Ajobdeep Bromho

Tragedy Inspirational Thriller

3  

Ajobdeep Bromho

Tragedy Inspirational Thriller

অপত্য লাভ

অপত্য লাভ

41 mins
395


(১)


আপনারা শুনতে পারছেন? একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। খুব ক্ষীণ। বোধহয় শুনতে পারছেন না। কারণ ব্যাপারটা একতলার একটা ঘরের মধ্যে ঘটছে। আর আমি ন্যাড়া ছাদের একদম ধারে বসে মনের সুখে পা দোলাচ্ছি। এই দোতলার ছাদটা সদ্য তৈরী হয়েছে। কাজ এখনও অনেকটা বাকি। পাঁচ বছর আগে আমি যখন এ বাড়িতে প্রথমবার বিয়ে করে আসি তখন কিন্তু এই ছাদটা ছিল না। ওই যে একতলাটা দেখছেন ওখানেরই একটি মাঝারি ঘরে আমার বউ হিসেবে ঠাঁই হয়েছিল। দত্ত পরিবারের বড় বউ। লতিকা দত্ত। তখন আমার বয়স মোটে ছাব্বিশ। রূপ মোটামুটি। তবে গায়ের রং ঢালবার ক্ষেত্রে ঈশ্বর বোধ করি একটুও কার্পণ্য করেননি। বোধহয় রঙের ছটা দেখেই আমার শ্বশুড় মশাই দূর্গাচরণ দত্তের আমাকে ভীষণ মনে ধরে। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর ছেলে নীতিশের সঙ্গে আমার বিবাহ পাকা করে ফেলেন। নীতিশ ছেলেটা এমনিতে ভালই। পোষাক আশাকের ব্যাপারে রুচিশীল। এমনকি একটি বহুজাতিক সংস্থায় মোটা বেতনের চাকরিও করে। তবে আমার কিন্তু এই বিয়েতে মত ছিল না। গায়ের রঙের বৈপরীত্যতে আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের পক্ষে বেঁকে বসাটা ভার। ওই একটা প্রবাদ আছে না, সোনার আংটি বাঁকাও ভাল! ব্যস্! ওতেই সব কাল হল। কালো তো কি হয়েছে, রূপই কি আসল নাকি, পরিবারটা ভাল, মোটা বেতন - এই সমস্ত কথায় জর্জরিত করে বাবা মা দুজনেই আমায় বিয়ের পীড়ি অবধি ঠেলে দিল। তার পরের ঘটনাগুলি ঘটাতে আর বেগ পেতে হয়নি। শ্যাওলায় পা পিছলিয়ে যাওয়ার মতনই একেবারে ফুলসজ্জার খাট অবধি গিয়ে হরকে পড়েছিলাম। প্রথম কয়েকদিন ভীষণ কষ্ট হয়েছে জানেন। নীতিশ যখন আমায় ছুঁতো আমার ভেতরে কেমন কেমন অস্বস্তি হত। ওর লালাসিক্ত ঠোঁট যখন আমার ঠোঁটের উপর ঘন হয়ে বসতো প্রচন্ড ঘেন্না পেতাম মনে মনে। এমনকি... এমনকি সামাজিক অধিকারে যখন ও আমার নিরুত্তাপ যোনীতে ওর পুরুষত্বের অধিকার ফলাত তখন ওকে ধর্ষক বলে মনে হত আমার। ভাল লাগত না। ইচ্ছে হতো সব ছেড়ে দিয়ে আমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাই। নিজের - সত্যি বলতে বিয়ের পর এই শব্দটাকে আমার এক নিঠুর পরিহাস বলে মনে হয়। যে বাড়িতে প্রথম পায়ের ছাপ পড়ল, ছাব্বিশটা বছর যে বাড়িতে অতিবাহিত করলাম, বাবা মা জানিয়ে দিল সেটা নাকি আর আমার নিজের বাড়িই নয়। সারাদিন উপবাস করে, শাস্ত্রে লিখিত একাধিক নিয়ম কানুন মেনে একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে যে বাড়িতে এলাম এখান সেটাই নাকি নিজের। ভাবলেও হাসি পায়। এই স্বামী নামক বস্তুটির ইচ্ছেতেই নাকি আমার বাকি জীবনের কর্ম। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তাই চক্ষু লজ্জার ভয়ে, নিজের মা বাবার সম্মানহানির ভয়ে ছেড়ে চলে যেতে পারিনি। সয়ে গিয়েছিল সব ধীরে ধীরে। মানে সয়ে নিতে হয়েছিল আর কি! তবে একটা কথা আমার শ্বশুড় বাড়িটি কিন্তু বেশ কপাল করেই পেয়েছি। শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুজনেই অত্যন্ত অমাইক। ছোট দেওর এবং ননদ প্রচন্ড সমীহ করে আমায়। বিয়ের বছর দেড়েক পরেই ননদের বিয়ে ঠিক হয়। বিরাট ধুমধাম করে তাকে শ্বশুড় বাড়িতে বিদায় করে দেওয়ার পর পরই আমরাও এই বাড়ি থেকে বিদায় নিই। নীতিশের ব্যাঙ্গালোরে বদলী হয়ে যায়। সেখানের এক দু কামরার ফ্ল্যাটে আমাদের আপাতত স্থান হয়। নতুন করে আবার সংসার সাজানো। বলা বাহুল্য ততদিনে আমি নীতিশের সঙ্গে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু অভ্যস্ত হলেই তো আর সবকিছু হয়ে যায় না। প্রকৃতি আমাকে অপত্য লাভ থেকে বঞ্চিত রাখল। দক্ষিণী শহরে একের পর এক বড় বড় ডাক্তারদের দ্বারস্থ হলাম। তাতেও সন্তান প্রাপ্তি আমার কপালে জুটল না। প্রথমে নীতিশ কিন্তু বেশ সহমর্মিতা দেখাত‌। কিন্তু পরে বাজা মেয়ে ছেলে বলে গঞ্জনা দিতে আরম্ভ করল। রাতে মাতাল হয়ে পা টলিয়ে বাড়ি ফিরে নির্যাতন করা খুব স্বাভাবিক লাগতে লাগল আমার কাছে। দু বছর আগে আমার ননদের ছেলে হয়েছে। আর সেই খবরই বোধ করি নীতিশের দুর্ব্যবহারকে আরও সম্পৃক্ত করে তোলে। কষ্টে আর চোখে জল ধরে না আমার। মরতে ভয় পাই তাই নিজেকে শেষ করতে পারিনি এই যা। আমার কি মনে হয় জানেন, হতভাগ্য মানুষদের মনটা বোধহয় দাহ্য তরলের মতনই সংবেদনশীল হয়। একটুখানি স্ফুলিঙ্গেই ঈর্ষার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আর সেই আগুনই পারিপার্শ্বিককে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। আমিও তাই করেছি। নিজের ননদের প্রতি আমার লেলিহান ঈর্ষার পরশে সমস্ত আনন্দ ভস্মীভূত করে দিয়েছি।

'আনন্দ' শব্দটা কেন ব্যবহার করলাম, তার নেপথ্যেও এক বিরাট তাৎপর্য আছে। বর্তমানে বাড়ির যা পরিস্থিতি তাতে এই 'আনন্দ' শব্দটাই বিশেষ করে খাটে। নব নির্মিত দোতলা থেকে রঙিন সুরু এল. ই. ডি. লাইটের চেইন ঝুলিয়ে সমগ্র বাড়িটিকে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। গেটের সামনে মস্ত এক কৃত্রিম ফুলের তোরণ বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে অবধিও আধুনিক হিন্দি গানের সুর ছোট্ট সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসছিল। তবে এখন সানাইয়ের ধ্বনি ঝংকৃত হচ্ছে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। এ বাড়িতে বিয়ের মরসুম চলছে। আমার ছোট দেওর নিখিলের বিয়ে আজ।


(২)


বছর খানেক আগে ব্যাঙ্গালোরে থাকাকালীনই নিখিলের জন্যে যে পাত্রী দেখা হচ্ছে তা জানতে পেরেছিলাম। একদিন হঠাৎ খবর পাই দূর্গা চরণ বাবু অর্থাৎ আমার পূজনীয় শ্বশুড় মশাই নিখিলের বিবাহ পাকা করে ফেলেছেন। হবু বউয়ের ছবিও আমাদের কাছে পাঠানো হল। একজন মেয়ের পক্ষে আরেকজন মেয়ের প্রসংশা করাটা বোধহয় খুবই অস্বস্তিকর। তাই অতি সংক্ষেপে সুশ্রী বলে কাটিয়ে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তবে আমার লম্বা চওড়া শ্যামবর্ণ দেওয়ের সঙ্গে যথেষ্ট মানানসই। মাঘ মাসের প্রারম্ভে অর্থাৎ ইংরাজির জানুয়ারীর মাসে বিবাহ সম্পাদনের দিন ঠিক করা হয়।

সময় যেন তরলের মতনই বয়ে গেল। দিন রাতের ঘুর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে একটা গোটা বছর পেরিয়ে গেল। চলে এল কলকাতায় ফেরার দিন। নীতিশের ছুটির ব্যাপারে অফিসে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তাই বিয়ের নির্ধারিত দিনের মোটে তিনদিন আগে আমি আর নীতিশ ব্যাঙ্গালোর থেকে ফ্লাইটে করে কলকাতায় চলে এলাম। একসাথে এলাম বটে তবে স্বামী স্ত্রী সুলভ আচরণটা একেবারেই হল না। আমি একটু উদারতা প্রকাশ করলেও নীতিশ যেন পুরো বিষয়টাই নির্মমের মতন দাবিয়ে রাখলো। একজন অজ্ঞাত যাত্রীর মতনই সমগ্র রাস্তাটা মুখ থমথমে করে রইল। প্রয়োজনাতিরিক্ত একটি শব্দও সে খরচ করল না। অবশ্য তাতে আমার কোন আক্ষেপ নেই। তবে কিঞ্চিত উদ্বিগ্ন ছিলাম বৈকি। আমাদের দাম্পত্য জীবন প্রবাহের এই আভ্যন্তরীণ বৈকল্যতা যদি আমার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়েরা, বিশেষ করে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঘুনাক্ষরেও আঁচ পান তাহলে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। তবে সেসব কিছুই হল না। বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখা ইস্তক উদ্বেগের সকল জালিকা ছিন্ন হয়ে গেল। বাড়ির অন্দর গমগম করছে। বহু আত্মীয়-স্বজনদের সতত কোলাহল, হই হুল্লোড়। বেশ সাদরেই গ্রহণ করে নিল আমায়। মনের বিষন্নতাও চকিতে ধাঁ হয়ে গেল। শ্বশুর মশাই বাড়ি ছিলেন না। কাজেই শ্বাশুড়িকে অধোবদনে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে নিজেদের ঘরে চলে এলাম।


ঘরটা আগের মতনই আছে। যেমনটা ফেলে গিয়েছিলাম। খালি দেওয়ালের রঙটা বদলিয়ে গিয়েছে। সবুজের জায়গায় আকাশি রঙটা সুন্দর ভাবেই প্রতিভাত হচ্ছে এখন। খাটের একটা পাশে আমাদের লাগেজটা ঢাই করে রাখা। শীতের বেলায় সন্ধ্যেটাও ঝুপ করে নিঃশেষ হয়ে যায়। ঘরের জানালাটা বন্ধ। তাই বাইরের হিমেল রাত্রিটাকে অনুভব হচ্ছিল না। বোধহয় জার্নির ধকলের জন্যই শরীরে বড্ড ক্লান্তি বোধ হচ্ছিল। তাই গরম জলে স্নান সেরে শীতল বিছানায় দেহ বিছিয়ে দিতেই নিঃসাড়ে ঘুম চলে এলো। হঠাৎ একটা ঠক ঠক শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মৃদু টোকা পড়ছে দরজায়। বাড়ি ভর্তি লোকজন।বয়জ্যেষ্ঠ মানুষের আধিক্যও অনেক। তাই নাইটি পড়বার বাসনাকে নিবৃত্ত করে একটি মেরুন তাঁতের শাড়ি পড়েই শুয়েছিলাম। কোন ক্রমে ব্লাঙ্কেটের উষ্ণতা থেকে নিজেকে উন্মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম। এরপর শাড়ির অবস্থান ঠিকঠাক করে দরজাটা খুলে দিলাম। খুব মৃদু শব্দে দরজাটা নব্বই ডিগ্রী ঘুরে যেতেই চকিতে একটি হাঁসির প্রতিফলন আমার দিকে ছিটকে এল। অনুক্ষণ আমার সারা শরীর রি রি করে উঠল। ওপাশে নিলীমা দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে অত্যন্ত সৌজন্যমূলক হাসি। নিলীমা আমার ননদ। আমায় দেখে এক প্রকার চিৎকার করেই উঠল। বৌদি! কেমন আছো?

ভাল আছি। আমি ম্লান হেসে জবাব দিলাম। লক্ষ্য করলাম সে একা। ছেলে সাথে নেই।

নিলীমা ফের জিজ্ঞেস করল, কখন এলে তোমরা?

এইতো বিকেলের দিকে। আলগা করেই উত্তর দিলাম। তারপর একটা কপট হাসি টেনে বললাম, এসো ভেতরে এসো।

আমি একটু সরে দাঁড়াতেই ও নির্লজ্জের মতনই ঘরে ঢুকে পড়ল। নিলীমা হয়তো তার বড় বৌদির ঘরে ঢুকছে - এই অধিকার নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করেছে। তবুও আমার কাছে কেমন নির্লজ্জের মতনই ঠেকল। বোধহয় বিছানার অবস্থা দেখেই সে খাটের উপর বসে বলল, ঘুমাচ্ছিলে বুঝি!

ওই আর কি। খুব ক্লান্ত লাগছিল তাই শুয়ে ছিলাম একটু। বলতে বলতে আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম।

নিলীমা কিঞ্চিত বিনয়ের সুরে বলল, এ বাবা! তাহলে তো তোমার ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিলাম। আসলে তুমি এসেছ শুনে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলাম না।

আমি ঈষৎ হাসলাম। না তেমন কিছুই না। তোমরা কেমন আছো?

এই যেমন দেখছো। ঠিকঠাক। শিশু সুলভ উত্তর দিল নিলীমা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কখন এলে?

এই তো সবে এলাম। দেখছো না এখনও শাড়ি পর্যন্ত ছাড়িনি।

এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি নিলীমা তুতে রঙের একটা শিফনের শাড়ি পড়ে রয়েছে। না‌ অতি কালো গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে তাকে। তার শাড়ির উপরই চোখ রেখে শুধালাম, তোমার ছেলে কেমন আছে? তাকে দেখছি না যে।

এমনি ভাল আছে। তবে প্রচন্ড ঠান্ডার ধাত। একটুতেই জ্বর সর্দি কাশি বাঁধিয়ে বসে। এই তো ক'দিন আগেও তো ওর শরীরটা ভাল ছিল না।

তাহলে একটু সাবধানে রেখো। তোমার বর কোথায়? সেও কি বাইরে নাকি?

নিলীমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর বলো না। তোমাদের জামাইয়ের আর লগন বয় না।

কেন?

বাবু নাকি ছুটি পাচ্ছেন না অফিস থেকে। বলে কয়ে তিনদিন খালি ছুটি পেয়েছে। বিয়ের দিন একেবারে আসবে ও। তাই আমি আগে ভাগে আজ চলে এলাম। আমি এই বাড়ির মেয়ে। তার উপর আমার ছোড়দার বিয়ে বলে কথা। নিমন্ত্রিতদের মতন বিয়ের দিন আসব, তা দেখতে ভাল লাগে বলো?

নিলীমা একটানা কথাগুলো বলে থামল। বেশ স্নিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বোধহয় তার কথার সম্মতি চাইছে। আমি মৃদু ঘাড় নেড়ে তার কথায় সায় দিলাম। বেশ করেছ। চলো বাইরে যাই। হওয়ার পরে তো তোমার ছেলেকে সামনা সামনি দেখিইনি।

হ্যাঁ চলো।

নিলীমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও তার পিছু পিছু বের হলাম।


ড্রয়িং রুমে গল্পের আসর বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। নানাবিধ গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন আত্মীয় এবং গুটি কয়েক প্রতিবেশীরা বোধহয় বিয়ের ব্যাপারেই কথাবার্তা বলছে। আমি সেখানে আসতেই সকলের দৃষ্টি যেন স্পটলাইটের আলোর মতনই আমার উপর এসে পড়ল। আমি অপ্রতিভ তাদের দিকে চাইলাম। উপবিষ্ট সকলেই আমার চেনা। শ্বশুর মশাই দূর্গা চরণ বাবু একটা একক সোফার উপর বসে। মাথায় মসৃণ পাকা চুল। গায়ে ধবধবে ফতুয়ার উপর ধূসর বর্ণের আলোয়ান। চেহারায় জমিদার সুলভ একটি ভাব। বাকিরা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছেন। কেউ কেউ সোফার উপর আবার কেউ কেউ শতরঞ্জির উপর। তবে নিতীশ এবং নিখিল কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভিড়ের মধ্যে থেকেই একজন প্রৌঢ়া বলে উঠলেন, ওই তো বড় বউমা এসে পড়েছে। আমি তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খানিক হাসলাম। তারপর শ্বশুর মশাইয়ের দিকে গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে অধোবদনে প্রনাম করলাম। দূর্গা চরণ বাবু সস্নেহে মাথার উপর হাত রাখলেন। সুখে থাকো মা। আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?

না বাবা। আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, আমি এসেই মায়ের কাছে আপনার খোঁজ করেছিলাম। আপনি বাড়ি ছিলেন না।

হ্যাঁ আমায় একটু বেরতে হয়েছিল মা।

আমি মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত সকল গুরুজনদের প্রতিও অনুরূপ প্রনাম সাড়লাম। পাছে কাউর আত্মসন্মানে না লাগে। নিলীমা ততক্ষণে সোফার একটি স্থানে উপবিষ্ট হয়ে পড়েছে। আমাকে উদ্দেশ করে বলল, আমার ছেলেকে দেখেছ?

কোথায়? না তো।

ওই তো মায়ের কোলে কেমন বসে আছে।

আমি এবার লক্ষ্য করলাম। এক ফোঁটা তরুণ প্রান শ্বাশুড়ি মায়ের কোলে বসে। দু হাত মুখের ভেতর। লালা রসে ধুয়ে গিয়েছে কব্জি পর্যন্ত। গায়ের রং মোটেই কালো নয়। অনেকটাই ফর্সার দিকে। শ্বাশুড়ি মা শতরঞ্জির উপর বসে ছিলেন। আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট্ট বলের মতন কোমল মুখখানি দেখতেই ননদের প্রতি আমার অব্যক্ত ঈর্ষা যেন নিমেষে উধাও হয়ে গেল। শ্বাশুড়ি মা আদো আদো করে আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে বললেন, এই দেখ কে এসেছে! বড় মামী এসেছে।

আমি তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ছোট্ট করে দু হাত বাড়িয়ে দিলাম। এসো এসো।

বাচ্চাটা নির্বিকার আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এবার তাকে কোলে নেওয়ার জন্য দু বগলে আঙ্গুল গলিয়ে দিতেই বাচ্চাটা বিশ্রী রকম সুর করে কেঁদে উঠল। ওরে বাবারে কি হল? মামী তো এটা বলে শ্বাশুড়ি মা তাকে ক্ষান্ত করবার জন্য দাপাদাপি করতে আরম্ভ করলেন। সয়ংক্রিয়ভাবেই প্রসারিত হাত দুটি আমার নিজের দিকে ফিরে এল। ভীষন ক্ষুন্ন হলাম মনে মনে। নিজের ক্লিষ্ট ভাগ্যের প্রতি একটা রাগ বিচ্ছুরিত হল। একটা ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে তার গায়ের কচি গন্ধটাকে ঘ্রান করারও অধিকার যেন প্রকৃতি আমাকে দেয়নি। নিলীমা সোফা ছেড়ে উঠে এলো। মাকে দেখতে পেয়েই বাচ্চাটা নিলীমার দিকে কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়াল। তাকে কোলে নিয়ে সে বেশ কয়েকবার ও ও করে মৃদু পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, কিছু মনে করোনা। ও আসলে তোমায় কখনও দেখেনি তো তাই...

আমি কি ওইটুকু বাচ্চার ওপর অভিমান করে থাকব! তাকে থামিয়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি নাম রেখেছো ওর?

অনির্বাণ।

ক্রমেই অনির্বাণের কান্নার বেগ থেমে এল। দেখলাম সে তার মায়ের কাঁধেই মাথা রেখে নুইয়ে পড়েছে। নিলীমা বলল, তুমি বসো বৌদি। আমি ওকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসি। আমি সোফাতে বসে পড়লাম। দূর্গা চরণ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, বৌমা! ব্যাঙ্গালোরে সব ঠিক আছে তো? থাকতে কোন অসুবিধা হয় না তো?

না বাবা। আপনাকে তো কতবার করে বললাম মাকে নিয়ে এসে ক'দিন ওখানে থেকে যান।

আর যাব যাব করে যাওয়াই হয়ে ওঠে না। তবে এবার নিশ্চয়ই যাব। ছোটটার বিয়ে হয় যাচ্ছে। ওর খেয়াল রাখার জন্য একজন এসে যাবে। ব্যস! এবার কর্তা গিন্নিতে মিলে তোমাদের ওখানে গিয়ে এক মাস থেকে আসব।

আমি এক পসলা হেসে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সে কোথায়? তাকে তো দেখছি না।

নিখিল? ওতো অফিসে গেছে। শ্বশুর মশাই জবাব দিলেন। জানোই তো বেসরকারি কোম্পানীগুলো ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে হাড় কঞ্জুস। কাজ কর কিন্তু ছুটি চাইতে পারবে না।

এ কথায় সকলে সমস্বরে হেসে উঠল। আমিও হাসলাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, এই একই সমস্যার ভুক্তভোগী আপনার বড় ছেলেও।

শ্বশুর মশাই বললেন, তা তোমার বরটি কোথায়? আসার পরে তো তার টিকিটিও দেখতে পেলাম না।

কথাটা শোনা মাত্রই শ্বাশুড়ি মা মুখ বাঁকালেন। অদ্ভুত একটা সুর নাকে চড়িয়ে বললেন, ন্যাকামো দেখ বুড়োর! এতদিন বাদে ছেলেটা কলকাতায় এলো। তা বেড়িয়েছে একটু পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে।

এমন সময় একজন প্রৌঢ়া, সম্পর্কে আমার মাসি শ্বাশুড়ি হন, আমায় জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁগো মা! ওই শহরটা কেমন? কলকাতার মতনই?

আমি বললাম, কলকাতার মতনই বড় শহর। ছিমছাম। তবে কালচারে অনেকটাই তফাৎ। এমনকি খাবার দাবারেও।

বাঙালি আছে ওখানে?

প্রচুর।

তাহলে তো বাংলা অনেকেই বলে।

সব সময় নয়। আমরা যেখানে থাকি সেখানে অধিকাংশ লোকই বাঙালি। তাই সচ্ছন্দে বাংলায় কথা বলা যায়। তবে তাই বলে সর্বত্র নয়।

দক্ষিণ ভারতের লোকেরা কি যে আগ্ডুম বাগ্ডুম বলে কিছুই বোঝা যায় না ছাতা।

আবার ঘরের মধ্যে অনুক্ষণ সমবেত হাসির রোল উঠল। আমি বললাম, দক্ষিণ ভারতে এক একটা রাজ্যের এক একরকম ভাষা।

সোফার প্রান্তে শতরঞ্জির উপর বসে থাকা একজন মহিলা প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা যেখানে থাক সেখানে কি ভাষা বলে?

কন্নড়।

মহিলা বোধহয় ভীষণ অবাক হলেন শুনে। অন্তত সেরকমই ভঙ্গিতে চোখ বাঁকিয়ে শুধালেন, বোঝ তোমরা?

প্রশ্নটা শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল। তবে ওইরূপ অকপটে প্রবল বেগে হাসাটা শোভনীয় নয় বলেই আমি আমার হাসিটাকে অবদমিত করে বললাম, একদম না। সারা জীবন থাকলেও বোধ করি ও ভাষা বুঝতে পারব না।

এমন সময় নিলীমা এলো। ঈষৎ অনুযোগের সুরে বলল, তোমরা কি এমন গল্প করছো বলো তো আমায় ফেলে রেখে।

আমি বললাম, তেমন কিছু না। এসো বসো। আমি আমার পাশের ফাঁকা সোফার মোলায়েম গদির উপর দুবার হাতের চেটো নাচিয়ে তাকে বসতে ইশারা করলাম। শ্বাশুড়ি মা জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে ঘুমিয়েছে?

নিলীমা বসে বলল, হ্যাঁ।

যাই মনুকে একটু সবার জন্য চা করতে বলি গিয়ে। শ্বাশুড়ি মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। নিলীমা হেসে বলল, কি ইন্টারেস্টিং গল্প হচ্ছিল শুনি।

তেমন কিছুই না। নিখিল আসবে কখন?

শ্বশুর মশাই বললেন, এতক্ষণে বোধহয় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে।

উপস্থিত সকলেই আবার বিয়ের আলোচনায় মনোযোগী হল। ঘরটা ফের গমগম করছে। গলার আওয়াজের বিভিন্নতা যেন উত্তাল সমুদ্রের ঢেউরের মতনই সিলিং অবধি গিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে ঘরময়। আমি চুপচাপ সবার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছি। বোধহয় এরা ঠিক পাঁচ বছর আগেও এইরকমই ঔৎসুক্যতা প্রকাশ করেছিল।

সঠিক কোন কথার পৃষ্ঠে জানিনা নিলীমা আচমকা একটা মন্তব্য করে বসে। সে তোমরা যাই বলো আমি আর বৌদি আছি তো। সব সামলে নেব।

ভীষন সারল্যতা ছিল এই মন্তব্যে। কিন্তু বাকিরা যেন ভূত দেখার মতনই থমকে গেলেন। হঠাৎ নৈঃশব্দে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল নীলিমা। আমিও খানিক হতবাকের মতন সবার দিকে নজর বোলালাম। প্রত্যেকের চাহনীতেই দ্বিধার ছাপ। এমন সময় মাসি শ্বাশুড়ি একটু গলা খাকারি দিয়ে বললেন, এসব তুই কি বলছিস?

কি বলছি মানে? নির্বোধের মতন নীলিমা তাঁর দিকে তাকাল।

আসলে... মানে...

জানিনা কেন মাসি শ্বাশুড়ি ভীষণ ইতস্তত করতে লাগলেন।

সেই মুহুর্তে অন্য প্রান্তে বসে থাকা আরেকজন প্রতিবেশী প্রৌঢ়া বললেন, দেখ নীলু। তোর মাসি ওমন সঙ্কোচ করছে বলেই বলি। আসলে তোর বৌদি এখানে বসে রয়েছে। ওর সামনে বলাটা ঠিক না…

আমি ভ্রুকুটি করে তাঁর দিকে চাইলাম।

আসলে শাস্ত্রে আছে সন্তানহীন মেয়ে মানুষদের কোন শুভ কাজে হাত লাগাতে নেই। আর এ‌ বাড়ির বড় বৌ তো...

নীলিমা প্রতিবাদ করে উঠল। পিসি তুমি একটু চুপ কর।

কথাটা যেন সপাটে চড়ের মতনই কানের কাছে বাজল। মনের ভেতরটা কেমন বিষাদে গাঢ় হয়ে উঠল। বন্যায় উৎখাত হয়ে যাওয়া গৃহহীনের মতনই সর্বস্বান্ত মনে হল নিজেকে। অকপটেই চোখের শার্সিটা ভারী হয়ে উঠল জলে। আংশিক উন্মুক্ত পিঠের উপর একটা করুনা মাখা স্পর্শ অনুভব হল। নিলীমার হাতের স্পর্শ। এমন সময় মনু ট্রে ভর্তি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল।


(৩)


বেশ শান্ত ভাবেই আমাদের গাড়িটা গড়িয়ার দিকে দৌড়াচ্ছে। বাইরে রোদও ঝিমিয়ে গিয়েছে অনেকটা। আর ঘন্টা দেড়েক বাদেই হয়তো রাত্রি ঘন হয়ে বসবে। বেশ নিপুণ হাতেই স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের ড্রাইভার একটার পর একটা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। কলকাতার রাস্তায় যেন উইপোকার মতনই কিলবিল করে যানবাহন। গাড়ির কাঁচ আঁটা। তাই বাইরের কোন শব্দই ভেতরে আসছে না। মেট্রো রেলের কাজ চলছে হরদম। মসৃণ রাস্তার বুক চিরে উঁচিয়ে থাকা কঙ্কালসার ব্রীজের থামগুলিকে এই মুহুর্তে ভীষণ বেমানান দেখাচ্ছে।

নিলীমা অনির্বানকে কোলে বসিয়ে বাইরের চলমান দৃশ্যকে আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে দেখাচ্ছে। বড্ড উপভোগ করছে সে। একটা খিলখিল হাসির শব্দ একই লহমায় ভেসে আসছে কানে। আমি হেলান দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রয়েছি। একটা আক্ষেপ যেন ক্রমাগত অশান্ত করে তুলছে আমায়। বুকের মতনই কোলের কাছটা খাঁ খাঁ করছে। সন্তান থাকলে আমিও হয়তো তাকে এমনটাই করতাম। কিংবা এর চাইতে বেশী কিছু।

সত্যি বলতে নিলীমাকে আমার সঙ্গে আনার এতটুকুও ইচ্ছা ছিল না। আমার এক সময়ের নিজের বাড়ি অর্থাৎ বাবার বাড়িতে যাচ্ছি। একা গেলেই ভাল লাগত অধিক। যদিও বাবা মা দুজনেই নিখিলের বিয়েতে আসবে তবুও যেন তর সইছিল না। প্রতিবেশী পিসির গতকালের অকপট মন্তব্যে মনটা এমনিতেই নিদারুণ ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল। বিশেষ করে মনের ভাবকে একটু তরল করতেই মায়ের কাছে যাওয়া। তাই রাতে খাওয়ার সেরে দূর্গা চরণ বাবুর ঘরে যাই। তাঁকে বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাবটা জানাই। শ্বশুর মশাই শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। আমার কথা শুনে বইটাকে বুকের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, ছোট ছেলেটার বিয়ে। একেই অনেক ব্যস্ততা সারা বাড়িতে। এর মধ্যে তোমার বাপের বাড়ি যাওয়াটা কি মানায়? তাছাড়া বেয়াই বেয়ান দুজনেই তো বিয়েতে আসছেন।

আপনি তো সবই জানেন বাবা। বিয়ের মতন একটা শুভ কাজে আমার মতন একজন সন্তানহীনা নারীর কি বা করণীয়! তার চাইতে…

শ্বশুর মশাই হাত তুলে আমায় থামতে বললেন। বোধহয় আমার মনের ভাবটা বুঝতে পেরেছেন। কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি তোমার বাড়িতে যাবে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু কার সাথে যাবে? নিতীশকে বলেছ?

না বাবা। ও যেতে চাইবে না।

তাহলে?

ভাবছি একাই ঘুরে আসব। গড়িয়া তো বেশি দূর নয়। দুপুরের দিকে বেরিয়ে রাতের মধ্যে চলে আসতে পারব।

দূর্গা চরণ বাবু কিঞ্চিত আপত্তি প্রকাশ করলেন। তুমি একা একা যাবে এটা আমার ঠিক লাগছে না। বরং সাথে করে কাউকে নিয়ে যাও।

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, কাকে নেব আমি?

তুমি বরং নীলুকে সাথে করে নিয়ে যাও। নিরুত্তাপ জবাব দিলেন দূর্গা চরণ বাবু।

আমি উদ্বেগ প্রকাশ করে বললাম, কিন্তু নীলিমার বাচ্চা যে ছোট।

তাতে কি! ট্যাক্সী নিয়ে নেবে। তাছাড়া আজকাল তো মোবাইলের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। বলে তিনি আবার বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজলেন। বুঝলাম এটাই তাঁর শেষ সিদ্ধান্ত। রাগে আমার ফেটে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। ঠিকাছে বাবা আসলাম। বলে আমি দূর্গা চরণের ঘর থেকে বিদায় নিলাম। বের হতেই নীলিমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। বোধহয় সে বাথরুম থেকে ফিরছে। পরণে ঢলঢলে একটা নাইটি। ও এই বাড়ির মেয়ে। কাজেই নাইটি পড়বার ব্যাপারে তার সংস্কার হানির বিষয়টাকে উপেক্ষা করলেও চলে। নীলিমা জিজ্ঞেস করল, বাবার ঘরে গেছিলে?

আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়ালাম। নীলিমা দু পা এগিয়ে এসে সহাস্যে আমার হাত ধরে বলল, এসো না বৌদি। আমার ঘরে এসো। একটু গল্প করি। সব সময় তো আর তুমি এখানে থাকবে না।

রাগে তখনও আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সমস্ত ক্ষোভ ননদের উপর উগড়ে দিই। আমি কপট ইতস্তততা দেখিয়ে বললাম, না না আজ থাক। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া অনির্বাণ ঘুমাচ্ছে। আমরা কথা বললে খামখা ওর ঘুমটা ভেঙ্গে যাবে।

তুমি অহেতুক এত ফরমাল হচ্ছো। এসো তো।

নীলিমা বলপূর্বক আমায় তার ঘরে নিয়ে গেল।


নীলিমার ঘরের বাতাস এক অদ্ভুত মিঠেল গন্ধে ভারী হয়ে রয়েছে। এই গন্ধের ঘ্রান আমি আগে কখনও পাইনি। গন্ধের সৌম্য মাদকতা ক্ষণে ক্ষণে বিভোর করে তুলেছে আমায়। মাথার ভেতরটা দমবন্ধ করে রয়েছে। ঘরের ঈষৎ আলোয় অনির্বাণকে নিষ্কলঙ্ক বদনে শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ মায়া লাগছিল। প্রবল অপত্য স্নেহে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছিল। সর্বোপরি তাকে নিজের ছেলে হিসাবে আপন করতে মন উচাটন হচ্ছিল। আমার এই বুকটা যে বড়ই ফাঁকা। শালীনতার অবগুণ্ঠনে লুকিয়ে থাকা দুটি বৃহৎ বৃত্তও কোনদিন কোন শিশুর পরশ পায়নি। অপূর্ণতায় শুকিয়ে গিয়েছে তারা। আমি ঈষৎ ঝুঁকে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে অনির্বাণের একবিন্দু চেহারার সমান্তরালে মুখ রাখতেই গন্ধটা প্রকট হয়ে উঠল। মাদকতার স্তরটাও যেন আরও বেড়ে গেল। প্রবল তৃপ্তির মধ্যেই কোন অপরিপক্ক শিশুর ত্বকের নির্ভেজাল অভূতপূর্ব গন্ধ আবিষ্কার করলাম। সস্নেহে তার নিটোল গালে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই নীলিমা স্তিমিত কন্ঠে বলল, শুনেছি ঘুমন্ত অবস্থায় কোন বাচ্চাকে আদর করতে নেই। এতে নাকি রাগ বারে।

আমি নির্লিপ্ত ভাবেই আঙ্গুলটা সরিয়ে নিলাম। সোজা হয়ে বসে বললাম, তুমি ভীষন ভাগ্যবান।

নীলিমা আমার গা ঘেষে বসল। হাত দুটোকে চেপে ধরে বলল, পিসির কথাটা খুব গায়ে লেগেছে জানি।

চোখটা ছলছল করছে। ধরা গলায় বললাম, পিসি তো ঠিকই বলেছেন। আমার মতন একজন বাজা মেয়েছেলের উপস্থিতিটাই ঘোর অমঙ্গলের।

বৌদি!

নিঃসাড়েই কান্নার বেগ চলে এল। পরশ্রীকাতর আমি, যে কিনা নিজের ননদকে সব চাইতে অধিক ঈর্ষা করে, তাকেই যেন আমি হিতাহিত জ্ঞান ভুলে জড়িয়ে ধরলাম। অঝোর কান্নায় তার বুকের উপর ভেঙ্গে পড়লাম।

আমি কি দোষ করেছি নীলু? কেন ভগবান আমার কোল ভরিয়ে দেয় না? অন্তত একটা বিকলাঙ্গ সন্তান হলেও না হয়…

কথাটা শেষ করতে পারলাম না। বাকি শব্দগুলো কন্ঠনালীতে দলা পাকিয়ে গেল। নীলিমা আমার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, প্লীজ বৌদি ওমন করে কেঁদো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

হবে না। হবে না। কিচ্ছু ঠিক হবে না।

অস্ফুটেই শব্দগুলো উচ্চারণ করলাম।

প্রাকৃতিক নিয়মেই একটা সময়ের পর আমার কান্নার বেগটা মন্থর হয়ে এল। নিজেকে সামলে নিলাম। চোখ মুছে বললাম, কালকে একটু বাবা মার কাছে যাব।

এতক্ষণ পরিবেশর বৈলক্ষনে বোধহয় নীলিমাও একটু হারিয়ে গিয়েছিল। তাই নিজের গলার যথাসম্ভব সহজ করে বলল, ওই জন্যে বাবার কাছে গেছিলে?

নিশ্চুপ মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম।

বেশ তো ঘুরে এসো।

বাবা বললেন তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। আমি আপত্তি করলাম যে, অনির্বানটা এখনও ছোট। ওকে নিয়ে...

কোন সমস্যা নেই। আমি যাব। তাছাড়া আমি যদি অনিকে নিয়ে হিমসিম খাই। তুমি আছো তো। তুমি সামলাবে ওকে।

আমাকে ভরসা জোগানোর চেষ্টা করল নীলিমা।

আমি একা থাকলে হয়তো বাসে করেই চলে যেতাম। নেহাত অনির্বাণের জন্যই আমাকে ক্যাব বুক করতে হল। নীলিমা হঠাৎ বলল, আমার ভীষন অদ্ভুত লাগছে জানো।

কেন? আমি ওর দিকে মুখ ঘোরালাম।

আর একদিন বাকি। তারপরেই ছোরদা নাকি বিয়ে করতে যাবে। জানি না ছোরদার কেমন লাগছে, তবে আমার বিয়ের সময় তো আমি ভীষন নার্ভাস ছিলাম। তোমার কেমন লেগেছিল গো যখন বরদা তোমায় বিয়ে করতে গেছিল?

আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সত্যিটা তাকে বলে দিলে ও নির্ঘাত আশাহত হয়ে পড়বে। একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া চলে আসাও অস্বাভাবিক নয়। তাই ঈষৎ কাষ্ঠ হেসে তার মনঃপুত একটা জবাব দিলাম। তোমার মতনই। নার্ভাস।


মেন রোডের উপর গাড়িটিকে ছেড়ে দিয়ে আমরা গলি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গলির একটু ভেতরে আমাদের বাড়ি। নীলিমা এবং আমি প্রায় একই রঙের শাড়ি পড়েছি আজ। হলদেটে মার্কা। রাস্তায় বেশ কিছু পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে দেখা হল। সকলের কুশল সংবাদ নিয়ে বাড়ির জীর্ণ লোহার গেটটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাবা একটা লুঙ্গি এবং স্যান্ডো গেঞ্জী পরে কলপাড়ে বসে জল ভরছিল। গেট খুলবার আওয়াজ পেতেই সে উঠে দাঁড়াল। পর মুহুর্তেই বাবার মুখটা হাসিতে ভরে গেল। আয় মা আয় বলেই সে সমস্ত কাজ পরিত্যাগ করে দ্রুতপদে বাড়ির ভেতর চলে গেল। খুব ক্ষীণ শুনতে পেলাম বাবা চিৎকার করে মাকে ডাকছে। কি গো! দেখো কে এসেছে! পরক্ষণেই মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কে এসেছে?

যথেষ্ট বিচলিত হয়েই মা বারান্দায় এলো। কি রে আয়! ওমন পরের মতন বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওমা নীলিমাও দেখি এসেছে। এসো এসো ভেতরে এসো। কোলে ওটি কে? ছেলে বুঝি?

নীলিমা হেসে মাথা দোলালো। ভাল আছেন মাসিমা?

হ্যাঁ মা। এসো। ভেতরে এসো।

ভেতরে গিয়ে আমরা বসলাম। বিছানা পরিপাটি করে গোছানো। দীর্ঘ মাসের ব্যবধানেও মধ্যবিত্ত এই বাড়িখানায় বিশেষ কোন পরিবর্তনই চোখে পড়ল না। কেবল জায়গায় জায়গায় দেওয়ালে পাপড়ি উঠে যাওয়া ছাড়া। বিয়ের সময় আপাত চাকচিক্য আনতে বাবা যে রঙটা করিয়ে ছিল সেটাই এখনও বর্তমান রয়েছে। তবে একটু ফ্যাকাশে হয়েছে বটে। বাবার তো ছিলই এখন মায়ের মাথাতেও চুলে পাক ধরেছে। বড্ড রুগ্ন দেখাচ্ছে মুখটা। বয়সের ছাপ বোঝা যাচ্ছে। আমি মুখে একটু উদ্বেগ টেনে বললাম, ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে তোমায়। শরীর ঠিকাছে?

বুড়ো বয়সে যেমন থাকে আর কি। প্রেসারটা বেড়েছে হালকা। চিরাচরিত ভঙ্গিতেই মা জবাব দিল।

নীলিমা বলল, বৌদির বিয়ের সময় কি সুন্দর লাগছিল আপনাকে দেখতে। এখন দেখে সত্যিই খুব চোখে লাগছে।

স্মীত হাসল মা। বলল, বয়েস তো বাড়বেই। ওটার ওপর তো কাউর জোর নেই।

বাবা ঘরে এলেন। পরণের লুঙ্গিটাকে ছেড়ে একটা সাদামাটা জামা আর প্যান্ট পড়ে এসেছেন। একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছিস মা? জামাই বাবা কেমন‌ আছে?

সবাই ভাল আছে।

তা জামাইকে নিয়ে এলি না কেন? কতদিন দেখা হয় না!

ওর সময় নেই। ভাইয়ের বিয়ে তাই নিয়েই খুব ব্যস্ত।

বেশ আড়ম্বর করেই মিথ্যে কথাটা বলতে হল। কারণ নীতিশের বর্তমান আচার ব্যবহার, তার সাথে আমার চাপা কলহ - এই সমস্ত কিছু বললে হয়তো তারা ভীষণ শোক পাবে। তাদের মেয়ের বিপুল কপট সুখের জীবন নিয়ে হুতাশের অন্ত থাকবে না। এমনকি তাদের আদরের জামাই যে, ইদানীং পরিণত মদ্যপ হয়ে উঠেছে, এমনকি গতকালও সে আকন্ঠ মদ্যপান করেই ফিরেছিল - এই কথাগুলো বলতে আমার মুখে বাঁধে। তাছাড়া নীলিমার সামনে এই সকল আলোচনাও শোভনীয় নয়। শত হলেও সে ওই বাড়ির মেয়ে আর আমি পরের বাড়ীর মেয়ে।

অনির্বাণ ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে আপন মনেই উঃ উঃ করছিল। মা বলল, নীলিমা তোমার ছেলে তো দেখছি অনেক বড়ো হয়ে গেছে! কথা বলতে শিখেছে?

নীলিমা অনিকে জড়িয়ে ধরে সহাস্যে বলল, ওই আদো আদো করে মা আর বাবা ডাকতে পারে। ডাক্তার বলেছে আরেকটু সময় লাগবে কথা বলতে।

বর ভাল আছে তো? বাবা জিজ্ঞেস করল।

নীলিমা ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ মেসোমশাই! ভাল আছে। আপনি ভাল আছেন তো?

বাবা দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন, রোগ ভোগে দিন কেটে যাচ্ছে।

দাঁড়া তোদের জন্য চা করে আনি। এই এদিকে একটু শোন তো! মা বাবাকে রান্নাঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। পরক্ষণেই বাবা ঘর থেকে হনহন করে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলাম। কোথায় যাচ্ছো?

বস তোদের জন্য একটু খাবার নিয়ে আসি।

আমার আগে নীলিমাই প্রতিবাদ করল। না না মেসোমশাই। অকারণ ব্যস্ত হবেন না। মাসিমা চা করছেন ওতেই হবে।

আমি তার কথায় সায় দিলাম। হ্যাঁ বাবা নীলু ঠিকই বলছে। এখন আমরা কিচ্ছু খাবো না‌। তুমি একটু বসো তো। কতদিন কথা হয় না।

কথা হবে খন। তোরা বস তো চুপটি করে। আমি যাব আর আসব।

বাবা স্থানু হলেন না। বেরিয়ে গেলেন।


আপনজনদের সংস্রবে এলে সময়ের একদম জ্ঞান থাকে না। বিশেষ করে ব্যবধানটা যদি বহুদিনের হয়। অনেকদিনের জমে থাকা কথা চোখের নিমেষেই উঁচু পর্বত হয়ে দাঁড়াল। তাতে রোদ উঠল, বৃষ্টি নামল। গল্পের ধারা বারিধারার মতন পাথরে আছাড় খেতে খেতে জলপ্রপাতের মতনই ছিটকে পড়ল। টুকরো টুকরো সফেদ মেঘের মতন চায়ের কাপ হাতে হাতে ঘুরে সুরুৎ সুরুৎ করে চুমুকের গর্জন তুলল। সেই অবিকল আস্বাদ। তার মধ্যে লুক্কায়িত থাকা অব্যক্ত মাতৃস্নেহ দীর্ঘক্ষণ আমার ওষ্ঠ যুগলের উপর আধিপত্য ফলিয়ে ছিল। বাবার এক ছুটে আনা মোগলাইটাও জমিয়ে গলাদ্ধকরণ করেছিলাম।

অনুপ্রবেশকারীদের পদধ্বনিতে গুপ্ত সভা ভেঙ্গে যাওয়ার মতন করেই আমাদের অদৃশ্য পাহাড় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ঘড়িতে আটটা দশ। আমরা বেরুবার জন্য উদ্যত হচ্ছি নীলিমা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, বৌদি একটু বাথরুম যাব।

বাবা মা চিন্তিত মুখেই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম, মা নীলুকে একটু বাথরুমটা দেখিয়ে দাও।

এতে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে। এসো। বাথরুমটা এইদিকে। মা নীলিমাকে বাথরুমে দিকে নিয়ে গেল। এর আগে অনিকে আমার অধীনে সপে গেল। আশ্চর্য রকম ভাবেই আজ অনি আমার কাছে আসতে দিরুক্তি করল না। সহজ ভাবেই আমার কোলের উপর বসে উঃ উঃ করতে লাগল। আমার বুকটাও যেন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠল। মনে হল অনি বোধহয় আমাকে ধীরে ধীরে চিনতে শিখেছে। আমি অনির সঙ্গেই কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম। আচমকা মায়ের কথায় আমার চটকা ভাঙ্গল।

মা রে তোর নিজেরও যদি এরম একটা ছেলে থাকত!

গলায় প্রচ্ছন্ন কান্নার ভাব। আমি মায়ের দিকে বিহ্বল চোখে চাইলাম। দেখলাম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে। চোখের কোনাতে চকিতে হীরকের মতনই কিছু একটা চিকচিক করে উঠল। বাবার মাথা নীচু। বুকের ভেতরের অজানা আনন্দটা আচম্ভীতেই শূন্য হয়ে গেল। মা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বাথরুমের দরজায় খট করে আওয়াজ হতে নিজেকে সামলে নিল। চকিতে মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে চোখটা মুছে নিল। নীলিমা ঘরে ঢুকে বলল, আরিব্বাস! তোমার সাথে তো দেখছি অনির ভীষণ ভাব হয়ে গেছে! আমি তো ভাবছিলাম এই বুঝি ও কেঁদে ফেলল। কিন্তু এতো দেখছি খুব সচ্ছন্দেই ও তোমার কোলে বসে রয়েছে।

আমি মৃদু হাসলাম।

চল বৌদি অনেক রাত হয়ে গেছে। মাসিমা, মেসোমশাই আসি হ্যাঁ। বিয়ের দিন তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। নীলিমা বেশ ব্যস্ত হয়েই কথাগুলো বলল।

বুকের ভিতরটা ভীষন হু হু করছিল। মা বাবার থেকে চোখের আড়াল হতে একদম মন চাইছিল না। অগত্যা বিষন্ন শরীরে তাঁদের দুজনকে বিদায় জানিয়ে নীলুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।


(৪)


নিখিলের বিয়ে হতে আর বেশি দেরি নেই। সামান্য রাতটুকুরই ব্যবধান। তারপরেই উলুধ্বনি দিয়ে তার বিয়ের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ শুরু হবে। বিবাহের যাবতীয় জিনিসপত্র কেনাকাটাও একদম শেষ। সারা বাড়িতে হই হুল্লোড় রব। বাড়ির বাহ্যিক চার দেয়াল রঙ্গিন আলোয় ঝলমল করছে। ফুল দিয়ে মূল ফটকও সাজানো হয়ে গিয়েছে। গান বাজছে পুরো দস্তুর মতন। গিজগিজ করছে আত্মীয় কুটুমেরা। তাদের সকলেরই আলোচ্য বিষয় এখন নিখিল। তাকে ঘিরে হাসি ঠাট্টার গুঞ্জন যেন আতসবাজির মতন ফাটছে। একজন প্রৌঢ় বলেছিলেন, আমাদের নিখিলটা দেখতে কত বড় হয়ে‌ গেল! এই সেদিন ওকে হতে দেখলাম, ন্যাঙ্কটো হয়ে খেলতে দেখলাম কত, আর কাল নাকি বাবু বউ আনতে যাচ্ছেন। ভাবা যায়!

সকলেই প্রৌঢ়ের কথায় হেসে লুটোপুটি। খালি নিখিলই সলজ্জ মাথা নীচু করে বসে ছিল। সম্ভবত তার কান দুটো লাল হয়ে গিয়েছিল। আগামীকাল শ্বাশুড়ি মা সহ আরও অনেক মহিলারা ভোর রাতে জল তুলতে যাবেন। কাক ডাকবার আগে। নীলিমার খুব ইচ্ছা ছিল আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু প্রৌঢ়ারা বড্ড উশখুশা করলেন। আকারে ইঙ্গিতে স্পষ্ট করে দিলেন আমার উল্লেখিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকাই মঙ্গলজনক। নীলিমা সম্ভবত মনে মনে ভীষন ক্ষুন্ন হয়েছিল। বয়সের সীমাবদ্ধতার জন্যই মেয়েটা প্রতিবাদ করতে পারেনি। কোন নারীর সন্তান সন্ততি না হওয়াতে সেই নারীর কি দোষ থাকতে পারে - এমনই অভিব্যক্তির ছাপ তার মুখে ফুটে উঠেছিল। পাগলী একটা! মেয়েটা এত আমায় সমীহ করে অথচ আমি যে, তার প্রতি অত্যন্ত পরশ্রীকাতর তা সে এতটুকুও আঁচ করতে পারে না। করুনা হয় ওর উপর।

যা হোক এইসব সন্তানহীনতার গঞ্জনা এবার আর আমায় ছুঁতে পারেনি। কান অবধি পৌঁছিয়েও শব্দগুলো কর্পূরের মতন উবে গিয়েছিল। কারণ এখন আমার সমস্ত শরীর অনির স্নেহে আড়ষ্ট। ওই যে, গতকাল অনি আমার কোলে এসেছিল। তারপর থেকেই আমার চিন্তনের ধারাই যেন বদলে গিয়েছে।আক্ষেপের কারাগারে বন্দী হয়ে থাকা মাতৃত্ব বোধ আচমকাই গরাদ ভেঙ্গে বাইরে উদগীরণ হয়েছে। বুঝি ক্রোরের শূন্যতা মোচন হল। সর্বক্ষণ খালি অনি। গতকাল রাতেই বাবার বাড়ি ফেরবার পথে একবারে জন্যও তাকে কোল ছাড়া করিনি। অনিও যেন আমার সাহচর্যকে সহজ ভাবেই মেনে নিয়ে ছিল। এমনকি আজও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। তাকে সবসময় কোলে করে ঘোরা, সময় মতন খাওয়ানো, স্নান করিয়ে দেওয়া, কেঁদে উঠলে তার মন ভুলিয়ে রাখা - সমস্ত কিছুই মাতৃসম করেছি। একবারের জন্যও মনে হয়নি যে, অনি আমার পেটে ধরা আত্মজ নয়। তার প্রতি আমার এই অসীম অকৃত্রিম ভালোবাসায় যেন আমি বুদ হয়ে গিয়েছি। নীলুও কোন আপত্তি করেনি। সেচ্ছায় নেওয়া অনির প্রতি আমার অধিকারকে সে হাসি মুখে প্রশয় দিয়েছে। বাড়তে দিয়েছে নিঃসংকোচে। হয়তো ভেবেছে অনির সংস্রবে যদি আমার দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়।

এমনকি আজ সন্ধ্যাবেলায় যখন সকলে মিলে বিয়ের আলোচনা করতে ব্যস্ত তখনও আমি তাদের বৃত্তের বাইরে গিয়ে অনিকে নিয়েই আত্মভোলা হয়ে রয়েছি। ঠিক কক্ষপথ থেকে ভটকে যাওয়া প্রস্তর খন্ডের মতন। কার্যত তাদের আলাপ আলোচনা একদম অপ্রাসঙ্গিক। একমাত্র অনির সুপ্রসন্ন মায়াবী মুখখানা ছাড়া। তাই সকলের উশখুশানি গোচরীভূত হতেই সেখান থেকে নির্লিপ্ত বদনে আমি ব্যালকনিতে চলে আসি। রঙের মেলা বসেছে যেন। ছাদ থেকে নিওন আলোর চেইন ঝুলছে। তার থেকেই বিচ্ছুরিত হচ্ছে না না বর্ণ। নীল হলুদ লাল ইত্যাদি। চারদিক ঘেরা ব্যালকনির লোহার রেলিঙগুলোকে ছাপিয়ে দু হাত বাড়িয়ে যেন মাখিয়ে দিচ্ছে আমাদের।

আমি অনিকে কোলে নিয়েই একটি ছোট মোরার উপর বসে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকি। জিহ্বার ক্রমাগত সঞ্চালনে নানা ধরনের আদর সম্পৃক্ত শব্দ বের হতে থাকে। বদলাতে থাকে মুখভঙ্গি। যেন আমার আর অনির বয়সের সমীকরণটা সমান হয়ে গিয়েছে। সে খিলখিল করে হাসছে। আও আও শব্দ করে আমার সঙ্গে কথা বলছে। তার মনে ভাব যেন সহসা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার কাছে। মনে হচ্ছে আমিই ওর পূর্ন মা। যেন অদৃশ্য নাড়ীর টানেই সে আমার কাছে ফিরে এসেছে। শুধু আজ বলে নয়, বহু জন্ম আগে থেকেই সে আমারই সন্তান হয়ে ফিরে ফিরে এসেছে। ঘটনাক্রমে কাল থেকে এ যাবৎ অনিও একেবারে জন্য নীলিমার কাছে যাওয়ার জন্য অভিপ্রায় প্রকাশ করেনি। কাজেই বেশীক্ষন সময় লাগল না উদ্রেক হওয়া মাতৃ সুলভ ধারণা বদ্ধমূল হতে। তিল তিল করে নয়, এক ধাক্কায় সেই ধারণা হৃষ্টপুষ্ট মহীরুহে পরিণত হল। রোখ চেপে গেল অনিকে কিছুতেই কোল ছাড়া করব না। তার জন্য যা মূল্য চোকাতে হয়, চোকাব। তাকে বোঝাব আমিই তার পৃথিবী।

আনমনে একটি সিক্ত চুম্বন অনির গালে এঁকে দিলাম। খিলখিলিয়ে উঠল সে। আচম্ভীতে সে বার দুই অস্ফুটে মা করে ডেকে উঠল। বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে গেল আমার। একটি খরস্রোতা নদী হঠাৎই শান্ত হয়ে বইতে আরম্ভ করেছে। আমি জানি অনির মুখ থেকে ছিটকে আসা অস্ফুট শব্দটি নীলিমার জন্যে নয়। একান্ত আমার জন্য। ধীরে ধীরে সেও আমার মতনই একটি অদৃশ্য নাড়ীর টান অনুভব করছে। চকিতেই একটি বিজয়ীর হাসি ঠোঁট ভরে জ্বলে উঠল। ঝলমল করে উঠল আমার সমস্ত মুখমন্ডল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখের উপর কালো ছায়া নেমে এলো। নিভে গেল সমস্ত বিজয় উত্তাপ। আচমকাই ব্যালকনিতে একটি শরীরের উদ্ভব হয়েছে। রঙের প্রতিফলনে বড়ই বিচিত্র দেখাচ্ছে সেই শরীর। খুব স্বাভাবিক গলায় নীলিমা বলল, চলে এলে যে!

নীলিমা আরেকটি মোড়া টেনে আমার মুখোমুখি বসল। গায়ের ভেতরটা রি রি করছে। আমার আর অনির একাত্বতার মধ্যিখানে নীলিমার অনধিকার প্রবেশকে আমি এক মুহুর্তও সহ্য করতে পারছি না। ঈর্ষার পাত্রী তো সে ছিলই। এখন যেন আমার চক্ষুশূল হয়ে উঠল। মেজাজটা উত্যক্ত করলেও নিজেকে অতি সন্তর্পনে শুধরে নিলাম। অতীব ঠান্ডা গলায় বললাম, তুমি তো জানোই। তা তুমি উঠে এলে কেন?

তোমার চলে যাওয়া দেখেই তো উঠে এলাম। আমার না ভীষন…

কাজটা মোটেই ঠিক করলে না। তোমার এভাবে অকস্মাৎ উঠে যাওয়াতে বাকিদের খারাপ লাগতে পারে।

তোমার কি খারাপ লাগে না, যখন ওঁরা বারংবার তোমার সন্তানহীনতাকে কটাক্ষ করে কথা বলে!

নীলিমার কন্ঠে একটা ঝাঁজ লক্ষ্য করলাম।

এখন আর সেই সকল কথাকে বিশেষ আমল দিই না। তাছাড়া তাঁরা যা বলেছেন তা একদিক থেকে ঠিক। বাজা মেয়েদের সত্যিই কোন শুভ কাজে থাকতে নেই। যে অনুষ্ঠানে আমার মতন একজন নিঃসন্তান মেয়ে মানুষের থাকা অনুচিত, সেখানে সেই অনুষ্ঠানের আলোচনা সভাতেও থাকা মানায় না।

ভীষন অভিমান হয়েছে তাদের উপর, না।

বড্ড তরল শোনাল নীলিমার গলার স্বর। আমি স্মীত হেসে বললাম, আর কোন অভিমান নেই। এখন আমার মন ভীষণ পিচ্ছিল।

নীলিমা প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল। বলল, দেখছি মামী আর ভাগ্নের আলাপটা কিন্তু ভালই জমেছে! মুচকি হাসল সে।

তৎক্ষণাৎ কথাটার অর্থটা বুঝতে পারলাম না। বিস্মিত কন্ঠে বললাম, মানে?

তোমার আর অনির কথা বলছি।

অনি আমার ভাগ্নে! কথাটা আপন মনেই উচ্চারণ করলাম। বিস্ময়ে আমার ভাববার ক্ষমতা ক্ষণিকের জন্য বিকল হয়ে গেল। দৃষ্টি শূন্য হয়ে আসলো। এ মেয়ে বলছে কি! অনি তো আমার সন্তান। আপন আত্মজ। এমনকি… এমনকি অনিও তো আমাকে মা বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তা নাহলে তখন ও অস্ফুটে মা বলে ডাকবে কেন তাকে? নীলিমা জানে না তাই ওমন অর্বাচীনের মতন কথা বলছে।

কি গো! কোথায় হারিয়ে গেলে?

মুখে কাছে দুবার তুরি মারার শব্দ হতেই আমার সম্বিত ফিরে এল।

হু!

হঠাৎ কি ভাবছিলে?

তুমি একটু আগে কি বললে? কাঁটা কাঁটা কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

কি বললাম? নীলিমা ভ্রু কুঁচকালো।

অনির আমার কে হয় বললে?

ও মা! সব জেনে শুনে অভিনয় করছো বুঝি! অনির তোমার ভাগ্নে হয় না!

ভাগ্নে?

গলায় একরাশ শূন্যতা দলা পাকিয়ে গিয়ে মুখের ভেতরটা ভীষণ বেস্বাদ করে তুলল। বললাম, কিন্তু ওকে আমি নিজের ছেলের মতনই ভালবাসি।

ও মা! তাতে কি? ভাগ্নে তো নিজের ছেলের মতনই। নীলিমাকে ভীষণ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সে আরও বলল, তুমি আছো বলেই অনেকটা বাঁচোয়া। কি সুন্দর ওকে নিয়ে হেসে খেলে বেড়াচ্ছো। আমি একদম ঝাড়া হাত পা। তা না হলে... তাছাড়া তুমি যে, ওকে কাছে পেয়ে কতটা আনন্দিত তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। খুব ভাল লাগছে গো, বিশ্বাস কর।

তাহলে তুমি অনিকে ছেলের মতন ভালবাসার অনুমতি দিচ্ছো? আমি নীলিমার দিকে বিহ্বল চোখে চাইলাম।

নীলিমা বলল, ছিঃ বৌদি! অনুমতি শব্দটা ব্যবহার করে আমায় ছোট করলে। ও তোমাদেরই ছেলে। যতদিন আমরা আছি ততদিন না হয় তুমিই ওর দেখভাল কর।

এবার যেন আমার মাথায় বজ্রাঘাত হল। শিরশিরে গলায় বললাম, তারপর তুমি ওকে নিয়ে যাবে?

জানি না কেন নীলিমা মুখ টিপে হাসল। বলল, জানি অনির প্রতি তোমার বড্ড মায়া জমে গেছে। কিন্তু কি করব বল, যার ছেলে তার কাছে তো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তোমার জামাইর তো ছেলে অন্ত প্রান।

আমি ভীষন মুষড়ে পড়লাম। এই সদ্যলব্ধ শিশুটি যে একদিন আমার কোল ছাড়া হয়ে যাবে, তা‌‌ যেন আমার কল্পনাতীত। তার প্রতি যে মমত্ববোধ আমার হৃদয় থেকে স্খলিত হয়েছে তার নিরসন ঘটানো আর কোন মতেই সম্ভব নয়। এই পাষাণ মানবী কেবল মাত্র একটি দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের বিচ্ছেদের কথা বলছে। যেহেতু সে এই শিশুটিকে গর্ভে ধারণ করেছে। কিন্তু অনি এবং আমার মধ্যে নব প্রতিষ্ঠিত হৃদ্যতা, তার প্রতি উজাড় করে দেওয়া আমার অকৃত্রিম স্নেহতিরিক্ত ভালবাসাকে সম্মুখস্থ মানবী সুবিন্যস্ত আস্ফালনে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তারই আভাস তার চোখে মুখে। ক্রোধ আর বাঁধ মানতে চাইছে না। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি এই পাষাণ মানবীর বুককে দ্বিখণ্ডিত করে দিই। এমনই স্পর্শকাতর মানসিক স্থিতিতে নীলিমা বলল, তুমি বসো। আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসি। দেখি কি চলছে? বলে মোড়া ছেড়ে উঠে পড়ল। বোধহয় তখন মনে বাতুলতাই ভর করেছিল। তাই তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে অতীব স্পষ্ট এবং ঠান্ডা গলায় বললাম, আমি অনিকে নিয়ে যেতে দেব না। নিজের গলার আওয়াজকে অচেনা মনে হল। অনুভব করলাম আমার বুকে মধ্যে কোন সঙ্কোচ নেই। বরং এক বেপরোয়া অধিকার বোধ পাথরের মতন শক্ত হয়ে গিয়েছে। নীলিমা থেমে গিয়ে আমার দিকে চাইল। রঙিন আলোর ছটায় তার হতবাক দৃষ্টি আমার নজর এড়ায়নি। সে অভিভূত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, কি বললে?

অনিকে আমি নিজ সন্তান জ্ঞানে ভালবেসে ফেলেছি। দোহাই ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না। এতদিন বাদে একটা বেঁচে থাকার উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি। সেটা যদি চলে যায়, তাহলে আমি বাঁচব কি করে! নীলু! এই নীলু! আমার কথাটা শোনো। একটু বোঝার চেষ্টা করো। তুমি তো… তুমি তো এখনও সবল। এখনও হাতে অনেক সময় আছে তোমার। আমার মতন তো তোমার জঠর আবিল হয়ে যায়নি। তাই… তাই তোমরা আরেকটা বাচ্চা খুব সহজেই নিয়ে নিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু দয়া করে… দয়া করে অনিকে আমার কাছ নিয়ে যেও না। আমি কথা দিচ্ছি… কথা দিচ্ছি ওকে অনেক দূরে চলে যাব। অনেক দূরে। আর তোমাদের কাছাকাছি কোনদিন আসব না শুধু ওকে…

একটানা কথাগুলো বলতে বলতে গলার ভেতরে কান্না মোচড় দিয়ে উঠল। অধোবদনে ফোঁপাতে লাগলাম। কান্নার দমকে সমগ্র শরীর কাঁপছে। নীলিমা আলতো করে আমার কাঁধের উপর হাত রাখল। খুব মলীন সুরে বলল, শান্ত হও বৌদি। এমন করে কেঁদো না। আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আর আমি এও জানি যে, অনিকে তুমি কতটা ভালবাসো। কিন্তু তুমি যা বলছ তা কোন মতেই সম্ভব নয়। কোন মা কখনই নিজের সন্তানকে অপরের হাতে এইভাবে তুলে দিতে পারে না। অন্তত জ্ঞানত তা সম্ভব নয়। আমায় তুমি ক্ষমা করো। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, যতদিন এ বাড়িতে আমরা আছি, ততদিন তুমি অনিকে নিজের জিম্মায় রাখতে পার। আমি কোন আপত্তি করব না।

আমি কাতর ভাবে মুখ তুলে চাইলাম। নীলিমা আমার সিক্ত দু চোখের উপর নজর স্থির রেখে বলল, তোমরা গল্প কর। আমি বরং ভেতরে যাই।

তৎসহ আমার গালে নীলিমার কোমল স্পর্শও অনুভুত হল। আমি বিমূঢ়ের মতন তার চলে যাওয়া দেখলাম। অনি হঠাৎই আবার অস্ফুটে মা বলে ডেকে উঠল।


(৫)


মহিলাদের সমবেত উলুধ্বনিতে এ বাড়ির নিদ্রা ভঙ্গ হল। আনন্দের আলোড়ন পড়ে গেল বাড়ির ত্রিসীমানায়। পিলপিল করছে মানুষ জন। সমস্ত বয়সের মুখগুলো থেকে উল্লাসের বাণ যেন সবেগে ছিটকে পড়ছে এদিক ওদিক। সকলেই যে যার কাজ - অকাজ নিয়ে ব্যস্ত। দূর্গা চরণ বাবু সাদা ধুতি এবং গেঞ্জি পড়ে পুরোহিত মশাইয়ের পাশে বসে শাস্ত্র প্রনোদিত ক্রিয়াকলাপ করছেন এবং মন্ত্র আওড়াচ্ছেন। নিখিলও বোধ করি আর কিছুক্ষণ বাদে পুরোহিত মশাইয়ের পাশে এসে বসবেন। আরেকটু বেলা বাড়তে আরও কিছু আত্মীয় স্বজন এ বাড়ির চৌহদ্দিতে এসে উঠলেন। ফলে পিলপিল করা ভিড়টা আরেকটু বেশি থিকথিকে হয়ে উঠল। তাতে আমার কোনও ঔৎসুক্যতা নেই। কারণ আমার বিশ্বটা ক্রমে সংকুচিত হতে হতে বর্তমানে একটি ঘরে এসে সীমাবদ্ধ হয়েছে। আমার নিজের ঘর। সেখানে বহির্বিশ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোন আভাসই এসে পৌঁছায় না। আলোচিত বিয়ে বাড়ি নিয়ে আমার যেমন কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, তদ্রুপ উক্ত অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ না করাতেও কোনও আক্ষেপ নেই। নিরুত্তাপ ভঙ্গিতেই আমার ব্যক্তিগত বিশ্ব চরাচরে থিতু হয়ে রয়েছি কোলে ছোট্ট একটি রক্ত মাংসের পৃথিবীটিকে নিয়ে। আমার আত্মজ। অনি। গতকাল রাতে নীলিমার বাক্য বিন্যাসের কোন জের এখন আর মনের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তার সান্ত্বনাকে নির্লিপ্ত ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছি। দৃঢ় প্রত্যয় করেছি অনিকে হারিয়ে যেতে দেব না। কিছুতেই নয়।

সেই কোন সকালে নীলিমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আর তাকে দেখতে পাইনি। সম্ভবত কাজে ব্যস্ত। বেলা কত হয়েছে খেয়াল নেই। আত্মহারার মতনই অনির সঙ্গে ব্যস্ত। আচমকা অনির কেঁদে ওঠে। তার আকুল কান্নায় আমি কেমন দিশেহারা হয়ে যাই। নানা ভাবে হাত নেড়ে, মুখে অঙ্গি ভঙ্গি করে তাকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকি।

কি হয়েছে অনি সোনার? কি হয়েছে? এই তো বাবা তোমার মা আছে তো সঙ্গে?

তবুও যেন সে শান্ত হতে চাইছে না। আন্দাজ করলাম তার ক্ষিদে পেয়েছে। হন্যে হয়ে তার দুধের বোতলটা খুঁজতে অগোছালো বিছানার উপর হাতরাতে লাগলাম। কয়েকবারের প্রচেষ্টাতেই বালিশের তলা থেকে বোতলটা আমার হাতে চলে এল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, এই তো বাবা! এই তো! আমার অনির সোনার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এবার সে দুদু খাবে। এই যে বাবা দিচ্ছি। বলে সঙ্গে সঙ্গে বোতলটার ঢাকনিটা টেনে খুলে তার তুলোর মতন তুলতুলে ঠোঁট দুটোর ফাঁকে নিপিলটা গুঁজতে গিয়েও হঠাৎ আমার হাতটা অনুক্ষণ স্থির হয়ে গেল। চকিতে আমার চোখ দুটো শানিত ছুঁড়ির ফলকের মতনই ঝকঝক করে উঠল। মনের ভেতর কে শিরশিরে গলায় বলল, এটাই তো সুযোগ নিজের আকাঙ্খা মিটিয়ে ফেলবার। এতদিন যে আস্বাদন থেকে তুই বঞ্চিত ছিলিস, এখন সময় এসেছে তা গ্রহণ করবার। করে ফেল। ও তোর ছেলে। তোর পূর্ণ অধিকার আছে।

আমার হাতটা মৃদু কাঁপছে। অনি তখনও অনতিদূরে থাকা নিপলটাকে মুখে নেওয়ার জন্য ছটফট করছে। চওড়া হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে যেতেই কয়েকটি দাঁত বাইরে বেরিয়ে এল। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম বোতলটাকে। নিপিলের ক্ষুদ্র ছিদ্র থেকে কয়েক ফোঁটা দুধ ছিটকে বিছানার উপর পড়ল। যন্ত্রচালিতের মতনই পরণের শালটা সরিয়ে শাড়ির আঁচলটিকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিলাম। লাল রঙের ব্লাউজটা দগদগ করছে বুকের উপর। অনির কোলের উপর শুয়ে শুয়েই তার ছোট্ট হাতের চেটো দিয়ে মৃদু মৃদু আমার স্তনকে স্পর্শ করছে। আচমকাই বুকের দুপাশে উপচে পড়া মাংস পিন্ড দুটিতে অদ্ভুত শিরশিরানি আরম্ভ হল। আমি অনির দিকে তাকালাম। তারপর একটা একটা করে ব্লাউসের সমস্ত বোতাম খুলে ফেললাম। স্তনগুলো আলগা হয়ে গেল অন্তর্বাসের অভাবে। আমি অনিকে ভাল করে ধরে একটি লালচে বৃন্তকে তার নরম ঠোঁটের আড়ালে গলিয়ে দিলাম। তুলতুলে মাড়ি দুটো যেন জাতির মতনই চেপে বসল। যন্ত্রনায় আমার সারা শরীর কোঁকিয়ে উঠল। চোখে সামনে অন্ধকার নেমে এল চকিতে।

ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে লাগল। যন্ত্রনাটাও উধাও। মাতৃত্বের প্রথম আস্বাদ, স্তন্যপান করানোয় যেন আমার সারা শরীরে এক অমোঘ প্রসন্নতার ভর করল। বোধহয় নতুন সূর্যোদয় দেখলাম। জানি বুক দুটো শূন্য। দুগ্ধের কোন আস্বাদ নেই। তবুও অনি যেন অকাতরে তা টানতে টানতে শান্ত হয়ে পড়েছে। পরম মুগ্ধতায় চোখ বন্ধ করে রয়েছে। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম। আজ এই মুহুর্তে অনির সঙ্গে আমার সম্পর্কের দাপ্তরিক সূচনা হলো। যা অবিচ্ছেদ্য। তৃপ্ত বদনে আস্তে আস্তে অনিকে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। তবে এরপর যেটা ঘটল তার জন্যে আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। বোধহয় তন্দ্রা ভাবে একটু আচ্ছন্ন হয়েই পড়েছিলাম। আচমকা একটি বুক কাঁপানো হুঙ্কারে আমি তটস্থ হয়ে উঠলাম। বৌদি!

সজাগ দৃষ্টিতে দেখলাম আকস্মিক বজ্রপাতের মতনই নীলিমা দরজার সামনে উপস্থিত হয়েছে। থরথর করে তার শরীর কাঁপছে। চোখে মনিতে দুর্দান্ত এবং অপ্রতিরোধ্য ক্রোধের অনল। তার এইরূপ রুদ্র অবয়ব দেখে আমি এক মুহুর্তের জন্য বোধহয় তার চারপাশে এক প্রচ্ছন্ন অগ্নিবলয় দেখতে পেলাম। আমি কিঞ্চিৎ ভয় খেয়ে ধরমড় করে উঠতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না। অনি তখনও আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন।

আমি অপ্রতিভ হেসে বললাম, নীলু তুমি!

এটা তুমি কি করছো? তার উচ্চস্বরে আমার কানের ভেতরটা ঝনঝন করে উঠল।

আমি বিনীত স্বরে বললাম, নীলু একটু শান্ত হও। ওমন চেঁচিও না। লোকজন এসে পড়বে।

আমি তার ক্রোধকে প্রশমিত করবার জন্য ব্যাকুল ভাবে হাত জোর করলাম। কিন্তু সে অবিকল কন্ঠেই বলল, আসুক। জানুক সমস্ত লোক। দেখুক এই বাড়ির বড় বউ কত নিম্ন মানসিকতার।

দোহাই চুপ কর নীলু। আমার গলা দিয়ে কান্না বেড়িয়ে এল।

সে বলল, আমি তোমায় প্রচন্ড বিশ্বাস করতাম বৌদি। আর সেই বিশ্বাসের জন্যেই অনিকে নির্দিধায় তোমার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম… 

নীলিমার গলায় কান্না পাক খাচ্ছে।

…ভেবেছিলাম আর যাই হোক তুমি ওর কোন ক্ষতি হতে দেবে না। কিন্তু তুমি এ কি করলে! আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে…

কি হয়েছে রে? এমন সময় শ্বাশুড়ি মা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। পেছনে প্রায় বাড়িসুদ্ধ লোক। সকলেই কৌতুহলী হয়ে ভেতরের ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছে। আমি ব্যস্ত ভাবে শাড়ির আঁচলটাকে বুকের উপর চড়িয়ে দিলাম। আঁচলের অবগুণ্ঠনে অনির মুখটা আংশিক আড়ালে চলে গেল। ভিড় ঠেলে নীতিশ ঘরে সউদ্বেগে নীলিমার পাশে এসে দাঁড়াল। কি হয়েছে নীলু? চিৎকার করছিস কেন?

কান্নার বেগ ঠেলে নীলিমা বলল, দেখ দাদা! তোর বউ কি করেছে। আমার ছেলেটাকে…

আঙ্গুল তুলে আমার দিকে তাক করল। নীতিশ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে চাইল। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না, এমনই মুখভঙ্গি তার। শ্বাশুড়ি মাকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ভিড়ের মধ্যে থেকে মাসি শ্বাশুড়ি বললেন, কি হয়েছে রে নীলু? বড় বৌমা কি করল কি?

নীলিমা অনুরূপ কাঁদতে কাঁদতে বলল, বৌদি আমার ছেলেটাকে নিজের বুক খাওয়াচ্ছিল।

কথাটা শোনা মাত্রই শিশিয়ে উঠলেন তিনি।

কি অলুক্ষণে কান্ডরে বাবা! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! বোন রে তোদের বড় বউয়ের কি মতিভ্রম হল নাকি? ওর খালি বুকগুলো নাকি একটা বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিল! রাম! রাম! রাম! রাম! কি ঘোর কলি পড়ল রে বাবা!

আমি পাথরের মতন মাসি শ্বাশুড়ির সমস্ত গঞ্জনা কান পেতে শুনলাম। তবুও কোন অপরাধ বোধ আমার মধ্যে জাগরিত হল না। বুকের মধ্যে আবার সেই শিরশিরে গলাটা শুনতে পেলাম। 

ওরা যা বলে বলুক। আরও বলতে দে। কিন্তু মনে রাখবি তুই যা করেছিস তা একদম ঠিক। অনি তোরই ছেলে। ওকে দুধ খাওয়ানোর অধিকার একমাত্র তোরই আছে। শুধু তোর।

হঠাৎই নীতিশ আমার কাছে এগিয়ে এল।

অসভ্য! জানোয়ার! বলেই আমার গালে করাঘাত করল সে। মুহুর্তে গালটা চিনচিন করে উঠল। এতগুলো লোকের মধ্যে কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। এমনকি নীলিমাও নয়। কেবল শ্বাশুড়ি মাই অস্ফুটে ফুঁসে উঠেছিল, বড়! তবে সেটা সাময়িক। পরক্ষণেই তিনি চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। আমি নির্বিকার চোখ বন্ধ করে নিলাম। নীতিশের উষ্মায় আমার দু কান ভরে গেল।

এতগুলো মানুষের সামনে আমাদের এভাবে বেইজ্জত করতে লজ্জা করল না! তুমি এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাবে। বেড়িয়ে যাও!

শেষের কথাটা ধমকের সুরেই সে বলল। চোখের কোনা বেয়ে তিরতির করে একটি জলের রেখা গড়িয়ে পড়ল। এ অবধিও ব্যাপারটা সহনীয় ছিল। কিন্তু এরপরে যখন নীলিমা ক্ষীপ্র হস্তে অনিকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইল, তখন যেন আর সহ্য করতে পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। দু হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ওকে নিয়ে যেও না। দয়া কর। আমাকে ওর থেকে আলাদা করে দিও না। আপনারা নীলুকে একটু বোঝান না!

কাতর দৃষ্টিতে সমবেত ভিড়ের দিকে তাকালাম। উপস্থিত সকলেই নাট্য মঞ্চের নির্বাক দর্শকের মতনই স্থানু হয়ে রয়েছে।

ওদিকে নীলিমাও অনিকে ব্যগ্র ভাবে নিজের কাছে টানবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ছাড়ো বৌদি! ওকে ছাড়ো।

না না ওকে আমি নিয়ে যেতে দেব না। ও আমার।

দড়ি টানাটানির মতনই চলছে ব্যাপারটা। এবার অসহিষ্ণু ভাবে নীতিশও তার বোনের পক্ষপাতিত্ব করল। আমার হাত দুটোকে ছাড়াবার জন্য বল প্রয়োগ করতে লাগল। ধাক্কাধাক্কির ফলে অনিরও ঘুম ভেঙ্গে গেল। তৎক্ষণাৎ সে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। আমি সকাতরে বললাম, দেখো ও কাঁদছে। আমার ছেলেটা কাঁদছে। ছেড়ে দাও ওকে। দয়া কর।

চুপ কর! নীতিশ ধমকে উঠল। তারপর বিপুল শক্তি প্রয়োগ করে আমার হাত দুটোকে অনির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। তৎক্ষণাৎ নীলিমা অনিকে কোলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে বেড়িয়ে গেল। আমি বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। নাআআআআআ…

বিছানার উপর আকুল স্বরে কাঁদতে লাগলাম। যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। নিষ্ঠুরের মতন আমায় একলা ফেলে রেখে সকলেই ঘর থেকে চলে গেল।


(৬)


অপরকে কষ্ট দিলে নিজেকেও কষ্ট পেতে হয়। এটাই নিয়ম। নীলিমা যখন নিষ্ঠুরের মতন অনিকে আমার থেকে আলাদা করে নিয়ে গিয়েছিল, তখন বুকটা অসহনীয় যন্ত্রনায় বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মুমূর্ষের মতন বিছানায় পড়ে ছিলাম। অনেকবার অনি অনি করে ডেকেও কোন সাড়া পায়নি। কান্না গিলতে গিলতে এক সময় চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নীলিমাও অনুরূপ ভাবে কাঁদছে। শুরুতেই যে কান্নার কথাটা বলেছিলাম, ওটা আমার ননদের কান্না। অনিকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুত্রশোকে অনিবার বিলাপ করে চলেছে নীলিমা। আমার বুকের ভেতরটা কেমন জুড়িয়ে যাচ্ছে। আনন্দে হাত পা ছুঁড়ে নাচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু না না না। একটু বেখেয়াল হলেই যে ও পড়ে যাবে। একেবারে নীচে।

দীর্ঘক্ষণ বিছানায় অথর্ব হয়ে থাকবার পর আমি উঠে নীলিমার ঘরের দিকে যাই। অনির জন্য মনটা প্রচন্ড হুঁ হুঁ করছে। তার পরশে আমার অভ্যন্তরে যে মাতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে তাকে এত সহজে হারাতে দিলে চলবে। আমি অনিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব। তা নাহলে এই বাড়ির কেউ আমাকে ওর সঙ্গে একাত্ম হতে দেবে না। অপত্য লাভের নেশায় আমি তখন বুঁদ হয়ে রয়েছি। নিজের ঘর থেকে বের হতেই কয়েকজনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সকলেই সন্ধিহান চোখে চাইল। কিন্তু কেউ কথা বলল না। শত লাঞ্ছনাকে উপেক্ষা করে নীলিমার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজাটা ভেজানো। অতিথির প্রায় সকলেই এখন বাইরে। আর কয়েকজন রান্নাঘরে কাজ কর্ম করছে। দৈবাৎ বাড়ির এদিকটায় কেউ নেই। একটু আগের ঘটে যাওয়া নাটকীয় ঘটনাকে উড়িয়ে দিয়ে আবার সকলে নিখিলের বিবাহ নিয়ে ব্যস্ত। জানিনা এমতাবস্থায় অনি আদেও ভেতরে আছে কিনা! আর যদি সঙ্গে নীলিমাও থাকে তাহলে আবার সে হাল্লা করবে। শত সংশয়ের মধ্যেও আমি দরজার হাতলে হাত রাখলাম। তারপর চারপাশটা ভাল করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা খুললাম। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ যেন সাপের হিসহিসের মতন শোনাচ্ছে। দরজা প্রায় ফাঁকা হয়ে যেতে কোন ঘটনাই ঘটল না। সব চুপচাপ। নৈঃশব্দ্যে ভেতরে ঢুকলাম। নীলিমা ঘরে নেই। কিন্তু বিছানার উপর অনি ঘুমিয়ে রয়েছে। চোখে জল চলে এলো। যেন কত বছর বাদে তাকে দেখছি। আমি চুপিচুপি তার দিকে এগোলাম। প্রশান্ত মুখখানি দেখে হৃদয় বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বললাম, এই তো সোনা! তোর মা চলে এসেছে। এবার তোকে নিয়ে এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব। আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।

আবার সেই শিরশিরানি গলাটা কানে বাজল।

এত কি ভাবছিস! যা। তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে সরে পর। নীলিমা কিন্তু এক্ষুনি এসে পড়বে। তখন আর ওকে নিয়ে যেতে পারবি না।

নাআআ! অস্ফুটে আওয়াজ করে উঠলাম।

অনুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে চকিতে তাকে কোলে তুলে নিলাম। আচমকা একটি ধাতব বস্তুর পড়ে যাওয়ার শব্দে আমার সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল। আর কালবিলম্ব না করে দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম।

অনি এখনও কিন্তু পরম আবেশে আমার কোলে ঘুমাচ্ছে। এই ছোট্ট শিশুটি কোথায় ছিল এবং এখন কোথায় চলে এসেছে - সে সমন্ধে কোন জ্ঞান নেই। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। তাকে পরম যত্নে কোলের উপর রেখে ছাদের ধারে বসে রয়েছি। বাইরে প্রচুর লোক। তাই দিশাহীনের মতন ছুটে ছাদে চলে এসেছি। এখন দুপুর। মাথার উপরে প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মিহি তাপে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা করছিলাম সন্ধ্যাবেলায় যখন সকলে মিলে বরযাত্রী চলে যাবে তখন এখান থেকে চম্পট দেব। কিন্তু অনিকে খুঁজে না পাওয়া গেলে যে, সারা বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে যাবে - এ ব্যাপারটা একবারেই মাথায় আসেনি। কি যে করি এখন?

বিয়ে বাড়ি এখন শোকস্তব্ধ।

আমি যেদিকটাতে বসে আছি সেটা বাড়ির পেছন দিক। ঝাড় জঙ্গলে পরিপূর্ণ বলেই এদিকটা কেউ আসে না। এমনকি এ পাশে কোনও ঘর বাড়িও নেই। আমাদের বাড়ির পাঁচিলটা পেরোলেই একটি ডোবা। তারপরেই সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা। এখান থেকে বসে সামসেটগুলোকে সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। চাইলে খুব সহজেই এখানে উতরে নীচে নামা যেতে পারে। কিন্তু… কিন্তু অনিকে নিয়ে নামতে কষ্ট হবে। একটা কিছু উপায় তো বের করতেই হবে। মস্তিষ্কের উপর আরেকটু জোর দিয়ে ভাবতে লাগলাম। বাইরে হাঁক ডাক চলছে। এমন সময় একটা খচখচানি শব্দে আমি চমকে উঠলাম। নীচের জঙ্গলে কেউ পদচারণ করছে। আমি হতচকিতের মতন সেখান থেকে উঠে অন্যপ্রান্তে দৌড় লাগালাম। ঠিক তখনই একটি পুরুষ কন্ঠ চেঁচিয়ে উঠল। ওই তো বৌদি! সঙ্গে নীলুর ছেলেও আছে। আমি শিউরে উঠলাম। মানুষ বোধহয় অতি সতর্কতার মধ্যেই সবথেকে বড় ভুল করে ফেলে। আমিও তাই করে ফেলেছি। জঙ্গলের খচখচ শব্দে নিজের গা ঢাকতে গিয়ে কখন যে বাড়ি সম্মুখ প্রান্তে চলে এসেছি তা খেয়ালই করিনি। এক তাল লোক আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। চমকে এবার ছাদের মাঝখানে চলে এলাম। ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উন্মাদের মতন পায়চারি করছি। না এ হতে পারে না। ওরা আবার আমার থেকে অনিকে আলাদা করে দেবে! হে ভগবান বাঁচাও আমায়।

চিন্তায় গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অনিকে আরও জাপটে ধরলাম। স্বাভাবিক ভাবেই কোলাহলটা এখন ছাদের দিকে আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি। আর কয়েক সেকেন্ড বাদেই ভিড়টা এখানে এসে ভেঙ্গে পড়বে। ছাদের দরজাটা লোহার। দূর্ভাগ্যবশত সেটাকে ছাদ থেকে বন্ধ করা যায় না। আমি হন্যে হয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলাম যা দিয়ে অন্তত দরজাটাকে সাময়িক আটকে ফেলা যায়। কতগুলো কালচে ইট ছাদের একটি কোনে স্তূপীকৃত করে রাখা। অনিকে ছাদের শুইয়ে রেখে আমি সেদিকে ছুটে গেলাম। ইটগুলিকে দরজার সামনে জড়ো করতে লাগলাম। মাথা কাজ করছে না। যা করছি তা আদপেও কার্যকারী কিনা তা ভেবে দেখবার মতন অবকাশ নেই। হঠাৎই কোলাহলটা প্রকট মনে হল। আচমকা কে একজন লোহার দরজায় সজোরে আঘাত করল। ভারসাম্য না রাখতে পেরে ইট সমেত আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। ভিড়টা বাঁধ ভাঙা জলের মতন ছাদের উপর চলে এল। দূর্গা চরণ বাবু, নীতিশ, নিখিল, নীলিমা, শ্বাশুড়ি মা সকলেই আমায় দেখে হতবাক। ভিড়ের মধ্যে মা বাবার মুখটাও ভেসে উঠল। নীতিশ গর্জন করে বলল, কি পাগলামী হচ্ছে এটা? অনিকে নিয়ে ছাদে কি করছো?

আমি অকুতোভয়ে ফুঁসে উঠলাম।

বেশ করেছি। অনি আমার ছেলে। আমি ওকে নিয়ে যা খুশী তাই করবো। যেখানে খুশী সেখানে থাকব। একদম আমাদের কাছে আসবে না।

নীলিমা উতলা হয়ে বলল, বৌদি কেন এমন করছো? আমি তো তোমায় ওকে নিজের ছেলে ভাবার পূর্ণ স্বাধীণতা দিয়েছি। তাহলে কেন পাগলামী করছো। ওকে নিয়ে দয়া করে ঘরে চল।

বলে সে দু পা এগোতেই আমি সাপের মতন বুক ঘষতে ঘষতে অনির কাছে চলে গেলাম। তারপর ব্যস্ত হাতে তাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, খবরদার নীলু! কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তাহলে কিন্তু অনিকে নিয়েই এই ছাদ থেকে ঝাঁপ দেব।

না! কোঁকিয়ে উঠল নীলিমা।

এবার দূর্গা চরণ বাবু কথা বললেন।

আমাদের ভালবাসায় কি কমতি ছিল বলো, যে, এমন বাতুলতা করছো!

কমতি! আমি রি রি করে উঠলাম। সেটা আপনার গুনধর ছেলেকে জিজ্ঞাসা করুন। আমি আপনাদের বংশকে প্রদীপ দিতে পারিনি সেটা কি আমার অপরাধ? ইচ্ছে করে তো কোন মেয়ে বাজা হয় না বাবা। সব মেয়েই তো সন্তান সুখ চায়। কান্না ঠিকরে এলো গলায়। 

আজ আমার কোন সন্তান হয়নি বলে প্রত্যেকদিন রাতে মাতাল হয়ে এসে নীতিশ আমায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, পশুর মতন বেধরক মারে - এটাই কি আপনাদের বংশের ভালবাসা?

ভিড়ে মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আমার নিজের মা বাবা কেঁদে উঠলেন। নীতিশের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। চুপ! একদম বাজে কথা বলবে না। ঝাঁঝিয়ে উঠল সে।

কেন চুপ করব? আমিও ক্ষোভে জ্বলে উঠলাম। তোমার মহান কীর্তি কলাপ বেফাঁস করে দিচ্ছি বলে খুব গায়ে লাগছে না!

তবে রে! নীতিশ তেড়ে আসার উপক্রম করছিল, দূর্গা চরণ বাবু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। নীতিশ! বেয়াদপির একটা সীমা থাকে। তুই বৌমার গায়ে হাত তুলিস? এত নীচে নেমে গেছিস তুই? এই তোকে শিক্ষা দিয়েছি? দেখো ওগো দেখো। তোমার ছেলের কত গুণ!

শেষ কথাটা তিনি শ্বাশুড়ি মাকে বললেন।

শুধু এই নয়। এই শিশুটির জন্যও আমাকে হেনস্থা হতে হয়েছে অনেক। সে কথা আর নাই বা বললাম।

আমি বরদার হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে অনিকে কোন ক্ষতি করো না।

নীলিমা কাতর ভাবে অনুরোধ করল। আমি উদগ্রীব হয়ে বললাম, এ তুমি কি বলছো নীলু! অনি আমার ছেলে। ওর কোন ক্ষতি হোক তা আমি কখনই চাইব না। তবে দয়া করে আমাদের একা ছেড়ে দাও। এখান থেকে চলে যাও। আমি ওকে কিছুতেই তোমাদের দেব না। আমি অনিকে কথা দিয়েছি, আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। এবার তোমরা যদি জোর জাবস্তি করার চেষ্টা কর তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি এখান থেকে ঝাঁপ দেব। 

নীলিমা ডুকরে উঠল। দূর্গা চরণ বাবু দু হাত উঁচিয়ে বললেন, বৌমা! এরকম করো না। কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে।

ঘটুক। অনিকে পাওয়ার জন্য আমি যে কোন সীমা লঙ্ঘন করতে পারি। যে কোন।

কাঁটা কাঁটা হাসি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। বলতে গেলে আমার শরীরটা শূন্যে দোল খাচ্ছে। ছাদের একদম ধারে কোন রকম ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছি। একটু বেচাল হলেই সোজা নীচে। এমন সময় বাবা ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এল। কান্না জড়ানো গলায় বলল, মারে! কেন এমন পাগলামী করছিস? ওকে ফিরিয়ে দে। ওই বাচ্চা যে তোর নয়।

আমি শিউরে উঠলাম। বাবা! এ তুমি কি বলছো?

তোর বাবা ঠিকই বলছে রে মা। এবার মা কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে এলো। বলল, এরকম পাপ করিসনে‌। একটা মায়ের কোল এভাবে খালি করে দিসনে। তোর ভাগ্যে যদি সন্তান সুখ না থাকে সেটা তোর ভাগ্য খারাপ। সাথে আমারও। তাই বলে তার শাস্তি অন্য আরেকজনকে দিবি? ধর্মে সইবে না রে মা।

আচমকাই আমার বুকের মধ্যে জমা আক্রোশটা বরফের মতন গলে গেল। ভিজে উঠল দু চোখ। কাঁদতে কাঁদতে অনিকে নিয়ে ছাদের উপর বসে পড়লাম।

আমি ভুল করেছি মা। আমায় তুমি ক্ষমা কর।

মা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। অসংলগ্ন ভাবে বার কয়েক মাথায় চুমু খেয়ে বলল, কাঁদিস না মা। একদম কাঁদিস না। তুই যে, নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পেরেছিস তাতেই আমি খুশী। এবার প্রায়শ্চিত্ত কর মা। যার সন্তান তাকে ফেরৎ দিয়ে দে।

আমি সজোড়ে ঘাড় দোলালাম। নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমায় ক্ষমা করে দাও নীলু। অজান্তেই তোমার অনেক বড় ক্ষতি করতে যাচ্ছিলাম। এই নাও। তোমার অনিকে তুমি ফেরৎ নিয়ে নাও।

অনিকে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। নীলিমা এগিয়ে এসে অনিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, বৌদি! দয়া করে মনের ভেতর পাপ বোধটাকে আর প্রশ্রয় দিও না। তুমি যা করেছ তা আপাত দৃষ্টিতে গর্হিত মনে হলেও, হয়তো তোমার জায়গায় আমি থাকলে এমনটাই করতাম। সন্তানহীনতার কলঙ্ক যে, কতটা বেদনাদায়ক, তা আজ স্পষ্ট বুঝতে পারছি। সত্যি বলছি ঈশ্বর যেন এই কষ্ট আর কোন নারীকেই না দেন।

মা বলল, চল মা নীচে চল। তোর দেওরের বিয়ের দিনে আর মন ফুলিয়ে থাকিস না।

আমি নির্লিপ্ত ভাবে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, তোমরা যাও। আমি আসছি।

কিন্তু…

আমি একটু একা থাকতে চাই মা।

ধীরে ধীরে ভিড়টা প্রশমিত হতে লাগল। আমি আবার ছাদের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুকের ভেতর থেকে শিরশিরে গলাটা বলল, তুই আবার সন্তানহীন হয়ে পড়লি। ওরা আবার অনিকে ছলে বলে তোর থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। আর তুইও নির্বোধের মতন মুঠো আলগা করে দিলি। ধিক্কার! ধিক্কার!

আমি কপট হাসলাম। বেশ করেছি।

চকিতে হাওয়ার বেগ বেড়ে উঠল। আচমকা বহুদূর থেকে নীলিমার চিৎকার কানে ভেসে এলো। কিন্তু আমার পা দুটো ততক্ষণে অনেকটা শূন্যে তলিয়ে গিয়েছে। শেষবারের মতন খেদোক্তি করেছিলাম, হে ভগবান! পরের জন্মে আমায় শত অনির মা করে পাঠিও।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy