Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!
Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!

Ajobdeep Bromho

Drama Romance Tragedy

3.0  

Ajobdeep Bromho

Drama Romance Tragedy

শেষদিন

শেষদিন

20 mins
1.0K


বাস থেকে নেমে সবার আগে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকালো নবারুণ। হাতের আঙ্গুলগুলোতে তার ছাল বাকল উঠে যাওয়া খসখসে মানি ব্যাগটা ঠেকতেই বেশ স্বস্তি বোধ করল সে। যাক্ এ যাত্রায় তার মানি ব্যাগটা রক্ষা পেয়েছে। আসলে শিয়ালদহ থেকে বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পর থেকেই নবারুণের বারবার মনে হচ্ছিল কেউ বোধহয় তার পাঞ্জাবির পকেটের আশেপাশে হাত চালাচ্ছে।‌ সে তটস্থ চোখে এদিক ওদিক চাইল কয়েক বার। কিন্তু দম বন্ধ করা বাসের ভীড়ে সেই বদ ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করা অসম্ভব। একবার মনে করেছিল সে নেমে যাবে বাস থেকে। কিন্তু পরক্ষনেই তার মনে হল তাতে বিশেষ লাভ হবেনা। কারণ এখন অফিস টাইম। কাজেই এর পরের বাস যে ফাঁকা হবে তা আশা করাও অন্যায়। অগত্যা তাকে বাসের একটা কোনে গুটিসুটি মেরে তার গন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।


মানি ব্যাগটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে সে তার প্যান্টের বাঁদিকের পকেটে গুঁজে রেখে সামনের দিকে তাকাল। হাজার হাজার অচেনা মুখ যাতায়াত করছে এদিক ওদিক। শত সহস্র গাড়ি ও বাসের সারিবদ্ধ আনাগোনা। তারই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ করে বেমানান ভাবে অসংখ্য মাল বোঝাই ঠ্যালা গাড়ী ও ভ্যানের ছোটাছুটি। সব মিলিয়ে এক অবিকল এবং অবিচ্ছেদ্য ধর্মতলা চত্তরটা ফুটে উঠছে তার চোখের কোটরে।

বেশ কিছুক্ষন সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকবার পর নবারুণ হাঁটতে আরম্ভ করলো। অন্যদিক থেকে গাড়ির সমষ্টি আসা যাওয়া করছে। কাজেই তাকে অতি সাবধানে ডানদিক বাঁদিক খেয়াল রেখে কয়েকটা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে এবং অগুনতি মানুষের থেকে গা বাঁচিয়ে এগোতে হলো। তবে গা বাঁচিয়ে চলাটা এখানেই শেষ নয়। কারণ সামনে গোটা নিউ মার্কেটটাই পড়ে আছে।


নবারুণ এমনিতে খুব সাবধানী ছেলে। তবে আজ তাকে সাময়িক বিপাকে পড়তে হয়েছে। আনমনেই কখন যে সে একটা ঠ্যালা গাড়ীর সামনে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। আরেকটু হলেই ঢাক্কা লেগে যেত। ঠ্যালা গাড়ীর অবাঙালী চালকতো "অন্ধ নাকি!" বলেই গাল মন্দ করতে আরম্ভ করলো। নবারুণ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দুবার সরি বলে কোনরকমে দ্রুত পদে এগিয়ে গেল। যেন সে হাপ ছেড়ে বেঁচেছে। খালি চোখে দেখলে মনে হবে দোষটা তারই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে দোষটা একদমই তার নয়। কারণ আজ তার মনকে অসুখে পেয়েছে। অন্যমস্কতার অসুখ।


গতকাল রাতে নবারুণ সদ্য ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরছে এমন সময় তার মোবাইলে একটা ফোন আসে। নম্বরটা অচেনা। সাইকেল থেকে নেমে ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে‌ একটি প্রশ্ন ধেয়ে এলো, "হ্যালো! কে নবারুণ?"

ঠিক সেই মুহূর্তে নবারুণের হৃৎপিণ্ডটাও ভীষণ জোরে কেঁপে উঠলো। প্রশ্নটা খুবই সহজ এবং যে প্রশ্নটি করেছে তার কন্ঠস্বরও অত্যন্ত নরম। কিন্তু তবুও নবারুণের কাছে তা খুবই অপ্রত্যাশিত। কারণ প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল সে এই কন্ঠস্বরটিকে শোনার অভ্যেস ত্যাগ করে ফেলেছে। সে ঈশিতাকে প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছে। তাই সে এই প্রশ্নের কোন জবাব দিলনা। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলো।


"হ্যালো! শুনতে পারছো?" ওপাশ থেকে ফের উদগ্রীব কন্ঠে প্রশ্ন এলো। নবারুণ বলল, "হুম পাচ্ছি।"

"আমি ঈশিতা বলছি। চিনতে পেরেছো?"

নবারুণ গলার স্বর একটু কঠিন করে বলল, "যদি বলি না!"

ঈশিতা মৃদু হেসে বলল, "নাই পারতে পারো‌। কারণ আমিই তো তোমায় ভুলতে বলেছিলাম। তোমাকে আমার জীবন থেকে চলে যেতে বলেছিলাম।"

- "সবই যখন মনে আছে তাহলে ফোন করেছ কেন?"

- "তোমাকে কিছু বলার ছিলো।"

নবারুণ শ্লেষের হাঁসি হেঁসে বলল, "বলার ছিল!

এতগুলো বছর পর আরও কিছু বলার বাকি থাকে? নাকি সেদিনের সেই অপমানগুলো করার পরেও আরও‌ কিছু অপমান করা বাকি রয়ে গেছে?"

- "প্লিজ নবারুণ ওমন করে বলোনা। জানি আমি তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছি। আর তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।"


- "দয়া করে ওই 'ক্ষমা' শব্দটা উচ্চারণ করোনা। বড্ড বেমানান লাগছে শুনতে। আর রইল বাকি তোমার অন্যায়ের কথা, সে ক্ষেত্রে দোষটা আমারই সর্বাধিক। কারণ তোমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোটাই ছিল আমার ধৃষ্টতা। বলাই বাহুল্য, আগুনের সংস্পর্শে আসলে পতঙ্গ তো পুড়ে মরবেই।"

- "প্লিজ চুপ করো তুমি।"

একটা চাপা আর্তনাদ যেন নবারুণের কানকে ভিজিয়ে দিল। দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তার অন্তর।

ঈশিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, "একটা জিনিস চাওয়ার আছে তোমার কাছে। প্লিজ না করবে না।"

- "ঈশিতা, তুমি আমাকে জোর করার কেউ নও। সেই অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছ।"


- "তা সত্বেও আমি অধিকার ফলাব। ব্যস আরেকবার। এই শেষবার বিশ্বাস করো। তাছাড়া একজন ফাঁসির আসামীর কাছেও তার শেষ ইচ্ছাটুকু জানতে চাওয়া হয়। তুমি আমাকে সেই শেষ সুযোগটুকু দেবে না?"

- "তুমি কেন আবার আমায় দুর্বল করে দিচ্ছো? কি চাও কি তুমি?"

- "একটু সময় চাই। পারবে না দিতে আমায়?"

"না পারবো না।" কঠিন ভাবে জবাব দেয় নবারুণ।

- "কিন্তু তোমার এইটুকু সময় যে আমার প্রয়োজন নবারুণ। দোহাই না করোনা। তোমার প্রাক্তন হিসেবে নয়, একজন অতি নিকৃষ্ট মানের বন্ধু হিসেবে চাইছি।"

নবারুণ চুপ করে রইলো।

ঈশিতা বলল, "হ্যালো! শুনতে পারছো! কিছু বলছো না কেন?"

নবারুণ তাও কোন উত্তর দিল না।

ঈশিতা এবার একটু মজা করে বলল, "আরে হা বোল দে ইয়ার। সায়াদ ফির ইস জানাম মে মুলাকাত হো না হো!"

নবারুণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "চুপ কর। আর ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করোনা।"

"তার মানে তুমি রাজি?" উচ্ছসিত কন্ঠে ঈশিতা বলে উঠলো।


নবারুণের ঠোঁটেও ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কিন্তু সে গম্ভীর ভাবে বলল," কবে, কোথায় আসতে হবে?"


- "কালকেই আসো যেখানে আমরা প্রায়শই দেখা করতাম। সেই ইলিয়ট পার্কে। আমি বেলা একটা নাগাদ তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।"

নবারুণ যথা সময়ে ইলিয়ট পার্কের গেটের সামনে পৌঁছে গেলেও ঈশিতার কোন পাত্তা নেই। প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে সে একই ভাবে দন্ডায়মান‌। এর মাঝে সে পাঁচ বার সেই অজানা নম্বরটাতে ফোন করেছে। কিন্তু ঈশিতা একবারও তার ফোনের জবাব দেয়নি। মনে মনে ভীষন ক্ষুব্ধ হল নবারুণ। ভাবল ঈশিতা এবারও তার সঙ্গে পরিহাস করেছে। সেও একটা গর্দভ যে এইভাবে কোন কিছু না ভেবেই যেচে অপমান হতে চলে এসেছে। আর ভাল লাগছিল না নবারুণের। ঠিক করল এবার বাড়ি মুখ হবে। তাই করল সে। কাছেই একজন ফেরীওয়ালা ছোলা মাখা বিক্রি করছিলো। সেখান থেকে সে এক ঠোঙা ছোলা মাখা কিনে ধর্মতলার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করে দিলো। কিন্তু বেশীদূর এগোতে পারলো না সে। পেছন থেকে তার নাম ধরে ডাক পড়ল হঠাৎ। সেই চেনা কন্ঠস্বর। সয়ংক্রিয়ভাবেই তার বুকের ভিতরটা কাঁপতে আরম্ভ করলো। ধীরে ধীরে চাইল পিছন পানে। দেখল ঈশিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তৎক্ষণাৎ তার হৃৎপিণ্ডটা কোনরকম কোনো তোয়াক্কা না করেই আরও একবার ভীষণ জোরে লাফিয়ে উঠলো। স্তম্ভিত হয়ে রইল নবারুণ। এ যেন স্বপ্ন। বোধহয় সজোরে চিমটি কাটলে এক্ষুনি তার নিদ্রা ভঙ্গ হয়ে যাবে। নতুবা সময়ের কোন এক কারসাজির ফলে সে আড়াই বছর পিছিয়ে গিয়েছে। যেখানে সে আর ঈশিতা অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ।


"কি হলো? চলে যাচ্ছিলে বুঝি?"

ঈশিতার প্রশ্নে নবারুণের সম্বিত ফিরলো। সমস্ত ভাবনার মেঘ কেটে যেতেই সে ঈশিতার দিকে ভাল করে চাইলো। অনেকগুলো দিনের ব্যবধান। তাই হয়তো অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে। মুখের উজ্জ্বলতাটা একটু ফিকে হয়ে গিয়েছে। ঠোঁটে হাসি আছে বটে তবে প্রানবন্ত নয়। মেরুন কুর্তি আর সাদা লেগিন্সে সুন্দরী লাগছে ঠিকই। কিন্তু আগের মতো তিলোত্তমা মনে হচ্ছে না।


নবারুণ তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত ভাবে বলল, "তা কি করতাম বলো? আধ ঘন্টা হয়ে গেল আমি এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু তুমি আসছো না। পাঁচ বার ফোনও করেছি তোমায়। কিন্তু একবারও ধরনি। তাহলে কি আমার চলে যাওয়াটা কি খুব অপরাধ হচ্ছিলো?"

জীভ কাটল ঈশিতা।


"সরি, সরি একদম ভুলে গেছিলাম। মোবাইলটা সকাল থেকেই সাইলেন্ট মোডে রয়েছে।" বলে কাঁধের ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। তারপর কয়েক সেকেন্ড ঘাটাঘাটি করে বলল, "বিশ্বাস করো এতে আমার কোনো দোষ নেই। আমি ঠিক সময়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মাঝ পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়লাম। না হলে কখন চলে আসতাম!"


মৃদু হাসল নবারুণ। বলল, "ঠিকাছে। এত পোক্ত অ্যালিবাই না দিলেও চলবে।" বলে ছোলা মাখার ঠোঙাটা এগিয়ে দিল। বলল, "নাও ছোলা খাও।"

ঈশিতা এক মুঠো ছোলা তুলে নিয়ে বলল, "সে খাচ্ছি। তবে আমরা কি এখানেই সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?"

নবারুণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "না না... তা কেন। বলো কোথায় যাবে?"


ঈশিতা ছোলা চিবোতে চিবোতে বলল, "বুদ্ধু আর কোথায় যাব! সামনেই এত সুন্দর একটা পার্ক রয়েছে। চলো ভেতরে গিয়ে বসি।"

"হুম চলো।"

মাথা ঝাঁকাল নবারুণ।

পার্কটা মোটামুটি ফাঁকাই। বিশেষ লোকজন নেই। কয়েকটা ছেলে মেয়ে জোড়ায় জোড়ায় এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। হয় গাছের তলায় অথবা ঝোঁপের আড়ালে। তবে তারা সকলেই যে যার গোপন প্রেমালাপে ব্যস্ত। বাহ্যিক জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন তারা। কয়েকটা নবীন যুবকদেরও দেখা গেল। বোধহয় কলেজ স্টুডেন্ট। কলেজ বন্ধ করে এখানে এসেছে আড্ডা দিতে।

ঈশিতা ‌"চলো ওইখানটাতে বসি" বলে একটা ছায়ায় ঘেরা বেঞ্চের উপর গিয়ে বসে পড়লো। নবারুণও একটু দূরত্ব রেখে সেখানটায় বসলো। তারপর ছোলা মাখার ঠোঙাটা তাদের দুজনের মাঝখানে নামিয়ে রেখে সামনের দিকে তাকালো। দুজনেই চুপচাপ। বোধহয় দুজনেই দুজনের কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে।

কিছুক্ষণ নীরব ভাবে বসে থাকবার পর ঈশিতা বলল, "ভালবাসা কি অদ্ভুত, তাই না!"

নবারুণ অবাক চোখে চাইল তার দিকে। বলল, "মানে?"


"ওদিকে দেখ।" বলে সে কিছুটা দূরে থাকা একটা মোটা গাছের হেলানো গুড়ির দিকে ইশারা করল। নবারুণও সেইদিকে মুখ ঘোরালো। দেখল দুজন মেয়ে নিবিড় ভাবে প্রকাশ্যে একে অপরকে চুম্বন করছে। দৃশ্যটা নবারুণের কাছে খুবই স্বাভাবিক হতে পারত যদি ওই চুম্বন ক্রিয়াটি একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে হতো। কিন্তু এতো দুজন মেয়ে! নিমেষের মধ্যে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, "ননসেন্স। এরা ভালবাসার অপচয় করছে।"

ঈশিতা প্রশ্ন করল, "কেন?"

নবারুণ বলল, "কেন আবার! দুজন সমান মানুষের মধ্যে আবেগ আসতে পারে কখনো?"

"কেন? পারে না?"

"না পারে না।"

তাচ্ছিল্য ভরে বলল‌ নবারুণ।

ঈশিতা ভ্রু কুঁচকে বলল, "আচ্ছা! তুমি এ পর্যন্ত তোমার কোন ছেলে বন্ধুকে আনন্দে বা মজার ছলে জড়িয়ে ধরনি কখনো?"

"হ্যাঁ বহুবার ধরেছি।"

"তাহলে তখন কেন লিঙ্গ বিচার করনি। আনন্দ, মজা - এগুলোও তো এক একটা আবেগ।"

"এটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।"

"না নবারুণ। সম্পূর্ণ নয়। কিছুটা আলাদা। তোমরা প্রেম করতে না কিন্তু এই মেয়ে দুটো করে। এইটুকুই। বাকিটা কিন্তু একদম এক।"

"দেখো আমি তোমার সঙ্গে কথায় কোনদিনই এঁটে উঠতে পারিনি। কাজেই আজও অহেতুক চেষ্টা করব না। তবে এটাই বলব সমকামীতা আমি ব্যক্তিগত ভাবে মোটেই পছন্দ করিনা। দেখলেই কেমন গা ঘিন ঘিন করে।"

ঈশিতা হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠলো। নবারুণের কাঁধে মৃদু চড় মেরে বলল, "বাবা! আগের‌ থেকে দেখছি মেজাজটা একটু বেশীই বেড়ে গেছে!"

নবারুণ একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলল, "সে তো তুমিও আগের চাইতে অনেকটা রোগা হয়ে গেছো। ভাল লাগছে না দেখতে।"

হাসিটা মিলিয়ে গেল ঈশিতার। কয়েক মুহুর্ত নবারুণের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "এই খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলোও তোমাকে মানাচ্ছে না নবারুণ। অতিরিক্ত প্রাপ্ত মনে হচ্ছে তোমাকে। তুমি আগে কখনোই দাঁড়ি রাখতে না! হঠাৎ..."

"সময়ের সাথে সাথেই অনেক কিছু পাল্টে যায় ঈশিতা। তবে সেই পরিবর্তনগুলো জীবাণুদের মতোই সুক্ষ্ম। গতিও ভীষণ মন্থর। তাই এদের কে দেখাও যায়না এবং অনুভবও করা যায় না।"

ঈশিতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কোন জবাব দিল না। নবারুণ ঈশিতার দিকে চেয়ে বলল, "শুনতে ভালো লাগলো না, তাই তো?"

ঈশিতা জোরে শ্বাস টেনে বলল, "না নবারুণ। তোমার কোন কথাই আজ আমার গায়ে লাগবে না। কেন জান? কারণ আজ আমি নিজেকে সেইভাবেই তৈরী করে এনেছি। আজ আমি প্রস্তুত তোমার সমস্ত রাগের দায় কাঁধে নিতে।"

"সে অবকাশ তুমি পাবে না।" নবারুণ ম্লান হাসল। বলল, "তাছাড়া তোমার উপর দায় চাপানোর আমি কে! সম্পর্কের বিচ্ছেদে অধিকার খালি এক তরফা হারায় না। তার চেয়েও বড় কথা তোমার উপর কোন রাগ নেই। তবে ছিল না তা নয়। ছিল। তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদের প্রথম ভাগে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছিলাম। তোমার প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা সবাই একসঙ্গে একই লহমায় মনের মধ্যে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছিলো। মনে হচ্ছিল হয় তোমায় মেরে ফেলি অথবা নিজে মরে যাই।"

শেষের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে বলল নবারুণ।

তারপর থামল ক্ষনকালের জন্য। ঈশিতার ভেতরটা হঠাৎ হু হু করে উঠলো। করুণ চোখে তাকিয়ে দেখল মাথা নীচু করে রয়েছে নবারুণ। তার ভীষন ইচ্ছা হচ্ছিলো নবারুণের ওই নত মাথাটিকে টেনে নিয়ে নিজের বুকে কাছে আশ্রয় দিতে। তবুও ইচ্ছেটাকে প্রশয় দিতে পারল না সে। কারণ নবারুণই বলেছে সম্পর্ক বিচ্ছেদে অধিকার খালি এক তরফা হারায় না। তাছাড়া সেই তো দায়ী এইসব কিছুর জন্য। সে ই তাদের সম্পর্কের ইতি টানতে চেয়েছিলো। কারণ! কি ছিল তখন নবারুণ? এখনকার মতনই অন্তঃসারশূন্য একটা জীব। যার গা থেকে মধ্যবিত্তের ছাপোষা গন্ধটা ছাড়া কিছুই বের হত না। তার চাইতে ওই লাখপতি ছেলেটার মুখ থেকে বেরনো সিগারেটের গন্ধটা ঢের মধুর ছিল। অন্তত তাতে অর্থের প্রাচুর্যটা ছিল অপরিমেয়। তাই আপোষটা তাকে নবারুণের সঙ্গেই করতে হয়েছিল। তবে তার চিন্তার ঘোরে বাঁধ সাধল নবারুণ। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী হলো না কিছুই। সমস্ত রাগ, বিদ্বেষ, ক্ষোভ - এই সমস্ত কিছুই আচম্ভিতে দমে যেতে আরম্ভ করলো।"

"এত কিছুর পরেও আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারলে?" প্রশ্ন করল ঈশিতা।

নবারুণ ঘার নেড়ে বলল, "আমি তো বলিনি যে, ক্ষমা করে দিয়েছি। হ্যাঁ রাগ হয়ত কমে গেছিলো। তবে ততদিনে কিন্তু অভিমানের একটা পুরু আস্তরন জমে জমে আমাকে ঘিরে একটা পাহাড় তৈরী করে ফেলেছিলো।"

"তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে আমিও কিন্তু সুখে নেই। বিশ্বাস করো। আমারও..."

বাকি শব্দগুলো গলার কাছেই জট পাকিয়ে গেলো ঈশিতার। যেন তার গলা থেকে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে। নবারুণ তাকিয়ে দেখল চোখ ছলছল করছে ঈশিতার। একটা মৃদু হাসি তার ওষ্ঠ যুগলকে স্পর্শ করে চলে গেল। কিন্তু সেই হাসির আঁচ সে ছাড়া আর কেউই টের পেল না। এমনকি তার পাশে অধিষ্ঠিত ঈশিতাও নয়। সে নিরুত্তাপ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে?"

ঈশিতা ঠোঁট দুটো চেপে নিয়ে একবার পলক ফেলে বলল, "শাস্তি হয়েছে। ভালবাসার শাস্তি।"

নবারুণ শ্লেষাত্ত্বক ভঙ্গিতে বলল, "অর্থের লালসাকে ভালবাসার নাম দিয়ে অকারনই ভালবাসাকে বদনাম করছো তুমি।" নবারুণের বাক্য বানে কিঞ্চিৎ আহত হলো ঈশিতা। ঝাঁঝাল গলায় বলল, "হ্যাঁ আমি তার টাকার মোহে অন্ধ হয়ে গেছিলাম। আমার সমস্ত বান্ধবীদের বয় ফ্রেন্ডরা তাদের নামি দামী রেস্তোরাঁতে নিয়ে যেত। বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতো। দামী গিফ্ট পেত তারা। কিন্তু আমার কপালে সেসব জুটতো না। কারণ তুমি সেগুলো এফোর্ট করতে পারতে না।"

তারপর গলার সুর একটু নরম করে বলল, "বিশ্বাস করো আমারও ওমন জীবন কাটাতে ইচ্ছা হতো। মনে মনে কল্পনাও করতাম অনেক। তারপর একদিন ওই ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হলো আমার। ধীরে ধীরে কথা বলে বুঝলাম একমাত্র এই পারবে আমার কল্পনাগুলোকে বাস্তবায়িত করতে। তাই আর লোভ সংবরণ করতে পারিনি। ঝুঁলে পড়েছিলাম তার গলায়। প্রথম প্রথম বেশ আনন্দই হচ্ছিলো। একের পর এক কল্পনাগুলো সত্যি হচ্ছে। নিজের বান্ধবীদের কাছে বেশ নাক উঁচু হয়ে গেছিলো আমার। কিন্তু একদিন সবকিছু ফিকে হয়ে গেল। যেদিন জানতে পারি আমি তার একা প্রেয়সী নই। আমি ছিলাম কেবলমাত্র একটি পন্য। যার‌ সঙ্গে সময়ও কাটানো যায় আবার তাকে ভোগও করা যায়।"

নবারুণ দেখল ঈশিতার দু চোখে কালো মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে। একটু বাদেই সেখানে অঝোরে বৃষ্টি নামবে। ঈশিতার ব্যর্থতায় সে অঘোষিত বিজয়ী বটে। তবুও মেয়েটার জন্য তার বড্ড মায়া হচ্ছিলো। তারতো খালি হৃদয় ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু ঈশিতা! সেতো একজন সর্বহারা ছাড়া আর কিছুই না। তার স্বপ্ন, সন্মান, মর্যাদা - সব আজ কলুষিত।

নবারুণ ঈশিতার কাঁধে হাত রেখে বলল, "কষ্ট পেওনা। জীবনের পরিহাসের কাছে আমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র।"

ঈশিতা সিক্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলো।

নবারুণ হেসে বলল, "চোখ মোছো। আসলে আমার কি মনে হয় জানো! জীবন‌ আমাদের অপরিহার্য অংশ হওয়া সত্বেও কখন সখন আমাদের অগোচরে সেই আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘোষণা করে। অসংখ্য মোহের মাধুরী দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বেশীরভাগ সময়ই মানুষের মন বিভ্রান্তির কাছে অপদস্থ হয়। যার ফলে আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে বিপাকে ফেলে দিই।"

ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, "তুমি ঠিকই বলেছ। আমি সেদিন বিভ্রান্তিতেই পড়ে গেছিলাম।" বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।

আচমকা একটা ঝোড়ো বাতাসে সমগ্র পার্কের পরিবেশটাই ভীষণ ঠান্ডা হয়ে গেলো। হঠাৎ করে একটা কাঠবেড়ালি পাশের গাছ থেকে সুড়ুৎ করে নেমে অন্যত্র পালিয়ে গেলো। নবারুণ সামনের দিকে চেয়ে দেখল সেই দুটো মেয়েদের মধ্যে একজন অপরজনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রয়েছে। আরেকজন কি যেন বলছে তাকে। মনে মনে ভাবল, সমকামী হোক আর যাই‌ হোক। দুজনেই তো আনন্দে আছে। নির্বিবাদে প্রেম বিনিময় করছে। তাদের মতো তো আর সম্পর্কহীন নয়। আজ ঈশিতা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তার পাশে বসে সুখ দুঃখের কথা বলছে - কেন বলছে? কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে বলছে? শুধু একজন প্রাক্তন হিসেবে? প্রাক্তন হওয়াটাও কি একটা সম্পর্ক? তার তো উচিৎ ছিল ঈশিতাকে আজ তীব্র ভর্ৎসনা করা, রাগ দেখান, তাকে এড়িয়ে যাওয়া! উচিৎ ছিল ঈশিতার দুঃখে সীমাহীন উল্লাস করা! আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়ে নিজের জয়ধ্বজা আকাশে ওড়ানো! কিন্তু সে পারেনি। তার সকল রাগ, কষ্ট, দুঃখ, অভিমান, আনন্দ এক নিমেষে বুকের মধ্যেই কোথাও জমে গেছে। তার হৃদয় বিগলিত হয়েছে বহুক্ষণ। দুর্বলতা তাকে কিছু হলেও গ্রাস করতে পেরেছে। কিন্তু কেন? সে কেবলই তার প্রাক্তন বলে? তার সাথে কোন একটা সময় গভীর হৃদ্যতা ছিল, এই কারণে? উত্তর জানা নেই নবারুণের।

নবারুণকে অন্যমনস্ক দেখে মৃদু ঠ্যালা দিল ঈশিতা। বলল, "কি ভাবছো তুমি?"

নবারুণ নির্বিকার ভাবে বলল, "না... কিছু না। আচ্ছা তুমি তো বললে না কেন আজ দেখা করতে চেয়েছিলে।"

"কেন? আমার সঙ্গ বুঝি আর ভাল লাগছে না?"

"সেটা কখন বললাম?"

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নবারুণ।

ঈশিতা হেসে বলল, "ওই আজ আসার কারণ জানার জন্য খুব উদগ্রীব হয়ে রয়েছে দেখছি।"

সসংকোচে নবারুণ হেসে বলল, "না তেমন কিছুই না। আসলে কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই ওটাই জিজ্ঞাসা করলাম।"

"আজ অন্তত তাড়া দিও না। একটু থাকতে দাও তোমার সাথে।"

নবারুণ বেশ বিস্মিত হলো। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, "কি হয়েছে বলোতো তোমার?"

"বড্ড প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে।"

মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলো ঈশিতা।

"কার?" ঈষৎ হেসে প্রশ্ন করল নবারুণ।

আবার ঈশিতা নবারুণের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, "তোমার।"

মুখে সুস্পষ্ট হাসি।

নবারুণের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এসব কি বলছে ঈশিতা! এই অপ্রত্যাশিত জবাবে সে সাময়িক দীর্ন হয়ে গেলো। হাসার একটা ব্যর্থ চেষ্টাও করলো। তারপর একটা কাষ্ঠ ঢোক গিলে যথা সম্ভব নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, "নিশ্চিত... তুমি মজা করছো।"

"না নবারুণ। শেষদিনে আমি তোমার সঙ্গে মজা করতে আসিনি।"

"শেষদিন!"

নবারুণের কথায় কর্ণপাত না করেই ঈশিতা বলে চলল, "আমার সত্যি তোমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। সমানুপাতিক অবহেলায় আমাদের মাঝে যে সম্পর্কের চাকাটা এতকাল ধরে থেমে রয়েছে তাকে আবার ঘোরাতে ইচ্ছে করছে। নতুন করে শুরু করতে ইচ্ছে করছে সবকিছু।"

এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে গেল সে। নবারুণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। ঈশিতার আসল অভিসন্ধি কি! কিছুতেই ধরতে পারছে না সে। মনের মধ্যে সুপ্ত আবেগগুলো আচম্ভিতেই চিন্তার সৈকতে আছড়াতে আরম্ভ করেছে। সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র মনটাই বোধহয় সংকুচিত হয়ে আসছে। বড্ড অসহিষ্ণু বোধ হচ্ছে তার।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "কি উন্মাদের মতো কথা বলছো তুমি!"

হাতের দমকে মুড়িয়ে রাখা ছোলার ঠোঙাটা নীচে পড়ে গেল।

ঈশিতাও দাঁড়িয়ে পরে বলল, "উন্মাদ বলো আর যাই বলো। আমি আমার ইচ্ছেটুকু জানালাম। বলো সবকিছু আগের মতো করা যায় না?"

নবারুণ গভীর সংকোচে পড়ে গেলো। কি উত্তর দেবে বুঝে পেল না। কিন্তু কিছু একটা তো বলা প্রয়োজন। ঈশিতা করুণ ভাবে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। শেষমেষ আর কিছু না ভাবতে পেরে "আমি জানিনা' বলেই ক্ষান্ত হল নবারুণ। একটা ভারী কিছু ক্রমাগত তার বুকের উপর চেপে বসছে যেন। ঈশিতা আলতো করে নবারুণের ডান হাতটা ধরলো। নবারুণের বুকের ভারটা যেন কয়েক গুণ আরও বেড়ে গেল। সে পালিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু তার পা সাথ দিচ্ছে না। যেন অনেক গভীর অবধি শিকড় বিছিয়ে দিয়ে বৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। তার হাতটা কাঁপছে। ঈশিতা স্মীত হাস্যে বলল, "এতো ভয় পাচ্ছো কেন তুমি? সেদিন তো ভয় পাওনি, যেদিন আমাকে প্রথমবার প্রোপজ করেছিলে এখানেই। আজ দেখো সেই ঈশিতা হয়েই তো এসেছি আবার। বলো আমাকে মেনে নেবেনা?"

নবারুণ প্রচন্ড বেগে মাথা নাড়ল। সেটাতে ঠিক হ্যাঁও হলো না আবার নাও হলো না। নবারুণের মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি দেখে ঈশিতা মুখ চেপে হাঁসতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন হাঁসার পর ধীরে ধীরে নবারুণের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, "ভয় নেই। আজ আমি ফিরব বলে আসিনি।"

নবারুণের বুকটা সামান্য হালকা হলো। একটা জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলল সে।

নবারুণের হাতটা ছেড়ে দিয়ে সে তার নিজের কাঁধের ব্যাগটাতে হাতড়াতে লাগলো। কয়েক মূহুর্ত পরে সে একটা লাল রঙের লম্বাটে খাম বের করে নবারুণের দিকে এগিয়ে দিল। সোনালী রঙের নক্সা কাটা খাম। নবারুণ নিরুদ্বেগ ভাবে জানতে চাইলো, "কি এটা?"

"আমার বিয়ের কার্ড।"

নবারুণের মুখটা কালো হয়ে গেলো শুনে। গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল, "তো তুমি আমাকে তোমার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে এসেছো?"

"আগে ধরো তারপর বলছি।"

নবারুণ কার্ডটা হাতে নিতে নিতে বলল, "যাই বলো। আমি কিন্তু তোমার বিয়েতে যাবো না।"

"আমি চাইওনা তুমি আসো।" দৃঢ় গলায় জানিয়ে দিলো ঈশিতা।

"তাহলে কেন দিচ্ছো আমায়?" প্রশ্ন করল নবারুণ।

ঈশিতা জবাবে বলল, "এই খামের ভেতরে কার্ড ছাড়াও আরেকটা জিনিস আছে।"

"কি আছে দেখি।" বলেই নবারুণ কার্ডের আচ্ছাদনটা খুলতে উদ্যত হলো।

ঈশিতা সঙ্গে সঙ্গে কার্ডটার উপর হাত রেখে বলল, "প্লিজ এখন খুলো না। আমি চলে গেলে দেখে নিও।"

'কিন্তু কি আছে বলবে তো।"

"বললাম না আমি চলে গেলে দেখে নিও। আপাতত ওটাকে তোমার ব্যাগের ভেতর রেখে দাও।"

নবারুণ তাই করলো। কোন কথা বাড়ালো না।

হঠাৎ করে ঈশিতার মোবাইলটা বেজে উঠতে সে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা ধরে বেশ বিরক্ত ভাবেই বলল, "আমি রাস্তায় আছি। পরে কথা বলছি... বললাম তো অতো কৈফিয়ৎ আমি দিতে পারবো না। আমাকে বিরক্ত করোনা। রাখো।" বলে ফোনটা কেটে দিয়ে মুখ গম্ভীর করে বেঞ্চের উপর বসে পড়লো। নবারুণও বসে পড়ে জিজ্ঞেস করল, "কি হলো আবার?"

ঈশিতা রাগত স্বরে বলল, "ওভার পজেসিভ ছেলে আমার একদম পছন্দ নয়। যতই সে আমার হবু স্বামী হোক তাকে সব কথার কৈফিয়ৎ দিতে হবে! নিজের স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই?"

"ভালবাসে তাই খেয়াল রাখে।" নবারুণ বলল।

ঈশিতা তাচ্ছিল্যের সহিত মুখ দিয়ে একটা হু শব্দ করলো।

নবারুণ জিজ্ঞেস করল, "সে জানে যে, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?"

ঈশিতা ঘার নাড়ালো। "না"

"যদি জানতে পারে? তখন কি বলবে?"

"সে গুড়ে বালি। সেই সুযোগটা সে পাবেই না।"

"তাই!" একটা শুকনো হাসি দিলো নবারুণ।

ঈশিতার মোবাইলটা ফের বেজে উঠলো। আবার তার মুখে বিরক্তির ছাপ। বেশ অবহেলার সঙ্গে ফোনটা কেটে দিয়ে বলল, "এবার বোধহয় আমাদের আজকের এই সাক্ষাতের উপসংহার টানার সময় হয়ে গেছে।

নবারুণ মৃদু ঘার দুলিয়ে বলল, "হয়তো।"

ঈশিতা বলল, "তুমি জানতে চেয়েছিলে না, আমি আজ কেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলাম! আসলে তোমার সাথে যতদিন আমার সম্পর্ক ছিল ততদিন আমি আমার জীবনের সব চাইতে ভালো মূহুর্তগুলো কাটিয়েছি‌। স্বীকার করতে কোন আক্ষেপ নেই। তাই আজকের দিনটাও তোমার সঙ্গেই কাটাতে চেয়েছিলাম।"

"আজকের দিনটাই কেন?" জানতে চাইলো নবারুণ।

"আজ আমার শেষদিন তাই।"

এই 'শেষদিন' শব্দটা খালি কানে নয় নবারুণের চিত্তকেও বিকট ভাবে ধাক্কা মারলো। সে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, "শেষদিন? তার মানে?"

ঈশিতা একটা চওড়া হাসি দিয়ে বলল, "আরে বুদ্ধু। আগামীকালই আমার বিয়ে।‌ তো হিসেব মতো আজ আমার ব্যাচেলর লাইফের শেষদিন হলো না!"

"ও তাই বলো।" নবারুণ একটু স্বস্তি পেলো।

ঈশিতা ধীর গলায় বলল, "থ্যাঙ্ক ইউটা তোমাকে কোনদিনই বলা হয়নি। হয়তো প্রয়োজনই কখনো পড়েনি। তবে আজ বলতে চাই। আমার অতীতের জন্য, আমার বর্তমানের জন্য, এমনকি আমার ভবিষ্যতের জন্য অনেক অনেক থ্যাঙ্ক ইউ তোমাকে। জানি অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার কারণও তোমায় জানিয়েছি। সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিও। তা নাহলে অভিমানেই না হয় মনে রেখো।

মৃদু হেসে বলল, "না হয় দিনরাত আমাকে গাল দিয়েই আমার মুন্ডুপাত করো। আপত্তি নেই তাতে। কিন্তু একেবারে ভুলে যেওনা। তবে সবচেয়ে বড়ো কথা ভালো থেকো নবারুণ। আশা করি যে ক্ষত আমি তোমাকে দিয়েছি। তোমার জীবন সঙ্গী যেন তা পুরোপুরি মলীন করে দিতে পারে। আমার ভেতরের ক্ষত আর সারবে না বুঝলে! আমি চলি।"

বলেই সে তার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করলো। নবারুণ হঠাৎ পেছন থেকে বলল, "তাহলে কি আর‌ কোনদিন দেখা হবে না?"

ঈশিতা থমকে গেলো। তার চোখ প্রচন্ড ভারী হয়ে আসছে। কয়েক‌ মূহুর্ত স্তম্ভিত থেকে ঈশিতা নিজেকে আর সামাল দিতে পারলো না। কাঁধের ব্যাগটাকে সটান ঘাসের উপর ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে সে নবারুণকে জড়িয়ে ধরলো। পরক্ষনেই আবেগের নোনা জলে ভিজে গেলো নবারুণের পাঞ্জাবি। নবারুণও তার দুই বাহুর মাঝে ঈশিতাকে আগলে নিলো।

ইতিমধ্যেই নবারুণের শরীরে প্রবল গতিতে ঝড় উঠেছে। অসীম ঝড়ের দাপটে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। উন্মাদের মতো ছিটকে পড়ছে শিহরণ শরীরের এ‌ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তাদের এইরূপ আচরণে, বিশেষত ঈশিতার কান্নার শব্দে পার্কে উপস্থিত সকলেই তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও তাদের আলিঙ্গনে কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। তারা বিহ্বল হয়ে রয়েছে একে অপরের প্রতি। সম্পর্কে থাকাকালীন তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছে বহুবার। কিন্তু এই আলিঙ্গনের আস্বাদ যেন সম্পূর্ণ আলাদা। এর গভীরতাও অনেক। নবারুণের চোখও সিক্ত হয়ে উঠলো। ঈশিতাকে যে ছেড়ে দিতে হবে। কেন? এটা কেমন পরিহাস ঈশিতার? যদি যাওয়ারই ছিলো তবে কেন সে ক্ষনিকের জন্য ফিরে এলো আবার! আর রাগ করে ঈশিতাকে দূরে ঠেলে দিতে পারছেনা সে। তার মননে গ্রহণ লেগেছে। এমতাবস্থায় সে এটা বাস্তবিক উপলব্ধি করতে পারলো যে, প্রাক্তন হওয়াটাও একটা সম্পর্ক। যার অসংলগ্ন সান্নিধ্যের সংলগ্নে বেদনাও ওত পেতে থাকে। যা নিতান্তই প্রহসন।

আচমকাই নবারুণের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ঈশিতা। দু পা পিছিয়ে গিয়ে চোখ মুছে বলল, "হ্যাঁ তোমাতে আমাতে আর কোনদিনই দেখা হবে না। তাই আমাকে বিদায় দাও। আর পিছনে ডেকো না। আমার এই শেষদিনের বাকি দিনটুকু নিজের মতো করে কাটাতে দাও একটু।"

নবারুণ দু পা এগিয়ে এসে দৃঢ় কন্ঠে বলল, "যদি ফেরারই ছিল তবে আগেই তো ফিরতে পারতে।

চিরকালের মতো।"

"তাহলে এই অনুভূতিটা থেকে সারাটা জীবন বঞ্চিত রয়ে যেতাম যে।"

"কিন্তু ঈশিতা..."

"চুপ করো। আর একটাও কথা নয়। আমার দিব্যি।"

নবারুণ সত্যিই আর কিছু বলল না।

ঈশিতা ধীরে ধীরে তার ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, "ভাল থেকো নবারুণ। খুব ভালো থেকো।"

বলেই সে পার্ক থেকে চলে গেলো।

নবারুণ অস্ফুট স্বরে বার কয়েক তার নাম ধরে ডাকলো ঠিকই। কিন্তু ঈশিতা একবারও আর ফিরে তাকালো না। চোখের সামনে থেকে ঈশিতার অবয়বটা আসতে আসতে মিলিয়ে যেতেই সে ধপ করে বেঞ্চের উপর বসে পড়লো। তার সামনের সেই মেয়ে দুটো আর নেই। কিছুক্ষণ আগেই তারা চলে গিয়েছে। তবে পার্কের পরিবেশ পূর্বের চেয়ে অনেকটাই গমগম করছে। অনেক নতুন নতুন মুখের আগমন হয়েছে চারিদিকে যা সে একদমই খেয়াল করেনি। আর করলেই বা কি? সে তো একা। তার মানসিক অবস্থা বোঝার দায় তো আর কারোর নেই! এ তাকেই বইতে হবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুমূর্ষের মতন গা এলিয়ে দিলো‌ নবারুণ। কয়েক মূহুর্ত এমনি করেই পড়ে থাকবার পর হঠাৎ সে শিড়দাড়া টান করলো। মনে পড়ল ঈশিতার বিয়ের কার্ডটির কথা। চকিতে ব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করে নিলো সে। খামের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা কার্ডটা খুবই সাধারণ। যেমনটা সচরাচর হয়ে থাকে। কিন্তু সেই খামে কার্ড ছাড়াও আরেকটা সাদা মোড়ানো কাগজ চোখে পড়লো তার। কাগজটা খুলতেই বুঝলো সেটা ঈশিতার নিজের হাতে লেখা একটি ছোট্ট চিঠি।নবারুণ আর সময় ব্যয় না করে সেটা পড়তে আরম্ভ করলো।

নবারুণ,

      

       চাইলেই তোমার নামের পাশে প্রিয় শব্দটা যুক্ত করতেই পারতাম। কিন্তু তাতে কিছুই প্রমান হতো না। আর আমি পরিমাপের প্রমান দিতেও ইচ্ছুক নই। তাই এই ব্যাপারে কিঞ্চিৎ মূর্খই সাজলাম। তুমি সর্বদাই আমার কাছে প্রিয় ছিলে। যদিও আমার পূর্বেকার ব্যবহারে তা নাও মনে হতে পারে। কেন সেই ব্যবহার? সেটা হয়তো এতক্ষণে জেনে ফেলেছ। আগামীকাল যে আমার বিয়ে সে খবরও নিশ্চয়ই এতক্ষণে পেয়ে গেছো। তবে কি! বিয়েটা আমি করছি না। তুমি নিশ্চিত থেকো। তার চেয়ে আমি প্রায়শ্চিত্ত করাতেই বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করছি।

প্রথমে খুব দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলাম তোমাকে ফোন করা নিয়ে। এতদিনের ব্যবধান। বুঝতে পারছিলাম না তোমার কেমন প্রতিক্রিয়া হবে! শেষমেষ করেই ফেললাম। তারপর যা যা কথা হয়েছে সে তো তুমি জানোই। তবে আমি যেটা জানিনা আজ আমার আর তোমার মধ্যে কি হবে কি না হবে! ভীষন রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে। এতদিন পর তোমার মুখোমুখি। যাই‌ হোক না কেন। তুমি আসবে, তোমায় আরও একবার দেখতে পাবো, হয়তো কোন একটা অজুহাতে তোমায় শেষবারের মতন স্পর্শ করতে পারবো - এই সামান্য ব্যাপারগুলোতেই তো আমি খুশী। শুধু চাই আজকের গোটা দিনটা যেন আমার পরিকল্পনা অনুযায়ীই অবধি হোক।

দিন ফুরানোর আগেই শেষ হোক আমার শেষদিন।

আর বেঁচে থাক তোমার সভ্যতা।

                                               ইতি,

                                         তোমার প্রাক্তন

                                               ঈশিতা

চিঠিটা পড়া মাত্রই কপালে ভাঁজ পড়লো নবারুণের। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো সে। ঈশিতা কর্তৃক লিখিত এই চিঠিখানির মর্ম কিছুতেই গোচরীভূত হচ্ছে না তার। ঈশিতা প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় কেন? আর কিভাবেই বা করবে সে? তার থেকেও বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করছে চিঠির শেষ দুটো লাইন। যেটা নিয়ে নবারুণ রীতিমতো ধন্দে পড়ে গিয়েছে। কথাগুলো কি খুবই সাধারণ? একেবারে অপ্রাসঙ্গিকও তো মনে হচ্ছে না তার যে, উপেক্ষা করবে। যদি কথাগুলোর নেপথ্যে অন্য অর্থ লুকিয়ে থাকে? এই সকল চিন্তা যখন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তখনই আচম্ভিতেই তার চেতনায় একটা চমক খেলে গেলো। নিমেষের মধ্যে সংশয়ের কালো মেঘ তাকে ঘিরে ফেলেছে। সে ব্যস্ত সমস্ত হয়েই চিঠিটাকে পাশে রেখে ঈশিতাকে ফোন লাগালো। সেই অচেনা নম্বরটিতে। কল কানেক্ট হতে সময় নিচ্ছে। আজ বোধহয় একটু বেশিই সময় নিচ্ছে। বিরক্ত লাগছে নবারুণের। তার যেন তর সইছে না আর। কানে মোবাইল নিয়ে অসহিষ্ণুর মতো পায়চারি করে যাচ্ছে। কয়েক মূহুর্ত পরেই ওপাশ থেকে একটি যান্ত্রিক মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে এলো। স্পষ্ট ভাষায় জানান দিলো, তার দ্বারা ডায়াল করা নম্বর বর্তমানে স্যুইচ অফ আছে। নবারুণ তবু হার মানলো না। বারবার ঈশিতাকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলো।

তবে সেদিন আর ঈশিতার সাথে কথা হয়নি নবারুণের। এমনকি আর কোনদিনই না।


Rate this content
Log in