আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ত্রিনবতিতম অধ্যায়
নিমতলা শ্মশানঘাটে রক্ষিত এবং রায়চৌধুরী পরিবারের সকলেই উপস্থিত ছিলেন । দাহকার্য্য শেষ হলে বুকুন বলল - এতদূর এসে গেলাম যখন ২৬/২ বাড়ীটা একবার দেখলে হত !
গোপা বাধা দিয়ে বলল - ওই অভিশপ্ত বাড়ীতে যাবার কোন প্রয়োজন নেই ।
রূপা বলল - ঠিকই তো ! ওখানে যেয়ে অতীতের স্মৃতিগুলো জাগিয়ে তোলা ঠিক হবে না ।
সুনেত্রা বলল - আমরা সবাই দেখেছি কিন্তু বুকুনদা তো কখনও দেখেনি; একবার দেখতে চাইছে যখন ...
গোপা ধমক দিয়ে বলে উঠল - তুই থাম । আমি মানা করে দিয়েছি যখন...
আমি বললাম - তা' কেন করবে ? তোমরা যাবে না ; সে তোমাদের ব্যাপার , কিন্তু বুকুন যদি দেখতে চায় সেটা তো অন্যায় নয় ।
গোপা বলল - তোমার মুখেই তো এই 'অভিশপ্ত ' কথাটা বারবার শুনেছি । সেই তুমিই বলছ বুকুন সেখানে যাক!
এ ভাবে আমাদের তর্ক বিতর্ক চলতে থাকায় বড়দা হয়তো বিরক্ত হয়েছিলেন । তিনি বললেন - তোরা থামবি ? রাস্তায় এমন ভাবে কথা বলতে বলতে চলেছিস আশেপাশের লোকজন কি ভাবছে বল তো !
আমি বললাম - বড়দা! বুকুন বলছে...
- সব বুঝলাম । কিন্তু এই রাতে ওখানে যাওয়া যাবে না। দরজায় তো পুলিশ তালা দিয়ে সীল করে দিয়েছে । অতএব পুলিশ ছাড়া সে তালা তো খোলা যাবে না । সকাল হোক , আমি মিঃ ভট্টাচার্য্যকে বলব তালা খুলে দেখিয়ে দিতে । অবশ্য বুকুন যদি মনে করে এখনই দেখবে তবে বাইরে থেকে অবস্থানটুকুই দেখতে পাবে ।
বুকুন বলল - থাক জেঠুমণি । কাল চেষ্টা করব । আজ বরং আমরা চিনার পার্কে শিউলিদের বাড়ী যাই ।
এখানেও গোপা বাধা দিয়ে বলল - এই রাত্তিরে এতগুলো লোক যেয়ে ওদের অসুবিধায় ফেলবি নাকি !
- তাও তো ঠিক । বুকুন বলল।
সুনেত্রা বলল - ওদের কোন অসুবিধা হবে না । বরং ভীষণ খুশী হবে । চল না বুকুনদা - যাই !
বড়দা বললেন - শিউলি আমাকে সন্ধ্যের সময় ফোন করে খবর নিয়েছে । বলেছে কাজ শেষ হলে আমরা যেন সেখানে চলে যাই । এবার বউমা তুমিই বল কি করবে ! যাবে নাকি গাড়ী নিয়ে মল্লিকপুরে ফিরব ?
গোপা বলল - আপনি যা' বলবেন বড়দা - তাই হবে ।
বুকুন বলল - জেঠুমণি ! প্ল্যানটা ভালো । শিউলি যখন বলেছে...
চিনার পার্কে পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে গেল । তারপর ফোন করে ফ্ল্যাট খুঁজতে আরও আধ ঘন্টা লাগল । শিউলি নীচে দাঁড়িয়েছিল। বলল - খুব অসুবিধা হল না স্যার !
আমি বললাম - সারাদিন যা ধকল গেছে এটাতো কিছু নয় ।
আমাদের নিয়ে যখন শিউলি তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠল ওর বিধবা মা রান্না বান্না সেরে সব রেডি করে রেখেছেন । বললেন - আপনারা হাতমুখ ধুয়ে ওই গঙ্গাজল রেখেছি মাথায় ছিটিয়ে খাওয়া দাওয়া করুন । আর গোপা , রূপা, আজ সবাই কিন্তু মাটিতে গড়াগড়ি দেব । খাটে ওঁরা তিনজন শুয়ে পড়বেন ।
সুনেত্রার সে কি আনন্দ ! বলল - আজ সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দেব । শিউলিও হাসতে লাগল । অনেকদিন পর তার মুখে হাসি দেখে মনে হল পিতৃবিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠেছে ।
গরম গরম ফুলকো লুচি, আলুর দম, আর কচি পাঁঠার মাংস সহযোগে ফলারটি বেশ জমল । আমরা তিনজন বিছানায় শুতে চলে গেলাম । বুকুন বলল - আমি ওদের দলে ভীড়ে যাই বাবা । জেঠুমণি আপনি আরামে ঘুমোন। আমার ঘুম আসবে না । ওদের সঙ্গে গল্প করব ।
বাধা দিলাম না । বড়দাও কিছু বললেন না । বুকুন পাশের হল বারান্দায় ওদের কাছে গিয়ে বসতেই গোপা বলে উঠল - তুই কেন ? এখানে সব মেয়েরা আছে । হংসী মধ্যে বক যথা - তুই কেন এলি ?
বুকুন ফিরেই আসছিল । শিউলির মা বললেন - এস এস বাবা । আমরা গালগপ্পো করে রাত কাটাই ।
এদিকে আমি বড়দার পাশে শুয়ে অস্বস্তি বোধ করছি । আমারও ঘুম আসছে না । তবু চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে আছি । বড়দা বললেন - ভাই! ঘুমিয়ে পড়লি নাকি ?
বললাম - নতুন জায়গা তো, ঘুম আসছে না।
- আমারও । তাহলে নে উঠে বস তো , দু'চারটে কথা বলি ।
বড়দার মুখোমুখি বসলাম । বললাম বলুন - কি কথা বলব - ভুত-প্রেত , দত্যি-দানা ?
বড়দা বললেন - ভুতের কথাই বলতে চাই । আচ্ছা তোকে কি কখনও বীরেশ্বর রক্ষিত স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন ?
আজব প্রশ্ন । বীরেশ্বর আমাকে কেন দেখা দিতে যাবেন ?
- আমাকে দিয়েছেন!
আমি ভাবলাম মাঝরাতে এ আবার কি তামাশা ! বললাম - বড়দা ! সারাদিন যে অক্লান্ত শারীরিক এবং মানসিক চাপে ভুগেছেন এবার অন্তত ব্রেণকে একটু রেস্ট দিন ।
- না রে ভাই ! আমি গল্প বলছি না । হকিকত বলছি ।
আমি বললাম - তার মানে ?
- হ্যাঁ রে ভাই ! সত্যিই বীরেশ্বর আমাকে দেখা দিয়েছেন। তাও আবার রাতের বেলায় নয় ; প্রকাশ্য দিবালোকে । সেই মূর্তি, সেই কন্ঠস্বর যেমনটি প্রকাশ পেত তাঁর কথাবার্তা চালচলনে আচার ব্যবহারে ।
আমি অবাক হয়ে শুনছি আর ভাবছি বড়দার মত মানুষের বিভ্রম হয় নাকি ! বড়দা বলতে লাগলেন - আমি হাসপাতালে ঢুকতেই একটা সুবাস পেলাম । এটা হাসপাতালের গন্ধকে ছাপিয়ে আমার নাকে যেন প্রবেশ করল । এক্জাক্টলি সেই পারফিউম যা বীরেশ্বর সবসময় ইউজ করতেন ।
তারপর পুলিশ কমিশনার যখন ডক্টর ভরদ্বাজকে প্রশ্ন করলেন যে তাঁর মত প্রথিতরশা চিকিৎসকের এমন ভুল হয় কি করে ; বললে বিশ্বাস করবি না ডক্টর ভরদ্বাজকে দেখলাম কমিশনারের প্রশ্নে হতচকিত হয়ে কেমন যেন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন । তারপর কমিশনার সাহেব ওঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতেই উনি যেন বীরেশ্বরের মতই তেজোদীপ্ত হয়ে উঠলেন ।
- অকারণে আপনি এরেস্ট করতে পারেন না । আপনি জানেন আমি একজন সম্ভ্রান্ত চিকিৎসক ।
বড়দা বললেন - আমি অবাক হয়ে গেলাম । সেঈ চোখ সেই মুখ সেই গলা । তখনই আমি এগিয়ে এসে কমিশনারকে বললাম - ভুল করছেন স্যার । বিনা প্রমাণে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না ।
শুনলে আরও অবাক হয়ে যাবি - এই যে গলায় আমি এখন তোর সাথে কথা বলছি ; এটা তো তোর চিরপরিচিত। কিন্তু তখন আমার গলা থেকে বীরেশ্বরের কন্ঠস্বর বেরোচ্ছিল আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। তখন তো দুপুর বেলা ।
আমি বেশ আমোদ অনুভব করলাম । বড়দা বলছেন তাই বিরোধিতা করতে পারছি না ।
বড়দা বললেন - হঠাৎ আমি অনুভব করলাম কে যেন আমার পিছু নিয়েছে । বউমাদের যখন বললাম নিখুঁত ভাবে কান্নার অভিনয় করতে হবে - ওরা বলল - পারব না ; আমার কানে কানে কে যেন বলল - আরে মশাই, চোখে গ্লিসারিন দিয়ে দিন ; খেলা জমে উঠবে ।
আমি তখন ডক্টর ভরদ্বাজকে বললাম কিছুটা গ্লিসারিন দিতে । আবার যখন ত্রিলোকেশ্বরের দাহ কার্য্য শেষের দিকে আমার মনে হল কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে - সত্যচরণ ঘোষালের বাড়ীতে জমির দলিল বাক্সবন্দী । উদ্ধার করে গোপা ও রূপার হাতে তুলে দেবেন - এই আমার শেষ অনুরোধ । ভালো থাকবেন। সুখে থাকবেন। চলি ।
( চলবে )