার ওরা ঢুকে পড়লে তাহলে তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। না না এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। প্রথম প্রথম একটু ভঁয় করছিল তার। মন খারাপ লাগছিল তার আপনজনদের জন্য। সেই আপনজন যারা তার মূল্যই বোঝে না। কিন্তু এখন সে মনস্থির করে ফেলেছে। সিলিং-এ ঝুলতে থাকা দড়িটিকে কম্পমান হাতে ধীরে ধীরে ধরে নিল। ইতিমধ্যে জানালার ধারেও বেশ কয়েকজন এসে জমায়েত করে ধাক্কা দিতে দিচ্ছে। "পামেলা! এই পামেলা! দরজাটা খোল! কিরে!"


ত্রস্ত চোখে সে দেখল দুর্ভেদ্য কাঁচের আড়ালে মানুষগুলির অবয়ব অশরীরীদের মতনই নড়া চড়া করছে। এদিকে ক্রমবর্ধমান দরজার ধাক্কা। সে একটা কাষ্ঠ ঢোক গিলে নিয়ে দড়ির ফাঁসটা সদ্য গলায় গলাতে যাচ্ছে এমন সময় কে একজন জানালার কাঁচটা ভেঙে ফেলল। ভেতরের ওইরূপ ভয়ার্ত দৃশ্য উন্মোচিত হতেই একজন মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন। পামেলাও ঘাবড়ে গিয়ে পায়ের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেই নীচের প্লাস্টিক টুলটি মেঝেতে উল্টে গেল। নিমেষের মধ্যে ঝুলে পড়ল সে। ফাঁসের বৃহৎ বৃত্ত সংকুচিত হয়ে গিয়ে চেপে ধরল তার গলা। ছটফট করতে লাগল সে। উন্মাদের মতন শূন্যে ঠাঁই খুঁজতে লাগল। দু হাত দিয়ে গলার ফাঁসটিকে ধিলা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যদি একটা শেষ রক্ষা করা যায়। ততক্ষণে হৈ হৈ রব চারিদিকে মহামারীর মতন ছড়িয়ে পড়েছে। ধাক্কার বেগও দরজায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছিটকিনির স্ক্রগুলি অনেকটা আলগা হয়ে এসেছে। পামেলা বুঝতে পারছে তার আর সময় নেই। চোখে মুখে ঝাপসা দেখছে সে। আর কয়েক মূহুর্ত ব্যস! তারপরেই তার পরিকল্পনা সার্থকতা পাবে। বন্ধ হবে মৃত্যুর প্রমাদ গোনা। এই আরেকটু খানি।


আচমকা একটা 'ধরাম' শব্দে দরজাটা ভেঙে পড়ে গেল। একজন স্বাস্থ্যবান জোয়ান দৌড়ে এসে পামেলা পা দুটি উঁচিয়ে ধরতেই সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন পুরুষ এসে হাতে হাত লাগাল। একজন তাড়াতাড়ি উল্টান টুলটিকে সোজা করে তার উপর দাঁড়িয়ে দ্রুত দড়িটিকে গলা থেকে আলগা করে দিল। জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলতে লাগল সে। তারপরেই অজ্ঞান।


(২)


সুন্দর, সুশ্রী। এ যুগের স্বাধীনচেতা আধুনিক নারী পামেলা। পেশাগত দিক থেকে সে যেমন অতি দক্ষ একজন নৃত্য শিক্ষিকা, তেমনই বাড়িতেও একজন অতি নিপুণ গৃহকর্ত্রী। গৃহকর্ত্রী এই কারণেই যেহেতু তার উপার্জিত অর্থই তাদের সংসারের মূল রসদ। তার মা, মেয়ে আর স্বামীর ভোগ বিলাসিতা করবার একমাত্র ইন্ধন। তবে স্বামী কিন্তু একেবারেই বেকার নয়। সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে যা দু পয়সা আয় করে তা দিয়ে তাদের খরচবহুল সংসারের এক কোনাও ভরাতে পারে না। তাতেও কিন্তু কোন বিরূপতা নেই। পরিবারের সকলেই পামেলার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। যদিও এতটা মসৃণ জীবন পামেলার ছিল না। জন্মের পর প্রথম চোখ খুলেতেই সে আর তার কয়েক মিনিটের ব্যবধানে হওয়া বোন যে অনটনকে প্রত্যক্ষ করেছিল তাই ছিল তাদের নিত্য দোসর। 


স্বল্প বেতনভুক্ত পামেলার বাবা দুই পিঠাপিঠি মেয়ে হওয়ার ক্ষোভে সেই যে তার স্ত্রীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, সেই যে সংসারের প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন, তারপরে আর কোনদিনও সেভাবে আর মনোনিবেশ করেননি। ছেলে না হওয়ায় দুঃখেই হয়ত করতে পারেননি। পরস্ত্রী নিয়েই বাকি যৌবনটা অতিবাহিত করে দিয়েছেন। তাতেও কিন্তু পামেলার মা অর্থাৎ মিতালী দেবী তার দুই কন্যা সন্তানের নয়, নিজের অদৃষ্টকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। চোখ ভিজেছে অনেক। এমনকি স্বামীর দেওয়া শ্রেষ্ঠ আঘাতগুলিও সে পিঠ পেতে নিয়েছে। যাওয়ার জায়গা ছিল না কোথাও। তাই মাটির দলার মতনই পড়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। অসহায়। তবুও নির্বিকার ভালবেসেছেন মেয়ে দুটিকে। প্রতিপালন করেছেন অদম্য জেদকে পাথেয় করে। দিনের পর দিন চোখের মাথা খেয়ে হেম করেছেন। মেয়ে দুটো স্কুলে ভর্তি হল। শরীর বাড়তে লাগল। পামেলার অনেক শখ ছিল সে নাচ শিখবে। একবার ইতস্তত করেও সেই শখ জানিয়েও ছিল তার মাকে।

শখ পূরণও হল তার। নাচের ক্লাসে ভর্তি হল সে। শিখে আসা হাত পায়ের ভঙ্গি সে তার ছোট বোন প্রমিলাকেও শেখাতে লাগল। তবে তাদের কার্যকলাপ কিন্তু তাদের বাবার কাছে ছিল চক্ষুশূল। আদিক্ষেতা বলে গালমন্দও কম করেননি তিনি। তবুও থেমে থাকেনি পামেলার শিক্ষণ। ধীরে ধীরে তার পরিধি বাড়তে আরম্ভ করল। মঞ্চে মঞ্চে প্রস্ফুটিত হতে লাগল দুই বোনের প্রতিভা। করতালিও অনেক সঞ্চিত হল। পাশাপাশি অর্থও। ঘটনার বারংবার পুনরাবৃত্তিতে তাদের বাবার চোখ হয়ে উঠল লালায়িত। ভাগ বসাতে আরম্ভ করল তাদের উপার্জিত অর্থে।

তখন তারা সবে ক্লাস এইটে উঠেছে। তাদের বাবা কোন এক দূর সম্পর্কের দাদার সাথে শলা পরামর্শ করে দুই মেয়েকে বেনারসে পাঠাবার বন্দোবস্ত করলেন। কারণ সেখানে নাকি বিস্তর টাকা ওরে। 


এই প্রস্তাবে মিতালী দেবী ঘোর অসন্তোষ প্রকাশ করলেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। চলে গেলেন দুই মেয়েকে নিয়ে বেনারসে। পড়াশুনার ল্যাটাও চিরকালের মতন চুকিয়ে গেল। রমরমিয়ে চলল পামেলা আর প্রমিলার নৃত্য বিক্রয়। টাকাও আসল প্রচুর।

চোরাবালিতে যেমন ধীরে ধীরে ধসে যায় মানুষ, তেমনই পামেলাও তলিয়ে যেতে লাগল। তার একটি বিশেষ কারণ ছিল প্রমিলার চাইতে অধিক রূপ আর গুন। কয়েক বছরেই নৃত্য বিক্রয় ক্রমেই হয়ে উঠল দেহ বিক্রয়ের কারখানা। মিতালী দেবী আঁচ পেতেই সেই জঞ্জাল থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য প্রবল উতলা হয়ে উঠেছিলেন। সহজ ছিল না। তবে কি করে তা সম্ভব হল সে ইতিহাস আলাদা।


ফের কলকাতায় ফিরে পামেলা একটি নাচের স্কুল খুলল। প্রমিলাকেও সংযুক্ত করল সেখানে। বাবা প্রথমে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। পরে শয্যাশায়ী হয়ে ছেড়ে চলেও গেলেন। প্রমিলার মনও বেশিদিন টিকল না। পালিয়ে বিয়ে করে নিল সে। পামেলা একা মাকে নিয়েই পড়ে রইল।

ধীরে ধীরে সে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাও ক্রমেই বৃদ্ধি পেল অনেক। এখন অনেক ব্যস্ত থাকে সে।


শত ব্যস্ততার মাঝেও তার নিঃসঙ্গতা কিন্তু চোখ এড়ায়নি তার মায়ের। মিতালী দেবী বহুবার বিয়ে করে নেবার প্রস্তাব দিয়েছেন তাকে। কিন্তু প্রত্যেকবারই পামেলা "তোমায় একলা ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারব না" বলে প্রত্যাখান করে দিয়েছে। চিন্তিত মিতালী দেবী তৃতীয় পথ খুঁজতে লাগলেন এবং আকস্মিক তা আপনা হতেই পেয়ে গেলেন। পাড়ারই ছেলে রমিতের সঙ্গে পামেলার হঠাৎ সখ্যতা তৈরী হল। সখ্যতা থেকে প্রেম। প্রেম থেকে কথা বিয়ে পর্যন্তও গড়াল। মিতালী দেবী এই ভেবেই নিশ্চিন্ত হলেন যে, মেয়ে চোখের সামনেই থাকবে। তদ্রুপ নিশ্চিন্ত পামেলাও হল। তবে শ্বশুরবাড়ির সুখ বেশীদিন ভোগ হল না তার। নির্যাতিতা পামেলা ছয় মাসের পোয়াতি অবস্থাতেই নিজের বাড়িতে এসে উঠল। সাথে রমিতও। পাড়ারই ছেলে। কাজেই ঘর জামাই নামক টিটকারিটি শুনতে হয়নি তাকে।


চার মাস পর পামেলার মেয়ে হল। বাড়িতেও এল উত্তাল আনন্দ। তবে মুদ্রারও ওপিঠ থাকে। ঘড়ির কাঁটার টানে যখন এক এক করে ক্যালেন্ডারের অনেকগুলি পাতা উলটে গেল, তখনই উন্মোচন হল এক নব্য বিষয়ের। রমিতের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। পামেলা বাড়ির কর্ত্রী হওয়ার দরুণ তার উপর হয়ত রমিত পুরুষতান্ত্রিক অধিকার ফলাতে পারেনি। তবুও সে মানসিক দিক থেকে বিবশ হয়ে পড়েছিল। সবকিছুর উর্ধ্বে একজন নারী হয়ে তার স্বামীর অধিকার অন্যজনে কক্ষিগত করবে তা সে মানতে পারেনি। ভ্রান্ত পামেলা বিবাহ বিচ্ছেদের মতন সহজ উপায়টিকে খারিজ করে দিয়ে সে কঠিন পথটাই বেছে নিয়ে ছিল।


(৩)


পাথরের মতন ঘুমিয়ে রয়েছে পামেলা। প্রথম দেখায় মৃত মনে হলেও নাভির উঠা নামায় আশ্বস্ত হওয়া যায়। গলার কাছটায় কালসিটে দাগ পড়ে গিয়েছে। নাড়ীর গতি ম্রিয়মান। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছে। সামন্য কিছু ওষুধের পাশাপাশি নিদান দিয়ে গিয়েছে সম্পূর্ণ রেস্টে থাকবার।

আশপাশের কয়েকজন এখনও মূর্তির মতন দন্ডায়মান। উদ্বেগের ছাপ সকলেরই মুখে। মিতালী দেবী পামেলার মাথার কাছেই খাটের একটি পায়ার উপর শোকগ্রস্ত স্থানু হয়ে রয়েছেন। নাতনি নিশা দিদুনের কোলে শায়িত। মুখ বিষন্নতায় ভরা। সে হয়ত পুরোপুরি অবগত নয় তবে তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এইটুকু বুঝতে পারছে তার মা গম্ভীর কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছে। তবে নিশার তৎপরতাতেই কিন্তু পামেলা এখনও জীবিত। সময় মতন সে চিৎকার করেছিল ভাগ্যিস! রমিতের কাছে খবর চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। হয়ত আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এসে পড়বে।

নিশা ক্রন্দানাচ্ছন্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, দিদুন! মায়ের কি হয়েছে? শুয়ে আছে কেন?

প্রশ্নটি বোধহয় মিতালী দেবী শুনতে পাননি। তাই জবাবও এল না। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, মায়ের শরীর একটু খারাপ করেছে বাবা!

মা কি আর সুস্থ হবেনা? বিবশ ভাবে প্রশ্ন করল নিশা।

নিশ্চয়ই হবে। ডাক্তার জেঠু এসে ওষুধগুলো লিখে দিয়ে গেলেন। সেগুলো খেলেই আবার মা সুস্থ হয়ে উঠবে।

নিশা দিদুনের কোলে আবার মুখ গুঁজল। মিতালী দেবী আবার কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, কেঁদোনা পামেলার মা। তুমি ভেঙে পড়লে কি করে চলবে বলতো?

আমার মেয়েটা যে এমন কেন করল?

আচমকাই ঘরে একটা মৃদু হৈহৈ রব খেলে গেল। পামেলা চোখ মেলেছে। দৃষ্টিতে এখনও ভীষণ প্রছন্ন ভাব। একটানা বৃষ্টির পর রোদ উঠলে আকাশ যেমন ঝলমলিয়ে ওঠে। মিতালী দেবীও অনুরূপ চাউনিতে পামেলার দিকে চাইল। সকলের চিন্তা মিশ্রিত দৃষ্টি পামেলার উপরেই নিবন্ধ।

মিতালী দেবী একরাশ জমাট উৎসাহ নিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, মারে! কেমন লাগছে এখন? কষ্ট হচ্ছে মা?

পামেলা মৃদু ঘাড় নাড়াল।

নিশা তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা! তোমার কি হয়েছে মা?

পামেলা একফালি হাসি টেনে নিশার গায়ে আড়ষ্ট ভাবে হাত রাখল।

মিতালী দেবী জিজ্ঞেস করলেন, মা! তুই এমন করলি কেন? কোন সমস্যা হলে তুই আমায় বলতে পারতিস।

আহঃ! এই কথাগুলো এখন থাক না পামেলার মা! পূর্বেকার ভদ্রমহিলা তাঁকে বাঁধা দিলেন। এতবড় একটা ধকল কাটিয়ে সবে উঠল বেচারী। ওকে একটু আরাম করতে দাও।

মিতালী দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘাড় দোলালেন। এমন সময় রমিতও ঘরে ঢুকল। পরনে ফরমাল পোশাক। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। পামেলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি করে হল এসব?

রমিতের গলার আওয়াজ পেতেই পামেলার গাঁ শিরশির করে উঠল। একবার শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে দৃকপাত করেই প্রবল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। রমিতের প্রশ্নটি মুক্ত। নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে নয়। তাই পূর্বেকার ভদ্রমহিলাই জবাব দিলেন।

ওসব থাক রমিত। এখন একটু বউয়ের প্রতি মনযোগী হও। যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে।

রমিত ধীরে ধীরে পামেলার পায়ের কাছটায় বসে পড়ল। পামেলা আরও তাচ্ছিল্য ভরে তার আড়ষ্ট পাটা সরিয়ে নিল। কষ্ট হল ভীষণ। একটি প্রস্তর খন্ডকে সরিয়ে ফেলার মতন কষ্ট। নিশা সহসা বাবার দিকে ঝুঁকে পড়ল। নিষ্কম্প হাত রাখল তার গায়ে। মিতালী দেবী রূঢ় নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। রমিতের সাহসে কুলায়নি বলেই হয়ত সে আর তার স্ত্রী এবং শ্বাশুড়ীর দিকে চোখ ফেরায়নি। তার কর্মকাণ্ডই যে দায়ী, সে খবর সর্বজনবিদিত।

একে একে সকলেই যার যার বাড়ি ফিরে গিয়েছে। ঘরটা ক্রমেই শূন্য হয়ে গিয়েছে। সবশেষে পূর্বেকার ভদ্রমহিলা তাদের সকলকে আবারও পামেলার খেয়াল রাখবার অনুরোধ জানিয়ে চলে গেলেন। দিনটা কেটে গেল একদম নিশ্চুপ।


পামেলা অনেকটাই সুস্থ এখন। পথ্য, ঔষধ সবেতেই দারুন কাজ দিয়েছে। বিশেষ করে মিতালী দেবীর শুশ্রূষা। তবে রমিতের খেয়ালের এতটুকু প্রয়োজন পড়েনি তার। সেদিনের পর রমিতকে সে আলাদা করে দিয়েছে। বেছে নিয়েছে একদম সহজ পথ যা সে প্রথমে নির্বোধের মতন এড়িয়ে গিয়েছিল। বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে রমিতকে। বেশ সুখীই থাকে আজকাল পামেলা। কারণ আজকাল তো আর নিঃসঙ্গ নয়। মেয়ে নিশাই এখন তার বেঁচে থাকবার সম্বল। অকাতর‌ স্নেহ দিয়ে জর্জরিত করবে তাকে। উপরন্তু মিতালী দেবী তো এখন আছেন। বাস্তবিকই তাই ঘটে চলল। দীর্ঘদিনের বিরামের পর পামেলা আবার নাচের ক্লাস জয়েন করল।


(৪)


জোরকদমেই চলছে পামেলার নৃত্য শিক্ষণ। আগের থেকে ব্যস্তও অনেক। তবুও যথা সম্ভব সময় দিচ্ছে মেয়েকে। বাকি তার অবর্তমানে দিদুনই সযত্নে দেখভাল করছে নিশার। অবান্তর কোন মানসিক চিন্তা নেই। নাই আছে কোন গ্লানি। স্বামী না থাক। অনেকেই তো অকৃতদার জীবন যাপন করে। সেক্ষেত্রে?

আসলে একা থাকাটা কোন কষ্টেরই নয়। বিয়ের আগেও তো সে একাই ছিল। তখন তো কোনও কষ্ট হয়নি তার। বরং বিয়ের পরেই অনেক মানসিক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে তাকে। সেই যন্ত্রনার চাইতে এই একাকিত্ব ঢেড় ভাল। যৌনতা নেই তবে মননে শান্তির অধিক স্খলন রয়েছে। রয়েছে অবারিত সুখ। যৌনতা অন্যপন্থা দ্বারাও নিবৃত্ত হয়।

সোস্যাল মিডিয়া তথা জীবন থেকে রমিতকে উড়িয়ে দিলেও মনের গোচরে নিঃশেষিত স্থান এখনও রয়ে গিয়েছে তার জন্যে। খুবই মলীন এবং আবছা। সামান্য কিছু স্মৃতির ক্ষরণ হলেও প্রশ্রয় নেই একটুও।


নাচের ক্লাসের পরিসমাপ্তির পর পামেলা ওয়াসরুমে ঢুকে চোখে মুখে ক্লান্তির উপর কয়েক পরত জলের ঝাপটা মেরে বেসিনের আয়নার সামনে স্থির হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নিজের চেহারার উপর চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। স্বাভাবিকই দেখাচ্ছে তাকে। সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানি এখনও শ্রীহীন হয়ে পড়েনি। ঝটপট পোষাক পাল্টে নিয়ে পিঙ্গল স্কার্ফটা গলার কাছে ঝোলাতেই খানিক থমকে যেতে হল তাকে। গলার ক্ষীণ কালসিটে দাগটা আচমকাই দগদগে দেখাচ্ছে ভীষণ। সময়ের অবদমনে দাগটা মলীন হয়েছে অনেকটাই। তবু পুরোপুরি বিলীন নয়। দাগের উপর কয়েক মূহুর্ত আঙ্গুল বুলিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ঠিক এইখানটাতেই মনে হয় কেউ বোধহয় তার গলা চেপে ধরেছে। সে উন্মত্তের মতন আঁতকে ওঠে। শ্বাসরুদ্ধ। দুর্নিবার গতিতে সেই অদৃশ্য হাত দুটিকে ছাড়াবার চেষ্টা করে প্রানপন। দুঃস্বপ্নের মতই লাগে ব্যাপারটা। স্বপ্ন বলেই হয়ত বিশেষ পাত্তা দেয় না।

পামেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্কার্ফটা পেঁচিয়ে নেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে।


এক বর্ষা মুখরিত সন্ধ্যায় পামেলা চাঁদপাড়া বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতন বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। একটাই বাস এ পথে চলাচল করে যা বারাসত অবধি যায়। তাও অনেকটা সময়ের ব্যবধানে চলে। বৃষ্টির দাপটে দিগ্বিদিক জনশূন্য। খালি সামনের চায়ের দোকানের লাইটা টিমটিম করে জ্বলছে। তাও দোকানের একটা ঝাঁপ বর্ষার জলকে প্রতিহত করবার জন্য নামিয়ে রেখে দোকানী অলস ভাবে রেডিও শুনছে। বিকেল থেকেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে বলেই আজ খদ্দের জোটেনি। পামেলাও এতক্ষণ নিঃসঙ্গ ছিল। কোথার থেকে একটা নেড়ী কুকুর কাক স্নান হয়ে স্ট্যান্ডের এসে দাঁড়াল। সবেগে গা ঝাড়া দিয়ে কয়েক মূহুর্ত পামেলাকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর একটা কোনে গুটিসুটি মেরে সুয়ে পড়ল। পামেলা আড় চোখে দেখল কুকুরটা মৃদু কাঁপছে। তারও হাল্কা হাল্কা শীত করছে। ছাতার জন্য মাথাটা রক্ষা পেলেও গা হাত পা একদম ভিজে জবজবে। একবার অতিষ্ঠ হয়ে মোবাইল টিপে সময়টা দেখে নিল। প্রায় সাড়ে সাতটা। অধৈর্য এবং বিরক্তি উভয় যেন তার মমনে প্রতিভাত হচ্ছে। এতক্ষণে তো বাস এসে যাওয়ার কথা! আসছে না কেন? বর্ষার জন্য কি? একবার মনে করল সে দোকানটাতে গিয়ে এক কাপ চা খেতে খেতে বাসের খোঁজ নেবে। একেই অনেকটা ভিজে গিয়ে সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। তাই আর ভিজতে ইচ্ছে হল না তার। বাস যখন আসে আসুক! একরকম দূরছাই করে জরাজীর্ণ স্টিলের বেঞ্চটাতে বসে চোখ বুজল।


আচমকা একটা হাঁচির শব্দে চটকা ভাঙ্গলো পামেলার। ধরফর করে উঠে চোখ মেলতেই দেখল বৃষ্টির বৈভব কিঞ্চিত হ্রাস পেয়েছে। সামনের চায়ের দোকান থেকে বেশ গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বোধহয় বৃষ্টি কমতে খদ্দের জুটেছে জনাকয়েক। পামেলা উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে উসখুস করল খানিক। আচম্ভিতেই গভীর আশঙ্কা ঘনীভূত হল তার মনে। বর্ষাতে বাস বিভ্রাট হয়নি তো? বড্ড অস্থির লাগছে বুকের ভেতর। একবার সামনের দোকানটিতে জিজ্ঞাসা করে আসা দরকার। এই ভেবে সে প্রস্তুত হচ্ছে, ছাতা খুলবার উপক্রম করছে, এমন সময় তার দু চোখ বাস স্ট্যান্ডের একদম কোনায় গিয়ে আটকে গেল। একজন যুবক হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে গালে হাত ঠেকিয়ে বসে রয়েছে। মুখ অন্যদিকে। স্ট্যান্ডের দীপ্তিমান শুভ্র আলো খুব জোড়াল না হলেও তার সীমিত প্রকাশেই যুবকটিকে স্পষ্ট দেখতে পারছিল পামেলা। ট্রাউজার এবং টি-শার্টে শহুরে বলেই বোধ হয়। মুখখানা দাড়িহীন মসৃণ। লম্বাটে গোছের। চোখ বোজার আগে অবধিও ওখানে একটা নেড়ী কুকুর শুয়েছিল। তার মাঝে কুকুরটা কখন গেল আর এই ছেলেটিই বা কখন এল তা সে একেবারেই বুঝতে পারেনি। বোধহয় ঘুমটা অনাহুতই চলে এসেছিল। যুবকটিকে দেখে পামেলা একটু আশ্বস্ত হল। ভাবল সেও বোধহয় তারই মতন অপেক্ষমান যাত্রী। ছাতাটিকে হাতে ধরেই পামেলা কিঞ্চিৎ এগিয়ে গেল। সসঙ্কোচে জিজ্ঞেস করল, বলছি দাদা বাসের খবর কিছু বলতে পারেন? আসলে অনেকক্ষণ হল অপেক্ষা করছি।

যুবকটি বোধহয় অন্যমনস্ক ছিল। ধাতস্থ হয়ে নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ! কিছু বলছিলেন?

পামেলা খানিক অপ্রতিভ হেঁসে প্রশ্নটা আবার করল।

যুবকটি আক্ষেপ সহকারে বলল, হ্যাঁ চলছে তো। এইতো কিছুক্ষণ আগেই একটা বাস বেড়িয়ে গেল। একটুর জন্য ধরতে পারলাম না। কত জোরে দৌড় লাগালাম! এমনকি গলা ফাটিয়ে চিৎকারও করলাম। কিন্তু কালার মরণ কন্ডাকটর শুনতেই পেল না। যাচ্ছে তাই!

যুবকটির কথায় পামেলার হাসি পেয়ে গেল। ফিচ করে একটু মুখ টিপে হেসে দিয়ে নিজেকে সংবরণ করে নিল সে।

তা আপনি ধরলেন না কেন? যুবকটি প্রশ্ন করল। বাসটা তো আপনার নাকের ডগা দিয়েই গেল।

পামেলা খানিক হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বোধহয় আপনার মতন আমারও দূর্ভাগ্যযোগ চলছে।

বলে বসে পড়ল সে। তারপর বলল, কি কুক্ষণে যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!

হো হো করে হেসে উঠে যুবক। বলে, তা মন্দ বলেননি। দেখলামই তো কেমন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন।

নাক ডাকছিলাম বুঝি!

লজ্জায় মাথা নত করে নেয় সে।

যুবকটি তার মনের ভাব আঁচ করতে পেরে বলে, এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। আমিও ডাকি। ইতস্তত করার তো কিছু নেই!

তাও!

পামেলা অধোবদনেই তার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে একটা ফোন করে বাড়িতে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে, হ্যালো! কে মাম্মাম?... এই তো মা আসছি... তুমি পড়তে বসেছ?... দিদুনকে কিন্তু একদম জ্বালাতন করবে না! ঠিকাছে?... দিদুন পাশে আছে?... মোবাইলটা দাও একটু... হ্যাঁ মা! বলছি বাস একটু কম চলছে তাই আসতে একটু দেরি হয়ে যাবে... আরে বাবা চিন্তা করো না। চলে আসব।... হ্যাঁ... এটাই জানাতে ফোন করেছিলাম... আচ্ছা ঠিকাছে। ওদিকে বৃষ্টি হচ্ছে?... বল কি! এখানে তো মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। এই এখন একটু ধরেছে।... হুম ঠিকাছে। চলে আসব আমি। রাখছি।

মোবাইলটা ফের ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে বলল, আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে!

ধৈর্য ধরুন এসে পড়বে বাস। যুবক তাকে আশ্বস্ত করে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, একটু দেরি হলেই বাড়ির লোক কেমন দুশ্চিন্তা করে তাই না!

হ্যাঁ তা করে। আমার মেয়ে তো আমায় চোখে হারায়।

মৃদু হাসে যুবক। বলে, আপনার মেয়ে! তাহলে খুব ছোটই হবে!

খুব ছোট নয় তা বলে। দশ বছর হতে চলল।

আবার কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্য।

যুবক বলে, বলাটা বোধহয় অনুচিত। তাও ঈশ্বরের প্রতি অনেক ধন্যবাদ যে, আপনি আগের বাসটা মিস করেছেন।

কেন? পামেলা ভ্রুকুটি করে তাকায়।

যুবক ইতস্তত করে বলে, ইয়ে আগেই বলেছি যে অনুচিত। তাও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে বাসটা মিস না করলে তো আর আপনি এখানে থাকতেন না। কার্যত আপনার সঙ্গে দেখাও হত না। ফলে বোবার মতন আমাকে এখানে বসে থাকতে হতো। কি অসহনীয় হত যে ব্যাপারটা!

পামেলা ঈষৎ হাসে। কার্যত এই কথায় তার রেগে যাওয়াটাই উচিৎ ছিল। কিন্তু তেমনটা হল না। বরং ঘন গলায় বলল, পারতপক্ষে কাউর বিবশ অবস্থা দেখে খুশী হবেন না।

আমি কিন্তু আপনার দূরাবস্থায় খুশী হইনি। আমি তো খালি...

আমি কিচ্ছু মনে করিনি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।

আবার নিস্তব্ধতা। পামেলা বাইরের দিকে চেয়ে দেখল বৃষ্টি ইলশেগুঁড়ির মতন পড়ছে। চায়ের দোকানটার বন্ধ ঝাপটাও দোকানী কখন যেন তুলে দিয়েছেন। ভেতরে কয়েকজন জমাটিয়া আড্ডা দিচ্ছে। সমস্বরে অট্টহাসির শব্দও ভেসে এল।

পামেলা লক্ষ্য করল যুবকের মুখটা খানিক গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। বোধহয় তার শেষ বক্তব্যে। সে তাকে প্রশ্ন করল, কতদূর যাবেন?

বারাসাত। ম্রিয়মান স্বরে জবাব দেয় যুবক।

বাহ্ বেশ তো।

বেশ তো কেন?

কারণ আমারও ওই একই গন্তব্য।

যুবক আলগা হাসে।

তাহলে আমিও আপনার মতন করে বলতে পারি ভাগ্যিস বাসটা মিস করলাম।

প্রয়োজন নেই। আমি জানি।

আপনি জানেন! কি করে?

যুবক সে কথার জবাব না জিজ্ঞেস করে, এদিকে কোথায় এসেছিলেন? যদিও একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন।

কথাটায় হাল্কা কটাক্ষের গন্ধ পায় পামেলা। তবুও গায়ে না মেখে বলে, আমি এখানে নাচ শেখাতে আসি।

রোজ?

না না। মাসে দু দিন।

যুবকের মুখে উজ্জ্বল হাসি খেলে যায়। সে বলে, আপনি একজন টিচার দেখলে কিন্তু মনে হয় না।

কেন?

কারণ টিচার বলতেই তো একটা গুরুগম্ভীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে মনে। সেরকম তো আপনি একদম নন।

এক চোট হেসে ওঠে পামেলা। বলে, হতেই পারে। নাচের শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের অভিব্যক্তি নাও মিলতে পারে। যদি এক হয়েও থাকে তাহলেও আমি গম্ভীর একেবারেই থাকতে পারি না। আমি চাই ছাত্র ছাত্রীরা যেন ভালবাসুক তবে ভয় পেয়ে নয়।

দারুন চিন্তাধারা আপনার। সাধুবাদ জানাই।

ধন্যবাদ।

হেসে মাথা করে পামেলা। তারপর বলে, আপনার ব্যাপারটা কি? মানে এখানে...

আমার এক সঙ্গীনির জন্যে এখানে এসেছিলাম।

পামেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, সঙ্গীনি? কোথায়? আপনাকে তো একাই দেখছি।

একবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখে নেয়।

যুবক হেসে বলে, এখানে আমি আর আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।

সঙ্গিনীর কথা বললেন যে।

খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যুবক। বলে, আসলে সঙ্গীনি নিজেও জানেনা যে, আমি তার সঙ্গে এসেছি।

পামেলা অদ্ভুত ভাবে তাকাল।

যুবক তার দৃকপাতের ধরণ দেখে বলল, ইয়ে... আমাকে দয়া করে পাগল বা বদমাশ ভাববেন না। আমার কোন অসৎ উদ্দেশ্যও নেই। একটু ব্যক্তিগত কারণেই তাকে অনুধাবন করতে হয়েছিল।

এবার আপনাকে কিন্তু একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।

তাই।

অট্টহাসি করল যুবক। তারপর রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হচ্ছে?

যুবকটির দৃষ্টি খুব ধারালো মনে হল পামেলার। চকিতে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। একরাশ অবাঞ্চিত অস্বস্তি যেন তাকে গলা সমান জলে ডুবিয়ে দিয়েছে।

বাস এসে পড়ছে। চলুন।

বলে যুবক উঠে দাঁড়াল। পামেলার হর্নের আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে গেল। সামনে‌ সে। পেছনে অজ্ঞাত যুবক।

বাস জনবহুল। তবুও উঠতে অসুবিধা হয়নি পামেলার। এমনকি লেডিস সীটগুলির কয়েকটা ফাঁকা থাকাতে বসার জায়গাও পেতে অসুবিধা হয়নি কোন। বসা মাত্রই সে সামনে দিকে চাইল। এমনকি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনেও তাকাল। থিকথিক করছে অজস্র মানুষের শরীর। কিন্তু সেই যুবককে আর দেখতে পাওয়া গেল না। পামেলা অযথা আর মাথা ঘামায়নি।


(৫)


আজ ক্লাসের চাপটা একটু কম আছে। তাই নিশার কথা মতন রাতে সপরিবারের বাইরে ডিনার করার পরিকল্পনাটাও ঝটপট তৈরী হয়ে গেল। পামেলাও যথারীতি নিশা এবং মিতালী দেবীকে একটি নামজাদা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। দ্বিতল বিশিষ্ট ঝাঁ চকচকে কাঁচেয় মোড়া রেস্টুরেন্ট। পুরোটাই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। মৃদু আলো এবং তৎসহ একটি রোমান্টিক স্যাক্সোফোনের ট্র্যাক সারা পরিসর জুড়েই খেলে বেড়াচ্ছে। তারা নীচতলাতেই বসল। ওয়েল ম্যানার্ড একজন সুদর্শন বেয়ারা এসে তাদের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল। নিশা মিতালী দেবীর পাশে বসে টেবিলের মধ্যিখানে রাখা চামচগুলিকে নিয়ে অনবরত ঘাটাঘাটি করে যাচ্ছে। ওপাশে পামেলা একা বসে একটু সোস্যাল মিডিয়াটার ফিডে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এল। নিশা তো খুবই উচ্ছ্বসিত। মিতালী দেবী মৃদু বকুনি দিয়ে বলল, দিদুন একটু চোপ করে বোস।

পামেলা সেদিকে কর্ণপাত করল না। মোবাইলটাকে টেবিলের উপর রেখে সদ্য একটা চামচ নিতে যাচ্ছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল তার। আড় চোখে দেখে নিয়ে সে বলল তোমরা খেতে লাগো। আমি কথা বলে আসছি।

পামেলা কথা বলতে বলতে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। রেস্টুরেন্টে লোকজনও একটু কম। তাই হই হট্টগোলটা একদমই নেই। পামেলার সামনে একটা মস্ত কাঁচের দেয়াল। তার ভেতর দিয়ে অনায়াসেই বাইরে গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করা যায়। এমনকি বাইরে থেকেও।

সে খুব মনযোগ সহকারেই কথা বলছিল মোবাইলে। আচমকা সামনের ল্যাম্প পোস্টের দিকে তার চোখ আটকে যায়। প্রথমে ভেবেছিল দেখার ভুল। কিন্তু না। সত্যিই একজন পোস্টের ধারেই দাঁড়িয়ে নিস্পলক তাকে দেখে হাসছে। বহুদিন বাদে দেখা হলে মানুষ খুশী হয়ে যেমন করে হাসে, ঠিক তেমনই হাসিটা। একদম সচ্ছ এবং অমায়িক। বিরক্ত লাগছিল পামেলার। মনে করল সরে যাবে। পরক্ষণেই মানসপটে একটু খটকার সঞ্চার হল। মুখটা তো খুব দেখা দেখা ঠেকছে। কিন্তু কোথায়... ভাবতে ভাবতে আকস্মিক মেঘ কেটে গেল। বোধ করি আলোর চাইতেও দ্রুতগতিতে মনে পড়ে গেল চাঁদপাড়ায় আলাপ হওয়া সেই যুবকের কথা। এ তো সেই। সেদিন রাতে তার পেছন পেছন বাসে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু তারপর যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। এমনকি বারাসাতে তাকে নামতেও দেখেনি।

পামেলা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে ক্ষীপ্র পদে বাইরের দিকে হাঁটা লাগাল। মিতালী দেবী অত্যন্ত বিস্মিত চোখে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে এমন হন্যে হয়ে তা জানবার জন্যে চেঁচাতে পারলেন না।

পামেলা ঝড়ের বেগে লাইট পোষ্টটির সামনে এসে দাঁড়াতেই হতভম্ব হয়ে গেল। কেউ নেই। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে যুবকটি হাওয়া। ভোজবাজি মনে হল পামেলার। বিস্মিত চোখে চারপাশটা দেখে নিল ভাল করে। এবারও তার সন্ধান পাওয়া গেল না। পামেলার মোবাইলটা ফের বেজে উঠতে দেখল মিতালী দেবী ফোন করেছেন। কাঁচের ভেতর দিয়ে তাদের দিকে একবার দৃকপাত করেই ফোনটা কেটে দিল।


চারিদিক কেবল সাদা। অনন্ত বিশ্রিত শুভ্রতার মরুভূমিতে পামেলার চোখ ধাঁধিয়ে উঠছে। নিরুত্তাপ ভেসে যাচ্ছে সে। কোথায় যাচ্ছে জানেনা। কতদূর পৌঁছিয়েছে তারও কোন হিসেব নেই। দিকভ্রান্ত। মাঝে মাঝে পেঁজা তুলোর মতন মেঘ তাকে ভেদ করে চলে যাচ্ছে। অদ্ভুত শীতলতায় ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। একবার মনে করল সে কি আকাশে উড়ছে! কিন্তু আকাশ কখনও এত সাদা হয়! কই মাটি থেকে আকাশের দিকে তাকালে এই রঙ তো চোখে ধরা দেয় না। হঠাৎ অনুভব হল বিন্দু কিছু পড়ছে। প্রথমে ঝিরঝির তারপর মুষলধারে। বোধহয় বৃষ্টি। কিন্তু কই সে তো একটুও ভিজছে না! অথচ সে কিন্তু প্রতিটা ফোঁটাকে অনুভব করতে পারছে আপাদমস্তক। বিস্মিত হল পামেলা। ছটফট করতে চাইল কিন্তু পারল না। কোথায় তার বাকি শরীর? একতাল মেঘ আচম্ভীতেই তাকে গলা অবধি ঢেকে ফেলেছে। অসাড় হয়ে গেছে দেহ। বরং বলা যেতে পারে এই মুহূর্তে মেঘের দলাটাই এখন তার নব প্রাপ্ত দেহ। ভয়ে উন্মাদের মতন চেঁচাতে আরম্ভ করল। চোখ চুঁইয়ে জলও নির্গত হল। আচমকা প্রতিধ্বনিত হল একটি প্রশ্ন।

এত ভয় কেন আপনার?

কে? ত্রস্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে পামেলা। এলোমেলো দৃষ্টি ঘোরাতে থাকে চারিদিক। মানব বিহীন বিজন শ্বেত মরুভূমিতে কেউ কোত্থাও নেই।

এত বিচলিত হয়ে কাকে খুঁজছেন?

এবার প্রশ্নটা পেছন থেকে এসে তার কর্নপটহে আঘাত করে। চমকে তাকায় সে। সেই যুবক। মুখে অবিকল মলীন হাসি। অথচ সে ভাসছে না। নির্দিধায় এবং অতি সচ্ছন্দেই শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবারও ভোজবাজি মনে হল তার। যুবক সেইরূপ হেসেই বলে, এখানে আমি আর আপনি ছাড়া তো আর কেউ নেই?

কে আপনি? কি চাই আপনার? ঝাঁঝাল কন্ঠে প্রশ্ন করে পামেলা।

আপনাকে চাই। দাঁত বের করে হাসে যুবক।

মানে?

যুবকের হাসির বেগ যেন বেড়ে যায়। একটা নয় একই রকম একাধিক গলার স্বর সমস্বরে অট্টহাসি করতে থাকে। স্পষ্টত বিদ্রুপের হাসি। পামেলার কান ফেটে যাচ্ছে। দু হাতের চেটো দিয়ে তা অবরুদ্ধ করবার চেষ্টাও করল। পারল না। শরীর নেই। বেষ্টিত মেঘমালাও তার ইচ্ছাধীন নয়। চিৎকার করতে যায় পামেলা। কিন্তু অনুভব করে হঠাৎ তার গতিবেগ বেড়ে গিয়েছে। সে ছিটকে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে‌ শক্ত মাটির উপর আছড়ে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে কাঁচের মতন। চোখের নিমেষে শুভ্রতা কালোতে পরিণত হল। হাসির আওয়াজও মিলিয়ে গেল সেই শুভ্রতায়। আচমকা একটা কর্কশ আর্তনাদ ভেসে এল কানে। ত্রস্ত চোখে দেখছে তার গতির চাইতেও অধিক গতিতে একটা কিছু ধেয়ে আসছে তার দিকে। বিন্দু থেকে ক্রমেই বড় হচ্ছে। প্রথমে একটি গোলক। তারপরেই সেই অজ্ঞাত যুবকের ধর বিহীন মুন্ডু। চোখ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে আগুনের হল্কা। মুখ অস্বাভাবিক রক্তিম। বিকৃত রহস্যময়ী হাসি ধারণ করে সে ক্রমে ধেয়ে আসছে। আকারেও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীউরে উঠে পামেলা। চিৎকার একটা বের হবার জন্যেই প্রস্তুত হচ্ছিল। তার আগেই চকিতে একটি শীর্ণ হাতের তালু তার মুখ চেপে চেপে ধরল। অনুভব করল আরেকটি হাত তার গলার উপর চড়ে বসেছে। চাপ বাড়ছে গলায়। প্রচন্ড চাপ। অসহনীয় চাপে তার শ্বাস রুদ্ধ হতেই বিদ্যুৎ গতিতে চোখ খোলে পামেলা। ধরফর করে বিছানায় উঠে বসে সে। অস্বাভাবিক জোড়ে নিঃশ্বাস পড়ছে। বুক উদ্ভ্রানের মতন কাঁপছে। সে চারপাশটা ভাল করে দেখল। পরিচিত আসবাবে সুসজ্জিত তার ছোট্ট কামড়া। পাশেই নিশা শুয়ে। বড্ড নিষ্পাপ মুখশ্রী তার। আপনা আপনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নাক ফুড়ে বেড়িয়ে এল। এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। মারাত্মক রকমের দুঃস্বপ্ন। 

মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই তার মাঝে মধ্যেই এমনটা হয়। ঘুমের মধ্যেই আঁতকে ওঠে সে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। খাট থেকে নেমে ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা জল বের করে ঢকঢক খেয়ে নেয় সে। মাথাটা ভোম হয়ে রয়েছে। ঘড়িতে টাইম দেখে। রাত পৌনে তিনটে। ফের নিজের জায়গায় ফিরে এসে ফোন ঘাটে বেশ খানিকক্ষণ। বুকের কম্পনটাও অনেকটা শীথিল লাগছে। এরপর ঘুমাবার চেষ্টা করে একটু। কিন্তু ব্যর্থ। এপাশ ওপাশ ব্যতিত আর কিছুই হচ্ছে না। বিরক্ত লাগছে। বারবার যুবকটির অনাবিল সুহাস্য লেপন মুখখানাই মনে পড়ে যাচ্ছে। 

পামেলা রহস্য প্রেমী নয়। তাই স্বপ্নে যুবকের প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করার মধ্যেও কোন রহস্য খুঁজতে চাইছে না। নিতান্তই কাকতালীয়। ঘুম কখন যে আবার চোখ জুড়িয়ে দিল পামেলা জানে না। তবে শেষবার খুব ক্ষীণ পাখির ডাক শুনতে পেয়েছিল সে।


(৬)


এইবার পশ্চিমবাংলায় বর্ষা খুব তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে। মে মাসের শেষার্ধেই ভিজতে আরম্ভ করেছে শহর। প্রকৃতির এইরূপ নিদারুণ আবহাওয়ায় কেউ কেউ রোম্যান্সের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ মনকে চাঙ্গা রাখতে সুরা, খিচুড়ি প্রভৃতিতে মেতে রয়েছে। কেউ কেউ আবার অদৃশ্য পেখম তুলে বৃষ্টি স্নাত হয়ে নাচছে আবার কেউ কেউ কাক স্নান হয়ে প্রকৃতিকে কটুকাটব্য করছে। আর আশ্রয়হীন অসহায় শুকিয়ে যাওয়া মুখগুলি এক চিলতে আশ্রয়ের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সবাই সবার জীবন নিয়েই মত্ত। সকলেই সচল।

প্রকৃতির বৈচিত্র্যময়তার জন্যই মানুষের জীবনধারণের ধারাও বদলিয়ে যায়। যেমন শীতে গরম পোষাক পড়তে হয়, গরমে একটু স্বস্তির জন্য হাওয়ার সন্ধান করতে হয়, আবার তেমনই বর্ষাকালেও ছাতা বা বরষাতির একটা আলাদা ঝক্কি পোহাতে হয়। এই একটা ঝক্কি যা পামেলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এড়িয়ে যেতে পারে না। আজও পারেনি। বাগবাজারের নাচের ক্লাসটা শেষ করে সে জোড় কদমেই হাঁটছে। ডানহাতে অসহিষ্ণুর মতন ছাতাটা ধরে রয়েছে আর অপর হাত দিয়ে কাঁধের চামড়ার ব্যাগটিকে জল থেকে বাঁচাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি কিছুটা কমে গিয়েছে দেখেই সে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু গলির প্রথম মোড়টায় বাঁক নিতেই মেঘ মত্থিত জলধারার পুনরায় বেগ বৃদ্ধি পায়। পামেলাও তার পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। সামনের আরও দুটো মোড় ঘোরা বাকি। তবেই সে মেন রাস্তার আলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে। তবে তা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। গলি সুদীর্ঘ। তৎসহ সংকীর্ণও। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা ছুঁই ছুঁই। কলকাতা শহরে এমন কিছুই রাত নয়। তবে আজ গলিটা বড্ড নির্জন। বৃষ্টির জন্যই রাস্তার বিচরণকারীরা গৃহ অন্দরে সেঁধিয়ে গিয়েছে। তবে সুরু পীচের রাস্তার ধার ধরে উঠে যাওয়া বাড়িগুলি ভীষণ সজীব। খোলা জানালাগুলো থেকে আলো ছলকে পড়ছে। কোথাও কোথাও টেলিভিশন থেকে অসংলগ্ন সংলাপ ভেসে আসছে। এই অতিবৃষ্টিতে পামেলার পক্ষে হাঁটা অসম্ভব। একটু আশ্রয়স্থল সে পাগলের মতন খুঁজছে। যা পাচ্ছে তার পরিসর ছোট। তাতে দাঁড়ানও যা আর ছাতা মাথায় এগিয়ে চলাও তাই। অগত্যা তাকে গতি বজায় রাখতে হল। সামনের আরেকটি মোড় ঘুরতেই একজন পুরুষ সাইকেল আরোহী বরষাতি গায়ে মন্থর গতিতে তাকে পাস করল। পামেলা প্রায় দৌড়াচ্ছে। আর একটু। আগত মোড়টাকে পার করলেই সে মেন রাস্তার ধারে কাছে চলে আসবে। অনন্ত সেখানে একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাবে।

দেখতে দেখতে শেষ মোড়টিকেও সে অতিক্রম করে ফেলল। মুখোমুখি দুটো সাবেকি তেতলা বাড়ির মাঝখান দিয়ে মেন রাস্তার আলো দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা গাড়ি এবং মোটরসাইকেল হুস হুস করে জল ছিটিয়ে পার হয়ে গেল। মুখোমুখি দুখানা বাড়ির একটির তলায় একটি কাঁচ দরজাওয়ালা ওষুধের দোকান। তারই একপাশে পর পর দুটি সাটার নামান দোকান। কার্নিশটাও বেশ চওড়া। পামেলা ছুট্টে সেখানটাতেই দাঁড়াল। বাঁচল সে। বৃষ্টির ধারা অবিকৃত। ছাতাটাকে খোলা অবস্থাতেই পাশে শানের উপর রেখে ব্যাগ থেকে একটি রুমাল বের করে মাথাটা খানিক মুছে নিল। রুমাল যদিও ভেজা তবুও সে করল।

ফার্মেসীর উজ্জ্বল আলো রৌদ্রের মতন রাস্তায় উপচে পড়ছে। কিছুটা তার পরিসরের দিকেও ছুটে আসছে। না আসার মতন। এ যেন এক নিঠুর পরিহাস। অন্ধকারাচ্ছন্ন আশ্রয়স্থলটি যেন বিদ্রুপের হাসি হাসছে তা দেখে। পায়ের কাছে চলমান জলস্তর ক্রমেই বাড়ছে। বিবশ লাগছে পামেলার। উৎকণ্ঠিত চিত্তে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে থাকে।

পামেলা খানিক অন্যমনস্ক হয়েই পড়েছিল। অকস্মাৎ পুরুষ রচিত একটি গলা খাকারিতে বেমালুম চমকে ওঠে সে। সভয়ে তাকায় পামেলা। আবছা অন্ধকারে একটি শারীরিক প্রতিকৃতির মৃদু আন্দোলনে বুকের ভেতর কেমন শূন্য হয়ে যায় তার। ভূতের নয় এক অদ্ভুত আশঙ্কায় তার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাতরে হাতরে ছাতাটিকে তুলে নিতেই একটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে অন্ধকার থেকে।

ভয় পেলেন নাকি?

পামেলা উত্তর দেয় না। ছাতাটিকে আঁকড়ে ধরে পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।

ভয় পেলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করতে চাইনি।

পামেলার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায়। মুখ বিবর্ণ। গলা কাষ্ঠ। অতিব কষ্টে অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে? কি...কি চাই আপনার?

অন্ধকারটা হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আপনি দেখছি সত্যি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। মার্জনা করবেন। বলে শরীরটা দু পা এগিয়ে এল।

পামেলা উদ্ভ্রান্তের মতন খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে ছাতাটা অন্ধকারের দিকে তাঁক করল। গলার স্বর কঠিন করে বলল, কি চান কি আপনি? একদম এদিকে আসবেন না। বেশী বেয়াদপি করলে কিন্তু এক্ষুনি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে দেব!

আরে আরে! আপনি তো দেখছি আমায় সাক্ষাৎ অপরাধী বানিয়ে ছাড়বেন। অন্ধকারের মধ্যেও পামেলা স্পষ্ট দেখতে পেল লোকটার দু হাত সমান্তরাল ভাবে তুলে তাকে থামবার ইঙ্গিত দিয়ে দিচ্ছে।

আরও বলল, আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই। তাছাড়া আপনি আমাকে চেনেন। অন্ধকারের মধ্যে আছি বলে বুঝতে পারছেন না।

পামেলা ভ্রু কুঁচকায়। অভিভূতের মতন বলে, চিনি মানে? একদম ছলচাতুরি কথা বলবেন না। এখানে আমার তেমন পরিচিত কেউ নেই। কি চান সেটা স্পষ্ট করে বলুন। নাহলে...

দাঁড়ান দাঁড়ান দয়া করে চেঁচামেচি করবেন না। আমি কোনও অসাধু লোক নেই। কোন প্রকার বদ মতলবও নেই। আগে আমার আলোর কাছে আসতে দিন! তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

পামেলা ছাতাটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। বলে, একদম কাছে আসবেন না। যা বলার ওখান থেকেই বলুন।

আচ্ছা আসছি না। আপনি একটা কাজ করুন আপনার মোবাইলের ফ্ল্যাস লাইটটা জ্বালুন তাহলে সব বুঝতে পারবেন। 

অত্যন্ত বিনম্র ভাবে কথাটা অন্ধকার থেকে ভেসে আসে।

পামেলা ঝটপট মোবাইলটা বের করে ফ্ল্যাস লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। আর জ্বালাতেই বজ্রাহতের মতন থমকে যায় সে। মুখ থেকে আচমকাই শব্দটা বেরিয়ে আসে। আপনি! ফ্ল্যাস লাইটের সুতীব্র আলোয় সেদিনের সেই যুবকের কোমল মুখটি ঝকঝক করছে। ঠোঁটে অবিকল সেই হাসি।

বৃষ্টির ঘ্যানঘ্যানে জলসায় কোন বৈকল্য না এলেও পামেলার অন্তর অঞ্চলে বিরাট তারতম্যের ঢেউ খেলে যায়। অশনি মেঘগুলিও গলে জল হয়ে বৃষ্টির আকারেই ঝড়ে পড়তে থাকে। একটি বেপরোয়া অনুভূতিই বোধহয় তার সারা শরীরে শিহরনের কপাট নাড়িয়ে দিয়ে গেল। হতচকিত পামেলার হাতের কাঠিন্য সয়ংক্রিয়ভাবেই ঢিলে হয়ে আসে। ছাতাটাও খানিক নুইয়ে যায়। যুবকটি অনাবিল হেসে প্রশ্ন করে, কি? চিনতে পারলেন তো? এবার ছাতাটাকে নামিয়ে রাখুন। কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে দেখতে। পামেলা একটু সহজসিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। ছাতাটাকে বন্ধ করে সাটারের গাঁয়ে ঠেস দিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করে, আপনি এখানে কি করছেন? আমায় ফলো করছেন না তো?

চোখের চাওনি তীক্ষ্ণ করে পামেলা। ততক্ষণে মোবাইলটাকেও ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় সে।

পামেলার প্রশ্নে যুবক জিভ কাটে‌। বলে, আমার মনে আপনাকে নিয়ে কোনও দূরভিসন্ধি নেই।

তাহলে এখানে কেন?

কারণটা একই। আমার এক সঙ্গিনীকে অনুধাবন করে আসা।

ভ্রু কুচকায় সে। বলে, কিন্তু আপনি তো একা।

যুবক সপ্রতিভ হেসে বলে, ব্যাপারটা জটিল বুঝলেন। এইভাবে ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার কাজ...

আপনার কথায় ভীষণ অসঙ্গতি আছে। ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।

দেখুন যেহেতু জটিল তাই একটু সহজ করে বলি। আমার কাজ স্রেফ তাকে অনুধাবন করা। তাকে সঙ্গ দেওয়া না। তবে হ্যাঁ প্রয়োজনে তার নিকটে আসতে পারি। তবে বুঝতে দেওয়া চলবে না।

আচ্ছা ভ্রনিতা করছেন তো মশাই!

যুবকের ঈষৎ হাসির আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল।

পামেলা হতবাকের মতন চেয়ে রইল কিছুক্ষন তার দিকে। আবছা অন্ধকারে তার মুখটা অনেকটাই দৃশ্যমান এখন। যদিও তার কথাবার্তাতে কোন প্রকার বিশ্বাসযোগ্যতা না খুঁজে পেলেও তার চেহারায় কিন্তু কোনও বৈলক্ষন খুঁজে পাচ্ছে না। চোখে মুখে এক অপরিমেয় স্নিগ্ধতা। যা মনকে মুগ্ধ করে দেয়। বিবশ করে দেয় তার প্রতি দুর্বল হতে।

পামেলা নিজেকে শক্ত করে। নিরুত্তাপ ভাবে বলে, আচ্ছা আমি ধরেই নিলাম যে, আপনি আপনার কোন এক সঙ্গিনীকে অনুধাবন করতে এসেছেন। তাহলে আমার সাথে বারবার দেখা হয়ে যাচ্ছে কেন?

কেন-এর কোন উত্তর আমার সঠিক জানা নেই। হয়তো পুরোটাই কাকতালীয় ব্যাপার।

হুস তা আবার হয় নাকি!

হচ্ছে তো। নিজেই তো পরিলক্ষিত করলেন।

আমার সন্দেহ হচ্ছে। অবিশ্বাসের সুরে পামেলা বলে ওঠে।

যুবক স্নিগ্ধ ভাবে বলে, আপনি সন্দেহ করতে চান বলেই হচ্ছে।

না করে আর উপায় কি বলুন! আপনার কথাতেই কেমন অসঙ্গতির দুর্গন্ধ।

জোরে হেসে ওঠে যুবক। বলে, আমি জিনিসটাই এমন কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। আপনাকে দোষ দিই কি করে বলুন তো।

পামেলার অভ্যন্তরে একটু রাগ স্ফুরিত হল। ছেলেটাকে তাকে ক্রমাগত কথার জালে জড়িয়ে ফেলছে। সে তাকিয়ে দেখল বৃষ্টির গতি এখনও ধীর হয়নি। জমে থাকা জল এখন পায়ের হিল জুতো জোড়াকে স্পর্শ করছে। পামেলা জিজ্ঞেস করল, সেদিন আপনি রেস্টুরেন্টের সামনে কি করছিলেন? সেদিনও কি আপনার কোন সঙ্গিনীকে অনুধাবন করতে গিয়েছিলেন?

আজ্ঞে। বিনম্র ভাবে জবাব দেয় যুবক।

তো আমার দিকে ওমন ক্যাবলাকান্তের মতন তাকিয়ে হাসছিলেন কেন?

চোখে চোখ পড়ে গেল যে। পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হলে সৌজন্যতার খাতিরে হাসাটাকি অন্যায়?

আমি কি আপনার পরিচিত? এটা তো জানতাম না।

এবার বেশ জোরেই হেসে ওঠে। অট্টহাসি বললেও ভুল হবে না।

পামেলার দাঁত কিড়মিড় কিড়মিড় করছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি যুবকের নিটোল গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা ভব্যতা হবে না। তাই রাগ প্রশমিত করে বলল, তারপর কোথায় উধাও হয়ে গেলেন বলুন তো? আমি বাইরে গেছিলাম আপনার সঙ্গে কথা বলতে।

উধাও হয়নি। সোজা কথায় কেটে পড়েছিলাম।

এর হেতু?

চক্ষু লজ্জার ভয়ে।

চক্ষু লজ্জা! কিসের?

বিস্ময় যদি কোন পারমানবিক বোমা হত তাহলে তা এই মুহূর্তেই পামেলার চিন্তনস্থলে ফেটে গিয়ে সমগ্র কলকাতাটাই নিশ্চিহ্ন করে দিত।

যুবক ঘন স্বরে বলল, আমার সঙ্গে কথা বললে লোকজন আপনাকেই পাগল ভাবত।

পামেলা বিরক্ত ভাবে জানতে চাইল। কেন?

ঘন স্বরকে কিঞ্চিত তরল করে বলল, পাগলের সাথে যে কথা বলে মানুষ তাকেও পাগল বলে ধরে নেয়।

তার মানে আপনি একজন পাগল?

সেটা আপনি বিচার করবেন।

ভারী অদ্ভুত লোক কিন্তু আপনি। কিছু মনে করবেন না অকপটেই বলি আপনাকে পাগলের চাইতে ধূর্তবাজই বেশি মনে হচ্ছে।

যুবক গদগদ হয়ে বলল, দারুন প্রসংশা।


আচমকা একটা দমকা হাওয়াতে প্রবাহমান বৃষ্টির কিছু ছাঁট তাদের জড়িয়ে দিল। পামেলা ব্যস্ত হয়েই তার ভেজা হাতের তালুটা মুখে বুলাতে লাগল। কোথার থেকে একজন মহিলা ছাতা মাথায় বেশ দৌড়েই ফার্মেসীর ভেতর চলে গেল। মাঝে একবার পামেলাকে বাঁকা ভাবে দেখেও নিল। যুবক জিজ্ঞাসা করল, আপনি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন?

পামেলা হাত চালাতে চালাতেই বলল, কি?

বৃষ্টি ব্যাপারটা কিন্তু কমন আমাদের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে।

পামেলা দু চোখ কুঁচকে তাকায়। অর্থাৎ?

রেস্টুরেন্টের দিনটা বাদ দিন সেদিন আমরা মুখোমুখি হইনি। কিন্তু যেদিন চাঁদপাড়ায় আপনার সঙ্গে প্রথম যখন সাক্ষাৎ হয় আমার সেদিনও কিন্তু এইরকমই বর্ষাস্নাত সন্ধ্যা ছিল। দৈবাৎ আজও আপনার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেই দেখা হল। কি অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না?

পামেলা খানিক অন্যমনস্ক হয়ে ভাবল। কথাটা সত্যি। কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? সবই তার চিন্তার থেকে অনেক দূরে। সন্দিগ্ধ মনের মধ্যেই যাই চিন্তা আসুক না কেন এই ছেলেটি এখনও পর্যন্ত তার সাথে কোনরূপ দুর্ব্যবহার করেনি। এমনকি এই ছোট্ট কার্নিশের নীচে যতটুকু দূরত্ব তাদের মধ্যে বজায় রয়েছে তার এতটুকুও লঙ্খন করেনি। কাজেই সে যে একদম লম্পট দুর্বৃত্ত মানুষ নয় এটা ভেবেই যেন পামেলার মনের ভেতরটা খানিক প্রসন্নতায় ভরে গেল। তবুও তার সাবধান থাকাটা জরুরি। মানুষের মন খুব জটিল। আর পামেলার ক্ষমতা নেই সেই জটিলতাকে ভেদ করে মূল অভিসন্ধি এবং অভিপ্রায়গুলোকে ছিনিয়ে এনে বাস্তবে উপনীত করা। কোথাও না কোথাও একটু রহস্য আছেই।

পামেলা মাথা নেড়ে বলল, তা ঠিক। বৃষ্টির বিষয়টা আমি আগে লক্ষ্য করিনি। তবে...

থেমে যায় সে। যুবক মলীন ভাবে বলে, একদম ইতস্তত করবেন না বলুন।

তবে কি... আপনার এই হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না। কোন যাদুবলে করেন বলুন তো? এই সেদিন চাঁদপাড়াতেই আপনি আমার পিছু পিছুই বাসে উঠলেন। অথচ তার পরে আপনাকে দেখতেই পেলাম না। এমনকি বারাসাতে যখন নামলাম তখনও কিন্তু আপনাকে নামতে দেখিনি।

যুবক হো হো করে হেসে ওঠে। ঈষৎ রসিকতার ভঙ্গিতে বলে, আপনার দুই তৃষিত নয়ন বুঝি আমায় খুঁজছিল? আগে জানলে পড়ে নামার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে যেতাম।

পামেলা একটু লজ্জা পেল। বুঝতে পারছে কান দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ম্রিয়মান হাসি ঠোঁটের একদম কোনায় ঝিলিক দিয়ে গেল। সে শক্ত ভাবেই বলল, না যা ভাবছেন তা একদমই না। আপনি তো মশাই আমার আমার বক্তব্যের অন্য অর্থ খুঁজে বের করলেন।

যুবক খানিক দ্বিধাগ্রস্ত হয়। বলে, দয়া করে গম্ভীর হবেন না। আমি একটু রসিকতা করছিলাম মাত্র।

যদিও আমি আপনার রসিকতা করার পাত্র নই। তবুও ঠিকাছে মেনে নিলাম। বেশ ঘন গলায় পামেলা জানান দেয়।

ধন্যবাদ। বলে চুপ করে যায় যুবক। বোধহয় মনে মনে বিব্রত বোধ করছে। পামেলা ডান হাতটা বারিয়ে আরও একবার বৃষ্টির গতি পরীক্ষা করে‌ নিল। বৃষ্টির হৃষ্টপুষ্ট ফোটা তার হাতকে ক্ষনিকের জন্য বিদ্ধ করে দিল। একটু কমেছে। আর একটু জিরলেই সে তৎক্ষণাৎ রওনা দেবে। 

মৃদু হেসে পামেলা বলল, আমার জবাবটা কিন্তু এখনও পেলাম না।

কোন জবাব? স্তিমিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে যুবক।

পামেলা বলে, সেদিন বাসে কোথায় হারিয়ে গেলেন।

যুবক জবাবে বলে, একদম সামনেই ছিলাম।

তাহলে বারাসাতে নামতে দেখলাম না কেন?

আমি তো বারাসাতের কিছু আগেই নেমে পড়েছিলাম। একটু জরুরি কাজ ছিল। তবে নামার সময়ে কিন্তু আমি আপনাকে লক্ষ্য করেছিলাম। আপনি চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন।

ঘুমাচ্ছিলাম না।‌ সজাগই ছিলাম।

তাহলে তাই।

আর রেস্টুরেন্টের দিন কোথায় চলে গিয়েছিলেন?

ওই রেস্টুরেন্টের একদম পাশেই একটি সরু গলি আছে। সেখানেই ঢুকে গিয়েছিলাম। রসিকতা করছি না। তবে দেখলাম আপনি হন্যে হয়েই কিন্তু আমায় খুঁজছিলেন সেদিন।

আপনি সব দেখেছেন বলুন? নিরুত্তাপ তাকায় পামেলা।

তা দেখেছি বই কি। নির্বোধের মতন হাসে যুবক।

আমি আপনাকে দেখতে পেলাম কেন? আশপাশটা তো খুব ভাল করেই খুঁজেছি।

ওটা একটা আলাদা ক্ষমতা আমার। লাইক সুপার পাওয়ার।

পামেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বোধহয় সেটা আক্ষেপের। এইরকম একটা সুপার পাওয়ার তার থাকলেও মন্দ হতো না। তাহলে সে অনায়াসেই তার প্রাক্তন স্বামী রমিত এবং তার বর্তমান প্রেমিকাকে খানিকটা হলেও ভেলকি দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারত। পামেলা রাস্তার ওপাশের হলুদ চলটা উঠে যাওয়া দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, বৃষ্টি তো প্রায় কমেই এল। এবার রওনা দেব ভাবছি। আচ্ছা আমি ধরুন কিছু এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাই তাহলে কি আপনাকে দেখতে পাব? নাকি এবারও উধাও হয়ে যাবেন?

একটি ক্যাঁচ করে শব্দ হল। পাশের ফার্মেসী থেকে সেই মহিলাটিই কাঁচের দরজা ঠেলে ছাতা মাথাতেই দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলেন। এবার সে পামেলার দিকে বাঁকা ভাবে তাকাল।

যুবক শান্ত ভাবে বলল, হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।

আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি। যাই তাহলে। অনেকে দেরি হয়ে গেল।

পামেলা ছাতাটাকে হাতে নিয়ে ময়ূরের পেখমের মতন মেলে দিল। তারপর সেটাকে মাথায় তুলে গোড়ালি উর্ধ জলে নেমে বলল, এখন যাবেন কোথায় আপনি? ছাতা সঙ্গে আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।‌

ও‌ ঠিক চলে যাব। আপনি সাবধানে যান।

পামেলা বলে, আমি পাঁচ মাথার মোড়ের দিকে যাচ্ছি। ওদিকে যাওয়ার থাকলে আমার সঙ্গে আসতে পারেন।

যুবক বলল, আমার এখনও ফিরে যাওয়ার সময় হয়নি। আপনি যান।

ঠিকাছে। বলে পামেলা হাঁটতে লাগল। হঠাৎ থেমে যুবকের দিকে তাকিয়ে শুধাল, আপনার নামটা কি তা তো বললেন না এখনও।

অবকাশই তো পেলাম না।

এবার তো পেলেন। বলুন তাহলে।

টুপটাপ করে বৃষ্টি পামেলার ছাতার উপর আছড়ে পড়ছে। সাথে এক অদম্য কাঁপুনি তার শরীরে। শীতল কাঁপুনি।

অন্ধকারের ভেতর থেকেই যুবক কোমল ভাবে বলল, তড়িজিৎ। তবে সেটা বিকৃত করে বন্ধু বান্ধবরা দড়ি করে দিয়েছে। আজকাল ওই নামটাই বেশ মনোরঞ্জক লাগে শুনতে।

দড়ি! অস্ফুটে উচ্চারণ করে পামেলা। মৃদু হেসে বলে, খুব ইউনিক নাম।

পছন্দ হলে ওই নামেই ডাকবেন।

উপর নীচ সীমিত ভাবে মাথা দোলায় পামেলা।

দড়ি বলে, আপনার নামটা? মানে এর পরেরবার দেখা হলে আপনাকে কি বলে সম্বোধন করব?

চোখ কপালে তোলে পামেলা। বলে, এর পরেরবার? আপনার আত্মবিশ্বাস দেখে সত্যিই আপ্লুত হলাম। হা হা করে হাসে সে।

বলে, আমার নাম পামেলা। তবে এর আর কোন বিকৃত শব্দ নেই।

তা বটে।

চললাম তাহলে।

আশা করি আবার আপনার সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাবে।

পামেলা ঠোঁট উল্টে বলে, দেখুন। আপনার কাকতালীয় ব্যাপারটা কতটা কার্যকরী।

অন্ধকারের দিকে হাত নাড়িয়ে সে মেন রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। রোডে উঠবার সন্ধিক্ষণে পামেলা পেছন ফিরে একবার চাইল। ফার্মেসীর উজ্জ্বল আলোয় ওপাশের কিছুই আর গোচরীভূত হচ্ছে না। পামেলা একখানি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল হয়তো দড়ি নামক ওই যুবকটি আর নেই। স্বভাব বশতঃ উধাও হয়ে গিয়েছে। অথবা ওখান থেকেই আড়াল হয়ে তাকে দেখছে।


(৭)


সেই রাতের বৃষ্টির পর অনেকবার আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হয়েছে। দফায় দফায়। বহুবার পামেলা ভিজেছে। বহুবার অসহিষ্ণুর মতন ছাতা সামলাতে হয়েছে তাকে। দেখতে দেখতে বর্ষাকালটাও ফুরিয়ে গিয়েছে। শরতের রোদ ঝলমলে নীলাভতায় বাংলার আকাশ সুসমৃদ্ধ। ইতিউতি কাশের বন মাথা চারা দিয়ে উঠে জানান দিচ্ছে দেবীর আগমনে আর দেরি নেই। মাত্র এক মাস। পামেলারও ক্ষান্তি নেই। পূজার সময় অনেকগুলি কনসার্ট আছে তার। তারই জোড় কদম প্রস্তুতিতে সে ব্যস্ত ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে। বাড়ি আর ক্লাস, ক্লাস আর বাড়ি - এই চক্রব্যুহের মধ্যেই সে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। দড়ির সাথেও পামেলার আর দেখা হয়নি এই ক'দিনে। তাতে যে আক্ষেপ আছে তা নয়। তবে ভাবনা নামক বস্তুটিতে মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি মারে সে।‌ ভাল লাগে পামেলার ভাবতে। মাঝেসাঝে এক আধদিন দেখা হলেও খুব মন্দ লাগত না তার। কয়েকবার সোস্যাল মিডিয়াতেও তাকে খুঁজবার চেষ্টা করেছে পামেলা। আশাপ্রদ কিছুই হয়নি। এতো গেল তার ক্লান্তি কালে ভাবনার কথা। বাস্তবিকই সে মগ্ন তার কাজে। ইদানিং তার গলার মলীন দাগটাও অনেকটাই বিলীন হয়ে গিয়েছে। লক্ষ্য করেছে কয়েকবার। আজকাল আর তাকে গলায় অহেতুক স্কার্ফ জড়িয়ে রাখতে হয় না। অনেকটাই স্বাধীন এখন পামেলা। অনেকটাই উন্মুক্ত বোধ করে সে।

চপল সময়ের আবর্তে পূজোও অনেকটা ঘনিয়ে এল। কঙ্কালসার বাঁধা বাঁশের স্তূপের উপর রঙিন কাপড় চড়িয়ে বহিরাবরণও প্রায় শেষ করে এনেছে দূর্গোৎসব কমিটিগুলি। এমনই একদিন রাতে পামেলা খাটের উপর বসে টেলিভিশন দেখছে। নিশা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, মা! আমরা সপিং-এ কবে যাব?

জানিসই তো মা এখন নাচ নিয়ে কিরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছি! তবে যাব। খুব শিগগিরই যাব। মৃদু হেসে জবাব দেয় পামেলা। এরপর তাকে কোলে টেনে নিয়ে গালে কতকগুলো স্নেহ সম্পৃক্ত চুম্বন বসিয়ে দেয়।

নিশা মুখ গম্ভীর করে বলে, কবে মা? আমার ক্লাসের সব বন্ধুদের কেনাকাটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। তারা এসে গল্প করে আমার সঙ্গে।

মেয়ের অভিমানটা পামেলা স্পষ্টত বুঝতে পারে। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলে, আর ক'দিন বাদেই আমরা যাব। তখন তুইও ওদের শুনিয়ে দিবি।

সত্যি মা? প্রসন্নতায় গাল ভরে যায় নিশার।


উৎসবের আনন্দে সামিল হতে বাঙালির ঔৎসুক্যতা যে কত দৃঢ় তা রাস্তায় পদচারণ করলেই আন্দাজ করতে পারা যায়। বিশেষ করে কলকাতার রাস্তায়। জায়গায় জায়গায় প্যান্ডেল নির্মানের শশব্যস্ততা। তার পাশাপাশি ছোট বড় সমস্ত দোকান, সপিং কমপ্লেক্সগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। থিকথিক করছে জনসমুদ্র। সকাল সকালই পামেলা এবং নিশা জনসমুদ্রে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। এই ভিড়ের মধ্যে চলতে পারবেন না বলেই মিতালী দেবী আজ বের হননি। অজস্র দোকান ঘুরে মনঃপুত জামা কাপড় কিনে তারা একটা হলুদ ট্যাক্সী করে গড়ের মাঠের উদ্দেশ্যে ছুটছে। মাঝে পার্ক স্ট্রীটের একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাওয়াও সেরেছে তারা।

দুপুর প্রায় সাড়ে তিনটে। সোনালী রোদ এখনও বেশ চড়া। নিশা পাশে বসে অনবরত কাগজ এবং প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলো ঘেটে যাচ্ছে। খুব খুশি দেখাচ্ছে তাকে। আর আক্ষেপ করে তাকে স্কুলে মুখ গুজে বসে থাকতে হবে না। এবার সেও কেনাকাটির ফিরিস্তি শোনাতে পারবে বন্ধুদের। গতিমান ট্যাক্সীর‌ খোলা জানালা দিয়ে অনাহুত হাওয়ার দল আবক্ষ পামেলাকে শীতল চড় লেপ্টে দিচ্ছে। মন্ত্র মুগ্ধের মতন নরম কালচে গদিতে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে সে। সারি সারি গাড়ি এবং বাসের ধূসর ধোঁয়া নিঃসরণের একঘেয়ে চলমান দৃশ্য। রাস্তার ধার বেয়ে মনুষ্য সৃষ্ট ফুটপাত ও সুসজ্জিত সবুজ বাগান। রং বেরঙের ফুলের সমাহার। আচমকা ট্যাক্সীটা গতি মন্থর করে দাঁড়িয়ে পড়ল। পামেলা বিরক্তির সঙ্গে সামনের স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে রেড সিগন্যালটা দেখে নিল। তাদের ট্যাক্সীটা যেখানে দাঁড়িয়েছে তার পাশেই নীল সাদা রেলিং-এ আবৃত একটা ফুটপাত। অকাতরে মানুষজনের পদধূলি পড়ছে সেখানে। নিশা অসহিষ্ণু হয়ে জিজ্ঞেস করল, মা ট্যাক্সীটা যাচ্ছে না কেন?

পামেলা নিশার কাঁধে হাত রেখে বলে, যাবে মাম্মাম! সামনে সিগন্যাল আছে যে।

কথাটা শেষ করা মাত্রই পামেলার চোখ স্থির হয়ে গেল। হঠাৎ সে দড়িকে দেখতে পেয়েছে। তাদেরই ট্যাক্সীর সামনে দিয়ে সেই কোমল নিখুঁত মুখ বিশিষ্ট যুবক সতস্ফুর্ত ভাবে মেন রাস্তাটা পার করে ফুটপাতে উঠবার উপক্রম করছে। পামেলা ব্যস্ত হয়ে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল। দড়ি! এই দড়ি! তড়িজিৎ!

যে অদম্য গলার আওয়াজে পামেলা ডেকেছিল তাতে দড়ির অনায়াসেই শোনা উচিত ছিল। কিন্তু দড়ির যাত্রাপথে কোন বৈলক্ষন দেখতে পেল না পামেলা। দড়ি নির্বিকার ফুটপাতে উঠে সামনের ভিড়ে মিলিয়ে গেল। মনে হল যেন শুনতেই পায়নি। পামেলা খানিক থিতু হয়ে গেল। নিশা জিজ্ঞেস করল, কাকে ডাকছিলে মা?

চেনা শোনা একজনকে দেখলাম বলে মনে হল। ছাড় বাদ দে।

ট্যাক্সীর ড্রাইভার একবার সন্দিহান চোখে রিয়র মিররে পামেলাকে দেখে নিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিল।


ট্যাক্সী থেকে নেমে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলছিল তারা। কয়েকটি যুগলবন্দী সেল্ফি। আবার কয়েকটি একক ফটো। এমন সময় এক শিখণ্ডী পামেলার কানের কাছে কয়েকবার তালি বাজিয়ে উঠল। তীব্র এবং নিখুঁত।কর্কশ গলায় বলল, দে মা কিছু পয়সা দে! তোরা এত্ত এত্ত বাজার করেছিস আমরাও একটু করব। পুজোর বকশিশ দে মা!

পামেলা বিরক্ত হয়ে বলল, যাও তো জ্বালাতন কর না।

শিখণ্ডীটি অনুরূপ ভাবে আরও কয়েকবার তালি ঠুকে বলল, মা এরকম করিস কেন? তোরা এত্ত কিছু কিনলি। আমরাও একটু কিছু কিনি। দে মা পয়সা দে। তোর অনেক ভাল হবে। তোর বাচ্চার অনেক ভাল হবে। বলে দুজনের মাথায় আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাত ছোঁয়াতে লাগলো। পামেলা অতিশয় বিরক্তির সঙ্গে তাকে দশ টাকা দিয়ে বিদায় করে গড়ের মাঠের অভিমুখে হাঁটা লাগাল।


গড়ের মাঠের ফুরফুরে হাওয়া, বিকালের মীয়ে আসা রোদ এবং সবুজ মোলায়েম ঘাসের মৃন্ময় স্পর্শ পামেলার মনকে অমোঘ আনন্দে ভরপুর করে তোলে। কিছু বিষন্নতাও মিশে আছে তাতে। রমিতের স্মৃতি। বিয়ের আগে এমনকি নিশার পেটে আসবার আগেও রমিতের সাথে অনেক ভাল মূহূর্ত কাটিয়ে গিয়েছে সে। ওই যে অদূরে যুগ যুগান্তর থেকে অলস ভাবে শুয়ে থাকা মৃত শুকনো পল্লবহীন গাছের হৃষ্টপুষ্ট কান্ডটি অন্যান্যদের মতন তাদেরও প্রেমালাপের সাক্ষী হয়েছে। সেইসব অতীতের ঘটমান স্মৃতিগুলিই পামেলার নাসারন্ধ্র থেকে দীর্ঘশ্বাসের আকারে বেড়িয়ে এল। নিশা তার মায়ের মোবাইল নিয়ে গেম খেলছে। মিষ্টি সুরের ছন্দ মোবাইল থেকে ভেসে আসছে কানে। পামেলা দু হাতের তেলোর উপর ভর দিয়ে পেছনে শূণ্যে হেলান দিল একটু। পাশেই জড়ো করে রাখা জামা কাপড়ের ব্যাগ। কত শত মানুষই রোজ আসে এখানে। আজও এসেছে। ইতিউতি ছড়িয়ে ভেজাল নির্ভেজাল প্রেমিক প্রেমিকার দল। গুটি কয়েক ছেলে জটলা করে গীটার বাজিয়ে আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের গান ভাজছে। চা ফেরীওয়ালাদের চা! এই চা! করা একঘেয়েমি হাক শ্লোগানের মতই পামেলার মনে হচ্ছে। অনেক দূরে কতকগুলো খচ্চর আরাম করে ঘাস আত্মসাৎ করেছে। পামেলা জিজ্ঞেস করল, মাম্মাম তুই কিছু খাবি? খিদে পেয়েছে?

নিশা মোবাইলের উপর চোখ রেখে বলল, না। খিদে পায়নি এখনও।

দেখ। কিছু খেলে বল। আমি চা আনতে যাচ্ছি।

আমার জন্য খালি বাদাম নিয়ে এসো। আর কিছু খাব না।

যথা আপনার ইচ্ছা। ব্যাগগুলোকে কোলের উপর নিয়ে বস। বলে পামেলা যাবতীয় ব্যাগপত্র নিশার দুই থাইয়ের উপর তুলে দিল।

নিশা তিক্ত কন্ঠে বলল, ধুর! দেখছ না গেম খেলছি।

আচ্ছা খেল আর বিরক্ত করব না। তবে দয়া করে ব্যাগের দিকে নজর রাখবেন। আমি এক্ষুনি আসছি।

নিশা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। পামেলা উঠে সব চাইতে কাছের চাওয়ালার দিকে হেঁটে গেল। মাটির ভাড়ে এক কাপ চা আর এক ঠোঙা চিনে বাদাম কিনে সে নিশার দিকে ফিরতে যাচ্ছে এমন সময় পা আপনা থেকেই থমকে গেল। হতবাকের মতন দেখল দড়ি তার পথ অবরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে অনাবিল হাসি। চোখের উপর চোখ পড়তেই অনুভব হল তার চোখের চাউনিতে এক অদ্ভুত নেশাতুর ভাব। ভোম্বলের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে পামেলা। বাকরুদ্ধ। আচমকা মনে হল কেউ বা কারা তার মাথার ভেতরে বালতি বালতি জল ঢেলে কৃত্রিম ঢেউয়ের সৃষ্টি করছে। নিমেষেই পুরো জগৎটা পামেলার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। এখন কেবল দড়িই প্রত্যক্ষমান। কয়েক মূহুর্ত এইরূপ স্তব্ধতার পর দড়ি হাঁটতে আরম্ভ করল। পামেলাও সম্মহিতের মতন তাকে অনুসরণ করতে লাগল। কেন সে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে - এই সামান্য চিন্তাটুকু করবার ক্ষমতা যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। সারা দেহ অসাড়। চোখ নিথর। কেবল পা দুটিই বাহ্যিক শক্তি দ্বারা যন্ত্রের মতন চলছে। একপ্রকার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। শরীরের ঝাঁকুনিতে চা উছলিয়ে পড়তে পড়তে ভারটা প্রায় শূন্য হয়ে গেল।

আচমকা ঘোর কাটল পামেলার। বুড়ো আঙুল এবং কব্জিতে সাঙ্ঘাতিক জ্বালা অনুভূত হতেই প্রায় খালি ভারটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। গরম চা পড়ে লাল হয়ে গিয়েছে চামড়া। ব্যাথায় টসটস করছে। বেয়াকুফের মতন চারপাশটা চাইল সে। এ কোথায়? গড়ের মাঠের মনোরম পরিবেশের পরিবর্তে নির্জন জঙ্গল। তারই মধ্যেকার একটি শুড়ি পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। পাখির কিচিরমিচির খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। পাশাপাশি গাড়ি বাসের খুব মিহি হর্ণের শব্দ অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। পামেলা উদ্ভ্রান্তের মতন এখান থেকে বেরুবার পথ খুঁজছে লাগল। দিশাহীন আত্মহারার মতনই হাতের বাদামের ঠোঙাটিকে ছুঁড়ে ফেলে দৌড়াতে আরম্ভ করল। মোবাইলটাও তার সঙ্গে নেই তার মেয়ে কাছেই সেটা... তার মেয়ে... নিশা... সে কোথায়? মাথা কাজ করছে না তার। ভাসা ভাসা মনে আসছে নিশাকে সে গড়ের মাঠে বসিয়ে চা আর বাদাম কিনতে গিয়েছিল। তারপরেই দড়ির সঙ্গে দেখা। কিন্তু তারপর কি করে যে এখানে এল তা আর কিছুতেই মনে করতে পারছে না। দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আচম্ভীতেই কিছুর সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেল পামেলা। ছিটকে মাটিতে পড়ে গিয়ে যন্ত্রনায় কোঁকিয়ে উঠল সে।

আরে আরে দেখে দৌড়াবেন তো?

চমকে পামেলা তাকায়। দেখে স্বশরীরে দড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে বলল, ভাগ্যিস ধাক্কাটা আমার সাথে খেলেন। কোন গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে মাথাটা এতক্ষণে ফেটে দু খন্ড হয়ে যেত!

আ... আমি কোথায়? বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে পামেলা।

একটা জঙ্গলে।

পামেলা ধীরে ধীরে উঠবার চেষ্টা করতে থাকে। এমতাবস্থায় দড়ি তার দিকে এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায় সে। কনুইয়ের কাছটায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। অবস লাগছে। বোধহয় কেটে গিয়েছে। পরনের নীল জিন্স এবং গোলাপী টপটাতেও মাটি লেগে গিয়েছে। ঘারের কাছ থেকে কালো ব্রা স্ট্র্যাপটা সামান্য উঁকি দিচ্ছে। পামেলা তার পোশাক ঠিক করে মাটি ঝেড়ে জিজ্ঞেস করল, আমি এখানে এলাম কি করে? আমি তো চা... দাঁড়ান আপনাকেও তো আমি গড়ের মাঠে দেখেছিলাম। আপনি এখানে কি করছেন?

এই দেখুন দেখা হতে না হতেই আপনি ফের জেরা শুরু করে দিলেন। আচ্ছা মহিলা তো আপনি!

আপনি লোকটাই ভীষণ বিদঘুটে। সত্যি করে বলুন আমি এখানে কি করে এলাম? আর আপনিই বা এই জঙ্গলের মধ্যে কি করছেন?

আপনি এসেছেন নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে। আপনাকে আমি বা অন্য কেউ পাঁজাকোলা করে আনেনি।

তীক্ষ্ণ ভাবে তাকায় পামেলা। জিজ্ঞেস করে, আর আপনি?

দড়ি নির্বোধের মতন হেসে বলে, আমি তো ওটা করতে এসেছিলাম।

ওটা!

আজ্ঞে ওটা। ডান হাতের কনিষ্ঠা দেখায় দড়ি।

পামেলার অসহিষ্ণুর মতন চোখ মুখ বাকায়। দড়ি বলে, আপনি ভীষন আজব জানেন তো। আপনার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পরেই আমি আপনাকে পাশ কাটিয়ে সরে পড়ব ভেবে অন্যদিকে হাঁটা দিলাম আর আপনি আমার পেছন ধরে বসলেন। যেদিক দিয়ে হাঁটি আপনিও দেখি সেদিক দিয়েই হাঁটছেন। শেষে বিরক্ত হয়ে এই জঙ্গলটায় ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যিস ঢুকে পড়েছিলাম বলেই ওটা হতে পারল। না হলে তো...

হতেই পারে না। লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে যায় পামেলার। বলে, আপনার কথার একবিন্দুও আমি বিশ্বাস করছি না।

এই যে পামেলা দেবী! আপনাকে অত লোকের মাঝে কোলে করে তুলে নিয়ে আদেয় সম্ভব কিনা একটু ভেবে দেখবেন। মার একটিও নীচে পড়ত না বুঝেছেন। নিন এবার আসুন। আশা করি এই জঙ্গলে রাত্রিবাস করার কোন ইচ্ছে নেই আপনার?

পামেলা কিছু বলল না। গটগট করে হাঁটতে আরম্ভ করল। দড়িও হাঁটতে লাগল তার পাশাপাশি। পামেলা কটাক্ষ করে বলল, কোন চেনা পরিচিতের সঙ্গে দেখা হলে যে কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হয়, এটা বুঝি আপনার ভদ্রতা?

জানি ব্যাপারটা খুবই অশোভনীয়। কিচ্ছু করার নেই আমি যে নিরুপায়। সেই কারণেই তো ট্যাক্সী থেকে অতবার করে ডাকা সত্তেও আমি কোন সাড়া দিইনি।

পামেলার মুখ হা হয়ে গেল। কটমট করে চেয়ে বলল, আপনি কাজটা জেনে শুনে করেছেন?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে দড়ি।

পামেলার সারা শরীরে আগুন জ্বলছে। ইচ্ছে করছে পাশের এই সুদর্শন যুবকটিকে এক্ষুণি ভস্বীভূত করে ফেলতে। কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ অকপটে নিজের অভদ্রতাকে স্বীকার করতে পারে। নিদেনপক্ষে না শুনতে পাইনি বলেও তো চালিয়ে দিতে পারত। তাহলে অন্তত গাত্রদাহটা আরম্ভ হত না। রাগে ফুঁসতে লাগল পামেলা। দড়ি খানিক তার দিকে তাকিয়ে চোখ নীচু করে বলল, যা করেছি আপনার ভাল ভেবেই করেছি। আমি চাইনা অকপটে কেউ আপনাকে পাগল ভাবুক।

পামেলা মুখ থেকে তাচ্ছিল্যের শব্দ করে একটা। দড়ি প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল, আপনার গলায় ওটা কিসের দাগ?

পামেলা অন্যমনস্ক হয়েই গলায় হাত দেয়। বলে, কিছু না।

দড়ি স্মিত হাসে। বলে, কি প্রয়োজন ছিল বলুন তো ওসব করার?

পামেলা অবাক চোখে চেয়ে জিজ্ঞাসা করে, কিসের কথা বলছেন?

আপনার ওই গলার দাগটা। ওটার জন্যই তো যত বিপত্তি।

কিসের বিপত্তি?

মেয়েটার কথা তো একবার অন্তত ভাবতে পারতেন। বড্ড করুনা হয় আপনাকে দেখে।

পামেলা অসহিষ্ণু কন্ঠ বলে, এই শুনুন। যা বলতে চাইছেন একটু পরিষ্কার করে সহজ ভাবে বলুন। তখন থেকে কি ভ্রনিতা করছেন!

কাষ্ঠ হাসে দড়ি। বলে, আমি কিন্তু সব বুঝি।

পামেলার গাত্রদাহে এই যুবকটি যেন ঘৃত সংযোগ করল। বারবার ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে তাকে বিব্রত করবার চেষ্টা করছে। পামেলার ইচ্ছা করছে এক্ষুনি একটা জোড়ে থাপ্পর কষিয়ে দিতে।

জঙ্গলের সীমানাটা ধীরে ধীরে কাছে চলে এসেছে অনেকটা। ওপাশে গড়ের মাঠের বৃহৎ পরিসরটাও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। বিকেলের রোদটাও অনেক ঝিমিয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার প্রস্তুতি করছে আকাশ। দড়ি গম্ভীর ভাবে বলল, আমি ভীষন ক্লান্ত বুঝলেন।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়বার শব্দ হল।

পামেলা রাগত চোখে মাপল তাকে। দড়ি কোনরূপ দৃকপাত না করে আক্ষেপের সুরে বলল, এইভাবে অনুধাবন করে বেড়াতে আর ভাল লাগে না।

পামেলা তিক্ত প্রশ্ন করল, আজও কি তাই করতে এসেছেন?

চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ে দড়ি। মুখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ। বলে, অগত্যা।

আপনার এই অনুধাবনের ব্যাপার ঠিক মাথায় ঢুকছে না। রি রি করে ওঠে পামেলা। বলে, আপনি কি তাকে সন্দেহ করেন? তাই লুকিয়ে তার গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে বেড়াচ্ছেন!

না। সন্দেহ নয়। আমি তাকে নিয়ে যেতে চাই।

মানে? অপহরণ? চোখ বড় বড় করে পামেলা।

দড়ি কপাল‌ কুঞ্চিত করে বলে, আমাকে দেখে কি আপনার অপরাধীই মনে হয়?

আপনার কথা শুনে অন্তত তাই মনে হয়।

হায় আমার কপাল!

দোষ আপনার কপালের না, আপনার মনের। কি খিচুড়ি পাকাচ্ছেন তা কে জানে?

দড়ি আশাহতের মতন বলল, আমার মনে কিন্তু কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। বিশ্বাস করুন ছাই না করুন।

পামেলা ব্যাকুল ভাবে বলল, তাহলে সরাসরি তাকে ডেকে নিজের মনের কথাটা বলে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। অত ঘোরাঘুরির কি প্রয়োজন?

আমার তাতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে সত্যটা বললে সে হয়তো ঠিক মেনে নিতে পারবে না।

তা কি এমন বলবেন শুনি!

সে কথা এখন বলতে আমি অপারগ। বোকার মতন হাসে দড়ি।

যাচ্ছেতাই! তাচ্ছিল্যের সহিত শূন্যে হাত নাড়ে পামেলা। কতকটা দু আঙ্গুলে অদৃশ্য কোন বস্তু ধরে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতন।

পামেলা অসহিষ্ণুর মতন চলেই যাচ্ছিল, দড়ি আচমকা বলে ওঠে, ভীষণ মায়া লাগে বুঝলেন। তাই জেনে বুঝেই নিজের থেকে পিছিয়ে যাই। কিন্তু কতদিন? আর কতদিন এভাবে নিজেকে আটকে রাখব। একদিন তো লাগবে তরী কুসুম বনে। একদিন তো সঙ্গীনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যিটা জানাতে হবে। যেতে হবে তাকে আমার সঙ্গে। আমার সঙ্গই যে তার নিয়তি।

পুরো চলচ্চিত্র মার্কা সংলাপ! মুখ বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গ করে পামেলা।

দড়ি ম্লান হেসে বলে, আপনি তাড়াতাড়ি যান। আপনার মেয়ে হয়তো এতক্ষণে আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে। কান্নাকাটি করছে কিনা দেখুন!

চকিতে পামেলার চোখের সামনে বোধহয় বজ্রপাত হল। এমনই মৌখিক গড়ন হল তার। উদ্বেগ এবং আশঙ্কার নির্নিমেষ কালো অবগুণ্ঠনে মুখের আদল আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সত্যই তার মেয়ে... নিশাকে অনেকক্ষণই দেখেনি। সেই যে চা আর চিনে বাদাম কিনতে গিয়েছিল... তারপর সব গুলিয়ে গিয়েছে। জঙ্গলের অভ্যন্তরে একবার মনে পড়লেও, চিন্তায় উদ্বেল হলেও দড়ির সঙ্গে বাক্যালাপে আবার সব গুলিয়ে যায়। পামেলা ছুটতে আরম্ভ করল। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। লোকজনও কিছু হ্রাস পেয়েছে। দৌড়নোর সময় খালি প্রতিধ্বনির মতন দড়ির কন্ঠ শুনতে পেয়েছিল সে। দড়ি বলেছিল, সাবধানে যাবেন। তবে মনে রাখবেন নিয়তি কখনই কাকতালীয় নয়।

পামেলা ভ্রুক্ষেপ করেনি। খালি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়েছে। পূর্বের স্থানে ফিরে আসতেই তার বুকের ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। থরথর করে কেঁপে উঠল সারা শরীর। নিশা তার জায়গায় নেই। ব্যাগ সমেত সে নিখোঁজ। কান্না ধেয়ে এল পামেলার চোখে। উদভ্রান্তের মতন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। খুঁজতে লাগল মেয়েকে। নিশা! নিশা! কোথায় তুই? নিশা!... পামেলার লাগামহীন গলার আওয়াজ পেয়ে আশপাশ থেকে বহু কৌতুহলী মানুষ ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরল। কি হয়েছে, কি হয়েছে! একটা উশখুশানি চালান হতে লাগল এক অজানা ঠোঁট থেকে আরেক অজানা ঠোঁটে। পামেলা কাতর কন্ঠে সকলকে জিজ্ঞেস করতে লাগল তারা কোন বাচ্চা মেয়েকে দেখেছে কিনা। সকলেই নিরুত্তর। কেবল নেতিবাচক পূর্ণ ঘাড় দোলানোর ইঙ্গিত। কান্নাও যেন তার গলার কাছে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মাটির উপরেই দু হাতের তালুতে মুখ গুজে বিবশ ভাবে বসে পড়ল পামেলা। আচমকা এমন জটলা দেখেই বোধহয় দুজন সাদা পোষাক পরিহিত পুলিশ সেখানে এসে উপস্থিত হন। দেখি কি হয়েছে! কি ব্যাপার! এসব বলতে বলতেই ভিড় সরিয়ে পামেলার কাছে এল দু জন। পামেলাকে ওমন ভাবে কাঁদতে দেখে তাদের একজন জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার ম্যাডাম! কি হয়েছে?

পামেলা মুখ তুলে পুলিশ দু জনকে দেখে বিদ্যুতের গতিতে উঠে দাঁড়াল। দু হাত জোর করে ব্যাকুল ভাবে বলল, দয়া করুন স্যার। আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দিন স্যার। প্লীজ। দেখুন না মেয়েটা কোথায়... আর মিনতি করতে পারল না পামেলা। দু হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

দ্বিতীয় জন পুলিশ বললেন, আহঃ ম্যাডাম আপনি একটু শান্ত হন। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কি করে আপনাকে আমরা সাহায্য করব?

পামেলা তেমন করেই অবরুদ্ধ স্বরে বলল, আমি... আমি কেমন করে শান্ত হব? মেয়েটা কোথায় যে চলে গেল! কোথায় খুঁজব মেয়েটাকে এখন?

প্রথম জন পুলিশ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মেয়েকে শেষবার কোথায় দেখেছিলেন?

এ... এই এখানেই। আঙ্গুল দিয়ে দেখায় পামেলা।

আপনার মেয়ের বয়স কত?

সাড়ে নয় বছর স্যার।

দ্বিতীয় জন পুলিশ প্রশ্ন করলেন, আপনার মেয়ে সঙ্গে আর কে ছিল?

আর কেউ না স্যার। আমি আর নিশাই একটু বেড়াতে এসেছিলাম।

নিশা মানে আপনার মেয়ে? প্রশ্ন করলেন প্রথম জন পুলিশ।

ঘাড় নাড়ে পামেলা।

কোথা থেকে এসেছেন?

বারাসাত।

দ্বিতীয় জন পুলিশ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলছেন যে, আপনার মেয়ে আপনার সঙ্গেই ছিল। তাহলে আপনার চোখের সামনে থেকে মেয়ে হারাল কি করে? বলেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

পামেলা বলল, স্যার নিশা আপনার চোখের সামনেই ছিল। তবে ওকে বসিয়ে রেখে আমি একটু চা আর বাদাম কিনতে গেছিলাম। ওই ওদিকে। বলে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে।

প্রথম জন পুলিশ জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণের জন্য গেছিলেন?

পামেলার মুখ ছোট হয়ে গেল। কিঞ্চিত বিব্রত কন্ঠে বলল, বেশীক্ষণের জন্যে নয়। তবে ফেরার পথে...

পামেলা তার পরের ঘটনা বলল না। এমনকি দড়ির কথাও না। তার বদলে সে বলল, ফেরার পথে এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তার সাথেই কথা বলতে বলতে এতটাই বিভোর হয়ে পড়ছিলাম...

পামেলা দু কান লাল হয়ে উঠল।

দ্বিতীয় জন পুলিশ বললেন, তাই নিজের মেয়ের কথাই ভুলে গেলেন! অদ্ভুত মা তো আপনি।

কটাক্ষ বানে পামেলা মাথা কাটা গেল। তা যাক। তাতে তার কিচ্ছু আসে যায় না। এখন তার মেয়েকে খুঁজে পাওয়াটাই আসল। তার জন্য যদি তাকে তার সন্মানটুকুও বলিদান দিতে হয়, তাও দেবে।

না স্যার ভুলে যায়নি। আমি...

থামুন। মৃদু ধমকে দিলেন প্রথম জন। বললেন, কোন মা যে তার সন্তানের প্রতি এতটা কেয়ারলেস হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না। যাইহোক আমার মেয়ের নিশ্চয়ই ছবি আছে মোবাইলে?

হ্যাঁ আছে... আছে। বলে ব্যস্ত হয়ে পামেলা মোবাইল বের করে দেখাল।

মেয়েকে কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছেন না?

এই তো স্যার। এইমাত্র এসে দেখি মেয়ে নেই। বলে আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল পামেলা।

মেয়েকে শেষবার কখন দেখেছেন মানে সময়টা আন্দাজ করতে পারবেন কি?

পামেলা কান্নার বেগ চাপিয়ে ধরা গলায় বলল, সঠিক সময়টা তো বলতে পারব না। তবে পৌনে পাঁচটার ধারে কাছে হবে।

মাই গড! দ্বিতীয় জন পুলিশ আঁতকে উঠলেন। গভীর বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, এতক্ষণ ধরে আপনি কি এমন গল্প করছিলেন‌ যে, নিজের মেয়ের কথা খেয়াল নেই!

পামেলা ধরা গলায় যেন বান এল। দু হাতের চেটো বুকের কাছে জড়ো করে অনুনয়ের সুরে বলল, আমি মানছি স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে। দয়া করুন আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে এনে দিন। না হলে আমি মরেই যাব।

প্রথম জন পুলিশ বললেন, আপনি একটু শান্ত হন। আমরা সাধ্য মতন চেষ্টা করব। আপনি আসুন আমাদের সাথে। একটা মিসিং ডায়েরী করতে হবে। এরপর অন্যজন পুলিশকে বললেন, তুমি ভিড়টা ফাঁকা করতো।

যেমন বলা তেমন কাজ। ভিড় ভাট্টা হালকা করে দুই পুলিশ পামেলাকে নিয়ে পার্ক স্ট্রীট থানায় দিকে এগোতে লাগলেন। এমন সময় তাদের ওয়াকিটকিতে একটি ঝিরঝিরে গলার আওয়াজ ফুটে উঠল। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল, গড়ে মাঠের পাশেই একটা বাচ্চা মেয়েকে পাওয়া গেছে। বয়স দশ বছরের মতন।

দুজন পুলিশের মধ্যে প্রথমজন ওয়াকিটকিটা মুখের কাছে এনে বললেন, আমি অসিত দাস বলছি। বাচ্চার নামটা কি?

নিশা রায় বলেছে।

ঠিকানা বা কার সাথে কোথায় এসেছিল, এসব কিছু বলেছে?

বলছে তো মায়ের সঙ্গে এসেছে। বারাসাত বাড়ি। পুজোর কেনাকাটা নাকি করতে বেড়িয়ে ছিল।

মায়ের নাম কিছু বলেছে?

হ্যাঁ। পামেলা রায়।

গড়ের মাঠেও একজন মহিলা বাচ্চার নিখোঁজের কথা বলে কান্নাকাটি করছিল। মনে হচ্ছে এই সেই। দাঁড়াও তোমাকে আমি একটা ছবি পাঠাচ্ছি। দেখ তো ছবিটির সঙ্গে মেলে কিনা।

ইতিমধ্যেই প্রথম জন পামেলার মোবাইল থেকে নিশার একটি মুখ ঝলমলে ছবি নিয়ে নিয়েছিলেন।

পামেলা পুলিশ দু'জনের পেছনে হৃদয় ভঙ্গের মতনই হাঁটছিল। বহির্জগত সমন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। তারা নিজেদের মধ্যে কি কথা বলল, অথবা কে তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, এমনকি কেউ তাকে হত্যা করবার জন্যে এলেও তার উচাটন মনে উদ্দীপনা আসবে না। খেলবে না কোন বৈকল্য। এমন সময় স্বগতোক্তির মতন পামেলা শুনতে পেল, আপনার নামটা কি?

মুখ তুলে তাকাল সে। দ্বিতীয় জন পুলিশের ঠোঁট নড়ছে। আবার তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করা হল। পামেলা আনমনে অস্ফুট উচ্চারণ করল তার নিজের নাম। একটা দুঃস্বপ্নের মতন লাগছে সবকিছু। কানে বোধহয় একশ ঝিঁঝিঁ পোকা অমানুষিক ভাবে ডাকাডাকি করছে। আবারও স্বগতোক্তির মতন সে শুনতে পেল, আপনার মেয়েকে পাওয়া গেছে ম্যাডাম।

পাওয়া গেছে! নিশ্চল গতিতে তার ঠোঁটের উপর শব্দগুলি যেন বেসুর নিক্কনের মতন বেজে উঠল। তারপর চটকা ভাঙ্গবার মতন সে বাস্তবের মাটিতে আঁচড়ে পড়ে।‌ অধীর ভাবে বলে, পাওয়া গেছে! কোথায় পাওয়া গেছে? প্লীজ আমায় এক্ষুনি নিয়ে চলুন। প্লীজ স্যার।

প্রথম জন হেসে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আসুন।

গড়ের মাঠের গাঁ ঘেঁষে রমরমিয়ে চলা ভেলপুরি, চা এবং সরবৎ লস্যির কয়েকটি দোকান ছাড়িয়ে তারা একটি ট্রাফিক কন্ট্রোলের ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হল। এতক্ষণ নিশা চুপটি করেই বসে ছিল। পামেলা মাম্মাম বলে ডাকতেই সে প্রায় লাফ দিয়ে পামেলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বুক ফাটিয়ে কেঁদে ফেলে সে। তৎসহ পামেলাও। অপত্য স্নেহ বিগলিত হয়ে পড়ছে নিশার মুখমন্ডলের উপর। যেন কত বছর দেখেনি, এমনই তাদের ভাবের আদান-প্রদান। ক্রন্দন রত নিশা জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় গেছিলে মা? কতক্ষন তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি!

পাশ থেকে একজন পুলিশ বললেন, আপনার খোঁজ করতে করতে তো মেয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কি ভাগ্য যে, কাজলের হাতে পড়েছিল! সেই ওকে আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। যদি অন্য কোন খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়লে কি হত ধারণা করতে পারছেন নিশ্চয়ই!

পামেলা এক বুক অনুশোচনা নিয়ে বলল, আর এমন করব না মা! কক্ষনও না। আমার ভুল হয়ে গেছে। তারপর সেই পুলিশটির চেয়ে বলল, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

পুলিশটি হেসে বললেন, তবে কৃতিত্ব কিন্তু কাজলের। বলে তিনি বাঁ দিকটাতে হাত ঘোরালেন। পামেলা জল ভরা চোখে সেদিকেই দৃকপাত করতে দেখল সেই তখনকার শিখণ্ডীটি দাঁড়িয়ে আছে।

পামেলা নিশার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে তার কাছে গিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ গো। তোমার দয়াতেই আমার মেয়েটাকে খুঁজে পেলাম। বলতে বলতে পামেলা তার দুখানি হাত চেপে ধরে। তারপর তার ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার এই ঋণ কখনই পরিশোধ করতে পারব না। তবুও এই সামান্যটুকু রাখ।

কাজল হেসে তা পরিহার করে দিয়ে বলে, এর কোন প্রয়োজন নেই ম্যাডাম। খালি মেয়েটাকে একটু সাবধানে রাখবেন। বড্ড ফুটফুটে দেখতে!


কথায় আছে শেষ ভাল যার সব ভাল তার। নিশাকে পামেলা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছিল ঠিকই। তবে সব ভাল কিন্তু একেবারেই হয়নি। তার জন্য অবশ্য সে মনে মনে সেই অজ্ঞাত যুবকটিকেই দায়ী করে।


(৮)



আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে ওঠে আলোক মঞ্জরী…


মহালয়ার ভোরে রেডিও থেকে মত্থিত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ বাবুর সেই কালজয়ী স্তোত্রপাঠ দেবী দুর্গার আগমনকে স্পষ্ট করে তোলে। জানান দেয় বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব একদম দোরগোড়ায়। বাঙালির অন্তরে এক বছর ধরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আনন্দের উচ্ছাস অতর্কিতেই দপ করে জ্বলে উঠে। কাউর দাবানলের আকারেও ছড়িয়ে পড়ে। শ্লথ গতিতে একটা একটা করে দিন গড়িয়ে পূজো আসে। ঢাকের শব্দে গমগমিয়ে ওঠা ঝলমলে পূজোর প্যান্ডেলগুলিতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় - এই দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা মেলান ভার। একটা আলাদাই আমেজ লুক্কায়িত থাকে। যা হয়তো পৃথিবীর কোন প্রান্তেই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সেই আমেজ, সেই উচ্ছাসের বহরও পামেলার কিছু কম নয়। পূজো তো বটেই, তবে এই উৎসব উপলক্ষে তার হাতে আসা বেশ কয়েকটি বড় কনসার্টের বরাতে সে সীমাহীন উত্তেজিত। দিন রাত পরিশ্রম করে সে তার ছাত্র ছাত্রীদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে তাদের নৃত্য কলাকে নিখুঁত ভাবে পরিবেশন করবার উদ্দেশ্যে। যাতে ভবিষ্যতের গুনমুগ্ধ দর্শকেরা প্রেক্ষাগৃহকে করতালির আওয়াজে মুখরিত করে তোলে। উত্তেজিত পামেলার নিঃশ্বাস নেবারও অবকাশ নেই এখন। ইদানিং সে তার স্বল্প অবসরে লক্ষ্য করেছে তার গলার কালসিটে দাগটাও প্রায় আবছা হয়ে গিয়েছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য না করলে তা দৃষ্টিগোচর হয় না।

গড়ের মাঠের সেই অনতভিপ্রেত ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর সে পন করেছিল এরপর দড়ির সঙ্গে কোনদিন দেখা হলেও আর তাকে কোনরূপ পাত্তা দেবেনা। যতই তার মন দড়ির দু চোখের দৃষ্টিতে উচাটন হয়ে উঠুক, যতই সেই সুদর্শন যুবকের অনাবিল হাসি তাকে বিহ্বল করে তুলুক, তাকে সে এড়িয়েই যাবে। যদিও এই সকল অভিপ্সা আর বাস্তবে প্রকাশ পায়নি। কারণ দড়ির সঙ্গে পামেলার এ যাবৎ আর দেখাই হয়নি। তবুও মনের মধ্যে একটু ক্ষুব্ধতা ছিলই। কারণ সে দড়িকে একটু অপমান করতে চেয়েছিল। বিগত ঘটনার সামান্যতম শোধ নিতে চেয়েছিল। তবে মানুষের মন তো আর খুব একটা ছোট জায়গা নয়। তাতে বিস্তর জমি। কাজেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পামেলার অগোচরেই তার প্যাসনের আড়ালে চাপা পড়ে গেল। পূজো এসে পড়েছে। সরু মোটা কাঠি দুটিই পেশাদার ঢাকির ছন্দবদ্ধ হাতে ঢাকের ধূসর চামড়ায় নির্লিপ্ত দোল খাচ্ছে। উৎসবের আধারে পূরবাসীর সম্পূর্ণ নিমজ্জিত।

কলকাতার বেশ কয়েকটি বৃহৎ প্রেক্ষাগৃহে পামেলার দলের নৃত্য পরিবেশন চলেছে। প্রত্যাশার অপেক্ষা বেশীই প্রসংশা এবং করতালি কুড়িয়েছে তারা। পূজোর আগের টানটান প্রশিক্ষণের দিনগুলি শ্লথ ভাবে কাটলেও, পূজোর চারটে দিন নৃত্য সমারোহে কি করে যে পামেলার অতিক্রান্ত হয়ে গেল তা সে টেরও পায়নি। আলোর বেগও বোধ করি এতটা দ্রুত নয়। নবমীর দিন রাতে পামেলার একক নৃত্য পরিবেশনকালে মাঝে একবার দড়িকে দেখতে পেয়েছিল সে। বেয়াক্কেলের মতন মঞ্চের একদম সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ভীষন রাগ হচ্ছিল পামেলার। সেটা যদি প্রেক্ষাগৃহ না হয়ে অন্য কোন স্থান হত তাহলে সে নির্ঘাত কিছু প্রতিক্রিয়া পেশ করে বসতো। নৃত্য শেষে করতালির হিল্লোলে যখন সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ গর্জে উঠেছে তখন আর তাকে দেখতে পায়নি সে। স্বভাববশতই উবে গিয়েছিল। 


আজ দশমী। দেবীর বিসর্জনের দিন। উৎসব মুখর বাঙালির এই দিনটাতেই মনের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা দূর্গাকে ছেড়ে দিতে হবে। ভেসে যাবে আবিল জলে। বিগলিত হবে মাটির প্রলেপ। খালি কাঠামোটাই অবশিষ্ট থাকবে। আবার তার উপর মাটির দলা চাপান হবে। আবার সকলের বেহিসাবি জীবন ফেলে রোজনামচা জীবন শুরু হবে। আবার এক বছরের প্রতীক্ষা। তবে দশমীর বিরহ বেলাতেও সিঁদুর খেলার পর্বটা এক বিরাট প্রশান্তি প্রদান করে। উজ্জীবিত করে বাঙালির মন প্রাণকে। এটাই সর্বশেষ আনন্দ। এরপরই সক্কলে মিলে তোরজোড় করে ভাসানের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

বেশ সরগরম হয়ে উঠছে উৎসব প্রাঙ্গণ। কমিটির লাগানো চোঙা থেকে দেবী দুর্গাকে বরণ করবার আহ্বান জানান হচ্ছে। পাড়ার মহিলারা পরপর লাইন দিয়ে মাকে বরণ করে চলেছে। সিঁদুরের আভায় ভরে উঠেছে মায়ের মৃন্ময় মুখ। ঠোঁটের উপর সন্দেশের পুর জমে মোটা আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। একই লহমায় ঢাক বেজে চলেছে। ছোট ছোট বাচ্চারা এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। পটপট করে ক্যাপ ফাটছে। মাঝে মধ্যে চকলেট বোম ফাটার শব্দ কানকে অনুক্ষন ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাড়ার যুবক যুবতীরা বেশ কয়েকজন জটলা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। ছবি তুলছে। বউয়েরা হাসি বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরকে সিঁদুরে রঞ্জিত করে তুলছে। এমন সময় পামেলাও নিশা এবং মিতালী দেবীকে নিয়ে প্রাঙ্গণে এল। যদিও সে মা'কে বরণ করবে না। পূজোর কটা দিনে ভীষণ ব্যস্ত থাকায় সেভাবে তার দূর্গা দর্শন হয়ে ওঠেনি। তার উপর নিশাও বড্ড বায়না ধরেছিল আসবার জন্য। নিশা জিজ্ঞেস করল, মা তুমি দূর্গা ঠাকুর বরণ করবে না?

পামেলা স্মিত হেসে বলল, না মাম্মাম।

কেন মা?

 মিতালী দেবী মৃদু ধমকে বললেন, এত কৌতুহল মেয়েটার! এত কৌতুহল! যদি একটু পড়াশোনাতেও থাকত!

পামেলা বলল, যাও ঠাকুরকে প্রনাম করে এসো। আমরা এখানটাতে বসছি। বলে পাশে থাকা গুটি কয়েক শূন্য চেয়ারের দিকে ইশারা করল।

নিশা দৌড়ে চলে যেতে পামেলা বলল, এসো মা। তুমি একটু বসে নাও। আমি একটু ঠাকুরের ওখান থেকে আসছি।

মিতালী দেবী একটা চেয়ারে বসতে পামেলা এগিয়ে গেল। এখনও বেশ লম্বা লাইন আছে। চেনা পরিচিতদের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে হাঁটতে লাগল। দেখল নিশা তারই বয়েসী কয়েকটি কচিকাঁচার সঙ্গে বেশ মজে উঠেছে। মা দূর্গার বৃহৎ মূর্তির সামনে গিয়ে পামেলা ভক্তি ভরে একটা প্রনাম করল। তারপর আচমকা দূর্গা মঞ্চ থেকে কিছুটা দূরে থাকা একটা জটলায় পামেলার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। পাড়ার মাঝ বয়সী কয়েকজন দাদারা সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। তার মধ্যে থেকেই রমিতের মুখটা ভেসে উঠল। চোখে আশ্চর্য অনুশোচনার দৃষ্টি। পামেলা অনুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্যের সহিত নজর ফিরিয়ে নিল। এমন সময় পাড়ার এক মহিলা তার দিকে এগিয়ে এসে সহাস্যে জিজ্ঞেস করল, ওমা তুমি কখন এলে?

পামেলা খানিক আলগা হেসে বলল, এইতো এলাম সবে।

মেয়ে কোথায়? মা আসেনি?

ওই তো মেয়ে খেলছে ওখানে। মাথা নেড়ে ইশারা করে সে। তারপর বলে, মা বসে আছে গেটের সামনে।

ও। তা তোমার মুখটা ভীষণ ফাঁকা লাগছে দাঁড়াও, বলে মহিলা তার হাতের থালা থেকে একটু সিঁদুর পামেলার গালে মাখাতে গেল।

পামেলা সসঙ্কোচে না না বলে উঠল।

মহিলা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, কি হল?

পামেলা বলল, জানই তো। আমার সিঁদুরের পাঠ চুকে গেছে।

তাতে কি? একটুখানি গালে মাখলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

তাও...

ধুরত্যারি! লাগাতে দাও দেখিনি। বলে মহিলা অনতিবিলম্বে পামেলার দু গালে ডান হাতের চার আঙ্গুল দিয়ে সিঁদুর লেপে দিল। কিঞ্চিত লজ্জা পেল পামেলা। বোধহয় এই দৃশ্য রমিতও লক্ষ্য করেছে।


মিতালী দেবীর পাশে পামেলা চুপচাপ বসে রয়েছে। ভীষন উদাস দেখাচ্ছে তাকে। রমিতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই প্রবল ঘৃনায় তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। কয়েকবার নিশার জোরাজুরিতে সে ছবিও তুলেছে কয়েকটা। তারপর আবার থিতু হয়ে গিয়েছে। বরণ পর্ব প্রায় শেষ। খালি একজন মহিলা মা দূর্গার দু গালে পান বোলাচ্ছে। বাইরে আকাশ অন্ধকার। দিনমানের ছিটেফোঁটা আলো কোথাও আর অবশিষ্ট নেই। বেশ তোরজোড় লেগে গিয়েছে বিসর্জনের প্রস্তুতি নিয়ে। ইতিমধ্যে তিনটে ম্যাটাডোরও এসে পড়েছে। নিরঞ্জনস্থল বেশী দূরে নয়। পাশেই পোস্ট অফিস বাড়ির পুকুরে। যদিও বাড়িটা পরিত্যক্ত। তবে পুকুরটিকে পাড়ার লোকজন অবাধে নিত্য কাজে ব্যবহার করে থাকে।

কমিটির সদস্যরা একটি ম্যাটাডোরে মা দূর্গা এবং অপরগুলিতে লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতীকে বোঝাই করে লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে হই হুল্লোড় করে তারপর পোস্ট অফিস বাড়ির পুকুরে গিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করবে। পামেলা প্রত্যেকবারই বিসর্জনে যায়। তাই সে সবটা জানে। কাজেই হাতে এখনও অনেকটাই সময় আছে দেখে সে নিশাকে ডাক দিল। খেলার সঙ্গীদের ছেড়ে নিশা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস, কি হয়েছে মা?

চল বাড়ি যাব। জবাব দেয় পামেলা।

আমরা কি বিসর্জনে যাব না মা? মুখ কাচুমাচু করে নিশা।

পামেলা হেসে বলে, যাব। তবে এখনও অনেক দেরি। কিছু খেয়ে নিই চল। পড়ে আবার আসছি।

নিশা উদাস হয়ে তার বন্ধুদেরকে টাটা করে মা আর দিদুনের সঙ্গে বাড়ি মুখো হল।


(৯)


অতি সাবধানে ধরাধরি করে দশভূজার বৃহৎ মৃন্ময় মূর্তিটিকে একটি ম্যাটাডোরে তুলে ফেলা হল। অপর ম্যাটাডর দুটিতে দেবীর চার সন্তানদের ভাগযোগ করে তোলা হল। পরক্ষণেই একটি পুরুষ কন্ঠ চিৎকার করে উঠল, বল দূগ্গা মাঈকি!

জয়! সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সকলে। নিশাও তার শিশু সুলভ অনুচ্চ কন্ঠে যথা সম্ভব গলা মেলাল।

আবার সেই পুরুষ কন্ঠস্বর চেঁচাল, আসছে বছর!

আবার হবে! (সমস্বরে)

পামেলা নিশার একটি হাত শক্ত করে ধরে মন্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখছে। পরনে ছাই রঙা সিল্কের শাড়ি। মিতালী দেবী এবার আর আসেননি। পামেলার উদাস ভাবটাও অনেকটাই কেটে গিয়েছে। একটা চাপা আনন্দ অনুভব করছে মনে মনে। তবুও সে নিশার সাথে চুপচাপ পুকুর অবধি হেঁটে যাবে। তারপর বিসর্জন অবধি অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে আসবে। একজন পৌঢ় লোক পামেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, কি ভাসানে যাবে না?

হ্যাঁ যাব তো। একগাল হাসল পামেলা। ঢাকের তালে নাচ্চে অনেক। এমনকি সে রমিতকেও উন্মত্তের নাচতে দেখল। বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে বেশ লাগছে দেখতে। মুখে সিঁদুরের ছাপ।

এমন সময় ম্যাটাডোর স্টার্ট দিল। পুনরায় বিসর্জনের সেই শ্লোগানের রব উঠল চারিদিকে। ম্যাটাডোরগুলো শ্লথ গতিতে চলতে শুরু করতেই উপস্থিত সকলেই পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। নিশা তার আবদ্ধ হাত দু বার টেনে বলল, ছাড় না। আমি একটু সামনে গিয়ে নাচি।

পামেলা কড়া ভাবে না বলল। নিশা খানিকটা আশাহত হয়ে পামেলার সাথেই রাস্তার একটা ধার দিয়ে চলতে লাগল। প্রবল উচ্ছাস সকলের। মাঝে মধ্যে ধুমধাম করে বোমা ফাটার আওয়াজ ভেসে আসছে। আচমকা ভিড়টা দাঁড়িয়ে যেতে কতকগুলো সেল ক্ষীপ্র বেগে আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে আলোর চাদর বিছিয়ে দিল। নিশা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। হ্যালোজিনের তীব্র আলোয় দেবীর গমনকে কোন স্বর্গীয় দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে পামেলার। হাঁটতে হাঁটতে বোধহয় সেও দেবীর সঙ্গে কৈলাসে পাড়ি দেবে। একদম সামনে নাচানাচির ভিড়। আচমকাই পামেলার বুকটা ধ্বক করে উঠল। নাচের ভিড়ের মাঝে বিদ্যুতের ঝলকের মতনই দড়ির মুখটা প্রত্যক্ষ হল তার। থমথমে রক্তিম মুখ। যেমনটা সে স্বপ্নে দেখেছিল। পামেলা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। সেদিকে আবার ভাল করে চাইল। চেনা মুখগুলোর উন্মত্ত আন্দোলন ছাড়া আর কিছুই নেই। নিজেকে সান্তনা দিয়ে বোঝাল এ তার স্মৃতিভ্রম। এখানে দড়ি আসবেই বা কোথা থেকে! ভিড়টা আবার এগোতে আরম্ভ করল।

সারা পাড়া চক্কর দিয়ে সেই লম্বা বিসর্জনের মিছিলটা পোস্ট অফিস বাড়ির পুকুর ঘাটে এসে থামল। ঢাক অবিরত বেজে চলছে। তেমনই অবিচ্ছিন্ন নাচের বহর। ঘাটের একটি কোনায় নিশাকে ধরে পামেলা দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাত তখন কত কোন হিসেব নেই। ইতিমধ্যে পাড়ার কয়েকজন মিলে দেবী দুর্গা এবং তার সন্তানদের মূর্তিগুলিকে নামাবার জন্য তোরজোড় করছে। আচমকা পামেলার মাথার ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। চারিদিককার কোলাহল মূহুর্তের মধ্যে ভীষন ম্রীয়মান শোনাচ্ছে তার কানে। মনে হচ্ছে অনেক দূর হতে ভেসে আসছে। চোখের দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠছে। নেশাগ্রস্তের মতন মনে হচ্ছে নিজেকে। গলার কাছটায় হঠাৎ একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। দলা পাকিয়ে যাচ্ছে কিছু একটা। নিশাকে এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে গলার উপর দিশাহীনের মতন হাত বোলাতে লাগল। চাপা কষ্ট হচ্ছে তার। এমতাবস্থায় সে কাউকেই ডাকতে পারছে না। খালি অস্ফুট আওয়াজ করছে মুখ দিয়ে। যদিও সে আওয়াজ এই প্রবল কোলাহলে কারুরই শুনবার কথা নয়।

আচম্ভীতে ঘোলাটে দৃষ্টিতেই পামেলা দড়িকে দেখতে পেল। অগুনতি মানুষের ভিড়ে দড়ির থমথমে রুক্ষ মুখটা ভীষণ স্পষ্ট মনে হচ্ছে তার। চোখে এক অদ্ভুত রকমের নিষ্ঠুরতা। দড়ি কেবল একবার উপর নীচ মাথা দোলাল। তারপরেই শূন্যে উবে গেল সে। ফের স্বপ্ন ভঙ্গের মতনই পামেলার কাছে সবকিছু স্বাভাবিক লাগতে লাগল। ঠিক আগের মতন। প্রবল কৌতুহল নিয়ে সে নিশাকে ফেলে রেখে দড়িকে খুঁজতে লাগল। নিশা ডাকল কয়েকবার। মা! ও মা! তুমি কোথায় যাচ্ছ?

পামেলা হাত নেড়ে ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলে সামনের ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। এদিকে দেবী মূর্তি ঘাটের উপর দন্ডায়মান। বিসর্জনের বহু চর্চিত শ্লোগানে হা হা করছে চারিদিক। উদ্ভ্রান্তের মতন খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখল দড়ি পুকুরের ধরে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পামেলাও সেদিকে যেতে লাগল। দড়ির গতি শ্লথ। তাই তাকে ধরে ফেলতে বিশেষ বেগ পেতে হল না তাকে। কাছাকাছি আসতেই পামেলা ডেকে উঠল। দড়ি! এই দড়ি!

দড়ি পেছন ফিরে চাইল।

পামেলা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, এই আপনি এখানে কি করছেন?

দড়ি রহস্যময় হাসল।

পামেলা ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল, এই আপনি কি কালা? কথা কানে যাচ্ছে না! কি করছেনটা কি এখানে?

সঙ্গিনী। অনুধাবন। ঘরঘরে কন্ঠে জবাব দিল সে।

পামেলা তীব্র ভৎসনা করে বলল, এখানেও আপনার সঙ্গীনি এসেছে! কে? কোথায় সে? চলুন। আমি তাকে দেখব। এক্ষুনি দেখব তাকে। বলে সে দড়ির দিকে দু পা এগিয়ে গেল।

দড়ি গম্ভীর ভাবে বলল, আর একটু অপেক্ষা করুন।

আপনি...

পামেলার কথাটা একটা খচখচ শব্দে অবদমিত হয়ে গেল। তটস্থ হয়ে চকিতে পিছন ফিরে দেখল অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। চিন্তিত মুখে পামেলা বলল, কে আসছে বলুন তো।

আপনারই পরিচিত কেউ হবে।

খচখচ শব্দটা আরেকটু কাছে আসতেই রমিতের গলা শুনতে পেল সে। পামেলা!পামেলা!

তৎক্ষণাতই পামেলার সারা শরীর রিরি করে উঠল রাগে। দাঁতে দাঁত চেপে নিশ্চুপ হয়ে রইল। রমিত আরেকটু কাছে আসতে জিজ্ঞেস করল, এই তুমি জঙ্গলে কি করছ?

দেখতে পারছ না প্রেম করছি! প্রবল উষ্মা প্রকাশ করল সে। দড়ি অন্ধকারে নির্বিকার হাসল। রমিত বলল, আমি জানি তুমি রেগে রয়েছ। আমায় প্লীজ ক্ষমা করে দাও।

পামেলা নিরুত্তাপ ভাবে বলল, এসব কথা এখন অর্থহীন রমিত। কেন অকারণ বলছ বল তো?

রমিত কাতর ভাবে বলল, আমি যে আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ওই নোংরা মেয়েছেলেটার পাল্লায় পড়ে তোমাকে কত আঘাত করেছি।

বেশ করছে তুমি। এবার যাও।

পামেলা! পামেলা! করতে করতে রমিত আরেকটু কাছে চলে এল। মদের তীব্র গন্ধ অনাহুতই পামেলার নাকে ঢুকে পড়ল। পামেলা তীব্র ভর্ৎসনা করে বলল, একদম কাছে আসবে না তুমি।

আচ্ছা আচ্ছা আমি আসছি না। নিশা... নিশা কেমন আছে গো?

খুব ভাল। পামেলা সুর করে বলল।

আমার কথা জিজ্ঞেস করে?

না। তোমাকে ছাড়া ও বেশ ভালই আছে।

থেমে থেমে হাসে রমিত। বলে, তা বেশ। তা বেশ। আমি তো দেখলাম নিশাকে ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে একা।

কথা বলেছ নাকি?

না না। একদম না। কোন মুখে কথা বলব বল তো?

শুনে খুশি হলাম যে, এটুকু বোধ রয়েছে মাথায়।

পামেলা!

কান খোলা আছে।

আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিতে পার না?

পামেলা বিরক্ত হয়ে বলল, এই সমস্ত ফালতু কথা বলে কেন আমায় বিব্রত করছ? আমি তোমাকে ঘেন্না করি। তোমার কারনেই সেদিন গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিলাম। আর তুমি বলছ ক্ষমা করার কথা! থু! দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। এভাবে অচেনা কাউর সামনে সিন ক্রিয়েট কর না।

অচেনা কেউ! রমিতের ভ্রু কুঁচকে গেল। বলল, এখানে আমরা ছাড়া আর কে আছে?

পামেলা চোখ মুখ কুঁচকে উঠে। বলে, ন্যাকামটা একটু বন্ধ কর। এত বড় জলজ্যান্ত শরীরটা দেখতে পারছ না! বলে দড়ির প্রতি লক্ষ্য করে পামেলা শূন্যে হাত দোলায়।

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায় রমিত। বলে, এসব তুমি কি বলছ? তারপর থেমে থেমে হেসে বলে, তুমি নির্ঘাত আমায় ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ বল! আমি কিন্তু একবারেই ভূতে ভয় পাই না।

কপাল মৃদু কপাল চাপরে বলে, হায় ভগবান! তুমি কোচি খোকা যে, ভূতের ভয় দেখাব!

তাহলে ওদিকে হাত কি দেখাচ্ছ?

পামেলা বিরক্ত হয়ে বলল, আরে এই ছেলেটাকে দেখতে পারছ না! তারপর সে দড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, দেখেছেন এই মানুষটা কি হারে ন্যাকাম করতে পারে!

রমিত বিষ্ফারিত চক্ষে পামেলাকে শূন্যে কথা বলতে দেখে। তারপর গলার স্বর কঠিন করে বলে, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? ওখানে কার সাথে কথা বলছ?

আরে আমি তো ওর সাথে কথা বলছি। দড়ির সাথে।

রমিতের ভীষণ রাগ হল। অমানুষিক ভাবে পামেলার দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কে দড়ি? ওখানে কেউ নেই। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার!

ঠিক সেই মুহূর্তে দড়ি খলখল করে হেসে উঠল। বলল, বলেছিলাম না আমার সাথে কথা বললে লোকে আপনাকে পাগল ভাববে।

বজ্রাহতের মতন স্তব্ধ হয়ে গেল পামেলা। ধীরে ধীরে রমিতের হাত দুটোকে আলগা করে দিল সে। দূরে আলো ঝলমলে ঘাটে দেবী দুর্গার বৃহৎ মূর্তিটি খুবই ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে। ক্রমশ হেলতে হেলতে জলে নিরঞ্জন হওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। যেন জলের ও প্রান্তেই কৈলাস। মহাদেব তার অর্ধাঙ্গিনীকে লুফে নেওয়ার জন্যে দু বাহু প্রসারিত করে রয়েছেন। এমনটাই নৈসর্গিক দৃশ্য মনে হচ্ছে পামেলার। মানুষের ঘিঞ্জি সমারোহে কাউকেই আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। রমিত বলল, তোমাকে এদিকে একা আসতে দেখেই তো তোমার পিছু পিছু এলাম কথা বলব বলে। এদিকে যাচ্ছিলে কোথায়?

পামেলা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যিই আমাকে একা দেখেছ?

হ্যাঁ। কি হয়েছে কি তোমার পামেলা? শরীর খারাপ?

পামেলা খুব ধীরে মাথা নেড়ে দড়ির দিকে তাকাল। আর তাকাতেই পামেলার সারা শরীর শিউরে উঠল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। চকিতে দড়ি তার কোমল সুদর্শন রূপটি বদলে ফেলে এক ভয়ানক পিশাচের অবয়ব ধারণ করেছে। মুখশ্রী বিচ্ছিরি ভাবে বিকৃত। অনাবৃত নগ্ন শরীরটাতে ছুঁড়ির ফলার মতন সুঁচালো কন্টক থিকথিক করছে। দু চোখ থেকে গাঢ় লাল রঙের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। এমন অদ্ভুত লাল সে আগে কোথাও দেখেনি। আকারেও অনেকটা বেড়ে গিয়েছে সে। নিদারুণ এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। হাড় হিম হয়ে গেল পামেলার। অকস্মাৎই তার গলা থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। আচমকা একদা দমকা হাওয়া আশপাশের সকল গাছপালাগুলোতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করল। রমিতও তা টের পেয়েছে। পামেলা রমিতের হাত টেনে চিৎকার করল, পালাও রমিত।

হতবাক রমিত বলে, কিন্তু কেন পালাব? কি হয়েছে?

পরে সব বুঝিয়ে বলব। আগে পালাও।

বলেই পামেলা প্রবল বেগে দৌড়াতে আরম্ভ করল। কিন্তু তার পরনের শাড়িটা যেন তার পরম শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চাইলেও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে দৌড়াতে পারছে না সে। রমিতও সংজ্ঞাহীনের পামেলাকে অনুসরণ করছে। এখনও হাসিটা শুনতে পাচ্ছে পামেলা। এ যেন এক মৃত্যুর সমন। আচমকা হাত পা আড়ষ্ট হয়ে গেল পামেলার। ধপ করে মাটিতে হুমরি খেয়ে পড়ে গেল সে। পামেলাকে আকস্মিক পড়ে যেতে দেখে রমিত তার কাছে এসে ব্যস্ত ভাবে বলে, কি হল পামেলা! ওঠ। জলদি। বলে তাকে ধরে তুলবার চেষ্টা করে রমিত। কিন্তু পারে না। পাথরের মতন ভারী হয়ে গিয়েছে পামেলার শরীর। পামেলা নিজেও তা বুঝতে পারছে। এমনকি তার নিজের জিহ্বাটাও সে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নাড়াতে পারছে না। অতি কষ্টে সে রমিতকে অস্ফুটে বলল, যা…ও। যা... যাও। ডে... ডে... ডেকে নি... য়ে আ... সো কা... আ...উকে।

কিন্তু তোমায় এভাবে ফেলে...

অস্ফুটে গর্জে ওঠে পামেলা। রমিত এক প্রকার ভয় খেয়ে দৌড়ে ঘাটের দিকে চলে যায়। পামেলা মৃত মাছের মতনই মাটিতে শুয়ে রয়েছে। বুকের ভেতরটা প্রবল গতিতে কাঁপছে। পিঠের তলায় কি যেন ভীষন বিড়বিড় করছে খুব। চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। নিশার নিষ্পাপ মুখটা ক্ষণে ক্ষণে চোখের মনি কোঠরে ভেসে উঠছে। সে হয়তো আঁচই করতে পারবে না যে, তার মা এমন একটা ভয়ানক বিপদে পড়েছে। সে হয়তো তার জন্য এখনও ঘাটের ধারে বসে অপেক্ষা করছে। ভগবান!

ধপ ধপ করে আওয়াজ করতে করতে পিশাচটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। অট্টহাসিটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আচমকা দুটো লাল ভয়ানক চোখ তার মুখের উপর উঁকি মারল। পামেলা অস্ফূটে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। জড়ান গলায় বলল, আমায় ছেড়ে দিন। দয়া করুন। আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার?

আবার পিশাচ অট্টহাসি করল। বলল, ছেড়ে দিন বললে তো ছেড়ে দিতে পারব না। অনেকদিন আপনাকে ছেড়েছি আর নয়। যেদিন আত্মহত্যা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন সেদিন তো এত ভয় পাননি। তবে আজ কেন ভয় পাচ্ছেন? হুম। হা হা হা হা! ভাল করে চেয়ে দেখুন আমি সেই দড়ি! আপনার অসম্পূর্ণ বাসনাকে সম্পূর্ণ করতে এসেছি।

উঃ...! উঃ...! তীব্র বেগে গোঙাতে লাগল পামেলা। মাথা খুব সীমিত গতিতেই দু দিকে দোলানোর চেষ্টা করছে সে।

দড়ি বলল, এখন আর না না করলে হবে না। আপনাকে ক্ষমা করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি দুঃখিত। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে।

পামেলার দু চোখ জলে ভরে গেল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে গোঙাতে লাগল ভীষণ। অস্ফুটে কিছু বলবার চেষ্টা করল তাকে। দড়ি আচমকাই তার পূর্বেকার কোমল রূপে আবার ফিরে এল। তারপর পামেলার শিয়রে বসে মাথায় স্নিগ্ধ ভাবে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কাঁদবেন না। নিজেকে শক্ত করুন। আমি তো ইচ্ছে করে আসিনি। আপনি আমাকে আহ্বান করে এনেছেন। তাহলে এখন দ্বিধা কিসের?

বলে মৃদু হাসল দড়ি। তারপর বলল, মৃত্যুর সমন দেখে বুঝি খুব ভয় পাচ্ছেন। দয়া করে পাবেন না। বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু আপনাকে একবারেই ভয় দেখাতে চাই না।

এরপর গলার সুর খানিক শক্ত করে বলল, আর কতদিন ধৈর্য রাখব বলুন তো? আপনার ওই মিষ্টি মেয়েটার কথা ভেবে এতদিন আপনাকে খালি অনুধাবন করে বেরালাম।

পামেলা বিস্মিত এবং ত্রস্ত চোখে দড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

দড়ি পামেলার মনের ভাব বুঝতে পেরে বিনম্র ভাবে বলল, হ্যাঁ ঠিকই ভাবছেন। সেই সঙ্গীনিটি আপনিই। একটু আগে বলেছিলাম না অপেক্ষা করলেই জানতে পারবেন। এবার বলুন কেমন লাগছে জেনে? আচ্ছা ছাড়ুন। এখন আপনি কথা বলার মতন অবস্থায় নেই। তাছাড়া আমার কাছেও সময় কম। এক্ষুনি আপনার প্রাক্তন স্বামী এখানে লোকজন নিয়ে চলে আসবে। তাই চলুন। বলে দড়ি পামেলার গলার উপর সবেগে হাত রাখল। পামেলা সজোড়ে গোঙাতে লাগল। দড়ি গলার উপর একটা অমানুষিক চাপ দিতেই পামেলার জিভ ঠিকরে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর এক টুকরো শোলার মতন তার দেহটাকে দড়ি শূন্যে তুলে ধরল। গলায় প্রচন্ড চাপ অনুভব করছে পামেলা। চোখের মনি দুটো ফুলে উঠেছে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত। আচম্ভীতে দড়ি সেই পৈশাচিক চেহারা ধারণ করল। তারপর শূন্য থেকে একটি দড়ির আমদানি করে সে পামেলার গলায় তা পেঁচিয়ে ফেলল। পামেলা সুতীব্র ভাবে গোঙাচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা রস স্খলিত হয়ে পিশাচের খর্বকায় হাতের উপর পড়ছে। চকিতে পিশাচ সেই দড়ির অপর প্রান্তটি ধরে জোড়ে হ্যাচকা টান মারতেই মট করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে একটি আঁতকে ওঠার শব্দের সাথেই পামেলার গোঙানিটা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার অস্থির দেহটা ক্রমেই স্থির হয়ে পিশাচের কব্জিতেই লুটিয়ে পড়ল।


রমিত ঘাটের দিক থেকে লোকজন ডেকে নিয়ে আসতেই এক্কেবারে থ মেরে গেল সে। আতঙ্কে তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। মাথার ভেতরটা আকস্মিক ঝনঝন করে উঠতেই সে মাথা ঘুরে জ্ঞানশূন্য হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। সেখানে উপস্থিত সকল চোখই দেখল একটি মোটা গাছের ডালে পামেলার সাড়হীন দেহটা ঘেটি ভাঙ্গা অবস্থায় পেন্ডুলামের মতন দোল খাচ্ছে।


(সমাপ্ত) 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror