শিপ্রা চক্রবর্তী

Abstract Others

4.0  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Abstract Others

আলোর নিচে অন্ধকার

আলোর নিচে অন্ধকার

3 mins
283



ভোর বেলায় উঠেই সাগর চকলেটের কৌটটা আর চিপসের প‍্যাকেট গুলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। এই কটা মাস যে..... সাগর কিভাবে সংসার চালিয়েছে সেটা কেবল মাত্র সাগরই জানে!! আজকে আবার ছেলেটাকে নিয়ে যেতে হবে কলকাতার হসপিটালে রক্ত পাল্টাতে। প্রত‍্যেক মাসেই একবার করে পাল্টাতে হয়। এই অভাবের সংসারে "গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া" হল, ওর ছেলের থ‍্যালাসেমিয়া রোগটা। যতই অভাবের সংসার হোক বাবা হয়ে ছেলেকে তো আর চোখের সামনে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলতে পারেনা। কিন্তু এই করোনা করোনা করে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় তার ওপর রোগের ভয়ে এখন সেই রকম বাইরের খাবার কেউ একটা খেতেও চাইছেনা। তাই সাগরের বিক্রি নেই বললেই চলে। তবে এই সংসারের জন‍্য সাগর একা খেটে মরে তা.... কিন্তু নয় সাগরের বউ লক্ষীও দু.... এক বাড়ি কাজ করে কিছু টাকা রোজগার করে। সত‍্যি স্বার্থক নাম একেবারে লক্ষীমন্ত বউ, একেবারে গুছিয়ে সংসারটাকে চালায়। তবে করোনার ভয়ে কাজের লোকেদের ও তো বাড়িতে কাজ করতে দিতে চাইছেনা কেউ । তাই কাজও নেই মাইনেও নেই।


তবে ঐ ডাক্তার বাড়ির গিন্নিমা লক্ষীর মাইনে কাটেনি পুরোটাই দিয়েছে মাস গেলে। সকাল থেকে অনেক ঘোরাঘুরি করেও সেইরকম কিছুই বিক্রি হলনা সাগরের। তাই অগত‍্যা বাড়ি ফিরে এসে দুটো সেদ্ধভাত মুখে দিয়ে ছেলে বউকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে বাস ধরে যেতে যেতে দেখল চারিদিক খুব সুন্দর করে রঙ বেরঙের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে, আসলে আগামীকাল বড়দিন কিনা। মায়ের কোলে বসে দুর্বল শিশু আঁধবোজা চোখে দেখতে লাগল সেই সৌন্দর্য আর হয়তো নিজের মনেই তৈরী করতে লাগল এক সুন্দর কল্পনার জগৎ যেখানে অভাব, অনটন, রোগ, কষ্ট কিছুই নেই।


হসপিটালের কাছে নেমেই ছেলের নামে টিকিট কেটে ছেলে আর বৌকে লাইনে বসিয়ে সাগর একটু বাইরে বেড়লো নিজের ঝোলাটা নিয়ে যদি কেউ কিছু কেনে। আনমনে হাটতে হাটতে সাগর খেয়াল করেনি কখন রাস্তায় চলে এসেছে, হঠাৎ করে ওর সামনে একটা বড় গাড়ি এসে জোড়ে ব্রেক কষলো আর একটু হলেই হয়তো অ‍্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একজন ভদ্রলোক বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠল দেখে চলতে পারোনা। এখনিই কিছু হলে যে... আমার দোষ হত।


সাগর করুন মুখ করে বলল বুঝতে পাড়িনি দাদাবাবু আসলে খেয়াল করিনি। গাড়িতে বসে থাকা বাচ্ছাটার দিকে এক প‍্যাকেট লেবু লজেন্স বাড়িয়ে দিয়ে বলল এই নাও মা। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে নিতে গেলে পাশ থেকে মেয়েটার মা চিৎকার করে বলে উঠল কি করছ সোনা মা। এগুলো নোংরা খাবার। এইসব খায়না তোমাকে আমি ক‍্যাডবেরি কিনে দেব। লোকটা সাথে সাথে একটা একশো টাকার নোট বার করে বলল এটা নাও দিয়ে সামনে থেকে যাও যতসব উটকো ঝামেলা।


অন‍্য সময় হলে সাগর হয়তো টাকাটা নিতনা কিন্তু এখন ও বড্ড অসহায় যে করেই হোক ছেলের ওষুধের ব‍্যাবস্থাটা করতে হবে তাই সমস্ত মান অপমান ভুলে টাকাটা নিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জলটা মুছে সরে দাঁড়াল। সাগরের সামনে দিয়ে গাড়িটা একটু একটু করে রাস্তার ব‍্যাঁকে মিলিয়ে গেল আরও অনেক গাড়ির সাথে।


আজ আর বিনামূল্যে রক্ত পায়নি, তাই সাগর নিজেই রক্ত দিয়েছে ছেলেকে। সারিদিন রোদের মধ‍্যে ঘুরে তারপর ছেলেকে রক্ত দিয়ে সাগর ক্লান্ত হয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। সূর্য অনেক আগেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু কোলকাতা শহর আলোর বন‍্যায় সেজে উঠেছে। রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। পুরাতন কে বিদায় জানিয়ে নতুনকে ভালোবেসে গ্রহন করার জন‍্য। চারিদিকে সবাই সান্তাক্লসের টুপি, জামা পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দোকানে দোকানে সবাই কেক, ক্রিসমাস ট্রীর পসরা সাজিয়ে বসেছে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েরা মা বাবার কাছে বায়না করছে। কিন্তু এইসব আনন্দ আহ্লাদ সাগর এবং তার পরিবারের কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওরা যে এইসব স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। আসলে কঠিন বাস্তবের সাথে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, তাই অলীক কল্পনায় নিজেদের গা ভাসাতে পাড়েনা। আচ্ছা সান্তাক্লস এদের জন‍্য একটা সুন্দর, সুস্থ, আনন্দে ভরা সকাল উপহার দিতে পারেনা। কে জানে এরা হয়তো মোজা ঝুলিয়ে রেখে উইশ করেনা!!





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract