Ajobdeep Bromho

Romance Tragedy Thriller

3  

Ajobdeep Bromho

Romance Tragedy Thriller

শ্যামলকে ভালবাসা যায় না

শ্যামলকে ভালবাসা যায় না

59 mins
699


বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ

ধূমপান ও মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

পাঠককুলের প্রতি আবেদন

নিম্নোক্ত গল্পে কিছু যৌন দৃশ্যের বর্ণনা এবং অপ্রীতিকর শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। তাই পাঠকগণকে নিজের দায়িত্বে গল্পটি পড়তে অনুরোধ করবো।


(এক)

রাতের পরত জমতে জমতে নিশুতি রাত হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। চারপাশের ঘন বন জঙ্গল যেন অপার্থিব অবয়ব ধারণ করে গ্রাস করার উপক্রম করছে। সম্পূর্ণ বেরির বাওরটাই এখন ঘুমে নিমগ্ন। নিদ্রাহীন কেবল শ্যামল মাঝি। সে পালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। তার বউ মেয়ে সেখানে... আহঃ! আর ভাবতে পারছেনা সেই বিভীষিকার কথা। ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভূতগ্রস্থ। একটি মরা আম গাছের পাশে নৌকাটিকে বেঁধে হাঁটু সমান জলে নেমে রাতের অন্ধকারে ক্রমাগত হাত ধুয়ে চলেছে সে। খুব দ্রুত গতিতে। যাতে রক্তের দাগটা চিরতরে মুছে যায়। কিন্তু না কিছুতেই সেই দাগ যাচ্ছে না। বাওরের জলটাকেই যেন রক্ত মনে হচ্ছে তার। যত ধোয়ার চেষ্টা করছে, ততই হাতে আরও লেগে যাচ্ছে। চমকে সে জল ছেড়ে পাড়ে উঠে আসে। তারপর পকেট থেকে ছোট্ট মোবাইলটা বের করে অত্যন্ত ঘৃনার সঙ্গে বাওরের জলে ছুঁড়ে মেরে মুখ থেকে একটা শ্লেষের আর্তনাদ করে ওঠে সে। এরপর ধীরে ধীরে তার শ্যামল তার অবসন্ন শরীরটিকে টানতে টানতে নৌকার উপর এলিয়ে দেয়। তারপর হাতরে কিছু একটা খুঁজতে থাকে অন্ধকারে এবং নৌকার একটি খাঁজে তা পেয়েও যায়। আধ ভাঙা একটি ব্লেডের টুকরো। প্রথমে নির্বোধের মতন হাসে শ্যামল। তারপর ধারালো টুকরোটিকে বাম হাতের কব্জিতে ঠেকাতেই অঝোড়ে কেঁদে পড়ে সে।

কয়েক মাস আগে...

রাত পৌনে এগারোটা। শ্যামল রাতের খাওয়া সেরে দাওয়ায় বসে বিড়ি খাচ্ছে। বাইরে প্রচণ্ড শীত। চারিদিক খাঁ খাঁ করছে অন্ধকারে। কয়েকদিন হলো পাশের পোস্টের লাইটটা কেটে গিয়েছে। খালি শ্যামলের বাড়ির বারান্দা থেকে যেটুকু বাল্বের হলুদ আলো তাদের উঠোনে এসে পড়ছে। বিড়ির ধোঁয়ার সাথে সাথে একটি বাংলা গানের সুরও বেরিয়ে আসছে তার গলা থেকে।

বিড়িতে শেষ একটা বড় টান দিয়ে ক্যারামের স্ট্রাইকারের মতন ছুঁড়ে দিয়ে দাওয়া থেকে উঠে এলো সে। বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করা অন্ধকারটুকুও বারান্দার আলোটা নিভে যেতেই গ্রাস করলো বাকি পরিসর। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল শ্যামল। মৃদু নীলাভ নাইট বাল্বের আলোয় দেখলো খাটের একদম ডানদিক ঘেঁষে তার পাঁচ বছরের মেয়ে মানা পরম তৃপ্তিতে ঘুমাচ্ছে। পাশে তার বউ রত্না। চোখ বুজে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। তবে সে জানে যে, রত্না এখনও ঘুমায়নি। সে গায়ের চাদরটাকে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর রেখে পরণের লুঙ্গিটাকে আরেকটু শক্ত করে বেঁধে রত্নার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সব নিস্তব্ধ। খালি ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। শ্যামল প্রথমে কিছুক্ষন টান হয়ে শুয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে রত্নার দিকে পাশ ফিরে খুব সীমিত কন্ঠে প্রশ্ন করল, কিগো ঘুমিয়ে পড়েছো?

হুম। রত্নাও খুব মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো।

শ্যামল খুব আলতো করে রত্নার কোমরের উপর ডান হাতটা রাখল। রত্না নির্বিকার। আজ দেখলো রত্না নাইটি পড়েনি। শাড়ি পড়েই শুয়েছে। ফলে তার উষ্ণ কোমল ত্বক প্রথম স্পর্শেই ছ্যাঁকা দিলো শ্যামলকে। তারপর আস্তে আস্তে সে তার হাতটিকে রত্নার নাভির কাছ অবধি নিয়ে এল। রত্না তার একটি হাত দিয়ে শ্যামলের হাতটিকে প্রতিহত করে চাঁপা গলায় বলল, উহঃ! কি করছো? মেয়ে জেগে যাবে!

না জাগবে না। এদিকে শোন।

মুখ টিপে হাসলো রত্না। তারপর শ্যামলের হাতটিকে সরিয়ে ধীরে ধীরে শ্যামলের দিকে ফিরলো। বলল, কি হয়েছে? ঘুমাতে দিচ্ছো না কেন?

শ্যামল মৃদু হেসে বলল, এমনি।

এবার সে জড়িয়ে ধরলো রত্নাকে। সঙ্গে সঙ্গে মানাও একটু নড়েচড়ে উঠলো। তারা দুজনেই চুপ মেরে গেল। রত্না ঘাড় বেঁকিয়ে একবার দেখে নিল মানাকে। ঘুমিয়েই আছে সে।

মৃদু বকুনি দিয়ে বলল, কি করছো কি? মেয়ে উঠে গেলে আর সহজে ঘুমাবে না কিন্তু।

শ্যামল হেসে মাথা নাড়লো। রত্নাও এবার শ্যামলকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল, আজ হঠাৎ এতো আদর!

শ্যামলও মুচকি হাসলো। কেন আমার বউকে আমি করতে পারি না?

নীরবে ঠোঁট উল্টালো রত্না। শ্যামল রত্নাকে ভাল করে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল তার গালে। রত্নাও কয়েক মূহুর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর বলল, আচ্ছা শোন না। একটা বলার ছিল। অনেকদিন ধরেই ভাবছি বলবো বলবো। বলা হচ্ছে না আর।

শ্যামল রত্নার গলায় মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, হুম বলো।

বলছি আমাদের এই বেরির বাঁওরটাতো এখন বেশ বিখ্যাতই হয়েছে। অনেক দূর দূর থেকে তো লোকজন আসে বেড়াতে।

শ্যামল রত্নার দিকে কৌতুহলী চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল, হ্যাঁ তাতে কি হয়েছে?

তুমিওতো মাঝে মাঝে তোমার নৌকাটা নিয়ে বেড়াতে আসা মানুষদের ঘোরাতে পারো। তাতে তো কিছু দু পয়সা রোজগার হয়।

বলছ?

হ্যাঁ। ওই দেখনা হারার বাবা কেমন টুকু টুক করে নৌকা নিয়ে ঘোরাতে বেড়িয়ে যায়। ভালোই তো কামাই হয় শুনেছি।

তা মন্দ বলনি রত্না। আমিও বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম। যাইহোক দেখি কি করা যায়। বলে আবার সে তার পূর্বেকার অসমাপ্ত কার্যে মগ্ন হয়ে গেল।

কয়েকদিন পর...

আরে ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল রীতা।

আরে আসোই না। হেসে মাথা নেড়ে ইশারা করলো শমীক।

দেখো অচেনা জায়গা। এভাবে হুটহাট করে যেখানে সেখানে চলে যেওনা প্লীজ।

আরে বাবা আমরা তো এখানে ঘুরতেই এসেছি নাকি। যদি নাই ঘুরি তাহলে জায়গাটা এক্সপ্লোর করবো কি করে!

রাখো তো তোমার এক্সপ্লোর। আমি যাব না ওদিকে। তারচেয়ে বরং যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিক দিয়েই ফিরে যাই।

তুমিও না সত্যি! বলে রীতার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো শমীক।

মাটির এবড়ো খেবড়ো পথ। একটু অসাবধান হলেই পড়ে গিয়ে বিপত্তি বাঁধবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শমীকের সঙ্গে যেতে হল তাকে।

এই বেরির বাঁওরে আসার আইডিয়াটা ছিল শমীকেরই। একটি ভিডিও প্লাটফর্মে জায়গাটার সন্ধান পেয়ে তৎক্ষণাৎই রীতাকে যাওয়ার প্রস্তাবটা দেয় সে। সেই সুবাদেই তারা আজ এখানে।

গ্রামের ভেতরে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মঠটি থেকে তারা দুপুরের ভোগ খেয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে। কারণ দুপুরবেলা মঠটি বন্ধ থাকে। রীতা মঠের উল্টোদিকের দোকানটির ছাউনীতে একটু বিশ্রাম করতে চেয়েছিল তবে শমীকের এক্সপ্লোরেশনের হুজুকে সেটি আর হয়ে উঠলো না তার। অগত্যা।

পথের একধারে বেশ উঁচু উঁচু বাঁশ ঝাড় আর অপরদিকে বিস্তীর্ণ সর্ষের ক্ষেত। উত্তরের শীতল বায়ু সরষে গাছ গুলো কে অনবরত দুলিয়ে যাচ্ছে। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সোনালী শোভায়। যদিও প্রকৃতির প্রতি শহুরে রীতার তেমন একটা টান নেই। তবে অভিভূত হয়ে পড়ছে শমীক। এখানে আসবার পর থেকেই সে "ওরে কি জায়গা কথাটা" ক্রমাগত বলে যাচ্ছে আর গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটা দিয়ে সবকিছু ফ্রেমবন্দী করে নিচ্ছে।

ক্ষেতটা শেষ হতেই তারা দেখলো একজন মাঝ বয়সী বউ মাটির বাড়ির দাওয়াতে বসে সেলাই করছে। শমীক সেইদিকে খানিক এগিয়ে গিয়ে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, বলছি এই রাস্তা ধরে গেলে কি হ্রদটা পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ আর কিছুটা এগোলেই পাবে। হাত দিয়ে দেখিয়ে দেন মহিলা।

ধন্যবাদ। এস। বলেই আবার তারা হাঁটতে আরম্ভ করলো। কিছুটা পথ যেতেই বৃক্ষরাজির আড়াল থেকে হ্রদটা চোখে পড়লো তাদের। তার পাশাপাশি একটা বিশ্রী গন্ধও ভেসে এলো নাকে। রীতা সঙ্গে সঙ্গে নাক টিপে বলল, উহঃ! কি বিচ্ছিরি গন্ধরে বাবা। থু!

শমীক হো হো করে হাসল। বলল, ওমন করার কিছু হয়নি। ওটা মূরগীর গায়ের গন্ধ। যা খেতে তুমি সবথেকে বেশী পছন্দ কর।

ইউ!! মুখ চোখ বেঁকিয়ে উঠলো রীতা।

শমীক বলল, আসে পাশেই হয়তো কোথাও মুরগির ফার্ম আছে।

সামনের রাস্তাটা থেকে কতকগুলো বাচ্চা ছেলে মেয়ে হি হি করতে করতে তাদের দিকে ছুটে আসছিল। তাদের দেখে হঠাৎ থমকে গেল তারা।

শমীক রীতাকে বলল, অনেক ভিডিওতে তো অনেককেই এখানে নৌকা চড়তে দেখেছি। কোথা থেকে চড়ে কে জানে!

হঠাৎ করে সেই কচিকাঁচার দল থেকে শ্যামলের মেয়ে মানা বলে উঠলো, তোমরা নৌকা চড়বে?

শ্যামল বলল, হ্যাঁ। পাওয়া যাবে কি নৌকা?

মানা খিলখিল করে হেসে বলল, হ্যাঁ পাওয়া যাবে। এসো আমার সঙ্গে। বলেই অতি চঞ্চল পদে হ্রদের ধারের একটি পাকা বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল। শমীকও সেইদিকেই হাঁটতে যাচ্ছিল রীতা হাত ধরে টেনে বলল, যাচ্ছো কোথায়?

ওই যে নৌকা পাওয়া যাবে!

তোমার এই বাড়াবাড়ি টা না আমি জাস্ট মানতে পারি না। একেই অচেনা জায়গা। কোথাকার একটা বাচ্চা মেয়ে বলল আর তুমি ওর পিছনে দৌড়াচ্ছো! শমীক কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ।

আরে ধুর তুমি অকারণই চিন্তা করছো। কিচ্ছু হবে না। আসো তো। বলে আবারও তাকে টেনে নিয়ে গেল শমীক।

বাড়ির উঠোনে বসে রোদ পোহাচ্ছিল রত্না। মানা দৌড়ে এসে বলল, মা! মা! জানো ওখানে না দুজন ঘোরার জন্য নৌকা খুঁজছে!

রত্না ব্যস্ত হয়ে বলল, বলিস কি! যা এক্ষুনি ডেকে নিয়ে আয়। আমি তোর বাবা কে ডাকিগে।

আমি বলেছি আসতে। ওই দেখো না আসছে ওরা। পিছন ঘুরে তাকালো মানা। রত্নাও দেখল দুজন অপরিচিত তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। রত্না সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলকে ডাকতে গেলো ভেতরে। শমীক ও রীতা মানার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে শমীক হেসে জিজ্ঞেস করল, তুমি নৌকার কথা বললে! কোথায়?

মানা খিলখিল করে হেসে বলল, দাঁড়াও মা বাবাকে ডাকতে গেছে। আমার বাবার নৌকা আছে।

তাই?

এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে শ্যামল ও রত্না বেরিয়ে এলো। শমীক তাদের দুজনকে দেখে একটু ইতস্তত করে বলল, নমস্কার! ও বলল যে, এখানে নাকি নৌকা পাওয়া যাবে!

রত্না উচ্ছসিত কন্ঠে বলল, হ্যাঁ পাওয়া যাবে। কিগো যাওনা ওনাদের একটু ঘুরিয়ে আন।

শ্যামল অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ইয়ে... হ্যাঁ আসছি দাঁড়ান।

শমীক খালি হাসলো।

রীতার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে পুরো ব্যাপারটায়। শমীকের কানের কাছে বলল, দেখো আমার না ভীষণ অদ্ভুত লাগছে।

শমীক হাত নেড়ে তাকে শান্ত হতে আশ্বস্ত করলো।

শ্যামল কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পরনের লুঙ্গিটাকে ছেড়ে একটা গোল গলা গেঞ্জি আর একটা প্যান্ট পড়ে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এল। আসুন এই দিকে। রত্না হেসে বলল, যান আপনারা। ঘুরে আসুন। খুব ভাল লাগবে।

শমীক একটা চওড়া হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে শ্যামলকে অনুসরণ করল। রীতাও মৃদু হাসল।

বাড়ির লাগোয়া পার বেয়ে শ্যামল নীচে নেমে বলল, আসুন। একটু দেখে নামবেন হ্যাঁ।

পারটা বেশ উঁচু তবে খুব একটা খাঁড়া নয়। বেশ ঢালুই। ঢাল বেয়ে বেশ কতকগুলি বাঁশ গাছ দিয়ে একটা সিঁড়ির মতন মই বানানো। রীতা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, আমি এখান দিয়ে নামবো কি করে?

দাঁড়াও খুব সোজা। প্রথমে আমি নামি। তারপর তোমায় ধরে নামাচ্ছি।

দেখো। খুব সাবধানে!

শমীক খুব সহজ ভাবেই মই বেয়ে নেমে এলো।

কোথায়? এসো!

দাঁড়াও। খানিক ইতস্তত করলো রীতা। তারপর অতি সন্তর্পনে সেও মই বেয়ে নেমে নীচে এলো। শমীক শ্যামলকে উদ্দেশ করে বলল, চলো। কোথায় তোমার নৌকা?

ওই তো আসেন। আঙ্গুল দিয়ে দেখালো সে।

রীতা চোখ বড় বড় করে বলল, একি! এটাতে করে যাবো নাকি আমরা? এটাতো খুবই ছোট। তিনজন হবে নাকি!

আহা চুপ করো না।

শ্যামল হেসে বলল, কোনো চিন্তা নেই ম্যাডাম। তিনজন কেন, সাতজন উঠলেও কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আপনারা, শহরের মানুষেরা নৌকা বলতে যা বোঝেন সেইসব এখানে পাবেন না। এখানকার মানুষ সবই ওই ছোট ছোট ডিঙাগুলিই ব্যবহার করে। আসেন। একটু সাবধানে উঠবেন। বলে প্রথমে সে নৌকায় উঠে অপর প্রান্তে গিয়ে বসল। তারপর শমীক ধীরে সুস্থে দোদুল্যমান নৌকাতে উঠে রীতাকেও তুলে নিল।

চলেন তাহলে। বলে ধীরে ধীরে শ্যামল নৌকার দাঁড় টানতে আরম্ভ করলো।

(২)

জলের ছলাত্ ছলাত্ শব্দে রীতা থেকে থেকে বিভোর হয়ে পড়ছে। নৌকার মৃদু দোলানিতে সে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। শ্যামল একই লহমায় দাঁড় টেনে চলেছে। কখনও ডান পাশে, কখনও বাঁ পাশে। বিকেল হয়ে গিয়েছে। সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বে গোটা আকাশটিকে সোনালী আভায় মাখিয়ে দিয়েছে। সন সন করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারিদিক। হাওয়ায় তোড়ে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রীতার। তবুও কোন তাড়া নেই তার। ধীরে সুস্থে কোমল ভাবে চুলগুলো কে ঠিক করবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। শমীক কেবল তার ক্যামেরা নিয়েই ব্যস্ত। অনবরত ফোটো তুলছে আর মাঝে মাঝে ওই দেখ, ওটা দেখ করে যাচ্ছে। রীতার তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। কি শমীক দেখতে বলল, কি না দেখতে পেয়ে সে খুব বড় জিনিস মিস করলো, তাতে তার কিচ্ছু এসে যাচ্ছে না। সে এখন সবকিছু কে অস্বীকার করে দিয়ে নিজেকে একাই বোধ করছে।

নৌকা অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। যে পার থেকে তারা উঠেছিল, তা আর দেখা যাচ্ছে না। হ্রদের দুধারে কেবল সারি সারি গাছ আর ছোট ছোট ঘর বাড়ি। হ্রদের প্রায় মাঝখানে একটি সরু লম্বা চড় চোখে পড়ল। তাতে বক, মাছরাঙা, শালিক আরও কত পাখি আড্ডা জমিয়েছে। বোধহয় তাদের নৌকাটা কেও তারা পরিলক্ষিত করেছে।

রীতা চোখ খুলে কোমল সুরে বলল, তোমাদের এই জায়গাটা কিন্তু খুব শান্ত। খুব সুন্দর।

অ্যা কিছু বললে?

তোমায় না। আমি মাঝি ভাইকে বলছি। তুমি তোমার কাজ করো।

শ্যামল মুচকি হাসলো।

রীতা বলল, এই দেখেছো। এতক্ষণ ধরে তোমার নৌকায় চড়ছি আর তোমার নামটাই জানা হয়নি।

হ্যাঁ তাইতো! তোমার নাম কি গো দাদা? শমীকও রীতার সাথে তাল দিল।

আজ্ঞে আমার নাম শ্যামল মন্ডল।

শমীক জিজ্ঞেস করল, তা তুমি করো কি? এটাই তোমার পেশা নাকি?

আরে না না। চাষবাস করি। নৌকাটা আমার শখের জিনিস। মাঝে মধ্যে এটা নিয়ে ওই একটু মাছ ধরতে বের হই। সত্যি বলতে আপনারাই প্রথম যাদেরকে নিয়ে এই বাঁওরটা ঘোরাতে বেরিয়েছি।

তাই নাকি! হো হো করে হেসে উঠলো শমীক। বলল, তা বেশ। তা বেশ। আমাদের দিয়েই তোমার এই কাজের শুভারম্ভ হলো।

আচ্ছা এখানে অনেকেই ঘুরতে আসে বুঝি? রীতা জিজ্ঞেস করল।

শ্যামল বলল, হুম অনেকেই তো আসে দেখেছি। তবে সবসময় নয়। শীতকালেই বেশি আসে মানুষজন। ওই ওপারে একটা পিকনিক স্পটও খুলেছে। ওখানে পিকনিক করতে আসলেই লোকজন এই বাঁওরটাতে নৌকা চড়ে।

বর্ষাকালে বন্যা হয় এখানে?

খুব বৃষ্টি হলে হয়। তা নাহলে ওই পার ডুবে যায়।

তোমাদের জীবন তো খুবই রিস্কি। বলল শমীক।

ও আমাদের অভ্যেস আছে স্যার। আমরা দুই তিন পুরুষ ধরে এই গ্রামে বাস করছি।

ওই বাড়িটাকি তোমার? প্রশ্ন করল রীতা।

মাথা দোলালো শ্যামল। হ্যাঁ।

আর তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যে মহিলা আমাদের সঙ্গে কথা বললেন তিনি নিশ্চয়ই...

আমার বউ। রত্না। আর আপনাদের যে ডেকে নিয়ে এসেছিল সেটা আমার মেয়ে মানা।

মানা! এ আবার কেমন নাম! শমীক শ্যামলের দিকে চাইল।

শ্যামল হেসে বলল, মানা ওর ডাকনাম। ওর ঠাকুমা দিয়েছিল। ভাল নাম হলো মনীষা।

বাহ্ খুব সুন্দর নাম তোমার মেয়ের। রীতা মুচকি হাসলো। তোমার বউকে কিন্তু দেখতে খুব সুন্দরী। ভাল মানিয়েছে তোমার সঙ্গে।

কথাটায় বেশ লজ্জা পেলো শ্যামল। একটুখানি হেসে মাথা নীচু করে নিল সে।

রীতা প্রশ্ন করল, প্রেম করে বিয়ে নিশ্চয়ই?

শ্যামল একটু মুচকি হেসে সম্মতিসূচক মাথা দোলালো।

দেখতে দেখতে বিকেল অনেকটাই গড়িয়ে গিয়েছে। সোনালী আকাশ ঈষৎ কালো রঙ ধরেছে। সূর্যকে আর চোখে পড়ছে না।

শমীক ক্যামেরাটাকে ব্যাগে পুড়তে পুড়তে বলল, না শ্যামল ভাই খুব ভাল ঘুরলাম গো তোমার নৌকায়। খুব ভালো অভিজ্ঞতা হলো।

শ্যামল গদগদ হয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ। আবার আসবেন আপনারা।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এতো সুন্দর একটা জায়গা একবার এসে মন ভরলো না। আবার আসতেই হবে। কি বলো রীতা?

হুম। মৃদু হেসে মাথা দোলালো সে।

শ্যামল বলল, এরপরের বার এলে সকাল সকাল চলে আসবেন। দুপুরে এই গরীবের বাড়িতেই না হয় খাবেন। আশা করি অসুবিধা হবে না কোন। তবে কি! সকালে এলে আমাদের গ্রাম, আমাদের ক্ষেত খামার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে পারবো।

রীতা শান্ত ভাবে বলল, তাই! সত্যি তোমার বাড়িতে খাওয়াবে?

হ্যাঁ একদম। নিমন্ত্রণ রইল আপনাদের দুজনের।

ভালই হলো। তাহলে তোমার ফোন নম্বরটা দিয়ে দাও।

হ্যাঁ নিন।

শোনো না রীতা। একেই জিন্সের প্যান্ট পড়ে রয়েছি। বসে বসে মোবাইলটা বের করতে পারছিনা। তোমার ফোনতো তোমার হাতেই রয়েছে। নম্বরটা নিয়ে নাওতো।

নিচ্ছি।

শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বলল, বলো।

নম্বর নেওয়ার পর শমীক বলল, আমাদের তাহলে ওই পারে নামিয়ে দাও। এবার বাড়ি যেতে হবে।

চলুন ওই পারের পিকনিক স্পটের সামনে নামিয়ে দিই। ওখান থেকে মেন রাস্তাটা কাছে হবে।

শ্যামল ওইপারে নৌকা থামাতে শমীক তাকে যথার্থ ভাড়া দিয়ে রীতাকে নিয়ে নেমে পড়ল। তারপর হাত নেড়ে বলল, তাহলে আসি শ্যামল ভাই। আবার এলে দেখা হবে।

আগের থেকে ফোন করে আসবেন। শ্যামলও হাত নাড়লো।

শেষবারের মতন হাসি বিনিময়ের পর শমীক ও রীতা মেন রোডের অভিমুখে হাঁটতে লাগলো। শ্যামলও বাড়ি মুখো হলো। এরই মাঝে রীতা নীরবে একবার পিছন ফিরে শ্যামলের দিকে চাইল।

(তিন)

সেই পেশীবহুল দাঁড় টানা হাত, সেই মেদহীন শরীর, সেই পাথরে মতন চওড়া বুকের ছাতি, সেই শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি - বারবার রীতার কল্পনাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। নিদারুণ গতিতে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে শরীরের ভেতরটায়। অসহায়ের মতন খালি এপাশ ওপাশ করছে সে। সবে নটা। এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস নেই তার। তবে আজ সে ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে। ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে লেপটাকে আপাদমস্তক ছড়িয়ে দিয়েছে অনেকক্ষন। তবুও সে অস্থির। নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে তার। সারা শরীর জুড়ে যেন হাজার হাজার পিঁপড়ে বিড়বিড় করছে। অসহায়ের মতনই সে তার গায়ে হাত বুলিয়ে সেই অদৃশ্য পিঁপড়ে গুলোকে শান্ত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই তার একটা হাত গলা, বুক, পেটকে অতিক্রম করে আচমকাই নীচের দিকে নেমে গেলো। পরনের নাইট গাউনটাকে কোন ক্রমে কোমর অবধি তুলে নীচের অন্তর্বাসের উপর আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে আরেকটা হাতকে বুকের উপর রেখে মুখ দিয়ে দ্রুত শ্বাস ছাড়তে লাগলো। হঠাৎই মোবাইলটা বেজে ওঠায় কামের উপাসনায় বিঘ্ন ঘটলো তার। সে বিরক্ত চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো পাশের ফ্ল্যাটের চন্দ্রিমা বৌদি ফোন করেছে। রীতা ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলল।

কিগো বাড়ি ফিরেছো?

হ্যাঁ এই কিছুক্ষণ আগেই এলাম।

বিরক্ত করলাম কি?

আরে না না। বলো।

জানোই তো তোমার দাদা আজ অফিস ট্রিপে নর্থ বেঙ্গল গেলো। তাই একটু একা লাগছে। বলছি... একটু আসবে আমার রুমে? গল্প করতাম। আসলে তোমার দাদাকে ফোন করছি কিন্তু বারবার আউট অব রিচ...

উফ্ বৌদি! তোমার কাছে কি আমি কোনো এক্সপ্লনেশন চেয়েছি? আসছি দাঁড়াও।

রীতা বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ে একটা চাদর চাপিয়ে "মা আমি একটু চন্দ্রিমা বৌদির ঘরে যাচ্ছি" বলে বেরিয়ে গেলো।

চন্দ্রিমা হচ্ছে রীতার খুব কাছের মানুষগুলোর মধ্যে একজন। প্রায় বেস্ট ফ্রেন্ড। মনের যে কথাগুলো সে শমীককে বলতে পারে না সেগুলো সে চন্দ্রিমার সঙ্গে সচ্ছন্দে ভাগ করে নিতে পারে। তাদের সম্পর্কের গভীরতা শুধু এইটুকুই নয় আরও গভীর অবধি মিশে গিয়েছে।

এসো, এসো। এক গাল হাসলো চন্দ্রিমা।

রীতা ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলো সে। যথারীতি রীতা সোজা বেডরুমে গিয়ে ঢুকে পড়ল। ঘরের ভেতর সেই দারুন গোলাপের ফ্রেসনারের গন্ধ। ভীষন পছন্দ তার।

ভালোই হয়েছে তুমি... কথাটা বলতে বলতে চন্দ্রিমা পেছনেই আসছিল কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারলো না সে। বিদ্যুতের গতিতে রীতা চন্দ্রিমার মুখটাকে তার দুই তালুর মধ্যে আটকে তার ঠোঁট দুটিকে চন্দ্রিমার ঠোঁটের সঙ্গে মিলিয়ে দিল। চন্দ্রিমাও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ধীরে ধীরে তারা মোলায়েম বিছানার উপর ধপ করে পড়ে গিয়ে দুজনেই দুজনের ঠোঁট, গাল, গলা আদরে ভরিয়ে দিল। একে একে বিবস্ত্র হলো দুজনে আর গরম লেপের আড়ালে তলিয়ে গেলো তারা।

রীতা চন্দ্রিমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে তার একটা স্তনবৃন্তের উপর খুব ধীর গতিতে আঙ্গুল বোলাচ্ছে আর গুনগুন করে গান করছে। চন্দ্রিমা তার নগ্ন পীঠের উপর আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল, এরকম তৎপরতা তো আগে কখনও দেখেনি! কি হয়েছে?

রীতা কোন জবাব দিল না।

চন্দ্রিমা ঈষৎ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ওই! কিছু জিজ্ঞেস করছি তো!

রীতা তার গুনগুনানি থামিয়ে বলল, হুম শুনেছি।

তাহলে উওর দিচ্ছো না যে।

রীতা বুকের থেকে মাথা সরিয়ে পাশের বালিশে টান হয়ে শুয়ে বলল, কি করে বলবো সেটাই বুঝে পাচ্ছিনা।

খুব পার্সোনাল? নাকি খুব সিরিয়াস?

কোনটাই না। বলে সে চন্দ্রিমার দিকে পাশ ফিরে শুলো। মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা বৌদি, দাদা ছাড়া আর কেউ আছে যার সাথে তোমার সেক্স করতে ইচ্ছা করে?

হ্যাঁ আছে তো। তুমি আছো। তোমার কথা মনে পড়লেই তো আমার সারা শরীরটা কেমন কেমন করতে থাকে।

হো হো করে হাসলো চন্দ্রিমা।

রীতা বলল, আরে ধুর আমি আমার কথা বলছি না।

তাহলে?

কোন ছেলে বা এমন কেউ?

চন্দ্রিমা খানিক ভেবে নিয়ে বলল, হ্যাঁ একজন ছিল। তোমার শুনে একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে সত্যি আমি তার জন্য পাগল ছিলাম। ওকে দেখলেই আমার হয়ে যেত।

এতে অদ্ভুত কি? কোয়াইট ন্যাচারাল।

অদ্ভুত এই যে, ছেলেটি সম্পর্কে ছিল আমার জ্যাঠতুতো দাদা।

নিজের? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রীতা।

আজ্ঞে ম্যাডাম।

কোনদিন ইয়ে মানে কোনদিন অ্যাপ্রচ করনি?

হুম চোখের ইশারায়, অঙ্গি ভঙ্গিতে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু গান্ডুটা বোঝেনি অথবা বোঝার চেষ্টা করেনি। কিন্তু দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া, তোর কেসটা কি বলতো?

একটা পুরুষ মানুষ।

কে পুরুষ মানুষ?

আজ গেছিলাম না বেড়াতে। সেখানেই আলাপ হয়েছে। তার নৌকাতেই আমরা অনেকক্ষণ ঘুরেছি। তার সেই পেটানো শরীর, টি-শার্ট এর উপর থেকেই উঁচু হয়ে থাকা বুকের ছাতি, সেই দাঁড় টানা বলিষ্ঠ হাত দুটি - উহঃ বৌদি কোন পুরুষের চেহারা যে কোন ওয়ার্কআউট ছাড়া এমন হতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। আমি যেন তাকে ভুলতে পারছি না বিশ্বাস করো।

এসব তুমি কি বলছো?

সত্যি বলছি। ওর স্ত্রীর কথা ভাবলে আমার ঈর্ষা হয়। ওইরকম একটা পুরুষকে মেয়েটা ভোগ করছে।

কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ রীতা। তুমি এতটা কামুক তো ছিলেনা। শমীক কি তোমায়...

ওই আবালটার কথা বাদ দাও। সারাদিন নিজের মধ্যেই ডুবে থাকে। ও নাকি আবার! হু...

রীতা উঠে তার নাইট গাউন টা পড়ে নিল।

আচ্ছা আমি আসি বুঝলে। নাহলে মা এক্ষুনি ফোন করবে। রাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ফোন করো! ঠিকাছে! আর নাইটিটা পড়ে নাও।

তোমায় আরেকটু ভাত দেই?

না। আমার পেট ভরে গেছে।

শ্যামল থালাতে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বিড়ি খেতে গেলো। বিড়িটা শেষ করে দরজা বন্ধ করে নিঃশব্দে রত্নার পাশে গিয়ে শুতেই রত্না পাশ ফিরে নীচু গলায় বলল, কিগো!

হু বলো।

আজ চুপচাপ শুয়ে পড়লে যে!

খুব ক্লান্ত লাগছে।

হবেই। আজ অনেকক্ষণ ধরে ওই দাঁড় বেয়েছো।

তাই হবে হয়তো।

ওই ছেলে মেয়ে দুটো ভাল ঘুরেছে?

হুম ভীষণ। খুব প্রশংসা করলো তোমার। এমনকি আমার ফোন নাম্বারও নিয়ে গেলো। বলেছে পরেরবার আসলে আমায় ফোন করবে।

এতো খুব ভালো কথা। বলে রত্না শ্যামলের বুকের উপর হাত বোলাতে লাগলো।

তাহলে তো এই কাজটা এবার পুরোদমে শুরু করতে পারো। ওরা এইটুকু ঘুরে তোমায় দুশোটা টাকা দিলো। এরকম ভাবে সারাদিনে দু তিনবার নৌকায় ঘোরালে ভালই রোজকার হবে।

দেখা যাক।

রত্না ম্লান হেসে শ্যামলকে জড়িয়ে ধরলো।

সেদিনের পর থেকে শ্যামল এই নৌকা করে পর্যটক ঘোরানোর কাজে বেশ মনোযোগী হয়েছে। পিকনিক করতে এলেই সে ওই পিকনিক স্পটের সামনে অন্যান্য মাঝিদের মতনই ধর্না দিয়ে বসে থাকে পর্যটকদের আশায়। টুকটুক করে ভালোই দাঁড় টানে সে। রোজকারও করে ভালোই।

এমনি একদিন চারজন পর্যটকদের নিয়ে সে হ্রদের উপর ঘোরাচ্ছে এমন সময় তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। অচেনা নাম্বার। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন মহিলা প্রশ্ন করল, কে? শ্যামল কথা বলছো?

হ্যাঁ বলছি। আপনি কে বলছেন?

আমি... রীতা বলছি।

কে রীতা? ঠিক চিনতে পারলাম না তো।

তাও ঠিক। আমার নাম বললে তোমার না চেনাটাই স্বাভাবিক। সেদিন তোমার নামটা জিজ্ঞেস করেছিলাম তবে আমার নামটা আর বলিনি।

সে যাইহোক। কি ব্যাপার বলুন।

আমি সেই ম্যাডাম বলছি যাকে তুমি প্রথম তোমার নৌকায় করে ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছিলে। মনে পড়েছে?

ও হ্যাঁ হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। ওরে বাবারে! তা কেমন আছেন?

ভালো। তুমি?

এই চলে যাচ্ছে ম্যাডাম। তা স্যারের কি খবর? উনি ভালো আছেন তো?

রীতা কয়েক মূহুর্ত থেমে বলল, হ্যাঁ খুব ভালো আছে। বলছি তুমি ব্যস্ত আছো নাকি?

ব্যস্ত বলতে ওই ঘোরাচ্ছি।

তাহলে বোধহয় ভুল সময়ে ফোন করলাম।

এ বাবা ছিঃছিঃ এমন ভাবে বলবেন না। জিভ কাটলো শ্যামল।

আচ্ছা তুমি কি এই রবিবার ফাঁকা আছো?

হ্যাঁ একদম ফাঁকা।

বেশ। তাহলে আমি আসবো কেমন!

অবশ্যই। সকালেই চলে আসুন। বলছি স্যারও আসবেন তো?

না শমীক আসবে না। আমি একাই আসবো। অসুবিধা আছে কোনো?

আরে না না।

তাহলে ওই কথাই রইল রবিবার।

ঠিকাছে ম্যাডাম। এখানে এসে আমায় ফোন‌ করবেন। আমি নিতে আসবো খন।

আচ্ছা।

(৫)

রীতা এবং চন্দ্রিমা শহরের একটি খ্যাতনামা কফি সপে এসেছে। এই ভর দুপুরে কফি সপটা একদমই ফাঁকা। তাদের টেবিলটা বাদে আর মাত্র একটা টেবিলেই কয়েকজন ছেলে মেয়ে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। রীতা ইচ্ছা করেই একদম কোন ঠাসা টেবিলটা বেছে নিয়ে বসেছে। চন্দ্রিমা দু কাপ কফি অর্ডার দিয়ে রীতার মুখোমুখি গিয়ে বসলো। সপের সাউন্ড সিস্টেম থেকে একটি সুন্দর ইংরেজি গানের সুর একদম অল্প আওয়াজে ভেসে আসছে। তবে মাঝে মাঝে অন্যপ্রান্তে বসে থাকা ছেলে মেয়েগুলোর অট্টহাসি বেশ প্রকট ভাবেই গরম করে তুলছে পরিবেশ। রীতা তিক্ত কন্ঠে বলল, কোথাও গিয়ে শান্তি নেই?

চন্দ্রিমা চোখ টিপে হেসে বলল, রিলাক্স। অতটাও কোলাহল নেই এখানে।

ম্যাম আপনাদের কফি।

থ্যাঙ্ক ইউ।

একটা ছেলে কাপ দুটোকে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে চলে গেলো। চন্দ্রিমা একটা কাপের আংটায় আঙ্গুল গলিয়ে দিয়ে বলল, কি হয়েছে বলো। এতো জরুরি তলব করলে যে! ইজ এভরিথিং অলরাইট?

কাপে একটা চুমুক দিলো সে। রীতা তার গরম কফি কাপটাকে দু হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, এমনি সব ঠিকই আছে। খালি একটা কথা ভাবছি বুঝলে।

তারপর কাপটাকে ধরে ঠোঁটের সঙ্গে ঠেকালো।

চন্দ্রিমা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কি কথা?

রীতা মোহগ্রস্থের মতন তাকিয়ে বলল, শ্যামলকে দ্বিতীয়বারের জন্য যদি সামনা সামনি দেখি তাহলে নিজেকে কি করে সামলে রাখবো?

মানে?

আমি ফোন করেছিলাম। এই রবিবার যাবো বলেছি।

কার সাথে? দাঁড়াও দাঁড়াও এবার এটা বলো না যে, তুমি একাই যাচ্ছো!

রীতা ম্লান হাসলো। হ্যাঁ আমি একাই যাচ্ছি।

মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি তোমার! তাছাড়া শমীক জানে?

না। রীতা অপরাধীর মতন চন্দ্রিমার দিকে তাকালো।

ইউ মিন তুমি শমীকের সঙ্গে চিট করবে?

কোথায় চিট করছি! আমি তো খালি শ্যামলকে দেখতে যাচ্ছি।

পুরো ব্যাপারটাইতো ওর অজ্ঞাতসারে হচ্ছে, তাই না?

তোমার আমার সম্পর্ক, সেটাও তো ওর অজ্ঞাতসারেই চলছে। তাহলে বলো সেটাও ওকে জানিয়ে দিই!

কথাটা গায়ে লাগলো চন্দ্রিমার। "ওকে ফাইন" বলে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো সে।

তোমার লাইফ তুমি ভালো বুঝবে। কথাটা বলেই সে হন্যে হয়ে কফি সপ থেকে বেরিয়ে গেলো।

রীতাও তার পিছু নিলো।

বৌদি শোন! বৌদি!

ফুটপাতের উপর কিছু দূর এগোতেই চন্দ্রিমার হাত টেনে ধরলো রীতা। চন্দ্রিমা বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকালো।

প্লীজ বৌদি, লিসেন টু মি। রাগ করো না প্লীজ। সত্যি বলছি তোমায় ইনটেনসানালি হার্ট করতে চাইনি। সরি। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গিয়েছে।

রত্না রান্নাঘরে বসে সবজি কাটছিলো। এখনও রাতের খাবারের বিশেষ কোনো আয়োজন হয়নি। শ্যামলকে আসতে দেখে সে দাওয়ায় এসে বলল, হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি চা করে নিয়ে আনছি।

শ্যামল কলপাড় থেকে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে চৌকির উপর বসে বলল, মানা কই? ওকে দেখছি না যে!

রান্নাঘর থেকে রত্না আওয়াজ দিলো, ও ঝুনুদের বাড়ি খেলতে গেছে।

মেয়েকে পড়তে বসাওনি আজ?

রত্না চায়ের কাপ হাতে ঘরে প্রবেশ করে বলল, তোমার দস্যি মেয়ে কি একটাও কথা শোনে আমার! দিন দিন একটা বেয়াদব তৈরী হচ্ছে। এই নাও চা।

শ্যামল কাপটা হাতে নিল।

রত্না বলল, আজ রাতে আর মাছ কুটতে ইচ্ছা করছে না। রাতে ডাল আর বেগুন ভাজা করি?

শ্যামল চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, করো।

রত্না একটু মুচকি হেসে শ্যামলের পাশে বসে জিজ্ঞেস বলল, হ্যাঁ গো আজ তো শুনেছি অনেক লোকেই নাকি পিকনিক করতে এসেছিল।

শ্যামল ক্লান্ত ভাবে বলল, হুম। আজ সেভাবে বসে থাকার সুযোগই পাইনি।

তাহলে তো ভালোই আয় হয়েছে বলো?

হুম হয়েছে তো।

রত্না উচ্ছসিত ভাবে বলল, আচ্ছা তুমি তাহলে একটু জিরিয়ে নাও। যাই মানাকে ডেকে নিয়ে আসি। এদিকে রান্না বসাতে দেরী হয়ে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে খেতে।

বলেই সে বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম করছিল এমন সময় শ্যামল বলল, ভালো কথা। তোমার সেই ম্যাডামের কথা মনে আছে?

রত্না ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কোন ম্যাডাম?

আরে সেদিন যে মানা একটা ছেলে আর মেয়েকে নৌকা চড়াবার জন্য ডেকে নিয়ে এসেছিল! মনে পড়েছে?

ও হ্যাঁ হ্যাঁ। তা কি হয়েছে?

ম্যাডাম ফোন করেছিলো আজ।

কি বলল?

এই রবিবার ফের আসবে।

ঘুরতে?

হ্যাঁ। তবে আমাদের বাড়িতে।‌ দুপুরে এখানেই খাবে।

বলো কি! ওনারা শহরের মানুষ। গরিবের বাড়ির খাবার ওনার মুখে রুচবে?

অত শত জানিনা। ম্যাডাম আসবে বলল। ব্যস।

তাহলে তো সেভাবেই আয়োজন করতে হবে।

সে না হয় করে দেব আমি।

বেশ।

রত্না বেরিয়ে গেল।

রবীন্দ্র সরোবরটা আগাগোড়াই রীতার ভীষণ প্রিয়। সুযোগ পেলেই সে এখানটায় ছুটে চলে আসে। হাজার বিষাদের মধ্যেও এই সরোবরের আগাগোড়া মোড়া প্রকৃতি তাকে যেন মুগ্ধ করে তোলে। সদ্য রোদ্দুরটা মোরে এসেছে। রীতা আর চন্দ্রিমা সরোবরেরই ধারে একটি বেঞ্চর উপর বসে। মাথার উপরে এক বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছের ছাউনী। মাঝে মাঝে একটা দুটো করে ফুল ও পাতা টপটপ করে বিনা অনুমতিতেই গায়ে খসে পড়ছে।

রীতা চন্দ্রিমার দিকে চোখ রেখে বলল, তুমি এখনও আমার উপর রাগ করে আছো বৌদি?

চন্দ্রিমা দু দিকে মাথা নাড়লো। তারপর রীতার হাতের উপর হাত রেখে বলল, না গো। এতে তোমার কোন দোষ নেই। আমি একটু বেশি বেশি করছিলাম।

ওমন করে বলো না প্লীজ। তোমার পুরো অধিকার আছে।

ওত অধিকার বুঝিনা। তবে তোমার জন্য চিন্তা হয়।

রীতা একটা মলিন হাসি দিল। চন্দ্রিমার কাঁধে মাথা রেখে বলল, জানো বৌদি আমি শমীকের সঙ্গেও অতোটা সহজ নই, যতটা তোমার সঙ্গে হতে পারি। তার মানে এটা নয় যে, আমি শমীকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে খুব দুঃখে আছি। তাই বলে আবার সুখেও আছি ঠিক তেমনটাও কিন্তু বলা যায় না। অভ্যেসবশত আছি। কথা বলি, ঘুরতে যাই, কেয়ার করি। ভালো ছেলে ও। কিন্তু এখনও পুরুষ হতে পারেনি আমার কাছে।

শ্যামল বুঝি প্রথম দর্শনেই তোমার কাছে বিরাট পুরুষ হয়ে উঠেছে?

সেটা আমার পক্ষে বিশ্লেষণ করা কঠিন।

রীতা মাথা সোজা করল। তারপর বেশ উত্তেজিত ভাবে বলল, তবে ওর চেহারায় যে পুরুষত্বরের ছাপ রয়েছে তা আমাকে থেকে থেকে পাগল করে দিচ্ছে। ভাবিয়ে তুলছে বারবার। বিশ্বাস করো সেদিনের পর থেকে একটা রাতও আমি সুস্থ মনে ঘুমাতে পারিনা।

চন্দ্রিমা তার একটা হাত ধরে বলল, তুমি এক নিদারুণ মোহের মধ্যে পড়ে গেছো রীতা। সাবধান!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। বলল, ঠিকই বলেছো। এই মোহ সহজে ভাঙ্গবার নয়।

চন্দ্রিমা কৌতুহলী হয়ে রীতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি শ্যামলকে ভালবেসে ফেলেছ?

রীতা গম্ভীরভাবে জবাব দিল, না বৌদি। শ্যামলকে ভালবাসা যায় না। শমীক আর শ্যামল দুজনের গুরুত্ব সম্পূর্ণ আলাদা আমার কাছে।

তাহলে?

শুধু ওর পুরুষত্বটাকে একটু আঁচ করতে চাই।

ইউ মিন সেক্স? চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো চন্দ্রিমার।

সেক্স না হোক। নিদেনপক্ষে একটু ছোঁয়াছুঁয়ি।

(৬)

রবিবার দিন সকালে...

কিগো শুনছো! এই নাও বাজারের ব্যাগটা। ভাল করে রান্না করো কিন্তু!

সকাল থেকেই বেশ খোশ মেজাজে আছে শ্যামল। ম্যাডাম তার বাড়িতে আসছে। এই উপলক্ষ্যেই যেন তার বাড়িতে আজ উৎসব লেগে গিয়েছে। মানা বাড়ির উঠোনেই একা একা রান্নাবাড়ি খেলছিল। শ্যামল কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এই যে দস্যি মেয়ে! আজ বাড়িতে কিন্তু লোক বেড়াতে আসবে। তাই কোন দুষ্টুমি করা চলবে না।

মানা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে আসবে বাবা?

ওই সেদিনের সেই পিসিটা।

বাবা, ওই পিসিটা কি কলকাতায় থাকে?

শ্যামল হেসে মাথা দোলালো।

মানা উৎফুল্ল হয়ে বলল, তাহলে পিসিটাকে বলবে আমায় কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে যেতে?

চোপ! বড্ড কথা শিখে গেছে! মৃদু ধমক দিল শ্যামল।

কিগো শ্যামল! শুনলাম তোমার বাড়িতে নাকি আজ অতিথি আসছে। পাশের বাড়ির পৌঢ় ভদ্রলোক হেসে জিজ্ঞেস করলেন।

শ্যামলের‌ জবাবের আগেই মানা বলে উঠলো, হ্যাঁ গো জ্যেঠু। কলকাতা থেকে আসবে।

ওরে বাপ রে! সেতো বিরাট ব্যাপার!

শ্যামল একটু আলগা হাসলো।

দেখতে দেখতে বেলা অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে। রত্নারও রান্না অনেকটা হয়ে এসেছে। শ্যামল দাওয়ায় বসে নারকেলের খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত। রত্না রান্নাঘর থেকে বাইরে এসে শাড়ির আঁচলে হাত পুছতে পুছতে বলল, ম্যাডাম কখন আসবে গো? রান্নাতো প্রায় শেষ। মাংসটা রান্না করলেই হয়ে যায়।

কি জানি?

তুমি ফোন করোনি?

না। আসলে সেদিন ম্যাডাম ফোন করলো। কাজের তারণায় নাম্বারটা সেভ করতে ভুলে গেছিলাম। পরে আর খুঁজে পাইনি নাম্বারটা।

তুমিও না সত্যি!

বাবা! বাবা! কই শহরের পিসিটা এসেছে? মানা তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা শেষ করে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে জিজ্ঞেস করল।

শ্যামল গম্ভীর ভাবে বলল, না আসেনি এখনও।

রত্না ব্যস্ত হয়ে বলল, যা তুই স্নানে যা। তাড়াতাড়ি স্নান করে নে। পিসি যখন তখন চলে আসবে। জানালার ধারে দেখ তেল রেখে দিয়েছি।

না আমি ঠান্ডার মধ্যে স্নান করব না।

একটা চড়ে গাল লাল করে দেব! তুই তেল মাখতে লাগ। আমি জল গরম করে দিচ্ছি।

মানা মুখ কাচুমাচু করে জামা ছেড়ে তেল মাখতে লাগলো। এমন সময় শ্যামলের মোবাইলটা আওয়াজ করে উঠতে রত্না বলল, ওই দেখো ম্যাডাম ফোন করেছে হয়তো।

মানা উচ্ছসিত হয়ে বলল, দাঁড়াও আমি ফোনটা এনে দিচ্ছি।

এক ছুটে সে ঘরের ভেতর থেকে মোবাইলটা এনে বাবার হাতে দিল। এই নাও।

শ্যামল মোবাইলটা কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে রীতার আওয়াজ। হ্যালো! বলছি আমি প্রায় এসে গেছি। কোথায় আছো তুমি?

শ্যামল ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি আসছি। আপনি অটো থেকে নেমে পাঁচপোতা বাস স্ট্যান্ডের সামনেই দাঁড়াবেন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বো।

আচ্ছা ঠিকাছে।

আমি ম্যাডামকে নিয়ে আসি, বলে শ্যামল সেইরূপ ব্যস্ত হয়েই গায়ে একটা জামা চড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো।

রীতা অটো থেকে নেমে বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে লাগলো। শ্যামলও কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লো সেখানে। রীতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে সহাস্যে বলল, আসতে অসুবিধা হয়নি তো কোন?

না তেমন একটা না। তবে এই জায়গাটার নামটা ভুলে গেছিলাম। অনেক বিবরণ দিয়ে তারপর অটোওয়ালাকে বোঝাতে পেরেছি।

আমায় একটা ফোন করলেই তো পারতেন।

আরে সেটা তো পড়ে খেয়াল হল। ওই যে কথায় আছে না চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।

দুজনেই হেসে উঠলো।

চলুন।

পোঁচপোতা থেকে একটা টোটো ভাড়া করে শ্যামল ম্যাডামকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হল।

টোটো থেকে নেমে তারা দুজনেই হাঁটতে আরম্ভ করেছে। এই রাস্তা রীতার চেনা। কিছুটা এগোতে সেই রামকৃষ্ণ মঠটা এবং তার উল্টো দিকে অবস্থিত ছাউনী সহ দোকানটা দেখতে পেলো। রীতা জিজ্ঞেস করল, তোমরা মেন রোডে যাতায়াত করো কি করে? সব সময় টোটো পাওয়া যায়?

শ্যামল হেসে জবাব দিল, কোন অসুবিধা নেই ম্যাডাম। কিছুক্ষন দাঁড়ালেই মোটর ভ্যান বা টোটো পাওয়া যায়।

সামনের বাঁশ বাগানটা পেড়োতেই ফের পোল্ট্রি ফার্মের দুর্গন্ধটা রীতার নাকের ভেতরটা ঝাঁঝিয়ে দিল।

কই গো রত্না কই গেলে? ম্যাডামকে নিয়ে এসে পড়েছি।

বাবার কন্ঠস্বর শুনে মানা ছুটে বাইরে চলে এলো নতুন অতিথিকে দেখবার জন্যে। কিন্তু পর মূহুর্তেই অতিথির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ঈষৎ লজ্জা পেলো সে। রীতা সৌজন্যমূলক হাসলো তাকে দেখে। কিন্তু মানা দরজার কাছটায় খানিক সিঁটিয়ে গিয়ে মুখের ভেতর আঙ্গুল দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আরে আসেন। রত্না সহাস্যে দাওয়ায় এসে রীতাকে নমস্কার করলো। রীতাও কিঞ্চিত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে প্রতিনমস্কার করলো তাকে।

বাইরে কেন? দিদিমনিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।

হ্যাঁ! হ্যাঁ! আসুন ম্যাডাম। ভিতরে আসুন।

রীতাকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল শ্যামল। ব্যস্ত হয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে তাকে বসতে দিল। সলজ্জিত ভাবে বলল, আমাদের ঘরটা একদমই ছোট। একটু মানিয়ে নেবেন।

রীতা বসতে বসতে বলল, আরে বাবা ঠিকাছে এতটা ফরমাল হওয়ার কিছু হয়নি। আমাকে নিজের ভাবো না বুঝি?

ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন! অত্যন্ত লজ্জা পেলো শ্যামল।

মানা দরজার আড়াল থেকে বারবার রীতাকে উঁকি মেরে দেখছিল। রীতার নজরে পড়তেই সে বলল, আসো এদিকে আসো।

ঝপ করে মানা মুখ লুকিয়ে নিল।

তোমার মেয়ে আমায় দেখে বোধহয় খুব লজ্জা পেয়েছে।

না না ও কিন্তু একেবারেই লাজুক নয়। আসলে প্রথমবার বাড়িতে এলেন তাই... মানা! এই মানা! এদিকে আয়। পিসি ডাকছে তো!

মানা ধীর পায়ে দরজার আড়াল থেকে মাথা নীচু করে শ্যামলের কাছে এসে দাঁড়াল।

রীতা হেসে বলল, এসো এদিকে।

শ্যামল বলল, যাও পিসির কাছে! ডাকছে না পিসি। এইতো সকালে বলছিলি পিসি আসলে বলতে কলকাতায় ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

মানার মুখ লজ্জায় আরো লাল হয়ে গেল।

রীতা একটা হাত উঁচিয়ে বলল, এসো এসো আমার কাছে এসো। আমার সাথে ভাব না করলে কি করে তোমায় বেড়াতে নিয়ে যাব বলো তো?

মানা মাথা নীচু অবস্থাতেই গুটি গুটি পায়ে রীতা কাছে গেল। রীতা আহ্লাদে গদগদ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দেখো তো আমার মানা সোনার জন্য কি এনেছি! বলে সে তার সাইড ব্যাগ থেকে বড় চকলেটের প্যাকেটটা বের করে তাকে দিল। মানা প্রচন্ড ইতস্তত করছে। শ্যামল সলজ্জ বলল, আরে ম্যাডাম এসবের কি দরকার ছিল!

তুমি থামোতো! এটা আমার আর মানার ব্যাপার।

মানা মিনমিন করে বলল, না আমি নেব না। না নিলে ভাববো যে, আমাদের মধ্যে এখনও ভাব হয়নি।

মানা গভীর অস্বস্তি নিয়ে বাবার দিকে তাকালো। শ্যামল ইশারায় তাকে নিতে বলতেই সে খপ করে প্যাকেট নিয়ে বাইরের দিকে দৌড় দিল।

আরে আরে একটু হলেই তো ধাক্কা লেগে যেত! অসভ্য মেয়ে কোথাকার! বলতে বলতে রত্না চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।

ওকে ওভাবে বকা দিও না। রীতা প্রতিবাদ করল। বলল, ও বাচ্চা মেয়ে! ওত কি বোঝে?

আপনি জানেন না কি শয়তানটাই না তৈরী হয়েছে। সারাটা দিন জ্বালিয়ে খায়।

সে হোক। তাই বলে আমার সামনে ওকে বকো না।

রত্না হেসে বলল, ওর কথা ছাড়ুন। আপনি একটু চা খান।

চায়ের কাপটা রীতার দিকে এগিয়ে দিতে রীতা বলল, আমি চা খাইনা খুব একটা।

আরে খান না একটু। প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। শ্যামল জোর করলো।

রীতা হেসে চায়ের কাপটা নিয়ে বলল, একটু জল দাও না আমায়।

হ্যাঁ দিচ্ছি বলে শ্যামল রান্নাঘরে জল আনতে গেল।

রীতা রত্নাকে বলল, তোমাদের চা?

আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

তাহলে ফালতু আমার একার জন্য করতে গেলে কেন?

কিচ্ছু হবে না। আপনি খান তো আগে।

এই নিন ম্যাডাম বলে শ্যামল জল ভর্তি গ্লাসটা রীতার হাতে দিল।

দুপুর বেলা ভাত খেতে খেতে রীতি বলল, শ্যামল, তুমি বলছিলে তুমি নাকি চাষবাস করো!

হ্যাঁ করি তো। ওই যে রাস্তাটা ধরে আমরা এলাম ওর ধারেই আমাদের জমি।

ওই সর্ষে ক্ষেত যেটা?

হ্যাঁ।

ওরে বাপরে ওতটা জমি তোমাদের নিজের!

রত্না বলল, শুধু কি তাই নাকি! ওই জমির পাশেই আমাদের নিজস্ব আম বাগানও আছে।

ওমা বলো কি! রীতা প্রচন্ড অভিভূত হলো শুনে। বলল, তাহলে তো তোমরা খুব বড়লোক।

শ্যামল মৃদু হেসে বলল, না না ম্যাডাম। আপনি যা ভাবছেন তা নয়। জমিতে ফসল ফলিয়ে ইনকাম করা অতো সহজ নয়। আর তাছাড়া এই জমি আমার বাপ ঠাকুরদা কিনে রেখে গেছে।

দিদিমনি খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করে নিন। তারপর না হয় তুমি দিদিমনি কে আমাদের ক্ষেত আর বাগানটা দেখিয়ে নিয়ে এসো।

হ্যাঁ সেই ভালো! রত্নার প্রস্তাবে সায় দিল রীতা।

অনাবিল দোদুল্যমান সর্ষে ক্ষেতের ধার ধরে তিনজন হেঁটে চলেছে। সবার আগে মানা, তারপর শ্যামল এবং সবশেষে রীতা। বাকি দুজন খুব নির্দিধায় চললেও রীতার কাছে এ পথটা বড়ই কষ্টসাধ্য। তাই শ্যামল মাঝে মধ্যেই তাকে সাবধান করে দিচ্ছে। সে মনে মনে চেয়েছিল শ্যামল একা আসুক। কিন্তু মানা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। মনের মধ্যে একটু রাগ হলেও মুখে কিন্তু একটা বিরাট মিষ্টি হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে গ্রহণ করেছিল।

মানা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বলল, এই দেখো পিসি কি সুন্দর ফুল!

কই দেখি, বলে রীতা দ্রুতপদে এগিয়ে গেল। প্রসঙ্গত বলে রাখি এতক্ষণে রীতার সঙ্গে মানার অনেকটাই ভাব হয়ে গিয়েছে। রীতাকে দ্রুত আসতে দেখে শ্যামল কিছুটা সরে দাঁড়াল। বলল, ম্যাডাম দেখে!

যথেষ্ট পরিসর ছিল। কিন্তু রীতা ইচ্ছে করেই শ্যামলের একটা হাত করে ধরে মানার কাছে এগিয়ে গেল। শ্যামল কিঞ্চিত দ্বিধাগ্রস্ত হল। মানা ততক্ষণে ফুলটা ছিঁড়ে রীতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। রীতা ফুলটা হাতে নিয়ে দেখল নীল রঙের ছোট্ট একটা ফুল। সে জিজ্ঞেস করল, কি ফুল এটা?

জানিনা। ঘাড় নেড়ে জবাব দিল মানা। আমরাতো জঙ্গলী ফুল বলি।

বাহ্ খুব সুন্দর। আমি এটা রাখি?

লম্বা করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল সে।

পেছন থেকে শ্যামল তাচ্ছিল্য করে বলল, ধুর ম্যাডাম! ওটা এমন কিছুই মহামূল্যবান ফুল নয়। এই গ্রামে আপনি হরদম দেখতে পাবেন।

তা হোক। আমি তাও রাখি।

রীতা ফুলটাকে তার সাইড ব্যাগের একটা প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে রাখল।

(৮)

অনেকক্ষণ ধরে রিং হয়ে ফোনটা কেটে গেলো চন্দ্রিমার। একবার নয় পরপর তিনবার। চন্দ্রিমা গুনগুন করতে করতে বাথরুমে স্নান করছে। সাওয়ারের শব্দ হচ্ছে ভীষণ। কাজেই বাইরের কোন শব্দই কানে যাচ্ছে না তার। স্নান পর্ব সেরে পোষাক পড়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে যখন সে মোবাইলটা হাতে নিল দেখল তিনখানা মিসড কল। শমীকের নাম্বার। সে তৎক্ষণাৎই ঘুরিয়ে ফোন করলো শমীককে। কয়েকবার রিং হতেই শমীক হ্যালো বলল। চন্দ্রিমা প্রশ্ন করল, হ্যালো ফোন করেছিলে?

ওপাশ থেকে শমীক ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ বৌদি... মানে... একটু দরকারেই করেছিলাম। ব্যস্ত আছ নাকি?

আরে না না। বাথরুমে ছিলাম তাই শুনতে পাইনি। বলো।

বলছি রীতা কি বাড়িতে? আসলে সকাল থেকে ফোন করছি ও রিসিভ করছে না।

শমীকের প্রশ্নে চন্দ্রিমা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কি বলবে সে! রীতা যে আজ শ্যামলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে তা সে তাকে আগেই জানিয়েছে। কিন্তু শমীককে কি বলে সে ম্যানেজ করবে তা সে ভেবে উঠতে পারছে না।

হ্যালো! বৌদি! শুনতে পারছো?

হ্যাঁ পাচ্ছি। বলো।

জান রীতা কোথায়? আসলে ও তোমায় সব বলে যায়। তাই...

ও বাড়িতে নেই। বেড়িয়েছে একটু।

বেড়িয়েছে! কোথায় গেছে?

ইয়ে... তাতো জানি না। তবে তুমি চিন্তা করো না।

না আসলে আমাদের বেড়োনোর কথা ছিল আজ। কিন্তু ও তো...

বড্ড খারাপ লাগছিল চন্দ্রিমার। সে সবটা যেনেও বলতে পারছিল না কিছুই। সেই অস্বস্তি বোধ থেকেই সে বলল, আচ্ছা আমি রাখি বুঝলে। রান্না করতে হবে। তুমি খামখা চিন্তা করো না। ও হয়তো কোনো কাজে বেড়িয়েছে তাই ফোন রিসিভ করতে পারছে না। ডোন্ট ওয়ারি।

বলে ফোন কেটে দিল চন্দ্রিমা।

এই এতো আম গাছ তোমাদের? অভিভূত হয়ে প্রশ্ন করল রীতা।

হ্যাঁ ম্যাডাম।

তাহলে তো প্রচুর আম হয়!

হ্যাঁ হয়। তবে সব বছর যে ফলন ভালো তা নয়। কোন কোন বছর শীলা বৃষ্টির জন্যে আমের বোল নষ্ট হয়ে যায়।

এতো আম দিয়ে কি করো? সব তোমরা খাও?

না না কিছু খাই। পাড়া পড়শীদের দিই। বাকি সব বিক্রি করে দিই।

এবার কিন্তু আমাকেও আম দিতে হবে বলে রাখলাম।

তা আর বলতে! এক গাল হাসল শ্যামল।

মানা আম বাগানে আসবার পর থেকেই সমান তালে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কখনও আবার গাছে উঠে পড়ে ডালে দোল খাচ্ছে। রীতা ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। দেখলো শমীকের অনেক গুলো মিসড কল। সে জানতো যে, শমীক তাকে ফোন করবে। তাই সে মোবাইলটাকে সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছিল। এমনকি আজ তাদের বেড়ানোরও কথা ছিলো। সেই সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে সে হেসে মানাকে ডাক‌‌ দিল। মানা এদিকে এসো। আমরা সবাই মিলে ছবি তুলব।

দাঁড়াও আসছি। মানা প্রবল উৎসাহে ছুটে এলো তাদের কাছে। রীতা বলল, এসো এসো সবাই একসাথে এসো। শ্যামল সলজ্জ বলল, না না ম্যাডাম আপনারাই ছবি তুলুন।

আমি বলেছি সবাই। আর সবাই বলতে তোমাকেও বোঝায়। তাই বেশি বাহানা না করে চলে এসো।

শ্যামল‌ হেসে একটুখানি এগিয়ে এলো। মানাকে সামনে রেখে রীতা শ্যামলের কনুই ধরে তাকে কাছে টানল। তারপর সে তার আরেকটি হাতকে আস্তে করে শ্যামলের নিতম্বের একটু উপরে রাখতেই উত্তেজনায় তার শরীর মৃদু কেঁপে উঠলো। অনুভব করল শ্যামলও একটু দ্বিধা বোধ করছে। তবুও রীতা তার নিজের অবস্থানেই অটল রইল। এরপর তার মোবাইলের সামনের ক্যামেরা চালু করে হাত উঁচিয়ে একটা সেল্ফি তুলে নিল।

সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতেই শ্যামল একটু সরে দাঁড়াল। রীতারও অনুতাপ হতে লাগলো, বোধহয় সে একটু বেশীই করে ফেলেছে। মানা ব্যস্ত হয়ে বলল, কই দেখি কেমন ফোটো এসেছে! বলেই রীতার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল সে। শ্যামল ধমক দিয়ে বলল, মানা! ফোনটা পড়ে যাবে তো!

আরে থাক না। কিচ্ছু হবে না। তুমি গেম খেলবে?

মানা আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, তোমার ফোনে গেম আছে!

হুম দারুন মজার একটা গেম। দাঁড়াও চালিয়ে দিই। বলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে আবার মোবাইলটা মানার হাতে দিল। বলল, যাও তুমি একটা জায়গায় বসে বসে খেলো। আর হ্যাঁ কোন ফোন আসলে ধরবে না।

মানা ঠিকাছে বলে একটা আম গাছের তলায় গিয়ে গেম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।

আপনি অকারনেই ওকে আস্কারা দিচ্ছেন!

ওফ শ্যামল! তুমিও না বেশী বেশী করছো! ওকে তো আমি দিয়েছি।

ও কিছু বোঝে না ফোনের। বাই চান্স খারাপ করে ফেলে যদি?

সে আমি বুঝবো।

তারপর খপাত করে শ্যামলের একটা হাত ধরে বলল, তুমি কি আমায় নিজের ভাবতে পারছো না?

না... মানে... আমি সেটা বলতে চাইনি... ইয়ে...

অস্বস্তিতে ফেটে পরলো শ্যামল। বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করছে তার। রীতার কোমল ত্বকের স্পর্শ যেন কাঁটার মতন বিঁধছে তার কব্জিতে।

উপায়ন্তর সে আলগা হেসে বলল, চলুন না ম্যাডাম। বাকি জায়গাটা ঘুরে দেখাই।

বলেই সে বিদ্যুৎ গতিতে তার কব্জিটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো। রীতাও তার পিছু পিছু চলতে লাগল। আশপাশটা খুব নিস্তব্ধ। ফলে তাদের পায়ের তলার খড়খড় শব্দ সারা বাগান জুরে আলোড়ন তুলছে।

রীতা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, এদিকে কোন বাড়ি নেই আর?

না ম্যাডাম। বাড়ি কেবল ওই রাস্তার ধার দিয়েই পাবেন।

রাত্রিবেলা যদি কেউ খুন করে দিয়ে চলে যায় তাহলে কেউ কিচ্ছু টের পাবেনা!

হুম ঠিক বলেছেন। মৃদু হাসলো শ্যামল।

বিকেল হয়ে গিয়েছে। তবুও এই আম বাগানে যেন সন্ধ্যা। রীতা দ্রুত পায়ে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, শ্যামল একটু আমার পাশাপাশি হাঁটো না। গাঁটা খুব ছমছম করছে।

শ্যামল পিছন ফিরে চেয়ে হো হো করে হেসে বলল, ভয় নেই। আমি আছি তো!

রীতা ঘন কোমল সুরে বলল, জানি তো।

আরও কিছুটা এগোতে একটা ছোট্ট পুকুর দেখতে পেলো রীতা। সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্রশ্ন করল, ওই পুকুরটাও কি তোমাদের?

না ওটা অন্যলোকের। লিজে নেওয়া আছে পুকুরটা।

রীতা দেখল পুকুরটার চারিধার নেট দিয়ে ঘেরা।

চলো না আমরা একটু পুকুরটার ধারে গিয়ে বসি।

হ্যাঁ চলুন।

তারা একটা গাছের তলায় গিয়ে বসে পড়ল। দুজনের মধ্যে সামান্যই ব্যবধান। একটু আনমনে নড়াচড়া করলেই হাঁটুতে হাঁটু ঠেকে যাবে তাদের। কালো কালো ছায়ার মতন মাছের ঝাঁক সারা পুকুরময় খাবি খেয়ে বেড়াচ্ছে।‌ মাঝে মাঝে আবার ঝাঁপও দিচ্ছে ইতি উতি। রীতার মন ভারি হয়ে উঠছে মুগ্ধতায়। ইচ্ছে করছে কাঁধে মাথা রেখে এই নির্মল পরিবেশটাকে গোগ্রাসে উপভোগ করতে। শমীক পাশে থাকলে হয়তো এটাই করতো সে। কিন্তু শ্যামল! তার কাছে তো সে এই অনুভূতিটা চায়না একজন প্রেমিকা হিসাবে। ভালবাসা চায় না সে। চায় কেবল শ্যামলের পুরুষত্ব। শ্যামল বলল, স্যারকে নিয়ে আসতে পারতেন। তাহলে খুব ভালো লাগতো।

আমি একা এসেছি তোমার কি ভাল লাগেনি?

ইয়ে... এই প্রশ্নবানে শ্যামল একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। ভাবল হয়তো সে একটা মারাত্মক রকমের ভুল কথা বলে ফেলেছে।

রীতা উদাসীন চোখে চেয়ে বলল, তাহলে বল আমি চলে যাই! আর কোনদিনও আসব না।

না না আমি সেটা তো বলিনি। আঁতকে ওঠে শ্যামল।

রীতা শ্যামলের কাঁধে একটা হাত রেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসির দমকে সে বারবার শ্যামলের গায়ের উপর হেলে পড়ছে। শ্যামলও অবুঝের মতন চেয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। মাঝে মাঝে একটা বৃথা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করছে সে। রীতা তেমনি হাসতে হাসতে বলল, আমি ইয়ার্কি করছিলাম একটু। তুমি তো দেখছি.... হা হা হা...

আরও কিছুটা হাসবার পর রীতা দম নিল খানিক। তারপর করুন চোখে তাকিয়ে বলল, আমায় কিছুটা সঙ্গ দেবে শ্যামল?

শ্যামল নির্বোধের মতন চেয়ে বলল, ঠিক বুঝলাম না।

রীতা শ্যামলের নগ্ন বাহু পেশীতে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, তোমার হাতের এই সুঠাম খাঁজগুলো আমার খুব ভাল লাগে। কি করে বানালে এগুলো?

ম্যাডামের এইরূপ অপ্রত্যাশিত আচরণে কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার। হৃদস্পন্দনটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কেমন গাঁয়ে কাটা দিচ্ছে। সে ভাল করে রীতার চোখের দিকে তাকালো। নেশাতুর চোখের দৃষ্টি। শ্যামল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ম্যাডাম এ আপনি কি করছেন? আমার ভীষন সুরসুরি লাগছে।

ভালো লাগছে না বুঝি! রত্না যদি এমনটা করতো তখন কি করতে?

কিন্তু ম্যাডাম...

চুপ।

রীতা একটা আঙ্গুল দিয়ে তার ঠোঁট দুটো বন্ধ করে দিল। শ্যামল গভীর সঙ্কোচে বার দুয়েক মাথা নাড়াতে রীতা আরেকটু কাছে চলে গেল তার। হাঁটু গেড়ে বসে শ্যামলের একটি বাহুকে শক্ত করে চেপে বুড়ো আঙুলটা তার ঠোঁটের উপর বোলাতে লাগল। লক্ষ্য করল বিড়ির উত্তাপে ঝলসে যাওয়া কৃষ্ণকায় ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে। তারপর রীতা শ্যামলের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার গায়ের গন্ধ পেতে চাই। বলেই সে ঘারের কাছটাতে জোরে শ্বাস টানল। মুখে তৃপ্তির আওয়াজ। শ্যামল অবরূদ্ধ কন্ঠে বলল, মানা এসে যাবে ম্যাডাম। দয়া করে আমায় ছেড়ে দিন।

রীতা ফিসফিস করে বলল, আসবে না। ও গেম খেলতে ব্যস্ত।

কিন্তু ম্যাডাম...

রীতা পাশবিক ভাবে শ্যামলের ঘাড়ে চুমু খেতে লাগল। শ্যামলও যেন একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতক্ষণ ধরে যে মৃদু প্রতিবাদ সে করছিল তা যেন আপনা থেকেই দমিত হয়ে যাচ্ছে। রীতা আরও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে তার বুকের উপর পাগলের মতন চুমু খেতে লাগল। শ্যামলও আর নিশ্চুপ বসে থাকতে পারল না। উদ্যত হল ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পর মূহুর্তেই মানার কন্ঠস্বরে ধ্যান ভঙ্গ হল তাদের।

পিসি, পিসি! তোমার ফোন এসেছে।

নিমেষের মধ্যে রীতা সোজা হয়ে বসে চুল, পোষাক ঠিক করতে করতে মানার দিকে স্বাভাবিক ভাবেই চাইল। মানা ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে আসতেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোমার ফোন পিসি। আমি ভুল করে ধরে ফেলেছিলাম।

কোথায় দেখি বলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল শমীক লাইনে রয়েছে। রীতা কানে দিয়ে বলল, হ্যালো।

কোথায় তুমি? একটা বাচ্চা মেয়ে তোমার ফোন রিসিভ করেছে! কে সে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল শমীক।

রীতা শান্ত ভাবে বলল, আমি একটু দূরে আছি।

দূরে আছো মানে! কোথায় আছো তুমি? সকাল থেকে তোমায় কতবার ফোন করেছি জানো!

হ্যাঁ দেখেছি।

তা দেখেছ যখন একবার কল ব্যাক তো এট লিস্ট করতে হয়! তারপর বাধ্য হয়ে আমি চন্দ্রিমা বৌদিকে ফোন করে ছিলাম।

চন্দ্রিমা বৌদিকে! কি বলেছে বৌদি?

বৌদি তো বলল তুমি নাকি বেড়িয়েছ।

আর কিছু বলেনি?

না তো। বলল‌তো জানে না তুমি কোথায় গেছো।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রীতা।

ঠিকাছে। এখন রাখো। পরে কল করছি।

পরে করছো মানে? আমাদের তো বেড়ানোর কথা ছিল।

ছিল তবে আজ হবে না। এখনও বাড়িতে ফিরতে পারিনি।

তুমি আছো কোথায় এক্সজ্যাকলি একটু বলবে?

পরে বলবো। এখন রাখলাম। বলে ফোন কেটে দিল রীতা। তারপর হাসি মুখে মানাকে বলল, বলেছিলাম না ফোন আসলে ধরবে না।

মানা মুখ কাচুমাচু করে বলল, ভুল করে ধরে ফেলেছিলাম।

আচ্ছা ঠিকাছে। গেম খেলবে আরও?

না হয়ে গেছে।

রীতা মোবাইলটাকে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেই শ্যামল জিজ্ঞেস করল, স্যার ফোন করেছিলেন নাকি?

রীতা শুকনো মুখে হ্যাঁ বলল।

স্যারকে জানাননি যে এখানে আসবেন?

এবারও একই ভাবে না বলল রীতা।

মানা বলল, বাড়ি যাবে না? চলো। অন্ধকার হয়ে যাবে তো!

হ্যাঁ চল। আসুন ম্যাডাম।

মানা পুনরায় রীতার মোবাইল নিয়ে খাটের উপর গেম খেলতে বসে গিয়েছে। রীতা চুপচাপ চেয়ারে বসে প্লাস্টিকের উঠে যাওয়া চলটাগুলোতে নখ ঘষছে। শ্যামল তার থেকে কিছু দূরে ভূতগ্রস্থের মতন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একবার আড় চোখে রীতার দিকে তাকালো সে। সালোয়ার কামিজের উপর দিয়েই ঠিকরে বের হচ্ছে তার যৌবন। সেই যৌবন যা বিনম্রতার চাদরে আজ বিকেল অবধিও ধাকাছিল। কিন্তু তারপর সবটাই কেমন গুলিয়ে গেল তার কাছে। বাগানের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটল সেই সবকিছুই কি সত্যি! ম্যাডামের মতন একজন সুন্দরী নারী এমনটা করতে পারে কখনও তার সঙ্গে? পুরোটাই স্বপ্নের মতন লাগছে শ্যামলের। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতভম্ব।

রত্না রান্নাঘর থেকে চা আর দু পিস সিঙারা এনে রীতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন দিদিমণি। একটু চা খেয়ে নিন।

রীতা চোখ বিস্ফারিত করে বলল, সিঙারা একদম খাবো না। আমি তেলে ভাজা থেকে সবসময় দশ হাত দূরে থাকি।

আরে একটা দিন খেলে কিচ্ছু হবে না। খান দেখি।

না গো। দুটো তো কোনমতেই খাবো না। একটা নিচ্ছি। আরেকটা তুমি মানাকে দাও বরং।

ওর জন্য রাখা আছে রান্নাঘরে। এই মানা পিসির ফোনটা আর কতক্ষন ঘাটবি! রাখ এবার! রান্নাঘরে সিঙারা রাখা আছে। খেয়ে নে গে।

মানা নাক বেঁকিয়ে বলল, উহঃ‌! দেখছো না আমি গেম খেলছি। আমাকে এখানে এনে দাও।

বিরাট ব্যস্ত উনি!

রত্না ফের রান্নাঘরে চলে গেল।

রীতা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, তোমার চা?

শ্যামল কোন জবাব দিল না। নিজের খেয়ালেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। রত্না এসে ডাকাডাকি করাতে তার সম্বিত ফিরল। রত্না বিরক্ত হয়ে বলল, কি এতো ভাবনা চিন্তা করছো শুনি! কখন থেকে চা নাও, চা নাও করে‌ যাচ্ছি।

হু! না কিছু না। কই দাও।

রত্না শ্যামলের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে তারপর মেয়ের সামনে তিনটে সিঙারা রেখে সে নিজে চৌকির উপর বসলো।

রীতা নম্র ভাবে জিজ্ঞেস করল, তোমার চা কোথায়? তুমি খাবে না নাকি?

আপনাদের আসার আগেই আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। তা বলেন, কেমন লাগল ঘুরতে?

রীতা চায়ের কাপটাকে প্রায় শূন্য করে মেঝেতে রেখে বলল, খুব সুন্দর। আমি শহরের মেয়ে এসব তো আর সচরাচর চোখে পড়ে না। তাই গ্রামে ঘুরতে এলে আমার বেশ আনন্দই হয়।

তাহলে যখনই মন চাইবে তখনই চলে আসবেন। কোন অসুবিধা নেই।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! আসতেই হবে। না হলে আমার পুচকু পিসিটাকে তো ভীষণ মিস করব। বলে মৃদু গাল টিপল মানার। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে আজকের মতন আসি। খুব মজা করলাম আজ।

রত্নাও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ওই যো বললাম ইচ্ছে হলেই চলে আসবেন।

ঠিকাছে। আসি তাহলে! তোমরাও সুযোগ করে কলকাতায় আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। ফোন নাম্বার তো আছেই কোন অসুবিধা হবে না যেতে।

মানা খিলখিল করে হেসে বলল, কলকাতায় গেলে কিন্তু আমাকে ঘোরাতে নিয়ে যেতে হবে।

নিশ্চয়ই যাবো। আমার মানা সোনাকে না নিয়ে গেলে হয়! বলে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেল রীতা। তারপর শ্যামলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, এখান থেকে মেন রোডে কি করে যাব? নৌকায়?

শ্যামল বলল, না ম্যাডাম। এই অন্ধকারে নৌকা চালানোটা ঠিক নয়। রাস্তা হয়েই যেতে হবে।

আজ আর নৌকা চড়া হল না। আশাহতের মতন রীতা মুষড়ে গেল।

রত্না সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না দিদিমণি। এর পরেরবার এলে নৌকা চড়বেন খন।

রীতা শিশু সুলভ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা আমি যাব কি করে? রাস্তা তো চিনতেও পারব না।

দাঁড়ান। মানার বাবা আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে।

আরও একবার মানা আর রত্নার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে রীতা শ্যামলের সঙ্গে রওনা দিল।

(৯)

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল। দিনগুলো আবার মাসেও পরিণত হল। শ্যামল আর রীতার সম্পর্কের ঘনত্ব আরও যেন প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। নিয়মিত ফোনে কথা হয় তাদের। এমনকি রীতা মাঝে মধ্যেই গোপনে দেখা করতে আসে শ্যামলের সঙ্গে। বাওরের নির্জনে একান্তে সময় কাটায় তারা। ছোঁয়াছুঁয়িও হয় অল্প বিস্তর।

শ্যামলের ভাল লাগে এই সমস্ত কিছু। রত্নার অজ্ঞাতসারে ম্যাডামের সঙ্গে তার এই গভীর প্রনয় যেন তাকে পরম তৃপ্তি দেয়। সে বিভোর হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। সংসারেও কোন মন নেই তার। কাজ কর্ম সব শিকেয় তুলে দিয়ে সব সময় ম্যাডামের ফোনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ছোট্ট মোবাইলটাকে এক পলকের জন্যও কাঁধ ছাড়া করে না। এমনকি প্রাতঃক্রিয়ার সময়ও না। শ্যামল তার এই অস্বাভাবিক আচরণের উপর খেয়াল না রাখলেও রত্না কিন্তু তা বেশ লক্ষ্য করেছে। একদিন রাতে তিনজনে খেতে বসেছে। রত্না মানা আর শ্যামলকে ভাত বেড়ে দিতে দিতে লক্ষ্য করল শ্যামল রোজকার মতন আজও পাশে তার মোবাইলটা নিয়ে বসেছে। ক্ষণে ক্ষণে মোবাইলটা বাঁ হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে। রত্না জিজ্ঞেস করল, রাতে শাক খাবে? একটুখানি রয়েছে।

শ্যামল আনমনে জবাব দিল। না। রাতে কেউ শাক খায় নাকি! জানো না!

তোমার কি হয়েছে একটু বলবে!

শ্যামল অদ্ভুত ভাবে তাকাল। কি হয়েছে বলতে?

ইদানিং দেখছি খুব মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত থাকো। চাষবাসটাও মন দিয়ে করছো না! এরকম করলে সংসার চলবে?

আহ্ বাজে কথা বলো না তো! সংসার কি চলছে না? নাকি না খেয়ে রয়েছ? এই যে ভাত খাচ্ছো! কার টাকায়?

এখন কি তুমি খাওয়ার খোটাও দেবে!

মানা বাবা মায়ের কথোপকথনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।

খোটা দিচ্ছি না। তুমি কথাটা তুললে তাই বললাম।

যা দেখছি তাই বললাম।

কি দেখেছো তুমি? বলো!

সারাটা দিন এই মোবাইলটা নিয়ে পড়ে থাকো। এমনকি... এমনকি পিকনিকের সিজনেও তুমি মন দিয়ে নৌকাটাও চালালে না।

বেশ করেছি... বেশ করেছি! ওটা আমার নৌকা। তোর বাপের পয়সায় কেনা না মাগী! যে তোর কথা মতন চালাতে হবে!

কি বললে তুমি? তোমার এত অধঃপতন যে, মেয়ের সামনে আমায় গালমন্দ করছো!

এই চুপ! একদম আমায় শেখাতে আসবি না। শ্যামল রীতিমতন আঙুল তুলে চোখ রাঙালো রত্নাকে।

রত্না ভীষণ হতবাক। ঝগড়া অশান্তি এ নতুন কিছু নয়। তবে আজকে শ্যামলের এইরকম দুর্ব্যবহার সে আগে কখনও দেখেনি।

রত্না গলা নীচু করে বলল, দোহাই চুপ করো। মেয়ে পাশে বসে শুনছে সব। তাছাড়া আশপাশের লোক শুনলে কি বলবে!

বাল ছেঁড়া যায় তাতে আমার! আমি কাউর বাপের পয়সায় খাইনা যে, সবাইকে ভয় পেয়ে চলতে হবে।

এরপর সে মানাকে ধমক দিয়ে বলল, ওই! মা বাবার কথা বসে বসে কি শুনছিস? খাঁ চুপচাপ!

মানা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। শ্যামল যেন আরও বিরক্ত হলো। ধ্যার বাড়া! বলে ফোনটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেল বাইরে। রত্না ক্রন্দনরত মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শ্যামলকে উদ্দেশ করে বলল, আরে মুখের ভাত ফেলে চলে যাচ্ছো কই? শোনো।

উম... ওহ্... আহ্... আর পারছি না বৌদি!

সব কিছুর শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যখন রীতা তার নাইট গাউনটা পড়ছে, তখন চন্দ্রিমা বলল, শমীক ফোন করেছিলো আমায়।

ওহ্। কি বললো? নিরুত্তাপ প্রশ্ন করল রীতা।

তোমার বিরুদ্ধে তো নালিশ করল রীতিমতো।

হু... সব ন্যাকামি।

চন্দ্রিমা উঠে বসে বলল, কথা বলো না কেন ওর সাথে?

প্লীজ বৌদি! এবার তুমি ওর হয়ে ওকালতি করছি না!

ওকালতি করছি না। আমি জাস্ট কারণটা জানতে চাইছি।

শমীক আজকাল ভীষণ ইমম্যাচুয়ারের মতন কথা বলে। কারণে অকারণে ঝগড়া করে খালি। আমার বিরক্ত লাগে তাই কথা বলিনা।

চন্দ্রিমা রীতার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললো, শোনো। তোমাদের মধ্যে এই যে সমস্যা, তার জন্য দায়ী কে?

রীতা তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি কি আমায় দায়ী করছো?

দেখো তুমি যদি বেরির বাঁওর আর ওই শ্যামলকে সিরিয়াসলি না নিতে...

বৌদি! তোমাকে আমি আগেও বলেছি আর এখনও বলছি আমি শ্যামলকে ভালবাসি না। ওকে নিয়ে জাস্ট আমার ফ্যান্টাসি আছে। দ্যাট্স ইট। আর সেটা যদি মিটে যায় তাহলে হয়তো আর ওর সঙ্গে কোন সম্পর্কই রাখব না।

ফ্যান্টাসিটা মনের মধ্যেই রাখো না। কেন খামখা সেটাকে টেনে হিঁচড়ে এনে নিজের ভালবাসার জীবনটাকে বিপর্যস্ত করে তুলছো! ফ্যান্টাসি কখনও পূরণ হয়না।

রীতা চন্দ্রিমার গালে হাত রেখে বলল, এই ফ্যান্টাসিটা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর সেটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না।

তাহলে তুমি কিছুতেই বুঝবে না! তাই তো?

রীতা একটা চওড়া হাসি দিয়ে চন্দ্রিমার ঠোঁটে একটা চুমু খেল। বলল, শমীককে নিয়ে অতো ভেবো না বৌদি। আমি ওকে ভীষন ভালবাসি।

গ্রামের একটা ভাটিখানায় বসে আকন্ঠ মদ গিলছে শ্যামল আর মোবাইলটাকে নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করছে। আগুন জ্বলছে মাথায়। বউটাও অকারণ ঝগড়া করল। উপরন্তু ম্যাডামও তাকে সন্ধ্যে থেকে একবারও ফোন করেনি। সব মিলিয়ে মেজাজ একেবারে সপ্তমে। একবার হাত থেকে মোবাইলটা ধপ করে টেবিলের উপর পড়ে গেল। শ্যামল বিরক্ত হয়ে বলল, ধোর শালা! বাল ফোনটাও থাকছে না হাতে।

বাংলা মদের বোতলটা কে মুঠো করে ধরে মুখের মধ্যে পুরতেই কে যেন পাশ থেকে আড়ষ্ট গলায় বলে উঠলো, আরে! এটা কে! শ্যামল নাকি!

শ্যামল আধবোজা কৌতুহলী দৃষ্টিতে সেদিকে চাইতে দেখল তারই সমবয়সী গ্রামের আরেক মাঝি তার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। আরেকটা চেয়ার টেনে তারই পাশে কোন ক্রমে টাল খেতে খেতে বসে জড়ানো গলায় বলল, আমি কি... নেশার ঘোরে ভুলভাল দেখছি! নাকি সত্যিই এটা শ্যামল! হুম... হা হা হা হা...

কোনরকম কোনো জবাব না দিয়ে শ্যামল একটু ব্যাঁকা করে হাসল। তারপর আবার তার বোতল থেকে আরেকটু মদ গিলে নিল।

সেই লোকটা আবার বলল, তা শ্যামল বাবাজীবন! এদিকে হঠাৎ কি মনে করে? পথ ভুল করেছিস নাকি? হুম...

খিলখিল করে হাসলো লোকটা।

শ্যামল প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, মেলা বকিস না তো। যা অন্য কোথাও গিয়ে মদ গেল। মেজাজ আমার ঠিক নেই।

বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?

না ওসব কিছু হয়নি। আমায় একটু একা ছাড়।

লোকটা শ্যামলের পিঠে মৃদু চাপড়ে দিয়ে বলল, আরে লজ্জা কিসের! আমরা দুজনেই ওই একই গোয়ালের গরু। আমার বউ তো আমায় দিন রাত সন্দেহ করে। তাই খানকি মাগীর সঙ্গে ঝগড়া করে এখানে রোজ চলে আসি... হা হা হা হা। আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা! তোর বউও কি তোকে...

না। তীব্র প্রতিবাদ করল শ্যামল।

লোকটা কটাক্ষ করে বলল, কিন্তু তোকে তো করা উচিৎ!

শ্যামল জিজ্ঞেস করল, কেন?

ওই সুন্দরী মহিলাটা কে রে?

কোন মহিলা?

এখন ন্যাকাচোদা সাজছো! বলে শ্যামলের থুতনিটা ধরে মৃদু ঝাঁকিয়ে দেয় সে।

শ্যামল সবেগে তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে, যা বলতে চাস একটু স্পষ্ট করে বল।

লোকটা এক ঢোক মদ খেয়ে বলল, তুমি সবই বুঝচ্ছো চাঁদু। খালি আমার সামনে ন্যাকামি করছো। কি তাই তো।

বিশ্রী রকম হাসল লোকটা।

দেখ বাড়া আমার ভেজা খাস না। তুইও যেমন লোকজনদের ঘোরাস তেমন আমিও ঘোরাই।

তাই বলে ওই একজন মেয়ে ছেলেকে নিয়ে আদারে বাদারে ফষ্টি নষ্টি করে বেরাও সবইতো দেখি ভাই। সত্যিটা বললেই পারিস যে, নতুন নাং জুটিয়েছিস।

মুখ সামলে কথা বল বোকাচোদা! সজোরে গেঞ্জির কলার চেপে ধরল শ্যামল।

লোকটাও দাঁত খিঁচিয়ে বলল, খানকির ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম চোদাচ্ছো তাতে দোষ নেই! আর আমি বললেই দোষ!

আমি যা খুশী তাই করবো। বোনচোদ তুই বলার কে? বলেই সজোড়ে ধাক্কা মারল তাকে। লোকটা হুমরি খেয়ে চেয়ার সুদ্ধ মাটিতে পড়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় ভাটিখানায় উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। শ্যামল আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। মোবাইলটা পকেটে পুরে হনহন করে বেড়িয়ে গেল।

রাত বারোটা। রাস্তাঘাট পুরো নিস্তব্ধ। সাদা আলোয় মোরা লাইট পোষ্টগুলো বিনিদ্র সেপাইর মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথাও আর কেউ নেই। শ্যামল একাই টাল খেতে খেতে বিনিদ্র সেপাইদের ভরসায় পীচ রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। একটা বিড়ি জ্বালাল সে। তারপর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ভাবল ম্যাডামকে ফোন করবে কি না! যদি ম্যাডাম ঘুমিয়ে পড়ে! এমন সময় কোথার থেকে চার পাঁচটা নেড়ী কুকুর তাকে দেখে দূর থেকে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিল। বড্ড রাগ হলো তার। পায়ের সামনে পড়ে থাকা একটা আদলা ইট তুলে ছুটে গেল কুকুরগুলোর দিকে। মাদারচোদ! আমায় দেখে চিৎকার করা! বলেই ছুড়ে মারল ইটটা। কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড়ে পাশের জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। শ্যামল আপন মনে বলল, বানচোদ! চোর দেখে চেঁচাবে না। আমায় দেখে চেঁচাচ্ছে! শালা!

এরপর মোবাইলটাকে ফের হাতে নিয়ে দোনামোনার মধ্যেই ম্যাডামকে ফোন লাগালো।

রীতা রাতের খাওয়া সেরে সদ্য এসি চালিয়ে বিছানায় শুয়ে শমীকের সঙ্গে চ্যাট করছিল। আচমকাই তার মোবাইলটা কেঁপে উঠে। স্ক্রীনে শ্যামলের নাম ভাসছে। এতো রাতে শ্যামলের ফোন! বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই ফোন রিসিভ করল সে।

হ্যালো!

শ্যামল তার আড়ষ্ট কন্ঠকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, হ্যালো। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?

না ঘুমাইনি এখনও। তবে এত রাতে ফোন করেছ! সব ঠিক আছে তো?

সরি সরি আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। হ্যাঁ সব একদম ঠিক। আসলে আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল ম্যাডাম। আপনি বিকেলের পর থেকে একবারও ফোন করলেন না।

শ্যামল! তুমি কি মদ খেয়েছ?

কই না তো।

মিথ্যে বলবে না একদম। তুমি ভালো করেই জান যে, আমি তোমার সবকিছু বুঝতে পারি।

শ্যামল ফিক করে হাসল। হ্যাঁ ম্যাডাম এ...ই একটুখানি খেয়েছি।

কারণটা জানতে পারি?

আর বলবেন না। খেতে বসে রত্না এমন ঝামেলা শুরু করল! বাধ্য হয়ে রাগ করে বেড়িয়ে গেলাম।

অকারণ ঝামেলা কেন করবে?

আমি সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকি, শালীর তাতে গায়ে জ্বালা ধরে যায়।

রীতার মুখ শুকিয়ে গেলো। বলল, সন্দেহ করছে নাকি?

ছাড়ুন তো ওর কথা‌। দিয়েছি আচ্ছা মতন খিস্তি। শালীকে যে মারিনি ওর চৌদ্দ গুষ্টির ভাগ্য ভালো।

না শ্যামল এটা ঠিক নয়। রত্নার মনে যাতে কোনরকমের কোন সন্দেহ উদ্রেক না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে তোমার আমার সম্পর্কটা...

আপনি চাপ নেবেন না ম্যাডাম‌। আমি সব সামলে নেব।

কি ভাবে? খিস্তি দিয়ে নাকি গায়ে হাত তুলে?

বেশী বকলে দেব হাত।

না। তুমি ওর সাথে কোনরকম কোনো অশান্তি করবে না। তাহলে ওর সন্দেহ আরও বেড়ে যাবে।

তাহলে?

আমি তোমার বাড়িতে যাব একটু।

কবে ম্যাডাম? চওড়া করে হাসল শ্যামল।

আজকালের মধ্যেই। রত্নার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে হবে ওর আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ আছে কি না। তাই তুমি দয়া করে নিজের বৌয়ের উপর পুরুষত্ব ফলাতে যেও না।

ওকে ম্যাডাম। যা আপনার ইচ্ছা। আপনার জন্য আম তুলে রেখেছি কিন্তু।

ঠিকাছে সেসব পরে হবে। এখন কোথায় আছো?

এই বাড়ির সামনে।

যাও এবার চুপ করে শুয়ে পড়ো। ঠিকাছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ঠিকাছে। গুড নাইট।

গুড নাইট।

(১০)

বেশ কিছুদিন হল শ্যামল আর রত্নার মধ্যে কথা একেবারেই বন্ধ। কেবল খাওয়ার সময়ে ডাকতে যাওয়া ছাড়া। কিন্তু শ্যামলের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আসে যায় খায় দায় টাকা দেয় এইটুকুই তার দায়বদ্ধতা। কোনদিন ভুলবশতও রত্নাকে জিজ্ঞেসও করেনি তার কি হয়েছে। সে এখন খালি ম্যাডামের আসার প্রহর গুনছে।

একদিন রত্না কলপাড়ে বসে বাসন মাজছে পাড়ার এক জনৈক মহিলা এসে বলল, কিগো মানার মা খবর কি?

রত্না ম্লান হেসে বলল, ভালোই।

বলছি তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিল।

রত্না নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞেস করল, কি কথা গো দিদি?

মহিলা ব্যাঙের মতন কুঁজো হয়ে বসল। রত্না বলল, যাও না দাওয়া থেকে পিড়িটা এনে বস।

আরে পিড়ি লাগবে না। মহিলা চাঁপা গলায় বলল, এসব কি শুনছি গো শ্যামলের নামে!

রত্না কড়াই মাজতে মাজতে বলল, কি?

শোননি কিছু? বেশ অবাক হল মহিলা।

কি শুনব? রত্না জিজ্ঞেস করল।

শ্যামল নাকি কেশবের মদের ঠেকে গিয়ে লগার সঙ্গে মারামারি করেছে।

রত্না বিস্মিত হয়ে বলল, কই না তো।

বল কি! এদিকে তো সারা পাড়া রটে গেছে। এদিকে লকাও তো কিসব বলে বেড়াচ্ছে।

কি বলছে?

দেখো মানার মা আমি কিন্তু কিছুই সঠিক করে জানিনা। যা কানাঘুষো শুনলাম তাই বলছি।

আরে কি বলছে বলবে তো!

মহিলা গলার স্বর আরও নীচু করে বলল, বলছে তো মানার বাবা নাকি কোন এক মহিলার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে। শহরের মেয়ে নাকি। খুব সুন্দরী। লকা নাকি অনেকবার ওদের দুজনকে একসাথে জড়াজড়ি করতে দেখেছে। কি অলক্ষুণে কান্ড বলতো!

তুমি ঠিক শুনেছ?

আমি তো আগে ভাগেই বলেছি আমি কিছু জানিনা। যা শুনলাম তাই বললাম। বলছি স্বামীকে একটু মুঠোর মধ্যে রাখার চেষ্টা কর গো। তা না হলে কি কেচ্ছাটাই না হবে বলো দেকিনি! এক মেয়ের বাপ কিনা...

বলতে বলতে মহিলা কিঞ্চিত থেমে গেলেন। কয়েক মূহুর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, ইয়ে... আমি আসি বুঝলে মানার মা। মেলা কাজ জমে আছে।

রত্না পাথর হয়ে বসে রইল। তার কয়দিনের সঞ্চিত সন্দেহ আজ যেন রূপ পাচ্ছে। ঘেন্না করছে এখন শ্যামলের কথা ভাবতে। কত ভালবেসেছে সে মানুষটাকে, কত বিশ্বাসই না করেছে সে‌! আর সেই মানুষটা কিনা এই প্রতিদান দিল তার ভালবাসার, তার বিশ্বাসের। শহরের মেয়ে। শব্দটা মনে আসতেই আচম্ভিতেই তার ম্যাডামের কথা মনে পড়ে গেল। কত আপ্যায়ণ করল তাকে সেদিন। আর সেই মেয়েটার জন্যই আজ তার স্বামী দূরে যেতে বসেছে। ছিঃ! তীব্র ঘৃণা এবং রাগে তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে উঠলো। জলে টইটুম্বুর দুই চোখ। ভেতরের জমাট বেদনা যেকোনো মুহূর্তেই বাক যন্ত্র ফেটে জেহাদ ঘোষণা করবে। আবেগের উপর আর কোন বশ নেই তার। সমস্ত কাজ কর্ম ফেলে সে সটান ঘরে ঢুকে গেল। মানা চৌকির এক কোনায় বসে খাতার উপর পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি আঁকছে। পিছন ফিরে বসে আছে। তাই তার মায়ের আগমন টের পাইনি। রত্না আস্তে করে মেঝেতে বসে দুহাতের মাঝে মুখ বুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মানা চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছ কেন?

বিকেলের প্রিন্সেস ঘাটটা বেশ সরগরমই থাকে। বহু মানুষের জমায়েত। কত রকমের গলার আওয়াজ, কত রকমের অভিব্যক্তি, কত রকমের কার্যকলাপ সব। তবে রীতা আর চন্দ্রিমা সেইসবের থেকে অনেক উর্দ্ধে। চেহারায় না আছে কোন অভিব্যক্তি, না আছে তাদের কোন ক্রিয়াকলাপ। কেবল তারা ভাসছে। অলস সময় কিছুতেই আর পার হচ্ছে না। নৌকার অক্লান্ত মাঝি দাঁড় টেনে এগিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছে গঙ্গার বুক ছুয়ে। পরন্ত রোদে সূর্যটা এখনও ঝাঁঝা করছে। স্বস্তি কেবল গঙ্গার মাতাল হাওয়া। অনতভিপ্রেত এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল। মুদিয়ে দিচ্ছে দুই চোখ। রীতা অনেকক্ষণ আগেই নিশ্চিন্তে শরীর নুইয়ে দিয়েছে চন্দ্রিমার বুকে। নৌকা মধ্যম তালেই বিদ্যাসাগর সেতুর নীচ দিয়ে পার হচ্ছে। রীতা গভীর স্থৈর্যের সঙ্গে বলল, রত্না বোধহয় শ্যামলকে সন্দেহ করছে।

রত্না? প্রশ্ন করল চন্দ্রিমা।

শ্যামলের বউ। খুব সুন্দরী দেখতে জানো!

আচ্ছা তাই! যার বউ এত সুন্দরী হয়, অন্তত একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের প্রসংশা করছে, তাহলে সে কেন পরস্ত্রীর প্রতি এতো আকৃষ্ট হবে? কটাক্ষ করল চন্দ্রিমা।

ধ্যাত! রীতা চন্দ্রিমার থাইয়ে একটা মৃদু চড় মারল। বলল, প্রশংসা মোটেও নয়। সত্যি বললাম।

যাইহোক তুমি কি বলছিলে বলো।

শ্যামলকে সন্দেহ করছে রত্না।

তুমি কি করে জানলে?

শ্যামলই বলছিল ফোন করে।

সর্বনাশ! তোমার কথা জেনে ফেলেছে নাকি?

বোধহয় না। সেরকম তো কিছু বলল না। তবে কি এই নিয়ে নাকি খুব অশান্তি হয়ে দুজনের মধ্যে।

খুব সাবধান রীতা। শ্যামলের বউ যদি জানতে পারে তার বর তোমার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে...

ওফ বৌদি! রীতা সোজা হয়ে বসল। চন্দ্রিমার দিকে ফিরে বলল, আমি শ্যামলের সাথে প্রেম করছি না।

চন্দ্রিমা রীতার হাঁটুর উপর একটা হাত রেখে বলল, সে তোমার মতামত। শ্যামলের মতামতটা নিয়েছ কি?

রীতা ঘাড় নাড়াল।

তবে?

শ্যামল যা ভাবে ভাবুক। কাউর ভাবনার উপর তো আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে খারাপ লাগছে ওদের মনোমালিন্যের কথাটা শুনে।

সেটা তো হওয়ারই ছিল।

অ্যাম ফিলিং গিল্টি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রীতা। বলল, আমি ভাবছি ওদের বাড়িতে গিয়ে আমি রত্নার সঙ্গে কথা বলব। বোঝাব ওকে। যাতে আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।

চন্দ্রিমা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, শ্যামলের মোহতে কি মাথাটা গেছে! রত্না যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে তুমিই সেই মেয়ে, তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছ? চূড়ান্ত অপমান করতে ছাড়বে না কিন্তু।

রীতা চন্দ্রিমার দু কাঁধ ধরে বলল, তাহলে কি করব বল?

কোন কিছু বেগতিক হওয়ার আগেই শ্যামলকে তোমার জীবন থেকে চিরতরে বাদ দিয়ে দাও।

আর আমার ফ্যান্টাসি? হা করে চেয়ে রইল রীতা।

ওফ! ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে!

এত কাছ থেকে ফ্যান্টাসিটা পুরণ করতে না পারলে যে, আজীবন আফসোস থেকে যাবে।

চন্দ্রিমা খানিক ভেবে নিয়ে বলল, তুমি একটা কাজ করো রীতা। শ্যামলকে কলকাতায় ডেকে নাও। তারপর মনের যাবতীয় বাসনা মিটিয়ে নিয়ে জাস্ট লিভ হিম ফরএভার।

রীতা চোখ বড় বড় করে বলল, বাড়িতে ডাকব নাকি!

চারিদিকে চেয়ে দেখো এই শহরে বাসনা মেটানোর অনেক জায়গা রয়েছে।

রীতার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুখে বিজ্ঞের হাসি।

(১১)

গ্রীষ্মের বেলা। সূর্য মধ্য গগন হতে রৌদ্রস্নাত করছে চারিদিক। হাড় ভাঙা খাটুনির পর শ্যামল একটু জিরিয়ে নেওয়ার তাগিদেই ক্ষেতের আলে বসে ধূম সেবন করছে। সারা শরীর ঘেমে জবজবে হয়ে উঠেছে। হাঁটু অবধি লিপ্ত কাঁদা। স্থির করেছে আরেকটু কাজ এগিয়ে রেখে বাড়ি যাবে স্নান খাওয়া সারতে। আচমকা শ্যামলের মোবাইলটা বেজে উঠল। লুঙ্গির কোচর থেকে যন্ত্রটা বের করতেই দেখল ম্যাডামের ফোন। উৎফুল্লতার সাথেই শ্যামল মোবাইলটা কানে ধরে বলল, হ্যাঁ ম্যাডাম বলুন।

তুমি ব্যস্ত নাকি?

আপনার জন্য কখনই ব্যস্ত নই। বলুন।

ইয়ে... মানে... বলছি একটু কলকাতায় আসতে পারবে?

শ্যামল এক গাল হেসে বলল, হ্যাঁ কেন পারব না! কবে আসতে হবে বলুন?

আজ।

আজ! বেশ অবাক হল শ্যামল। বলল, এত জরুরি তলব করছেন! সব ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ সব ঠিক আছে। তুমি কি পারবে?

ইয়ে... এত চটজলদি... শ্যামল ভাবতে বসে গেল।

রীতা একটু অভিমানী সুরে বলল, একটা হ্যাঁ বলতে এতো ভাবতে হচ্ছে! এইটুকু তুমি আমার জন্য করতে পারবে না! আমি কতবার তোমার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে ছুটে এসেছি আর আজ তোমায় আমি ডাকছি তুমি আসতে পারছ না! খুব ভাল।

না না ম্যাডাম আমি যাব না সেটা তো বলিনি। শ্যামল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

বলনি। তবে হ্যাঁ আমি আসছি সেটাও তো একবারও বলনি।

শ্যামল তার হাতের আধ খাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোথায় আসতে হবে বলুন?

রীতা একটু বিজয়ীর মতন হাসল। বলল, তুমি বিধাননগরে এসো‌। ট্রেনে উঠেই আমাকে একটা ফোন করো। বাকিটা বলে দেব।

ঠিকাছে ম্যাডাম।

তাড়াতাড়ি এসো। বলে ফোনটা কেঁটে দিল রীতা। তারপর বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চন্দ্রিমা রীতার পেটের উপর একটা হাত রেখে বলল, গুড লাক!

রীতা চন্দ্রিমার হাতটা চেপে ধরে বলল, আমার খুব নার্ভাস লাগছে জানো।

নার্ভাসনেস কে গুলি মার আর আগে কি কি করবে ভাব। কিন্তু মাথায় রেখ এটাই প্রথম আর এটাই...

শেষ।

এইতো মেয়ে কত্ত বুঝে গেছে!

দুজনেই একসাথে হাসল।

রত্না দাওয়াতে মন মরা হয়ে বসে রয়েছে। এঁটো বাসন কোসন, রান্না বান্না সবই অধরা। এই সংসার যেন এখন তার কাছে গলার ফাঁস। কি কমতি ছিল তার ভালবাসায় যে, তার বর তার সঙ্গে এইভাবে প্রতারণা করল! মানা ভেতরে বসে আনমনে খেলছে। কয়েকবার মা, মা করে ডেকেওছে। কিন্তু না না অজুহাতে তাকে প্রতিহত করেছে সে। শ্যামল হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরল। তারপর জোর কদমে স্নান সেরে পোষাক পড়ে বেড়বার জন্য তৈরী হয়ে নিল। মানা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছো বাবা?

কলকাতায়। মাকে বলে দিস।

রত্না কান পেতে সবটাই শুনলো। তার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎও করে উঠলো। তবুও সে আগ বাড়িয়ে কোন প্রশ্নই করল না। শ্যামলও তাকে কিছু বলল না। এমনকি তার স্ত্রীর অস্ত্বিতটাকেও যেন বেমালুম এড়িয়ে গেল। মানা হয়তো আরও কিছু জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু সু্যোগের অভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি। এক মূহুর্ত দাঁড়ায়নি শ্যামল। যেমন গতিতে এসেছিল, তেমন গতিতেই বেড়িয়ে গেল।

জমজমাট কলকাতা শহরের ব্যস্ততাকে কোনরকমে এড়িয়ে রীতার কথা মতন শ্যামল উল্টোডাঙার ফুটব্রীজের উপর অপেক্ষা করেছে। বেশ অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। ভীষন উতলা হচ্ছে মনে মনে। ম্যাডাম এখনও কেন আসছে না! আবার ফোন লাগালো সে। কয়েকবার রিং হতেই রীতা ব্যস্ত ভাবে বলল, আর পাঁচ মিনিট। এসে পড়েছি।

পাঁচ মিনিটটা কেবলমাত্র মৌখিক প্রতিশ্রুতি। আরও মিনিট কুড়ি পর রীতার আগমন হল‌। শ্যামল কটাক্ষ করে বলল, এই আপনার পাঁচ মিনিট!

রাস্তায় জ্যাম থাকলে বুঝি আমার দোষ? চলো ওপাশটা দিয়ে নামি।

শ্যামল হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

চুপচাপ চলো। সময় আসলে বুঝতে পারবে।

শ্যামল চুপ মেরে গেল।

ব্রীজ থেকে নেমে একটা ক্যাব নিয়ে তারা রওনা দিল।

শ্যামলের মনের ভেতরটা বড্ড উশখুশ করছে। গন্তব্য একদম অজানা। পাশে বসে থাকা রীতাও তার সঙ্গে কোন কথা বলছে না। আপন মনে মোবাইল ঘেঁটে যাচ্ছে। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে শ্যামলের। কতকটা অস্বস্তি মিশ্রিত রোমাঞ্চ। মাঝে একটা ফোন এলো রীতার। সে কেবল হ্যাঁ, একদম, ঠিকাছে বলে ফোনটা কেটে দিলো।

শ্যামল থেকে থেকে গাড়ির জানালার এপাশ ওপাশ দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। সারি সারি গাড়ি আর বাসের ভীড়। তার পাশাপাশি ঝাঁ চকচকে ইমারত। হঠাৎ সে দেখল একটা লম্বা ঘড়ি লাগানো টাওয়ারকে বাঁ দিকে রেখে তাদের গাড়িটা বাঁক নিলো। তারপর আরও কিছুটা গিয়ে আবার বাঁদিকে বাঁক নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে একটা উঁচু বিল্ডিংএর সামনে গিয়ে থামল। রীতা পার্স থেকে কিছু টাকা বের করে চালকের হাতে দিয়ে বলল, চলো আমরা এসে গেছি।

শ্যামল ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে সামনের উঁচু বিল্ডিংটাকে ভাল করে দেখে নিল। বাদামী রঙের সুউচ্চ বাড়ি। কাঁচের অনেকগুলো ছোট ছোট জানালা। বেশ বড় বড় অক্ষরে উপর থেকে নীচ অবধি বিল্ডিংটার নাম লেখা। "টাপুর ইন"।

রীতার পেছন পেছন সে বিল্ডিংএর ভেতর প্রবেশ করলো। ছোট্ট রিসেপশন। একধারে একটা মাঝারি আকারের টেবিল আর অন্য দুই ধারে দুটো সোফা। রীতা ঝটপট চেক ইন করে নিয়ে শ্যামলকে সাথে করে লিফটে উঠে পরলো।

ঘরটা খুব একটা বড় নয়। তবে বেশ ছিমছাম। সাদা চাদরে মোড়া নরম বিছানা। তার একপাশে একটা টেবিল আর তার ঠিক উপরেই একটা ছোট্ট দেয়ালে ঝোলানো টিভি আর অন্য প্রান্তে বাথরুমের দরজা। বিছানার কাছেই পাশাপাশি খোলা যায় এমন একটি কালো কাঁচের জানালা। যার অর্ধেকটা আবার মেরুন পর্দার অবগুণ্ঠনে লুকিয়ে রয়েছে। জানালার ঠিক উপরিভাগে একটি এয়ার কন্ডিশন মেশিন। শ্যামল বেশ ভাল করেই পুরো ঘরটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। বেয়ারাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রীতা দরজা বন্ধ করে দিতেই শ্যামল উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা এখানে কেন এলাম ম্যাডাম?

রীতা তার সাইড ব্যাগটাকে বিছানার উপর ছুড়ে দিয়ে বলল, এমনি। কিছু খাবে এখন?

ইয়ে... হ্যাঁ একটু খিদে খিদে পাচ্ছে বইকি। আসলে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরনোর সুযোগ পাইনি। যা তাড়া মারলেন আপনি! অপ্রতিভ হাসল শ্যামল।

ঠিকাছে দাঁড়াও বলে রীতা টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটা থেকে এক প্লেট চাউমিনের অর্ডার দিল।

শ্যামল জিজ্ঞেস করল, এক প্লেট কেন? আপনি খাবেন না?

না। আমি খেয়ে বেড়িয়েছি।

রীতা তার ব্যাগ থেকে একটা নাইট গাউন বের করে বলল, আমি ফ্রেস হতে যাচ্ছি। যদি কেউ নক করে তাহলে দরজা খুলে চাউমিনটা নিয়ে নিও।

শ্যামল ঘাড় নাড়লো।

(১২)

ঝমঝম করে জলের আওয়াজ ভেসে আসছে বাথরুম থেকে। শ্যামল একবার বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর একবার কাত হয়ে পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। বিকেলের শেষ বেলার আলোয় ওপাশের উঁচু বিল্ডিংএর ছাদ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এরপর সে অতি শীষ্টতার সঙ্গে তার স্যান্ডেল জোড়া মেঝেতে খুলে রেখে বিছানার উপর গিয়ে বসে পড়ল। অনবরত পা দোলাচ্ছে সে। খুব স্নায়বিক চাপ অনুভব হচ্ছে। কেন, কি! হাজার হাজার প্রশ্ন তার মস্তিষ্কের অন্দরে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। মাঝে একবার দরজায় টোকা পড়ল। শ্যামল রীতার কথা মতন চাউমিনের প্লেটটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ল। রীতার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

ঠক করে একটা শব্দ হতেই শ্যামল চকিতে বাথরুমের দিকে চাইল। নিশ্চল গতিতে রীতাকে বেরিয়ে আসতে দেখে শ্যামলের মাথা যেন ঘুরিয়ে গেল। স্নিগ্ধ কোমল মুখমন্ডলের উপর ভেজা চুলগুলো পরজীবী উদ্ভিদের মতন অবাধে লেপ্টে রয়েছে। পরনের নীল ফিনফিনে নাইট গাউনের মধ্য দিয়েই তার অতিশয় যৌবনোচ্ছল শরীরটা সাপের মতন হেলে দুলে উঠছে। আবৃত হয়েও যেন অনাবৃত। রীতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, যাও তুমি ফ্রেস হয়ে নাও। চাউমিন দিয়ে গেছে?

শ্যামল উত্তেজিত কন্ঠে বলল, হ্যাঁ… হ্যাঁ দিয়ে গেছে।

তাহলে যাও তাড়াতাড়ি‌। নাহলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো। রীতা চুল আঁছড়াচ্ছে।

শ্যামলের যেন চোখ সরছে না কিছুতেই। মন্ত্র মুগ্ধের মতন চেয়ে আছে রীতার দিকে। যৌবন যেন আকস্মিক বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে তোলপাড় করে দিচ্ছে তার সমগ্র শরীর। রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে চাপা উত্তেজনায়। মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে। চোখ দুটো লালের সমুদ্র। সে ধীরে, খুব ধীরে উঠে দাঁড়ালো। রীতা আড় চোখে আয়নায় শ্যামলকে দেখে থমকে গেল। অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে। বুভুক্ষের ন্যায় তার দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। কয়েক মূহুর্তের স্থিরতা। শ্যামল দ্রুতবেগে পেছন থেকে রীতার স্তন যুগল চেপে ধরে এলোপাতাড়ি ঘাড়ে পিঠে মুখ ঘষতে লাগলো। রীতার হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেল। সে কাতর ভাবে চোখ বন্ধ করে মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল, ছা… ছাড়ো শ্যামল। ওহ… কি করছো তুমি? যাও… যা…ও ফ্রেস হয়ে নাও।

কামের আগুন বিদুৎএর গতিতে সংক্রমিত হচ্ছে তার সর্বাঙ্গে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে সে। বারকয়েক মৃদু জোড় খাটিয়ে সে শ্যামলকে প্রতিহত করবার চেষ্টা করল। কিন্তু শ্যামল যেন বড্ড একরোখা। যত রীতা জোড় খাটাচ্ছে, তত সে লোহার শিকলের মতন আঁকড়ে ধরছে তাকে। শ্যামল রীতাকে এবার তার অভিমুখে ঘুরিয়ে নিল। দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে চুমু খেতে লাগল। রীতা এখনও নিজেকে ছাড়াবার মৃদু সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। দু হাত দিয়ে প্রতিহত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট লাগা অবস্থাতেই রীতা বলল, ছাড়ো আমায় শ্যামল। প্লিজ।

শ্যামল একটা হাত দিয়ে রীতার নিতম্ব চেপে ধরে বলল, না ম্যাডাম আজ না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

রীতা আচমকাই শ্যামলকে সজোরে একটা ধাক্কা দিল। ছিটকে পড়লো সে বিছানার উপর। হতচকিত।

রীতার দেহ উত্তেজনায় কাঁপছে। নিথর দৃষ্টিতে শ্যামলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শ্যামল খানিক ভয় খেয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ম্যাডাম?

রীতা কোন জবাব দিল না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে শ্যামলের শায়িত শরীরের উপর চড়াও হয়ে উন্মাদের মতন চুমু খেতে লাগল। শ্যামলের জামাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল নীচে। উন্মুক্ত শরীরের সে আদরের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। শ্যামলও প্রতিআদরে মেতে উঠেছে। নিশ্ছিদ্র উন্মাদনায় রীতার শীৎকার শ্যামলকে আরও পাগল পাগল করে তুলছে। পোষাক পরিচ্ছদ যেন চক্ষুশূল হয়ে উঠছে তাদের। নির্লজ্জতার শিরচ্ছেদ করে সমস্ত কিছুকে বহিস্কার করে দেওয়া হলো যৌন উন্মাদনায়। বিছানার ক্রোরে বিলীন হয়ে রইল দুটি উন্মুক্ত শরীর নিদারুণ উত্তাপে। শেষ বিন্দু পর্যন্ত।

আপেক্ষিক নিঃশেষিত পুরুষত্ব নিয়ে ক্লান্ত শ্যামল চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে। মুখে আন্ততুষ্টির ছাপ। রীতা শ্যামলের দিকে পিঠ করে বসে। নগ্ন পিঠ যেন আবারও তাকে উস্কানি দিচ্ছে। শ্যামল উন্মুক্ত পিঠের উপর আঙ্গুল চালাতেই রীতা বিরক্ততার সঙ্গে তার হাত সরিয়ে দিল। রুক্ষ্ম স্বরে বলল, হাত সরাও শ্যামল। আর ভাল লাগছে না।

শ্যামল উঠে বসে বলল, কি হয়েছে ম্যাডাম? আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি?

রীতা জবাবে বলল, যা হয়েছে সেটা পুরোটাই ভুল। তাই আর না।

ভুল! কিসের ভুল? কোন ভুলের কথা বলছেন আপনি?

শ্যামল রীতার কাঁধে হাত রাখলো।

রীতা এবার সবেগে তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো, আমাকে প্লীজ ছুইওনা। আমার আর ভাল লাগছে না। তুমি কেন বুঝতে পারছ না!

প্রচন্ড ঝাঁঝিয়ে উঠলো রীতা।

শ্যামল হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল, আপনি এমন কেন করছেন? কি হয়েছে বলবেন তো!

রীতা উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবে বলল, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আর কোনদিন আমার কাছে আসার চেষ্টাও করো না। যদিও চাইলে তুমি আসতেও পারবে না।

শ্যামলের চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। বলল, আপনি এভাবে কেন বলছেন? আমার ভালবাসায় কিছু কমতি আছে?

কোন ভালবাসা নেই। কোনদিন ছিল না।

ছিল না মানে! এই এতদিন ধরে আমাদের মধ্যে যা‌ কিছু চলছে সেটা কি ভালবাসা নয়?

তোমায় ভালবাসা যায় না শ্যামল। আমি স্রেফ তোমার সাথে শুতে চেয়েছিলাম। কারণ তোমার শরীরটা আমায় খুব প্রলুব্ধ করেছিল। আর তাছাড়া আমার জীবনে শমীক আছে। আমি ওকেই ভালবাসি।

বলে রীতা বাথরুমে চলে গেল। বিস্মিত শ্যামল নির্বাক বিছানার উপর কাঠ হয়ে রইল। ম্যাডামের স্বীকারোক্তিতে তার ভাবাবেগের শৈল যেন জল হয়ে চোখ ধুয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ রত্নার সরল মুখটা ভেসে উঠলো। ম্যাডামের জন্য কত অবহেলা করেছে তাকে! এমনকি নিজের মেয়ে মানার কথাও খেয়াল রাখেনি। ভুল করেছে সে। তার আর মুখ নেই রত্নার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। তবুও সে মুখ নীচু করে গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইবে। প্রয়োজনের পায়ে পড়তেও কুন্ঠা করবে না।

বাথরুমের দরজার শব্দে শ্যামলের চটকা ভাঙ্গলো। রীতা আগের সালোয়ার কামিজটা পড়ে বেড়িয়ে এসে বলল, তুমি ফিরে যাও শ্যামল। আমার কথা না ভেবে নিজের পরিবারের প্রতি মনোযোগী হও।

রীতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে দেখে নিয়ে বলল, আমি বেড়িয়ে যাচ্ছি। তুমিও বেড়িয়ে যেও। হোটেল থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোলেই বাস স্টপ পেয়ে যাবে। সেখানেই তুমি…

মাগী তুই আমার সাথে বেইমানি করলি! হুঙ্কার দিয়ে উঠলো শ্যামল।

রীতা কটমট করে চেয়ে বলল, এই মুখ সামলে কথা বলো। আমি কোন বাজারের... আআআআআ!

তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো সে। শ্যামল একলাফে বিছানা থেকে নেমে শীতল চাউমিনের প্লেটটা সরাসরি বসিয়ে দিয়েছে রীতার মাথায়। চকিতে প্লেটটা চুরমার হয়ে গিয়ে চাউমিন সহ বিক্ষিপ্ত ভাবে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। তৎসহ রীতাও। জলশূন্য মাছের মতন কাতরাচ্ছে। গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাথা থেকে। শ্যামল ঘাবড়ে দু পা পিছিয়ে গেল। তারপর মেঝেয় লুন্ঠিত জামা প্যান্টটা কোন ক্রমে পড়ে নিয়ে সন্ত্রস্ত পদে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

(১৩)

চোখের সামনে নিজের বাড়িটা দেখতে পেয়ে ভীষণ স্বস্তি হলো শ্যামলের। তা না হলে তার প্রান তো প্রায় গলার কাছে চলে এসেছিল। যে মূহুর্ত থেকে সে ওই হোটেলে রুমটা ছেড়েছে, তখন থেকেই যার যার সঙ্গে সে মুখোমুখি হয়েছে তারাই তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। হোটেলের বেয়ারা থেকে শুরু করে রিসেপশনিস্ট, এমনকি রাস্তার মানুষজনও। তার বারবার মনে হয়েছে মুখে বোধহয় রক্তের ছিটে লেগে রয়েছে তাই সকলে ওমন করে তাকাচ্ছে। রেল স্টেশনে এসে সে ভাল করে মুখ ধুয়েছে। আয়নায় ভাল করে দেখেওছে। তবুও তার মনের অস্বস্তি যায়নি।

চারিদিক অন্ধকার। কেবল দাওয়ার হলদে বাল্বটা জ্বলছে। রত্নাই হয়তো জ্বালিয়ে রেখে দিয়েছে সে এখনও আসেনি দেখে। সম্ভ্রমে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো তার। পরক্ষণেই রীতার কাতরানো শরীরটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠতেই শ্যামল ব্যস্ত হয়ে দরজায় ধাক্কাতে লাগল‌। রত্না! এই রত্না! তাড়াতাড়ি খোল।

বারকয়েক সন্ত্রস্ত চোখে পিছন দিকে চাইল। রত্না দরজার খিলটা খুলতেই দমকা বাতাসের মতন ঘরে ঢুকে গেল শ্যামল। ভীত কন্ঠে বলল, বন্ধ করে দাও। তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দাও দরজা।

চৌকির উপর বসে অনর্গল কাঁপছে শ্যামল। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না সে। মুখের রং উড়ে গিয়েছে। রত্না ভীষণ অবাক হলো তার স্বামীর এই অবস্থায়। তবুও সে নিরুত্তাপ প্রশ্ন করল, কি হয়েছে?

শ্যামল মাথা নত করে কাঁপা গলায় বলল, এ…এ…একটা ভুল হয়ে গিয়েছে।

তারপর একটা ঢোক গিলে বলল, মারাত্মক ভুল। মা…মা…মারাত্মক। হ্যাঁ হ্যাঁ ভীষণ মারাত্মক।

রত্না আরেকটু এগিয়ে আসল। বলল, ওরম করছ কেন?

আমি…আমি…আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম।

তোমার ম্যাডামের সাথে দেখা করতে?

শ্যামল অপরাধীর মতন মাথা দোলালো।

তা বেশ তো। প্রেমিকার সঙ্গে খুব ফূর্তি করে এসেছ। তোমার তো এখন খোস মেজাজে থাকার কথা।

শ্যামল উঠে রত্নার হাত দুটো ধরে বলল, আ...আ…আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।

ছাড়ো একদম ছোঁবে না।

ঘৃনার সহিত পিছিয়ে গেল রত্না। বলল, বাইরের মেয়ে ছেলের সঙ্গে ফূর্তি করে এসে এখন ন্যাকামি হচ্ছে!

চুপ করো তুমি। আমার কথাটা আগে শোনো। রি রি করে উঠলো শ্যামল।

এমন সময় মানাও একটু নড়েচড়ে উঠলো। রত্না তৎক্ষণাৎ মেয়ের কাছে গিয়ে গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, আস্তে কথা বল। মেয়ে ঘুমাচ্ছে।

দু চোখে তার প্রচন্ড ক্ষোভ।

শ্যামল মুষড়ে গিয়ে মেঝের উপর বসে কাঁদতে লাগলো। আমাকে বাঁচাও রত্না। আমাকে বাঁচাও।

রত্না একবার ভাল করে মেয়েকে দেখে নিয়ে বলল, কি হয়েছে কি? এত ঢং করছ কেন আসার পর থেকে!

শ্যামল চোখ মুছে সভয়ে বলল, আমি ঢং করছি না। একদম করছি না। তবে আমি মস্ত অপরাধ করেছি। ম্যাডাম…ম্যাডাম আর বাঁচবে না। আর বাঁচবে না ম্যাডাম…

শেষ কথাটা আপন মনেই বারকয়েক পুনরায় উচ্চারণ করল শ্যামল।

রত্না বিরক্ত ভাবে বলল, পাগলামি ছেড়ে স্পষ্ট করে কিছু কি বলবে?

খানিক থম মেরে থেকে শ্যামল করুন ভাবে রত্নার পানে তাকিয়ে বলল, আগে বল তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছ!

তোমায় আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না। মরে গেলেও না।

শ্যামল আঁতকে উঠল। দোহাই মরার কথা বলো না। মরার কথা বললেই আমার বড্ড ভয় করছে। ম্যাডাম বোধহয় মরেই গেছে।

রত্না অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল, আরে ম্যাডাম মরবেটা কেন? কে মারবে তাকে?

শ্যামল গলার স্বর নীচু করে বলল, আমি।

অ্যাঁ! তুমি!

হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি…আমি মেরে ফেলেছি ম্যাডামকে। যদিও যখন বের হই তখনও ম্যাডাম নড়াচড়া করছিল।

রত্নার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল।‌ বলল, কি আবোল তাবোল বকছো তখন থেকে! তুমি ম্যাডাম মারতে যাবে কেন খামখা?

শ্যামল দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, কারণ হারামজাদি আমার সাথে গদ্দারি করেছে। শালা এত ভালবাসতাম আর ওই মাগী শুয়ে টুয়ে বলে আমায় নাকি ভালবাসা যায় না।

রত্নার কানে কেউ মনে হলো অ্যাসিড ঢেলে দিল।

দিয়েছি মাগীর মাথায় এক ঘা।

তারপর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, খুব জোরদার লেগেছে জান। খুব তরপাচ্ছিল।

রত্না আগুনের মতন জ্বলে উঠলো। শ্যামলের কলার খামচে ধরে বলল, এ তুমি কি করেছ! একজনকে খুন করে এসেছ।

শ্যামল অপ্রকৃতিস্থ ভঙ্গিতে বলল, আমি খুন করিনি। ভুলবশত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো।

এত বড় একটা অপরাধ করে তুমি এখানে এসেছ কি করতে! তুমি বাঁচতে পারবে না। থানা পুলিশ হবে। তোমায় ঠিক খুঁজে বের করবে। কান্নায় ভেঙে পড়ল রত্না। বলল, এ তুমি কি করলে! মেয়েটার কথা একবারও ভাবলে না। পরস্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রেখেছ এই গ্লানি নিয়ে হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু একজন খুনি! আমি সহ্য করতে পারব না। কিছুতেই পারব না।

রত্না উঠে আলমারি খুলে জামা কাপড় বের করতে লাগল। শ্যামল উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছো?

যেখানে খুশী। তবু তোমার এখানে মেয়েকে নিয়ে থাকব না।

দাঁড়াও রত্না। দাঁড়াও বলছি। শ্যামল ব্যস্ত হয়ে রত্নাকে বাঁধা দিতে গেল।

ছাড়ো আমাকে। আমি থাকব না তোমার সাথে এক মূহুর্তও।

আমি বলছি তুমি যাবে না। কোথাও যাবে না তুমি। গলার স্বর কঠিন হয়ে গেল শ্যামলের।

আমি একটা খুনির সঙ্গে কিছুতেই থাকব না।

আমি খুনি!

হ্যাঁ তুমি খুনি। একজনকে খুন করে এসেছ।

তবে রে শালি! বলেই শ্যামল রত্নার গলা টিপে ধরলো। অপ্রস্তুত রত্না তাকে সরাবার জন্য মরিয়া হয়ে হাত পা ছুড়তে লাগল। কিন্তু শ্যামলের অদম্য শক্তির কাছে সে নিরুপায়। জিভ বেরিয়ে আসছে তার। চোখ দুটো যেন অসহায়ের মতন চিৎকার করছে। আচমকা তাদের ধস্তাধস্তিতে মানার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম আচ্ছন্ন চোখে বাবার পৈশাচিক রূপ দেখে সে সভয়ে চিৎকার করে উঠে। বাবা! শ্যামলের আঙ্গুলগুলো আলগা হয়ে যেতেই ত্রস্ত রত্না তাকে ধাক্কা দিয়ে মানার দিকে ছুটে যায়। ঠিক তখনই শ্যামল চৌকির তলায় পড়ে থাকা শাপলটা হাতে নিয়ে রত্নার দিকে চালিয়ে দেয়। তারপরেই ধরাম ধরাম করে দুবার শব্দ হল। হাতে ধরা শাপল থেকে রক্ত টুপটুপ করে চুঁইয়ে পড়ছে। রত্নার নিস্তেজ শরীরটা মানার নিথর শরীরের উপরেই লুটিয়ে পড়েছে। দুজনেরই মাথায় রক্ত। শ্যামল যেন ভীষন আঁতকে উঠল। শাপলটাকে ছুঁড়ে ফেলে রত্না আর মানাকে ডাকতে লাগলো। কোন সাড়া নেই। কান্না পাচ্ছে। পাগল মনে হচ্ছে নিজেকে। সে মানুষ নয় একজন দৈত্য। সর্বোপরি সে একজন খুনি। প্রতিহিংসার নেশায় উন্মত্ত হয়ে সে ম্যাডামকে মেরে এসেছে আর এখন উন্মাদনার বশে নিজের মেয়ে বউকেও হত্যা করেছে। আর ঘরে থাকতে পারল না সে। দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে ডিঙাটা নিয়ে অন্ধকারেই বাওরের জলে ভেসে গেল।

পরদিন সকালে জেলেরা মাছ ধরতে এসে শ্যামলের মৃতদেহ দেখতে পায়। নিজেরই শখের ডিঙাতে অসাড় দেহটা পড়ে রয়েছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। বাঁ হাতের কাটা শিরা থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ফোঁটা ফোঁটা পড়ে বাওরের জলকে খানিক রঞ্জিত করে তুলেছে।

(সমাপ্ত) 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance