বৃত্তের বাইরে পর্ব বাহাত্তর
বৃত্তের বাইরে পর্ব বাহাত্তর
পর্ব বাহাত্তর
স্থান - কোক ওভেন থানা , কাল - দুপুর গড়িয়ে বিকেল , পাত্র পাত্রী - এস পি মিঃ পাঠক, ওসি - মিঃ মিত্র, আসামী - মহিম ও তার স্ত্রী ভাবনা , কয়েকজন কনস্টেবল ।
জিজ্ঞাসাবাদ চলছে । এস পি সাহেব মহিমকে প্রশ্ন করলেন - কি করা হয় ?
- আজ্ঞে স্যার ব্যানার্জী ভিলায় চাকরি করতাম । আমি ছিলাম দেহরক্ষী কাম ড্রাইভার আর আমার বউ রাঁধুনি গিরি করত ।
- সুখের চাকরি ছিল তো ! ছেড়ে পালিয়ে গেল ?
- স্যার, এখানে রোজ রোজ একটা না একটা কিছু ঝামেলা লেগেই থাকত । আমাকে সবকিছু সামাল দিতে এগিয়ে দেওয়া হত । তাই এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে বউকে নিয়ে দেশের বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম ।
- দেশের বাড়ি? কোথায় ?
- আজ্ঞে স্যার বালাদেশের খুলনা জেলায় ।
- কি ভাবে এ দেশে এসেছিলে ? পাসপোর্ট ভিসা দেখাতে পারবে ?
মহিম মাথা নীচু করে চুপ করে রইল।
ওসি ফুট কেটে বললেন - দেখলেন স্যার । কি ভাবে বাংলাদেশীগুলো এ পারে এসে চুরি ছিনতাই করে পালিয়ে যায় !
এস পি সাহেব ওসিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন - প্লীজ বি সাইলেন্ট । আমি তো কথা বলছি ।
কামদাকিঙ্কর স্ত্রীকে নিয়ে থানায় ঢুকলেন ।
বললেন - ও সাহেব ! ও সব পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না । বিষয় সম্পর্কিত টু দ্য পয়েন্ট প্রশ্ন করুন । আমি আশা রাখি মহিম সদুত্তর দেবে । কিছু না হোক , আমি এটুকু জানি যে মহিম ও তার স্ত্রী ভদ্র পরিবারের সন্তান এবং মিথ্যেবাদী নয় ।
কামদাকিঙ্করকে দেখে মহিম এবং ভাবনা উভয়ে কিঞ্চিত আশ্বস্ত হল ।
এস পি সাহেব বললেন - ঠিক আছে স্যার । আপনি এসে গেছেন , এডভোকেট মানুষ , আমি চাই মহিমের সঙ্গে আপনি কিছু কথা বলে দেখুন নতুন কোন তথ্য পান কি না ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - ওরে মহিম । মনে হচ্ছে তোদের ফাঁসানো হয়েছে । সত্যি করে বল তো কেন পালিয়েছিলি ? শম্ভুর মত আমার সেখানেও তো যেতে পারতিস !
হাত জোড় করে মহিম বলল - কত্তা বাবু গো ! কোন মুখে আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই! স্যার যে কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন ।
- শর্ত ? কি শর্ত ?
- বাবু গো ! স্যারের মেয়ের রে রাতে বে' হল ; স্যার বললেন ' মহিম ভাবনাকে নিয়ে ছাদনাতলায় চলে আয়!'
- সে আমিও জানি । আমরা তো তখন সেখানেই ছিলাম ।
অন্য কিছু বল ।
মহিম বলল - বিশ্বেস করবেন তো বাবু ?
- সে প্রশ্ন পরে ; কি ঘটেছিল তা' আগে বল ।
মহিম বলতে শুরু করল ।
- বউকে নিয়ে দ্বিতীয় বার ছাদনাতলায় বসেছি । স্যার নিজে কন্যা সম্প্রদান করছেন । ম্যাডাম ভাবনাকে ধরে বসেছিলেন। স্যার মুচকি হেসে বললেন ' রাজা করে দেব '
' আর কারও হয়ে দালালি করতে হবে না । তবে একটা শর্ত আছে । বলে চোখ টিপে আমার কানে কানে বললেন ' কামদাকিঙ্করের রক্ত এনে দিতে হবে । পারবি তো ?
এস পি সাহেব বললেন - বিভূতিভুষণের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবি তো ?
কামদাকিঙ্কর বললেন - বিভূতির আমার উপর এমন প্রতিশোধস্পৃহা কেন ! বুঝলেন মিঃ পাঠক ! মনে হয় কুলীন ব্রাহ্মণ আর তন্তুবায়ের মধ্যে ফারাকটা ভুলতে পারেনি।
এস পি সাহেব বললেন - ঠিক বুঝলাম না স্যার ।
- শুনুন তবে । আমার পরিবারও প্রাচীন পন্থী । তবে যুগের হাওয়ায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি । তথাপি পাল্টি ঘর বলে এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধুর অনুরোধে আমি সম্মত হই বিভূতির মেয়েকে ঘরের লক্ষ্মী করে আনতে ।
কিন্তু বিভূতির মনে যে লোভ আছে বরাবর তা জানতাম না ।
এস পি সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তাঁর কথা ।
কামদাকিঙ্কর বলে চলেছেন - বিভূতির স্ত্রী শুভমিতাকে বলেছিলাম - শুধু ওকে কেন - বিভূতিকেও বলেছিলাম ' তোমার শ্বশুর সুরঞ্জন চক্রবর্তীর ছেলে দুটি যেন পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয় । তোমাদের তো অঢেল সম্পত্তি, রোজগার । ছেড়ে দাও না, ওরে করেকম্মে খাচ্ছে তো খাক - তোমাদের কাছে তো হাত পাতে না ।
এক চুমুক জল গলায় ঢেলে কামদাকিঙ্কর আবার শুরু করলেন - ওরা আমার কথা শোনেনি । সুরঞ্জন একবার ছেলেদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পুরো সম্পত্তি মেয়ে শুভমিতার নামে উইল করে দেয় । যদিও পরে আরেক উইলে সমান তিনভাগ করে আবার উইল করে ।
তো শুভমিতা হুমকি দেয় বাইরের জমি তো বটেই, ঘরবাড়ির তার অংশ সে বাইরের কাউকে বিক্রি করে দেবে , কারণ তারা তো তাকে দাবীমত মূল্য চোকাতে পারবে না !
ফলে ছেলেরা মামলা করে আমারই পরামর্শে, জিতেও যায় আর আমি বিভূতির বিরাগভাজন হয়ে যাই । আমি পুরন্দরপুর থেকে আসার পথে প্রথম গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে । পরে ওর গাড়ির ড্রাইভার সামওয়ান বিনোদ ঠাকুর পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ওকেও ট্রানজিট রিমাণ্ডে আনার সময় ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করে ।
কাঁকসা থানায় সে ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে । আমি সেই রাতে ব্যানার্জী ভিলায় সপরিবারে যাই নাতির বিয়ের নেমন্তন্ন করতে । এটাই হয়তো তার রাগের কারণ ।
মহিম বলে ওঠে - স্যার , আবারও আমার বিয়ের নামে তখনই কত্তাবাবুকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - আবার সেই দ্বিমুখী ফলা সাহেব । হয়তো আমার মরণ অথবা খুনের দায়ে মহিমকে জড়িয়ে দেওয়া ।
ওর পালানো ছাড়া কোন পথ ছিল না তো ! বিভূতি থানায় ডায়েরী করবে - সেটা স্বাভাবিক , আর তাতে যে এত রঙ চড়িয়ে ডায়েরী করবে - এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয় ।
এস পি সাহেব বললেন - তাহলে আপনি বলতে চাইছেন মহিম নির্দোষ !
কামদাকিঙ্কর বললেন - আমি বলার কে ? আপনারা বিভূতি ও মিতাকে থানায় এনে জেরা করে দেখুন মহিমের দোষ কোথায় ?
মিঃ মিত্র , কোক ওভেন থানার ওসি, বললেন - স্যার এক মিনিটের জন্য আমি আসছি ।
এস পি সাহেব সম্মতি দিয়েই ফেলেছিলেন, গম্ভীর কন্ঠে কামদাকিঙ্কর বললেন - একদম না । এখন এই অবস্থায় কাউকেও বাইরে যাওয়া যাবে না ।
তারপর মিঃ পাঠককে বললেন - আপনি স্যার নিজে বিভূতিকে সস্ত্রীক থানায় ডেকে পাঠান । মিঃ মিত্র যে বাইরে যেতে চেয়েছেন তা শুধু বিভূতিকে সাবধান করে দিতে ।
এস পি বললেন - আই সি !
মিঃ মিত্র বলে উঠলেন - আপনি বড় বাজে কথা বলছেন মিঃ কামদাকিঙ্কর মুখার্জী । আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে যে আমিই বিভূতিভূষণকে সাবধান করে থাকি ?
কামদাকিঙ্কর হাসলেন । এস পি কে বললেন - কাঁকসা থানার ওসি মিঃ শ্রীধর মাইতিকে ডেকে পাঠান । দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে ।
এস পি সাহেব বললেন - মিঃ মিত্র ! আপনার বিরূদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারীর ব্যবস্থা করছি । আগে বিভূতিভূষণ , তাঁর পত্নী আর কাঁকসার ওসিকে আসতে দিন ।
বলে বিভূতিভূষণকে ফোন করলেন তাঁদের ল্যাণ্ডফোনে এবং নির্দেশ দিলেন পত্রপাঠ যেন তাঁরা কোক ওভেন থানায় হাজিরা দেন । মহিম ও তার স্ত্রীকে ধরে আনা হয়েছে ।
কামদাকিঙ্কর বললেন - মিঃ মাইতিকেও আসতে বলুন স্যার ।
( চলবে )